হযরত ইমাম হোসেনের (‘আঃ) উত্থানের প্রকৃতি ও উদ্দেশ্য : একটি নিরপেক্ষ পর্যালোচনা

হযরত ইমাম হোসেনের (‘আঃ) উত্থান ও কারবালায় শাহাদাতের ঘটনার প্রতি সাধারণতঃ ভাবাবেগের দৃষ্টিতে দৃষ্টিপাত করা হয়। এটা অস্বাভাবিক নয়। কারণ, হযরত ইমাম হোসেন (‘আঃ) রাসূলে আকরাম হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ)-এর নাতি ও তাঁর পবিত্র আহলে বাইতের (‘আঃ) সদস্য - আল্লাহ্ তা‘আলা কোরআন মজীদে মু’মিনদের জন্য যাদের প্রতি ভালোবাসা পোষণকে রিসালাতের বিনিময় হিসেবে উল্লেখ করেছেন তথা ফরয করেছেন। সুতরাং তাঁর শাহাদাতের ঘটনায় মুসলমানদের পক্ষে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়া খুবই স্বাভাবিক। আর এ আবেগের কারণেই সাধারণতঃ কতক বর্ণনার ভিত্তিতে, বিশেষ করে মীর মশাররফ হোসেন লিখিত “বিষাদ সিন্ধু” উপন্যাসের প্রভাবে বাংলাভাষী মুসলমানদের মধ্যে কারবালায় হযরত ইমামের (‘আঃ) ভূমিকাকে একজন রূপকথার বীর নায়কের ভূমিকা হিসেবে দেখা হয়।

অবশ্য হযরত ইমাম হোসেন (‘আঃ) যে একজন প্রকৃত বিপ্লবী ও বীর নায়ক ছিলেন তাতে কোনোই সন্দেহ নেই। কারণ, সমকালে প্রচলিত সব ধরনের বিপুল পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত একটি বিশাল বাহিনীর অধিনায়ক হিসেবে বীরত্বের পরিচয় দেয়া অনেকের পক্ষেই সহজ, কিন্তু এ ধরনের একটি বাহিনীর মোকাবিলায় নিরস্ত্র অবস্থায় আমরণ স্বীয় আদর্শ ও নৈতিক অবস্থানের ওপর অটল থাকা খুব কম লোকের পক্ষেই সম্ভব; যাদের পক্ষে সম্ভব তাঁরাই প্রকৃত বিপ্লবী ও প্রকৃত বীর নায়ক এবং হযরত ইমাম হোসেন (‘আঃ) ছিলেন এ ধরনের বিপ্লবীদের ও বীর নায়কদের আদর্শ। কারণ, তিনি ত্রিশ হাজার সৈন্যের এক বিরাট শত্রু বাহিনীর মোকাবিলায়ও নতি স্বীকার না করে ৭২ জন সঙ্গী-সাথী সহ (যাদের মধ্যে তাঁর পরিবারের পুরুষ সদস্যগণ ছিলেন অন্যতম) শহীদ হওয়া পর্যন্ত স্বীয় নীতিগত অবস্থানের ওপর অটলভাবে দাঁড়িয়ে ছিলেন।

হযরত ইমাম হোসেন (‘আঃ) ছিলেন রাসূলুল্লাহর (ছ্বাঃ) আহলে বাইতের (‘আঃ) সদস্য ও আল্লাহ্ তা‘আলার পক্ষ থেকে মনোনীত মা‘ছূম্ ইমাম এবং সে হিসেবে আমরা তাঁর সকল কর্ম ও নীতিগত অবস্থানকেই সঠিক বলে জানি। কিন্তু এখানে আমরা তার ভিত্তিতে নয়, বরং সর্বজনীন মানদণ্ডে ও নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে তাঁর উত্থান ও শাহাদাতের ঘটনা সম্পর্কে আলোচনা করবো।

প্রকৃত পক্ষে হযরত ইমাম হোসেন (‘আঃ) ক্ষমতা দখলের জন্য লড়াই করেন নি বা সশস্ত্র বিদ্রোহও করেন নি। বরং তিনি লড়াই করেছিলেন স্বীয় নৈতিক ও আদর্শিক অধিকার ও মানবিক মর্যাদার হেফাযতের লক্ষ্যে অনন্যোপায় হয়ে সর্বশেষ পন্থা হিসেবে। নচেৎ তিনি ছিলেন একজন শান্তিকামী প্রকৃত ইসলামী নেতা এবং এ কারণে তিনি তাঁর জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সশস্ত্র সঙ্ঘাত এড়াবার জন্য সর্বান্তকরণে চেষ্টা চালিয়েছিলেন।

বস্তুতঃ এ ব্যাপারে বিতর্কের কোনোই অবকাশ নেই যে, দ্বীনী জ্ঞান ও নৈতিকতার বিচারে হযরত ইমাম হোসেন (‘আঃ) ছিলেন তাঁর যুগের শ্রেষ্ঠতম ইসলামী নেতা যিনি একটি ইসলামী হুকুমাতের শাসক হবার জন্য প্রয়োজনীয় সমস্ত গুণের অধিকারী ছিলেন। এমনকি, তিনি আল্লাহ্ তা‘আলার পক্ষ থেকে মনোনীত মা‘ছূম্ ইমাম ছিলেন বলে ‘আক্বীদাহ্ পোষণ করেন না এমন নিরপেক্ষ ব্যক্তিরাও তা স্বীকার করেন। অন্যদিকে ইতিহাসের সাক্ষ্য অনুযায়ী ইয়াযীদ ইসলামী শাসকের জন্য অপরিহার্য ন্যূনতম দু’টি গুণ অর্থাৎ দ্বীনী ‘ইলম্ ও নৈতিকতা - এর একটিরও ন্যূনতম মাত্রায়ও অধিকারী ছিলো না, বরং সে প্রকাশ্যেই মদপান ও বানর নিয়ে খেলা করার ন্যায় হারাম কাজে অভ্যস্ত ছিলো।

এ অবস্থায় ইয়াযীদের পিতা মু‘আাভীয়া্র মৃত্যুর পর সে তার পিতার মনোনীত উত্তরাধিকারী হিসেবে ইসলামী হুকূমাতের খেলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ করে। আর ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হবার পর পরই সে মদীনার উমাইয়াহ্ প্রশাসকের কাছে হযরত ইমাম হোসেনের (‘আঃ) কাছ থেকে তার (ইয়াযীদের) অনুকূলে বাই‘আত্ (আনুগত্যশপথ) আদায় করার এবং তিনি বাই‘আত্ করতে রাযী না হলে তাঁকে হত্যা করার জন্য নির্দেশ পাঠায়।

