কারবালা ও ইমাম হোসাইন (আ.)-শেষ পর্ব

নবী পরিবারের পুনরায় কারবালায় গমন

ইমাম হোসাইনের পরিবার যখন ইরাকে প্রবেশ করলেন, তখন তারা কাফেলার পথ প্রদর্শককে বললেন, “আমাদেরকে কারবালার উপর দিয়ে নিয়ে যাও।” যখনই তারা কারবালায় পৌছালেন তখন সেখানে হযরত জাবির বিন আব্দুল্লাহ আনসারী (রা.), একদল বনী হশিম এবং নবী পরিবারের কয়েকজন পুরুষের সাথে তাদের সাক্ষাত হয়। এখানে উল্লেখ্য যে, হযরত জাবির (রা.), বনী হাশিমের ঐ দল এবং নবী পরিবারের পুরুষ ব্যক্তিরা কারবালায় ইমাম হোসাইনের (আ.) পবিত্র সমাধি যিয়ারত করতে এসেছিলেন । সবাই কান্না কাটি করতে লাগল এবং শোকে-দুঃখে মুখ চাপড়াতে লাগলেন। তারা কারবালায় এমনভাবে মাতম করছিলেন যা দেখে এমন কোন হৃদয় নেই যা শোকানলে জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়নি। কারবালার আশে পাশে যে সব আরব বেদুইনরা বসবাস করত তাদের মহিলারাও সেখানে মাতম ও শোক করার জন্য জড়ো হয়েছিল। এভাবে সেখানে অনবরত কয়েকদিন শোকানুষ্ঠান চলতে থাকে।

আবু হাব্বাব কলবী থেকে বর্ণিতঃ একদল চক ও কড়িমাটি সংগ্রহকারী বর্ণনা করেছেঃ আমরা এক রাতে হাব্বাহ নামক একটি স্থানে যাচ্ছিলাম। সে সময় আমরা সবাই শুনতে পেলাম যে, জ্বীনরা ইমাম হোসাইনের (আ.) জন্য বিলাপ করে চলছেঃ

ইমাম হোসাইনের কপালে চুম্বন করতেন রাসূল (সা.)

তার (ইমামের)গালে রয়েছে রাসূলের চুম্বনের ঔজ্জ্বল্য,

হোসাইনের পিতা মাতা ছিলেন রাসূলের কুরায়শ

এবং তার মাতামহ ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ মাতামহ;

আহলে বাইত (আ.) যখন মদীনার নিকটবর্তী হলেন

কারবালা থেকে নবী পরিবার (আ.) মদীনা পানে রওয়ানা হলেন। বশীর বিন জাযলাম থেকে বর্ণিতঃ মদীনার নকটবর্তী হওয়া মাত্রই যয়নুল আবেদীন (আ.) সওয়ারী থেকে নেমে পড়লেন, তাবু টানান হল এবং মহিলারাও সওয়ারী থেকে নামলেন । তখন ইমাম বললেন, “হে বশীর, খোদা তোমার পিতাকে ক্ষমা করুন। তোমার পিতা কবি ছিলেন। তুমি কি কবিতা রচনা করতে পার?” বশীর তখন বললঃ “জ্বী হ্যাঁ, আমিও একজন কবি।” ইমাম একথা শুনে বশীরকে বললেন, মদীনায় গিয়ে জনগণকে আবু আবদিল্লাহ ইমাম হোসাইনের (আ.) শাহাদাতের সংবাদ জানাও।” বশীর এরপর বলেছেন, “আমি (ইমামের নির্দেশে) ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে অতিদ্রুত মদীনায় পৌছালাম। আমি মসজিদে নববীতে পৌছে উচ্চস্বরে ক্রন্দন করতে করতে নিম্নোক্ত কবিতাটি আবৃত্তি করলামঃ

