কারবালা ও ইমাম হোসাইন (আ.)-৫ম পর্ব

আলী আকবর (আ.)-এর বীরত্ব

ইমাম হোসাইন (আ.)এর সঙ্গীরা ক্ষতবিক্ষত ও রক্তাক্ত অবস্থায় একে একে ভূমিতে লুটিয়ে পড়েন। আহলে বাইত ছাড়া আর কেউ বেচে নেই।

এ সময় সবচেয়ে সুন্দর অবয়ব, সর্বোত্তম চরিত্রের অধিকারী আলী বিন হোসাইন (আ.) তার পিতার কাছে এসে যুদ্ধের অনুমতি প্রার্থনা করেন। ইমাম হোসাইন (আ.) তৎক্ষণাৎ অনুমতি দেন। এরপর তার দিকে উদ্বেগের দৃষ্টি ফেলেন আর ইমামের দু’চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছিল। অশ্রুসিক্ত অবস্থায় বললেনঃ

أللّهُمّ اشْهدْ، فقدْ برز إليْهمْ غُلامٌ أشْبهُ النّاس خلْقا وخُلُقا ومنْطقا برسُولك صلّى اللّه عليه و آله ، وكُنّا إذا اشْتقْنا إلى نبيّك نظرْنا إليْه

হে খোদা,তুমি সাক্ষী থাক! তাদের দিকে এমন এক যুবক অগ্রসর হয়েছে যে শরীরের গঠন, সৌন্দর্য চরিত্র ও বাক্যালাপে তোমার রাসূল (সা.) এর সাদৃশ্যপূর্ণ। আমরা যখন তোমার নবী (সা.) এর দিকে চাওয়ার আকাঙ্ক্ষা করতাম এ যুবকের দিকেই তাকাতাম। এরপর ওমর বিন সা’দের প্রতি লক্ষ্য করে সুউচ্চকন্ঠে বললেনঃ

يابْن سعْدٍ قطع اللّهُ رحمك كما قطعْت رحمى

হে সা’দের ছেলে দুশমনের মোকাবিলায় প্রচণ্ড লড়াই শুরু করেন। বহুসংখ্যক শত্রুসৈন্য হত্যা করে ক্লান্ত-শ্রান্ত-তৃষ্ণার্ত অবস্থায় পিতা ইমাম হোসাইনের (আ.) কাছে এসে বললেনঃ

يا أبت، ألْعطشُ قدْ قتلنى ، وثقْلُ الْحديد قدْ أجْهدنى ، فهلْ إلى شرْبةٍ منْ الْم أ سبيلٌ؟

হে মহান পিতা, পিপাসায় আমার জীবন ওষ্ঠাগত, যুদ্ধের প্রচণ্ডতায় আমি ক্লান্ত, আমাকে একটু পানি দিয়ে জীবন বাচাতে দাও। ইমাম হোসাইন (আ.) কান্নাবিজড়িত কন্ঠে বললেন- اغوْثاهُ হায় কে সাহায্য করবে। প্রিয় ছেলে ফিরে যাও, যুদ্ধ চালাও সময় ঘনিয়ে এসেছে। একটু পরেই আমার নানা মুহাম্মদ (সা.)-এর সাক্ষাৎ করবে। তার হাতের পেয়ালা এমনভাবে পান করবে-এরপর আর কখনও পিপাসা হবে না। আলী ময়দানে ফিরে যান, জীবনের মায়া ত্যাগ করে শাহাদতের জন্য প্রস্তুতি নেন।

প্রচণ্ড হামলা শুরু করেন। হটাৎ মুনকিজ বিন মুররা আবদী (আল্লাহর লানত তার উপর বর্ষিত হোক) আলী বিন হোসাইন (আ.) এর দিকে তীর নিক্ষেপ করেন। এ তীরের আঘাতে তিনি ধরাশায়ী হয়ে পড়েন। চিৎকার দিয়ে বলেনঃ

يا أبتاهُ عليْك منّى السّلامُ، هذا جدّى يقْرؤُك السّلامُ ويقُولُ لك: عجّل الْقُدُوم عليْنا

বাবা! খোদা হাফেজ, আপনার প্রতি সালাম। আামর সামনেই নানা মুহাম্মদ (সা.) আপনাকে সালাম জানাচ্ছেন আর বলছেন-“হে হোসাইন তাড়াতাড়ি আমাদের সাথে মিলিত হও।” এরপরই একটি চিৎকার দিয়ে শাহাদাতের শরবত পান করেন।

হোসাইন (আ.) নিহত সন্তানের মাথার কাছে দাড়ালেন।

তার গালে গাল লাগিয়ে চুমু খেলেন আর বললেনঃ

হে বৎস! আল্লাহ সে সম্প্রদায়কে হত্যা করবে যে তোমাকে হত্যা করেছে। এরা আল্লাহর কাছে কতই না অপরাধ করেছে, আল্লাহর রাসূলের সম্মানে কতই না আঘাত হেনেছে।

বর্ণিত হয়েছে যয়নব (আ.) তাবু থেকে বের হয়ে ময়দানের দিকে ছুটে চললেন এবং ভয়ানক চিৎকার দিয়ে বললেন-

يا حبيباهُ يابْن أخاهُ হে আদরের ধন, হে ভাতিজা, আপন ভাতিজার লাশের কাছে এসে গড়িয়ে গড়িয়ে কেদেছিলেন। ইমাম হোসাইন (আ.) এসে তাকে নারীদের তাবুতে ফিরিয়ে নেন। এরপরই আহলে বাইতের যুবকরা একে একে ময়দানে অবতীর্ণ হলেন এবং ফরিয়াদ করে বললেন-হে আমার চাচাতো ভাইয়েরা, হে আমার বংশধরগণ ধৈর্য ধারণ করো। আল্লাহর শপথ, আজকের দিনের পর কোনদিন অপমানিত লাঞ্ছিত হবে না।

কবি বলেনঃ

এসেছে নিশি, পূর্ণশশী তুমি তো আসনি

জীবন ওষ্ঠাগত, আমার জীবন হে আলী আসনি

খাচার পাখী মরুর দিকে উড়ে গেল

কিন্তু হে হোমা পাখী তার কাছেও আসনি

আমার সম শরৎ অন্তর তোমার দিদারে হতো বসন্ত

হে গোলাপ পুষ্প কেন তুমি আসনি

ছাড়লাম অশ্রু, গেলাম সবার আগে তোমার গমন পথে

তোমার প্রতীক্ষায় হলাম পেরেশান-তুমি তো আসনি

অধীর আগ্রহে প্রতীক্ষায় ছিলাম তুমি যদি আস

তোমার পায়ে জান করব কোরবান, তুমি তো আসনি।

কাসেম বিন হাসান (আ.) ময়দানে আসলেন

রাবী বলেছেনঃ এমন একজন যুবক ময়দানে এসে যুদ্ধ শুরু করলেন যার চেহারা ছিল পূর্ণ চাঁদের মতো। ইবনে ফুজাইল আযদী তার মাথায় এমন জোরে তরবারী চালিয়ে দেয় এতে তার মাথা দু’ভাগ হয়ে যায়। তিনি ধূলায় লুটিয়ে পড়ে চিৎকার দিয়ে বলে ওঠেনঃ ‘হে চাচা! হোসাইন (আ.) শিকারী বাজপাখির মতো ময়দানে ঝাপিয়ে পড়লেন । ক্রোধান্বিত বাঘের মত ইবনে ফুজাইলের উপর হামলা চালান। এতে তার হাত বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তার চীৎকার শুনে কুফাবাসী সৈন্যরা তাকে রক্ষার জন্য হামলা চালায় কিন্তু সে ঘোড়ার পায়ের নীচে ছিন্নভিন্ন ও ধূলিস্যাৎ হয়ে যায়।