এ নির্দেশ পাবার পর মদীনার প্রশাসক হযরত ইমাম হোসেন (‘আঃ)কে ডেকে পাঠায় এবং তাঁকে ইয়াযীদের অনুকূলে বাই‘আত্ করার জন্য আহবান জানায়। হযরত ইমাম (‘আঃ) পরিস্থিতি অবগত হবার পর এ বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা করে দেখার জন্য ঐ দিন রাতের অবকাশ চান এবং প্রশাসক তাঁকে অবকাশ প্রদান করে।

এখানে প্রশঙ্গতঃ একটি বিষয়ের ওপর আলোকপাত করা যরূরী বলে মনে করি, তা হচ্ছে এই যে, মুসলিম সংখ্যাগুরু ও অমুসলিম সংখ্যাগুরু নির্বিশেষে যে কোনো দেশে কোনো অমুসলিম শাসক বা ধর্মসম্পর্করহিত (সেক্যুলার) শাসনব্যবস্থাধীনে কোনো শাসক থাকতে পারে - ধর্মীয় দিক থেকে যার মুসলিম বা অমুসলিম হওয়ায় কোনোই পার্থক্য ঘটে না - যে শাসক একটি আইনগত রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়, তা সে প্রক্রিয়া নির্বাচনী প্রক্রিয়াই হোক বা উত্তরাধিকারভিত্তিক রাজতান্ত্রিক প্রক্রিয়াই হোক অথবা অন্য কোনো প্রক্রিয়াই হোক। এতে কোনোই সন্দেহ নেই যে, এ ধরনের শাসক ইসলামী শাসক না হওয়া সত্ত্বেও অবশ্যই রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে একজন বৈধ শাসক এবং এ ধরনের শাসককে ঐ দেশের বৈধ শাসক হিসেবে মেনে নেয়া মানে রাজনৈতিক দিক থেকে বৈধ শাসক হিসেবে মেনে নেয়া, ইসলামী শাসক বা খলীফাতুল মুসলিমীন্ হিসেবে নয়। কিন্তু একজন শাসক যখন নিজেকে খলীফাতুল মুসলিমীন্ বা ইসলামী শাসক হিসেবে দাবী করে বা একটি ইসলামী হুকূমাতের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয় তখন তাকে অবশ্যই উপরোল্লিখিত ইসলামী শাসক হবার গুণাবলীর অন্ততঃ ন্যূনতম মাত্রায় অধিকারী হতে হবে, নচেৎ এ ধরনের শাসক ইসলাম ও ইসলামী হুকুমাত্ সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণা ও বিভ্রান্তি সৃষ্টির কারণ হতে বাধ্য। আর বলা বাহুল্য যে, ইয়াযীদ উপরোল্লিখিত গুণাবলীর ন্যূনতম মাত্রায়ও অধিকারী ছিলো না। এ কারণেই একজন প্রকৃত ইসলামী নেতা হিসেবে হযরত ইমাম হোসেনের (‘আঃ) পক্ষে ইয়াযীদকে খলীফাতুল্ মুসলিমীন্ বা ইসলামী উম্মাহর নেতা ও শাসক হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া সম্ভব ছিলো না।

এখানে বিষয়টি আরো কিছুটা পরিষ্কার করে ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন বলে মনে করি। তা হচ্ছে, অনেক ক্ষেত্রে এ রকম হতে পারে - এবং ইতিহাসে বহু বার এমনটা ঘটেছে - যে, ইসলামী হুকুমাতের শাসনক্ষমতায় অধিষ্ঠিত শাসক বা ইসলামী শাসক হবার দাবীদার একজন শাসক আসলে প্রকৃত ইসলামী শাসক নয়, বরং একজন যালেম ও স্বৈরাচারী শাসক, কিন্তু সে তার যুলুম ও স্বৈরতন্ত্রের ওপর বাহ্যতঃ রাজনৈতিক বৈধতার ও ইসলামী আবরণ পরিধান করিয়ে এ সব কাজ আঞ্জাম দিয়ে থাকে এবং এর ফলে সাধারণ জনগণ তাকে যালেম ও স্বৈরাচারী বলে মনে করে না, বরং ইসলাম ও মুসলমানদের খাদেম বলে মনে করে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি এড়ানোর লক্ষ্যে একজন প্রকৃত ইসলামী নেতা এরূপ শাসককে সহ্য করে নেয়ার নীতি অনুসরণ করতে পারেন। আমরা আহলে বাইতের (‘আঃ) মা‘ছূম্ ইমামগণের (‘আঃ) যিন্দেগীতে এ ধরনের আচরণের দৃষ্টান্ত দেখতে পাই। বিশেষ করে ইয়াযীদের পিতা মু‘আাভীয়ার শাসনামল ছিলো এর প্রকৃষ্ট দৃষ্টান্ত। বস্তুতঃ মু‘আাভীয়ার রাজনৈতিক জীবন ছিলো ইসলামের দৃষ্টিতে চরম নিন্দনীয়; আজীবন রাসূলুল্লাহর (ছ্বাঃ) বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে মক্কাহ্ বিজয়ের পুর্বরাতে বন্দী হয়ে কেবল জীবন বাঁচানোর জন্য ইসলাম গ্রহণের ঘোষণা প্রদান, দল-মত নির্বিশেষে সকল মুসলমানের দ্বারা বৈধ খলীফাহ্ হিসেবে স্বীকৃত হযরত ‘আলী (‘আঃ)-এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ও হাজার হাজার মুসলমানের রক্তপাত ঘটানো এবং হযরত ইমাম হাসান (‘আঃ)-এর সাথে কৃত সন্ধিচুক্তি ভঙ্গ করে খেলাফতের জন্য হযরত ইমাম হোসেন (‘আঃ)কে স্বীয় উত্তরাধিকারী মনোনীত না করে স্বীয় পাপাচারী পুত্র ইয়াযীদকে যুবরাজ পদে মনোনীত করে ইসলামের ইতিহাসে স্বৈরাচারী রাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার প্রবর্তন ছিলো মু‘আাভীয়ার রাজনৈতিক জীবনের চরম নিন্দনীয় দিকগুলোর কয়েকটি অবিতর্কিত দিক মাত্র। কিন্তু তা সত্ত্বেও মু‘আাভীয়ার জীবনাচরণে একটি বাহ্যিক ইসলামী আবরণ ছিলো - যে আবরণের কয়েকটি দিক ছিলো নিজেকে রাসূলুল্লাহর (ছ্বাঃ) ছ্বাহাবী ও মু’মিনদের মামা [রাসূলুল্লাহর (ছ্বাঃ) শ্যালক] হিসেবে প্রচার, প্রকাশ্যে ও জনগণের কাছে ধরা পড়ার মতো করে কোনো অবিতর্কিত হারাম কাজ আঞ্জাম না দেয়া এবং স্বীয় যুলুম-অত্যাচারমূলক কাজগুলোকে রাজনৈতিক বৈধতার রঙে রঞ্জিতকরণ। এ কারণে তৎকালীন সাধারণ মুসলিম জনগণের পক্ষে মু‘আাভীয়াহকে একজন অনৈসলামী শাসক হিসেবে গণ্য করা সম্ভব ছিলো না এবং তাকে একজন অনৈসলামী শাসক বলে সাধারণ জনগণকে বিশ্বাস করানোও সম্ভব ছিলো না। এ কারণেই মু‘আাভীয়ার বিশ বছরের শাসনামলে হযরত ইমাম হাসান (‘আঃ) ও হযরত ইমাম হোসেন (‘আঃ) মু‘আাভীয়ার বিরুদ্ধে কোনো প্রকাশ্য প্রচারাভিযান চালান নি; চালালে মু‘আাভীয়ার পোষা বিরাট প্রচার নেটওয়ার্ক উল্টো তাঁদের বিরুদ্ধে জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতো।