“হে মদীনাবাসীরা এরপর আর মদীনায় থেকো না। কারণ ইমাম হোসাইন (আ.)-কে শহীদ করা হয়েছে। আর তার শাহাদতের কারণে আমার চোখ দিয়ে যেন বৃষ্টির মত অশ্রু ঝরছে। রক্তে রঞ্জিত ইমাম হোসাইনের (আ.) পবিত্র দেহ কারবালায় আর তার পবিত্র মাথা বর্শাগ্রে গেথে শহর থেকে শহরে ঘুরানো হচ্ছে।” এরপর আমি বললাম, “হে মদীনাবাসীরা, আলী ইবনুল হোসাইন (আ.) ফুপু ও বোনদের সহকারে তোমাদের কাছে এবং মদীনার দেওয়ালের পশ্চাতেই অবস্থান করছেন। আমি তার প্রেরিত দূত। আমি তোমাদেরকে তার আবস্থানস্থল নির্দেশ করব। আমার এ কথায় মদীনার সব মহিলাও তাবু ছেড়ে বেরিয়ে এসে “ওয়া ওয়াইলা, ওয়া সাবুরাহ” বলে উচ্চস্বরে বিলাপ করতে লাগল।

আমি ঐ দিনের বিলাপকারীদের মত এত অধিকসংখ্যক বিলাপকারী আর কোন দিন দেখিনি। ঐ দিনের ন্যায় আর কোন দিবসই মুসলমানদের জন্য এত তিক্তকর ছিল না। আমি ঐ দিন একজন মহিলাকে ইমাম হোসাইন (আ.) এর জন্য কাদতে এবং শোক প্রকাশ করতে দেখেছি। সে বলছিলঃ

“দূত এসে আমাকে আমার নেতা ও মওলা (আ.) এর শাহাদতের সংবাদ দিয়েছে। আর এ সংবাদ মুনে আমার অন্তর ব্যথা বেদনায় ভরে গেছে এবং আমিও অসুস্থ হয়ে পড়েছি। হে আমার নয়নযুগল, অশ্রুপাতের ক্ষেত্রে উদার হও এবং বার বার অশ্রু ঝরাতে থাক ঐ পুণ্যাত্মার জন্য যার মুসিবত খোদার আরশকেও করেছে প্রকম্পিত। তাকে (আ.) শহীদ করার মধ্য দিয়ে ধার্মিকতা ও মান-সম্ভ্রমকেও কর্তন করা হয়েছে। মহানবী (সা.) এর দৌহিত্র এবং হযরত আলী ইবনে আবু তালিব (আ.)-এর সন্তান হোসাইনের জন্য অশ্রুপাত করতে থাক যিনি এ নগরী থেকে বহু দূরে চলে গেছেন।”

এ শোকগাথা আবৃত্তি করার পর ঐ মহিলা বলতে লাগল, “এ শোক সংবাদ বহনকারী হে দূত তুমি আমাদের দুঃখ-কষ্টকে ইমাম হোসাইনের (আ.) শাহাদাতের কারণে তাজা করে দিয়েছে এবং আমাদের অন্তরের ক্ষতসমূহ যা এখনও সেরে ওঠেনি তাতে আরো নতুন করে তাতে আরো ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে। তুমি কে হে দূত?” আমি তখন বললাম, “আমি বশীর বিন খাযলাম। আমাকে মওলা ইমাম যয়নুল আবেদীন (আ.) পাঠিয়েছেন। বশীর থেকে বর্ণিতঃ মদীনাবাসীরা আমাকে রেখেই অতিদ্রুত মদীনার বাইরে চলে আসল। আমি ঘোড়ায় চড়ে ওখানে এলাম। দেখলাম রাস্তাঘাট লোকে লোকারণ্য । তিল ডরিমাণ জায়গা খালি নেই। ঘোড়া থেকে নেমে মানুষের কাধ ডিঙ্গিয়ে একদম তাবুর কাছে পৌছে গেলাম। ইমাম যয়নুল আবেদীন (আ.) তাবুর ভিতরে ছিলেন। কিছুক্ষণ পর তিনি তাবুর বাইরে আসলেন। তার হাতে একটি রুমাল ছিল যা দিয়ে তিনি অশ্রু মুছছিলেন। তার পেছনে পেছনে একজন খাদেম একটি চেয়ার আনল। তিনি ঐ চেয়ারটির উপর বসলেন। কিন্তু তার দু’চোখ বেয়ে অনবরত অশ্রুপাত হচ্ছিল। চতুর্দিকে কান্নার রোল পড়ে গেল। মহিলা ও দাসীদের ক্রন্দনধ্বনি তীব্র হয়ে উঠল। জনতা ইমাম যয়নুল আবেদীন (আ.) কে সান্তনা দিতে লাগল। তবে ঐ স্থান জুড়ে কান্নাকাটিই চলছিল।

