সূরা হিজর;(২য় পর্ব)

সূরা হিজর; আয়াত ৭-১১

সূরা হিজরের ৭ ও ৮ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে : 

لَوْ مَا تَأْتِينَا بِالْمَلَائِكَةِ إِنْ كُنْتَ مِنَ الصَّادِقِينَ (7) مَا نُنَزِّلُ الْمَلَائِكَةَ إِلَّا بِالْحَقِّ وَمَا كَانُوا إِذًا مُنْظَرِينَ

“(হে পয়গম্বর!) তুমি সত্যবাদী হলে আমাদের নিকট ফেরেশতাগণকে উপস্থিত করছো না কেন?” (১৫:৭)

“(অথচ) আমরা ফেরেশতাদেরকে হুকুম জারি করার জন্যই প্রেরণ করি, ফেরেশতাগণ উপস্থিত হলে ওরা আর কোন অবকাশ পাবে না।" (১৫:৮)

সূরা হিজরের ৬ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, অবিশ্বাসী কাফেররা আল্লাহর পক্ষ থেকে পাঠানো সুস্পষ্ট যুক্তি প্রত্যাখ্যান করার কোন পথ খুঁজে না পেয়ে নবী রাসূলদের অপমান অপদস্থ করেছে। তারা নবী-রাসূলদের উন্মাদ এবং নিজেদের ভীষণ বুদ্ধিমান ভাবতো। এই আয়াতে ধর্ম বিরোধীদের অযৌক্তিক বক্তব্যের প্রতি ইঙ্গিত করে বলা হয়েছে, তারা সত্য গ্রহণের শর্ত হিসেবে ফেরেশতাদের দেখতে এবং তাদের মুখ থেকে সরাসরি আল্লাহর বাণী শুনতে চায়। অথচ আল্লাহ বলছেন, যারা নবী-রাসূলের কাছ থেকে ঐশী বাণী শুনে ঈমান আনে না, তারা ফেরেশতার মুখে শুনলেও ঈমান আনবে না। সেক্ষেত্রে তারা সত্য প্রত্যাখ্যানের জন্য অন্য কোন অজুহাত তৈরি করবে। এছাড়া, আল্লাহ প্রত্যেক ব্যক্তিকে ঈমান গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করার জন্য তার দাবি মেনে নিয়ে ফেরেশতা পাঠাতে থাকবেন- এটাতো কোন যুক্তির কথা হতে পারে না। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, নবী রাসূলদের কথা যদি যুক্তি বুদ্ধিতে সঠিক বলে মনে হয়, তবে তা গ্রহণ করে ঈমান আনতে হবে। আর কারো কাছে তা যদি অযৌক্তিক মনে হয়, তবে তা প্রত্যাখ্যান করার স্বাধীনতা তার রয়েছে। কিন্তু রাসূলের কথা বিশ্বাস করানোর জন্য যদি তার সঙ্গে ১০ জন ফেরেশতাও হাজির করা হয়, তবুও কাফেররা তা বিশ্বাস করবে না।

এ আয়াতের পরবর্তী অংশে বলা হয়েছে, যদি আল্লাহ কাফেরদের দাবি মেনে নিয়ে তাদের দেখানোর জন্য ফেরেশতা পাঠাতেন, তবে তাদের সামনে সত্য গ্রহণ করা ছাড়া অন্য কোন উপায় থাকতো না। কারণ, ফেরেশতা পাঠানোর পরও আল্লাহর বিরোধিতা করলে সাথে সাথে তারা আল্লাহর ক্রোধের শিকার হতো এবং তাদের ওপর আসমানী বালা নেমে আসতো। কিন্তু আল্লাহ তার বান্দাদের সঠিক পথে ফিরে আসার জন্য নির্দিষ্ট সময় দেয়ার যে বিধান সৃষ্টি করেছেন, এটি তার বিপরীত হতো বলে তিনি তা করেননি।

এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হচ্ছে-

প্রথমতঃ কাফের ও অবিশ্বাসীদের দাবি দাওয়ায় কান দিতে নেই, কারণ, তাদের একটি দাবি পুরণ করা হলে পরবর্তী দাবি তুলে ধরবে এবং কখনোই এসব দাবি শেষ হবে না।

দ্বিতীয়তঃ মানুষের চাহিদা বা দাবির ভিত্তিতে আল্লাহ পৃথিবীতে ফেরেশতা পাঠান না, বরং তিনি যখন প্রয়োজন মনে করেন তখন পাঠান।

সূরা হিজরের ৯ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-

إِنَّا نَحْنُ نَزَّلْنَا الذِّكْرَ وَإِنَّا لَهُ لَحَافِظُونَ

"নিশ্চয়ই আমি কুরআন অবতীর্ণ করেছি এবং আমিই এর সংরক্ষণ করব।"(১৫:৯)