কিন্তু ইয়াযীদের অবস্থা তার পিতার মতো ছিলো না, বরং সে ছিলো ইসলামের প্রকাশ্য নাফরমান। এ কারণেই হযরত ইমাম হোসেনের (‘আঃ) পক্ষে ইয়াযীদকে ইসলামী শাসক হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া সম্ভবপর ছিলো না। কারণ, হযরত ইমাম হোসেনের (‘আঃ) পক্ষ থেকে তাকে ইসলামী শাসক হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হলে তা ইসলামে একটি খারাপ দৃষ্টান্ত হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতো এবং মুসলমানদের জন্য যে কোনো ফাসেক্ব-ফাজের ও পাপাচারী শাসককে ইসলামী শাসক হিসেবে নিঃশর্তভাবে মেনে নেয়া অপরিহার্য বলে পরিগণিত হতো, আর তাহলে সে কাজটি হতো ইসলামের মৃত্যুর সমার্থক।

বস্তুতঃ হযরত ইমাম হোসেনের (‘আঃ) পক্ষে যে ইয়াযীদকে খলীফাতুল মুসলিমীন্ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া সম্ভবপর ছিলো না এ বিষয়টি মু‘আাভীয়ারও অজানা ছিলো না। তাই, যেমন বর্ণিত হয়েছে, ইয়াযীদের উদ্দেশে মু‘আাভীয়ার মৃত্যুকালীন ওয়াছ্বীয়াত্ ছিলো এই যে, সে যেন হযরত ইমাম হোসেনের (‘আঃ) কাছ থেকে বাই‘আত্ আদায় করার চেষ্টা না করে [যার ফলে হযরত ইমাম (‘আঃ) ইয়াযীদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য বিরোধিতায় অবতীর্ণ হতে বাধ্য হন]। কিন্তু ইয়াযীদ তার পিতার ওয়াছ্বীয়াত্ অমান্য করে হযরত ইমাম হোসেনের (‘আঃ) কাছ থেকে বাই‘আত্ আদায় করার এবং তিনি বাই‘আত্ না করলে তাঁকে হত্যা করার জন্য মদীনার উমাইয়াহ্ প্রশাসককে নির্দেশ দেয়।

এমতাবস্থায় হযরত ইমাম হোসেন (‘আঃ) যদি ক্ষমতা দখল করতে চাইতেন তাহলে তিনি মদীনায় থাকাকালে ইয়াযীদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র অভ্যুত্থান করতে পারতেন এবং সেখানকার উমাইয়াহ্ প্রশাসন ও সৈন্যদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে মদীনার ক্ষমতা দখলের জন্য চেষ্টা করতে পারতেন - ঠিক যেভাবে ‘আব্দুল্লাহ্ ইবনে যুবাইর মক্কায় অভ্যুত্থান করে সেখানকার ক্ষমতা দখল করেছিলেন এবং সেখানে একটি স্বাধীন প্রশাসন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। আর হযরত ইমাম হোসেন (‘আঃ) সে ধরনের চেষ্টা চালালে নিঃসন্দেহে মদীনাহবাসীরা হযরত ইমামের (‘আঃ) পৃষ্ঠপোষকতা করতো, কারণ, সেখানে তাঁর বিরাট প্রভাব ছিলো, তার ফলে তিনি সফল হতেন।

কিন্তু হযরত ইমাম হোসেন (‘আঃ) তা করেন নি। তার কারণ হয়তো এই ছিলো যে, এমনকি আল্লাহর পক্ষ থেকে মনোনীত একজন মা‘ছূম্ ইমামও কেবল তখনই হুকূমাতের ক্ষমতা গ্রহণ করবেন যখন জনগণ তাঁকে আল্লাহর পক্ষ থেকে মনোনীত মা‘ছূম্ ইমাম হিসেবে চিনতে পারবে ও শাসনক্ষমতা গ্রহণ করার জন্য অনুরোধ জানাবে - ঠিক যেমনটি ঘটেছিলো হযরত ইমাম ‘আলী (‘আঃ)-এর ক্ষেত্রে। আর এদ্ব্যতীত ক্ষমতা গ্রহণ বা দখল করে সফল হওয়ার কোনোই সম্ভাবনা থাকে না - যে কারণে পরবর্তীকালে হযরত ইমাম রেযা (‘আঃ) মা’মূনের প্রস্তাব অনুযায়ী খলীফাহর পদ গ্রহণ করতে রাযী হন নি। সুতরাং হযরত ইমাম হোসেন (‘আঃ) না ইয়াযীদের অনুকূল্যে আনুগত্য শপথ (বাই‘আত্) করলেন, না ক্ষমতা দখলের জন্য সশস্ত্র বিদ্রোহের আশ্রয় নিলেন, বরং তিনি শান্তিপূর্ণভাবে সঙ্ঘাত এড়িয়ে যাবার লক্ষ্যে রাতের বেলা স্বীয় পরিবারের সকল সদস্য ও কতক ঘনিষ্ঠ সহচর সহ মদীনাহ্ ত্যাগ করে ইয়াযীদের শাসনের বাইরে অবস্থিত ‘আব্দুল্লাহ্ ইবনে যুবাইরের শাসনাধীন মক্কাহর পথ ধরলেন।

