সূরা নাহল;(২১তম পর্ব)

সূরা নাহল; আয়াত ৯০-৯২

সূরা নাহলের ৯০ নম্বর  আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-

إِنَّ اللَّهَ يَأْمُرُ بِالْعَدْلِ وَالْإِحْسَانِ وَإِيتَاءِ ذِي الْقُرْبَى وَيَنْهَى عَنِ الْفَحْشَاءِ وَالْمُنْكَرِ وَالْبَغْيِ يَعِظُكُمْ لَعَلَّكُمْ تَذَكَّرُونَ

“আল্লাহ ন্যায়পরায়ণতা, সদাচরণ এবং আত্মীয়-স্বজনকে দান করার আদেশ দেন এবং তিনি অশ্লীলতা, অসঙ্গত কাজ এবং অবাধ্যতা করতে নিষেধ করেন। তিনি তোমাদের উপদেশ দেন যেন তোমরা স্মরণ রাখ।” (১৬:৯০)

এ আয়াতটি কুরআনের পূর্ণাঙ্গতম আয়াতগুলির অন্যতম, যা দুনিয়ায় মু’মিনদের মানবিক ও সামাজিক সম্পর্ক বৃদ্ধি এবং ন্যায়পরায়ণতা, দয়া ও সব ধরনের জুলুম-অত্যাচার থেকে দূরে থাকার নির্দেশ দেয়। এ নির্দেশ আমাদেরকে সব অবস্থায় পালন করতে হবে। ন্যায়পরায়ণতা ও ইনসাফ হল ইসলামী শরীয়ত ও ধর্মের সব শিক্ষার ভিত্তি। আল্লাহ কারো উপর জুলুম করেন না এবং কাউকে অন্য কারো উপর জুলম করার বা কারো অধিকার লঙ্ঘন করারও অনুমতি দেননি।

কথা-বার্তা ও চাল-চলনে সব ধরনের বাড়াবাড়ি পরিহারের মাধ্যমে ইনসাফ বাস্তবায়ন সম্ভব। তাহলে ব্যক্তি ও সমাজের ব্যবহারে­­­­­­ পরিবর্তন আসবে।

অবশ্য ইসলামী আচরণ পালনের ক্ষেত্রে কখনো কখনো মানুষকে ইনসাফেরও উর্ধ্বে উঠে অন্যের ভুল ক্ষমা করে দিতে হবে। এমনকি মানুষ অন্যের প্রাপ্য অধিকারের চেয়েও বেশি তাদেরকে দিতে পারে। আর এগুলো সবই দয়া ও করুণার বহিঃপ্রকাশ। আল্লাহ-তায়ালা মানুষের প্রতি সর্বোত্তম দয়া দেখিয়েছেন বলে তিনি এভাবে অন্যের সঙ্গে আচরণ করার নির্দেশ দিয়েছেন।  অন্যদিকে, আল্লাহ-তায়ালা ব্যক্তি ও সমাজের সুস্থতা ও নিরাপত্তার জন্য কিছু বিষয়কে নিষেধ করেছেন, যা অপকর্ম ও মন্দ কাজ হিসেবে পরিচিত। প্রত্যেক  বিবেকবান ব্যক্তি এসব কাজকে খারাপ কাজ হিসেবে সাক্ষ্য দেবেন।

এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হচ্ছে:

এক. ন্যায় প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি সামাজিক সম্পর্ক রক্ষার জন্য দয়া করাও গুরুত্বপূর্ণ। তাহলে সমাজের মানুষের মধ্যে আন্তরিকতা ও বন্ধুত্ব রক্ষা পাবে।

দুই. আল্লাহর নির্দেশাবলি মানবজাতির বিবেক-বুদ্ধির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। ন্যায় ও করুণার প্রতি সব মানুষের আগ্রহ রয়েছে। সেইসঙ্গে তারা মন্দ কর্ম হতেও দূরে থাকতে চায়। আর  ধর্মও এ নির্দেশই দেয়।

তিন. সত্ কাজের আদেশ ও অসত‌্ কাজে নিষেধ করার ক্ষেত্রে এ কথা ভাবা ভুল হবে যে, সবাই আমাদের কথা মেনে নেবে। কারণ আল্লাহ-তায়ালাও যখন মানুষকে নির্দেশ দেন তখন বলেন- হয়তো তোমরা স্মরণ করবে এবং হয়তো মেনে নেবে। সর্ব শক্তিমান আল্লাহও মানুষকে তার নির্দেশ মানতে বাধ্য করেননি।

