ইসলামের চরম দূর্দিনের ত্রাণকর্তাঃ হযরত ইমাম হোসাইন (আ.)-এর সুমহান মর্যাদা

বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)এর প্রাণপ্রিয় দৌহিত্র,বেহেশতী নারীদের নেত্রী হযরত ফাতিমার (সা.) কলিজার টুকরা এবং  জ্ঞানের দরজা আমীরুল মুমিনিন হযরত আলী (আ.)’র সুযোগ্য দ্বিতীয় পুত্র এবং ইসলামের চরম দূর্দিনের ত্রাণকর্তা ও শহীদদের নেতা হযরত ইমাম হোসাইন (আ.)-এর সুমহান মর্যাদ সম্পর্কে সংক্ষিপ্তাকারে কিছু আলোচনা করব ইনশাআল্লাহ।

হযরত ইমাম হোসাইন (আ.) ছিলেন সম্মান, দয়া, বীরত্ব, শাহাদত, মুক্তি ও মহানুভবতার আদর্শ। তাঁর আদর্শ মানবজাতির জন্য এমন এক ঝর্ণাধারা বা বৃষ্টির মত যা তাদের দেয় মহত্ত্বম জীবন, গতি ও আনন্দ। মানুষের জীবনের প্রকৃত মর্যাদা ও প্রকৃত মৃত্যুর সংজ্ঞাকে কেবল কথা নয় বাস্তবতার মাধ্যমে দেখিয়ে দিয়ে অমরত্ব দান করে গেছেন এই মহাপুরুষ। বিশেষ করে আল্লাহর পথে সর্বোচ্চ ত্যাগ ও শাহাদাতকে তিনি দিয়ে গেছেন অসীম সৌন্দর্য।

কারবালার মহাবিপ্লবের রূপকার ইমাম হোসাইন (আ.) মানবজাতির ওপর ও বিশেষ করে  প্রকৃত মুমিন মুসলমানদের ওপর যে গভীর প্রভাব রাখবেন সে সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করে গেছেন স্বয়ং বিশ্বনবী (সা.)। তিনি বলেছেন, " নিশ্চয়ই প্রত্যেক মু'মিনের হৃদয়ে হোসাইনের শাহাদতের ব্যাপারে এমন ভালবাসা আছে যে, তার উত্তাপ কখনো প্রশমিত হয় না। " (মুস্তাদরাক আল-ওয়াসাইল, খণ্ড-১০, পৃষ্ঠা-৩১৮)

ইমাম হোসাইন (আ.)  হিজরি চতুর্থ সনের তৃতীয় শা’বান এই ভূপৃষ্ঠে আগমণ করেন এবং ৬১ হিজরীর ১০ মুহররম কারবালা ভূমিতে বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর এই দৌহিত্র বেহেশতের যুবকদের নেতা ইমাম হোসাইনকে নির্মমভাবে শহীদ করা হয়।