ময়দান ধূলায় ছেয়ে যায়। দেখলাম হোসাইন (আ.) কাসেমের শিয়রে উপস্থিত হলেন। সে তখনও হাত-পা নাড়ছিল। হোসাইন (আ.) বললেন-

بُعْدا لقوْمٍ قتلُوك، ومنْ خصمهُمْ يوْم الْقيامة فيك جدُّك

“সে সম্প্রদায়ের প্রতি অভিশাপ-যারা তোমাকে হত্যা করেছে। কিয়ামত দিবসে তোমার হত্যার বিচার যারা চাইবেন তারা হলেন তোমার নানা ও বাবা।”

এরপর বললেনঃ

আল্লাহর শপথ! তোমার চাচাকে কেউ আহ্বান করলে তিনি সাড়া দেবেন না এটা হতেই পারে না, যদিও তোমার কোন উপকারে নাও আসে।

“খোদার শপথ! আজ এমন একটি দিন যেদিন তোমার চাচার দুশমনের সংখ্যা অধিক আর বন্ধুর সংখ্যা অনেক কম।”

একথা বলেই ইমাম কাসেমকে বুকে তুলে আহলে বাইতের শহীদগণের সারিতে রেখে দেন।

হেসাইন (আ.) যখন দেখলেন যুবকদের দু’হাত কর্তিত অবস্থায় ধূলায় লুটিয়ে আছে, শাহাদাতের জন্য প্রস্তুত হয়ে আছে। উচ্চকন্ঠে ফরিয়াদ করলেনঃ

هلْ منْ ذابٍّ يذُبُّ عنْ حرم رسُول اللّه؟ هلْ منْ مُوحّدٍ يخافُ اللّه فينا؟ هلْ منْ مُغيثٍ يرْجُو اللّه بإغاثتنا؟

কেউ আছ কি যে দুশমনদেরকে রাসূলে খোদা (সা.) এর পবিত্র হেরেম থেকে তাড়িয়ে দেবে? এক আল্লাহর পূজারী কেউ আছ যে আমাদের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করবে। কেউ আছ যে আল্লাহর জন্যই আামাদের সাহায্য করবে?

ইমাম (আ.) এর এ কথাগুলো তাবুতে অবস্থানকারী নারীদের কানে পৌছলে তাবুর ভেতর কান্নার রোল পড়ে যায়।

কবি বলেন-

বিশ্বাসের পথে দুঃখ-যাতনা কতই না সুখের

নিজের জীবন দিয়ে সকলের জীবন ক্রয় কতই না আনন্দের।

তোমার মত বন্ধুর কদমে জান দেয়া কতই না সৌভাগ্যের।

কারবালার ধুলাকালিতে রক্তে গড়াগগি কতই না আনন্দের।

তোমার মত বাদশাহর সামনে থেকে কিসের চিন্তা, শংকা

তোমার পথে হাতযুগল কর্তিত হওয়া কতই না খুশীর বিষয়।

দুধের শিশুর শাহাদাত

হোসাইন (আ.) তাবুর দরজায় এসে যয়নবকে বললেন-

ناولينى ولدى الصّغير حتّى أُودّعهُ

“আমার ছোট ছেলেকে দাও-তার কাছে থেকে বিদায় নেই।”

দুধের শিশুকে হাতে তুলে নিয়ে ইমাম (আ.) তাকে চুমু দেয়ার জন্য উপরের দিকে উঠাচ্ছেন এমন সময় হারমালা বিন কাহেল আসাদীর (আল্লাহর লানত তার উপর আপতিত হোক) একটি তীর এসে শিশুর গলায় বিদ্ধ হওয়ার সাথে সাথে আলী আসগর শাহাদাত বরণ করেন। হোসাইন (আ.) বললেনঃ এ শিশুকে নাও, নিজের হাত মোবারক শিশুর গলার রক্তস্রোতে রাখলেন। যখন তার হাত তাজা রক্তে রঞ্জিত হয়ে পড়ে, আকাশের দিকে রক্ত ছুড়ে বললেন-

“এসব মুছিবত আমার জন খুবই সহজ। কেননা, এসবই আল্লাহর রাস্তায় হচ্ছে আর আল্লাহ দেখছেন।”

হযরত ইমাম বাকের (আ.) বলেন-ঐ সব রক্তকণা যা ইমাম হোসাইন আকাশের দিকে নিক্ষেপ করেন একটুও যমীনে ফিরে আসেনি।

প্রখ্যাত লেখক জুরজী যায়েদান লিখেছেন-এ দুধের শিশুর শাহাদাত হোসাইন বিন আলীর নিষ্পাপ ও মজলুম হওয়াকে দুনিয়ায় প্রমাণ করে দিয়েছে। কেননা যদি সে শহীদ না হতো সম্ভাবনা ছিল বনি উমাইয়ার প্রচারযন্ত্র জনগণকে এই বলে বিভ্রান্ত করতো যে, হোসাইন (আ.) তার একদল সঙ্গী-সাথী নিয়ে রাজত্ব লাভের জন্য যুদ্ধের ময়দানে এসেছেন। আমরা প্রতিরক্ষার জন্যই তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছি, আর এর ফলে তার সঙ্গী-সাথীসহ নিহত হয়েছে, এতে আমাদের কোন দোষ নেই।”

কিন্তু জনতার প্রশ্ন যদি ধরে নেয়া হয় হোসাইন (আ.) ও তার সাথীরা অপরাধী এবং যুদ্ধাংদেহী, দুধের শিশু তো যুদ্ধ করতে আসেনি, কাউকে হত্যা করেনি-তাকে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করা হল কেন? এ নিষ্পাপ দুধের শিশুর রক্তে কারবালা রঞ্জিত হল কেন?

