কোরআনের ঐতিহাসিক অলৌকিকতা

কোরআনে ভবিষ্যৎবাণী

এমন কিছু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার কথা কোরআন আগেই প্রকাশ করে যেগুলো পরে ভবিষ্যতে সত্যি সত্যি ঘটেছিল-এটিও কোরআনের অলৌকিকত্বের একটি দিক। উদাহরণ স্বরূপ সূরা ফাতহ্ এর ২৭ নং আয়াতে আল্লাহ তাআলা মুসলমানদের এই সুসংবাদ দেন যে তখনকার দিনে র্পৌত্তলিকদের দখলকৃত মক্কা অচিরেই মুসলমানেরা জয় করে নেবে :

নিশ্চয়ই আল্লাহ তাঁর রাসূলকে বাস্তবায়িত করে দেখিয়েছেন স্বপ্নটি যথাযথভাবে। অবশ্যই তোমরা আল্লাহর ইচ্ছায় মসজিদে হারামে প্রবেশ করবে নিরাপদে, তখন তোমাদের মধ্যে কেউ কেউ মাথা মুড়াতে থাকবে এবং কেউ কেউ চুল কাটতে থাকবে। তোমাদের কোন প্রকার ভয় থাকবে না । আল্লাহ জানেন যা তোমরা জান না। আর তিনি তোমাদেরকে এ স্বপ্ন বাস্তবায়িত হওয়ার পূর্বে এক আশু বিজয় দিলেন। (কোরআন, ৪৮ : ২৭)

আরো গভীরভাবে বিবেচনা করলে দেখা যায় যে, আয়াতটি কিন্তু মক্কা বিজয়ের পূর্বে আরেকটি বিজয়ের সংবাদ ঘোষণা করে। বাস্তবিকই মুসলমানরা আয়াতটির ঘোষণার মতোই মক্কা বিজয়ের পূর্বে প্রথমে ইহূদিদের দখলকৃত খাইবার দুর্গ দখল করে নেয় এবং তারপর মক্কায় প্রবেশ করে।

যে ঘটনাগুলো ভবিষ্যতে ঘটবে, আগে ভাগেই এদের ঘোষণা করা কোরআনের প্রাজ্ঞতার এক টুকরা উদাহরণ মাত্র। কোরআনের কথা যে অসীম জ্ঞানবান আল্লাহরই বাণী এই সাক্ষ্যও দিচ্ছে এই ব্যাপারটি। বাইজেন্টাইনের পরাজয়ের কথা ভবিষ্যতে ঘটে যাওয়া অন্যান্য ঘটনার মতো একটি যা কোরআনে ঘোষণা করা হয়েছিল যেগুলো সে সময়কার মানুষের পক্ষে কোন ভাবেই জানা সম্ভব ছিল না। এই ঘটনার সবচাইতে কৌতুহলের ব্যাপারটি এই যে রোমানরা পৃথিবীর সবচাইতে নিম্নতম অঞ্চলে পরাজয় বরণ করে ছিল-পরবর্তীতে ব্যাপারটি বিস্তারিত বর্ণনা করা হবে। এটি মজার যে এখানে “সর্বনিম্ন পয়েন্টের” কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। সে আমলের প্রযুক্তি দিয়ে এমন একটি মাপযোখ করে পৃথিবীর নিম্নতম অঞ্চল নির্ধারণ একেবারে স্পষ্টভাবেই অসম্ভব ব্যাপার ছিল। এসবই মানব জাতির উদ্দেশ্যে মহাজ্ঞানী আল্লাহ সোবহানাল্লাহু তাআলার প্রকাশিত বাণী।