রবীয়াহ্ সা’দী থেকে বর্ণিত আছে : কোন্ কোন্ সাহাবীর মর্যাদা সবচেয়ে বেশী-এ ব্যাপারে জনগণের মধ্যে মতপার্থক্য দেখা দিলে আমি মদীনায় সাহাবী হুযাইফা বিন ইয়ামানের কাছে (প্রকৃত ব্যাপারটি জানার জন্য) গমন করলাম। হুযাইফা আমাকে জিজ্ঞেস করলেন,“তুমি কোথাকার অধিবাসী?” আমি বললাম,“আমি একজন কুফাবাসী।” এ কথা শুনে হুযায়ফা আমাকে স্বাগত জানালেন। আমি বললাম,“সাহাবীদের ফযীলত ও মর্যাদা সম্পর্কে জনগণের মধ্যে যে মতভেদ হয়েছে সে ব্যাপারে আপনাকে জিজ্ঞেস করার জন্য মদীনায় এসেছি।” হুযায়ফা বললেন,“তুমি এমন এক ব্যক্তির কাছে এসেছ যার এ ব্যাপারে জ্ঞান রয়েছে। আর তুমি জেনে রাখ,আমি যা শুনেছি,দেখেছি এবং যা আমার অন্তরে আছে কেবল তাই তোমার কাছে বর্ণনা করব।” অতঃপর হুযায়ফা বলতে লাগলেন,“একদিন মহানবী আমাদের কাছে আসলেন। আমি তোমাকে যেমনভাবে দেখতে পাচ্ছি ঠিক তেমনিভাবে আমি মহানবীকে দেখতে পাচ্ছিলাম,তিনি হোসাইন ইবনে আলীকে কাঁধে বসিয়ে হাত দিয়ে তাঁর পা বুকের সাথে লাগিয়ে যেন বলছেন,“জনগণ,আমি ভালভাবেই অবগত আছি,আমার ওফাতের পরে আমার মনোনীত ব্যক্তিদের সম্পর্কে তোমাদের মধ্যে মতপার্থক্য হবে। (তাই শুনে রাখো) এই হোসাইন ইবনে আলীর মাতামহ ও মাতামহী সবার চেয়ে শ্রেষ্ঠ। তার মাতামহ হচ্ছে মুহাম্মদ,যে মহান আল্লাহ্ কর্তৃক প্রেরিত (রাসূল) এবং সর্বশেষ নবী। আর তার মতামহী হচ্ছেন খাদীজাহ্ বিন খুওয়াইলিদ,যিনি পৃথিবীর সমস্ত মহিলার আগেই মহান আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান এনেছেন।

এই হোসাইন ইবনে আলীর পিতামাতা সবার চেয়ে শ্রেষ্ঠ। তার পিতা আলী ইবনে আবি তালিব রাসূলুল্লাহর ভাই,সাহায্যকারী,পিতৃব্য পুত্র এবং পৃথিবীর সকল পুরুষের চেয়ে আগে মহান আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান এনেছে। আর তার মা ফাতেমা যিনি মুহাম্মদের কন্যা এবং পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ নারী। এই হোসাইন ইবনে আলী চাচা ও ফুফুর দিক থেকে সবার চেয়ে শ্রেষ্ঠ। তার চাচা আবু তালিবের পুত্র জাফর যাকে দু’টি ডানা দেয়া হয়েছে এবং ঐ দু’টি ডানা দিয়ে বেহেশতের মধ্যে যেখানে ইচ্ছা সেখানে তিনি উড়ে বেড়ান। আর তার ফুফু আবু তালিবের কন্যা উম্মে হানী। এই হোসাইনই শ্রেষ্ঠ মামা ও খালার অধিকারী। তার মামা কাসিম বিন মুহাম্মদ ও খালা যয়নাব বিনতে মুহাম্মদ।

(মহানবী (সা.)-এর সাহাবীগণের মাঝে তাঁর আহলে বাইতের একটি স্বতন্ত্র ও বিশেষ বৈশিষ্ট্য ও মর্যাদার কারণে আহলে বাইতপন্থী লেখকগণ ছাড়াও আহলে সুন্নাতের প্রখ্যাত আলেম আল্লামাহ্ আবু বকর জাস্সাস তাঁর ‘আহকামুল কোরআন’ গ্রন্থে এবং শাইখ আবদুল হক মুহাদ্দিস দেহলভী তাঁর ‘রাহাতুল কুলুব’ গ্রন্থে মহানবীর (সা.) আহলে বাইতের সদস্যগণের নামের পাশে ‘আঃ’ এবং অন্যান্য সাহাবীগণের নামের পাশে ‘রাঃ’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। অনুরূপভাবে বিশেষ বৈশিষ্ট্যের কারণে হযরত ঈসার (আ.) মাতা হযরত মরিয়ম,হযরত আদমের (আ.) স্ত্রী হযরত হাওয়ার নামের পাশে এবং বিশেষ বিশেষ ফেরেশতাগণের নামের পাশেও ‘আঃ’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। লেখক এখানে এ রীতিটিকেই অনুসরণ করেছেন।)

