আশুরার শিক্ষা ও আমাদের কর্তব্য

আশুরা, মহররম, ইমাম হুসাইন, কারবালা প্রভৃতি শব্দগুলো প্রতিটি অসহায়, মজলুম, নির্যাতিত ও মুস্তাজআফ মানুষের অন্তরে ঝড় তুলে দেয়, হৃদয়ে বেদনার সৃষ্টি করে, হাহাকার, আত্মবিলাপ ও আহাজারী বৃদ্ধি করে আর তার মাধ্যমে জন্ম দেয় জুলুম বিনাশের বাঁধ ভাঙ্গা আন্দোলনের।

আশুরার শিক্ষা ১:

এ বিশাল পৃথিবীতে বহু ধর্ম, মাঝহাব ও মতবাদ বিদ্যমান। আসমানি ও অআসমানি ধর্ম। আসমানি ধর্ম যেমন, ইসলাম, খৃষ্টান ও ইহুদী ইত্যাদি আবার অআসমানি ধর্ম যেমন বৌদ্ধ, হিন্দু ইত্যাদি। বিশ্বের বিভিন্ন মতবাদের মধ্যে বর্তমানে বিভিন্ন দেশে শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত আছে পুজিবাদ ও সমাজতন্ত্র। সমাজতন্ত্রের মধ্যে আবার বিভিন্ন ভাগ রয়েছে। প্রতিটি ধর্মের রয়েছে আবার বিভিন্ন শাখা-প্রশাখা। খৃষ্টান ধর্মের বিভিন্ন শাখা যেমন: ক্যাথলিক, প্রতেষ্টান, অর্থদোক্স, আবার ইসলাম ধর্মের মধ্যে রয়েছে শিয়া ও সুন্নি। সুন্নি আবার চার মাঝহাবে বিভক্ত। হানাফি, শাফেয়ী, মালেকী ও হাম্বালী। শিয়াদের মধ্যে বর্তমানে তিনটি মাঝহাবের অস্তিত্ব রয়েছে। যায়দি(চার ইমামি), ইসমাঈলী(ছয় ইমামি) ও বার ইমামি। শিয়াদের মধ্যে শেষোক্ত মাঝহাবের অনুসারীর সংখ্যা অন্য দুই মাঝহাবের চেয়ে বেশী। এতসব ধর্ম, মাঝহাব ও মতবাদের মধ্যে মানুষের মনুষ্য প্রকৃতির (ফিতরাত) সাথে মিল ও সামঞ্জস্য রেখে যে ধর্ম ও মাঝহাব তার ধর্মিয় দৃষ্টিভঙ্গি ও আচার-অনুষ্ঠান রচনা করেছে তা হলো ইসলাম এবং শিয়া-বারো ইমামের মাঝহাব। এটি একটি প্রাকৃতিক মাঝহাব। প্রকৃত বিরোদ্ধ কোন দৃষ্টিভঙ্গি ও কর্ম-কান্ডকে প্রশ্রয় দেয় না এ মাঝহাব। আকল ও বিবেক-বুদ্ধি সম্পন্ন মাঝহাবও এটি। তাই এই মাঝহাবে রয়েছে তাওয়াল্লা এবং তার্বারা নামক দু’টি গুরুত্বপূর্ণ বিধান। আর এখান থেকেই উদ্ভব হয়েছে মহানবি(সা.)-এর আহলে বাইতের আনন্দে আনন্দ-উল্লাস করা এবং তাঁদের কষ্ট ও দুঃখে শোকাহত ও মর্মাহত হয়ে অশ্রু ঝড়ানো। এ ধরনের ধর্মিয় বিধান আর কোন ধর্ম ও মাঝহাবে বিদ্যমান নেই। এই বিধানটি যে কত যৌক্তিক এবং বিজ্ঞানসম্মত ও মানব প্রকৃতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ তা আর ব্যাখ্যা দিয়ে বলার অবকাশ রাখে না। যে কোন বুদ্ধিমান ব্যক্তিই এ ব্যাপারে একমত হবেন। তাই আমাদের উচিত এই মহররম মাসে ইমাম হুসাইনের করুন ও মর্মবেদী কোরবানির কারণে শোক পালন করা।

আশুরার শিক্ষা ২:

ঐতিহাসিক ৬১ হিজরীর দশম মহররমে কারবালার উত্তপ্ত ও বালুকাময় মরু প্রান্তরে সর্বকালের ও সর্বযুগের যে মর্মান্তিক, বেদনাদায়ক ও হৃদয়বিদারক ঘটনার অবতারণা হয়েছিল তার মধ্যে আল্লাহর রাহে প্রাণ বিসর্জন এবং তাদের অব্যহত মিশন ও কর্মধারার বিষয়টি ছিল সর্বোদ্ধে। আল্লাহ্ সূরা আলে ইমরানের ১৬৯ নং আয়াতে বলছেন:

“তোমরা কি মনে করেছো যারা আল্লাহর রাহে নিহত হয় তারা মৃত, না-বরং তারা জীবিত, তাঁরা তাঁদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে রিজিকপ্রাপ্ত।”

আল্লাহ্ সূরা বাক্বারার ১৫৪ নং আয়াতে এ প্রসঙ্গে আরো বলছেন:

“যারা আল্লাহর রাহে নিহত হয় তাদেরকে মৃত বলো না, বরং তারা জীবিত, তবে তোমরা তা উপলব্ধি করতে পারো না।”

উপরোক্ত দু’টি আয়াত থেকে আমরা শহিদদের জীবন সম্পর্কে স্পষ্ট ধারনা পাই। আর কারবালার শহিদরা তো সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ শহিদ। আবার এ সকল শ্রেষ্ঠ প্রাণ উৎসর্গকারীদের নেতা হলেন ইমাম হুসাইন(আ.)। তারা কিভাবে জীবিত এবং কিভাবে তারা আল্লাহর কাছ থেকে রিজিক পাচ্ছেন?

আল্লাহ্ এ দু’টি আয়াতে বারযাখের জগতের জীবনকে বুঝাননি। সে জগতে তো সকল মানুষ জীবিত। কোন মানুষই তো কখনো মরে না, স্থানান্তরিত হয় মাত্র। তাই আল্লাহ্ কাফের ও মুশরিকদের সম্মোধন করে বলেননি যে, তোমরা এমনটি মনে করো না যে, আল্লাহর পথে নিহতরা জীবিত। কেননা তারা তো পরকাল ও তার জীবনকেই বিশ্বাস করতো না। তারা পরবর্তী জীবনকেই অস্বীকার করতো। তাই তাদেরকে এ কথা বলা যে, যারা আল্লাহর রাহে নিহত হয় তাদেরকে মৃত বলো না, বরং তারা জীবিত-এর কোন অর্থ হয় না।

প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ্ বিশ্বাসীদেরকে সম্মোধন করে বলছেন, “যারা আল্লাহর রাহে নিহত হয় তাদেরকে মৃত বলো না, বরং তারা জীবিত।” আর তাদের জীবিত থাকার বিষয়টি যে বারযাখের জগতের সঙ্গে সম্পর্কীত নয় তাও স্পষ্ট। কেননা মুমিন- মুসলমানরা এ দুনিয়ার পর অন্য জগত সম্পর্কে কোন সন্দেহ করে না। সে জগতে সবাই জীবিত। তাই নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, আল্লাহর পথে নিহতদের জীবন এবং রিজিক এ জগতেই, পরজগতে তো আছেই। অন্য কথায় আল্লাহর পথে নিহতদের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য, কর্মধারা ও স্মরণ সমাজের মানুষের মাঝে অব্যহতভাবে বিরাজ করবে আর এর মাধ্যমে তাদের অসম্পূর্ণ কাজগুলো সমাজে চলতে থাকবে। এভাবেই তারা সমাজের বুকে জীবিত আছেন এবং কর্মকান্ড পরিচালনা করছেন। তাই যথার্থই আল্লাহ্ বলেছেন:

“যারা আল্লাহর রাহে নিহত হয় তাদেরকে মৃত বলো না, বরং তারা জীবিত, তবে তোমরা তা উপলব্ধি করতে পারো না।”

আশুরার শিক্ষা ৩:

ইমাম হুসাইনের আন্দোলন ও সংগ্রাম এবং শাহাদাত-এর প্রতিটি পদে পদে আমাদের জন্যে শিক্ষা রয়েছে।