মদীনার উপকন্ঠে ইমাম যয়নুল আবেদীনের (আ.) ভাষণ

এ সময় ইমাম যয়নুল আবেদীন (আ.) সবাইকে নীরবতা অবলম্বন করতে বললেন। লোকেরা কান্না থামাল। তিনি ভাষণে বললেনঃ

“ঐ আল্লাহর সমস্ত প্রশংসা যিনি ইহকাল ও পরকালের প্রভু, মহান বিচার দিবসের অধিপতি এবং সব কিছুর স্রষ্টা। ঐ আল্লাহর সমস্ত প্রশংসা যার সত্তাকে মানুষ বুদ্ধি দিয়ে অনুধাবন করতে অক্ষম এবং সকল গুপ্ত বিষয় ও রহস্য তার কাছে উন্মোচিত ও প্রকাশিত। কালের সমস্যা, দুঃখ-কষ্ট ও যাতনা বড় বড় বিপদাপদ, কঠিন আাঘাত, ঘাত প্রতিঘাত এবং বেদনার সময়ও ঐ মহান আল্লাহর প্রশংসা করছি (অর্থাৎ সুখে-দুঃখে সর্বাবস্থায় তিনি প্রশংসনীয়)। হে লোকসকল, ঐ খোদার প্রশংসা করছি যিনি ইসলামের উপর আপতিত বড় বড় মুসিবত ও বিপদাপদের মাধ্যমে আমাদেরকে পরীক্ষা করেছেন। নিশ্চয়ই আবু আব্দুল্লাহ ইমাম হোসাইন (আ.) এবং তার বংশধরদেরকে হত্যা করা হয়েছে, তার স্ত্রী, কন্যা ও আত্মীয়াদেরকে বন্দী করা হয়েছে। তার পবিত্র মাথঅ বর্শাগ্রে বেধে শহর থেকে শহরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এটা এমনই এক বিপদ যার তুল্য দ্বিতীয়টি আর নেই। হে লোকসকল, এ ঘটনার পর তোমাদের মধ্যে কোন ব্যক্তি হাসিখুশী থাকতে পারবে? সে কোন হৃদয় যে এ মহাঘটনায় ব্যথিত ও দুঃখভারাক্রান্ত হবে না? সে কোন নয়ন যা অশ্রুপাত করবে না অথচ সাত আসমান হোসাইন (আ.) এর জন্য কাদেছে, সাগরসমূহ তরঙ্গ তুলে ক্রন্দন করেছে, আকাশের স্তম্ভসমূহ শোকে-দুঃখে গর্জন করে উঠেছে এবং পৃথিবীর প্রতিটি প্রান্তও ক্রন্দন করেছে। আরো ক্রন্দন করেছে গাছের ডাল-পালাসমূহ, মৎস, সমুদ্রের ঢেউমালা, নৈকট্যপ্রাপ্ত ফেরেশতারা। সকল আকাশবাসী এ মহা বিপদে শোক করেছে, বিলাপ করেছে। হে লোকসকল, এমন কোন হৃদয় আছে কি যা হোসাইনের (আ.) প্রতি এখনও আকৃষ্ট হয়নি? ইসলামের উপর আপতিত চরম সংকটের কথা শোনার মত ক্ষমতা কারো আছে কি? হে লোকেরা, আমাদেরকে ছত্রভঙ্গ করা হয়েছে এবং এমনভাবে আমাদেরকে শহর থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছে যেন আমরা তুর্কিস্থান ও কাবুলের বিধর্মী যুদ্ধবন্দী। অথচ আমরা তো কোন পাপ করিনি বা আমাদের দ্বারা কোন মন্দ কাজও সংঘটিত হয়নি। এমন কি আমরা ইসলাম ধর্মের কোন বিকৃতি সাধন করিনি।