অতঃপর মহানবী হোসাইনকে কাঁধ থেকে মাটিতে নামিয়ে দিলেন। আর হোসাইন তখন মহানবীর আগে আগে হাঁটছিলেন এবং কখনো কখনো মাটিতে পড়ে যাচ্ছিলেন। মহানবী আবার বললেন,“হে জনগণ,এই হোসাইন ইবনে আলীর মাতামহ,মাতামহী,চাচা,ফুফু,মামা ও খালা বেহেশতে প্রবেশ করবে। আসলে হোসাইনকে যা (যে গুণাবলী ও মর্যাদা) দেয়া হয়েছে তা একমাত্র নবী ইয়াকুবের পুত্র নবী ইউসুফ ব্যতীত আর কোন নবীর সন্তানকেই দেয়া হয়নি।”(মুলহাকাতু ইহ্কাক আল-হক,১১শ খণ্ড,পৃঃ ২৮২;আল্লামাহ্ গাঞ্জী আশ্-শাফেয়ী প্রণীত কিফায়াতুত তালিব গ্রন্থ,পৃঃ ২৭২;রাসূলী মাহাল্লাতী প্রণীত যিন্দেগানী-ই ইমাম হোসাইন (আ.),১ম খণ্ড,পৃঃ ১৬।)

ঠিক এ রকম আরেকটি হাদীস আল্লামাহ্ মুহিব্বুদ্দীন আল্লামাহ বিন আব্দুল্লাহ আত্-তাবারী প্রণীত যাখায়িরুল উকবা ফী মানাকিব-ই যাভীল কুরবা গ্রন্থে (পৃঃ ১৩০) রয়েছে। এ বর্ণনাটির শেষে আরো সংযোজিত হয়েছে,“হে আল্লাহ্,নিশ্চয় তুমি জানো,হাসান,হোসাইন বেহেশতে প্রবেশ করবে এবং তাদের চাচা ও ফুফুও বেহেশতে প্রবেশ করবেন। আর যারা তাদের দু’জনকে ভালবাসবে তারাও বেহেশতী হবে। আর যারা তাদের সাথে শত্রুতা করবে তারা দোযখে প্রবেশ করবে।”

হোসাইন (আ.)-এর কান্নায় মহানবী (সা.) বিচলিত ও ব্যথিত হতেন

মহানবীর ঘর হযরত ফাতেমার ঘরের পাশেই ছিল। একদিন মহানবী ঘর থেকে বের হয়ে ফাতেমার ঘরের দরজায় আসলেন। মহানবী হোসাইনের কান্নার শব্দ শুনলেন। এমতাবস্থায় রাসূলের পক্ষে হযরত ফাতেমার ঘর অতিক্রম করা সম্ভব হলো না। তিনি কিছুক্ষণের জন্য সেখানে দাঁড়িয়ে পড়লেন এবং হযরত ফাতেমার ঘরের দরজায় জোরে জোরে আঘাত করতে লাগলেন। শব্দ শুনে হযরত ফাতেমা ঘরের ভেতর থেকে বাইরে আসলেন। বাইরে এসেই তিনি মহানবী দেখতে পেলেন। আর ভাবলেন,হয়তোবা মহানবী তাঁকে দেখতে এসেছেন। তাই তিনি পূর্ব অভ্যাস অনুযায়ী মহানবীকে অভ্যর্থনা জানালেন। মহানবী হযরত ফাতেমার ভক্তিপূর্ণ এ অভ্যর্থনার প্রত্যুত্তরে বললেন,“তুমি কি জানো না,হোসাইনের কান্নায় আমি ব্যথিত হই?”(ফাযায়েলুল খামসাহ্,৩য় খণ্ড,পৃঃ ২৫৬;তাবরানী প্রণীত আল-মুজাম আল-কাবীর গ্রন্থে ইয়াযীদ বিন আবি যিয়াদের সূত্রে এ হাদীসটি বর্ণিত হয়েছে।)