কবি বলেনঃ

হোসাইন এসেছে ময়দানে

আর আলী আসগর তার কোলে।

নীরব ঠোঁটে সে বলেছে তার মনের জ্বালা

শংকাহীন পানিবিহীন অবস্থায়

তার কোলে মাথা ঝুকিয়েছে

রংবিহীন ঠোঁট খুনরাঙা অন্তরের দৃষ্টি

চিন্তিত শংকিত, কারবালার

পরিস্থিতি রহিত করেছে

সব ধৈর্য ও হুশ।

দুধ নেই তাতেও নেই কান্না, পানি নেই

তবুও নেই আহাজারি

কখনও বের করেছেন জিহ্বা অতি আরামে

তার নিরব ঠোঁটে লালাও নেই আজ

আকবরের মতো আসগরও আল্লাহর

পথে যাত্রী মাছের মতো

লাফাচ্ছে ডাঙায়, কিন্তু তার

ঠোঁটে রয়েছে মুচকি হাসি।

বাদশাহর আগমনে প্রতীক্ষায় বাঁশির সুর

বেজে উঠলো আপাদমস্তক তার

রক্তে রঞ্জিত আর আলী আসগর

তার কোলে, এ তৃষ্ণার্ত মেহমানের

গলে বিষাক্ত তীর মারাত্মকভাবে

হল বিদ্ধ।

হযরত আবুল ফজল (আ.) এর ত্যাগ ও শাহাদত

রাবী বলেনঃ হোসাইন (আ.) পিপাসায় কাতর হয়ে ফোরাতের তীরে উপস্থিত হলেন। সাথে রয়েছে তার ভাই আব্বাস। ইবনে সা’দের বাহিনী ঝাপিয়ে পড়ল দু’জনার উপর। তাদের পথ বন্ধ করল। বনি দারম গোত্রের এক দুরাচার আবুল ফজল আব্বাস (আ.) এর দিকে তীর নিক্ষেপ করলে তার পবিত্র মুখে বিদ্ধ হয়। ইমাম হোসাইনই (আ.) তা টেনে বের করে নেন তার হাত রক্তে রঞ্জিত হয়ে যায়। রক্তগুলো ছুড়ে ফেলে বললেন-হে খোদা! এ জনগোষ্ঠী তোমার নবী নন্দিনীর সন্তানের উপর এ জুলুম চালাচ্ছে এদের বিরুদ্ধে তোমার দরবারে বিচার দিচ্ছি ।ইবনে সা’দের বাহিনী মুহূর্তের মধে ইমাম হোসাইন (আ.) থেকে হযরত আব্বাস (আ.) কে ছিনিয়ে নেয়। চতুর্মুখী আক্রমণ, তরবারীর সম্মিলিত আঘাতে হযরত আব্বাস (আ.) তার শাহাদাতে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। কবি তাই বলেছেন-

কতই না উত্তম ব্যক্তি যার জন্য ইমাম হোসাইন (আ.) কারবালার এ কঠিন মুছিবতের সময়ও কেদেছেন। তিনি ছিলেন হোসাইনের ভাই তার বাবা ছিলেন আলী, তিনি তো আর কেও নন রক্তাক্ত বদন আবুল ফজল আব্বাস। তিনি ছিলেন ইমাম হোসাইনের সহমর্মী, কোন কিছুই তাকে এ পথ থেকে সরাতে পারেনি। প্রচণ্ড পিপাসা নিয়ে ফোরাতের তীরে পৌছেন কিন্তু হোসাইন যেহেতু পান করেন নি তিনিও তাই পানি মুখে নেননি।

অন্য কবি বলেন-

মুষ্ঠির মাঝে পানি লইলেন-মন ভরে পান করে নিবারিবেন তৃষ্ণা কিন্তু যখনই হোসাইনের পিপাসার কথা মনে পড়লো-হাতের মুটোয় পানিতে অশ্রু ফেলে ফিরে আসলেন।

হযরত আবুল ফজল আব্বাস (আ.) এর মহান আত্মত্যাগ সকল লেখক, চিন্তাশীলদের দৃষ্টিতেই গুরুত্বপূর্ণ।

আল্লামা মাজলিশী তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘বিহারের’ মধ্যে লিখেন-হযরত আব্বাস ফোরাতের তীরে গেলেন। যখনই অঞ্জলী ভরে পানি পান করতে চাইলেন হটাৎ হোসাইন (আ.) ও তার আহলে বাইতের পানির পিপাসার যন্ত্রণার কথা মনে পড়ল। পানি ফোরাতেই ফেলে দিলেন পান করলেন না।

একজন আরবী কবি বলেন-

আবুল ফজল আব্বাস তার সবচেয়ে মূল্যবান প্রাণ হোসাইন (আ.) এর জন্যই উৎসর্গ করেছেন। হোসাইন (আ.) পান করার পূর্বে তিনি নিজে পান করলেন না মানুষের কর্মের সর্বোত্তম কর্ম ও মূল কাজই তিনি করলেন, আপনি তো গৌরবের দিবসে রাসূলের দুই নাতির ভাই আর আপনিই তো পানি পানের দিবসে করেছেন আত্মত্যাগ হে আবুল ফজল।

পানি টলটলায়মান-বাদশাহ তৃষ্ণায় ওষ্ঠাগত,

উদ্দম তার অন্তরে হাতে রয়েছে পানির মশক,

মুরতাজার সিংহ শাবকেরে হামলা করল এমনভাবে

এ যেন অগণিত নেকড়ের মাঝে এক বাঘ।

এমন একটি বদন কেউ দেখেনি

যাতে কয়েক হাজার তীর

এমন একটি ফুল কেউ দেখেনি

যাতে রয়েছে কয়েক হাজার কাটা।

যুদ্ধের ময়দানে শহীদগণের নেতা ইমাম হোসাইন (আ.)

ইমাম হোসাইন (আ.) ময়দানে এসে শত্রুপক্ষকে মল্লযুদ্ধের আহ্বান জানালেন। দুশমনের খ্যাতনামা বীর একে একে ইমাম (আ.) এর আঘাতে ধরাশায়ী হচ্ছে। তাদের বহুসংখ্যক নিহত হওয়ার পর ইমাম (আ.) হটাৎ বলে উঠলেন-

লজ্জার বাধনে থাকার চেয়ে মৃত্যুই শ্রেয়

জাহান্নামে যাওয়ার চেয়ে লজ্জাই শ্রেয়

একজন বর্ণনাকারী লিখেছেনঃ আল্লাহর শপথ! দুশমন বেষ্টিত সন্তান, পরিবার ও সাথীদের লাশ চোখের সামনে। এ অবস্থায় হোসাইন (আ.) এর চেয়ে অধিক দৃঢ়চিত্ত বীর আর কেউ হতে পারে না। যখনই শত্রুবাহিনী সম্মিলিত হামলা চালাতো তিনি তাদের দিকে তরবারী হানতেন পুরো বাহিনী চতুর্দিকে নেকড়ের মত ছিটকে পড়তো। এক হাজারের অধিক সৈন্য এক সাথে তার উপর হামলা চালায়। ইমাম (আ.) এর সামনে এসে পঙ্গপালের মতো পালাতে থাকে। একটু দূরে গিয়েই বলতে থাকে-