মহান আল্লাহ এই আয়াতে অবিশ্বাসী কাফেরদের অপবাদ ও অন্যায় আচরণের জবাবে মুমিন বিশ্বাসীদের সান্ত্বনা দিয়ে বলছেন : পবিত্র কুরআনের যথার্থতার ব্যাপারে অন্তরে কোন ধরনের সংশয় পোষণ কর না। এই কুরআন আল্লাহর পক্ষ থেকে রাসূলুল্লাহ (সা.) এর ওপর অবতীর্ণ হয়েছে এবং এটি সংরক্ষণের দায়িত্ব আল্লাহ নিজেই নিয়েছেন। কাজেই দেখা যাচ্ছে, কুরআন রাসূলের ওপর অবতীর্ণ হওয়ার সময় অথবা তা মানুষের কাছে উপস্থানের সময় কিংবা তা লিপিবদ্ধ করার সময়- কখনোই এতে কোন ধরনের পরিবর্তন, পরিবর্ধন বা বিকৃতি ঘটেনি। এছাড়া, পৃথিবীর সমাপ্তি পর্যন্ত এই কুরআনে কোন কিছু যুক্ত করা বা বাদ দেয়ার অনুমতি আল্লাহ কাউকে দেবেন না। কুরআন যে বিকৃত হবে না- ইতিহাস তার সাক্ষী। এছাড়া, বিশ্বে লাখ লাখ মুসলমান হাফেজ রয়েছেন যারা সমস্ত কুরআন মুখস্ত করে রেখেছেন। পাশাপাশি অধিকাংশ মুসলমান পবিত্র কুরআনের অন্তত কয়েকটি সূরা মুখস্ত করেছেন এবং প্রতিদিন ৫ ওয়াক্ত নামাজের পাশাপাশি অন্যান্য সময়েও তারা এসব সূরা তেলাওয়াত করেন।

এই আয়াতের শিক্ষণীয় দু’টি বিষয় হচ্ছে:

এক. কুরআন আল্লাহর বাণী। এই কুরআন মানুষকে সঠিক পথের আলো দেখায়।

দুই. অন্যান্য আসমানী কিতাবের তুলনায় কুরআনের শ্রেষ্ঠত্বের অন্যতম কারণ হলো এটি গত প্রায় সাড়ে চৌদ্দশ' বছর ধরে অবিকৃত রয়েছে এবং শেষ দিন পর্যন্ত অবিকৃত থাকবে।

সূরা হিজরের ১০ ও ১১ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলছেন :

وَلَقَدْ أَرْسَلْنَا مِنْ قَبْلِكَ فِي شِيَعِ الْأَوَّلِينَ (10) وَمَا يَأْتِيهِمْ مِنْ رَسُولٍ إِلَّا كَانُوا بِهِ يَسْتَهْزِئُونَ

"নিশ্চয়ই আমরা তোমার পূর্বে অনেক সম্প্রদায়ের নিকটও (রাসূল) পাঠিয়েছিলাম।” (১৫:১০)

“তাদের নিকট এমন কোন রাসূল আসেনি যাকে ওরা ঠাট্টা-বিদ্রূপ করতো না।" (১৫:১১)

নবী-রাসূলদের ধারাবাহিকতা রক্ষা খোদায়ী বিধানের একটি অলংঘনীয় নিয়ম। মহান আল্লাহ যুগ যুগ ধরে বিভিন্ন জাতি ও সম্প্রদায়ের কাছে নবী-রাসূল পাঠিয়েছেন। অবশ্য এসব নবীর অধিকাংশ ছিলেন ধর্ম প্রচারক। তারা তাদের পূর্ববর্তী কিতাবধারী নবী-রাসূলদের ধর্ম প্রচারের দায়িত্ব পালন করেছেন। তবে কোন ধরনের ব্যতিক্রম ছাড়া সকল নবী-রাসূল জনগণের পক্ষ থেকে তীব্র বিরোধিতার সম্মুখীন হয়েছেন এবং অনেকে তাদের ব্যঙ্গবিদ্রূপ ও ঠাট্টা করেছে। তারা ধর্ম প্রচারে নবী-রাসূলদের বাধা দিয়েছে।

এ আয়াতে মুমিনদের সতর্ক করে দিয়ে বলা হচ্ছে, তারা যেন তাদের বিশ্বাস ও কর্মের ব্যাপারে কখনো হতাশ বা আশাহত না হয়। তাদের জেনে রাখা উচিত, এ ধরনের বিরোধিতা সৃষ্টির শুরু থেকে ছিল এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। অবিশ্বাসীরা নবী-রাসূলদের যুক্তিপূর্ণ কথা ও সত্যের সামনে নিজেদের অসহায় দেখে এ ধরনের বিকৃত পথ অবলম্বন করে এবং তাদের বিদ্রূপ করে।

এ আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হচ্ছে-

প্রথমতঃ ইতিহাসে দীর্ঘ পরিক্রমায় অপরের দুঃখ কষ্টের দৃষ্টান্ত লক্ষ্য করলে মানুষের পক্ষে একই ধরনের কষ্ট সহ্য করা সহজ হয়ে যায়।

দ্বিতীয়তঃ আল্লাহ প্রেরিত প্রত্যেক নবী-রাসূলকে অবিশ্বাসীরা ব্যঙ্গবিদ্রূপ করলেও মহান আল্লাহ তার প্রেরিত পুরুষদের পৃথিবীতে পাঠানো থেকে বিরত থাকেননি। কারণ, তিনি প্রতি যুগের প্রতিটি জাতির কাছে তাঁর বার্তা পৌঁছে দিতে চান, যাতে এসব মানুষ বলতে না পারে যে, তারা সত্যের বাণী শুনতে পায়নি।