বেলায়েতের আয়াতের ব্যাকরণগত দিক সম্পর্কে একটি গবেষণামূলক বিশ্লেষণ

সারসংক্ষেপ:

কালামশাস্ত্রে আয়াত এবং রেওয়ায়েতসমূহের ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে ব্যাকরণগত দিক একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। অনুরূপ ভাবে বেলায়েত ও নেতৃত্বের বিষয়টিও কালামশাস্ত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে পরিগণিত হয়। এই লেখনীতে বেলায়েতের আয়াত (সূরা মায়েদার ৫৫ নং আয়াত) সম্পর্কে দু’দল কালাম শাস্ত্রবিদ তাদের মতের সপক্ষে যে সকল ব্যাকরণগত যুক্তি উপস্থাপন করেছেন তার মধ্যে তুলনামূলক বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এই বিষয়টি উপস্থাপন করতে গিয়ে ইসলামী বিশ্বের দু’জন প্রসিদ্ধ কালামশাস্ত্রবিদ ‘তাজরিদুল ইতিকাদ’ গ্রন্থের রচয়িতা গবেষক তুসী এবং এ গ্রন্থের ব্যাখ্যাকারক ফাজেল কুশচীর মতকে মূল ধরা হয়েছে। প্রথমেই এই আয়াত দ্বারা হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর পর পরই হযরত আলী (আ.) এর বেলায়েত ও খেলাফতকে প্রমাণ করার ক্ষেত্রে গবেষক তুসীর ব্যবহৃত বিভিন্ন প্রমাণ এবং ব্যাকরণগত যুক্তি বর্ণনা করা হয়েছে। অতপর তার মত খণ্ডন করে গবেষক ফাজেল কুশচী যে যুক্তি-প্রমাণ উপস্থাপন করেছেন তা উল্লেখ করে তাদের দৃষ্টিভঙ্গির সমালোচনা ও পর্যালোচনা করা হয়েছে।

ভূমিকা : বেলায়েত ও নেতৃত্ব সম্পর্কিত আলোচনা কালাম শাস্ত্রের উৎপত্তির শুরু থেকেই একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল। শাহরেস্তানীর মতে রাসূল (সা.) এর ওফাতের পর মুসলমানদের মধ্যে সর্ব প্রথম এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছিল তা তার স্থলাভিষিক্তি এবং পরবর্তী নেতৃত্ব নিয়েই। (শাহরেস্তানী, আল-মেলাল ওয়ান নেহাল, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা-২৪।) মুসলমানরা এ বিষয়টি নিয়ে দুদলে বিভক্ত হয়। তাদের একদল বিশ্বাস করে যে, হযরত মুহাম্মদ (সা.) তাঁর পর হযরত আলী (আ.) কে খলিফা হিসাবে মনোনীত করেছেন। অপরদল বিশ্বাস করে তিনি কাউকেই নেতা নিযুক্ত করে যাননি।

তাদের প্রথম দল হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর পর পরই হযরত আলী (আ.) এর খেলাফতকে প্রমাণ করার জন্য বিভিন্ন আকলী (বুদ্ধিবৃত্তিক) এবং নাকলী (কোরআন ও হাদীসের) দলীল উপস্থাপন করে থাকেন। নাকলী দলীল হিসাবে তারা কোরআনের বিভিন্ন আয়াত এবং রাসূল (সা.) এর হাদীস ব্যবহার করে থাকেন।

তন্মধ্যে একটি হচ্ছে, সূরা আল-মায়েদার ৫৫ নং আয়াত যা আহলে বাইতের অনুসারীদের মধ্যে বেলায়েতের আয়াত নামে প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। এই আয়াতটি হচ্ছে-

إِنَّمَا وَلِيُّكُمُ اللَّهُ وَرَسُولُهُ وَالَّذِينَ آمَنُوا الَّذِينَ يُقِيمُونَ الصَّلَاةَ وَيُؤْتُونَ الزَّكَاةَ وَهُمْ رَاكِعُونَ

তোমাদের অভিভাবক হচ্ছেন কেবল আল্লাহ ও তার রাসূল এবং যারা ঈমান এনেছে, নামাজ কায়েম করেছে আর রুকুরত অবস্থায় যাকাত প্রদান করেছে।

আহলে বাইতের অনুসারীদের বিশ্বাস এই আয়াত অকাট্যভাবে হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর পরপরই হযরত আমিরুল মু’মেনীন (আ.) এর খেলাফতকে প্রমাণ করে।

গবেষক তুসী তার “তাজরিদুল ই’তিকাদ” গ্রন্থে নবী (সা.) এর উত্তরাধিকারী যে ঐশীভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত, তা দুই দলীল যথা নিষ্পাপতা (ইসমাত) এবং রাসূল (সা.) এর সীরাত বা কর্মনীতি দ্বারা প্রমাণ করে বলেছেন: যে সব দলীল প্রমাণ হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর পরপরই হযরত আমিরুল মু’মেনিন আলী (আ.) এর ইমামত ও খেলাফতের দিকে ইঙ্গিত করে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে বেলায়েতের আয়াত। কেননা এই আয়াতে যে সব গুণাবলীর কথা উল্লেখ করা হয়েছে একমাত্র আলী (আ.) এর মধ্যেই তার সমাবেশ ঘটেছে। (তুসী, তাজরিদুল এ’তেকাদ, পৃষ্ঠা নং-২২৫)

তাজরিদুল ই’তিকাদ এর ব্যাখ্যাকারক আল্লামা কুশচী, গবেষক তুসীর বক্তব্যকে এভাবে বর্ণনা করেছেন :

১. সকল মুফাসসির এব্যাপারে একমত যে, এ আয়াতটি হযরত আলী (আ.) এর শানে অবতীর্ণ হয়েছে। এ আয়াত এমন সময় অবতীর্ণ হয়েছিল যখন হযরত আলী (আ.) রুকুরত অবস্থায় একজন অসহায় নিঃস্ব ব্যক্তিকে নিজের আংটি দান করেছিলেন।

২. «انّما» (ইন্নামা) শব্দটি মূলত আরবি ব্যাকরণশাস্ত্রে হাসর (حصر) বা সীমাবদ্ধতা নির্দেশ করতে ব্যবহৃত হয়ে থাকে এবং কোরআন ও হাদীসের বর্ণনাতেও এর সপক্ষে দলীল রয়েছে।

৩. «ولي» শব্দটি কখনো সাহায্যকারী অর্থে আবার কখনো কোন বিষয়ে কর্তৃত্বকারী এবং কর্তৃত্বের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত অর্থে ব্যবহৃত হয়। যেমন যখন বলা হয়: স্ত্রীর বড়ভাই তার অভিভাবক, অথবা শাসক হলেন অভিভাবকহীনের অভিভাবক এবং অনুরূপভাবে রক্তের দাবিদার ও উত্তরাধিকারীরা নিহত ব্যক্তির রক্তের প্রতিশোধ গ্রহণের অধিকারপ্রাপ্ত। উল্লিখিত সকল ক্ষেত্রেই «ولي» শব্দটি (কোন কিছুর ওপর) কর্তৃত্বের অধিকারী বা অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।

এই আয়াতেও ওয়ালি শব্দটি দ্বিতীয় অর্থে অর্থাৎ কর্তৃত্বের অধিকারী অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। এই আয়াতে হাসর (সীমাবদ্ধতা নির্দেশক অব্যয় ‘ইন্নামা’) থাকার কারণে বেলায়াত (শাসনক্ষমতা, কর্তৃত্ব) শব্দটি সাহায্যকারী অর্থে ব্যবহৃত হতে পারেনা। কেননা পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে-

وَالْمُؤْمِنُونَ وَالْمُؤْمِنَاتُ بَعْضُهُمْ أَوْلِيَاءُ بَعْضٍ

অর্থাৎ সকল মুসলমান নরনারী পরস্পর পরস্পরের সাহায্যকারী। (সূরা আত-তওবাহ, আয়াত নং-৭১)।

সুতরাং সূরা মায়েদার আলোচ্য আয়াতটিতে «ولي» শব্দটি সাহায্যকারী অর্থে ব্যবহৃত হওয়ার পক্ষে কোন দলীল প্রমাণ নেই কারণ তাহলে এ (সাহায্যকারী) অর্থটি কেবল ঐসব মুসলমান যারা রুকু অবস্থায় যাকাত প্রদান করে তাদের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়বে।

৪. «ولي» ওয়ালি শব্দের অর্থ ইমাম বা নেতা।

৫. যেহেতু আয়াতে উল্লিখিত গুণাবলীর সমাবেশ শুধুমাত্র আলী (আ.) এর মধ্যেই ঘটেছে সেহেতু একমাত্র তিনিই ইমামত বা নেতৃত্বের যোগ্য। (কুশচী, শারহে তাজরিদুল ইতিকাদ, পৃ-৩৬৮।)

কালাম শাস্ত্রের বিভিন্ন গ্রন্থে দু’দল কালাম শাস্ত্রবিদের মধ্যে এ বিষয়ে আয়াতটির ব্যাকরণগত দিক নিয়ে বেশ বিতর্ক পরিলক্ষিত হয়। পাঁচটি ব্যাকরণগত বিষয়কে কেন্দ্র করে এই আয়াতে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা রয়েছে। এ পাঁচটি বিষয় যথাক্রমে :

১. «انّما» ইন্নামা এর সীমাবদ্ধতা।

২. «هم راکعون» অবস্থা নির্দেশক বাক্য (جملة حالية), না কি সংযোজিত (معطوف বা সম্বন্ধসূচক) বাক্য?

৩. রুকু শব্দের অর্থ।

৪. বহুবচনমূলক শব্দরূপকে একবচনের ক্ষেত্রে প্রয়োগ।

৫. «ولی» ওয়ালি শব্দের অর্থ।

আলোচনার ইতিহাস:

কালাম শাস্ত্রের বিভিন্ন গ্রন্থে প্রাসঙ্গিকভাবে এই আয়াতের ব্যাকরণগত দিকটি আলোচিত হয়েছে। কিন্তু বিশেষ শিরোনামে স্বতন্ত্রভাবে কখনোই এ বিষয়টির ওপর পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণ হয়নি। এ দৃষ্টিতে আলোচ্য প্রবন্ধটি এই বিষয়ক স্বয়ংসম্পূর্ণ একটি আলোচনা বলে গণ্য হতে পারে কারণ এখানে গবেষক তুসীর যুক্তি উপস্থাপনের পর ফাজেল কুশচী ছাড়াও বিশিষ্ট কিছু মনীষী ও বিশেষজ্ঞের মত ও এ সংক্রান্ত তাদের প্রশ্ন ও আপত্তি উত্থাপিত হয়েছে অতপর আহলে বাইতের অনুসারী কালামশাস্ত্রবিদদের দৃষ্টিতে তার উত্তরও প্রদান করা হয়েছে। উপরন্তু নতুন কিছু উত্তরও উপস্থাপন করা হয়েছে।

প্রথমে সংক্ষিপ্তাকারে পবিত্র কোরআনের আয়াতে ব্যবহৃত শব্দাবলী ও বাক্যকে গঠনিক ও ব্যাকরণগত দৃষ্টিতে বিশ্লেষণ (তারকীব) করা হয়েছে অতপর উল্লিখিত বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে।

বেলায়াতের আয়াতের শব্দাবলী ও বাক্যের স্বরূপ বিশ্লেষণ :