খোদার কসম. মহানবী (সা.) আমাদের ব্যাপারে উম্মতকে যে সব উপদেশ প্রদান করেছেন তদস্থলে তিনি যদি আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার আদেশও দিতেন তাহলে তারা আমাদের সাথে যা করেছে এর চেয়ে বেশী কিছু করতে পারত না। ইন্নালিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজেউন। আমাদের বিপদ কতবড়, কত বেদনাদায়ক, কত কঠিন কত তিক্ত। মহান আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করছি, যেন তিনি এমন বিপদাপদ ও দুঃখ-কষ্ট সহ্য করার জন্য আমাদেরকে উত্তম প্রতিদান দেন। কারণ তিনি মহাপরাক্রমশালী ও প্রতিশোধ গ্রহণকারী।

ইমাম যয়নুল আবেদীন (আ.)-এর বক্তৃতা যখন শেষ হল তখন সওহান বিন সা’সাআহ বিন সওহান যিনি রোগগ্রস্থ হয়ে পড়েছিলেন তিনি উঠে দাড়িয়ে বললেন, “হে নবীর (সা.) দৌহিত্র, আমার চলার শক্তি রহিত হয়ে আমি শয্যাশায়ী হয়ে পড়েছিলাম। আর এ কারণে আমি আপনাদেরকে সাহায্য করতে পারিনি ।” ইমাম যয়নুল আবেদীন (আ.) সওহানের কথা গ্রহণ করলেন, তাকে ধন্যবাদ জানালেন এবং সওহানের পিতা সা’সাআর জন্য দোয়া করলেন।

মদীনার বাড়ীঘরের অবস্থা

এরপর ইমাম যয়নুল আবেদীন (আ.) নিজ পরিবার-পরিজন সহকারে মদীনায় প্রবেশ করলেন। তিনি আত্মীয় ও বন্ধুদের ঘর-বাড়ির দিকে তাকিয়ে দেখতে পেলেন যে, ঘরগুলো যেন নীরবে নিথরে (যারা ঘরে বসবাস করতো তাদের জন্য) বিলাপকারিনী মহিলাদের মত কাদছে, শোক করছে। এসব বাড়ীঘর ইমাম যয়নুল আবেদীনকে (আ.) ঘরের অধিবাসীদের সম্পর্কে জিজ্ঞেস করছিল এবং নিহতের জন্য শোক প্রকাশ করছিল।

ইমাম হোসাইনের (আ.) গৃহ ফরিয়াদ করে বিলাপ করছিল আর বলছিল, “হে লোকেরা যেহেতু আমি এভাবে শোক ও ফরিয়াদ করছি বলে আমাকে ক্ষমা কর। তোমরাও এ মহা বিপদের দিনে আমাকে সাহায্য কর। তারা আমার দিনরাতের সংগী, আধার রাত ও ভোর রাতের প্রদীপ, মর্যাদা ও গৌরবের প্রতীক, আমার শক্তি ও বিজয়ের উৎস এবং আমার চন্দ্র-সূর্য ছিলেন। তাদের মহত্ত্বের কারণে কত রাতে আমার ভীতি দূর হয়ে গেছে। তাদের অনুগ্রহ ও কৃপায় সম্মান বেড়েছে। তাদের প্রভাতী প্রার্থনা আমার কর্ণকুহরে এসে পৌছেছে। তাদের গুপ্তভেদের দ্বারা আমি সম্মানিত হয়েছি। তারা বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও সভা উদযাপন করতেন, আর এ সব অনুষ্ঠান ও সভা আমার সৌন্দর্যকে আরো বাড়িয়ে দিত।

