সূরা রা’দ; (৯ম পর্ব)

সূরা রা’দ; আয়াত ২৭-২৮

সূরা রা'দের ২৭ নং আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-

وَيَقُولُ الَّذِينَ كَفَرُوا لَوْلَا أُنْزِلَ عَلَيْهِ آَيَةٌ مِنْ رَبِّهِ قُلْ إِنَّ اللَّهَ يُضِلُّ مَنْ يَشَاءُ وَيَهْدِي إِلَيْهِ مَنْ أَنَابَ

“যারা অবিশ্বাস করেছে তারা বলে তার প্রতিপালকের নিকট হতে তার কাছে কোন অলৌকিক নিদর্শন অবতীর্ণ হয়নি কেন? বলুন, আল্লাহ যাকে ইচ্ছা বিভ্রান্ত করেন এবং তিনি তাদেরকেই পথ দেখান যারা তাওবা করে এবং তাঁর অভিমুখী হয়।” (১৩:২৭)

এই আয়াতে হঠকারী এবং একগুঁয়ে কাফেরদের অনাকাঙ্ক্ষিত আবদারের বর্ণনা দেয়া হয়েছে। সত্য প্রত্যাখ্যানকারী কাফেররা বলতো, মুহাম্মাদ (দ.) এর দাবি যদি সত্যি হয় তাহলে তিনি অলৌকিক ক্ষমতা প্রদর্শন করেন না কেন? তাদের মনোভাব এমন ছিল যে, তারা যা বলবে আল্লাহর রাসূল যেন অলৌকিক ক্ষমতাবলে তখনই তা করে দেখান। কিন্তু সর্বশেষ পয়গম্বর প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (দ.) কে শুধু অলৌকিক কাণ্ড প্রদর্শনের জন্য পাঠানো হয়নি। তিনি যে মহাগ্রন্থ মানব জাতিকে উপহার দিয়েছেন তা অত্যন্ত বিজ্ঞানময়। এই মহাগ্রন্থই তাঁর অলৌকিক ক্ষমতার নিদর্শন। তিনি মানুষকে তার জ্ঞান ও বুদ্ধিবৃত্তির ওপর নির্ভর করে সত্যকে গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি যেমন সত্যপন্থীদের জন্য সুসংবাদ বয়ে এনেছেন তেমনি সত্য প্রত্যাখ্যানের পরিণতির ব্যাপারে সতর্ক করেছেন। ফলে অবিশ্বাসী কাফেরদের অযৌক্তিক আবদারের ব্যাপারে এই আয়াতে বলা হয়েছে, হে পয়গম্বর (দ.)! আপনি বলে দিন, আল্লাহ যাকে ইচ্ছা বিভ্রান্ত করেন অর্থাৎ যারা সত্যকে প্রত্যাখ্যান করে তারা সুপথ প্রাপ্তির ক্ষেত্রে আল্লাহর সাহায্য লাভের যোগ্যতা হারিয়ে ফেলে। আবার আল্লাহ যাকে ইচ্ছা তাকে সৎপথ প্রদর্শন করেন, এর অর্থ হচ্ছে যারা সত্যকে গ্রহণ করে, এ ব্যাপারে সৃষ্টিকর্তার সাহায্য কামনা করে আল্লাহ তা'লা তাদেরকে সুপথে আসার তাওফিক দান করেন।

কাজেই যারা কুরআনের মত বিজ্ঞানময় গ্রন্থ প্রত্যক্ষ করার পরও তাতে বিশ্বাস স্থাপন করে না মহান আল্লাহও তাদেরকে তাদের অবস্থার উপর ছেড়ে দেন, ফলে তারা আরো বিভ্রান্তির অন্ধকারে হারিয়ে যায়।

আসলে যারা জ্ঞানী এবং সত্য সন্ধানী তারা নবীদের জ্ঞান-প্রজ্ঞা এবং যে কোন মুজিজা দেখা মাত্রই সত্যকে গ্রহণ করে নেয় কিন্তু যারা হঠকারী এবং যারা একগুঁয়েমি স্বভাবের তারা মুজিজা বা অলৌকিক ক্ষমতা প্রত্যক্ষ করলেও সত্যকে মেনে নিতে চায় না বরং আরো বিভ্রান্তিকর প্রশ্ন করতে থাকে। তারা পাপ এবং গোঁয়ার্তুমির কারণে এক ধরনের মানসিক রোগে আক্রান্ত। ভালো কথা এবং ঐশী বাণী তাদের অন্তরে জ্বালার সৃষ্টি করে।