«انما» ইন্নামা যুক্তশব্দটিতে বিদ্যমান «ان»ইন্না শব্দটি হুরুফে মুশাব্বাহ বেল ফেল (حروف مشبهه بالفعل বা ক্রিয়াপদের সদৃশ অব্যয়সমূহ, যা এর পরে আসা নামবোধক শব্দ বা বিশেষ্যের স্বর বা পদচিহ্নকে নাসব نصب-এ রূপান্তরিত করে।) এর অন্তর্ভুক্ত যার শেষে «ما» ‘মা’ অব্যয়টি সংযুক্ত হয়ে তাকে আমল (পরবর্তী শব্দের পদচিহ্নের উপর প্রভাব বিস্তার) করা থেকে বিরত রেখেছে। «ما» মা অব্যয়টি অতিরিক্ত এবং বাধাদানকারী যার কারণে «ان» ইন্নার আমল রহিত (বাতিল) হয়েছে। «ولی» ওয়ালি শব্দটি خبر (বিধেয়) যাকে পূর্বে এবং «الله» শব্দটি مبتدا (উদ্দেশ্য) যাকে পরে উল্লেখ করা হয়েছে। «رسول» রাসূল এবং «الذین آمنوا» যারা ইমান এনেছে «الله» শব্দটির প্রতি عطف (সংযোজিত) হয়েছে। «الذین یقیمون» অর্থাৎ যারা কায়েম করেছে বাক্যটি «الذین آمنوا» অর্থাৎ যারা ইমান এনেছে বাক্যটির বাদাল بدل» « অথবা আতফে বায়ান «عطف بیان»«آمنوا» এবং «یقیمون» موصول (সম্বন্ধবাচক সর্বনামের) এর صله (সম্বন্ধ) স্বরূপ। «یؤتون الزکوة» বাক্যটি «یقیمون الصلوة» বাক্যটির প্রতি عطف (সংযোজিত) হয়েছে। «هم راکعون» বাক্যটি অবস্থাসূচক বাক্য এবং «یؤتون» ক্রিয়াটির মধ্যে নিহিত فاعل (কর্তা) এর حال (অবস্থা) যা কিছু সংখ্যক আলেমের দৃষ্টিতে বৈধ। (তাফতাজানী, শারহে মাকাছেদ ফি ইলমুল কালাম, ৩য় খণ্ড, পৃ-৫০২; কুশচী, শারহে তাজরীদুল ইতিকাদ, পৃ-৩৬৯।) আবার «یقیمون الصلوة» বাক্যটির প্রতিও عطف (সংযোজিত)। (নূহাশ, এরাবুল কোরআন, ১ম খণ্ড, পৃ-২৭৩; দারউইশ, এরাবুল কোরআন ও বায়ানুহু, ২য় খণ্ড, পৃ-৫০৮।)

«انّما»সীমাবদ্ধতার অর্থে ব্যবহৃত হয় :

পবিত্র এই আয়াতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাকরণশাস্ত্রীয় আলোচনা হচ্ছে «انّما» শব্দটির সীমাবদ্ধতার অর্থ নিয়ে। আহলে বাইতের অনুসারী আলেমগণ ‘ওয়ালি’ শব্দটি যে এই আয়াতে বন্ধু বা সাহায্যকারী হিসেবে ব্যবহৃত হয়নি তা প্রমাণ করতে حصر (সীমাবদ্ধতা) এর অর্থকে দলীল হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। কেননা এটা হতে পারেনা যে ওয়ালি শব্দটি বন্ধু বা সাহায্যকারী অর্থে শুধুমাত্র আল্লাহ, তাঁর রাসূল (সা.) এবং কিছু সংখ্যক মুসলমান যারা নামাযরত অবস্থায় যাকাত প্রদান করেছে তাদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে। কেননা আল্লাহ তাআলা বলেছেন : সকল মুমিন অবশ্যই একে অন্যের সাহায্যকারী ও শুভাকাংখী। গবেষক তুসীর দলীল প্রমাণভিত্তিক বর্ণনায়ও এ দিকটিই ফুটে উঠেছে। অর্থাৎ তিনিও এই আয়াতটিকে তার মতের সপক্ষে প্রমাণ হিসেবে পেশ করার জন্য «انّما» শব্দটিকে حصر (সীমাবদ্ধ) এর অর্থে গ্রহণ করেছেন।

"وَالْمُؤْمِنُونَ وَالْمُؤْمِنَاتُ بَعْضُهُمْ أَوْلِيَاءُ بَعْضٍ" অর্থাৎ সকল মুসলমান নরনারী পরস্পর পরস্পরের সাহায্যকারী। (সূরা আত-তওবাহ, আয়াত নং-৭১)

ফখরুদ্দীন রাযী, তাফতাজানী এবং মোল্লা আলী কুশচীর ন্যায় আহলে সুন্নাতের বিশিষ্ট আলেমগণ আলোচ্য আয়াতে ওয়ালি শব্দটির অর্থ যে বন্ধু অথবা সাহায্যকারী তা প্রমাণ করার জন্য ইন্নামা শব্দটি حصر বা সীমাবদ্ধতা নির্দেশক হওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেছেন। কুশচী লিখেছেন :

নিশ্চয় حصر (সীমাবদ্ধতা) শুধুমাত্র কোন বিষয়ে বিদ্যমান সংশয় বা বিবাদকে দূরীভূত করার উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়। আর যেহেতু এই আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার সময় খেলাফত ও নেতৃত্বের বিষয় নিয়ে কোন সংশয় বা বিবাদই ছিলনা যে حصر (সীমাবদ্ধতা) নির্দেশক শব্দ দ্বারা তার অবসান ঘটানো হবে। (তাফতাজানী, শারহে মাকাছেদ ফি ইলমিল কালাম, ৩য় খণ্ড, পৃ-৫০২; কুশচী, শারহু তাজরীদিল আকায়িদ, পৃ-৩৬৮।)

ফখরুদ্দীন রাযীও তার নিজের দাবীকে প্রমাণ করার জন্য পবিত্র কোরআনের দুটি আয়াতকে দলীল হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। তিনি দাবী করেছেন যে এই দুই আয়াতে ইন্নামা সীমাবদ্ধতার অর্থে ব্যবহৃত হয়নি। তিনি তার মাফাতিহুল গাইব তাফসীরগ্রন্থে আলোচ্য আয়াতটি সম্পর্কে লিখেছেন :

“ইন্নামা শব্দটি সীমাবদ্ধতার অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে তা আমরা মানিনা। তার প্রমাণ আল্লাহ তাআলার বাণী-

 « إِنَّمَا مَثَلُ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا كَمَاءٍ أَنْزَلْنَاهُ مِنَ السَّمَاءِ » অর্থাৎ নিশ্চয় পার্থিব জীবনের উপমা সেই পানির মত যা আমি আসমান থেকে বর্ষণ করি। (সূরা ইউনুস, আয়াত নং-২৪।) নিঃসন্দেহে পার্থিব জীবনের জন্য এই উপমা ব্যতিত অন্য উপমাও রয়েছে (অর্থাৎ দুনিয়ার উদাহরণ শুধুমাত্র এই এক দৃষ্টান্তের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়)। তেমনি মহান আল্লাহ অন্যত্র বলেছেন-« إِنَّمَا الْحَيَاةُ الدُّنْيَا لَعِبٌ وَلَهْو» অর্থাৎ পার্থিব জীবন তো কেবল খেলাধূলা ও আমোদ প্রমোদ। (সূরা মুহাম্মদ : ৩৬।) অথচ নিঃসন্দেহে পার্থিব জীবন ছাড়াও অন্য স্থানে খেলাধূলা ও আমোদ প্রমোদ হতে পারে।”

সমালোচনা ও পর্যালোচনা :

ফখরুদ্দীন রাযী ও কুশচী ইন্নামা শব্দটির সীমাবদ্ধতার অর্থ শর্তহীনভাবে অস্বীকার করেননি বরং তারা এ শব্দটির সীমাবদ্ধতার অর্থকে সবসময়ের জন্য মনে করেন না। তারা মনে করেন তা বিশেষ ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতার অর্থে ব্যবহৃত হয়।

তবে ফখরুদ্দীন রাযীর এই বক্তব্য ঠিক নয় কারণ ইন্নামা সব সময় এবং সব ক্ষেত্রেই অপরিহার্য ভাবে সীমাবদ্ধতার অর্থ দেয়। কেননা :

 প্রথমত : সর্ব সম্মতভাবে «انّما» (ইন্নামা) সবসময়ই হাসরের (সীমাবদ্ধতার) অর্থে ব্যবহৃত হয়। অলংকার শাস্ত্রের সমস্ত গ্রন্থসমূহে «ادوات حصر» অর্থাৎ সীমাবদ্ধসূচক অব্যয় সমূহের অলোচনায় «انّما» কে তারই একটা প্রকার হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। (সাক্কাকী, মিফতাহুল উলুম, পৃ. ১৩০; তাফতাজানী, মুখতাসারুল মাআনী, পৃ. ১৮০)। এমনকি নাহু শাস্ত্রে (আরব ব্যাকরণের একটি শাখা) “কখন مبتدا (উদ্দেশ্য) অথবা خبر (বিধেয়) কে পরে নিয়ে আসা অপরিহার্য' এবং “কখন  فاعل (কর্তা) অথবা مفعول কে (কর্মবাচক পদ) পরে নিয়ে আসা অপরিহার্য” শীর্ষক আলোচনায় «محصور فیه» বা কোন কিছুর মধ্যে সীমাবদ্ধ হওয়াকে পরে আসার কারণ হিসেবে বলা হয়েছে এবং ইন্নামাকে এর উদাহরণ হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছে।

দ্বিতীয়ত : অলংকার শাস্ত্রবিদগণ দ্ব্যর্থহীনভাবে ঘোষণা করেছেন যে, ইন্নামা হাসর বা সীমিতকরণের জন্য প্রণীত হয়েছে। অলংকারশাস্ত্রের কোন কোন গ্রন্থে সীমাবদ্ধসূচক অব্যয়গুলোর মধ্যকার পার্থক্যে বলা হয়েছে : “ইন্নামা শাব্দিক ক্ষেত্রে হাসর বা সীমাবদ্ধতা নির্দেশ করে।” (জুরজানী, আল ইশারাত ওয়া আত তানবিহাত ফি ইলমুল বালাগা,পৃ-৮১; হাশেমী, জাওয়াহেরুল বালাগা, পৃ. ১৫২।) অনুরূপভাবে বলা হয়েছে “কাসর” (সীমিতকরণ) ইন্নামা দ্বারা প্রকাশ করাই অধিক উপযুক্ত।

ইন্নামা আতফের (সংযোজন) বিপরীতে কোন কিছুর জন্য কোন বৈশিষ্ট্যকে প্রমাণ করার সাথে সাথেই অন্যদের জন্য তা থাকার সম্ভাবনাকে বাতিল করে। এর বিপরীতে যে সমস্ত হরফে আতফ (সংযোজনসূচক অব্যয়) হাসরের অর্থ দেয় তা থেকে প্রথমে কোন কিছুর কোন একটি বৈশিষ্ট্য থাকার বিষয়টি বোঝা যায় পরে অন্যদের যে তা নেই তা স্পষ্ট হয় অথবা প্রথমে অন্যদের থেকে ঐ বৈশিষ্ট্য নাকচ করে পরে তার জন্য তা প্রমাণ করে। (তাফতাজানী, আল মুতাওয়াল, পৃ. ৪১; জুরজানী, আল ইশারাত ওয়াত তানবিহাত ফি ইলমিল বালাগা, পৃ. ৮১; হাশেমী, জাওয়াহেরুল বালাগা, পৃ. ১৫২।)

পরিশেষে আমরা এ সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি যে, “ইন্নামা”কে হাসর নির্দেশ করার জন্যই প্রণয়ন করা হয়েছে, এমনকি অন্যান্য সীমাবদ্ধতা নির্দেশের ক্ষেত্রে তা অন্যান্য সীমাবদ্ধতাসূচক অব্যয়গুলোর থেকেও শক্তিশালী। এই কারণে কোন কোন বাক্যে ইন্নামা “সীমাবদ্ধতা” অর্থ দান করে না- এ দাবি আরবি ব্যাকরণের রীতিবিরুদ্ধ। আর তাই কোন ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা অর্থ না দিলে তা এর প্রকৃত «حقیقی» অর্থের পরিপন্থী বিধায় এ ধরনের বাক্যের সাথে অবশ্যই সমর্থক কোন দলীল «قرینه» ও প্রমাণ থাকা প্রয়োজন। আর যখন তা না থাকবে তখন প্রকৃত অর্থেই তা ব্যবহৃত হয়েছে ধরতে হবে, রূপক অর্থে গ্রহণের কোন সুযোগ নেই।

সুতরাং ফখরুদ্দীন রাযীর যুক্তি সঠিক নয় তিনি ভ্রমাত্মক যুক্তি প্রদর্শন করেছেন। কেননা হাসর দুই প্রকার, অথচ তিনি মনে করেছেন এক প্রকার।

মা’আনী ও বায়ান (অলংকার শাস্ত্রের দুটি শাখা) শাস্ত্রবিদগণ দ্ব্যর্থহীন ভাবে ঘোষণা করেছেন যে, হাসর দুই প্রকার। এক. হাসরে হাক্বিকী (প্রকৃত হাসর)। দুই. হাসরে গায়রে হাক্বিকী (অপ্রকৃত হাস)। (তাফতাজানী, শারহে আল-মুখতাসার, পৃ. ১৭৩)