লা-হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ।

প্রচণ্ড যুদ্ধ চলছে-দুশমন প্রায় তাবুর কাছে পৌছে গেছে । এমন সময় হোসাইন (আ.) ফরিয়াদ করে বললেন-

হে আবু সুফিয়ানের বংশের দল, যদি তোমাদের দীন না থেকে, পরকালেকে ভয় না-ও করো অন্ততপক্ষে দুনিয়ায় স্বাধীন থাকো। তোমাদের বংশ, বুনিয়াদের দিকে তাকাও যদি আরব হয়ে থাক, তোমরা তাই দাবী করছ।

শিমার বলল-হে ফাতেমার সন্তান কি বলছ? ইমাম (আ.) বললেনঃ

আমি তোমাদের সাথে যুদ্ধ করব আর তোমরা আমার সাথে যুদ্ধ করবে। নারীরা তো কোন অপরাধ করেনি। আমি যতক্ষণ জীবিত আছি এসব অকৃতজ্ঞ, মূর্খ ও জালেমদেরকে আমার তাবুতে ঢুকতে দেব না। শিমার বলল তোমার এ প্রস্তাব গ্রহণ করলাম। এরপরই শিমারের নেতৃত্বে ইমাম হোসাইন (আ.) কে হত্যার জন্য পূর্ণ প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়। তারা ইমাম হোসাইন (আ.) এর উপর হামলা করে। ইমাম (আ.) ও পাল্টা হামলা চালান। এ সময় ইমাম পিপাসায় কাতর হয়ে পড়েন। শত্রুদের কাছে একটু পানি চান কিন্তু তারা এক ফোটা পানিও দেয়নি। এ সময়ের মেধ্যে ইমামের পবিত্র বদন ৭২টি আঘাতে জর্জরিত হয়ে যায়।

তিনি থমকে দাড়িয়ে গেলেন। দুর্বলতার কারণে কিছু সময় যুদ্ধ করতে সক্ষম হননি। দাড়িয়ে আছেন এমন সময় একটি পাথর এসে তার পেশানীতে আঘাত হানল। রক্তধারা গড়িয়ে পড়ে জামা ভিজতে শুরু করে। তিনি নিজের জামা দিয়ে রক্তস্রোত বন্ধ করতে চেষ্টা করেন এমন সময় একটি বিষাক্ত ত্রিশূল এসে ইমামের বুকে বিদ্ধ হয়-ইমাম হোসাইন (আ.)-এর মুখ দিয়ে বের হযে আসে-

بسْم اللّه و باللّه و على ملّة رسُول اللّه

এরপর আকাশের পানে মুখ করে ইমাম বলতে লাগলেন-

“হে খোদা, তুমি জানো এ বাহিনী যাকে হত্যা করছে নবী নন্দিনীর ছেলেদের মধ্যে সে ছাড়া আর কেউ নেই।” এরপর নিজেই ত্রিশূলটি টেনে বের করেন আর রক্ত বন্যার মতো গড়িয়ে পড়তে থাকে। এর ফলে তিনি যুদ্ধ করার শক্তি হারিয়ে ফেলেন তিনি নীরব নিথর অবস্থায় দাড়িয়ে আছেন কিন্তু যেই তাকে হত্যার জন্য এগিয়ে আসে সেই আল্লাহর নিকট হোসাইনের হন্তা হিসেবে চিহ্নিত হবার ভয়ে আবার পিছু হটে। এরপর কান্দা গোত্রের মালেক বিন ইয়াসার ইমাম হোসাইনের (আ.) সামনে দাড়িয়ে তাকে অত্যন্ত খারাপ গালি দিয়ে ইমামের মাথায় তরবারী চালিয়ে দেয় । তাতে তার পাগড়ী ভেদ করে মাথায় ঢুকে পড়ে। ইমামের গোটা পাগড়ী রক্তে রঞ্জিত হয়। ইমাম একখানা রুমাল দিয়ে মাথা বাধলেন ও মাথায় দেয়ার জন্য একটি টুপি চাইলেন। এরপর পাগড়ী দিয়ে মাথা ভালভাবে বাধলেন। ইবনে যিয়াদের বাহিনী একটু বিরতি দিয়েই চতুর্দিক থেকে তাকে ঘিরে ফেলে।

আব্দুল্লাহ বিন হাসান (আ.)-এর শাহাদত

আব্দুল্লাহ বিন হাসান বিন আলী (আ.) ছিলেন নাবালেগ (অপ্রাপ্তবয়স্ক কিশোর)। নারীদের তাবু থেকে বের হয়ে ইমাম হোসাইন (আ.) এর সামনে দাড়ালেন। যয়নব (আ.) দৌড়ে এসে তাকে তাবুতে ফিরিয়ে নিতে চাইলেন। কিন্তু এ কিশোর রাজী না হয়ে বলল-খোদার শপথ! আমার চাচার কাছ থেকে দূরে যাব না। এ সময় আবহুর বিন কাব অন্য বর্ণনামতে, হারমালা বিন কাহেল (লানাতুল্লাহে আলাইহিমা) ইমাম হোসাইন (আ.) এর গায়ে তরবারী চালানোর জন্য উদ্যত হয়। কিশোর আব্দুল্লাহ চিৎকার দিয়ে বলে) হে জারজ আবহুর! তোর ধ্বংস হোক। আমার চাচাকে হত্যা করতে চাও? এ চিৎকার শোনার পরও এ নাপাক ইমামের গায়ে তরবারীর আঘাত হানতে গেলেই কিশোর নিজের হাত দিয়ে তা ফিরাতে চেষ্টা করে। তরবারীর আঘাত তার হাতে লাগলে সে চিৎকার দিয়ে ওঠে। হে চাচা! ইমাম হোসাইন (আ.) তাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন এবং বললেন- ভাতিজা এ মুছিবতে তুমি ধৈর্য ধারণ কর, আল্লাহর দরবারে কল্যাণ কামনা কর। কেননা মহান আল্লাহ তোমাকে নেককার বান্দাদের কাতারে শামিল করবেন। হটাৎ হারমালা বিন কাহেল দূর থেকে আব্দুল্লাহকে লক্ষ্য করে তীর ছুড়ে। ফলে ইমাম হোসাইনের (আ.) কোলেই আব্দুল্লাহ শহীদ হন। তারপরই শিমার বিন জিলজওশন তাবুতে হামলা চালায়, নিজের বর্শার আঘাতে তাবু দ্বিখণ্ডিত করে চিৎকার দিয়ে বলে আগুন নিয়ে এসো, তাবুতে যারা আছে তাদেরসহ আগুন লাগিয়ে দাও। হোসাইন (আ.) বললেন, হে শিমার! তুমি আমার আহলে বাইতকে পুড়িয়ে মারার জন্য আগুন চাচ্ছ! আল্লাহ তোমাকেও আগুনে জ্বালাবেন। ‘শাবছ’ এসে শিমারের এ কাজের তিরস্কার করে। শিমার লজ্জিত হযে তাবুতে আগুন দেয়া বন্ধ রাখে। হোসাইন (আ.) বললেন, আমার জন্য এমন একটি পুরানো জামা নিয়ে এসো যাতে কেউ ঐ জামার প্রতি আসক্ত না হয়। আর আমার পোশাকের নিচে আমি এজন্য পরিধান করব যেন আমার শরীর পোশাকবিহীন না থাকে। ইমামের জন্য ইয়েমেন থেকে পাওয়া একটি জামা আনা হল। তিনি জামার একাংশ ছিড়ে মূল জামার নীচে পরিধান করলেন। কিন্তু ইমামের শাহাদাতের পর আবহুর বিন কাব তার শরীর থেকে সব জামা খুলে ইমামের পবিত্র বদনকে উলঙ্গ অবস্থায় ফেলে রাখে। এ কাজের ফলে তার দু’হাত গ্রীষ্মকালের শুকনো কাঠ, শীতকালের বরফের মত ঠাণ্ডা হয়ে রক্ত ঝরতে থাকে। মৃত্যু পর্যন্ত তাকে এ শাস্তি ভোগ করতে হয়।