মহানবী (সা.) মিম্বর থেকে নেমে আসেন

 

একদা মহানবী (সা.) মসজিদে নববীর মিম্বরে দাঁড়িয়ে জনগণের উদ্দেশ্যে উপদেশ ও বক্তৃতা দিচ্ছিলেন। আর জনগণও একাগ্রতার সাথে তাঁর অমিয় বাণী শ্রবণ করছিল। হঠাৎ করেই মহানবীর ভাষণ বন্ধ হয়ে গেল এবং তিনি ব্যথিত মনে মিম্বর থেকে নীচে নেমে আসলেন। তখন সবাই লক্ষ্য করল,শিশু হোসাইন মসজিদে আসার সময় পায়ের সাথে কাপড় জড়িয়ে মাটিতে পড়ে গড়াগড়ি যাচ্ছেন আর কান্নাকাটি করছেন। মহানবী তখন হোসাইনকে মাটি থেকে উঠিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরলেন এবং নিজের সাথে মিম্বরের ওপর নিয়ে আসলেন।

মহানবী (সা.) সিজদা দীর্ঘায়িত করেন

একদিন মসজিদে নববীতে জামাতে নামায আদায় করার সময় মহানবীর পাশেই শিশু ইমাম হোসাইন বসেছিলেন। কোন এক রাকাতে মহানবী সিজদা করার জন্য মাটিতে মাথা রাখলেন। আর তিনি এত বেশী সময় ধরে ঐ সিজদায় ছিলেন যে,মুসল্লীরা মনে করলেন সম্ভবত মহানবীর কিছু হয়েছে অথবা তাঁর ওপর মহান আল্লাহর তরফ থেকে ওহী অবতীর্ণ হচ্ছে। নামায শেষে মহানবীকে এর কারণ জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বললেন,“না,আমার ওপর ওহী অবতীর্ণ হয়নি। তবে আমার দৌহিত্র (হোসাইন) আমার পিঠের ওপর চড়ে বসেছিল এবং আমি তাকে পিঠ থেকে নামাতে চাচ্ছিলাম না। কারণ আমার ইচ্ছা ছিল,সে নিজেই পিঠ থেকে নেমে আসুক।”(ইবনে হাজর আল-আসকালানী প্রণীত তাহযিব আত্-তাহযিব,২য় খণ্ড,পৃঃ ৩৪৬;ফাযায়েলে খামসাহ্,৩য় খণ্ড,পৃঃ ১৯৩।)

মহানবীর কাঁধে হোসাইন

মদীনাবাসীরা বহুবার দেখেছে,মহানবী তাঁর দুই দৌহিত্রকে দু’কাঁধে বসিয়ে তাঁদের মন খুশী করার জন্য মদীনার অলিতে-গলিতে হাঁটছেন। অনেকে বহুবার চেষ্টা করেও তাঁদের একজনকেও মহানবীর কাঁধ থেকে নামাতে পারেনি। মহানবী কাউকে তা করার অনুমতি দেননি।

কোন কোন সাহাবী এ দৃশ্য দেখে ইমাম হাসান ও ইমাম হোসাইনকে বলতেন,“কতই না উত্তম বাহনের ওপর তোমরা দু’জন চড়েছো!”

মহানবীও ঐ সাহাবীদের উদ্দেশে বলতেন,“আর এ দু’জনও কতই না উত্তম আরোহী!”

