সূরা হিজর; (১১তম পর্ব)

সূরা হিজর; আয়াত ৭৮-৮৪

সূরা হিজরের ৭৪ থেকে ৭৭ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে,

فَجَعَلْنَا عَالِيَهَا سَافِلَهَا وَأَمْطَرْنَا عَلَيْهِمْ حِجَارَةً مِنْ سِجِّيلٍ (74) إِنَّ فِي ذَلِكَ لَآَيَاتٍ لِلْمُتَوَسِّمِينَ (75) وَإِنَّهَا لَبِسَبِيلٍ مُقِيمٍ (76) إِنَّ فِي ذَلِكَ لَآَيَةً لِلْمُؤْمِنِينَ (77(

“অতঃপর আমি জনপদটিকে উল্টে দিলাম এবং তাদের উপর কঙ্কর বর্ষণ করলাম।”(১৫:৭৪)

“নিশ্চয়ই এতে চিন্তাশীলদের জন্যে নিদর্শনাবলী রয়েছে।”(১৫:৭৫)

“পথের পাশে ওই জনপদের ধ্বংসাবশেষ এখনো বিদ্যমান রয়েছে।”(১৫:৭৬)

“নিশ্চয়ই এতে বিশ্বাসীদের জন্য রয়েছে নিদর্শন।"(১৫:৭৭)

লুত সম্প্রদায় যে আল্লাহর গজবে ধ্বংস প্রাপ্ত হয়েছিল তা এর আগের কয়েকটি আয়াতে বলা হয়েছে, খুব ভোরে সূর্যোদয়ের সাথে সাথে গোটা জনপদটিতে মহাপ্রলয় নেমে আসে। ভয়াবহ পরিস্থিতিতে মানুষ চৈতন্য ও সজ্ঞা হারিয়ে ফেলে। ঐ ঘটনারই ধারাবাহিকতায় এই আয়াতে বলা হচ্ছে, ঐ ভয়ঙ্কর পরিস্থিতিতে এক শক্তিশালী ভূমিকম্প পুরো নগরটিকে সম্পূর্ণ ওল্টে-পাল্টে দেয়, ঘুমন্ত মানুষের ওপর তাদের ঘর-বাড়ী আছড়ে পড়ে, এর পাশাপাশি আকাশ থেকে বৃষ্টির মত কঙ্কর নিক্ষিপ্ত হতে থাকে, ফলে ঐ মহা প্রলয়ের হাত থেকে কেউ রেহাই পায় নি। এর পরের আয়াতে বলা হচ্ছে, ঐ জনপদের ধ্বংসাবশেষ এখনো বিদ্যমান। কিন্তু শুধুমাত্র বুদ্ধিমান ও চিন্তাশীল মানুষই তা দেখে শিক্ষা গ্রহণ করে থাকে।

পাপের সীমা অতিক্রম করার কারণে বহু জতি আল্লাহর গজবে ধ্বংস হয়ে গেছে, ইতিহাস সেই ভয়ংকর স্মৃতি বয়ে চলে যুগ থেকে যুগান্তরে, যাতে প্রজন্মের পর প্রজন্ম তা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে। পাপের পরিণতি স্বচক্ষে দেখে মানুষ যাতে সঠিক পথে ফিরে আসতে পারে, মানুষ যাতে সম্বিত ফিরে পায় সে কথাই মনে করিয়ে দেয়া হচ্ছে এই আয়াতে।

এই সূরার ৭৮ ও ৮৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে,

وَإِنْ كَانَ أَصْحَابُ الْأَيْكَةِ لَظَالِمِينَ (78) فَانْتَقَمْنَا مِنْهُمْ وَإِنَّهُمَا لَبِإِمَامٍ مُبِينٍ (79(

“গহীন অরণ্যের অধিবাসীরাও সীমালংঘনকারী, জালেম ছিল।” (১৫:৭৮)

“সুতরাং আমি তাদের কাছ থেকে প্রতিশোধ নিয়েছি, তাদের উভয়েরই ধ্বংসস্তুপ প্রকাশ্যে পথের পাশে অবস্থিত।" (১৫:৭৯)