হাসরে হাক্বীকি সকল বাস্তব দৃষ্টান্তকে অন্তর্ভুক্ত করে বলে একটি সর্বজনীন বিষয় কিন্তু হাসরে গায়রে হাক্বীকি আপেক্ষিক এবং তা কোন বিশেষ ব্যক্তি বা গোষ্ঠির মধ্যে সীমাবদ্ধতা নির্দেশে ব্যবহৃত হয়। যেমন যখন কোন ব্যক্তি ধারণা করছে, আমরও যায়েদের সাথে এসেছে তখন তাকে যদি বলা হয় «انّما جاء زید» এর অর্থ দাঁড়াবে শুধু যায়েদ এসেছে তার সাথে আমর আসেনি কিন্তু তার অর্থ এটা নয় যে, যায়েদ ছাড়া অন্য কেউই আসেনি। অতএব এরূপ ক্ষেত্রে কেবল আমর যে আসেনি এটা নিশ্চিত করার জন্য انّما দ্বারা একদিকে যাইদের আসাকে সমর্থন করা হয়েছে অপর দিকে আমরের আগমনকে নাকচ করা হয়েছে।

উল্লিখিত দুটি আয়াতে কাসরে গায়রে হাক্বীকি অথবা ইবনে হিশামের ভাষায় কাসরে মোকাইয়্যাদ (ইবনে হিশাম আনসারী, মুগনি আল লাবিব আন কুতুবিল আ’আরিব, ১ম খণ্ড, পৃ. ৬২) ব্যবহৃত হয়েছে। এমন নয় যে তাতে কোন হাসরই ব্যবহৃত হয়নি।

«انّما الحیاة الدنیا لعب و لهو» অর্থাৎ পার্থিব জীবন তো কেবল খেলাধূলা ও আমোদ প্রমোদ। একই বিষয় বস্তু সম্পর্কিত আয়াত পবিত্র কোরআনে «ما النافیة» অর্থাৎ না বোধক ‘মা’ এবং “ইল্লা” যা حروف استثناء (বা ব্যতিক্রম সূচক অব্যয়) সহযোগে ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন মহান আল্লাহ বলেছেন :

 «و ما الحیاة الدنیا الا لعب و لهو» পার্থিব জীবন তো কেবল খেলাধুলা ও আমোদ প্রমোদ। (সূরা আনআম, আয়াত-৩২) ফখরুদ্দীন রাযি এখানে হাসরকে অস্বীকার করতে পারেননা এমনকি এ আয়াত দ্বারা তার যুক্তিও খণ্ডন করা হয়েছে। কেননা না বোধক অব্যয় «لا و ما» যখনই ইস্তিসনা অর্থাৎ ব্যতিক্রমসূচক কোন অব্যয়ের সাথে আসে তখন স্পষ্টতই তা সীমাবদ্ধতার অর্থ দেয়।

অনুরূপভাবে ফখরুদ্দীন রাযি সূরা আনআমের পবিত্র এই আয়াতে হাসরের বা সীমাবদ্ধতার অর্থকে সঠিকভাবে করেননি। কেননা উল্লিখিত আয়াতটিতে «محصور فیه»   (অর্থাৎ যার মধ্যে সীমাবদ্ধ করা হয়েছে) হল لعب و لهو । ফখরুদ্দীন রাযি যে অর্থ করেছেন তার দিকে লক্ষ্য করলে দেখতে পাই যে, তিনি «حیاة الدنیا» পার্থিব জীবনকে «محصور فیه»  ধরেছেন। কিন্তু সমস্ত অলংকার শাস্ত্রবিদগণ বলেছেন “ইন্নামা” এর মাহসূর ফি সবসময় বাক্যের শেষে আসে। (তাফতাজানী, আল মুতাওয়াল, পৃ. ৪১; জুরজানী, আল ইশারাত ওয়াত তানবিহাত ফি ইলমিল বালাগা, পৃ. ৮১; হাশেমী, জাওয়াহিরুল বালাগা, পৃ. ১৫২) অতএব এ আয়াতের সঠিক অর্থ হচ্ছে- দুনিয়া শুধু খেলাধুলা ও আমোদ ফুর্তির।

 আবু হাইয়্যানও ফখরুদ্দীন রাযির ন্যায় যামাখশারীর প্রতি আপত্তি জানিয়েছেন।

 قُلْ إِنَّمَا يُوحَى إِلَيَّ أَنَّمَا إِلَهُكُمْ إِلَهٌ وَاحِدٌ

‘বলুন আমাকে তো এ আদেশই দেয়া হয়েছে, তোমাদের উপাস্যই একমাত্র উপাস্য’ (সূরা আম্বিয়া : ১০৮)

এ আয়াতের ব্যাপারে যামাখশারী বলেছেন: «أنما» (আন্নামা)«إنما» (ইন্নামা)র মতই হাসরের অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। এই আয়াতে আন্নামা গুণিতের «موصوف» জন্য সিফাত বা গুণকে সীমাবদ্ধ করার জন্য ব্যবহৃত হয়েছে এবং ইন্নামা সিফাতের জন্য মাউসূফ বা গুণিতকে সীমাবদ্ধ করার জন্য ব্যবহৃত হয়েছে। (যামাখশারী, আল কাশিফ আন হাক্বায়িকি গাওয়ামিজিত তানযিল, পৃ. ১৩৯)। আবু হাইয়্যান, যামাখশারীর এই বক্তব্যকে প্রত্যাখান করে বলেছেন- আন্নামাও ইন্নামার ন্যায় হাসরের প্রতি ইঙ্গিত করে এটা শুধু যামাখশারী বলেছেন যা অন্য কেউ বলেননি।

আবু হাইয়্যান আরো বলেছেন: যদি এই আয়াতে হাসর থেকে থাকে, তাহলে অর্থ হবে যে, তাওহীদ (আল্লাহর একমাত্র উপাস্য হওয়ার বিষয়) ছাড়া নবী (সা.) এর নিকট অন্য কোন বিষয়ে ওহী আসেনি অথচ নবী (সা.) এর নিকট তাওহীদ ছাড়া অন্য বিষয়েও ওহী এসেছে।

ইবনে হিশাম আনসারী যামাখশারীর পক্ষ অবলম্বন করে আবু হাইয়্যান এর যুক্তিকে প্রত্যাখ্যান করে লিখেছেন : আবু হাইয়্যানের এই বক্তব্য ঠিক নয়, কেননা এই আয়াতে “হাসরে মোকাইয়্যাদ” রয়েছে এবং আয়াতের অর্থ হবে : প্রভুত্ব ও রুবুবিয়্যাতের ব্যাপারে তাওহীদ (আল্লাহর একত্ব) ছাড়া আমার প্রতি কোন ওহী নাযিল হয়নি। এমন কাসরকেকে কাসরে ক্বালব বলা হয়। কেননা শ্রোতার আস্থা এবং বিশ্বাসকে পরিবর্তন করে (কারণ মুশরিকরা ধারণা করত মানুষের ওপর তাদের উপাস্য মুর্তিগুলোরও প্রভুত্ব রয়েছে, এ আয়াতে তাদের এ বিশ্বাসকে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে)। (ইবনে হিশাম আনসারী, মুগনি আল লাবিব আন কুতুবিল আ’আরিব, ১ম খণ্ড, পৃ-৬২)।

ইবনে হিশাম এমন একটি খণ্ডনমূলক উত্তরও দিয়েছেন যা স্পষ্টভাবে আবু হাইয়্যানের যুক্তিকে ভুল প্রমাণ করে। তিনি পবিত্র কোরআনের একটি আয়াতের উল্লেখ করেছেন যাতে না বাচক ‘মা’ এবং ‘ইল্লা’ ব্যবহৃত হওয়া সত্ত্বেও সার্বিকভাবে সীমাবদ্ধতা নির্দেশ করে না। তিনি বলেছেন:

« وَمَا مُحَمَّدٌ إِلَّا رَسُولٌ »

অর্থাৎ মুহাম্মদ রাসূল ছাড়া কিছুই নয়। (সূরা আলে ইমরান : ১৪৪)

এই আয়াতে না বাচক ‘মা’ «ما النافیة» এবং ‘ইল্লা’ নিঃসন্দেহে হাসরের জন্য ব্যবহৃত হয়েছে। অথচ আমরা জানি যে মহানবীর (সা.) সিফাত শুধুমাত্র রেসালাতের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। এতদসত্বেও হাসর ব্যবহার করা হয়েছে। (ইবনে হিশাম, প্রাগুক্ত) সুতরাং এখানে হাসরে মোকাইয়্যাদ বা আপেক্ষিক সীমাবদ্ধতা নির্দেশিত হয়েছে। তেমনি সুরা আহযাবের ৪০নং আয়াতেও «ما النافیة» এবং لکن আপেক্ষিক সীমাবদ্ধতা নির্দেশ করছে অর্থাৎ হযরত মুহাম্মদ (সা.) তোমাদের মধ্যকার কোন পুরুষের পিতা নন, বরং তিনি আল্লাহর রাসূল এবং সর্বশেষ নবী।

যেমনটি পরিলক্ষিত হয় যে, যামাখশারীর প্রতি আবু হাইয়্যানের আপত্তি কোনভাবেই ধোপে টেকে না।

তাফতাজানী এবং কুশচীর বক্তব্যও সঠিক নয়। কেননা হাসর সব সময় বিদ্যমান কোন বিষয় ও বাস্তবে অস্তিত্বমান কিছুকে প্রত্যাখ্যান করতে ব্যবহৃত হয়না। বরং কখনও কখনও ভবিষ্যতে দ্বিধা-সংকোচ বা বিবাদের সৃষ্টি করতে পারে এমন সম্ভাবনাকে প্রতিরোধ করার জন্য ব্যবহার করা হয়; অর্থাৎ যদি কোন ব্যক্তি তার বক্তব্যের বিষয়বস্তু নিয়ে ভবিষ্যতে দ্বিধা-সংকোচ বা বিবাদ সৃষ্টির আশংকা করে, তবে এরূপ ক্ষেত্রেও সে হাসর ব্যবহার করতে পারে। এটা অন্যভাবেও বলা যায় যে, হাসর কখনও সন্দেহকে দূরীভূত করার জন্য আবার কখনও তাকে প্রতিরোধ করার জন্য ব্যবহার করা হয়। এই পরিপ্রেক্ষিতে মা’আনী ও বায়ান শাস্ত্রবিদগণ মত দিয়েছেন যে, হাসর ব্যবহারের জন্য সন্দেহের অবকাশ ও সম্ভাবনা থাকাই যথেষ্ট, বাস্তবে সন্দেহের অস্তিত্ব থাকতে হবে এমন কথা নেই।

বেলায়াত সম্পর্কিত আয়াতে সম্ভাব্য দ্বিধা-সংকোচ বা সন্দেহ প্রতিরোধ করার জন্য হাসর ব্যবহৃত হয়েছে। কারণ আল্লাহ তাআলা ভালভাবেই জানতেন যে ভবিষ্যতে খেলাফত নিয়ে সংশয় ও দ্বিধার সৃষ্টি হবে তাই এই আয়াতে হাসর ব্যবহার করেছেন।

সুতরাং এই বিষয়ে কুশচীও ভুলের শিকার হয়েছেন কারণ তিনি মনে করেরেছন যে, হাসরকে কেবল বিদ্যমান দ্বিধা, সন্দেহ, ইচ্ছাকৃত উপেক্ষা ও উদাসীনতা দূরীভূত করার ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয় অর্থাৎ তিনি হাসরকে, হাসরে রাফয়ি «رفعی» বা প্রতিহতকারী অর্থের মধ্যে সীমাবদ্ধ করেছেন।

এই ভ্রান্তধারণার আরেকটি জবাব হল যে, বালাগাত শাস্ত্রবিদগণ “ইন্নামা” এবং অন্যান্য সীমাবদ্ধসূচক অব্যয়গুলির মধ্য পার্থক্য করেছেন। তারা বলেছেন “ইন্নামা” ঐ সকল ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয় যেখানে শ্রোতা কোন বিষয়ের আবশ্যকতা সম্পর্কে অজ্ঞ নয় বা অস্বীকারকারীও নয় বরং তাকে সচেতন এবং স্মরণ করিয়ে দেয়ার জন্য ব্যবহার করা হয় যেন শ্রোতা তার গুরুত্ব সম্পর্কে অবহিত হয় ও তার প্রতি নিবেদিত থাকে। (জুরজানী, আল-ইশারাত ওয়াত তানবিহাত ফি ইলমিল বালাগা : পৃ. ৮২)