বাইজেন্টাইনদের বিজয়

কোরআন নাযিলের আরেকটি আশ্চর্য ঘটনা এই যে সূরা রূমের প্রথম আয়াতে বাইজেন্টাইন সম্পর্কে ভবিষ্যৎ বাণী করা হয়েছে। পরবর্তী রোমান সাম্রাজ্যের পূর্বদিকের একটি অংশই হলো বাইজেন্টাইন। উক্ত আয়াতগুলোতে উল্লেখ করা হয় যে, বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য একটি পরাজয়ের মুখোমুখি হয়েছিল ঠিকই কিন্তু শীঘ্রই জয়ের মুখ দেখবে।

আলিফ লাম মীম

রোমকরা পরাজিত হয়েছে,

এক নিম্নতম স্থানে এবং তারা তাদের এ পরাজয়ের পর অতি সত্বর জয়লাভ করবে, তিন থেকে নয় বছরের মধ্যে। পূর্বের ও পরের ফয়সালা আল্লাহরই। আর সেদিন মুমিনরা আনন্দিত হবে। (কোরআন, ৩০ : ১-৪)

র্পৌত্তলিক পারস্যদের হাতে বাইজেন্টাইন খৃষ্টানদের গুরুতর পরাজয় বরণ করার ৭ বছর পরে, ৬২০ সনে উক্ত আয়াতগুলো নাযিল হয়েছিল। বাইজেন্টাইনরা খুব অল্প সময়ের মাঝেই বিজয় ছিনিয়ে নেবে আয়াতগুলোতে তাই বর্ণিত হয়েছিল। সত্যি বলতে কি, বাইজেন্টাইনরা কেবল মারাত্মক পরাজয়ই বরণ করেনি, এমনকি এটির টিকে থাকাই যেখানে অসম্ভব হয়ে দাড়িয়েছিল সেখানে জিতার কথা বাদই দিতে হয়। কেবল পারস্যরাই নয়, মারাত্মক ভীতির কারণ হিসেবে আরও বিদ্যমান ছিল আভারস, স্লাভ, আর লম্বার্ডরা। আভারস্ কন্সটান্টিনোপোলের দেয়াল পর্যন্ত এসে গিয়েছিল। বাইজেন্টাইন সম্রাট হেরাক্লিয়াস গির্জাসমূহের স্বর্ণ, রৌপ্যগুলো গলিয়ে মুদ্রা বানিয়ে তার বাহিনীদের খরচ মেটানোর আদেশ দিলেন। এগুলোও যখন অপর্যাপ্ত মনে হলো তখন এমনকি ব্রোঞ্জের মূর্তিগুলো গলিয়ে মূদ্রা বানানো হলো। বহু গভর্ণর হেরাক্লিয়াসের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিল আর তার সাম্রাজ্য ছিল পতনের মুখে। আগের বাইজেন্টাইনের অধীনস্ত রাষ্ট্র, যেমন, মেসোপটেমিয়া, সিলিসিয়া, সিরিয়া, পেলেস্টাইন, মিসর, আর্মেনিয়া তখন মূর্তিপূজক পারস্যদের অধীনস্ত হয়ে গিয়েছিল।

স্বল্প কথায় সকলেই মনে করছিল যে বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য ধ্বংস হয়ে যাবে। ঠিক সেই মুহূর্তে সূরা রূমের প্রথম কয়েকটি আয়াত নাযিল হয়, যাতে ঘোষিত হয়েছিল যে, কয়েক বছরের মাথায় বাইজেন্টাইনরা বিজয় ছিনিয়ে নেবে। কিন্তু বিজয় তখন এমনি অসম্ভব ছিল যে, বহু-ঈশ্বরবাদী আরবরা আয়াত কয়টি নিয়ে পরিহাস শুরু করে দিল। তারা ভেবেছিল যে কোরআনের এই বিজয়ের ঘটনা কখনও সত্যি হবে না।