এ পৃথিবীর শুরু থেকে এ পর্যন্ত ঐতিহাসিকভাবে আমাদের সামনে উপস্থিত মানব আচরণ ও কর্মকান্ড পর্যবেক্ষন করলে আমরা চার প্রকার কর্মের ধরন পরিলক্ষীত করি:

এক: আবেগ তাড়িত কাজ। যেমন কাউকে ভালবাসা অথবা করো সাথে শত্রুতা করা, কাউকে পছন্দ করা অথবা কাউকে অপছন্দ করা। যখন এ ধরনের কোন ব্যক্তিকে প্রশ্ন করা হয় যে আপনি কেন তাকে ভালবাসেন? অথবা আপনি কেন তাকে অপছন্দ করেন? তখন তিনি উত্তরে বলেন আমি এর কোন কারণ জানি না, তবে তাকে আমার ভাল লাগে অথবা তিনি বলেন তাকে আমার পছন্দ হয় না। এই শেষ কথা। এটাকেই বলে আবেগ তাড়িত হয়ে কোন কাজ করা। যে কাজের পেছনে কোন যুক্তি ও দলিল নেই, রয়েছে শধুই আবেগ।

দুই: শুধুই যুক্তি ও বুদ্ধিভিত্তিক কাজ। এ ধরনের কাজের পেছনে কোন প্রকার আবেগ তৎপর থাকে না। তাই এ ধরনের কাজের মধ্যে কোন ভাবাবেগ, রস-কষ, আন্দোলন- উদ্দীপনা থাকে না। এ কাজটি একটি শুষ্ক কাঠের মত। তাই এ ধরনের কাজের মূল্য খুবই কম।

তিন: আবেগ ও যুক্তিবিহীন কাজ। এধরনের কাজ অর্থহীন। এর কোন মূল্য কোন মানুষের কাছে নেই।

চার: আবেগ মিশ্রিত যুক্তি ও বুদ্ধির কাজ। এ ধরনের কাজ মহাপুরুষেরা সম্পাদন করে থাকেন। যাদের কাজ সমাজে প্রভাব বিস্তার করে এবং দীর্ঘস্থায়ী হয়, যাদেরকে মানুষ তাদের কর্মের কারণে স্মরণ করে থাকে তাদের কর্ম আবেগ ও যুক্তির সংমিশ্রনে সংঘটিত হয়ে থাকে। এ পর্যন্ত সকল নবি-রাসূল, ইমাম, অলি, গাউস-কুতুব এ ধরনের কাজ সম্পাদন করে গেছেন। তাই তাদের কাজ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ইমাম হুসাইনের আন্দোলনও এমনি একটি কাজ- যার সাথে আবেগ ও যুক্তি জড়িত।

কুখ্যাত ওয়ালিদ তখন ইয়াযিদের পক্ষ থেকে মদিনার গভর্নর। মদ্যপ ইয়াযিদ ক্ষমতা আরোহণের পর পরই মদিনার বিশিষ্ট্য ব্যক্তিবর্গের বাইয়াত নেয়ার জন্যে ওয়ালিদের কাছে চিঠি প্রেরণ করে। এ চিঠি প্রাপ্তির পর ওয়ালিদ ইমাম হুসাইনকে গভর্নরের অফিসে তলব করে। ইমাম সেখানে ওয়ালিদের কাছে সময় চেয়ে বলেন: “আগামীকাল সকালে কি ঘটে দেখা যাবে।” তিনি সকালেই মদিনা থেকে মক্কার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। তখন বনি হাশেমের যেসব লোকজন মদিনাতে অবস্থান করছিলেন তিনি তাদের উদ্দেশ্যে বক্তব্যে ইয়াযিদের স্বরূপ উন্মোচন করে বলেছিলেন: “সে একজন মদ্যপ ও বানর নৃত্যকার। আমার মত ব্যক্তির পক্ষে তার মত লোকের হাতে বাইয়াত গ্রহণ ইসলামের ইতিরেখা টানারই নামান্তর।” এখানে ইমাম শধুমাত্র আবেগের বশবর্তী হয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন নি, যদিও এখানে ইসলামের পক্ষে তার নানার রেখে যাওয়া আমানত রক্ষার জন্যে আবেগের কোন কমতি ছিল না, তবু তিনি তার মিশনের উদ্দেশ্য যুক্তিপূর্ণভাবে উল্লেখ করেছিলেন। আমরা ইমাম হুসাইনের সন্তান ও সঙ্গীদেরকে আশুরার পূর্বের দিন এবং আশুরার দিন যেভাবে শাহাদাতের জন্যে আবেগ উদ্বেলিত এবং এ কাজের পক্ষে বিভিন্ন যক্তিপূর্ণ বক্তব্য অবলোকন করি তা থেকে স্পষ্ট হয়ে যায় যে তারা আবেগ মিশ্রিত যৌক্তিক কাজের অবতারণা করেছিলেন। তারা কোনক্রমে শুধুমাত্র আবেগপ্রবন ছিলেন না। এটাই সকল মহামানব এবং বুদ্ধিমান মানুষের কাজ।