 এই বর্ণনা অনুযায়ী বলা যেতে পারে যে, এই আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার সময় সকল মুসলমান জানতেন যে “ওয়ালি” পদটি আল্লাহ, তাঁর রাসূল এবং হযরত আলী (আ.) এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ। তার পরেও আল্লাহ তাআলা মুসলমানদেরকে স্মরণ করিয়ে দেয়ার জন্য এই আয়াতে “ইন্নামা” ব্যবহার করেছেন যেন মুসলমানেরা তাদের জ্ঞাত এই বিষয়টির আবশ্যক দাবিগুলো পূরণ করে।

তৃতীয় : আহলে সুন্নাতের কিছু কিছু আলেম, যেমন- যামাখশারী (যামাখশারী, আল কাশশাফ আন হাকায়েক ওয়া গাওয়ামেজুত তানযিল, ১ম খণ্ড, পৃ. ৬৪৮) বলেছেন যে “ইন্নামা” এই আয়াতে সীমাবদ্ধতার অর্থেই ব্যবহৃত হয়েছে ।

«و هم راکعون» বাক্যটির এরাব «اعراب»  বা পদচিহ্ন :

আলেমদের মধ্যে আরেকটি বাকরণগত মতবিরোধ হচ্ছে «و هم راکعون» বাক্যটির এ’রাব নিয়ে। তাফতাজানী এবং কুশচী এই বাক্যটির এ’রাব সম্পর্কে বলেছেন :

আয়াতে উল্লিখিত গুণাবলী হযরত আলী (আ.) এর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকার অর্থ হচ্ছে «و هم راکعون» (হুম রাকেউন) বাক্যটি «یؤتون» ক্রিয়াটির মধ্যে নিহিত ضمیر (সর্বনাম) টির حال (অবস্থাসূচক বাক্য) যদিও এই তারকিব ওয়াজিব নয়। এটি তার পূর্ববর্তী বাক্যের সাথে عطف (সংযোজিত)ও হতে পারে, এই অর্থে যে মুসলমানরাও তাদের নামাজে রুকু করে অর্থাৎ তাদের নামাজ ইয়াহুদিদের মত রুকু বিহীন নয়।

তাফতাজানী এবং কুশচীর এই বক্তব্য সঠিক নয়। নিম্নোক্ত কারণে এই বাক্যটি অবস্থাসূচক বাক্য এবং «واو» টি অবস্থাসূচক অব্যয়।

১. « هم راکعون » যদি আতফ্ হয় তাহলে এক্ষেত্রে দুটি মৌলিক নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটেছে আর এক বাক্যে দুই মৌল নীতির ব্যতিক্রম ঘটা ব্যাকরণশাস্ত্রের রীতিবিরুদ্ধ ও বাগ্মিতার পরিপন্থী হিসাবে জায়েজ ও বৈধ নয়। বিশেষ করে পবিত্র কোরআনের -সাহিত্যিকমান ও আলংকারিক (বালাগাত ও ফাসাহাত) দৃষ্টিতে যার অবস্থান শীর্ষ চূড়ায়- মধ্যে এমন বিষয় থাকা অসম্ভব। (ইবনে হিশাম আনসারী, প্রাগুক্ত, ১ম খণ্ড, পৃ. ৩২৯) এ দু’টি পরিপন্থী নীতি হল :

ক. جملة اسمیة (যে বাক্যের প্রথমে ইসম বা বিশেষ্য থাকে), جملة فعلیة (যে বাক্যের প্রথমে ফেল বা ক্রিয়া থাকে) এর সাথে আতফ বা সংযুক্ত হয়েছে। কেননা নাহুশাস্ত্রবিদগণের মতে, আতফের নিয়ম হল দুটি বাক্যের রূপ একই রকম হওয়া। (সূয়ুতী, আল বাহজাতুল মারজিয়াহ ফি শারহিল আলফিয়া, পৃ-১০৪)

খ. « هم راکعون » বাক্যটিকে আতফ ধরলে এর পূর্বে «یقیمون الصلاة» বাক্যটির উল্লেখ থাকায় পুনরাবৃত্তি ঘটছে অথচ নিয়ম হল পুনরাবৃত্তি না হওয়া (অর্থাৎ নামাজের পর তার একটি অংশ রুকুর উল্লেখ বাচালতার শামিল বলে মানানসই নয়)। (সাইয়েদ মুরতাজা, আশ-শাফী ফিল ইমামাহ, ২য় খণ্ড, পৃ.-২৩৭)

 

২. আহলে বাইতের অনুসারী ও আহলে সুন্নাতের সূত্রে এই আয়াত সম্পর্কিত যে সব রেওয়াইয়াত বর্ণিত হয়েছে তা স্পষ্টভাবে ইঙ্গিত করছে “ওয়াও” حالیة (অবস্থাসূচক) অব্যয়। শেখ হুররে আমেলী উল্লিখিত বিষয়ে উভয় সূত্র থেকে বর্ণিত হাদীসসমূহ বর্ণনা করেছেন। (হুররে আমেলী, ইছবাতুল হুদা, ৩য় খণ্ড, পৃ. ১৪১।) এসব হাদীসের কোন কোনটিতে এভাবে বলা হয়েছে : আলী (আ.) রুকু অবস্থায় যাকাত দিয়েছেন। (রাযী, মাফাতিহুল গাইব, ১২তম খণ্ড, পৃ.৩৮৩; সূয়ুতী, আদ্ দুররুল মানসূর ফি তাফসীরিল মা’ছুর, ২য় খণ্ড, পৃ. ২৯৩) অন্য আরেক রেওয়ায়েতে আরো সুন্দর ও স্পষ্টভাবে বর্ণনা করা হয়েছে নবী করীম (সা.) ভিক্ষুককে জিজ্ঞাসা করলেন: “আলী কি অবস্থায় তোমাকে দান করেছে?” ভিক্ষুক বলল: “রুকু অবস্থায়।” (সূয়ুতী, পৃ.-৩৯৪; তাবারী, দালায়িলুল ইমামাহ, পৃ.-৫৪) নাহু শাস্ত্রবিদগণ বলেছেন: কোন ব্যক্তির অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে তার উত্তরে حال আসে। এই হাদীসে রাসূল (সা.) হযরত আলী (আ.) এর আংটি দান কালীন অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে ভিক্ষুক বলল: “রুকু অবস্থায়”। সুতরাং « و هم راکعون» বাক্যটি جملة حالیة (অবস্থাসূচক বাক্য)।

৩. যামাখশারীও তাফসীরে কাশ্শাফে বলেছেন: “ওয়াও” حالیة বা অবস্থাসূচক অব্যয়। আহলে সুন্নাতের অন্যান্য গবেষক ও মুফাচ্ছিরগণও স্বীকার করেছেন যে এ বাক্যটি حالیة। (রাযী, ১২তম খণ্ড, পৃ.-৩৮৫; আলুসী, রুহুল মাআনী ফি তাফসীরিল কোরআনিল আযিম, ৫ম খণ্ড, পৃ.- ৪৫৮; ছাআলাবী, আল জাওয়াহিরুল হাসান, ১ম খণ্ড, পৃ.-৪৩৮; দারউইশ, এরাবুল কোরআন ওয়া বায়ানুহু, ২য় খণ্ড, পৃ.-৫০৮; ছাফী, আল জাদওয়াল ফি এরাবিল কোরআন, ৬ষ্ঠ খণ্ড, পৃ.-৩৮৬; বায়দ্বাভী, আনওয়ারুত তানযিল ওয়া আসরারুত তা’বিল, ২য় খণ্ড, পৃ.-১৩২)

আহলে বাইতের অনুসারীদের তাফসীর গ্রন্থসমূহে লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে, “ওয়াও” حالیة হওয়ার ব্যাপারে সকলেই একমত। (তাবাতাবাই, আল-মিযান ফি তাফসীরিল কোরআন, ৬ষ্ঠ খণ্ড, পৃ.-১২; তাবারসী, মাজমাউল বায়ান, ৩য় খণ্ড, পৃ.-৩২১; কাশানী, মিনহাজুস সাদেকীন, ৩য় খণ্ড, পৃ.-২৫৫)

৪. ইসলামী যুগে এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে কবিতাও রচিত হয়েছে, ঐসব কবিতায় লক্ষ্য করলে দেখা যায় তারাও এই বাক্যকে حال হিসেবে ধরে নিয়েছেন। যা হাসসান বিন ছাবেত এর কবিতাতেও ফুটে উঠেছে, আল্লামা আমিনীও তার বিখ্যাত গ্রন্থ “আল গাদীরে” এ কবিতাটিকে আহলে বাইতের অনুসারী এবং সুন্নিদের বিভিন্ন সূত্র থেকে বর্ণনা করেছেন। ( আমিনী, আল গাদীর ফিল কিতাব ওয়াস সুন্নাহ ওয়াল আদাব, ৩য় খণ্ড, পৃ.-৬২; আলুসী, প্রাগুক্ত; হাসকানী, শাওয়াহেদুত তানযিল লে কাওয়ায়েদুত তাফযিল, ১ম খণ্ড, পৃ.-২১৪) কবিতাটি হচ্ছে :

ابا حسن تفدیک نفسی و مهجتی     وکل بطئ فی الهدی و مسارع

أیذهب مدحی و المحبین ضائعاً      و ما المدح فی ذات الاله بضائع

فأنت الذی اعطیت اذ انت راکع          فدتک نفوس القوم یا خیر راکع

হে আবা হাসান আমার জান প্রাণ তোমার জন্য উৎসর্গ হোক। আরও উৎসর্গ হোক তাদের প্রাণ যারা ধীর অথবা দ্রুত গতিতে হেদায়েতের পথে চলে।

আমার স্তুতি এবং প্রেমিকরা যদিও হারিয়ে কিংবা নষ্ট হয়ে যাবে? কিন্তু আল্লাহর কৃত প্রশংসা শেষ হবার নয়।

তুমিই তো রুকুরত অবস্থায় দান করে ছিলে। আমাদের সকলের প্রাণ তোমার জন্য উৎসর্গ হোক হে উত্তম রুকুকারী।

নাহুশাস্ত্রবিদগণ বর্ণনা করেছেন: অবস্থাসূচক বাক্যে واو এর পরিবর্তে (স্থান বা কালবাচক) اذ এরও ব্যবহার হতে পারে। (ইবনে হিশাম, ২য় খণ্ড, পৃ.-২৩) কবিতার শেষ লাইনেও «و انت» এর পরিবর্তে «اذ انت» ব্যবহৃত হয়েছে যা حال এর অর্থই দেয়। কেননা তখন অর্থ হবে : “রুকু করার সময় দান করেছ”।

৫. আলোচ্য আয়াতের সাথে «رایت زیدا و هو راکب» অর্থাৎ ‘আমি যায়েদকে দেখেছি এমতাবস্থায় যে সে আরোহী ছিল’ এমন বাক্য থেকে প্রথমেই যা মনে ভেসে উঠে তা হচ্ছে তা হচ্ছে و هو راکب বাক্যটি যায়েদের অবস্থা বর্ণনা করছে যে, সে আরোহী অবস্থায় আছে। (বাহরানী, আন-নাজাতু ফিল কিয়ামাহ ফি তাহকীকি আমরিল ইমামাহ, পৃ.-৯৬)

বহুবচন মূলক শব্দ একবচনের অর্থে ব্যবহার করা:

কেন বহুবচন মূলক শব্দকে একবচনের জন্য ব্যবহার করা হয়েছে? এর উত্তরে নিম্নোক্ত বিষয়গুলোর উল্লেখ করা যেতে পারে :

