সূরা ইব্রাহীম;(৯ম পর্ব)

সূরা ইব্রাহীম; আয়াত ৩২-৩৫

সূরা ইব্রাহিমের ৩২ ও ৩৩ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-

اللَّهُ الَّذِي خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ وَأَنْزَلَ مِنَ السَّمَاءِ مَاءً فَأَخْرَجَ بِهِ مِنَ الثَّمَرَاتِ رِزْقًا لَكُمْ وَسَخَّرَ لَكُمُ الْفُلْكَ لِتَجْرِيَ فِي الْبَحْرِ بِأَمْرِهِ وَسَخَّرَ لَكُمُ الْأَنْهَارَ (32) وَسَخَّرَ لَكُمُ الشَّمْسَ وَالْقَمَرَ دَائِبَيْنِ وَسَخَّرَ لَكُمُ اللَّيْلَ وَالنَّهَارَ

"তিনিই আল্লাহ যিনি আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন, যিনি আকাশ হতে পানিবর্ষণ করে তা দিয়ে তোমাদের জীবিকার জন্য ফল-মূল উৎপাদন করেন, যিনি জলযানকে তোমাদের অধীন করেছেন যাতে তাঁর বিধানে তা সমূদ্রে বিচরণ করে এবং যিনি নদীসমূহকে তোমাদের অধীন করেছেন।” (১৪:৩২)

“তিনি তোমাদের অধীন করেছেন সূর্য ও চন্দ্রকে যারা অবিরাম একই নিয়মের অনুবর্তী এবং তোমাদের অধীন করেছেন রাত ও দিনকে।" (১৪:৩৩)

আগের পর্বে বলা হয়েছে, মহান আল্লাহ মানুষকে দুনিয়া ও আখেরাতে সুখ ও সমৃদ্ধির জন্য নামাজ আদায় এবং যথাসম্ভব দান করার আদেশ দিয়েছেন। এই আয়াতে বলা হচ্ছে, সেই আল্লাহর সামনে সিজদায় অবনত হও যিনি এত বিশাল সৃষ্টিজগতের মালিক। এছাড়া আল্লাহর রাস্তায় দান করো- কারণ তোমাদের অধীনে যা কিছু রয়েছে তার সব তারই দান। এই আয়াতে মানব জীবনে পানির গুরুত্ব ও ভূমিকাকে তিনটি দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। একটি হচ্ছে আকাশ থেকে বর্ষিত পানি বা বৃষ্টি যা শুষ্ক ভূমিকে উর্বর করে তোলে; এর ফলে সেই ভূমিতে ফল-মূলসহ নানা ধরনের শস্য উৎপন্ন হয়। দ্বিতীয়তঃ সমূদ্রের পানি। এই পানিতে সামূদ্রিক জীব এবং মানুষের জন্য উপকারী ও সুস্বাদু নানান জাতের মাছ বসবাস করে। সেই সাথে পণ্য পরিবহণের সবচেয়ে সহজ ও সাশ্রয়ী পথ হচ্ছে সমূদ্রপথ। এমনকি জ্ঞানবিজ্ঞানের এত উন্নতির এই যুগে মানুষ যখন বিশালাকৃতির উড়োজাহাজ ও অন্যান্য বাহন আবিস্কার করেছে, তখনও আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও পণ্য লেনদেনের জন্য সমূদ্রপথ সবচেয়ে বেশী ব্যবহৃত হচ্ছে। এই সমূদ্র আল্লাহ সৃষ্টি করে তা মানুষের নিয়ন্ত্রণে ছেড়ে দিয়েছেন।

এ আয়াতে আল্লাহ পানির তৃতীয় যে উৎসের দিকে ইঙ্গিত করেছেন তা হচ্ছে নদ-নদী ও খাল-বিল। যেসব স্থানে বৃষ্টিপাত কম হয়, নদনদী সেসব স্থানের মানুষের পানির চাহিদা মেটায়। এছাড়া খাল কেটে অনেক শুষ্ক ভূমিতে আজ ফসল ফলাচ্ছে মানুষ। এ আয়াতে আরো বলা হয়েছে, চাঁদ ও সূর্যের নিয়মানুবর্তিক ঘূর্ণায়নের ফলে দিন ও রাত্রি সৃষ্টির বিষয়টি মানুষের হাতে না থাকলেও এই দিন ও রাত মানুষের কল্যাণে নিয়োজিত রয়েছে।

সূরা ইব্রাহিমের ৩৪ নম্বর আয়াতে মহাপ্রভূ আমাদের বলেছেন-

وَآَتَاكُمْ مِنْ كُلِّ مَا سَأَلْتُمُوهُ وَإِنْ تَعُدُّوا نِعْمَةَ اللَّهِ لَا تُحْصُوهَا إِنَّ الْإِنْسَانَ لَظَلُومٌ كَفَّارٌ

"তোমরা আল্লাহর কাছে যা যা চেয়েছো, তিনি তার সবই তোমাদের দিয়েছেন। তোমরা যদি আল্লাহর অনুগ্রহসমূহকে গণনা করতে চাও তবে তা গুণে শেষ করতে পারবে না। মানুষ তো অবশ্যই অতিমাত্রায় সীমালংঘনকারী ও অকৃতজ্ঞ।" (১৪:৩৪)