তাদের ফযীলত ও মহৎ গুণাবলী আমাকে মিষ্টি সৌরভে ভরপুর করে দিত। আমার শুষ্ক কাঠগুলো তাদের সদর্শনে সবুজ ও রসাল হয়ে পড়ত। তাদের আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে আমার থেকে যাবতীয় অমঙ্গল দূর হয়ে যেত। আমার আশাকে তারা নব নব পল্লবে বিকশিত করেছিলেন। আর আমাকে নানাবিধ বিপদাপদ থেকে মুক্ত ও নিরাপদ রেখেছিলেন। প্রভাতকালে তাদেরকে পেয়ে অন্য সকল প্রাসাদ ও গ্রহের উপর আমার শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠিত হত। আর এ কারণে আমি গর্ববোধ করতাম, সুখী ছিলাম। তাদের সান্নিধ্যে অনেক নিরাশা আশার আলোয় পরিণত হয়েছিল। অনেক বিপদাপদ ও ভয় বা ভীতি ক্ষয়প্রাপ্ত অস্থির মত আমার অস্তিত্বের সীমারেখার মাঝে লুক্কায়িত ছিল তাদেরই বদৌলতে সেগুলো দূরীভূত হয়ে গিযেছিল। কিন্তু অবশেষে মৃত্যুর তীর তাদেরকে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করল। তারা অপরিচিত শত্রুদের দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে তাদের হাতে নির্মমভাবে নিহত হলেন। মর্যাদা ও সম্মানবোধ যা তাদের জীবদ্দশায় বিদ্যমান ছিল তা আজ ধ্বংস হয়ে গেছে। তাদেরকে হারিয়ে আজ উন্নত চারিত্রিক গুণাবলী যেন নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। মহান আল্লাহর বিধি-বিধানসমূহে তাদের জন্য বিলাপ করছে। হায়, ঐ পুণ্যাত্মার (হোসাইনের) রক্তপাত করা হয়েছে। হায়, পূর্ণত্বপ্রাপ্তদের সেনাদলের পতাকা আজ ভূলুন্ঠিত হযে গেছে। আজ যদি আমার সাথে মানবজাতি ক্রন্দন না করে এবং অজ্ঞ লোকেরা যদি এ বিপদে শোকে প্রকাশ করার সময় আমাকে ত্যাগ করে তাহলে পুরোনো টিলা-পাহাড় এবং ধ্বংসপ্রাপ্ত গৃহসমূহের দেওয়ালগুলোই আমার জন্য যথেষ্ট। কারণ ওগুলোও আমার মত ক্রন্দন করছে, বিলাপ করছে। আর আমার মত তারাও শোকাচ্ছন্ন এবং দুঃখভারাক্রান্ত। যদি তোমারা শুনতে পাও যে, নামায কিভাবে ঐ সব সত্যপন্থী শহীদের জন্য বিলাপ করেছে, দানশীলতা ও মহানুভবতা তাদের দর্শনপ্রার্থী এবং দর্শনের জন্য অপেক্ষমান; মসজিদের মেহরাব তাদের বিচ্ছেদ বেদনায় ক্রন্দনরত এবং অভাবীদের অভাব তাদের দান পাওয়ার জন্য উচ্চস্বরে ফরিয়াদ করছে; তাহলে অবশ্যই এসব ফরিয়াদ শুনে তোমরাও শোকাচ্ছন্ন ও দুঃখভারাক্রান্ত হতে এবং জানতে পারতে যে এ মহাবিপদে তোমরা দায়িত্ব পালন করনি। বরং যদি তোমরা আমার একাকিত্ব ও ভেঙ্গে পড়ার অবস্থা প্রত্যক্ষ করতে এবং তাদের বিহনে আমার সভাগুলো যে খালি, এ অবস্থা যদি দেখতে পেতে তাহলে তোমাদের মানসপটে এমন এক চিত্র ফুটে উঠত যা সহিষ্ণু হৃদয়কে দুঃখ ও বেদনায় উদ্বেলিত করে ও বক্ষকে ভারী করে দেয়। যে সব গৃহ আমার সাথে হিংসা করত, আজ তারা আমাকে ভর্ৎসনা করছে। আমার উপর যুগের বিপদাপদ জয়ী হয়েছে। হায়, অধীর আগ্রহের সাথে ঐ গৃহকে দেখতে ইচ্ছে করছে যেখানে তাদের দেহ শায়িত । হায়! আক্ষেপ, আমি যদি মানুষ হতাম এবং তলোয়ারের সামনে যদি ঢালের মত দাড়িয়ে তাদের চরণতলে নিজকে উৎসর্গ করতে পারতাম যাতে করে তারা জীবতি থাকতে পারেন। হায়, যদি আামি ঐসব শত্রুর বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিতে পারতাম যারা তাদেরকে বর্শা দিয়ে আক্রমণ করেছে। হায়, আমি যদি তাদের কাছ থেকে শত্রুদের নিক্ষিপ্ত তীর ফিরিয়ে দিতে পারতাম। অথচ আমি এ মুহূর্তে কিছুই করতে পারলাম না। হায়, যদি আমি তাদের সুকোমল দেহের বাসস্থান হতে পারতাম এবং তাদের পবিত্র দেহকে যদি রক্ষা করতে পারতাম। আহ আমি ঐ সব মহান আত্মোৎসর্গকারী পুণ্যাত্মাদের অবস্থানস্থল হতে পারতাম তাহলে সর্বশক্তি ব্যয় করে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে তাদের দেহগুলোকে রক্ষা করতাম এবং তাদের পুরোনো হক বা অধিকার আদায় করে আনতাম। পাথরগুলোকে তাদের উপর পড়তে দিতাম না। তাদের সামনে অনুগত দাসের মত সব সময় উপস্থিত থাকতাম তাদের চরণতলে সম্মান ও মর্যাদার গালিচা বিছিয়ে দিতাম। তাহলে তাদের সহচর্য লাভ করার সৌভাগ্য হত এবং অন্ধকারে তাদের আলো থেকে উপকৃত হতাম। আহ! এসব আশা পূরণ হওয়ার জন্য আমি কত আগ্রহী। আমার মাঝে যারা বসবাস করতেন তাদের বিরহ বিচ্ছেদে আমি জ্বলছি। আমার ফরিয়াদ অন্য সব ফরিয়াদকে ছাড়িয়ে গেছে । তারা ছাড়া আর কোন ওষুধে আমি আরোগ্য লাভ করব না। তাদেরকে হারিয়ে আমি শোকের পোশাক পরিধান করেছি। আমি আর ধৈর্য ধারণ করতে পারছি না। আমার ধৈর্যের বাধ ভেঙ্গে গেছে। আর আমি বলছি হে শান্তিদাতা, তোমার সাথে আমার দেখা হবে রোজ হাশরের মাঠে।