সূরা রূমের প্রথম আয়াতখানা নাযিলের সাত বছর পরে ৬২৭ সনের ডিসেম্বরে বাইজেন্টাইন আর পারস্যদের মাঝে একটি চূড়ান্ত যুদ্ধ শুরু হল নিনেভেহতে। এই সময় আশাতীতভাবে বাইজেন্টাইনরা পারস্যদের পরাজিত করল। কয়েক মাস পরে পারস্যরা বাইজেন্টাইনদের সঙ্গে চুক্তি করতে বাধ্য হল, যারই ফলে তাদেরকে নিজেদের দখল করা অংশগুলো হতে হটতে বাধ্য হয়েছিল।

অবশেষে আল্লাহ তাআলার ঘোষণাকৃত “রোমকদের বিজয়” বাণীটি অলৌকিকভাবে সত্য হয়ে গিয়েছিল।

উক্ত আয়াতটির আরেকটি অলৌকিক বিষয় হলো ভৌগলিক বিষয় সম্বন্ধে একটি ঘোষণা যা তখনকার মানুষের পক্ষে জানতে পারা সম্ভব ছিল না।

সূরা রূমের তৃতীয় আয়াতে আমরা আরো অবগত হই যে, রোমানরা পৃথিবীর সবচেয়ে নিম্ন এলাকায় পরাজিত হয়েছে। “আদনা আল আরব” এই অভিব্যক্তিটি বহু অনুবাদে “পাশ্ববর্তী স্থান” হিসেবে অনূদিত হয়েছে। কিন্তু এটি মূল বক্তব্যের আক্ষরিক অর্থ না হয়ে বরং আলঙ্করিক অর্থ প্রকাশ করেছে। আরবীতে “আদনা” শব্দটি উৎপত্তি হয়েছে “দেনি” শব্দ থেকে যার মানে হলো “নীচু”, আর “আরদ্” শব্দের অর্থ পৃথিবী। তাই “আদ্না আল আরদ্” এর প্রকাশ ভঙ্গীটির অর্থ হলো “পৃথিবীর নিম্নতম এলাকা”।

সবচেয়ে কৌতূহলের বিষয় হলো বাইজেন্টাইন আর পারস্যের যে যুদ্ধে বাইজেন্টাইনদের পরাজয় হয় আর ফলে তারা জেরুজালেমের উপর অধিকার হারিয়ে ফেলে সেই যুদ্ধেরই একটি অতি সংকটপূর্ণ পর্যায় সত্যি ঘটেছিল পৃথিবীর একটি নিম্নতম এলাকায়। বিশেষ এই এলাকাটি হলো মৃত সাগরের বেসিন বা গহ্বরে যা কিনা সিরিয়া, পেলেস্টাইন আর জর্দানের ভূভাগের ছেদন বিন্দুতে বিদ্যমান। সমুদ্র পৃষ্ঠের ৩৯৫ মিটার নিম্নের এই মৃত সাগরটি আসলেই ভূ-পৃষ্ঠের সর্বনিম্নাঞ্চল।

তার মানে হলো যে কোরআনে যেমন উল্লেখ রয়েছে ঠিক তেমনভাবেই বাইজেন্টাইনরা বিশ্বের সর্বনিম্ন এলাকায় হেরে গিয়েছিল।

মজার ব্যাপারটি হলো এই যে, কেবল মাত্র আধুনিককালের পরিমাপক প্রযুক্তি দিয়েই মৃত সাগরের গভীরতা মাপা যেতে পারে। এর আগে পৃথিবীপৃষ্ঠের সর্বনিম্ন এলাকাটি কোথায় বা কোনটি তা জানা সম্ভব ছিল না। কিন্তু কোরআনে উল্লেখ হয়েছে যে এটি পৃথিবীর সর্বনিম্ন এলাকা। এ ব্যাপারটি আবারো সাক্ষ্য দিচ্ছে যে কোরআন একটি স্বর্গীয় ধর্মগ্রন্থ।