লূত সম্প্রদায়ের পরিণতির কথা বর্ণনার পর এই আয়াতে হযরত শোয়াইব (আ.) এর সম্প্রদায়ের ঘটনা বলা হচ্ছে, হযরত শোয়াইব (আ.) এর সম্প্রদায় সবুজ-শ্যামল বৃক্ষময় প্রান্তরে বসবাস করতো বলেই তাদেরকে এই আয়াতে ‘আসহাবুল আয়কাহ’ বলা হয়েছে। হযরত শোয়াইব (আ.)এর সম্প্রদায় কোন ধরনের পাপে নিমজ্জিত ছিল এই আয়াতে সে সম্পর্কে সুস্পষ্ট ইঙ্গিত না থাকলেও যেহেতু ‘জুলুম’ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে ফলে এর দ্বারা সব ধরনের গুনাহ বা পাপ ধরে নেয়া যেতে পারে। এরপর বলা হয়েছে, লুত সম্প্রদায়ের ধ্বংসাবশেষ যেমন বিদ্যমান তেমনি শোয়াইব (আ) এর সম্প্রদায়ের পরিণতির নিদর্শনও বিদ্যমান রয়েছে, ফলে তা দেখে মানুষ যাতে শিক্ষা গ্রহণ করে সে কথাই পুনরায় মনে করিয়ে দেয়া হয়েছে এই আয়াতে।

জুলুম করা বা সীমা লংঘন করার ফলে বিপর্যয় নেমে আসে। সমাজে একজন বা দুইজন যদি সীমা লংঘন করতে থাকে তাহলে হয়ত ঐশী শাস্তি বা আল্লাহর গজব নেমে আসবে না, কিন্তু জুলুম-অত্যাচার আর অনাচারে যখন কোন সমাজ নিমজ্জিত হয়ে পড়ে তখন ঐশী শাস্তি বা আল্লাহর গজবে গোটা সমাজই বিপর্যন্ত হয়ে পড়ে।

সূরা হিজরের ৮০ থেকে ৮৪ নম্বর আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেছেন,

وَلَقَدْ كَذَّبَ أَصْحَابُ الْحِجْرِ الْمُرْسَلِينَ (80) وَآَتَيْنَاهُمْ آَيَاتِنَا فَكَانُوا عَنْهَا مُعْرِضِينَ (81) وَكَانُوا يَنْحِتُونَ مِنَ الْجِبَالِ بُيُوتًا آَمِنِينَ (82) فَأَخَذَتْهُمُ الصَّيْحَةُ مُصْبِحِينَ (83) فَمَا أَغْنَى عَنْهُمْ مَا كَانُوا يَكْسِبُونَ (84(

"হিজরবাসীগণ রাসূলদের প্রতি মিথ্যা আরোপ করেছিল।”(১৫:৮০)

“আমি তাদেরকে আমার নিদর্শন দিয়েছিলাম কিন্তু তারা তা উপেক্ষা করেছিল।” (১৫:৮১)

“তারা নিশ্চিন্ত হয়ে পাহাড় কেটে গৃহ নির্মাণ করত।” (১৫:৮২)

“অতঃপর এক প্রভাতে মহানাদ তাদের আঘাত করল।” (১৫:৮৩)

“সুতরাং তারা যা করেছিল তা তাদের কোন কাজে আসেনি।" (১৫:৮৪)

লুত এবং শোয়াইব সম্প্রদায়ের বর্ণনার পর এই আয়াতে সামুদ জাতির কথা বলা হয়েছে। এই জাতি পাহাড়ের ভেতর খোদাই করে নিজেদের গৃহ নির্মাণ করতো, এজন্য তাদেরকে ‘আসহাবুল হিজর’ সম্বোধন করা হয়েছে। এই আয়াতে বলা হচ্ছে, পয়গম্বরদের বিরুদ্ধাচরণ করা এবং মুজিজা বা অলৌকিক নিদর্শনাদীকে মিথ্যা বলে উড়িয়ে দেয়া এই জাতির স্বভাবে পরিণত হয়েছিল। পয়গম্বরদের কথা তারা বিন্দুমাত্র কর্ণপাত করতো না। আল্লাহর নবী হযরত সালেহ (আ.) এই জাতিকে সৎপথে আনার জন্য যত চেষ্টাই করলেন, কোন লাভ হলো না। তারা নবীর কথায় কান দিলো না। ফলে এই জাতিও একদিন তাদের কৃতকর্মের জন্য আল্লাহর গজবে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল। তারা পাহাড়ে খোদাই করে যে বাড়ী নির্মাণ করতো তা নিয়ে তাদের খুব গর্ব ছিল। কিন্তু ঐশী শাস্তির মুখে তাদের সেই সব নিরাপদ ঘরবাড়ি কোন কাজেই আসল না।

আল্লাহর গজবের হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার কোন পথ নেই, কারো সাধ্য নেই তা প্রতিহত করার। বহু ঔদ্ধত্য ও গর্বিত শক্তি ঐশী শাস্তির মুখে মাটিতে মিশে গেছে, মানবেতিহাসে এর বহু প্রমাণ ও নিদর্শন চিরকাল অম্লান হয়ে থাকবে, যাতে করে চিন্তাশীল মানুষ তা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে।