কে মু’তা বিবাহ নিষিদ্ধ করেছে? (১)

প্রবন্ধ: সহীহ মুসলিমে বিশিষ্ট সাহাবী হযরত জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ আনসারীর উদ্ধৃতি দিয়ে বর্ণনা করা হয়েছে, তিনি বলেছেন: আমরা রাসূলের (সা.) যুগে খোরমা ও আটার দেন মোহরের বিনিময়ে কিছু দিনের জন্য সাময়িক বিবাহে আবদ্ধ হতাম। এ অবস্থা প্রথম খলিফার যুগেও অব্যাহত ছিল। কিন্তু পরবর্তীতে দ্বিতীয় খলিফার যুগে তা নিষিদ্ধ করা হয়।

একই গ্রন্থে অপর একটি রেওয়ায়েতে বর্ণিত হয়েছে: মু’তা বিবাহ ও মু’তাতুল হাজ্ব প্রসঙ্গে ইবনে আব্বাস ও আবদুল্লাহ ইবনে জুবাইরের সাথে বাগ-বিতণ্ডা দেখা দেয়। ফলে তারা জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ আনসারীর মধ্যস্থতা চান। তিনি বলেন: আমরা রাসূলের (সা.) যুগে এ দু’টি আমল সম্পন্ন করতাম। কিন্তু খলিফা উমরের যুগে তা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এ কারণে আমরা তা হতে বিরত থেকেছি।
   উপরে বর্ণিত হযরত জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ আনসারীর ন্যায় বিশিষ্ট সাহাবীর হাদীসটি একটি বহুল আলোচিত হাদীসের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়, যে হাদীসটি সুন্নী মাযহাবের খ্যাতনামা মুহাদ্দেস, মুফাসসের ও ফিকাহবিদগণ স্ব স্ব গ্রন্থাবলীতে দ্বিতীয় খলিফা হযরত উমরের উদ্ধৃতি দিয়ে বর্ণনা করেছেন। হাদীসটি হচ্ছে খলিফা উমর বলেছেন,
متعتان کانتا مشرو عتین فی عهد رسول الله (ص) و أنا أنهی عنهما متعة الحج و متعة النساء
"রাসূলের (সা.) যুগে দু’ধরনের মু’তার প্রচলন ছিল। কিন্তু আমি সে দু’টি নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছি। তন্মধ্যে একটি হচ্ছে তামাত্তু হজ্ব এবং অপরটি মু’তাতুন্নেসা বা সাময়িক বিবাহ।
     কিছু কিছু সূত্রে হাদীসটিতে এ বাক্যটিও ( و اعاقب علیهما) "অর্থাৎ যারা সে দু’টি কাজ করবে আমি তাদেরকে কঠোর শাস্তি দিব” রয়েছে।
     তামাত্তু হজ্ব বলতে বুঝায় : উমরাহ হজ্ব সম্পন্ন করার পর এহরাম হতে বের হয়ে আসা। অতঃপর কিছু দিন অতিবাহিত হওয়ার পর পুনরায় হজ্বের জন্য এহরাম বাধা।
     উপরোক্ত হাদীসটি অত্যন্ত প্রসিদ্ধ ও বহুল প্রচারিত। দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমর তার খেলাফত কালে মিম্বারে বসে জনগণের উদ্দেশ্যে বক্তৃতার এক পর্যায়ে এটি উল্লেখ করেছেন। এ হাদীসটি সুন্নী মাযহাবের নির্ভরযোগ্য বিভিন্ন সূত্রে সামান্য তারতম্যের সাথে বর্ণিত হয়েছে। আমরা নিম্নে  হাদীসটি বর্ণিত সুন্নী মাযহাবের প্রসিদ্ধ হাদীস, ফিকাহ ও তাফসীর গ্রন্থাবলী মধ্যে সাতটি গ্রন্থের নামোল্লেখ করছি :
১-     মুসনাদে আহমাদ, ৩য় খ-, পৃ. ৩২৫।
২-     সুনানে বেইহাকী, ৭ম খ-, পৃ. ২০৬।
৩-    আল মাবসুত সারখসী, ৪র্থ খ-, পৃ. ২৭।
৪-     আল মুগনী ইবনে কোদামাহ, ৭ম খ-, পৃ. ২৭।
৫-    মাহুলী ইবনে হাজম, ৭ম খ-, পৃ. ১০৭।
৬-    কানজুল উম্মাল, ১৬তম খ-, পৃ. ৫২১।
৭-     তাফসীরে কাবীর, ১০ম খ-, পৃ. ৫২।
     আলোচিত হাদীসটি অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াবলী আমাদের নিকট সুষ্পষ্ট করে, যেমন:
(ক) প্রথম খলিফার যুগে সাময়িক বিবাহ জায়েয ছিল
     মু’তা বা সাময়িক বিবাহ রাসূলুল্লাহর (সা.) জীবদ্দশায় জায়েয ছিল, এমনকি প্রথম খলিফার খেলাফতকালেও এ বিবাহের প্রচলন ছিল। কিন্তু দ্বিতীয় খলিফা তা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন।
(খ) অকাট্য দলিল ও টেক্সটের মোকাবেলায় ইজতেহাদ
     দ্বিতীয় খলিফা রাসূলুল্লাহর (সা.) প্রকাশ্য ঘোষণার বিপরীতে স্বতপ্রণোদিত হয়ে স্বীয় ইচ্ছানুযায়ী আইন প্রবর্তন করেছেন। অথচ পবিত্র কোরআনে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে,
 "আর রাসূল যা তোমাদের জন্য নিয়ে এসেছে তা গ্রহণ কর এবং যা কিছু নিষেধ করে তা হতে বিরত থাক।”
     রাসূলুল্লাহ (সা.) ব্যতিত আল্লাহর বিধানে বিন্দুমাত্র হস্তক্ষেপের কোন অধিকার অন্য কারও আছে কি?
     রাসূলুল্লাহ (সা.) এমন করেছেন আর আমি এরূপ করছি- এহেন উক্তি করার অধিকার আদৌ কারও রয়েছে কি?
     মহানবী (সা.) প্রকাশ্য ঘোষণার (যা পবিত্র কোরআনের আলোকে উৎসারিত) মোকাবেলায় কোনরূপ ইজতেহাদ করা কি জায়েয?
     প্রকৃতপক্ষে রাসূলুল্লাহর (সা.) প্রকাশ্য আদেশকে এমনভাবে উপেক্ষার ঘটনাটি সত্যিই বিস্ময়কর ও ন্যাক্কারজনক।
     উপরন্তু প্রকাশ্য দলিল ও ঘোষণার মোকাবেলায় যদি কেউ এমন মনগড়া ইজতেহাদ করে, তাহলে অন্যরাও যে এরূপ পদক্ষেপ নিবে না তার কোন নিশ্চয়তা আছে কি? এক্ষেত্রে ইজতেহাদ কী শুধুমাত্র একজন বিশেষ ব্যক্তির মাঝে সীমাবদ্ধ ছিল? অন্যরা কী ইজদেহাদের অধিকারী ছিলেন না? এ বিষয়টি অতীব গুরুত্ব সম্পন্ন। কেননা প্রকাশ্য ঘোষণা ও দলিলের মোকাবেলায় যদি ইজতিহাদের দ্বার এভাবে অনিয়ন্ত্রিতভাবে উন্মোচিত হয় তাহলে আল্লাহর বিধানাবলী সুরক্ষিত থাকবে না। ইসলামের চিরন্তন বিধানাবলী তখন এক ভয়ানক বিশৃংখলা ও স্বেচ্ছাচারিতার শিকার হবে। এক কথায় বলা যায় যে, ইসলামের বিধানাবলী তখন এক চরম বিপদসংকুল অবস্থায় উপনীত হবে।
(গ) খলিফা উমরের বিরোধিতার নেপথ্য কারণ
     কেন খলিফা উমর শরিয়তের এ দু’টি বিধানের প্রকাশ্য বিরোধিতা করেছেন?
     হজ্বে তামাত্তু সম্পর্কে তিনি এমন ধারণা করেছিলেন- যারা হজ্ব পালনের উদ্দেশ্যে এসে হজ্ব ও উমরাহ সম্পন্ন করার পর এহরামের অবস্থা হতে বের হয়ে আসে এবং স্বীয় স্ত্রীর সাথে সম্ভোগ করে। এখানে উমরাহ সম্পন্নের পর এহরামের অবস্থা হতে বের হওয়া (অর্থাৎ এহরাম অবস্থাতে যে সব হালাল কর্ম তার উপর নিষিদ্ধ ছিল তা পুনরায় জায়েয হওয়া; যেমন স্ত্রী সহবাস)-এ কাজটি হজ্বের ন্যায় আধ্যাত্মিক আমলের সাথে কোনরূপ সামঞ্জস্যতা রাখে না!