কোরআনের ঐতিহাসিক অলৌকিকতা

কোরআনে “হামান” শব্দ

প্রাচীন মিসর সম্পর্কে কোরআনের কিছু তথ্য বহু ঐতিহাসিক বিষয় উন্মোচিত করে যেগুলো কিনা সাম্প্রতিক কাল পর্যন্ত অনুদঘাটিত ছিল। এই বিষয়গুলো আমাদের আরো নির্দেশ করছে যে এ কোরআন এক নিশ্চিৎ মহাবিজ্ঞের পক্ষ থেকে নাযিল হয়েছে।

কোরআনে ফেরাউনের পাশাপাশি হামান নামক একটি চরিত্রের উল্লেখ রয়েছে। ফেরাউনের একজন কাছের মানুষ হিসেবে এ নামটি কোরআন শরীফের ছয়টি ভিন্ন অংশে উল্লেখ করা হয়েছে।

আশ্চর্যের বিষয় যে, তৌরাতের যে অংশে মূসার জীবনী রয়েছে, তাতে এ নামটি কখনো উল্লেখ করা হয়নি। তবে ওল্ড টেষ্টামেন্টের সর্বশেষ অধ্যায়ে ব্যাবিলনের এক রাজার সাহায্যকারী হিসেবে এ নামটি পাওয়া যায়, যে রাজা কিনা মূসার সময়ের ১১০০ বছর পরে ইসরাঈলীদের উপর নিষ্ঠুর অত্যাচার চালিয়েছিল।

কিছু অমুসলিম, যারা দাবী করে যে, রাসুলুল্লাহ (দঃ) তৌরাত এবং বাইবেল থেকে নকল করে কোরআন শরীফ সাজিয়েছেন, তারা জোর গলায় বলে যে, এ প্রক্রিয়ার সময় নবী (দঃ) কিছু কিছু বিষয়ে ত্রুটি সহকারে কোরআনে এনেছেন।

কিন্তু ২০০ বছর আগে যখন মিসরীয় প্রাচীন সংকেত লিপি হাইআরোগ্লিফিক (hieroglyphic) উদঘাটন করে বুঝা গেল আর প্রাচীন লিপিগুলোয় হামান শব্দটির উল্লেখ রয়েছে জানা গেল-তখন এই দাবির অসারতা প্রমাণিত হলো।

এই আবিস্কারের আগে প্রাচীন মিসরীয় লিখা আর অভিলিখন (শিলার গায়ে লিখা) বুঝা যেতো না। হাইআরোগ্লিফিক বা সংকেত লিখনে লিখা প্রাচীন মিসরীয় ভাষা যুগ যুগ টিকে ছিল। তবে, দ্বিতীয় এবং তৃতীয় শতাব্দিতে খৃষ্টান ধর্ম প্রচার আর অন্যান্য সংস্কৃতির প্রসারের ফলে মিসরীয়রা প্রাচীন বিশ্বাস আর হাইআরোগ্লিফিক বা সংকেত লিপি ভুলে যায়। সংকেত লিখনের সর্বশেষ জানা উদাহরণটি ৩৯৪ সনের একটি অভিলিখন ছিল। এরপর এ ভাষাটি স্মৃতি থেকে মুছে গিয়েছিল, আর কেউ তা লিখতে বা বুঝতে পারতো না। ২০০ বছর আগে পর্যন্ত এ অবস্থাটি বিদ্যমান ছিল ...।

১৭৯৯ সনে “Rosetta Stone” নামের একটি ট্যাবলেট বা লিপিফলক আবিষ্কারের ফলে প্রাচীন মিসরীয় সংকেতলিপি বা হাইআরোগ্লিফিক এর রহস্যের সন্ধান পাওয়া গেল; ফলকটি ছিল খ্রীষ্টের জন্মের ১৯৬ বছর আগের। এই অভিলিখন খানির গুরুত্ব এমনি ছিল যে, এটি তিনটি ভিন্ন ভিন্ন উপায়ে লিখা ছিল; উপায়গুলো ছিল হাইআরোগ্লিফিক, ডেমোটিক (প্রাচীন মিসরীয় হাইআরেটিক লিখনের সহজরূপ) আর গ্রীক । গ্রীক লিখনটির সাহায্য নিয়ে প্রাচীন মিসরীয় সংকেত লিখনগুলোর অর্থ বের করা হলো ।