মালিকশূন্য ঘরগুলো যখন কাদছিল তা বর্ণনা করতে গিয়ে ইবনে কুতাইবা কত সুন্দর বলেছেনঃ

মুহাম্মদের (সা.) বংশধরদের গৃহসমূহের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় দেখলাম ঐ ঘরগুলো যখন মহানবীর (সা.) বংশধরেরা এখানে থাকতেন এখন আর নেই। মহান আল্লাহ, এ গৃহ ও এ গৃহের মালিককে রহমত থেকে বঞ্চিত না করেন। আমার ধারণায় যদিও এ ঘরগুলো মালিকবিহীন হয়ে গেছে । তোমরা জেনে রেখো যে, কারবালায় শহীদদের নিহত হওয়ার কারণে মুসলমানদের ঘাড়ে অপমানের বোঝা অর্পিত হয়েছে। আর এখন তাদের উপর আপমানের চিহ্ন স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। মহানবীর (সা.) বংশধরেরা সব সময় উম্মতের আশ্রয়স্থল ছিলেন। আর এখন তাদের উপর অর্পিত বিপদাপদই সকল বিপদাপদ অপেক্ষা ভয়ানক। তোমরা কি দেখনি যে, ইমাম হোসাইনের শাহাদাতে আকাশের সূর্য স্লান হয়ে গিযেছিল এবং পৃথিবী এ তীব্র বিপদে প্রকম্পিত হয়েছিল?

তোমরা যে কেউ ইমাম হোসাইনের এ বিপদের কথা শুনবে যেমনিভাবে মহানবীর (সা.) বংশধরেরা শোকাভিভূত হয়েছিলেন ঠিক তেমনিভাবে তোমরাও শোকাভিভূত ।

ইমাম যয়নুল আবেদীনের (আ.) ক্রন্দন

বর্ণিত আছে যে, ইমাম যয়নুল আবেদীন (আ.) অত্যন্ত ধৈর্যশীল ও সহিষ্ণু হওয়া সত্ত্বেও এ মহা বিপদের সময় অত্যন্ত কাদলেন এবং তার দুঃখ-কষ্টের অন্ত ছিল না। ইমাম জাফর সাদেক (আ.) থেকে বর্ণিত আছে যে ইমাম যয়নুল আবেদীন (আ.) তার পিতার কথা স্মরণ করে চল্লিশ বছর কেদেছিলেন। তিনি এ দীর্ঘ চল্লিশ বছরে দিবাভাগে রোযা রাখতেন এবং ইবাদত-বন্দেগী করে রাত কাটাতেন। ইফতারের সময় যখন তার গোলাম তার সামনে খাবার ও পানি এনে বলত, “প্রভু ইফতার করুন।” তখন ইমাম যয়নুল আবেদীন (আ.) বলতেন-