১. এ বিষয়টি শুধুমাত্র এ আয়াতেই নয় পবিত্র কোরআন ও হাদীসের পাঠ্যে অনেক স্থানেও একবচনের জায়গায় বহুবচনের শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। তন্মধ্যে মুবাহেলার আয়াত (আলে ইমরান:৬১) যেখানে হযরত আলী (আ.) এর জন্য বহুবচন «انفسنا» ও হযরত ফাতেমা (আ.) এর জন্যও বহুবচন «نسائنا» ব্যবহৃত হয়েছে। এরূপ আরো অনেক স্থানে এরূপ ভাষা প্রয়োগের দৃষ্টান্ত মুফাসসিরগণ উপস্থাপন করেছেন। আল্লামা আমিনী তার আল গাদীর গ্রন্থে প্রায় বিশটি আয়াত উল্লেখ করেছেন যেসব আয়াতে একবচনের জন্য বহুবচনের শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। (আমিনী, আল গাদীর, ৩য় খণ্ড, পৃ. ১৬৪)

২. যামাখশারী তাঁর ‘আল কাশশাফ’ তাফসীর গ্রন্থে এর কারণ হিসেবে বলেছেন:

অন্যদের এমন কাজে মানুষকে উৎসাহিত করার জন্য এই আয়াতে বহুবচন ব্যবহার করা হয়েছে। মানুষকে স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে যে, মুমিন ব্যক্তির বৈশিষ্ট্য এমনই হতে হবে যাতে করে তারা এরূপ ভাল কাজে আগ্রহী হয়ে উঠে এবং তা সম্পাদনে বিলম্ব না করে, যদি নামাজরত অবস্থায়ও থাকে। এমন ভালও মঙ্গলজনক কাজে যেন নামাজ শেষ হওয়ারও অপেক্ষা না করে। (যামাখশারী, কাশশাফ, ১ম খণ্ড, পৃ.-৬৪৯)

৩. আল্লামা তাবারসী মনে করেন : হযরত আলী (আ.) এর সম্মান ও শ্রেষ্ঠত্ব নির্দেশের জন্যই বহুবচনের শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। সম্মান ও শ্রেষ্ঠত্বের কারণে বহুবচনের শব্দ একবচনের স্থানে ব্যবহৃত হয় আর এটা ভাষাবিদদের নিকট একটি মামূলী ব্যাপার, সে জন্য কোন দলীল প্রমাণেরও প্রয়োজন হয়না। (তাবারসী, ৩য় খণ্ড, পৃ. ৩২৭)

অন্যান্য গ্রন্থেও এ বিষয়টি গুরুত্বের সাথে আলোচনা করা হয়েছে। (ফাখরুদ্দিন রাযী, প্রাগুক্ত; তুসী, আল-ইকতিসাদ ফিমা ইয়াতাআল্লাকু বিল ইতিকাদ, পৃ.-৩২৩; তাবাতাবাই, প্রাগুক্ত; মিনহাজুস সাদেকীন, প্রাগুক্ত; আলুসী, প্রাগুক্ত)

সূয়ুতী, আল-মাযহার গ্রন্থে লিখেছেন :

একজন শ্রোতার ক্ষেত্রে বহুবচনের শব্দ ব্যবহার করা এটা আরবদের একটা রীতি। যেমন কোন উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তিকে বলা হয়ে থাকে : «انظروا فی امری» অর্থাৎ আমার ব্যাপারে আপনারা খেয়াল রাখবেন এবং পবিত্র কোরআনেও এসেছে- «ربّ ارجعون»  হে আমার পালন কর্তা আমাকে আপনারা (পুনরায় দুনিয়ায়) ফিরে যেতে দিন। (সূয়ুতী, আল-মাযহার ফি উলুমিল লুগাহ ওয়া আনওয়ায়িহা, ১ম খণ্ড, পৃ.-৩৩৩; আল-আমিন, আযওয়াউল বায়ান ফি ইযাহিল কোরআন বিল কোরআন, ৫ম খণ্ড, পৃ.-৩৫৫; হালাবি, আদ-দুররুল মাসূন ফি ইলমিল কিতাবিল মাকনূন, ৫ম খণ্ড, পৃ.-২০০; ছাফী, প্রাগুক্ত, ১৮তম খণ্ড, পৃ.-২০৯)

৪. এই কারণে আহলে বাইতের অনুসারীদের বিভিন্ন গ্রন্থে যে সমস্ত রেওয়াইয়াত রয়েছে (কুলায়নি, উসূলে কাফি, ২য় খণ্ড, পৃ.-৩৯৭) এই আয়াত আহলে বাইতের ইমামদের সকলের ইমামতের প্রমাণ স্বরূপ। শুধু আলী (আ.) এর জন্যই নির্দিষ্ট নয় বরং সমস্ত ইমামের ইমামতকেই প্রমাণ করার জন্য। কিন্তু যেহেতু রাসূল (সা.) এর পর প্রথম খলিফা কে?- এ বিষয়টি নিয়ে মুসলিম উম্মাহর মধ্যে একটা মৌলিক মতবিরোধ রয়েছে। সেজন্য আহলে বাইতের অনুসারীদের পক্ষ থেকে শুধু আলী (আ.) এর খেলাফতকে প্রমাণ করার জন্যই এটা উপস্থাপন করা হয়। আর একবচনের স্থলে বহুবচনের ব্যবহার আরবি ভাষার নিয়মানুসারেই হয়েছে।

৫. হামল বার মা’না বা ভাবার্থের ওপর প্রয়োগ- এর নিয়ম অনুসারেও একবচনের ক্ষেত্রে বহুবচনের ব্যবহারের বিশুদ্ধতা প্রমাণিত হয়। এটি আরবি ব্যাকরণের একটি গুরুত্বপূর্ণ পদ্ধতি, আরবি সাহিত্যের বিভিন্ন গ্রন্থে এর অনেক দৃষ্টান্ত রয়েছে। উদাহরণ স্বরূপ: পুংলিঙ্গ কে স্ত্রীলিঙ্গ, আবার স্ত্রীলিঙ্গকে পুংলিঙ্গ, অনুরূপভাবে বহুবচনের শব্দ দ্বারা একবচনের উদ্দেশ্য আবার একবচনের শব্দ দ্বারা বহুবচনকে উদ্দেশ্য করা হয় এটা হামল বার মা’না এর নিয়মের অন্তর্ভুক্ত। (ইবনে জিন্নী, আল খাসায়িস, ২য় খণ্ড, পৃ.-৪১১) অর্থাৎ আরবি সাহিত্য ও ব্যাকরণে অনেক ক্ষেত্রেই সর্বনাম বা ইঙ্গিতবাচক বিশেষ্য «اسم اشارة» শব্দটি পূর্বের যে শব্দটিকে নির্দেশ করছে বচন ও লিঙ্গের ক্ষেত্রে তার অনুরূপ হয় না।

রুকুর প্রকৃত অর্থ :

কুশচীর পূর্বে আহলে সুন্নাতের আরো অনেক আলেম ও মনীষী “রুকু” কে বিনয়ী অর্থে ব্যবহার করার চেষ্টা করেছেন। যেন এর দ্বারা তারা দাবি করতে পারেন যে, এই সিফাত অর্থাৎ রুকু অবস্থায় যাকাত প্রদান একজন ব্যক্তির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয় বরং সকল মু’মিনই এর অন্তর্ভুক্ত। অথচ রুকুর প্রকৃত অর্থ বিনয়ী নয়। কেননা :

ভাষাবিদদের অনেকেই বলেছেন যে রুকুর প্রকৃত অর্থ হল “উপুড় হওয়া” বা “বাঁকা হওয়া”। যামাখশারী তার আসাসুল বালাগা গ্রন্থটিতে, যা শব্দের প্রকৃত অর্থ থেকে রূপক অর্থকে আলাদা করার জন্য নিমিত্তে রচনা করেছেন, লিখেছেন “রুকু” এর অর্থ হল “ঝুকে পড়া”।(যামাখশারী, আসাসুল বালাগ, পৃ.-১৭৬)

তাজুল আরুস (যুবাইদি, তাজুল আরুস মিন জাওয়াহিরুল ক্বামূস, ৫ম খণ্ড, পৃ.-৩৬২) এবং মাজমাউল বাহরাইন (তুরাইহী, মাজমাউল বাহরাইন, ৪র্থ খণ্ড, পৃ.৩৩৯) এর লেখকবৃন্দও বলেছেন রুকুর অর্থ বাঁকা হওয়া বা ন্যুব্জ হয়ে পড়া।

তাজুল আরুসে এভাবে এসেছে:«رکع الشیخ»   : এ বৃদ্ধ ব্যক্তি ন্যুব্জ হয়ে পড়েছে রুকুর প্রকৃত অর্থ এটিই আর এখান থেকেই নামাজের রুকুর অর্থ নেয়া হয়েছে।

ইবনে ফারেস লিখেছেন:

“রাকাআ” শব্দটি মানুষ ছাড়াও অন্যান্য যে কোন কিছুর ক্ষেত্রে উপুড় ও নত হওয়া অর্থে ব্যবহার করা হয়। প্রত্যেক বক্র ও নুব্জ বস্তুকে রুকুকারী বলা হয়। আর নামাজের রুকুর অর্থও এটাই। (ইবনে ফারেস, মুকায়িসুল লুগাহ, ২য় খণ্ড, পৃ. ৪৩৪)

রাগেব ইসফাহানীও বলেছেন যে, রুকুর অর্থ উপুড় হওয়া। (ইসফাহানী, মুফরাদাতু আলফাজিল কোরআন, ৩৬৪)

ফাইয়ুমি লিখেছেন: رکع رکوعا : উপুড় হওয়া, যে বৃদ্ধলোক বয়সের ভারে নূয়ে পড়েছে তাকে «رکع الشیخ» বলা হয় অর্থাৎ বয়স্ক লোকটি বাঁকা হয়ে গেছে। (ফাইয়ুমি, আল মিসবাহুল মুনির, পৃ.-২৩৭)

অতএব প্রকৃত অর্থে রুকু হচ্ছে বিশেষ পদ্ধতিতে মাথা নোয়ানো আর ইসলামি শরীয়তেও তা এই একই অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। এই কারণে “বিনয়ী ও নমনীয়” হচ্ছে রুকুর রূপক অর্থ। (সাইয়েদ মুরতাজা, প্রগুক্ত, ২য় খণ্ড, পৃ.-২৩১) আর তাই কোন কারিনা অর্থাৎ সমর্থক দলীল বা রূপক অর্থ নির্দেশক সহযোগী প্রমাণ ছাড়া এ শব্দটিকে “বিনয়ী ও নমনীয়” অর্থে ব্যবহার করা ঠিক নয়।

বেলায়াতের আয়াতে “রুকু” যে তার রূপক অর্থ অর্থাৎ “বিনয়ী ও নমনীয়” অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে এমন কোন প্রমাণ নেই। সুতরাং রুকু তার প্রকৃত অর্থেই ব্যবহৃত হয়েছে।

ولی শব্দটির অর্থ :

আলোচ্য আয়াতে আহলে সুন্নাত এবং ইমামীয়া কালামশাস্ত্রবীদদের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হচ্ছে ولی শব্দটির অর্থ নিয়ে।

আহলে সুন্নাতের অনেক আলেম যেমন: ইজি এবং কুশচী (কুশচী, প্রাগুক্ত,পৃ.৩৬৮ ইজি, প্রাগুক্ত, পৃ.-৬০২) মনে করেন এই আয়াতে “ওয়ালি” শব্দটির অর্থ ‘কর্তৃত্বে ক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠতম’ নয়। কেননা :

প্রথম দলীল : আয়াতের অবস্থানজনিত ভাব বা বাচনিক ধারা

এই আয়াতের পূর্ববর্তী আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেছেন :

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَتَّخِذُوا الْيَهُودَ وَالنَّصَارَى أَوْلِيَاءَ بَعْضُهُمْ أَوْلِيَاءُ بَعْضٍ

অর্থাৎ হে মুমিনগণ তোমরা ইহুদী ও খ্রীষ্টানদেরকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করো না, তারা একে অপরের বন্ধু। (সূরা মায়েদা-৫১) “ওয়ালি” র অর্থ বন্ধু বা সাহায্যকারী। কেননা এই আয়াতে ইহুদী এবং খ্রীষ্টানদের সাথে বন্ধুত্ব করতে না করা হয়েছে সুতরাং “ওয়ালি” শব্দটি এখানে নেতৃত্ব বা ইমামত অর্থে ববহৃত হয় নি। বরং উদ্দেশ্য হল বন্ধু এবং সাহায্যকারী। অনুরূপভাবে পরবর্তী আয়াতে বলা হয়েছে:

وَمَنْ يَتَوَلَّ اللَّهَ وَرَسُولَهُ وَالَّذِينَ آمَنُوا فَإِنَّ حِزْبَ اللَّهِ هُمُ الْغَالِبُونَ

