সূরা নাহল;(২০তম পর্ব)

সূরা নাহল; আয়াত ৮৫-৮৯

সূরা নাহলের ৮৫ ও ৮৬ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-

وَإِذَا رَأَى الَّذِينَ ظَلَمُوا الْعَذَابَ فَلَا يُخَفَّفُ عَنْهُمْ وَلَا هُمْ يُنْظَرُونَ (85) وَإِذَا رَأَى الَّذِينَ أَشْرَكُوا شُرَكَاءَهُمْ قَالُوا رَبَّنَا هَؤُلَاءِ شُرَكَاؤُنَا الَّذِينَ كُنَّا نَدْعُوا مِنْ دُونِكَ فَأَلْقَوْا إِلَيْهِمُ الْقَوْلَ إِنَّكُمْ لَكَاذِبُونَ

“যখন পাপীরা শাস্তি (সত্য সত্যই) প্রত্যক্ষ করবে, তখন আর তাদের শাস্তি লঘু করা হবে না এবং তাদের কোন অবকাশও দেয়া হবে না।” (১৬:৮৫)

“আর দুনিয়ায় যারা শিরক করেছিল তারা যখন নিজেদের তৈরি করা শরীকদেরকে দেখবে তখন বলবে,হে আমাদের রব!  এরাই হচ্ছে আমাদের শরীক,তোমাকে বাদ দিয়ে যাদেরকে আমরা ডাকতাম। এ কথা শুনে তাদের ঐ মাবুদরা পরিষ্কার জবাব দিয়ে বলবে,তোমরা মিথ্যুক।”(১৬:৮৬)

কিয়ামতে মুশরিক ও জালিমদের যে করুণ অবস্থা হবে,এ দু'টি আয়াতে সে বিষয়েই বলা হয়েছে। শেষ বিচারের দিন পাপাচারীদেরকে কোনো ধরনের ছাড় দেয়া হবে না এবং শাস্তি দেয়ার ক্ষেত্রে বিলম্বও করা হবে না। শিরক ও কুফরির পেছনে কোনো ধরনের অজুহাতকে গ্রহণ করা হবে না। কাফির ও মুশরিকরা যেসব মূর্তিকে নিজেদের কুফরি ও শিরকের জন্য দায়ী বলে তুলে ধরবে, সেই মূর্তিরাও সেদিন কথা বলতে শুরু করবে। তারা মুশরিকদের বলবে,তোমরা মিথ্যা বলছো বরং তোমরা তোমাদের অহঙ্কার,গোঁয়ার্তুমি তথা কুপ্রবৃত্তির কারণে নবী-রাসূলদের কথা অমান্য করে আমাদের পুজা করেছো। আসলে তোমরা তোমাদের অন্যায় মনোবাসনা পুরণ করতে চেয়েছো।

বিভিন্ন হাদিসে এসেছে, আল্লাহর আদালতে একেক কাঠগড়ার বৈশিষ্ট্য থাকবে একেক রকম। কোনো কোনো কাঠগড়ার ব্যক্তির মুখ বন্ধ করে দেয়া হবে, শুধুমাত্র ওই ব্যক্তির অন্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সাক্ষ্য দেবে। আবার কোনো কোনো কাঠগড়ার ব্যক্তিকে কথা বলার সুযোগ দেয়া হবে। কিন্তু সেদিন কোনো ধরনের ক্ষমা প্রার্থনা গ্রহণযোগ্য হবে না। কোনো কোনো পাপী ব্যক্তি তাদের পাপ কাজের জন্য শয়তানকে দায়ী করবে। কিন্তু শয়তান তাদের ওই অভিযোগের জবাবে বলবে,আমি তোমাদের বাধ্য করিনি,কেবলমাত্র উস্কানি দিয়েছি।

এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:

এক. কিয়ামতে মানুষ তার প্রতিটি কাজের প্রতিদান পাবে। পৃথিবীর কাজের ভিত্তিতেই তাকে শাস্তি বা পুরস্কার দেয়া হবে। সেখানে তাদের কাজের প্রমাণও তুলে ধরা হবে। কোনো ধরনের অন্যায় করা হবে না।

দুই. আল্লাহর পক্ষ থেকে পাপীদের অপরাধের বিষয়ে অকাট্য প্রমাণ তুলে ধরা হবে। এর ফলে তাদের কঠোর শাস্তি যুক্তিযুক্ত বলে গণ্য হবে।

সূরা নাহলের ৮৭ ও ৮৮ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-

وَأَلْقَوْا إِلَى اللَّهِ يَوْمَئِذٍ السَّلَمَ وَضَلَّ عَنْهُمْ مَا كَانُوا يَفْتَرُونَ (87) الَّذِينَ كَفَرُوا وَصَدُّوا عَنْ سَبِيلِ اللَّهِ زِدْنَاهُمْ عَذَابًا فَوْقَ الْعَذَابِ بِمَا كَانُوا يُفْسِدُونَ

“সেদিন তারা (প্রকাশ্যে) আল্লাহর প্রতি আনুগত্য দেখাবে এবং তাদের উদ্ভাবিত ‘মিথ্যা’ তাদের হতাশার মাঝে হাওয়া হয়ে যাবে।” (১৬:৮৭)