মক্কায় যাবার পথে এবং সেখানে উপনীত হবার পরেও যেখানেই লোকেরা হযরত ইমামের (‘আঃ) কাছে এসে তাঁর এভাবে মদীনাহ্ ত্যাগ করে চলে আসার কারণ জানতে চায় সেখানেই তিনি লোকদের উদ্দেশে তাঁর বক্তৃতায় তাঁর উত্থানের উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করেন। তিনি তাঁর এ সব বক্তৃতায় সুস্পষ্ট ভাষায় উল্লেখ করেন যে, তাঁর উত্থানের উদ্দেশ্য ক্ষমতা দখল করা নয়, বরং তাঁর উদ্দেশ্য হচ্ছে তাঁর নানার [রাসূলে আকরাম হযরত মুহাম্মাদ্ (ছ্বাঃ)-এর] হুকূমাতের অবস্থার সংশোধন করা। তিনি লোকদেরকে ইসলামী হুকূমাতের তৎকালীন বিরাজমান অবস্থা সম্পর্কে সচেতন করার চেষ্টা করেন এবং বলেন যে, তিনি শুধু কোরআন মজীদে বিধৃত “আমর্ বিল্-মা‘রূফ্ ওয়া নাহ্য়ী ‘আনিল্-মুনকার্”-এর (ভালো কাজ আঞ্জাম দেয়ার জন্য ও মন্দ কাজ পরিহার করার জন্য নছ্বীহত্ করার) দায়িত্ব পালন করছেন। তাই এমনকি মক্কায় উপনীত হবার পরেও তিনি ইয়াযীদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধ করার জন্য সেনাবাহিনী গঠনের কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেন নি।

এখানে কেউ হয়তো বলতে পারেন যে, যেহেতু হযরত ইমাম হোসেন (‘আঃ) এবং তাঁর পরিবারের পুরুষ সদস্যগণ ও তাঁর সহচরগণ কারবালায তলোয়ার হাতে নিয়ে যুদ্ধ করেছেন, সেহেতু অবশ্যই তাঁর একটি সশস্ত্র বাহিনী ছিলো, তা যতোই না ক্ষুদ্র হোক এবং তার অস্ত্রশস্ত্রের পরিমাণ যতোই না কম হোক।

কিন্তু এ প্রসঙ্গে আমাদের মনে রাখতে হবে যে, তৎকালীন আরব রীতি ও ঐতিহ্য অনুযায়ী যে কোনো পুরুষ ব্যক্তি সাধারণ আত্মরক্ষার জন্য একটি তলোয়ার বহন করতে পারতো এবং তা বেসামরিক আত্মরক্ষা (civil defense) উপকরণ হিসেবে পরিগণিত হতো, যুদ্ধাস্ত্র হিসেবে নয়। নচেৎ তৎকালে তলোয়ার ছাড়াও বিভিন্ন ধরনের যুদ্ধাস্ত্রের প্রচলন ছিলো - যার মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ছিলো পাথর ও আগুন নিক্ষেপক কামান - উমাইয়াহ্ বাহিনী যার সাহায্যে আবদুল্লাহ্ ইবনে যুবাইরের নিয়ন্ত্রণাধীন পবিত্র মক্কাহ্ নগরীর ওপর - এমনকি পবিত্র কা‘বাহ্ গৃহের ওপরও - হামলা চালিয়েছিলো।

সুতরাং এটা পুরোপুরি সুস্পষ্ট যে, হযরত ইমাম হোসেনের (‘আঃ) উত্থানের প্রকৃতি ছিলো সম্পূর্ণরূপে শান্তিপূর্ণ বেসামরিক উত্থান - যা বর্তমান যুগে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কর্তৃক মানবাধিকার ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা হিসেবে স্বীকৃত।

হযরত ইমাম হোসেন (‘আঃ) মক্কায় অবস্থানকালে কূফাহর কয়েকশ’ বিশিষ্ট ব্যক্তির পক্ষ থেকে হযরত ইমামকে (‘আঃ) সেখানে গিয়ে তাদের নেতৃত্ব গ্রহণের জন্য অনুরোধ জানিয়ে পত্র প্রেরণ করা হয়। নিঃসন্দেহে তাদের পত্রে হযরত ইমামকে (‘আঃ) যে ধরনের নেতৃত্ব গ্রহণের জন্য অনুরোধ জানানো হয় তা ছিলো বেসামরিক গণ-আন্দোলনের নেতৃত্ব; এমনকি তাদের উদ্দেশ্য যদি সশস্ত্র অভ্যুত্থান হয়েও থাকে তথাপি হযরত ইমাম (‘আঃ) যে তাদের আহবানে সাড়া দেন সে ক্ষেত্রে তাঁর উদ্দেশ্য ছিলো গণসচেতনতা সৃষ্টিমূলক বেসামরিক গণ-আন্দোলনে নেতৃত্বদান - তিনি তাঁর সব বক্তৃতায় তাঁর উত্থানের উদ্দেশ্য হিসেবে যা উল্লেখ করেন। অন্যথায় তিনি কোনো সশস্ত্র বাহিনী গঠন না করে মক্কাহ্ থেকে কূফাহর উদ্দেশে রওয়ানা হতেন না। শুধু তা-ই নয়, তাঁর উদ্দেশ্য সামরিক হলে এটাই স্বাভাবিক ছিলো যে, তিনি মদীনায় লোক পাঠিয়ে সেখান থেকে সশস্ত্র জনবল সংগ্রহ করার পর তাদেরকে সাথে নিয়ে কূফাহর পথে রওয়ানা হতেন।

হযরত ইমাম হোসেন (‘আঃ) যখন মক্কাহ্ থেকে কূফাহর পথে অগ্রসর হন তখন ইয়াযীদের দ্বারা কূফাহর জন্য নব-নিযুক্ত প্রশাসক ‘উবায়দুল্লাহ্ বিন্ যীয়াদ্ তার গোয়েন্দাদের মাধ্যমে তা জানতে পারে। তাই হযরত ইমাম (‘আঃ) কূফাহর পথে কারবালা উপনীত হবার আগেই ইবনে যীয়াদ্ [নিঃসন্দেহে ইয়াযীদের নির্দেশ বা অনুমতিক্রমে] সেখানে ত্রিশ হাজার সৈন্যের একটি বাহিনী প্রেরণ করে। ‘উমার্ বিন্ সা‘দের অধিনায়কত্বাধীন এ বাহিনী হযরত ইমামের (‘আঃ) কাফেলাহর গতিরোধ করে এবং এমনকি তাঁদের জন্য ফোরাত নদীর পানিও বন্ধ করে দেয়।

ইয়াযীদী বাহিনীর পক্ষ থেকে হযরত ইমামকে (‘আঃ) জানানো হয় যে, তিনি যদি ইয়াযীদের অনুকূলে বাই‘আত্ করেন তাহলে তিনি মুক্ত-স্বাধীনভাবে যেখানে ইচ্ছা যেতে পারবেন এবং ফোরাত থেকে পানি নিতেও তাঁর জন্য কোনো বাধা থাকবে না, অন্যথায় অস্ত্রের মাধ্যমে ফয়ছ্বালাহ্ হবে তথা তাঁর জন্য বন্দিত্ব বা মৃত্যুই হবে একমাত্র পরিণাম।