আগের আয়াতে আকাশ ও ভূমিতে আল্লাহর অসংখ্য অনুগ্রহের কথা বর্ণনা করার পর এই আয়াতে বলা হচ্ছে, সৃষ্টিকর্তা মানুষের সব ধরনের প্রয়োজন মিটিয়েছেন। এমনকি আল্লাহর অনুগ্রহের বিষয়টি গণনা করেও শেষ করা মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু তারপরও মানুষ আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞ নয় এবং তার দেয়া নেয়ামতগুলোকে সঠিক পথে ব্যবহার বা ব্যয় করে না। আল্লাহ প্রদত্ত চোখ, কান ও জিহ্বাকে মানুষ তারই নির্দেশ লংঘনের কাজে ব্যবহার করে। একের প্রতি অন্যের জুলুম ও অবিচারের কারণে আল্লাহর অসংখ্য অনাগ্রহ সত্ত্বেও কেউ অঢেল সম্পদের মধ্যে বসবাস করছে এবং কেউ সবকিছু থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এছাড়া যে অনুগ্রহের কোন সীমা পরিসীমা নেই, সে অনুগ্রহের জন্য আমাদের আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞ হওয়া উচিত, সীমা লংঘনকারী নয়।

সূরা ইব্রাহিমের ৩৫ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেছেন-

وَإِذْ قَالَ إِبْرَاهِيمُ رَبِّ اجْعَلْ هَذَا الْبَلَدَ آَمِنًا وَاجْنُبْنِي وَبَنِيَّ أَنْ نَعْبُدَ الْأَصْنَامَ

"স্মরণ করো- যখন ইব্রাহিম বললো : হে আমার প্রতিপালক! এই শহরকে নিরাপদে রাখো এবং আমাকে ও আমার সন্তানদেরকে মুর্তিপূজা থেকে দূরে রাখো।" (১৪:৩৫)

আল্লাহর নবী ইব্রাহিমের নাম অনুসারে এই সূরার নামকরণ করা হয়েছে। কাজেই এই আয়াত থেকে হযরত ইব্রাহিম (আ.) এবং তার জীবনের নানা ঘটনা ও আল্লাহর সাথে তার কথোপকথনের কথা বর্ণনা করা হয়েছে। হযরত ইব্রাহিম ও তার পুত্র হযরত ইসমাইল (আ.) পবিত্র কাবাঘর পুনঃনির্মানের পর আল্লাহর এই নবী আল্লাহর কাছে দোয়া করেন এবং তাঁর কাছে অনেক কিছু কামনা করেন। এই আয়াত অনুসারে আল্লাহর কাছে তিনি সবার আগে মক্কা নগরীর নিরাপত্তা কামনা করেছেন। অন্য কিছু আয়াতেও এ বিষয়টির প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। এটি অত্যন্ত স্পষ্ট যে, বিশ্ববাসীর ইবাদত ও আল্লাহর একত্ববাদের কেন্দ্র হবে যে স্থানটিকে ঘিরে, তার পরিপূর্ণ নিরাপত্তা সবার আগে নিশ্চিত করতে হবে। শুধু মানুষ নয় কাবাঘর এলাকার অন্যান্য পশুপাখী এবং জীবজন্তুও বিশেষ মর্যাদার অধিকারী। হযরত ইব্রাহিম (আ.) এর এই আবেদনটিকে আল্লাহ কবুল করে নিয়েছেন। আজও মক্কা নগরী আল্লাহর হেরেম শরীফ হিসেবে চিহ্নিত এবং কিয়ামত বা বিচার দিবসের আগ পর্যন্ত তা অক্ষুণ্ন থাকবে।

মহান আল্লাহ তার নবীকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, যে কোন বিপদ আপদ থেকে এই নগরীকে রক্ষা করা হবে। বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, হযরত ইব্রাহিম (আ.) প্রথম মুর্তি ধ্বংস করেছিলেন এবং একত্ববাদের প্রতি বিশ্বাসের মূর্ত প্রতীকে পরিণত হয়েছিলেন। তারপরও তিনি আল্লাহর কাছে দোয়া করলেন, তিনি যেন তার বংশধরদের মুর্তিপূজার হাত থেকে রক্ষা করে একত্ববাদের পথে অটল রাখেন। কাজেই আমরা দেখতে পাচ্ছি, আল্লাহর প্রেরিত পুরুষগণ তাদের উম্মতদের ইবাদতের জন্য নির্বিঘ্ন ও নিরাপদ পরিবেশ সৃষ্টির ব্যাপারে তৎপর ছিলেন। এছাড়া মানুষ প্রতিনিয়ত শয়তানের ধোঁকা খেয়ে কিংবা কুপ্রবৃত্তির বশবর্তী হয়ে বিপথে চলে যেতে পারে। এ কারণে সব সময় নিজেদের এবং সন্তানদের আল্লাহর পথে অবিচল রাখার জন্য তাঁর কাছে করুণা ভিক্ষা করা উচিত।