“যারা আল্লাহকে প্রত্যাখ্যান করে এবং (মানুষকে) আল্লাহর রাস্তায় বাঁধা দেয় - তাদের জন্য শাস্তির উপরে শাস্তি বৃদ্ধি করব। কারণ তারা অশান্তি বিস্তার করে।” (১৬:৮৮)

আগের আয়াতের ধারাবাহিকতায় এ দু'টি আয়াতেও কিয়ামতে মুশরিকদের পরিণতি সম্পর্কে বলা হয়েছে। মুশরিকরা আল্লাহর সঙ্গে যাদেরকে শরীক করেছিল,তারা সেখানে মুশরিকদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেবে এবং তাদেরকে মিথ্যাবাদী বলে অভিহিত করবে। এ অবস্থায় আল্লাহর প্রতি আনুগত্য করা ছাড়া পাপীদের সামনে আর কোন পথ বাকি থাকবে না। ঐশী শাস্তি মোকাবেলার মতো কোনো অবলম্বনই তাদের থাকবে না। তারা সেখানে পুরোপুরি নিরুপায় ও অসহায় হয়ে পড়বে। যেসব বিভ্রান্ত ব্যক্তি অন্যদেরকেও বিভ্রান্তির পথে ডাকবে এবং কুফরি ও শিরকের পথে চলার জন্য উস্কানি দেবে,তাদের শাস্তি হবে সাধারণ পাপীদের চেয়েও অনেক বেশি। কারণ তাদের মাধ্যমে যারা পাপাচারে লিপ্ত হবে,তাদের পাপেরও অংশীদার হবে ওই সব ব্যক্তি।

এ দু'টি আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:

এক. পৃথিবীতে যারা আল্লাহর নির্দেশ মেনে চলবে না এবং আল্লাহর আনুগত্য করবে না,তারাও কিয়ামতে নিরুপায় অবস্থায় আল্লাহর আনুগত্য করবে। কিন্তু সেদিনের আনুগত্য তাদেরকে শাস্তি থেকে রেহাই দেবে না।

দুই. কুফরি ও শিরক হচ্ছে সমাজে অন্যায় ও দুর্নীতির ক্ষেত্র সৃষ্টিকারী। যারা সমাজের নিরাপত্তা বিনষ্ট করে, কেবল তারাই পাপাচারী নয় বরং যারা মানুষের সত চিন্তা ও বিশ্বাসের ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করে তারাও মারাত্মক পাপী।

সূরা নাহলের ৮৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

وَيَوْمَ نَبْعَثُ فِي كُلِّ أُمَّةٍ شَهِيدًا عَلَيْهِمْ مِنْ أَنْفُسِهِمْ وَجِئْنَا بِكَ شَهِيدًا عَلَى هَؤُلَاءِ وَنَزَّلْنَا عَلَيْكَ الْكِتَابَ تِبْيَانًا لِكُلِّ شَيْءٍ وَهُدًى وَرَحْمَةً وَبُشْرَى لِلْمُسْلِمِينَ

“সেদিন প্রত্যেক উম্মতের মধ্যে আমি তাদের মধ্য থেকেই একজন সাক্ষী দাঁড় করাব এবং তাদের বিষয়ে তোমাকে সাক্ষী হিসেবে উপস্থাপন করব। আমি মুসলমানদের (আত্মসমর্পনকারী) জন্য সব বিষয়ে ব্যাখ্যাদানকারী, পথনির্দেশক, অনুগ্রহ  এবং সুসংবাদ স্বরূপ তোমার প্রতি কিতাব অবতীর্ণ করেছি।” (১৬:৮৯)

এ আয়াতে, শেষ বিচার দিবসে বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-কে সব উম্মতের সাক্ষীদের সাক্ষী হিসেবে উপস্থিত করার কথা বলা হয়েছে। এর মধ্যদিয়ে সব নবী-রাসূলের মধ্যে বিশ্বনবীর শ্রেষ্ঠত্বের বিষয়টি আবারো স্পষ্ট করা হয়েছে। এ ছাড়া, এ আয়াতে মানুষকে সত পথে পরিচালনার ক্ষেত্রে পবিত্র কুরআনের ভূমিকা ও গুরুত্ব তুলে ধরা হয়েছে। সত্য ও মিথ্যাকে চেনার জন্য যা কিছু প্রয়োজন, তার সব কিছুই আল্লাহতায়ালা কুরআনে উল্লেখ করেছেন। এটা মানুষের প্রতি আল্লাহর বিশেষ রহমত বা অনুগ্রহ। কেবল মুসলমানরাই পবিত্র কুরআনের প্রতি বিশ্বাস রাখে। কাজেই তারাই আল্লাহর এ অনুগ্রহের শামিল হয়।

এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:

এক. নবী-রাসূলরা পৃথিবীতে মানুষের সব কাজের পর্যবেক্ষক। এ কারণেই তারা কিয়ামতে তার উম্মতের বিষয়ে সাক্ষ্য দিতে সক্ষম হবেন।

দুই. পবিত্র কুরআন হচ্ছে মানুষের সত পথে পরিচালনার ক্ষেত্রে পরিপূর্ণ একটি ঐশী গ্রন্থ।