হযরত ইমাম হোসেন (‘আঃ) দেখতে পেলেন যে, কূফাহর যে সব লোক তাঁকে সেখানে গিয়ে সেখানকার জনগণকে নেতৃত্ব দেয়ার জন্য দাও‘আত্ করেছিলো তাদের বেশীর ভাগই - বরং কতক ব্যতিক্রম ব্যতীত প্রায় সকলেই - ইয়াযীদী বাহিনীর মধ্যে উপস্থিত - যার মানে ছিলো এই যে, তারা তাদের দাও‘আত্ ও অঙ্গীকার থেকে পশ্চাদপসরণ করেছে। সুতরাং তাঁর জন্য আর তাদের দাও‘আতে সাড়া দেয়ার নৈতিক দায়িত্ব এবং কূফায় গমনের প্রয়োজনীয়তা থাকলো না। অন্যদিকে, ইতিপূর্বে যেমন উল্লেখ করা হয়েছে, হযরত ইমামের (‘আঃ) পক্ষে ইয়াযীদের অনুকূলে বাই‘আত্ করা ও তাকে খলীফাতুল্ মুসলিমীন্ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া সম্ভবপর ছিলো না। সুতরাং তিনি শান্তির স্বার্থে শত্রু পক্ষের কাছে দু’টি বিকল্প প্রস্তাব দিলেন : তিনি যেখান থেকে এসেছেন তাঁকে সেখানে ফিরে যেতে দেয়া হোক, অথবা ইয়াযীদের শাসনাধীন এলাকার বাইরে কোনো অমুসলিম প্রধান ভূখণ্ডে হিজরত করতে দেয়া হোক।

কিন্তু শত্রু পক্ষ হযরত ইমামের (‘আঃ) সে প্রস্তাব গ্রহণ করে নি, বরং স্বীয় দাবীর ওপরে একগুঁয়েমি করতে থাকে এবং হযরত ইমাম (‘আঃ)ও আগের মতোই তাদের দাবী প্রত্যাখ্যান করেন। এমতাবস্থায় দশই মুহাররাম (৬১ হিজরী) তারিখে ইয়াযীদী বাহিনী হযরত ইমামের (‘আঃ) বিরুদ্ধে হামলা চালায় এবং হযরত ইমাম যায়নুল ‘আবেদীন্ (‘আঃ) ব্যতীত হযরত ইমাম হোসেনের (‘আঃ) পরিবারের সকল পুরুষ সদস্য ও তাঁর সহচরগণ (মোট ৭২ জন) এবং তিনি নিজে কেবল বন্দিত্ব এড়াবার লক্ষ্যে আত্মরক্ষামূলক লড়াই করে শাহাদাত বরণ করেন; আল্লাহ্ তা‘আলার বিশেষ ইচ্ছায়, - যাতে আহলে বাইতের (‘আঃ) ধারাবাহিকতার পরবর্তী মা‘ছূম্ ইমাম হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করতে পারেন - ঐ সময় হযরত ইমাম যায়নুল ‘আবেদীন্ (‘আঃ) অসুস্থ হয়ে মরণাপন্ন অবস্থায় ছিলেন - যার ফলে তিনি বন্দিত্ব এড়াবার যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে পারেন নি এবং তিনি অচিরেই নিশ্চিতই মারা যাবেন মনে করে ইয়াযীদী সৈন্যরা তাঁকে হত্যা করা হতে বিরত থাকে।

হযরত ইমাম হোসেনের (‘আঃ) দেয়া শান্তিপ্রস্তাব সম্পর্কে কোনো কোনো সূত্রে একটি বিতর্কিত তৃতীয় বিকল্পের কথাও উল্লেখ করা হয়েছে, তা হচ্ছে এই যে, তিনি বলেছিলেন যে, তাঁকে ইয়াযীদের কাছে যেতে দেয়া হোক যাতে তিনি সরাসরি তার সাথে আলোচনা করতে পারেন। কিন্তু আমরা যদি এ বিকল্পটির কথা সঠিক বলেও গ্রহণ করি তাতেও পরিস্থিতিতে কোনোই পার্থক্য ঘটে না। কারণ, সে ক্ষেত্রে হযরত ইমাম হোসেন (‘আঃ) একজন স্বাধীন মানুষ হিসেবে ইয়াযীদের কাছে যেতে ও তার সাথে আলোচনা করতে চেয়ে থাকবেন, একজন বন্দী হিসেবে নয়। কিন্তু শত্রু পক্ষ কথিত সে প্রস্তাবও গ্রহণ করে নি। ফলে তিনি দু’টি নাকি তিনটি বিকল্পের প্রস্তাব দিয়েছিলেন তাতে কোনোই পার্থক্য ঘটছে না।

এ ব্যাপারে বিতর্কের কোনোই অবকাশ নেই যে, হযরত ইমাম হোসেনকে (‘আঃ) এবং তাঁর পরিবারের সদস্য ও তাঁর সহচর ৭২ ব্যক্তিকে অন্যায় ও কাপুরুষোচিতভাবে হত্যা করা হয়েছিলো। কিন্তু তা সত্ত্বেও এমন কতক লোকও দেখা যায় যারা কারবালার এ বিয়োগান্তক ঘটনাকে যথার্থ ও যুক্তিসঙ্গত বা বৈধ বলে দেখাবার ঘৃণ্য অপচেষ্টা চালাচ্ছে।

এদের মধ্যে কতক লোক বলে যে, হযরত ইমাম হোসেন (‘আঃ) ইসলামী জাহানের তৎকালীন খলীফাহর সাথে কৃত বাই‘আত্ ভঙ্গ করেছিলেন ও তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলেন, সুতরাং একজন বিদ্রোহীর বিরুদ্ধে আত্মসমর্পণ বা নিহত না হওয়া পর্যন্ত যুদ্ধ করা অন্যায় বা অবৈধ ছিলো না।

কিন্তু এটা পুরোপুরি একটা মিথ্যা দাবী ও উপস্থাপিত যুক্তিটি একটি ভ্রমাত্মক অপযুক্তি (fallacy)। কারণ, এটি একটি বিতর্কাতীত ঐতিহাসিক সত্য যে, হযরত ইমাম হোসেন (‘আঃ) কখনোই ইয়াযীদের অনুকূলে বাই‘আত্ করেন নি, সুতরাং বাই‘আত্ ভঙ্গ করার ও বিদ্রোহ করার প্রশ্নই ওঠে না। তেমনি কারবালায় ইয়াযীদের পক্ষ থেকে তার বাহিনীর অধিনায়কের দেয়া প্রস্তাব থেকেও তা-ই প্রমাণিত হয়। কারণ, চিরাচরিত রীতি অনুযায়ী একজন বিদ্রোহীর কাছে একমাত্র যে প্রস্তাব দেয়া যেতে পারে তা হচ্ছে আত্মসমর্পণ করে স্বেচ্ছাবন্দিত্ব বরণ করে বিচারের সম্মুখীন হওয়া, নচেৎ অস্ত্রের মুখে ফয়ছ্বালাহ্, নতুন করে আনুগত্যশপথ (বাই‘আত্) করা নয়। কারণ, বিদ্রোহীকে রণাঙ্গনে আনুগত্যশপথের বিনিময়ে মুক্ত-স্বাধীনভাবে ছেড়ে দেয়ার মানে হচ্ছে পরে সুবিধাজনক অবস্থা ও অবস্থানে পুনরায় বিদ্রোহ করার জন্য সুযোগ দেয়া।

