আল হাসানাইন (আ.)

সূরা ইব্রাহীম; (৩য় পর্ব)

1 বিভিন্ন মতামত 03.0 / 5

সূরা ইব্রাহীম; আয়াত ৭-১০

সূরা ইব্রাহীমের ৭ ও ৮ নং আয়াতে বলা হয়েছে-

وَإِذْ تَأَذَّنَ رَبُّكُمْ لَئِنْ شَكَرْتُمْ لَأَزِيدَنَّكُمْ وَلَئِنْ كَفَرْتُمْ إِنَّ عَذَابِي لَشَدِيدٌ (7) وَقَالَ مُوسَى إِنْ تَكْفُرُوا أَنْتُمْ وَمَنْ فِي الْأَرْضِ جَمِيعًا فَإِنَّ اللَّهَ لَغَنِيٌّ حَمِيدٌ

“যখন তোমাদের প্রতিপালক ঘোষণা করলেন যে, যদি কৃতজ্ঞতা স্বীকার কর তাহলে তোমাদেরকে আরো দিব এবং যদি অকৃতজ্ঞ হও তবে নিশ্চয়ই আমার শাস্তি কঠোর।” (১৪:৭)

“মূসা বলেছিল, তোমরা ( বনি ইসরাইল ) এবং পৃথিবীর সকলেই যদি অকৃতজ্ঞ হও-তথাপি আল্লাহ অভাব মুক্ত এবং প্রশংসার অধিকারী।" (১৪:৮)

এর আগের আয়াতে বলা হয়েছে,বনি ইসরাইল ফেরাউনের কবল থেকে উদ্ধার পাওয়ার পর হযরত মূসা (আ.) জাতির প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন তারা যেন এজন্য আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করে। এই আয়াতে বলা হচ্ছে, কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা হলে সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহর অনুগ্রহ বৃদ্ধি পায় আর যারা অকৃতজ্ঞ হয় তাদের প্রতি ঐশী অনুগ্রহের পরিমান হ্রাস পায়। তবে আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের বিভিন্ন পন্থা রয়েছে। দোয়া দরুদ বা আল্লাহকে স্মরণের মাধ্যমে যেমন কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা যায় তেমনি দরিদ্র অসহায় মানুষকে সাহায্য করা বা আল্লাহর রাস্তায় তাঁরই সন্তুষ্টির জন্য দান করার মাধ্যমেও সৃষ্টিকর্তার অসংখ্য অনুগ্রহের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা যায়। মহান আল্লাহ আমাদেরকে সুস্থ দু’টি চোখ দিয়েছেন, কেউ যদি আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন এবং মানবতার সেবা করার উদ্দেশ্যে এই দুই চোখ জ্ঞান অর্জনের জন্য কাজে লাগায় তাহলে এর মাধ্যমেও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ পায়। মোটকথা, কারো মধ্যে যদি এই অনুভূতি থাকে যে আল্লাহ আমাকে সুস্থ রেখেছেন, সম্পদ দান করেছেন, কাজেই আমি আমার শক্তি এবং সামর্থ সৎপথে ব্যয় করবো। তাহলে এটাও আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ বলেই বিবেচিত হবে।

হাদিস শরীফে বলা হয়েছে, আল্লাহ তা'লা হযরত মূসা (আ.) কে নির্দেশ দিলেন তিনি যেন আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন। জবাবে হযরত মূসা (আ) বললেন, হে পরওয়ারদিগার! তোমার প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের সাধ্য আমার নেই। কারণ আমি যে জন্য কৃতজ্ঞা জানাবো তার জন্যও কৃতজ্ঞতা জানানো অপরিহার্য হয়ে পড়বে। আল্লাহ বললেন, তোমার এই স্বীকারোক্তি এবং অনুভুতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের উত্তম পন্থা ।