রাবী বলেছেনঃ ইমাম হোসাইন (আ.) যখমের কারণে দুর্বল হয়ে পড়েন। দুশমনের অসংখ্য তীর তার বদনে কাটার মতো বিদ্ধ ছিল। সালেহ বিন ওহাব মুযনী তার পাজরে একটি বর্শা নিক্ষেপ করলে ইমাম অশ্ব থেকে যমিনে লুটিয়ে পড়লেন। তার মাথা মাটির সাথে লাগিয়ে বলছিলেন-

بسْم اللّه و باللّه و على ملّة رسُول اللّه

একটু পরেই যমীন থেকে মাথা তুললেন। এ সময় হযরত যয়নব (আ.) তাবু থেকে বেরিয়ে এসে সুউচ্চ কন্ঠে ফরিয়াদ করলেন-

“হে ভাই আমার, হে আমাদের নেতা, হায় আহলে বাইত।”

তারপর বললেন-

“হায় আসমান যদি যমিনে ভেঙ্গে পড়তো, হায়! পাহাড় যদি ছিন্নভিন্ন হয়ে যমীনে পড়তো।” এ সময় শিমার চিৎকার দিয়ে তার সৈন্যদের বলল, কিসের অপেক্ষা করছ, হোসাইনকে শেষ করে দিচ্ছ না কেন?” সেনাবাহিনী চতুর্দিক থেকে তাকে ঘিরে ফেলে সম্মিলিতভাবে ইমামের শরীরে হামলা চালায়। যুরআ বিন শুরাইক ইমাম হোসাইন (আ.)-এর বাম কাধে তরবারীর আঘাত হানে। তিনি পাল্টা হামলা করলে সে নিহত হয়। আরেক ব্যক্তি তার অপর কাধে আঘাত হানে। তাতে তিনি নুয়ে পড়েন। বিভীষিকা ও ক্লান্তিতে চেহারা মলিন হয়ে পড়ে। বার বার উঠতে চেষ্টা করেন, কিন্তু দুর্বলতা ও ক্লান্তিতে বসে পড়েন। সেনান বিন আনাস নাখয়ী ইমাম হোসাইন (আ.) এর গলায় বর্শার আঘাত হেনে তা টেনে বের করে। এরপর বুকে নিক্ষেপ করে তা বুকের হাড়ে বিদ্ধ হয়ে যায়, এরপর একটি তীর তার গলায় বিদ্ধ করে। এতে করে ইমাম হোসাইন (আ.) ধরাশায়ী হয়ে পড়েন । তারপরও ইমাম উঠে দাড়ান এবং নিজের গলা থেকে তীর বের করে ফেলেন। দু’হাতে রক্ত চেপে ধরে যখন হাত ভরে যায় সে রক্ত দিয়ে নিজের চেহারা মোবারক রঞ্জিত করেন। আর বলেন-এ অবস্থায় আল্লাহর সাক্ষাৎ করব। রক্ত ছাড়াই খেজাব লাগিয়েছি। এরা আমার অধিকার ছিনিয়ে নিয়েছে।

ওমর বিন সা’দ তার ডানপাশে দাড়ানো এক ব্যক্তিকে বলল, যাও হোসাইনের কাজ সাঙ্গ করে এস। খুলী বিন ইয়াজিদ আসবাহী হোসাইন (আ.) এর বদন থেকে মাথা বিচ্ছিন্ন করার জন্য উদ্যোগ নেয়, কিন্তু তার শরীরে কাপন সৃষ্টি হয়, সে ফিরে যায়। সেনান বিন আনাস অশ্ব থেকে নেমে পড়ে। ইমাম হোসাইন (আ.) এর ঘাড়ে তরবারী বসিয়ে দেয় । আর বলে-খোদার শপথ, তোমর মাথা বিচ্ছেদ করেই ছাড়বো। আমি জানি তুমি মহানবীর আওলাদ, মাতা-পিতার দিক থেকে সর্বোত্তম মানুষ । এরপর এ মহান বদন থেকে মাথা বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। এ প্রসঙ্গে কবি বলেছেন-

ইমাম হোসাইন (আ.)এর মুসিবতের সাথে কোন মুসিবতের তুলনা করবে। সেদিনের বিপদ কতই না জঘন্য যেদিন অপবিত্র ও অপরাধী সেনান বিন আনাসের হাত তাকে হত্যা করেছে এবং শরীর থেকে মাথা বিচ্ছিন্ন করেছে।

মরহুম মুহাদ্দেস কোমীর বর্ণনামতে ইমাম হোসাইন (আ.)-এর হন্তা ছিল শিমার । এরপর বর্তমান গ্রন্থের হুবহু বর্ণনা দেন। নাসেখুত তাওয়ারিখ গ্রন্থে হোসাইন (আ.) এর হন্তা সম্পর্কে বিভিন্ন মানুষের মতামত উল্লেখ করে লিখেছেন, অধিকাংশের মতে শিমার জিল জওশন ছিল ইমামের হন্তা। এটাই অধিক সমর্থনযোগ্য। তবে হতে পারে খুলী এবং সেনান তাকে সহযোগিতা করেছে।–অনুবাদক