Jean-Francoise Chamollion নামের একজন ফরাসী লোকের সহায়তায় লিপিখানির অনুবাদ সম্পূর্ণ করা হয়েছিল। এভাবে এই ভুলে যাওয়া ভাষা এবং এর সঙ্গে জড়িত কিছু ঘটনার প্রকাশ ঘটল। এমন করে প্রাচীন মিসরের সভ্যতা, ধর্ম আর সমাজ জীবনের বিশাল এক জ্ঞানের খোঁজ পাওয়া গেল।

ঊনবিংশ শতাব্দীতে মিসরের ভাষা হাইআরোগ্লিফিক অনুবাদ করে উদঘাটন করার আগে পর্যন্ত “হামান” নামটি-জানা ছিল না। হাইআরোগ্লিফিক অনুবাদ করে বুঝা গেল যে হামান ফেরাউনের একজন নিকট সহযোগী ছিল এবং সে ছিল পাথর চূর্ণকারীদের প্রধান। এখানে সত্যিকারের গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টটি হলো যে কোরআনে হামান ফেরাউনের আদেশে নির্মাণকার্য পরিচালনা করতো বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এর মানে এটিই দাঁড়ায় যে এই যে তথ্যটি যা সম্পর্কে কারো পক্ষে কিছু জানা সম্ভব ছিল না, তাই কোরআনে উল্লেখ করা হয়েছিল।

হাইআরোগ্লিফিক এর সংকেতগুলোর গূঢ়ার্থ বুঝতোরায় গুরুত্বপূর্ণ জ্ঞানের সন্ধান পাওয়া গেল : বাস্তবিকই “হামান” শব্দটি মিসরীয় সংকেতলিপিতে লিখা ছিল। ভিয়েনার Hof Museum এ নামটির উল্লেখ রয়েছে।

সমগ্র অভিলিখনগুলোর সংগ্রহের উপর নিভর্র করে তৈরী অভিধান People in the New

Kingdom এ হামানকে “পাথর চূর্ণকারীদের নেতা” হিসেবে পরিচয় দেয়া হয়েছে।

শিলালিপিটি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সত্যের উন্মোচন করে দিল। কোরআন বিরোধীদের মিথ্যা দাবীর বিপরীতে দেখা গেল এই সেই ব্যক্তি হামান, যে কিনা মূসার (আঃ) সময়কালে ফেরাউনের একজন অতি কাছের মানুষ হিসেবে মিসরে বসবাস করে আসছিল। কোরআনে যেমন বলা হয়েছে ঠিক তেমনি, হামান নির্মাণ কাজে নিয়োজিত ছিল।

অধিকন্তু কোরআনের একটি আয়াতে একটি ঘটনায় যেমন উল্লেখ আছে যে ফেরাউন হামানকে একটি টাওয়ার নির্মাণের কথা বলছে, সেটি প্রত্নতত্ত্ববিদদের প্রাপ্ত তথ্যাবলীগুলোর সঙ্গে একদম মিলে যায় :

ফেরাউন বলল : হে সভাসদবৃন্দ ! আমি ছাড়া তোমাদের অন্য কোন উপাস্য আছে বলে আমি মনে করি না। হে হামান! তুমি আমার জন্য ইট পোড়াও, তারপর আমার জন্য একটি সুউচ্চ প্রাসাদ নির্মাণ কর, যাতে আমি মূসার মা’বুদের প্রতি উঁকি মেরে দেখতে পারি। তবে আমারতো ধারণা যে, সে অবশ্যই মিথ্যাবাদী। (কোরআন, ২৮ : ৩৮)