আর এভাবে মহানবী তাঁর দুই দৌহিত্রের উচ্চ মর্যাদা,সম্মান ও তাঁদের দু’জনের প্রতি তাঁর অগাধ ভালবাসা ও আত্মিক টানের কথা বর্ণনা করতেন।(মানাকিবে খাওয়ারিয্মী,পৃঃ ১১১।)

হোসাইন আমা হতে আমিও হোসাইন হতে

ইয়ালী বিন মুররাহ্ বলেন,“একবার মহানবী (সা.) আমাদেরকে দাওয়াত করলেন এবং আমরা ঐ দাওয়াতে অংশ গ্রহণ করার জন্য রওয়ানা হলাম। চলার পথে আমরা একটি ময়দানে এসে উপস্থিত হলাম। সেখানে শিশুরা খেলাধুলা করছিল আর তাদের মধ্যে ইমাম হোসাইনও ছিল। শিশুরা আমাদেরকে দেখা মাত্রই আমরা সেখান থেকে না যাওয়া পর্যন্ত খেলাধুলা বন্ধ করে দিল। মহানবী আমাদের সামনাসামনি হাঁটছিলেন। তিনি যখন হোসাইনকে ঐ শিশুদের মাঝে দেখতে পেলেন তখন তাকে দেখে চুমো না দিয়ে থাকতে পারলেন না। তাঁর সাথে লোকজন থাকা সত্ত্বেও সবাইকে দাঁড় করিয়ে রেখে হোসাইনের দিকে গেলেন এবং তাকে বুকে জড়িয়ে ধরার জন্য হাত বাড়ালেন। কিন্তু হোসাইন এদিক-ওদিক ছুটোছুটি করতে লাগল। আর এতে মহানবী হাসলেন। অবশেষে তিনি হোসাইনকে ধরে এক হাত তাঁর চিবুকে ও অপর হাত তাঁর মাথায় রাখলেন। এরপর তিনি নিজের গাল হোসাইনের গালের সাথে মিশিয়ে বললেন,

حسین منی و انا من حسین، احبّ الله من احبّ حسینا. الحسین سبط من الاسباط

“হোসাইন আমা হতে আমিও হোসাইন হতে। যে হোসাইনকে ভালবাসবে আল্লাহ্ও তাকে ভালবাসবেন। হোসাইন সৎ কাজের ক্ষেত্রে যেন নিজেই একটি জাতি।”(শেখ সুলায়মান আল-হানাফী আল-কুন্দুযী প্রণীত ইয়ানাবিউল মাওয়াদ্দাহ্,পৃঃ ২৬৪;আল-খাওয়ারিয্মী প্রণীত মাকতালুল হোসাইন,১ম খণ্ড,পৃঃ ১৪৬;ইবনে আসীর প্রণীত আন্-নিহায়াহ্ ফী গারীবিল হাদীস,২য় খণ্ড,পৃঃ ২৩৪।)

মহানবী থেকে বর্ণিত সিব্ত্ (سبط) শব্দের একাধিক অর্থ করা যেতে পারে :

১। হোসাইন সৎ কাজের ক্ষেত্রে যেন নিজেই একটি জাতি অর্থাৎ একটি গোত্র বা জাতির সমান।(ইবনে আসীর প্রণীত আন্-নিহায়াহ্ ফী গারীবিল হাদীস,২য় খণ্ড,পৃঃ ২৩৪।)

২। সিব্ত্ শব্দের অপর অর্থ বিভিন্ন শাখা-প্রশাখায় পল্লবিত বৃক্ষ। আর হোসাইনকে সিব্ত্ বলার অর্থ হচ্ছে,মহানবীর বংশধরগণ হোসাইনের মাধ্যমে বিস্তার লাভ করবে।

৩। এ হাদীসটির অর্থ এও হতে পারে,উচ্চ সম্মান ও মর্যাদার ক্ষেত্রে একটি জাতি যেমন সুউচ্চ আসনের অধিকারী এক্ষেত্রে হোসাইনেরও ঠিক এমনি আসন রয়েছে।

৪। এ হাদীসের অর্থ এমনও হতে পারে,একটি জাতি যেমন পুণ্য ও প্রতিদান পেয়ে থাকে ঠিক তেমনিভাবে ইমাম হোসাইনও মহান আল্লাহর কাছে পুণ্য ও প্রতিদান পাবেন।(পারতাভী আয-আযামাতে হোসাইন,পৃঃ ৩৩।)