আবু তাহের মুহাম্মদ বিন হাসান তরসী তার মায়ালেমুদ্দিন গ্রন্থে বর্ণনা করেন যে, ইমাম সাদেক (আ.) বলেছেন-হোসাইন (আ.) যখন শহীদ হলেন ফেরেশতাগণ দলে দলে তার শিয়রে আসে। তারা বলতে থাকে, ‘হে খোদা তোমার মনোনীত এবং নবী নন্দিনীর সন্তানকে এরা এভাবে হত্যা করল। মহান আল্লাহ হযরত ইমামে যামানের (মাহদী) ছবি তাদের সামনে প্রদর্শন করে বললেন-এ ব্যক্তির মাধ্যমে ইমাম হোসাইন (আ.) এর দুশমনদের প্রতিশোধ নেব। বর্ণিত হয়েছে, সেই সেনান বিন আনাসকে মোখতার পাকড়াও করে এবং তার আংগুলগুলোর প্রতিটি গিট বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। এরপর তার হাত-পা কেটে দেয়। বাকী অংশে জয়তুনের তেল ঢেলে তাকে সেখানে নিক্ষেপ করে চরম শান্তি দিয়ে হত্যা করে। রাবী বলেছেন, ফেরেশতাদের আগমনের পরই কালো ও অন্ধকারময় প্রচণ্ড ধূলাবালি আকাশকে ছেয়ে ফেলে। এ অন্ধকারে কোন কিছুই দৃষ্টিগোচর হচ্ছিল না। ইবনে সা’দের বাহিনী মনে করল তাদের উপর বুঝি আযাব নাযিল হয়েছে। কিছুক্ষণ পর এ অন্ধকার দূরীভূত হয়।

 

ইমাম হোসাইন (আ.)-এর অন্তিম মুহূর্ত

হেলাল বিন নাফে বর্ণনা করেন যে, আমি ওমর বিন সা’দের সেনাবাহিনীর সাথে দাড়িয়েছিলাম। এমন সময় একজন হটাৎ চিৎকার দিয়ে বলে ওঠে, হে আমীর আপনাকে শুভ সংবাদ। শিমার ইমাম হোসাইন (আ.) কে হত্যা করেছে। আমি সৈন্যদের সারি থেকে বের হয়ে হোসাইন (আ.) এর সামনে দাড়িয়ে দেখছিলাম তিনি জীবনের শেষ মুহূর্ত অতিক্রম করছেন।

খোদার কসম রক্তাক্ত অবস্থায় নিহত মানুষের মধ্যে এরূপ উত্তম ও আকর্ষণীয় চেহারা আর কখনও দেখিনি। ইমাম হোসাইন (আ.) এর চেহারায় উদ্ভাসিত হয়েছিল নূর। তার এ নূর ও ব্যক্তিত্বের সৌন্দর্যে তাকে শহীদ করার চিন্তা আমি পরিত্যাগ করলাম।

এ সময় ইমাম হোসাইন (আ.) পানি চাইলেন।

আমি শুনলাম এক ব্যক্তি বলছে খোদার শপথ আমাদের বশ্যতা স্বীকার না করলে পানি দেব না যতক্ষণ না তা হবে জালাতনের গরম পানি। আমি শুনলাম ইমাম (আ.) বলছেন আমি তোমাদের কাছে নত হব না আমি আমার নানা রাসূলের (সা.) সান্নিধ্যে পৌছব এবং বেহেশতে তার সাথে এক সাথে থাকব আর তথাকার সুমিষ্ট পানি পান করবো এবং তোমাদের জুলুমসমূহের বিচার চাইব।

হেলাল বলল ইমাম (আ.) এর একথাগুলো শুনে সেনাবাহিনী ক্ষিপ্ত হয়ে এমন আচরণ করে মনে হয় আল্লাহ তাদের কারো অন্তরে বিন্দুমাত্র দয়া রাখেননি। ইমাম (আ.) তার কথা বলা শেষ না করতেই তার শরীর থেকে মাথা মোবারক বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। আমি তাদের এ নির্দয় আচরণ দেখে হতবাক হয়ে গেলাম। আমি বললাম আল্লাহর কসম কোন অবস্থাতেই তোমাদের সাথে থাকব না। এরপর ইবনে সাদের বাহিনী হোসাইন (আ.) কে উলঙ্গ করে ফেলে। তার জামা পরিধান করে ইসহাক বিন হাবিয়া হাজরামী। এতে তার শরীরে শ্বেত রোগের সৃষ্টি হয় এবং শরীরের সকল পশম ঝরে পড়ে। বর্ণিত হয়েছে, তার জামায় প্রায় একশ’ নব্বইটি তরবারী, তীর ও বর্শার আঘাতের চিহ্ন ছিল। হযরত ইমাম সাদেক (আ.) বললেন, হোসাইন (আ.) এর বদনে ৩৩টি বর্শা এবং ৪৩টি তরবারীর আঘাত ছিল। হোসাইন (আ.) এর পাজামা নিয়ে যায় আবহোর বিন কাব। বর্ণিত হয়েছে, এ পাজামা পরিধান করার পর সে অবশ হয়ে যায়।

হোসাইন (আ.) এর পাগড়ী নিয়ে যায় আখনাস বিন মারসাদ বিন আলকামা। অন্য বর্ণনামতে জাবের বিন ইয়াজিদ আওদী পাগড়ী নিয়ে যায়। এ পাগড়ী মাথায় পরিধান করার সাথে সাথে তার মস্তিষ্ক বিকৃতি ঘটে। তার জুতা মোবারক নিয়ে যায় আসওয়াদ বিন খালেদ, আংটি নিয়ে যায় বোজদিল বিন সালিন কালবী। এ আংটি নেয়ার অপরাধে পরবর্তীতে তার আংগুল কর্তন করা হয়। এই বোজদিল বিন সালিনকে মোখতার সাকাফী বন্দী করে তার হাত-পা কেটে ছেড়ে দেয়। এ অবস্থায় রক্ত ঝরতে থাকে অবশেষে এ রক্তক্ষরণে সে মারা যায়। ইমাম হোসাইন (আ.) এর চামড়ার রুমালটি নিয়ে যায় কায়েস বিন আশসাস। বাতারা নামক বর্মটি নিয়ে যায় ওমর বিন সা’দ। ওমর বিন সা’দ নিহত হলে মোখতার সে বর্মটি ওমর সাদের হত্যাকারীকে দান করেন।

ইমাম (আ.) এর তরবারী জামী বিন খালফ আওদী অন্য বর্ণনামতে, বনি তামিম গোত্রের আসওয়াদ বিন হানজালা নামক এক ব্যক্তি হস্তগত করে। ইবনে আবি আস আদের বর্ণনামতে, ইমাম (আ.) এর তরবারী ফালাফেস নাহশালী নিয়ে যায়। মুহাম্মদ বিন যাকারিয়া একথা বর্ণনার পর লিখেন, এ তরবারী পরবর্তীতে হাবিব বিন বুদালের কন্যার হাতে পৌছে। এখানে উল্লেখ্য, যে তরবারী তারা লুন্ঠন করেছে তা জুলফিকার ছিল না। কেননা জুলফিকার রাসূলে পাক (সা.) ও ইমামদের অন্যান্য স্মৃতিবহুল সম্পদের সাথে সংরক্ষিত রয়েছে। এ কথাটি বিভিন্ন রাবী সত্যায়ন করেছেন এবং হুবহু বর্ণনাও করেছেন।