প্রকৃতিতে আল্লাহ পাকের ধরাবাধা নিয়মই হচ্ছে, কৃতজ্ঞতাকারীর প্রতি কল্যাণ ও ঐশী অনুগ্রহ বৃদ্ধি পাবে আর অকৃতজ্ঞরা তা থেকে বঞ্চিত হবে। আল্লাহ তা'লা মানুষের কৃতজ্ঞতা লাভের জন্য মুখাপেক্ষী নন,মানুষের স্বার্থেই এই কৃতজ্ঞতা। এর ফলে মানুষের নীতি নৈতিকতার উন্নতি হয়,চারিত্রিক উৎকর্ষতা সাধিত হয়। পরিণামে সে আরো বেশি কল্যাণের অধিকারী হতে পারে।

সূরা ইব্রাহীমের ৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

أَلَمْ يَأْتِكُمْ نَبَأُ الَّذِينَ مِنْ قَبْلِكُمْ قَوْمِ نُوحٍ وَعَادٍ وَثَمُودَ وَالَّذِينَ مِنْ بَعْدِهِمْ لَا يَعْلَمُهُمْ إِلَّا اللَّهُ جَاءَتْهُمْ رُسُلُهُمْ بِالْبَيِّنَاتِ فَرَدُّوا أَيْدِيَهُمْ فِي أَفْوَاهِهِمْ وَقَالُوا إِنَّا كَفَرْنَا بِمَا أُرْسِلْتُمْ بِهِ وَإِنَّا لَفِي شَكٍّ مِمَّا تَدْعُونَنَا إِلَيْهِ مُرِيبٍ

“তোমাদের কাছে কি তোমাদের পূর্ববর্তীদের নূহ, আদ ও সামুদের সম্প্রদায়ের বা তাদের পরবর্তীদের খবর পৌছেনি? তাদের সম্পর্কে আল্লাহ ছাড়া আর কেউ অবহিত নয়। তাদের নিকট স্পষ্ট নিদর্শনাবলীসহ পয়গম্বর এসেছেন। অতঃপর তারা নিজেদের হাত নিজেদের মুখে রেখে দিয়েছে এবং বলেছে, যা নিয়ে তোমরা প্রেরিত হয়েছে তা আমরা বিশ্বাস করি না এবং যে পথের দিকে তোমরা আমাদেরকে আহ্বান জনাও সে সম্পর্কে আমাদের মনে সন্দেহ আছে যা আমাদেরকে উৎকণ্ঠায় ফেলে রেখেছে।" (১৪:৯)

এই আয়াতে যুগে যুগে পয়গম্বরদের সাথে মানুষের ঔদ্ধত্য আচরণ এবং তীব্র বিরুদ্ধাচরণের কথা বর্ণনা করা হয়েছে। পয়গম্বরগণ সুস্পষ্ট প্রমাণ এবং অলৌকিক কর্ম প্রদর্শন করলেও এক শ্রেণীর মানুষ বলতো আমাদের মন থেকে সন্দেহ এখনো দূর হয়নি। তাই আপনার কথায় আমরা বিশ্বাস স্থাপন করতে পারছি না। এমনকি তারা পয়গম্বদের কাজ বাধা সৃষ্টি করতো এবং পয়গম্বদের কথা না শোনার জন্য অন্যদেরকেও উদ্বুদ্ধ করতো। তাদের এই সন্দেহের পিছনে ছিল অন্ধত্ব ও গোঁড়ামি । কারণ যুক্তি-প্রমাণ এবং অলৌকিক নিদর্শন উপস্থাপন করার পর সব কিছু দিবালোকের মত সুস্পষ্ট হয়ে যায়। এর পরও সন্দেহ উদ্রেক করার অর্থ হচ্ছে অজ্ঞতা ও অন্ধকারের কাছে বশ্যতা স্বীকার করে নেয়া।

ইতিহাস পাঠ এবং কুরআনে বর্ণিত জাতিগুলোর পরিণতি থেকে শিক্ষা নেয়া হবে বুদ্ধিমানের কাজ। এছাড়া কাফেররা গোঁড়ামি ও একগুয়েমির কারণে সত্যের সন্ধান পায়নি এবং হেদায়াত থেকে বঞ্চিত হয়েছে।