অন্যদিকে অপর কতক লোক এই বলে ইয়াযীদের পক্ষে ছাফাই গায় যে, ইয়াযীদ হযরত ইমাম হোসেন (‘আঃ)কে এবং তাঁর পরিবারের পুরুষ সদস্যদেরকে ও তাঁর সহচরদেরকে হত্যা করার জন্য নির্দেশ দেয় নি, বরং ইবনে যীয়াদ্ নিজের পক্ষ থেকে তার বাহিনীর অধিনায়ককে এ আদেশ দিয়েছিলো।

বস্তুতঃ এটাও একটা নির্জলা মিথ্যা দাবী। কারণ, শাসক (ইয়াযীদ)-এর নির্দেশ বা অনুমতি ব্যতীত একজন প্রশাসক (ইবনে যীয়াদ্)-এর পক্ষে ত্রিশ হাজার সৈন্যের একটি বাহিনী প্রেরণ - বিশেষ করে হযরত ইমাম হোসেনের (‘আঃ) কাফেলাহর ন্যায় একটি ক্ষুদ্র নিরস্ত্র কাফেলাহর বিরুদ্ধে - যা কোনোভাবেই সামরিক হুমকি ছিলো না - কোনোভাবেই সম্ভব ছিলো না। আরো বিশেষভাবে এ কারণে যে, হযরত ইমাম হোসেন (‘আঃ) কূফায়ই যাচ্ছিলেন এবং ইবনে যীয়াদের পক্ষে সেখানে তাঁর সাথে মোকাবিলা করা খুবই সহজ হতে পারতো। এমতাবস্থায় কারবালায় বাহিনী প্রেরণের উদ্দেশ্য হয়তো এটাই ছিলো যে, সেখানে ফোরাতের পানি বন্ধ করে দিলে পিপাসায় নারী ও শিশু সহ কাফেলাহর সকল সদস্যের মৃত্যু এড়াবার লক্ষ্যে হযরত ইমাম (‘আঃ) ইয়াযীদের অনুকূলে বাই‘আত্ করতে রাযী হবেন। অন্যদিকে ইতিপূর্বে হযরত ইমাম (‘আঃ) বাই‘আত্ না করলে তাঁকে হত্যা করার জন্য যে ইয়াযীদ্ মদীনার উমাইয়াহ্ প্রশাসককে নির্দেশ দিয়েছিলো সেই একই ব্যক্তি (ইযাযীদ্) একই বিষয়ে [বিশেষ করে হযরত ইমাম (‘আঃ) মদীনার প্রশাসকের খপ্পর থেকে বেরিয়ে আসার প্রেক্ষিতে] ইবনে যীয়াদকে অপেক্ষাকৃত নমনীয় নির্দেশ প্রদান করবে এটা কোনোভাবেই সম্ভব ছিলো না।

তা সত্ত্বেও আমরা যদি তাদের এ দাবীকে অর্থাৎ ইয়াযীদের আদেশ ব্যতীতই ইবনে যীয়াদ্ হযরত ইমাম হোসেন (‘আঃ) এবং তাঁর পরিবারের পুরুষ সদস্যদের ও তাঁর সহচরদের হত্যার জন্য নির্দেশ দিয়েছিলো বলে - যা কোনোই নির্ভরযোগ্য ঐতিহাসিক সূত্র থেকে প্রমাণিত নয় - যুক্তির খাতিরে সত্য বলে ধরে নেই, সে ক্ষেত্রে ইয়াযীদ্ অন্ততঃ ইবনে যীয়াদ্, ‘উমার্ বিন্ সা‘দ্ (কারবালায় ইয়াযীদী বাহিনীর অধিনায়ক) ও শিমর্ [হযরত ইমাম হোসেনের (‘আঃ) হত্যাকরী]কে শাস্তি দিতে পারতো, বিশেষ করে এ কারণে যে, কারবালার বিয়োগান্তক ঘটনা বানী উমাইয়াহ্ এবং আহলে বাইত্ (‘আঃ) ও তাঁদের অনুসারীদের মধ্যে দুশমনী, আর সেই সাথে বানী উমাইয়াহর প্রতি সমস্ত দ্বীনদার মুসলমানদের অন্তরে ঘৃণা বৃদ্ধি করেছিলো, ফলে তাদেরকে শাস্তি দিলে তাতে বিপরীত ফল পাওয়া যেতো এবং ইয়াযীদ ও বানী উমাইয়াহ্ রাজনৈতিকভাবে লাভবান হতো। কিন্তু ইয়াযীদ তা করে নি, কারণ, ইবনে যীয়াদ্ প্রমুখ কেবল ইয়াযীদের হুকূমের গোলাম ছিলো এবং ইয়াযীদের আদেশ বাস্তবায়ন করেছিলো মাত্র।

এই লোকেরা আরো দাবী করে যে, ইয়াযীদ হযরত ইমাম হোসেন (‘আঃ)কে হত্যা করার দায়ে ইবনে যীয়াদের সমালোচনা ও নিন্দা করেছিলো এবং বলেছিলো যে, সে এটা চায় নি, তেমনি ইয়াযীদ্ হযরত ইমাম হোসেনের (‘আঃ) পরিবারের সদস্যদের সাথে মানবিক আচরণ করেছিলো এবং তাঁদেরকে সসম্মানে মদীনায় পাঠিয়ে দিয়েছিলো।

আমরা নিশ্চিতভাবে জানি না ইয়াযীদ কর্তৃক ইবনে যীয়াদের সমালোচনা ও নিন্দার তথ্য এবং হযরত ইমাম হোসেনের (‘আঃ) পরিবারের সদস্যদের সাথে মানবিক ও সসম্মান আচরণের তথ্য কতোখানি সত্য। কারণ, যুগে যুগে দরবারী ও হুকূমাতের পদলেহী ঐতিহাসিকরা শাসকগোষ্ঠীকে খুশী করার জন্য ইতিহাসে অনেক মিথ্যা সংযোজন করেছে এবং অনেক সত্যকে বিপরীতভাবে বা বিকৃতরূপে উপস্থাপন করেছে। তথাপি আমরা যদি ইয়াযীদ সম্পর্কিত এ ধরনের দাবীকে যুক্তির খাতিরে সত্য বলে মেনে নেই তাতেও প্রকৃত ব্যাপারে অর্থাৎ কারবালার হত্যাকাণ্ড যে ইয়াযীদের নির্দেশেই ঘটেছিলো সে সত্যে বিন্দুমাত্র পরিবর্তন ঘটতে পারে না এবং প্রমাণিত হয় না যে, ইয়াযীদ মদীনার প্রশাসককে যে আদেশ দিয়েছিলো কূফাহর প্রশাসককে তার তুলনায় নমনীয় আদেশ দিয়েছিলো।

এখন কেউ যদি বিনা প্রমাণে দাবী করে যে, স্বৈরাচারী ও পাপাচারী ইয়াযীদ হযরত ইমাম হোসেনের (‘আঃ) কারবালায় উপনীত হবার আগেই অনুতপ্ত হয়েছিলো ও তাওবাহ্ করেছিলো তাহলে সে দাবীকে সঠিক মনে করার দাবী হচ্ছে এই যে, ইয়াযীদ হযরত ইমামকে (‘আঃ) বাধা না দেয়ার জন্য ইবনে যীয়াদকে নির্দেশ দিতো এবং তার অনুমতি ছাড়াই হযরত ইমামকে (‘আঃ) হত্যার অপরাধে ইবনে যীয়াদ্ সহ হত্যার সাথে জড়িত সকলকে আদর্শ শাস্তি দিতো - যা সে করে নি।

এরপরও যদি ইয়াযীদ কর্তৃক ইবনে যীয়াদের সমালোচনা ও নিন্দার তথ্য এবং হযরত ইমাম হোসেনের (‘আঃ) পরিবারের সদস্যদের সাথে মানবিক ও সসম্মান আচরণের তথ্য সত্য হয়ে থাকে তো তার একমাত্র ব্যাখ্যা হচ্ছে স্বৈরাচারী শাসক কর্তৃক গণপ্রতারণার লক্ষ্যে নিজের অপরাধের দায়-দায়িত্ব অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়া এবং ‘মূল শত্রু’কে হত্যা করার পর একই লক্ষ্যে তাঁর স্বজনদের সাথে কৃত্রিম ও লোকদেখানো মানবিক ও সসম্মান আচরণ করা, কারণ, রাজনৈতিক দৃষ্টিতে তাতে লাভ বৈ ক্ষতির কোনোই কারণ থাকে না। ইয়াযীদ যদি সত্যি সত্যিই তা-ই করে থাকে তো তার এ ভণ্ডামি কিছুটা হলেও সফল হয়েছে। কারণ, তা কিছু নির্বোধ লোককে প্রতারিত করতে সক্ষম হয়েছে, অবশ্য এ নির্বোধ লোকদের অন্ততঃ অংশবিশেষ সত্যিকারের নির্বোধ না-ও হতে পারে, বরং খুবই সম্ভব যে, তারা হচ্ছে আত্মবিক্রিত এবং স্বার্থান্বেষিতার কারণে নির্বোধ হবার ভান করছে মাত্র।

* * *

হযরত ইমাম হোসেন (‘আঃ) ক্বিয়ামত পর্যন্ত মুক্তি, স্বাধীনতা, মানবাধিকার ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার সংগ্রামীদের জন্য প্রেরণার উৎস - যিনি গোলামীর জীবনের ওপরে স্বাধীন মানুষ হিসেবে নিহত হওয়াকে অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন, তাই তাঁর শ্লোগান ছিলো : هَيهات مِنّا الذِّلَّة - “দূর হোক লাঞ্ছনা আমাদের থেকে।”

* * *

পুনশ্চ : কোনো কোনো লোকের ধারণা যে, ইয়াযীদ রাসূলুল্লাহর (ছ্বাঃ)-এর ছ্বাহাবী ছিলো এবং এ কারণে তার সমালোচনা করা জায়েয হবে না। শুধু তা-ই নয়, এ ধারণার বশবর্তী হয়ে তাঁরা ইয়াযীদের নামের পরে “রাযিয়াল্লাহু তা‘আলা ‘আনহ” (আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁর ওপরে সন্তুষ্ট হোন) বলে থাকেন এবং লেখার ক্ষেত্রে এর সংক্ষেপণ হিসেবে “(রাঃ)” লিখে থাকেন। এ ধরনের লোকেরা ঈমানের ঘোষণা সহকারে রাসূলুল্লাহ্ (ছ্বাঃ)কে এক নযর দেখেছেন এমন যে কাউকে ছ্বাহাবী গণ্য করেন। এ সংজ্ঞা গ্রহণ করা হলে ইসলামের দৃষ্টিতে ছ্বাহাবী হবার বিন্দুমাত্র গুরুত্ব নেই, কারণ, তাহলে ‘আব্দুল্লাহ্ ইবনে উবাই সহ রাসূলুল্লাহ্ (ছ্বাঃ)-এর যুগের সকল মুনাফিক্বকে ছ্বাহাবী গণ্য করতে হবে। [এ বিষয়ে আমি ফেসবুকে প্রকাশিত আমার প্রবন্ধ “কোরআন মজীদের দৃষ্টিতে ছ্বাহাবী ও রাসূলুল্লাহর (ছ্বাঃ) যুগের মুনাফিক্ব”-এ বিস্তারিত আলোচনা করেছি। ] সুতরাং কোনো ব্যক্তি যদি আমলের দিক থেকে যালেম ও পাপাচারী হয়, তো তার ছ্বাহাবী হওয়ায় কিছুই আসে-যায় না। তবে প্রকৃত ব্যাপার হচ্ছে এই যে, কারবালার খলনায়ক ইয়াযীদ্ বিন্ মু‘আাভীয়াহ্ আদৌ প্রচলিত সংজ্ঞা অনুযুায়ীও ছ্বাহাবী ছিলো না। কারণ, তার জন্ম রাসূলুল্লাহর (ছ্বাঃ) ওফাতের ১৫ বছর পরে ২৬ হিজরীতে। বরং ছ্বাহাবী ছিলেন তার চাচা ইয়াযীদ্ বিন্ আবী সুফীয়ান্ - যিনি ৬৪০ খৃস্টাব্দে (আনুমানিক ১৯ হিজরীতে) ইন্তেকাল করেন।

(২০শে সেপ্টেম্বর ২০১৮)

পুনরাবৃত্তি :