অর্থাৎ আর যারা আল্লাহ তার রাসূল এবং বিশ্বাসীদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করে, তারাই আল্লাহর দল এবং তারাই বিজয়ী। (মায়েদা-৫৬) এখানে تَوَلّ শব্দটির অর্থ বন্ধুত্ব এবং সাহায্যকারী, ইমামত নয়। সুতরাং আলোচ্য আয়াতের পূর্ববর্তী এবং পরবর্তী আয়াত থেকেও বোঝা যায় যে এই আয়াতের “ওয়ালি” র অর্থ বন্ধু এবং সাহায্যকারী। তাই এ ক্ষেত্রে গ্রহণ উপযুক্ত নয়।

তাদের বক্তব্যের সারমর্ম হল এই আয়াতের পূর্ব ও পরবর্তী আয়াতের বাচনিক রূপ ও ধারাই বলে দিচ্ছে যে, ওয়ালি শব্দের অর্থ বন্ধু এবং সাহায্যকারী আর তা ওয়ালি শব্দকে ইমামত বা কর্তৃত্ব অর্থে গ্রহণের যুক্তিকে প্রত্যাখ্যান করে।

দ্বিতীয় দলীল: হাসর অনুপস্থিত

হাসর দ্বিধা, সন্দেহ দূরীভূত করার জন্য ব্যবহার করা হয়। এটা স্পষ্ট যে এই আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার সময় খেলাফতের বিষয়টি উপস্থাপিত হয়নি এবং ইমামতের ব্যাপারে কোন বিতর্কও ছিলনা। অন্যদিকে এই আয়াতে “ইন্নামা” সীমাবদ্ধতার জন্যও ব্যবহৃত হয়নি। পূর্বেই এই আপত্তির জবাব দেয়া হয়েছে।

সমালোচনা ও পর্যালোচনা :

কুশচী “ওয়ালি” শব্দের আরেক অর্থ যে “কর্তৃত্বের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত” তা মেনে নিয়েছেন। এতদসত্বেও বলেছেন: ‘এই আয়াত সম্পর্কে যেসব যুক্তি প্রমাণ উপস্থাপিত হয়েছে তার ভিত্তিতে বলা যায় যে, তাতে ‘ওয়ালি’ শব্দটি এই অর্থে ব্যবহৃত হয়নি।’ কিন্তু তিনি তার মতকে প্রমাণে ব্যর্থ হয়েছেন। কেননা তার তিনটি দলীলই প্রত্যাখ্যাত।

প্রথম আপত্তির জবাব:

যদিও বেলায়াতের আয়াতে “ওয়ালি” শব্দটির অর্থ “কর্তৃত্বের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত” হয় তবুও পূর্ববর্তী আয়াতের সাথে অসামঞ্জস্য তো নয়ই বরং পরিপূর্ণ সামঞ্জস্য রয়েছে। কেননা মহান আল্লাহ তাআলা বেলায়েতের আয়াতের পূর্বে এরশাদ করেছেন:

হে মুমিনগণ, তোমাদের মধ্যে যে স্বীয় ধর্ম থেকে ফিরে যাবে, অচিরে আল্লাহ এমন এক সম্প্রদায় সৃষ্টি করবেন, যাদেরকে তিনি ভালবাসবেন এবং তারাও তাকে ভালবাসবে। তারা মুসলমানদের প্রতি বিনয়ী ও নম্র হবে এবং কাফেরদের প্রতি কঠোর হবে। তারা আল্লাহর পথে জেহাদ করবে এবং কোন তিরস্কারকারীর তিরস্কারে ভীত হবেনা। এটি আল্লাহর অনুগ্রহ তিনি যাকে ইচ্ছা দান করেন। আল্লাহ প্রাচুর্যদানকারী, মহাজ্ঞানী।

এই আয়াত হযরত আলী (আ.) এর শানে অবতীর্ণ হয়েছে। (শেখ মুফিদ, আল ইফসাহ ফি ইমামাতি আমিরিল মুমিনিন, পৃ.-১৩২) যেমনিভাবে হযরত আলী (আ.) উষ্ট্রের যুদ্ধে এব্যাপারে ঘোষণা দিয়েছেন এবং ইমাম বাকের ও ইমাম সাদেক (আ.) থেকে বর্ণিত অসংখ্য রেওয়ায়েতে এর সত্যতার প্রমাণ মেলে। (তাবারসী, প্রাগুক্ত, ২য় খণ্ড, পৃ.-৩২১) এই রেওয়াইয়াত আহলে সুন্নাতের বিভিন্ন সূত্রেও বর্ণিত হয়েছে। (রাযী, প্রাগুক্ত, পৃ.-৩৭৮) এই ব্যাপারে আহলে বাইতের অনুসারীদের সূত্রে বর্ণিত হাদীসসমূহ মুতাওয়াতির।

এই হাদীসের প্রতি লক্ষ্য করলে দেখতে পাওয়া যায় যে, এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা হযরত আলী (আ.) এর বেলায়াতের দিকেই ইঙ্গিত করেছেন এবং বেলায়াতের আয়াতে এ ব্যাপারে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছেন। সুতরাং বেলায়াতের আয়াতে ওয়ালি শব্দটিকে “কর্তৃত্বের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত” অর্থে গ্রহণ করলেও তার পূর্ববর্তী আয়াতের বাচনভঙ্গি বা ধারার সাথে সামঞ্জস্য রয়েছে।

ওয়ালি র প্রকৃত অর্থ :

،وِلاء، وِلایت، وَلایت وَلاء, ولی، مولی، اولی এই শব্দগুলো ولی শব্দমূল থেকে গৃহীত হয়েছে। মুকায়িসুল লুগাহ এর গ্রন্থকার ইবনে ফারেস বলেছেন ولی শব্দটির মূল হচ্ছে وَلی অর্থ-নিকটবর্তী।( ইবনে ফারেস, মুকায়িসুল লুগাহ, ৬ষ্ঠ খণ্ড, পৃ. ১৪১)

আল মিসবাহুল মুনির এর প্রণেতা ফাইয়ুমির মতেও ওয়ালি শব্দটির অর্থ নিকটবর্তী, কাছাকাছি।«ولی»   فعیل এর ওজনে (গঠনরূপে) فاعل (কর্তাবাচক) অর্থ দান করে। (ফাইয়ুমি, আল মিসবাহুল মুনির,পৃ. ৬৭২) ওয়ালি শব্দটির প্রকৃত ও আসল অর্থ হচ্ছে নিকটাত্মীয়, কাছাকাছি যা তার অন্যান্য অর্থ যেমন-কর্তৃত্বশীল, মুক্তকারী, চাচাতো ভাই, সাহায্যকারী, রক্ষক এবং বন্ধু এসবের সাথেও সামঞ্জস্যশীল।

আল্লামা রাগেব তার মুফরাদাত নামক অভিধানে লিখেছেন : ولي শব্দটির প্রকৃত অর্থ হল দুটি জিনিসের এমনভাবে পাশাপাশি অবস্থান যেন তাদের মাঝে কোন ফাঁক না থাকে। ‘ওয়ালি’ র অন্যান্য যেসব অর্থ তিনি উল্লেখ করেছেন সেগুলোকে তিনি এ অর্থের দিকেই প্রত্যাবর্তন করিয়েছেন। ( আল্লামা রাগেব ইসফাহানী, আল মুফরাদাত, পৃ.-৮৮৫)

জালাল উদ্দিন সূয়ুতীও «ولی ، یلی»  এবং তার থেকে নির্গত সকল শব্দকে «وقع بعد»  তার পরেই রয়েছে বা অবস্থান করছে অর্থ করেছেন। (জালাল উদ্দিন সূয়ুতী, আল বাহজাতুল মারজিয়্যাহ ফি শারহিল আলফিয়্যাহ, পৃ.-২৯, ৬১ ও ৯৮)

‘আত তাহকিক ফি কালামাতিল কোরআনিল কারিম’ এর রচয়িতা মনে করেন এ শব্দটির আসল অর্থ হল “পরস্পর সম্পর্ক যুক্ত দুটি জিনিসের পাশাপাশি অবস্থান”। আর এ শব্দটির অন্যান্য সকল অর্থকে এই অর্থের দিকে ফিরিয়ে দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন: ‘ওয়ালি শব্দটির জন্য অন্য যে সব অর্থ উল্লেখ করা হয়েছে যেমন- নিকটবর্তী, ভালবাসা, সাহায্য করা এবং অনুসরণ তা এই অর্থের থেকে উদ্ভূত আবশ্যিক ও অবিচ্ছেদ্য অর্থ। (মুস্তাফাভী, আত তাহকিক ফি কালামাতিল কোরআন আল কারিম, ১৩তম খণ্ড, পৃ.-২০২) 

প্রথমত: ওয়ালির যৌথ অর্থ রয়েছে অর্থাৎ একটা সামগ্রিক অর্থের (নৈকট্য ও সংযুক্তি) জন্য প্রণয়ন করা হয়েছে যার দৃষ্টান্ত রয়েছে যেগুলোর ওপর প্রযোজ্য হয়ে থাকে। উপরিউল্লিখিত কোন লেখকই ভালবাসা, সাহায্য করা, অনুসরণ এবং কর্তৃত্বের ক্ষেত্রে যোগ্যতম এসবকে ওয়ালির প্রকৃত অর্থ বলে উল্লেখ করেননি। (আর তাই এ অর্থগুলো গ্রহণের জন্য তার প্রতি নির্দেশক ও নির্দিষ্টকারী দলীল থাকতে হবে, তা না থাকলে ঐ অর্থ গ্রহণ বৈধ হবে না)।

দ্বিতীয়ত: এই শব্দের প্রকৃত অর্থের ব্যাপারে দুটি ভিন্ন রকমের দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। একদল নিকটবর্তিতাকে অন্যদল দুটি জিনিসের পাশাপাশি অবস্থানকে এই শব্দের প্রকৃত অর্থ বলেছেন এবং নিকটবর্তিতাকে এই পাশাপাশি অবস্থানের অপরিহার্য পরিণতি হিসাবে তার আবশ্যিক অর্থ বলে চিহ্নিত করেছেন।

দ্বিতীয় মতটিকেই অধিক যুক্তিযুক্ত বলে মনে হয় তবে নিকটবর্তিতাও মূল অর্থটির অন্যতম দৃষ্টান্ত। এই দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী ওয়ালি শব্দটির প্রকৃত অর্থ হচ্ছে পাশাপাশি দুটি জিনিসের এমনভাবে অবস্থান যেন তাদের মধ্যে কোন দূরত্ব না থাকে। অর্থাৎ দুটি জিনিস পরস্পরের সাথে এমনভাবে সংযুক্ত যেন অন্য কোন কিছুই তাদের মধ্যে না থাকে। যেমন যদি কয়েক ব্যক্তি পাশাপাশি বসে থাকে, তখন আমরা বলি যায়েদ সভার সামনের সারিতে বসে আছে আর যায়েদের পাশেই আমর এবং আমরের পাশেই বকর বসে আছে। (অর্থাৎ তাদের একে অপরের মধ্যে কোন ফাঁক নেই) এই কারণেই ولی শব্দটি قرب (নিকটবর্তিতা) এর ক্ষেত্রেও ব্যবহৃত হয়েছে। সেটা স্থানের ক্ষেত্রেই হোক আর অবস্তুক কোন সত্তার ক্ষেত্রেই হোক (যেমন কোন সম্মানিত ও মর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তির সাথে কারো ভাল সম্পর্ক আছে বুঝাতে তিনি তাঁর নৈকট্যপ্রাপ্ত বলা হয়ে থাকে)। এই নিকটবর্তিতার সম্পর্কের কারণেই বন্ধুত্ব, দায়িত্বলাভ, সাহায্যকারী, কর্তৃত্বশীল এবং এরূপ অন্যান্য অর্থে তা ব্যবহৃত হয়েছে, অর্থাৎ এ সকল অর্থেই (দুটি বস্তু বা বিষয়ের মধ্যে) এক ধরনের প্রত্যক্ষ সম্পর্ক ও সংযোগ রয়েছে। তাই ولی শব্দটি যেখানেই ব্যবহৃত হবে সেখানে বাক্যের অর্থনির্দেশক অভ্যন্তরীণ ও সংযুক্ত শাব্দিক দলীল এবং অবস্থা ও ভাবগত দলীলের ভিত্তিতে তার অর্থ খুজে বের করতে হবে। (মুতাহ্হারী, মাজমুএ আছার, ৩য় খণ্ড, পৃ.-২৫৫-২৫৬)