পরিশেষে, হামানের অস্তিত্ত্বের বিষয়টি কোরআন বিরোধীদের বানোয়াট জাল দাবিকেই শুধু গুরুত্বহীন বলে প্রমাণ করেনি, বরং আবারো একবার প্রমাণ করে দিল যে, কোরআন এসেছে সর্বশক্তিমান আল্লাহর তরফ থেকে। একরকম অলৌকিকভাবেই কোরআন সেই সমস্ত ঐতিহাসিক ঘটনাসমূহ সম্পর্কে আমাদের জানিয়েছে যা নবীর (দঃ) সময়ে ঘটেনি কিংবা জানা ছিল না।

কোরআনে মিসরের শাসকগণের উপাধি

মিসরের প্রাচীন ইতিহাস ঘেঁটে এ তথ্যই বেরিয়ে আসে যে, সে অঞ্চলে মুসা (আঃ) ই একমাত্র নবী হয়ে আসেননি। মুসার (আঃ) সময়ের বহু আগে ইউসুফ (আঃ) মিসরে বসবাস করে গেছেন।

মুসা (আঃ) এবং ইউসুফ (আঃ) এ দুজনের ঘটনাবলী পড়তে গিয়ে আমরা কিছূ সাদৃশ্যের বা তুলনার মুখোমুখি হই। কোরআনে ইউসুফ (আঃ) এর সময়কার মিসরের শাসকদের সম্বোধন করতে গিয়ে মালিক শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে।

মালিক (বাদশাহ) বলল : ইউসুফকে আমার কাছে নিয়ে এসো, আমি তাকে আমার একান্ত সহচর করে রাখব । তারপর সে যখন তার সাথে কথা বলল তখন সে বলল : নিশ্চয়ই আজ আপনি আমাদের কাছে অতিশয় মর্যাদাবান ও বিশ্বস্ত (কোরআন, ১২ : ৫৪)

কিন্তু মুসার (আঃ) সময়ে শাসকদের ডাকা হতো “ফেরাউন” ।

আর আমি তো মূসাকে নয়টি প্রকাশ্য মু’জিযা দিয়েছিলাম, আপনি বনী ইসরাঈলকে জিজ্ঞেস করুন; যখন সে তাদের কাছে এসেছিল তখন ফেরআউন তাকে বলেছিল : “হে মূসা ! আমি তো মনে করি, অবশ্যই তুমি যাদুগ্রস্থ। (কোরআন, ১৭ : ১০১)

আজ যে সমস্ত ঐতিহাসিক রেকর্ড পাওয়া যাচ্ছে তাতে শাসকগণের ভিন্ন ভিন্ন নামকরণের কারণ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে। পূর্বে প্রাচীন মিসরে রাজপ্রাসাদকে “ফেরাউন” বলা হতো আর এখান থেকেই এসেছে এই শব্দটি। প্রাচীন রাজবংশের শাসকগণ তাদের উপাধি হিসেবে এই নামটি ব্যবহার করেননি। মিসরের ইতিহাসে “নূতন রাজ্য” যুগের পূর্ব পর্যন্ত রাজাদের উপাধি হিসেবে এ নামটি শুরু হয়নি। এই সময়কালটি ১৮তম রাজবংশের সঙ্গে শুরু হয় আর বিংশতম রাজবংশ থেকে রাজাদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতে গিয়ে এই “ফেরাউন” শব্দটি টাইটেল হিসেবে ব্যবহৃত হতে শুরু করে।

এখানে আরেকবার কোরআনের অলৌকিকত্ব প্রমাণের আরেকটি উদাহরণ পাওয়া যায় : ইউসুফ (আঃ) প্রাচীন রাজত্বে বর্তমান ছিলেন যে যুগে রাজাদের “ফেরাউন” নয় বরং “মালিক” বলে সম্বোধন করা হতো। উল্টো যেহেতু মুসা (আঃ) নূতন রাজ্যের যুগে বর্তমান ছিলেন, তাই তখনকার শাসকদের “ফেরাউন” নামে ডাকা হতো।