মহানবী (সা.) ইমাম হাসান ও ইমাম হোসাইনকে সর্বদা চুমো দিতেন এবং তাঁদের শরীরের ঘ্রাণ নিতেন মহানবী (সা.) ইমাম হোসাইনকে অত্যন্ত ভালবাসতেন এবং স্নেহ করতেন। আর এ ভালবাসা,স্নেহ ও মমতা প্রকাশ করার জন্য তিনি হোসাইনকে চুমো দিতেন এবং এভাবে তিনি আত্মিক প্রশান্তি লাভ করতেন। মহানবী প্রায়ই হযরত ফাতেমাকে বলতেন,“আমার দৌহিত্রদ্বয়কে ডেকে আন,আমি তাদেরকে জাড়িয়ে ধরে তাদের শরীরের ঘ্রাণ নেব।”

কখনো কখনো হোসাইন মহানবীর কাছে আসতেন। তখন তিনি হযরত আলীকে বলতেন,“হে আলী,ওকে ধরো এবং আমার কাছে নিয়ে এসো।”হযরত আলী হোসাইনকে ধরে মহানবীর কাছে নিয়ে আসতেন এবং মহানবী তাঁকে ধরে চুমো খেতেন।

শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার আগেও মহানবী (সা.) ইমাম ভ্রাতৃদ্বয়কে বুকে জড়িয়ে চুমো দিয়েছিলেন এবং তাঁদের শরীরের ঘ্রাণ নিয়েছিলেন। আর এ সময় তাঁর দু’চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরছিল।(আল-খাওয়ারিয্মী প্রণীত মাকতালুল হোসাইন,১ম খণ্ড,পৃঃ ১০২।) কী হৃদয় বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়েছিল তখন!!!

মহানবীর কোলে শিশু হোসাইন

উসামা বিন যায়েদ থেকে বর্ণিত : এক রাতে মহানবীর সাথে সাক্ষাৎ করার জন্য বের হলাম। আমার খুব জরুরী কাজ ছিল তাঁর সাথে। মহানবীর কাছে আমার প্রয়োজনের কথা বর্ণনা করলে তিনি আমার আবেদন গ্রহণ করলেন। কথা বলার সময় আমি দেখতে পেলাম,তাঁর দেহের দু’পাশ ফোলা যেন তাতে কিছু আছে। আমি ভাবছিলাম,কখন তিনি তাঁর চাদর খুলে ফেলেন। কিন্তু তিনি চাদর খুললেন না। তাই কথাবার্তা শেষ হলে আমি নিজেই তাঁকে প্রশ্ন করলাম,“হে রাসূলাল্লাহ,আপনার চাদরের নীচে কি লুকিয়ে রেখেছেন?” তিনি স্মিত হেসে চাদরটি একটু সরালেন। অমনি আমি দেখতে পেলাম,হাসান ও হোসাইন নানার ঊরুর ওপরে নির্বিঘ্নে শুয়ে আছে যেন তারা শান্তির মাঝে ঘুমিয়ে পড়েছে। মহানবী এমতাবস্থায় বললেন,

هذان ابنای و ابنا ابنتی، اللهم انی احبهما فاحبّهما و احبّ من یحبهما

“এরা দু’জন আমার দৌহিত্র এবং আমার কন্যার সন্তান। হে আল্লাহ্,আমি এ দু’জনকে ভালবাসি। অতএব,তুমি তাদেরকে ভালবাস যারা এ দু’জনকে ভালবাসবে।”(আল-খাওয়ারিয্মী প্রণীত মাকতালুল হোসাইন,১ম খণ্ড,পৃঃ ৯২।)

হযরত সালমান কর্তৃক বর্ণিত হাদীসে ইমাম হোসাইনের মর্যাদা

একদিন হোসাইন (আ.) মহানবীর পবিত্র ঊরুর ওপর বসেছিলেন। তিনি তাঁকে চুমো দিচ্ছিলেন এবং তাঁকে বলছিলেন,

انت السیّد ابن السیّد ابو السادة- انت الامام ابن الامام ابو الائمة- انت الحجة ابن الحجة ابو الحجج تسعة من صلبک و تاسعهم قائمهم (حجّ)

“তুমি নেতা,নেতার সন্তান ও নেতাদের পিতা,তুমি ইমাম,ইমাম-পুত্র ও ইমামদের পিতা;তুমি মহান আল্লাহর নিদর্শন পুরুষ,নিদর্শন পুরুষের সন্তান এবং নয়জন নিদর্শন পুরুষের পিতা। আর এদের মধ্যে নবম নিদর্শন পুরুষই হচ্ছে ইমাম মাহ্দী।”(মানাকিব,৩য় খণ্ড,পৃঃ ২২৬;আল-খাওয়ারিয্মী প্রণীত মাকতালুল হোসাইন,১ম খণ্ড,পৃঃ ১৪৬।)

হাসান ও হোসাইন মহানবী (সা.)-এর দুটি সুগন্ধি ফুল

মহানবী প্রায়ই ইমাম হাসান ও ইমাম হোসাইনকে বুকে টেনে নিয়ে বলতেন,“সন্তান সুগন্ধি ফুলের মত;হাসান ও হোসাইন আমার দু’টি সুগন্ধি ফুল। তাই এ দু’জনের সুঘ্রাণ গ্রহণ করি।”

আবু আইয়ুব আনসারী (রাঃ) বলেন,“একদিন মহানবীর কাছে গেলাম। হাসান ও হোসাইন তাঁর বগলের নীচে ছিল এবং খেলা করছিল। মহানবীকে বললাম,“আপনি কি এ দু’জনকে ভালবাসেন?” তিনি বললেন,“কিভাবে এ দু’জনকে না ভালবেসে থাকতে পারি আর এরাই তো এ পৃথিবীর বুকে আমার সুগন্ধি ফুল! আর আমি এ দু’জনের সুঘ্রাণ নিয়ে থাকি।”(উসদুল গাবাহ্,২য় খণ্ড,পৃঃ ১৮।)

হোসাইনের তৃষ্ণায় মহানবী বিচলিত হয়ে পড়েন

একদিন মহানবী বাড়ি থেকে বের হওয়ার সাথে সাথেই শিশু হাসান ও হোসাইনের কান্নার শব্দ শুনতে পেলেন। মহানবী হযরত ফাতেমার দিকে দ্রূত অগ্রসর হয়ে বললেন,“আমার দৌহিত্রদ্বয় কাঁদছে কেন?” তখন হযরত ফাতেমা তাঁকে বললেন,“ওরা তৃষ্ণার্ত,তাই পানি চাচ্ছে।” মহানবী এ কথা শুনে পানির খোঁজে গেলেন। কিন্তু পানি পেলেন না। তাই তিনি নিজের পবিত্র জিহ্বা হাসান ও হোসাইনের মুখের ভেতর রাখলেন এবং এর ফলে শিশু ভ্রাতৃদ্বয় কান্না থামালেন। আরো অনেক সময় মহানবী ইমাম হাসান ও হোসাইনের মুখের ভেতর জিহ্বা রেখেছেন এবং তাঁরাও তাঁর জিহ্বা চুষে তৃষ্ণা মিটিয়েছেন।(আল্লামাহ্ ইবনে হাজার আসকালানী প্রণীত তাহযিব আত্-তাহযিব,২য় খণ্ড,পৃঃ ২৯৮;আল-খাওয়ারিয্মী প্রণীত মাকতালুল হোসাইন,১ম খণ্ড,পৃঃ ১৫২;ফাযায়েলুল খামসাহ্,৩য় খণ্ড,পৃঃ ১৭৯।)#হাসানাইন