     অথচ তার এহেন ধারণাটি অশুদ্ধ ও ভিত্তিহীন। কেননা হজ্ব ও উমরাহ  এ দু’টিই পরস্পর আলাদা আমল। এ দু’টি আমলের মধ্যে এক কিংবা ততোধিক মাসের সময়ের ব্যবধান থাকতে পারে- শরীয়তের দৃষ্টিতে তাতে আদৌ কোন সমস্যা নেই। মনে করুন! কোন মুসলমান হজ্ব পালনের উদ্দেশ্য শাওয়াল কিংবা জিলক্বদ মাসে মক্কায় পৌছে (অর্থাৎ মূল হজ্বের আনুষ্ঠানিকতা শুরুর এক কিংবা দু’মাস পূর্বে) উমরাহ সম্পন্ন করে নিবে। অতঃপর ৮ই জিলহজ্ব পর্যন্ত এহরাম অবস্থা হতে মুক্ত থাকবে। তারপর পুনরায় এহরামের নিয়্যাত করে মূল হজ্ব পালনের নিমিত্তে আরাফাতের ময়দানে গমণ করবে। এ পদ্ধতিতে শরিয়তগত কোন সমস্যা না থাকায় দ্বিতীয় খলিফার অহেতুক বিরোধিতা আদৌ যুক্তিসঙ্গত নয়। অনেকের ভাষ্যমতে মু’তা বিবাহ সম্পর্কে দ্বিতীয় খলিফার ধারণা হচ্ছে- যদি মু’তা বিবাহের প্রচলন অব্যহত থাকে, তাহলে বিবাহ ও ব্যভিচারের মাঝে পার্থক্য নিরূপণ কষ্ট সাধ্য হবে। কেননা যে কোন পুরুষ ও মহিলাকে এক সাথে ঘুরতে দেখলে তারা নিজেদেরকে সাময়িক বিবাহের স্বামী ও স্ত্রী হিসেবে দাবী তুলতে পারে! ফলে ব্যভিচার ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
     এ ধারণাটি পূর্বের ধারণা অপেক্ষা বেশি দুর্বল ও অযৌক্তিক। কারণ সাময়িক বিবাহের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের ফলে সমাজে অশ্লীলতা ও ব্যভিচারের বিস্তার ঘটে। আমরা ইতিপূর্বে বিশদভাবে বর্ণনা করেছি যে, অনেক বিবাহ যোগ্য ব্যক্তি নানাবিধ কারণে স্থায়ী বিবাহে অক্ষম কিম্বা কেউ কেউ দীর্ঘ সময় স্ত্রী থেকে দূরে থাকায় স্বাভাবিক যৌন চাহিদা পুরণের নিমিত্তে কখনও কখনও পরস্পর বিরোধী দু’ই রাস্তার মুখোমুখী হয়-  এর এক পথে আছে শরিয়তসম্মত সাময়িক বিবাহ এবং অপর পথে শরিয়ত পরিপন্থী ব্যভিচার। স্বাভাবিকভাবেই সাময়িক বিবাহের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের কারণে এ সব ব্যক্তিদের কেউ কেউ নিরুপায় হয়ে বিষাক্ত ও কদর্যপূর্ণ ব্যভিচারের পথে পা বাড়ায় এবং অশ্লীলতায় গা ভাসিয়ে দেয়।
     আর তাই তো আমিরুল মু’মিনিন আলী (আ.) একটি প্রসিদ্ধ হাদীসে বর্ণনা করেছেন,
لو لا أنّ عمر نهی النّاس عن المتعة ما زنی إلّا شقی
"যদি উমর মু’তা বিবাহ নিষিদ্ধ না করত, তাহলে পাপিষ্ঠ হতভাগা ব্যক্তি ছাড়া কেউ ব্যভিচারের ন্যায় জঘন্য কর্মে লিপ্ত হত না।”#অনুবাদ: মোহাম্মাদ মিজানুর রহমান