২. যেহেতু ولي و ولايت এর প্রকৃত অর্থ হল সংযুক্তি, সান্নিধ্য ও নিকটবর্তিতা, তাই আলোচ্য আয়াতে কর্তৃত্ব অর্থদানের সাথে পূর্ব ও পরবর্তী আয়াতের গৃহীত অর্থের (বন্ধু ও সাহায্যকারী) পার্থক্য বাচনভঙ্গি ও বর্ণনাধারার মধ্যে কোন ছেদ ঘটায়না। কেননা সমস্যা তখনই দেখা দিবে যখন ولایت একটি দ্ব্যর্থবোধক শব্দ হবে কিন্তু ইতি পূর্বেই প্রমাণিত হয়েছে যে, ولایت কোন দ্ব্যর্থবোধক শব্দ নয় বরং এর অভিন্ন অর্থ রয়েছে। তিনটি আয়াতেই সান্নিধ্য এবং নিকটবর্তিতার অর্থ রয়েছে। যদিও সংযুক্তি ও নৈকট্য নির্দেশকারী বস্তুর উদাহরণ ও দৃষ্টান্তের মধ্যে পার্থক্য বিদ্যমান কিন্তু একই ধারা ও ভাবার্থ নির্দেশের জন্য আয়াত তিনটির দৃষ্টান্তসমূহের মধ্যে এতটুকু ঐক্য থাকাই যথেষ্ট। মহান আল্লাহ তাআলা প্রথমে মুমিনদেরকে ইহুদী এবং খ্রীষ্টানদের সাথে সম্পর্ক স্থাপনের জন্য তাদের সান্নিধ্য লাভের চেষ্টা এবং তাদের নিকটবর্তী হওয়া থেকে নিষেধ করেছেন। ইহুদীদের সাথে এই সংযোগ ও সান্নিধ্য শুধুমাত্র বন্ধুত্বের ব্যাপারে অঙ্গিকারাবদ্ধ হওয়ার দ্বারা এবং পারস্পরিক সম্পর্ক জোরদার করার মাধ্যমেই সম্ভব। বেলায়াতের আয়াতেও মহান আল্লাহ তাআলা মুমিনদেরকে তাঁর এবং তাঁর রাসূল ও কিছু সংখ্যক মুমিনের সান্নিধ্যে যাওয়ার বা নিকটবর্তী হওয়ার আহবান জানিয়েছেন। কারণ আল্লাহর সান্নিধ্য কেবল তাঁর সৃষ্টিগত অনিবার্য (অলঙ্ঘনীয় প্রাকৃতিক) নিয়ম এবং মানুষের স্বাধীন ইচ্ছাশক্তির গণ্ডিতে নির্ধারিত শরীয়তের বিধি বিধানের প্রতি নিজেকে সমর্পিত করার মাধ্যমেই লাভ করা সম্ভব। তেমনিভাবে রাসূলের (সা.) রেসালাতকে মেনে নিয়ে এবং তার অনুসরণ করেই শুধু রাসূলের সান্নিধ্য লাভ করা যায়।

তেমনি ভাবে কর্তৃত্বের ক্ষেত্রে তাঁর মনোনীত ব্যক্তির অনুসরণ করা এবং তার আনুগত্যের পতাকাতলে একত্রিত হওয়ার মাধ্যমেই ঐ কর্তৃত্বশীল ব্যক্তির নিকটবর্তী হওয়া যায়। সুতরাং বন্ধু, সাহায্যকারী, অভিভাবক ও নেতা এদের সকলের ওপরেই বেলায়েত বা নৈকট্য ও সংযুক্তির বিষয়টি প্রযোজ্য। তবে এক্ষেত্রে তাদের মধ্যে যে পার্থক্য রয়েছে তা ঐ ব্যক্তির সাথে সম্পর্কের দৃষ্টিতে তাদের ঘনিষ্ঠতা ও প্রভাবের পর্যায়ের ভিন্নতা থেকে উদ্ভূত।

৩. যদি বেলায়তের আয়াতে ওয়ালি শব্দটির অর্থ কর্তৃত্বের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত এবং তার পরবর্তী আয়াতে সাহায্যকারী হয় তবুও তা অসঙ্গত ও আলাদা তো নয়ই বরং সঙ্গতিপূর্ণ। কেননা আল্লাহ তাআলা প্রথমেই বলেছেন: আল্লাহ, তাঁর রাসূল এবং মুমিনদের কিছুসংখ্যক ওয়ালি (কর্তৃত্বের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত) এবং পরবর্তী আয়াতে এরশাদ করেছেন: যারা আল্লাহ, তাঁর রাসূল এবং মুমিনদের সাহায্য করবে তারাই বিজয়ী হবে।

আয়াতের শুরুতে তিনি মুমিনদের একাংশের ইমামত ও বেলায়াতকে সত্যায়ন ও নিশ্চিত করেছেন অতপর পরের আয়াতে মুমিনদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন তাদেরকে সাহায্য করার জন্য। (সাইয়েদ মুরতাজা, প্রাগুক্ত, ২য় খণ্ড, পৃ.-২৩৫) যেভাবে রাসূল (সা.) গাদীরে খুমের ঘটনার সময় প্রথমে হযরত আলী (আ.) কে নিজের স্থলাভিষিক্ত হিসেবে পরিচিত করিয়েছেন, তারপর দোয়া করেছেন এবং বলেছেন: হে আল্লাহ যে আলীকে (আ.) সাহায্য করবে তুমি তাকে সাহায্য কর, আর যে তাকে অপদস্ত করতে চায় তুমিও তাকে অপদস্ত কর।

৪. তদুপরি যদি কোন ক্ষেত্রে কোন আয়াতের অন্তস্থ অর্থগত দলীলের সাথে তার পূর্ব ও পরের আয়াতের বর্ণনাধারাগত অর্থের বৈপরীত্য দেখা যায় তবে সেক্ষেত্রে আয়াতের অন্তস্থ অর্থগত দলীলকে বর্ণনাধারাগত অর্থের মিল থাকার নীতির «سیاق» ওপর প্রাধান্য দিতে হবে।   

সুতরাং এই আয়াতে ওয়ালি শব্দটি কর্তৃত্বের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে, এব্যপারে শেখ তুসীর যুক্তি প্রমাণই সঠিক।

 

উপসংহার:

পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে,

১. «انما»  এই আয়াতে সবসময়ের মতই সীমাবদ্ধতার (হাসর) অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। আর হাসর থাকার কারণে ওয়ালি শব্দটি “কর্তৃত্বের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত” অর্থের জন্যই নির্ধারিত হয়েছে। এ কারণে বন্ধু বা সাহায্যকারী অর্থ হতে পারেনা।

২. «هم راکعون»  বাক্যটি معطوف হওয়ার সম্ভাবনা নেই; কারণ এতে একই বিষয়ের পুনরাবৃত্তির ন্যায় অগ্রহণযোগ্য নীতির অবতারণা হয়। তাছাড়া এই বাক্যটি থেকে প্রথম যে অর্থটি শ্রোতার মনে আসে তা হল «هم راکعون»  হল অবস্থাবাচক বাক্য বা حالیة جملة এবং আয়াতের শানে নুজুলসহ আয়াতের ব্যাখ্যাকারী বহির্গত অন্যান্য দলীলও উক্ত দাবির (معطوف হওয়ার) বিপরীত বিষয়কে প্রমাণ করে।

৩. বহু সংখ্যক ভাষাবিদের মতে রুকু শব্দটির প্রকৃত অর্থ ‘উপুড় হওয়া’ এ শব্দটি বিনয়ী বা ন¤্রতার অর্থে ব্যবহারের জন্য قرینه বা সমর্থক দলীলের প্রয়োজন। অথচ এই আয়াতে এরূপ কোন قرینه নেই।

৪. মহত্ব, শ্রেষ্ঠত্ব এবং ভালকাজের প্রতি মানুষকে আকৃষ্ট করার জন্য একবচনের ক্ষেত্রে বহুবচনের ব্যবহার আরবি সাহিত্যে প্রচলিত আছে। অনেক পণ্ডিত ব্যক্তি ও বৈয়াকরণ এর সত্যতা স্বীকার করেছেন।

৫. «ولی»  শব্দটির যৌথ অর্থ রয়েছে যা একটা সামগ্রিক অর্থ অর্থাৎ সান্নিধ্য বা নৈকট্য নির্দেশের জন্য প্রণয়ন করা হয়েছে। এই সামগ্রিক অর্থের অনেক দৃষ্টান্ত ( مصاﺪیق) রয়েছে যেমন- মুক্ত, মুক্তকারী, ভালবাসা পোষণকারী, সাহায্যকারী, অভিভাবক, নেতা ইত্যাদি। তবে পবিত্র এই আয়াতে বিদ্যমান «انما» সীমাবদ্ধতা নির্দেশক অব্যয়টি এবং অন্যান্য অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক দলীলের ভিত্তিতে বলা যায় যে, ওয়ালি শব্দটি কর্তৃত্বের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত বা অভিভাবক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।

সুতরাং হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর পরপরই হযরত আলী (আ.) এর নেতৃত্বের বিষয়টি এই আয়াত দ্বারা প্রমাণিত হয় এবং এক্ষেত্রে ফাজেল কুশচী, ফাখরুদ্দীন রাজী ও অন্যরা যা বলেছেন তা এ মত খণ্ডনকারী দলীল বলে গণ্য হতে পারে না।

টীকা :

১. মুহাম্মাদ বিন মুহাম্মাদ বিন হাসান তুসী (জন্ম ৫৯৭ হি. ও মৃত্যু ৬৭২ হি.) বিশ্ব বিখ্যাত পণ্ডিত, ইরান এবং ইসলামের গর্ব। (হাসান আল-আমীন, আল ইসমাঈলিয়্যুন ওয়াল মোগল ওয়া নাসিরুদ্দীন তুসী) তিনি মোগল যুগের একজন উজ্জল নক্ষত্র ছিলেন তিনি তার জীবদ্দশায় ইসলামের অনেক খেদমত করেছেন। তিনি বিভিন্ন বিষয়ে যেমন-দর্শন, কালাম, গণিত এবং জ্যাতিষ শাস্ত্রে অসাধারণ পাণ্ডিত্যের অধিকারী ছিলেন। কালামশাস্ত্রে তার রচিত তাজরীদুল এ’তেকাদ গ্রন্থটি চির অমর হয়ে আছে। এই গ্রন্থের ভাষার মাধুর্যতা, বর্ণনার ধারা এবং বিভিন্ন যুক্তি প্রমাণ অনেককে এর ব্যাখ্যা গ্রন্থ রচনা করতে এবং এতে টীকা সংযোজন করতে উদ্বুদ্ধ করেছে। শুধুমাত্র আহলে বাইতের অনুসারীরাই নয় এমনকি আহলে সুন্নাতের অনেক গণ্যমান্য প্রসিদ্ধ আলেমও এর বিষয়বস্তুকে তাদের গ্রন্থে ব্যাখ্যা করেছেন।

২. আলাউদ্দীন আলী বিন মুহাম্মাদ কুশচী (৮৭৯হি.) ফাজেল কুশচী এবং মোল্লা আলী কুশচী নামে প্রসিদ্ধ, তিনি আহলে সুন্নাতের আশআরী চিন্তাধারার একজন মনীষী। তিনি তাজরীদুল ইতিকাদ গ্রন্থটির অন্যতম ব্যখ্যাকারক। তিনি তার শারহে জাদীদে তাজরীদ নামের প্রসিদ্ধ গ্রন্থে ইমামতের আলোচনায় শেখ তুসীর দৃষ্টিভঙ্গির ত্রুটি ধরেছেন ও সমালোচনা করেছেন। (আগা বুজুর্গে তেহরানী, আয যারিয়াহ ইলা আছারিশ শিয়া, ৩য় খণ্ড, পৃ. ৩৫৪; যারকুলী, আল আলাম, ৫ম খণ্ড, পৃ.-৯; কাহালা, মু’জামুল মুআল্লিফিন, ৭ম খণ্ড, পৃ. ২২৭; কুম্মি, আলকুনি ওয়াল আলকাব, ৩য় খণ্ড, পৃ. ৯৪)

 

গ্রন্থসূচী:

১. আল কোরআনুল কারীম।

২. ইবনে যিন্নী, আবিল ফাতহ ওসমান, আল খাসায়িস, গবেষণা মুহাম্মদ আলী নাজ্জার, বৈরুত, আলামুল কিতাব।

৩. ইবনে ফারেস, মুকায়িসুল লুগাহ, মাকতাবুল এ’লামিল ইসলামী, ১৪০৪ হি:।

৪. ইবনে হিশাম আনসারী, আব্দুল্লাহ, মুগনী আল-লাবিব আন কুতুবেল আ-আরিব, তেহরান, মুয়াসসাসে আস-সাদেক, প্রথম সংস্করণ, ১৩৮৬।

৫. ইস্পাহানী, রাগেব, মুফরাদাতে আলফাজিল কোরআন, গবেষণা দাউদি, ছাফওয়ান আদনান, দামেস্ক ও বৈরুত, দারুল কালাম ও দারুস সামিয়াহ, প্রথম সংস্করণ।

৬. আলুসী, মাহমুদ, রুহুল মাআনী ফি তাফসীরিল কোরআনুল আযিম, সাবউল মাছানী, বৈরুত, দারুল ইহইয়াউত তুরাছিল আরাবি, ১৪২০ হিজরি।

৭. আমিনী, আব্দুল হোসাইন, আল-গাদীর ফিল কিতাব ওয়াস সুন্নাহ ওয়াল আদাব, বৈরুত, দারুল কিতাবিল আরাবি, ৪র্থ সংস্করণ, ১৩৭৯ হিজরি।

৮. ইজি, আজদুদ্দিন আব্দুর রহমান বিন আহমাদ, আল-মাওয়াকিফ, বৈরুত, দারুল জিয়াল, ১৯৯৭ খ্রিস্টাব্দ।

৯. বাহরানী, ইবনে মাইসাম, আন নাজাতু ফিল কিয়ামাহ ফি তাহকিকি আমরিল ইমামাহ, কুম, মুয়াসসাসে আল হাদী, ১ম সংস্করণ, ১৪১৭ হিজরি।

১০. বাইদ্বাভী, আব্দুল্লাহ বিন ওমর, আনওয়ারুত তানযিল ওয়া আসরারুত তা’বিল, বৈরুত, দারুল ইহইয়াউত তুরাছিল আরাবি, ১৮১৮ হিজরি।

১১. তাফতাজানী, মাসউদ বিন ওমর, আল মুতাওয়াল, বৈরুত, দারু ইহইয়াউত তুরাছিল আরাবি, ১ম সংস্করণ, ১৪২৫ হিজরি।

১২. তাফতাজানী, মাসউদ বিন ওমর, শারহুল মুখতাছার, ইসমাঈলিয়্যান, ২য় সংস্করণ।

১৩. তাফতাজানী, মাসউদ বিন ওমর, শারহুল মাকাসিদ ফি ইলমিল কালাম, পাকিস্তান, দারুল মাআরেফ আন নোমানিয়া, ১ম সংস্করণ।

১৪. ছাআলাবি, আব্দুর রহমান, আল জাওয়াহিরুল হাসান, বৈরুত, দারুল কিতাবিল ইলমিয়্যাহ, ১৪১৬ হিজরি।

১৫. জুরজানী, আলী বিন মুহাম্মাদ, শারহুল মাওয়াকিফ, মিসর, মাতবাআতুস সাআদাহ, ১ম সংস্করণ, ১৩২৫ হিজরি।

১৬. জুরজানী, আল ইশারাত ওয়াত তানবিহাত ফি ইলমিল বালাগা, বৈরুত, ১ম সংস্করণ, ১৪২৩ হিজরি।

১৭. হুররে আমেলী, ইছবাতুল হুদা, বৈরুত, মুয়াসসাসাহ আল আলামী, ১ম সংস্করণ, ১৪২২ হিজরি।

১৮. হাসকানী, শাওয়াহিদুত তানযিল লি কাওয়ায়িদুত তাফযিল, তেহরান, বেজারাতে এরশাদে ইসলামী, ১৪১১হিজরি।

১৯. হাসান আল আমিন, আল ইসমাঈলিয়্যুন ওয়াল মোগল ওয়া নাসিরুদ্দীন তুসী, কুম, মারকাজুল গাদীর লিদিরাসাতুল ইসলামিয়্যাহ, ২য় সংস্করণ, ১৪১৭ হিজরি।

হোসাইনি কাফুমি, আবুল বাকা আইয়্যুব বিন মুসা, আল মুজাম ফিল মুস্তালাহাত ওয়াল ফুরুকুল লুগাবিয়্যাহ, তাহকিক আদনান দারউইশ, বৈরুত, মুয়াসসাসে আর রিসালাহ, ১৪১৯ হিজরি।

২০. হালাবি, সামিন, আদ-দুররুল মাসূন ফি ইলমিল কিতাবিল মাকনূন, বৈরুত, দারুল কিতাবিল ইলমিয়্যাহ, ১৪১৪ হিজরি।

২১. হালাবি, হাসান বিন ইউসুফ, কাশফুল মোরাদ ফি শারহি তাজরীদিল ইতিকাদ, তাহকিক হাসানযাদে আমুলী, কুম, মুয়াসসাসাতুন নাশরিল ইসলামী, ১০ম সংস্করণ, ১৪২৫ হিজরি।

২২. দারউইশ, মহিউদ্দীন, এরাবুল কোরআন ওয়া বায়ানুহু, সিরিয়া, দারুল ইরশাদ, ১৪১৫ হিজরি।

২৩. দোআস, এরাবুল কোরআনিল কারীম, দামেস্ক, দারুল মুনির, ১৪২৫ হিজরি।

২৪. রাযী, আব্দুল্লাহ বিন মুহাম্মদ বিন ওমর, মাফাতিহুল গাইব, বৈরুত, দারুল ইহইয়াউত তুরাছিল আরাবি, ১৪২০হিজরি।

২৫. যুবাইদি, মুহাম্মদ মুরতাজা, তাজুল আরুস মিন জাওয়াহিরুল ক্বামূস, বৈরুত, দারুস সাদর, ১৩৮৬ হিজরি।

২৬. যারকুলী, খাইরুদ্দীন, আল এ’লাম, বৈরুত, দারুল ইলম, ১৯৮০ খ্রিস্টাব্দ।

২৭. যামাখশারী, মাহমুদ বিন ওমর, আসাসুল বালাগাহ, তাহকিক আব্দুর রাহিম মাহমুদ, বৈরুত, দারুল মা’রেফাহ।

২৮. যামাখশারী, মাহমুদ বিন ওমর, আল কাশশাফ আন হাক্বায়িকি গাওয়ামিজিত তানযিল, বৈরুত, দারুল কিতাবুল আরাবি, ১৪০৭ হিজরি।

২৯. সাকাকী, ইউসুফ বিন আবি বকর, মেফতাহুল উলুম, বৈরুত, দারুল কিতাবুল ইসলামিয়্যাহ, ১৪০৭ হিজরি।

৩০. সূয়ুতী, জালাল উদ্দীন, আল বাহজাতুল মারজিয়াহ ফি শারহিল আলফিয়া, কুম, নাবিদে ইসলামী, ১ম সংস্করণ।

৩১. সূয়ুতী, জালাল উদ্দীন, আদ্ দুররুল মানসূর ফি তাফসীরিল মা’ছুর, কুম, আয়াতুল্লাহ মারআশী নাজাফি লাইব্রেরী, ১৪০৪ হিজরি।

৩২. সাইয়্যেদ শারাফ উদ্দীন আল মুসাভি, আব্দুল হোসাইন, আল মুরাজায়াত, তাহকিক হোসাইন আর রাযী, দারুল কিতাবুল ইসলামি।

৩৩. সাইয়্যেদ মুরতাজা আলামুল হুদা, আশ শাফি ফিল ইমামাহ, কুম, মুয়াসসাসে ইসমাঈলিয়্যান, ২য় সংস্করণ।

৩৪. সূয়ুতী, জালাল উদ্দীন, আল মাযহার ফি উলুমিল লুগাহ ওয়া আনওয়ায়েহা, দারুল ইহইয়ায়ে কিতাবুল আরাবি, ১ম সংস্করণ।

৩৫. শাহরেস্তানী, মুহাম্মদ বিন আব্দুল করিম, আল মেলাল ওয়ান নেহাল, বৈরুত, দারুল মা’রেফাহ।

৩৬. শেখ মুফিদ, আল ইফসাহ ফি ইমামাতি আমিরিল মুমিনিন, কুম, মুয়াসসাসেহ আল বে’সাত, ১ম সংস্করণ, ১৪১২ হিজরি।

৩৭. ছাফী, মাহমুদ বিন আব্দুর রহিম, আল জাদওয়াল ফি এরাবিল কোরআন, বৈরুত, দারুর রাশিদ, ১৪১৮ হিজরি।

৩৮. তাবাতাবাই, সাইয়্যেদ মুহাম্মদ হোসাইন, আল-মিযান ফি তাফসীরিল কোরআন, তেহরান, দারুল কিতাবুল ইসলামিয়্যাহ, ১৩৭২ ফার্সি সাল।

৩৯. তাবারসী, ফাজল বিন হাসান, মাজমাউল বায়ান ফি তাফসীরিল কোরআন, তেহরান, নাসের খসরু, ১৩৭২ ফার্সি সাল।

৪০. তাবারী, মুহাম্মদ বিন জারীর, দালায়েলুল ইমামাহ, কুম, দারুজ জাখায়ির লিলমাতবুআত।

৪১. তুরাইহী, ফাখরুদ্দীন, মাজমাউল বাহরাইন, তেহরান।

৪২. তুসী, মুহাম্মদ বিন হাসান, আল-ইকতিসাদ ফিমা ইয়তাআল্লাকু বিল ইতিকাদ, বৈরুত, দারুল আযওয়া, ১৪০৬ হিজরি।

৪৩. তুসী, মুহাম্মদ বিন মুহাম্মদ, তাজরীদুল ইতিকাদ, দাফতারে তাবলিগাতে ইসলামী, ১ম সংস্করণ, ১৪০৭ হিজরি।

৪৪. ফাইয়ুমি, আল মিসবাহুল মুনির, কুম, দারুল হিজর, ৩য় সংস্করণ, ১৪২৫ হিজরি।

৪৫. কুম্মি, আব্বাস, আল কুনি ওয়াল আলকাব, তেহরান, মাকতাবাতুস সাদর।

৪৬. কুশচী, আলী বিন মুহাম্মাদ, শারহে তাজরীদুল আকায়েদ, কুম, মানশূরাতে রাযী।

৪৭. কাশানী, ফাতহুল্লাহ, মিনহাজুস সাদেকীন ফি ইলযামিল মুখালিফিন, তেহরান, ইসলামিয়্যা প্রেস, ১৩৭৮ ফার্সি সাল ।

৪৮. কাহালী, ওমর রেজা, মু’জামুল মুআল্লিফিন, বৈরুত, মাকতাবাতুল মুসান্না।

৪৯. কুলাইনি, মুহাম্মাদ বিন ইয়াকুব, উসূলে কফি, আনুবাদ মুহাম্মদ বাকের, তেহরান, আসওয়েহ প্রেস, ৪র্থ সংস্করণ।

৫০. মুহাম্মদ আল আমিন, আসওয়াউল বায়ান ফি ইযাহেল কোরআন বিল কোরআন, বৈরুত, দারুর ফেকর, ১৪১৫ হিজরি।

৫১. মুস্তাফাবী, আত তাহকিক ফি কালামাতিল কোরআন আল কারিম, ইরান, বেজারাতুছ ছাকাফাহ ওয়াল ইরশাদে ইসলামী, ১ম সংস্করণ।

৫২. মুতাহ্হারী, মুরতাজা, মাজমুএ আছার, তেহরান, সাদর, ২য় সংস্করণ।

৫৩. নূহাস, এরাবুল কোরআন, বৈরুত, দারুল কুতুবুল এলমিয়্যাহ, ১৪২১ হিজরি।

৫৪. হাশেমী, আহমাদ, জাওয়াহেরুল বালাগাহ, কুম, ওয়ারিওন, ৪র্থ সংস্করণ।

(ইরান থেকে প্রকাশিত ত্রৈমাসিক পত্রিকা ‘কাউছার’, ৭ম বর্ষ ১৯তম সংখ্যা থেকে অনূদিত)