তাবু লুট ও অগ্নিসংযোগ

রাবী বলেছেন, ইমাম হোসাইন (আ.)-এর শাহাদাতের পর একটি ছোট মেয়ে তাবু থেকে বাইরে আসে। এক ব্যক্তি তাকে বলে, হে আল্লাহর দাসী, তোমার বাবা হোসাইন (আ.) নিহত হয়েছে। মেয়েটি বলল, একথা শুনেই আমি চিৎকার দিয়ে নারীদের কাছে দৌড়ে যাই। তারাও আমার চিৎকার শুনে উঠে আসে। সবাই মাতম আহাজারি শুরু করে। এরপরই সেনাবাহিনী অতি দ্রুত মহানবীর আওলাদ এবং হযরত ফাতেমার চোখের মণিদের তাবুতে আক্রমণ চালায়। নারীদের মাথা থেকে চাদর ছিনিয়ে নেয়। নবী বংশের বীরাঙ্গনারা তাবু থেকে বেরিয়ে পড়লেন। তাদের কান্নায় আত্মীয়-স্বজন ও প্রিয়জনদের বিচ্ছেদের ফরিয়াদে আকাশ-পাতাল মাতমে ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে। আল্লামা মাজলিসী (রহ.) লিখেছেন, কোন কোন গ্রন্থে এমনও পরিদৃষ্ট হয়েছে যে ফাতেমা সোগরা বলেছেন, “আমি তাবুর দরজায় দাড়িয়ে আমার বাবার মাথাবিহীন লাশ এবং ধূলায় পড়ে থাকা প্রিয়জন-সহচরদের দেহগুলো দেখছিলাম। দুশমনের ঘোড়াগুলো যখন এসব লাশের উপর দিয়ে দলে দলে চলছিল আমি কান্নায় ফেটে পড়ছিলাম। চিন্তায় ছিলাম পিতার অবর্তমানে বনি উমাইয়া গোষ্ঠী আমাদের সাথে কি আচরণই না করে বসে। আমাদেরকে কি তারা হত্যা করে না বন্দী করে নিয়ে যায়। হটাৎ এক ব্যক্তিকে দেখলাম সে বর্শা উচিয়ে নারীদেরকে একদিকে হাকিয়ে নিয়ে যাচ্ছ। নারীগণ আশ্রয় গ্রহণ করার জন্য ছুটোছুটি করছে। এ সময় নারীদের বোরকা ও অলংকার সব লুন্ঠন হয়ে গেছে, আর নারীগণ চিৎকার দিয়ে বলছিল-

হে নানা! হে বাবা! হে আলী, কেউ নেই আজ আমাদের আশ্রয় দেবে? কেউ নেই আমাদের সাহায্য করবে?

ফাতেমা (সোগরা) বলেন-

এ দৃশ্য দেখে আামর বুকে কম্পন এসে যায়, সমস্ত শরীর শিউরে ওঠে। ঐ ব্যক্তির ভয় থেকে রক্ষার জন্য আমার ফুফু উম্মে কুলসুমকে খুজতে শুরু করি । হটাৎ দেখলাম ঐ লোকটি আমার দিকে আসছে। তার অত্যাচার থেকে মুক্তির জন্য পালাতে চেষ্টা করলাম কিন্তু সে এসেই গেল। বর্শার ফলক দিয়ে আমার বুকে আঘাত হানল, আমি উপড়ে যমিনে পড়লাম। সে আমার কান দু’টুকরা করে ফেলে, আর কানের অলংকার ও চাদর ছিনিয়ে নেয়। সরে যাওয়ার সাথে সাথে দেখলাম আমার মাথা ও মুখমণ্ডল রক্তে রঞ্জিত হয়ে গেছে। আমি বেহুশ হয়ে গেলাম। হাটাৎ দেখি আমার ফুফু আমার শিয়রে বসে কাদছেন আর বলছেন, ‘প্রাণের ফাতেমাঃ ওঠো আমরা যাই, জানি না মেয়েদের বিশেষ করে তোমার ভাই আলী বিন হোসাইনের কি অবস্থা হয়েছে। আমি উঠে দাড়ালাম, বললাম ফুফুজান, কোন কাপড় আছে কি যাতে আমার মাথা ঢাকতে পারি? তিনি বললেন-মা দেখছ না তোমার ফুফুও আজ খালি মাথায়, কাপড় নেই। দেখলাম সত্যিই তো তার মাথা খালি আর গোটা শরীর চাবুক ও বর্শার ফলকের আঘাতে কালো হয়ে গেছে। আমরা একসাথেই তাবুর দিকে অগ্রসর হলাম, ‘দেখলাম তাবুতে যা ছিল সব লুটতরাজ হয়ে গেছে আর আমার ভাই আলী বিন হোসাইন (আ.) মাটির উপর পড়ে আছে। অধিক পিাপসা আর অসুস্থতায় মাথা তুলতে পারছেন না। তার এ অসহায় অবস্থা ও নাজুক পরিস্থিতি দেখে আমি কান্নায় ভেঙ্গে পড়লাম।–অনুবাদক

হামীদ বিন মুসলিম বর্ণনা করেন, বকর বিন গায়েল গোত্রের এক নারী তার স্বামীসহ ওমর বিন সাদের সেনাবাহিনীর সাথে ছিল। যখন দেখল সৈন্যরা হোসাইন (আ.) এর তাবুর নারীদের উপর হামলা চালিয়েছে এবং তাদের সম্পদ সব লুট করে নিয়েছে তরবারী হাতে সে তাবুর দিকে অগ্রসর হয়ে বলল, হে বকর বিন ওয়ায়েলের সম্প্রদায়! তোমাদের কি ব্যক্তিত্ব বীরত্ব কিছুই নেই যে, তোমারা এখানে থাকতে নবী বংশের নারীদের পোষাক লুটতরাজ হচ্ছে? এরপর ফরিয়াদ করে বলেঃ

আল্লাহ ছাড়া কারো হুকুম চলবে না। হে রাসূলের (সা) বীরাঙ্গনাগণ। তার স্বামী এসে তার হাতে ধরে তাবুতে ফিরিয়ে নেয়।