আবর্জনা স্তুপে বৃষ্টি পড়লে তা থেকে অস্বস্তিকর দুর্গন্ধ ছড়ায় আবার এই বৃষ্টির কল্যাণেই উর্বর জমি ফসলে ভরে যায়। তেমনি ঐশী গ্রন্থ এবং নবী-রাসূলদের শিক্ষা রহমতের বৃষ্টির মত, অনুর্বর মাটিতে তা বর্ষিত হলে তাতে আগাছা ছাড়া অন্য কিছু জন্মায় না কিন্তু তা যদি কোন ফলের বাগানে কিংবা শস্য ক্ষেতে বর্ষিত হয় তাহলে তা ফুলে-ফলে এবং ফসলে সুশোভিত হয়ে পড়ে। কাজেই এখানে যে বলা হয়েছে, আল্লাহ যাকে ইচ্ছা তাকে বিভ্রান্ত করেন, এর অর্থ এই নয় যে. আল্লাহ একদল মানুষকে ইচ্ছা করেই বিভ্রান্তিতে নিপতিত করেন। বরং বিভ্রান্তির কারণ হচ্ছে তারা আল্লাহর বিধানকে গ্রহণ করে না বরং তারা আল্লাহর নির্দেশের বিরোধিতায় অবতীর্ণ হয়। ফলে তাদের মনোভাব এবং কৃতকর্মের কারণেই তারা সৎপথ লাভের ঐশী মদদ থেকে বঞ্চিত হয়ে পড়ে। অপর দিকে যারা নিজেদের ভুলের জন্য অনুশোচিত মনে সত্যকে সন্ধান করে, তারা এ ব্যাপারে ঐশী মদদ লাভের সৌভাগ্য অর্জন করে।

সূরা রা’দের ২৮ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে,

 الَّذِينَ آَمَنُوا وَتَطْمَئِنُّ قُلُوبُهُمْ بِذِكْرِ اللَّهِ أَلَا بِذِكْرِ اللَّهِ تَطْمَئِنُّ الْقُلُوبُ

"যারা বিশ্বাস স্থাপন করে এবং আল্লাহর স্মরণে যাদের চিত্ত প্রশান্ত হয় ( এরা তারাই) জেনে রাখ, আল্লাহর স্মরণেই কেবল চিত্ত প্রশান্ত হয়।" (১৩:২৮)

আগের আয়াতে বলা হয়েছে আল্লাহ তা'লা সত্যসন্ধানীদেরকেই সুপথে পরিচালিত করেন। এই আয়াতে বলা হচ্ছে, তারাই সৎপথ লাভের সৌভাগ্য অর্জন করেন যারা আল্লাহর উপর বিশ্বাস স্থাপন করে এবং দ্বিধাহীন চিত্তে আল্লাহর অস্তিত্বের ওপর ঈমান এনে মানসিক তৃপ্তি বা প্রশান্তিতে উপনিত হয়। কারণ মনে-প্রাণে আল্লাহকে স্মরণ করা হলে চিত্তে স্বর্গীয় প্রশান্তির আবহ তৈরি হয়। ফলে আস্থা ও শান্তিতে মন ভরে ওঠে। এই মানসিক শান্তির সঙ্গে যেমন অন্য কিছুর তুলনা চলে না তেমনি প্রকৃত ঈমান ছাড়া অন্য কোন ভাবে তা অর্জন করাও সম্ভব হয় না।

আল্লাহর স্মরণ বলতে বুঝায়, নামাজ বা এবাদত-বন্দেগী ছাড়াও সর্বাবস্থায় আল্লাহকে স্মরণ করা। বিশেষ করে আপদকালে কিংবা কোন ভুল করে ফেললে তার সাহায্য ও অনুকম্পা কামনা করা। স্বাভাবিক জীবনে আল্লাহর অনুগ্রহের জন্য তাকে কৃতজ্ঞতা জানাতে ভুলে না যাওয়া ইত্যাদি। তবে যে ব্যক্তির অন্তর ঈমানের আলোতে দীপ্ত এবং স্বর্গীয় প্রশান্তিতে ভরপুর সে ব্যক্তির মনে সব সময় আল্লাহর ভয়ও বিদ্যমান থাকে। কারণ ঈমানের দীপ্তিতে সে আল্লাহর বিশালত্ব এবং শক্তিমত্তাকে অনুভব করতে পারে। ফলে আল্লাহর শক্তিমত্তা এবং বিশালত্বের সামনে সব কিছুই তার কাছে তুচ্ছ মনে হয়। এজন্য দেখা যায় ঈমানদাররা মানসিক রোগে আক্রান্ত হয় না। অপর দিকে ঈমান বা আল্লাহর ওপর বিশ্বাস না থাকার করণে ধর্মহীন সমাজে বিষন্নতা ও অন্যান্য মানসিক রোগ বেশি দেখা যায়।