সূরা ইব্রাহিমের ১০ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

قَالَتْ رُسُلُهُمْ أَفِي اللَّهِ شَكٌّ فَاطِرِ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ يَدْعُوكُمْ لِيَغْفِرَ لَكُمْ مِنْ ذُنُوبِكُمْ وَيُؤَخِّرَكُمْ إِلَى أَجَلٍ مُسَمًّى قَالُوا إِنْ أَنْتُمْ إِلَّا بَشَرٌ مِثْلُنَا تُرِيدُونَ أَنْ تَصُدُّونَا عَمَّا كَانَ يَعْبُدُ آَبَاؤُنَا فَأْتُونَا بِسُلْطَانٍ مُبِينٍ

“তাদের রাসূলগণ বলেছিল,আল্লাহ সম্বন্ধে কি কোন সন্দেহ আছে- যিনি আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর সৃষ্টিকর্তা? তিনি তাঁর দিকে তোমাদের আহ্বান করেন তোমাদের পাপ মার্জনা করার জন্য এবং এক নির্দিষ্টকাল পর্যন্ত তোমাদের অবকাশ দেবার জন্য। তারা বলতো, তোমরা তো আমাদেরই মতো মানুষ। আমাদের পিতৃপুরুষগণ যাদের উপাসনা করতো, তোমরা তাদের উপাসনা হতে আমাদের বিরত রাখতে চাও। অতএব তোমরা আমদের নিকট কোন প্রমাণ উপস্থিত করো।" (১৪:১০)

অবিশ্বাসীরা নবী রাসূলদেরকে তাদের বক্তব্য সঠিকভাবে উপস্থাপনের সুযোগ দিত না। তাদের এই কাপুরুষোচিত কাজের জবাবে নবী রাসূলগণ বলতেন, তোমরা হয়তো আমাদের অস্বীকার করতে পারছো, কিন্তু তোমরা কি আল্লাহকেও অস্বীকার করতে চাও? তিনি তোমাদের সৃষ্টি করেছেন এবং এখন সঠিক পথের দিকে আহ্বান করছেন। যদি সে আহবানে সাড়া না দাও তবে নির্দিষ্ট সময়ের পর আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে তওবা করার সুযোগটুকুও পাবে না। তখন তোমাদেরকে আল্লাহর মহাক্রোধে পড়তে হবে। কাজেই সময় থাকতে সত্য গ্রহণ করে আল্লাহর ক্ষমা লাভের যোগ্যতা অর্জন করো।

কিন্তু নবী-রাসূলদের আহ্বান সত্ত্বেও কাফেররা তাদের অবস্থানে অটল থেকে বলতো, "তোমরা কী যোগ্যতাবলে আমাদের থেকে শ্রেয়তর হলে যে আমাদেরকে তোমাদের পথে আহ্বান করছো এবং আমাদের পূর্বপুরুষদের দেখিয়ে দেওয়া পথ অনুসরণ থেকে বিরত থাকতে বলছো? কী কারণে আমরা তোমাদের ডাকে সাড়া দেবো?

কাফেরদের এ কথা থেকে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, তারা তাদের পূর্ব পুরুষদের অন্ধ অনুকরণের কারণে সত্য গ্রহণ করতে অস্বীকার করছিল। তাদের এ কথার জবাবে নবীরাসূলগণ বলতেন, "তোমরা কীভাবে বুঝলে যে তোমাদের পূর্বপুরষগণ সঠিক পথে ছিল? তারা যা কিছু করেছেন, তার সবই কি সঠিক ছিল? যদি সবাই তাদের পূর্বপুরষদের অনুসরণ করে তবে সমাজে কোনদিনই পরিবর্তন আসবে না এবং কোন জাতিরই উন্নতি উন্নতি ঘটবে না।

আল্লাহ প্রেরিত নবী রাসূলগণ মানুষকে গোনাহ ও সব ধরনের দূষণ থেকে পবিত্রতার দিকে আহ্বান করতেন। কারণ, দুর্নীতিপরায়ন মানুষ কখনো নবীদের কথায় কান দেয় না। মুসলমানরা সত্যের অনুসারি। গোত্র ও বংশপ্রীতি এবং পূর্বপুরুষদের অযৌক্তিক পথের অনুসরণ ইসলামে গ্রহণযোগ্য নয়।

আপনার মতামত

মন্তব্য নেই
*
*

আল হাসানাইন (আ.)