“মহানবীর (সা.) দৌহিত্র (আ.)-কে ক্ষুধার্তাবস্থায় হত্যা করা হয়েছে, তাকে তৃষ্ণার্তাবস্থায় হত্যা করা হয়েছে।” তিনি বার বার এ কথা বলতেন এবং কাদতেন। যার ফলে খাবার ও পানির সাথে তার অশ্রু মিশে একাকার হয়ে যেত। তিনি আমৃত্য এ অবস্থার উপর ছিলেন।

ইমাম যয়নুল আবেদীনের (আ.) একজন দাস থেকে বর্ণিতঃ একদিন ইমাম যয়নুল আবেদীন (আ.) মরুভূমির দিকে বের হলে আমিও তার (আ.) পিছু পিছু গেলাম। দেখলাম, তিনি একটি কঠিন পাথরের উপর কপাল রাখছেন। আমি দাড়িয়ে গেলাম ও তার কান্না শুনতে পেলাম। আমি শুনলাম তিনি এক হাজার বার

لا اله الاّ اللّهُ حقّا حقّا، لا اله الاّ اللّهُ تعبُّدا ورِقّا، لا اله الاّ اللّهُ ايمانا و تصْديقا

পড়লেন । তারপর তিনি সিজদা থেকে মাথা উঠালেন; দেখলাম তার পবিত্র বদনমণ্ডল ও দাড়ি চোখের জলে ভিজে গেছে। আমি বললাম, “হে আমার (প্রভু) মওলা আপনার দুঃখের কি শেষ নেই, আপনার কান্নার কি শেষ নেই” তিনি একথা শুনে বললেন, “তোমার জন্য আক্ষেপ, ইয়াকুব বিন ইসহাক বিন ইব্রাহীম নিজেও নবী ও নবী পুত্র ছিলেন। তার ১২জন সন্তান ছিল। মহান আল্লাহ তার এক পুত্রকে তার দৃষ্টিশক্তির অন্তরালে নিয়ে যান। শোক-দুঃখের ভারে তার চুলগুলো সাদা হয়ে গিয়েছিল, তার কোমর বাকা হয়ে গিয়েছিল এবং অনবরত কাদার ফলে তার দু’চোখ অন্ধ হয়ে গিয়েছিল অথচ তার ঐ সন্তান ঠিকই জীবিত ছিল। আর আমি স্বচক্ষে আমার পিতা, ভাই এবং আমার পরিবারের ১৭ জনকে নিহত হয়ে মাটিতে পড়ে থাকতে দেখেছি। তাই কি করে আমার শোক-দুঃখের অবসান হবে এবং কান্না থামবে?

গ্রন্থ প্রণেতা বলেন-আমি ঐ সব পুন্যাত্মদের স্মরণে নিম্নোক্ত কবিতাটি আবৃত্তি করছিঃ

কে কারবালার শহীদদেরকে বলবে যে, “তোমাদের বিরহ বিচ্ছেদে আমরা যে শোকের পোশাক পড়েছি তা কখনও পুরোনো ও ধ্বংস হবে না। বরং আমরা বৃদ্ধ ও মৃত্যুমুখে পতিত হব। এই তো সেদিন তাদের সান্নিধ্যে আমরা হাসিখুশী ছিলাম। আর এখন তাদের বিরহে আমরা কাদি। তাদেরকে হারিয়ে আমাদের অবস্থা শোচনীয় হয়ে গেছে (আমাদের জীবন তিমিরাচ্ছন্ন হয়ে গেছে)। অথচ এককালে তাদের উজ্জ্বল আলোর প্রভাবে আমাদের অন্ধকার রাতগুলো দিনের মত আলোকিত ছিল।

বইটির এখানেই সমাপ্তি। যে কেউ এ বই সম্পর্কে জ্ঞাত তারা জানেন যে, কলেবরের দিকে থেকে ছোট হওয়া সত্ত্বেও ইমাম হোসইনের জীবনী ও কারবালার ইতিহাসের ক্ষেত্রে যে সব বই পুস্তক লেখা হয়েছে সেগুলো থেকে এ বইটি সর্বাধিক উন্নত।#আল হাসানাইন