সন্দেহ নেই যে এমন পৃথক করে বলার জন্য একজনকে মিসরের ইতিহাস জানতে হবে। কিন্তু চতুর্থ শতকের মাঝেই মিসরের ইতিহাস সম্পূর্ণরূপে ভুলে যায় মানুষ; কারণ মানুষ আর মিসরের ভাষা (হাইআরোগ্লিফিক) বুঝতে পারেনি; দীর্ঘদিন পর মিসরের ইতিহাস পুণরায় উনিশ শতকে উদ্ধার করা হয়। সুতরাং কোরআন নাযিল হওয়ার সময় মিসরের ইতিহাস সম্পর্কে কোন পুংখানুপুংখ জ্ঞান অর্জন করা সম্ভব ছিল না। অগণিত সাক্ষ্যপ্রমাণের মাঝে এটিও প্রমাণ করে যে কোরআন আল্লাহর বাণী।

কোরআন আল্লাহরই বাণী

এই অবধি আমরা যা দেখেছি, তাতে একটি সত্যই স্পষ্টভাবে বেরিয়ে আসে : কোরআন সেই গ্রন্থ যাতে বর্ণিত প্রতিটি তথ্যই সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে। বিজ্ঞান বিষয়ক তথ্যাবলী আর ভবিষ্যতে ঘটবে এমন কটি বিষয় সম্পর্কে কোরআনের উল্লেখ-যার মানে, যে সময়ে যা কিছু মানুষের পক্ষে জানা সম্ভব ছিল না-সেসবই কোরআনের আয়াতগুলোয় সেই সময়ে ঘোষিত হয়েছিল। সেই সময়ের জ্ঞান আর টেকনোলজির মাত্রা বা অবস্থা দিয়ে এসব তথ্যসমূহ জানতে পারা ছিল অসম্ভব। এটাই স্পষ্ট সাক্ষ্য দান করছে যে কোরআন কোন মানুষের কথাবলী নয়। যিনি সব কিছু সৃষ্টি করেছেন আর যিনি তাঁর জ্ঞানের মাধ্যমে সব কিছু পরিবেষ্টন করে আছেন সেই মহাশক্তিশালী আল্লাহরই কথামালা এই কোরআন।

কোরআনের একটি আয়াতে আল্লাহ উল্লেখ করেছেন যে, “কোরআন যদি আল্লাহ ভিন্ন অন্য কারো তরফ থেকে আসতো, তবে তাতে তারা অসংখ্য অসামঞ্জস্য খুঁজে পেত।” (কোরআন, ৪ : ৮২) কোরআনে অসামঞ্জস্য তো নয়ই, বরং এ স্বর্গীয় বইটির প্রতিটি তথ্য দিনে দিনে উত্তোরোত্তর অলৌকিকত্ব প্রকাশ করছে।–

এখন মানুষের কর্তব্য আল্লাহর নাযিল করা এই বইখানি দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরে তার অনুসরণ করা আর এটিকেই এক মাত্র গাইড বা পরিচালিকা হিসেবে গ্রহন করে নেয়া। আল্লাহ আমাদের আহ্বান করে বলেছেন :

এটি একটি কিতাব, যা আমি নাযিল করেছি, অতীব বরকতময়। অতএব এর অনুসরণ কর এবং সতর্ক হও, যাতে তোমরা রহমতপ্রাপ্ত হও। (কোরআন, ৬ : ১৫৫)

অন্য একটি আয়াতে আল্লাহ উল্লেখ করছেন :

বলুন : সত্য তোমাদের রবের তরফ থেকে এসেছে; অতএব যার ইচ্ছা হয় ঈমান আনুক এবং যার ইচ্ছা হয় কুফরী করুক। (কোরআন, ১৮ : ২৯)

না কখনও এরূপ করবেন না, এ কোরআন তো উপদেশবাণী। অতএব যার ইচ্ছা হয়, সে তা গ্রহন করুক। (কোরআন, ৮০ : ১১-১২)