আশুরার শিক্ষা ৪:

আমরা জানি আল্লাহর অনেক প্রিয় বান্দাদেরকে তিনি বিভিন্নভাবে পরীক্ষা করে থাকেন। এটা আল্লাহর সুন্নত(সুন্নাতুল্লাহ)। তাই মহানবি(সা.)-এর আহলে বাইতের ইমামদেরকে বিভিন্ন প্রকার পরীক্ষার সমুক্ষীন হতে হয়। এসকল পরীক্ষাগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, তাদের শত্রুরা তাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন মিথ্যা গুজব সমাজে রটিয়ে থাকেন। যেমন, ইমাম হুসাইনের ঐশ্বী মিশনের বিরুদ্ধে ইয়াযিদীদের অপপ্রচার ছিলো যে, “(ইমাম) হুসাইন ও তার সাথীরা খারেজী(ধর্মচুত্য)।” এ কারণে মুসলিম উম্মতের অনেকে ইমাম হুসাইনের পরিচয়ই জানতে পারেনি। এমনকি কুফার অভিশপ্ত গভর্নর উবাইদুল্লার পক্ষে এবং ইমাম হুসাইনের বিরুদ্ধে এ উপরোক্ত কারণে অর্থাৎ ইসলাম রক্ষার নিয়তে ইমামের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারন করেছিলেন অনেক অজ্ঞ মানুষ।

আমরা ঐতিহাসিক সুত্র থেকে জানতে পারি যে, যখন উমাইয়্যা বাদশাহ ওমর বিন আব্দুল আযিয মুয়াবিয়া কর্তৃক জারীকৃত নির্দেশ তথা ইমাম আলী ও তাঁর বংশের বিরুদ্ধে জুম্মা নামাজের খুতবায় অভিশাপ বর্ষণ রহিত করেন তখন মুসলিম বিশ্বের বহু খতিব প্রতিবাদের ঝড় তোলেন এবং তারা বলেন জুম্মার খুতবায় আলী ও তার বংশের বিরুদ্ধে অভিশাপ ব্যতিত খুতবাই সহিহ হবে না। তাই তারা খলিফার বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলেন যে তিনি তাদের জুম্মা নামাজ নষ্ট করে দিয়েছেন। এ হলো অপপ্রচার ও গুজবের ফল। তাই বিবেকের কাজ হলো যে কোন কথা ও প্রচারের ব্যাপারে প্রমাণ ও দলিল দিয়ে গ্রহণ ও বর্জন করা।

ইমাম আলী(আ.)-এর যোগ্য সন্তান হযরত আবুল ফাজল আব্বাস বিন আলী এ ক্ষেত্রে আমাদের জন্যে সুন্দর আদর্শ। তিনি কখনো, এতসব অপপ্রচার সত্তেও এক মুহূর্তের জন্যে ইমামতের প্রতিরক্ষার কাজে পিছপা হননি এবং এক মুহূর্তের জন্যেও অন্তরে কোন প্রকার দিধ্বাদন্দের প্রশ্রয় দেননি।

আল্লাহ্ ইমামতের রাহে আমাদের সকল কিছু কবুল করুন। আমাদের জান-মাল, ইজ্জত-আবরু, পরিবার-পরিজন সকল কিছু জামানার ইমাম, ইমাম মাহদী(আ.)-এর চরণে উৎসর্গ হোক।
#আল হাসানাইন