আশূরা দিবসে আকাঙ্ক্ষা ও নতুন মুবাহালাহ্

হে ইমাম হোসেন (‘আলাইকাস্ সালাম্)! আপনাকে দেখি নি, কিন্তু জন্মের পরে বুঝশক্তির বিকাশ হওয়ার পর সাথে সাথেই পিতা-মাতা সহ বড়দের কাছ থেকে পাক পাঞ্জাতনের কথা এবং তাঁদের অন্যতম হিসেবে আপনার কথা শুনেছি; শুনেছি, পাক পাঞ্জাতন মানে মানবকুলের শ্রেষ্ঠতম পাঁচজন - যাদেরকে সৃষ্টি করা না হলে বিশ্বজগত সৃষ্টি করা হতো না। তাই সেই শৈশব থেকেই আপনাদেরকে ভালোবেসে এসেছি।

হে ইমাম! তখন সেই শৈশবে ইমামত কী জানতাম না এবং ‘ইছ্ব্মাত্ কী বুঝতাম না, কিন্তু জানতাম যে, হযরত ইমাম হাসান ও হযরত ইমাম হোসেন (‘আঃ) রাসূলুল্লাহর (ছ্বাঃ) নাতি এবং তাঁদের জন্মই হয়েছিলো মুসলিম উম্মাহর ইমাম হিসেবে; আর শৈশবে যা শুনে জেনেছি পরবর্তীতে অকাট্য জ্ঞানেও তার সত্যতা পেয়েছি।

হে ইমাম! যখন আপনার শহীদ হওয়ার ঘটনা প্রথম বার শুনেছি তখন থেকেই বিশেষভাবে ‘আশূরার দিনে হলেও কেবল ‘আশূরার দিনে নয়, বরং যখনই স্মরণ করেছি তখনই দু’চোখ অশ্রুসিক্ত হয়েছে এবং অনেকের চোখ অশ্রুসিক্ত হতে দেখেছি।

হে ইমাম! যখনই আপনার শাহাদাত স্মরণ করেছি তখনই অন্তরে আকাঙ্ক্ষা জেগেছে, আহা! আমি যদি তখন থাকতাম তাহলে হক্ব ও বাত্বিলের সে যুদ্ধে - ঈমান ও কুফরের সে যুদ্ধে আপনার সঙ্গী-সাথীদের একজন হয়ে বাত্বিল অপশক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে শহীদ হয়ে যেতাম। তাহলে কতোই না ভাগ্যবান হতাম আমি!

হে ইমাম! আল্লাহর শপথ, আপনাকে ভালোবাসি, যদিও পরিপূর্ণ ভালোবাসার দাবী করতে পারি না - যেরূপ ভালোবাসা থাকলে প্রিয়জনের শাহাদাতের সংবাদলাভে বা স্মরণে প্রাণ দেহ থেকে বের হয়ে যায়।

হে ইমাম! পাক পাঞ্জাতনের প্রতি, বিশেষ করে আপনার প্রতি আমার এই যে অপূর্ণ ভালোবাসা, জানি না তাতে আল্লাহ্ তা‘আলা আপনাদের প্রতি যে মাওয়াদ্দাত্ ফরয করেছেন তার হক্ব কতোটুকু আদায় হয়েছে, কিন্তু এতোটুকু বলতে পারি যে, আপনার স্মরণে কোনোরূপ চেষ্টা বা চর্চা ছাড়াই এই যে নয়নের সিক্ততা ও অশ্রুপাত - এ হচ্ছে অন্তরস্থ ভালোবাসা ও বেদনারই স্বতঃস্ফূর্ত বহিঃপ্রকাশ। এ ভালোবাসা ও বেদনা অপূর্ণ হলেও আপনার মহানুভবতার কাছে আবেদন, আল্লাহ্ তা‘আলার কাছে সুপারিশ করুন, তিনি যেন এর বদৌলতে আমাকে, আমার পূর্বপুরুষদেরকে, আমার প্রিয়জনদেরকে ও আল্লাহ্ তা‘আলার মুখলিছ্ব্ বান্দাহদেরকে নাজাতের কিশতীতে সওয়ার হওয়ার ও থাকার তাওফীক্ব দেন আর হাশরের ময়দানে আপনার পাশে উত্থিত করেন।

* * *

হে আল্লাহ্! অনুগ্রহ কর “মুহেব্বিনে হোসেন”-এর ওপর এবং লা‘নত্ বর্ষণ কর তাদের ওপর যে হোসেনকে হত্যা করেছে, যে তাঁকে হত্যার জন্য নির্দেশ দিয়েছে, যারা তাঁর বিরুদ্ধে শত্রুতা করেছে, যারা তাঁকে তাঁর হক্ব্ থেকে বঞ্চিত করেছে, যারা তাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে, যারা তাঁর নিহত হওয়ায় খুশী হয়েছে, যারা তাঁকে বৈধ খলীফাহর বিরুদ্ধে বিদ্রোহী বলে ও তাঁর হত্যাকে সঠিক কাজ ছিলো বলে অপপ্রচার চালিয়ে সরলমনা মুসলমানদেরকে বিভ্রান্ত করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে; তাদের ওপর লা‘নত্ কর দুনিয়ায়, ‘আালামে বারযাখে ও ‘আালামে আখেরাতে।

হে আল্লাহ্! তুমি জানো যে, হোসেন হক্বের ওপরে ছিলেন। কিন্তু এ সত্ত্বেও কিছু লোক হোসেনকে বৈধ খলীফাহর বিরুদ্ধে বিদ্রোহী বলে ও ইয়াযীদকে হক্ব্পন্থী বলে অপপ্রচার চালিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছে এবং “মুহেব্বিনে হোসেন”-কে কষ্ট দিচ্ছে। হে আল্লাহ্! আমরা তোমার মাধ্যমে তাদের প্রতি মুবাহালাহর আহবান জানাচ্ছি। হে আল্লাহ্! যদি এমন হয়ে থাকে যে, হোসেন হক্ব্-এর ওপর ছিলেন ও ইয়াযীদ্ বাত্বিলের ওপর ছিলো (নিঃসন্দেহে তা-ই), তাহলে যারা হোসেনকে বাত্বিলের ওপর ও ইয়াযীদকে হক্বের ওপর বলে দাবী করে তাদের ওপর লা‘নত কর, আর এর বিপরীত হলে তথা ইয়াযীদ যদি হক্বের ওপর থেকে থাকে ও হোসেন যদি বাত্বিলের ওপর থেকে থাকেন (যদিও নিঃসন্দেহে এমনটি নয়), তাহলে আমরা যারা মুহব্বিনে হোসেন তাদের ওপর লা‘নত কর।

হে আল্লাহ্! আমরা মুবাহালায় আমাদের পক্ষ থেকে যা করণীয় তা আঞ্জাম দিয়েছি, এবার, যারা ইয়াযীদকে হক্বের ওপর ও হোসেনকে বাত্বিলের ওপর বলে দাবী করে তারা এ মুবাহালায় আমাদেরই মতো প্রকাশ্যে অংশ নিয়ে লা‘নত্ করুক।

* * *