সূরা নাহলের ৯১ ও ৯২ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-

وَأَوْفُوا بِعَهْدِ اللَّهِ إِذَا عَاهَدْتُمْ وَلَا تَنْقُضُوا الْأَيْمَانَ بَعْدَ تَوْكِيدِهَا وَقَدْ جَعَلْتُمُ اللَّهَ عَلَيْكُمْ كَفِيلًا إِنَّ اللَّهَ يَعْلَمُ مَا تَفْعَلُونَ (91) وَلَا تَكُونُوا كَالَّتِي نَقَضَتْ غَزْلَهَا مِنْ بَعْدِ قُوَّةٍ أَنْكَاثًا تَتَّخِذُونَ أَيْمَانَكُمْ دَخَلًا بَيْنَكُمْ أَنْ تَكُونَ أُمَّةٌ هِيَ أَرْبَى مِنْ أُمَّةٍ إِنَّمَا يَبْلُوكُمُ اللَّهُ بِهِ وَلَيُبَيِّنَنَّ لَكُمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ مَا كُنْتُمْ فِيهِ تَخْتَلِفُونَ (92(

“তোমরা যখনই আল্লাহর নামে অঙ্গীকার করবে তখনই তা পূর্ণ কর, তোমরা আল্লাহকে সাক্ষ্য রেখে শপথ দৃঢ় করবার পর ভঙ্গ কর না। তোমরা যা কর আল্লাহ তা ভালভাবে জানেন।” (১৬:৯১)

“তোমরা তার মত হয়ো না, যে তার সুতা মজবুত করে পাকাবার পর খুলে নষ্ট করে দেয়। তোমরা পরস্পরকে প্রবঞ্চনা করার জন্য শপথ ব্যবহার করে থাকো, যাতে একদল অন্যদল অপেক্ষা লাভবান হও; আল্লাহ তো এটা দ্বারা শুধুমাত্র তোমাদের পরীক্ষা করেন; তোমরা যে বিষয়ে মতভেদ করছিলে, কেয়ামতের দিন আল্লাহ অবশ্যই স্পষ্টভাবে তা প্রকাশ করে দেবেন।” (১৬:৯২)

আগের আয়াতে সামাজিক আচার-আচরণ সম্পর্কে ইসলামের সার্বিক নীতিমালা বর্ণিত হয়েছে। সেইসঙ্গে ন্যায়পরায়ণতা, দয়া এবং সব ধরনের জুলুম ও অত্যাচার থেকে দূরে থাকাকে সামাজিক সম্পর্কের মূল ভিত্তি বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এ আয়াতে সামাজিক সম্পর্কের বিষয়ে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের প্রতি আলোকপাত করে বলা হয়েছে, প্রতিশ্রুতি আল্লাহর সঙ্গে হোক বা তার বান্দাদের সঙ্গে হোক- প্রত্যেক মুমিন ব্যক্তিকে তা পালন করতে হবে। কেউ কোনো মানত করলে আকাঙ্ক্ষা পূরণ হলেই মানত পূর্ণ করতে হবে। অর্থনৈতিক বা সামাজিক ক্ষেত্রেও কাউকে  কোনো বিষয়ে প্রতিশ্রুতি দিলে তা পালন করতে হবে। বিনা কারণে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করা যাবে না। সেইসঙ্গে অযথা আল্লাহর নামে শপথ করা যাবে না। আর কোনো কারণে যদি শপথ করতেই হয়, তাহলে অবশ্যই তা পালন করতে হবে। শপথ ভঙ্গ করে আল্লাহর নামের মাহাত্ম ও দ্বীনের পবিত্রতা নষ্ট করা যাবে না।

এ আয়াতে আল্লাহ আরো বলেছেন, যদি ক্ষমতার অধিকারই হও, তাহলে তোমার  অধীনস্ত ব্যক্তি, সমাজের দুর্বল ও  ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর প্রতি জুলুম কর না। তাদেরকে অধিকার বঞ্চিত কর না। কারণ এসব আচরণ সুস্পষ্ট জুলুম ও অত্যাচারের সমতুল্য। অবশ্য সামাজিক জীবনেও আল্লাহর সঙ্গে প্রতিশ্রুতি পালনের সুস্পষ্ট উদাহরণ রয়েছে। এরমধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হল ধর্মীয় নেতা এবং আল্লাহর ওলীদের অনুসরণ করা। আল্লাহ-তায়ালা ধর্মীয় নেতাদেরকে পৃথিবীতে নিজের প্রতিনিধি হিসেবে মনোনয়ন দিয়েছেন।

এ আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে:

এক. ওয়াদা ভঙ্গ করা শুধু অনৈতিক কাজ নয়, বরং কেয়ামতের দিন ওয়াদা ভঙ্গকারীকে আল্লাহর কঠিন শাস্তির সম্মুখীন হতে হবে।

দুই. অবৈধ স্বার্থ হাসিলের কাজে পবিত্র নামের অপব্যবহার করা যাবে না।

দুই. পথভ্রষ্টতা ও ওয়াদা ভঙ্গের ক্ষেত্র সৃষ্টিকারী একটি উপাদান হলো  ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়া। ক্ষমতা হাতে পেলে আমাদেরকে আল্লাহর কাছে জবাবদিহিতার বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে। কারণ, আল্লাহ মানুষকে পরীক্ষা করার জন্য তাকে ক্ষমতা দিয়ে থাকেন।