রাবী বলেছেন-তাবু লুটতরাজ শেষ হওয়ার পর তাবুসমূহে অগ্নিসংযোগ করা হয়। তাবু থেকে বোরকাবিহীন অবস্থায় নবী পরিবারের নারীরা বের হতে বাধ্য হয়। কান্নার রোল পড়ে যায়। অপমানিত হয়ে দুশমনের হাতে বন্দী হয়। তার কসম দিয়ে বলে-আমাদেরকে হোসাইন (আ.)-এর হত্যা স্থানে নিয়ে যাও। তাদেরকে যখন সে স্থানে নিয়ে যাওয়া হয় চিৎকার দিয়ে কেদে ওঠে এবং মাথা ও মুখে হাত চাপড়াতে থাকেন।

রাবী বলেন-খোদার শপথ যয়নব বিনতে আলী (আ.) তার ভাইয়ের জন্য যেভাবে কেদেছেন তা কোন দিন ভুলব না। করুণ বিলাপ ও হৃদয়বিদারক আওয়াজে তিনি বলছিলেন, হে নানা মুহাম্মদ (সা.) আপনার উপর ফেরেশতাগণ দরুদ পড়েন। এই যে আপনার হোসাইন রক্তে রঞ্জিত। তার শরীরের অংশ বিচ্ছিন্ন আর আপনার মেয়েরা আজ বন্দী।

মহান আল্লাহ মুহাম্মদ মুস্তফা (সা.), আলী মোরতাজা (আ.), ফাতিমা যাহরা (আ.), সাইয়্যেদুশ শুহাদা হামজা (রা.)-এর কাছে এ অত্যাচারের অভিযোগ পেশ করছি। হে মুহাম্মদ (সা.)! এই যে আপনার হোসাইন কারবালার যমীনে খালী পায়ে উলঙ্গ পড়ে আছে মরুর বাতাস তার গায়ে বালি ছিটাচ্ছে।

এই যে আপনার হোসাইন (আ.) জারজ সন্তানদের হাতে নিহত হয়েছে। হায় আফসোস! আজ এমন দিনে আমার নানা মুহাম্মদ (সা.) দুনিয়ায় নেই।

হে মুহাম্মদ (সা.)এর সাহাবীগণ এরা তো মহানবী (সা.) এর সন্তান। তাদেরকে সাধারণ কয়েদীর মতো বেধে নিয়ে যাচ্ছে।

অন্য বর্ণনায় এসেছে, যয়নব (আ.) আরজ করছিলেন, হে মুহাম্মদ (সা.)! তোমার মেয়েরা বন্দী আর ছেলেরা নিহত হয়েছে মরু বলি তাদের লাশের উপর গড়িয়ে পড়েছে। এই যে তোমার হোসাইন (আ.)। তার মাথা শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন করে নিয়ে গেছে। তার পাগড়ী ও চাদর সব লুট হয়ে গেছে।

আমার পিতা উৎসর্গ হোক ঐ ব্যক্তির প্রতি, সোমবার দুপুরের সময় দুশমন বাহিনী যাকে হত্যা করেছে এবং তার সম্পদ লুট করেছে আমার পিতা কোরবান হোক এ ব্যক্তির জন্য যার তাবুগুলোও লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছে।

আমার পিতা উৎসর্গিত ঐ ব্যক্তির জন্য যার বদনে জখম এমন নয় যে, মলম লাগানো যেতে পারে। তার জন্য উৎসর্গিত যার জন্য প্রাণ দিতে পারাই জীবনের চরম চাওয়া পাওয়া।

আমার পিতা তার জন্য উৎসর্গিত হোক যে মনে চরম দুঃখ নিয়ে ইন্তেকাল করেছেন, আমার পিতা তার জন্য উৎসর্গিত হোক যে পিপাসায় কাতর অবস্থায় শাহাদত বরণ করেছেন। আমার পিতা তার জন্য কোরবান যার নানা ছিলেন আল্লাহর নবী মুহাম্মদ মুস্তাফা (সা.)। আমার পিতা উৎসর্গিত যে হেদায়েতের মশাল নবীর নাতি আমার নানা মুহাম্মদ মোস্তফা (সা.), নানী খাদিজাতুল কোবরা, পিতা আলী আল মুরতাজা (আ.), নারীদের নেত্রী মা ফাতিমাতুয যাহরা (আ.) সবার জন্য আমার জীবন উৎসর্গিত।

রাবী বলেনঃ

খোদার কসম হযরত যয়নবের (আ.) কান্নায় বন্ধু-শত্রু সবাই কেদেছে। এরপর সকিনা তার বাবার লাশ জড়িয়ে ধরে পড়লেন। একদল আরব এসে তাকে সেখান থেকে সরিয়ে দেয়। এ সময় ওমর বিন সা’দ তার সেনাবাহিনীর মধ্যখান থেকে চিৎকার দিয়ে বলল-

কে আছে যে হোসাইন (আ.) এর লশের উপর ঘোড়া দাবড়াবে?

দশজন অশ্বারোহী এ দায়িত্ব গ্রহণ করে।

এ দশজনের নাম নিম্নরূপ

১। ইসহাক বিন হাররা-যে ইমামের জামা হরণ করেছে

২। আখনাস বিন মারসাদ

৩। হাকিম বিন তোফাইন সামরানী

৪। আমর বিন সাবিহ সায়দাবী

৫। রেজা বিন মুনকায আবদী

৬। সালেন বিন খুসহিমা জু’ফী

৭। ওয়াহেয বিন নায়েম

৮। সালেহ বিন ওহাব জু’ফী

৯। হানি বিন শাবস হাজরামী

১০। উসাইদ বিন মালেক (আল্লাহর অভিশাপ তাদের উপরে)

এ দশ দুরাচার হোসাইন (আ.) এর মাথাবিহীন পবিত্র দেহের উপর ঘোড়া চালিয়ে তার পবিত্র সিনা মোবারক ও পেছনের হাড়গুলো গুড়ো গুড়ো করে দিয়েছে। এ দশজন কুফায় এসে ইবনে যিয়াদের সামনে দাড়ায়। ইবনে যিয়াদ জিজ্ঞেস করলো-তোমরা কারা? তাদের মধ্যে উসাইদ বিন মালেক বলে ওঠে-

আমরা ঐ দল যারা হোসাইন (আ.) দেহের উপর ঘোড়া চালিয়ে তার হাড়-মজ্জা গুড়ো করে দিয়েছি।

ইবনে যিয়াদ তাদেরকে ততটা গুরুত্ব দেয়নি। সামান্য কিছু পুরুস্কার দিয়েই তাদেরকে বিদায় করে। আবু আমর যাহেদ বলেছেন-এ দশজনের জীবন বৃত্তান্ত পর্যালোচনা করে দেখেছি-এরা সবাই জারজ সন্তান। পরবর্তীকালে এ দশজনকেই মোখতার বন্দী করে হাত-পা লোহার পেরেক দিয়ে ছিদ্র করে এবং নির্দেশ দেয় তাদের উপর মৃত্যু না ঘটা পর্যন্ত যেন ঘোড়া চালানো হয়।#আল হাসানাইন