মানুষের ঐশী প্রতিনিধিত্ব- প্রথম অংশ

সার সংক্ষেপ

মানুষের মর্যাদার একটি মূল্যবান দিক হল সে মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে সর্বজনীন প্রতিনিধিত্ব লাভ করেছে। হযরত আদম (আ.) সকল মানবীয় মর্যাদার অধিকারী হিসাবে এক্ষেত্রে ফেরেশতাদের সামনে উপস্থাপিত হয়েছেন। মানুষকে এ প্রতিনিধিত্বের জন্য মনোনয়নের পেছনে যুক্তি হিসাবে মহান আল্লাহর (পবিত্র) নামসমূহ সম্পর্কে তাঁর অবগতির বিষয়টি পবিত্র কুরআনে উল্লিখিত হয়েছে। ইসলামী জ্ঞানের উৎসসমূহে আল্লাহর নামসমূহ বলতে অদৃশ্য জগৎ ও তার রহস্যময় ভাণ্ডারই উদ্দেশ্য।

মানুষের এ ঐশী প্রতিনিধিত্ব পৃথিবীতে সীমাবদ্ধ নয়;বরং সে পৃথিবী ও আকাশমণ্ডলী সর্বত্রই আল্লাহর খলিফা বা প্রতিনিধি হিসাবে দায়িত্বপ্রাপ্ত। প্রতিনিধিত্বের দৃষ্টিতে তার মধ্যে উপাস্য (ইলাহ্) হওয়া ও নিরঙ্কুশ শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদার হওয়া ব্যতীত স্রষ্টার সকল গুণবাচক বৈশিষ্ট্য রয়েছে।

পূর্ণ মানব (ইনসানে কামেল) ঐশী প্রতিনিধিত্বের সমুজ্জ্বল নমুনা ও দৃষ্টান্ত হিসাবে আল্লাহর সুন্দরতম (গুণবাচক) নামসমূহের পূর্ণ প্রকাশস্থল। সে সমগ্র অস্তিত্ব জগতে (বস্তু ও অবস্তু উভয় জগতে) মহান আল্লাহর প্রতিনিধি এবং সামগ্রিক শক্তি ও ক্ষমতার অধিকারী। সে আল্লাহর সরাসরি প্রতিনিধি এবং অন্য পূর্ণ মানবরা তাঁর মাধ্যমে আল্লাহর প্রতিনিধি।

মানুষের ঐশী খেলাফত বা প্রতিনিধিত্বের মূল ভিত্তি হল আল্লাহর পূর্ণতম নামসমূহ সম্পর্কে তার জ্ঞান ও সেগুলোর প্রকাশস্থল হওয়া। যেহেতু মহান আল্লাহ অসীম এবং তাঁর সকল বৈশিষ্ট্যই অসীম সেহেতু মানুষের এ প্রতিনিধিত্ব লাভ সৃষ্টিজগতে আল্লাহর ক্ষমতা ও অস্তিত্বগত সীমাবদ্ধতার কারণে নয়;বরং যে অস্তিত্ব জগতের ওপর ঐশী মানবের প্রতিনিধিত্ব রয়েছে আল্লাহর অনুগ্রহ ধারণের ক্ষেত্রে সেটির (অস্তিত্বজগতের) অক্ষমতা ও সীমাবদ্ধতাই এ ঐশী মানবের প্রতিনিধিত্বের কারণ। প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ্ সকল কিছুকে বেষ্টন করে আছেন এবং নিরঙ্কুশভাবে প্রকাশিত।

পূর্ণ মানব আল্লাহর খলিফা বা প্রতিনিধি হিসাবে সমগ্র সৃষ্টিজগতকে অস্তিত্বগত ও বিধানগতভাবে পরিচালনাকারী এবং অবস্তুসত্তাসমূহ (ফেরেশতামণ্ডলী) এবং বস্তুসত্তাসম্পন্ন (বস্তুজগতের) সকল কিছুর শিক্ষক। সে আল্লাহর মধ্যে বিলীন হওয়ার কারণে নিজে কোন সত্তার অধিকারী নয়। এ ব্যাখ্যার ভিত্তিতে আল্লাহর খেলাফত ও প্রতিনিধিত্ব লাভের ক্ষেত্রে স্তরগত পর্যায় রয়েছে। প্রতিটি অস্তিত্ব যতটুকু ঐশী বৈশিষ্ট্যের অধিকারী,প্রতিনিধিত্বের ক্ষেত্রে সে ঐ অবস্থানে রয়েছে।

ভূমিকা

মানুষের প্রকৃত পরিচয় কী তা প্রাচীন কাল থেকেই বিভিন্ন চিন্তাবিদ ও চিন্তাধারার (মতবাদ) নিকট আলোচনার বিষয় ছিল। ইসলাম পূর্ণতম ধর্ম হিসাবে এ বিষয়টির প্রতি সর্বাধিক দৃষ্টি দিয়েছে ও মানুষের সৃষ্টির রহস্যের পর্দা উন্মোচিত করেছে। ইসলাম মানুষকে আল্লাহর প্রতিনিধিত্বের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত এক অস্তিত্ব হিসাবে তুলে ধরেছে। ইতোপূর্বে কোন ধর্মই মানুষের মর্যাদাপূর্ণ এ অবস্থানের বিষয়ে এতটা সূক্ষ্ম দৃষ্টি দান করেনি।

মানুষ অস্তিত্বগতভাবে দু’টি দিকের অধিকারী যার একটি হল তার ঐশী ও আত্মিক দিক যার মাধ্যমে সে ঐশী প্রতিনিধিত্বের স্থানে পৌঁছায় এবং অপর দিকটি হল বস্তুগত দিক যার মধ্যে মানুষের সকল দুর্বল দিক নিহিত। মানুষের নিম্নস্তরের এ দিকটির কারণেই ফেরেশতারা মানুষ সৃষ্টির যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন করেছিলেন।

যদিও মানুষের ঐশী প্রতিনিধিত্বের সত্তাকে বোঝা ও জানা প্রায় অসম্ভব,তদুপরি আমাদের সাধ্যমত এ গোপন সত্য ও গুপ্ত ভাণ্ডারকে উদ্ঘাটনের চেষ্টা করা উচিত যাতে তার প্রকৃত পরিচয় লাভের মাধ্যমে মহান আল্লাহকে চেনা সম্ভব হয় এবং মানুষের প্রকৃত রূপ দর্শনের মধ্যে মহান আল্লাহকে চেনার নিদর্শনকে খুঁজে পাওয়া যায়,ফলে তা দেখে আল্লাহর পরিচয় লাভ সম্ভব হয়। মহানবী (সা.) বলেছেন : ‘যে নিজেকে চিনতে পেরেছে,নিঃসন্দেহে সে তার প্রভুকে চিনেছে।’

এ পরিচিতি বিভিন্নভাবে অর্জিত হতে পারে। কখনও আমরা মানুষের বস্তুগত রূপের পরিচয় লাভ করতে চাই,আবার কখনও তার আত্মিক ও অবস্তুরূপের পরিচয় লাভের আকাঙ্ক্ষী। এক্ষেত্রে আল্লাহর প্রতিনিধি মানুষের পরিচয় লাভ এ দৃষ্টিতে বিশেষ গুরুত্ব রাখে যে,এ পরিচিতির মাধ্যমে ঐশী আমানত রক্ষায় দায়িত্বশীল এবং মহান আল্লাহর নামসমূহের প্রকাশস্থল হওয়া ও স্রষ্টার নিকটতম স্থানে ও সান্নিধ্যে পৌঁছার বিষয়টিকে অনুধাবন করা সম্ভব। এ প্রবন্ধে ইসলামের দৃষ্টিতে মানুষের ঐশী প্রতিনিধিত্বের বিভিন্ন দিক পর্যালোচনার চেষ্টা করা হয়েছে।

খলিফা শব্দের আভিধানিক অর্থ

অভিধানে খলিফা হল সে-ই যে কারও পেছনে এসেছে ও স্থলাভিষিক্ত হয়েছে। খলিফা শব্দটি ‘فعيله’ ওয়ায্ন (গঠনরূপ) ধারণ করেছে এবং কর্তৃকারক নির্দেশ করতে ব্যবহৃত হয়েছে। এ শব্দটি সাধারণত পূর্ববর্তী কারও স্থলাভিষিক্ত হওয়া অর্থে ব্যবহৃত হয়। কিন্তু এর অর্থ এ নয় যে,পূর্ববর্তী ব্যক্তি বা সত্তা ধ্বংস বা বিলীন হওয়ার পর স্থলাভিষিক্ত হওয়ার বিষয়টি ঘটেছে।’

ঐশী খেলাফতের অর্থ

পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ মানুষকে তাঁর প্রতিনিধি হিসাবে মনোনয়নের ঘোষণা দিয়ে বলেছেন : ‘এবং যখন তোমার প্রভু ফেরেশতাদেরকে বললেন : নিশ্চয় আমি পৃথিবীতে খলিফা (প্রতিনিধি ও স্থলাভিষিক্ত) নিযুক্তকারী। তারা বলল : আপনি কি সেখানে এমন কাউকে নিযুক্ত করবেন যে বিশৃংখলা সৃষ্টি করবে ও রক্তপাত করবে? অথচ আমরাই তো আপনার গুণগান করছি। তিনি বললেন : নিশ্চয় আমি যা জানি তোমরা তা জান না।’

সুতরাং মানুষ পৃথিবীতে আল্লাহর খলিফা এবং তাকে এ গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনের জন্য উপযুক্ত ক্ষমতা ও যোগ্যতা দেয়া হয়েছে।

মানুষ পৃথিবীতে আল্লাহর স্থলাভিষিক্ত

পবিত্র কুরআনে যে মানুষকে স্থলাভিষিক্ত বলে উল্লেখ করা হয়েছে সেক্ষেত্রে মানুষ কার স্থলাভিষিক্ত তা নিয়ে মুফাসসিরদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। কেউ কেউ মানুষকে জীন জাতির স্থলাভিষিক্ত,কেউ বা ফেরেশতাদের স্থলাভিষিক্ত,কেউ কেউ পূর্ববর্তী মানবজাতির,আবার কেউ কেউ তাকে সকল সৃষ্টির স্থলাভিষিক্ত বলেছেন;কিন্তু পবিত্র কুরআনের আয়াতসমূহ ও হাদীস থেকে সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়,মানুষ পৃথিবীতে আল্লাহর প্রতিনিধি এবং তার এ মর্যাদার কারণেই ইবলিস তার প্রতি হিংসা করেছিল। মানুষ আল্লাহর প্রতিনিধি হওয়ার সপক্ষে পবিত্র কুরআনের সূরা বনি ইসরাইলের ‘নিশ্চয়ই আমি আদম সন্তানদেরকে সম্মানিত করেছি এবং তাদেরকে স্থলে ও সমুদ্রে আরোহণ করিয়েছি এবং তাদেরকে পবিত্র রিয্ক (জীবিকা) দান করেছি এবং আমরা যাদের সৃষ্টি করেছি তাদের অনেকের ওপর তাদের শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছি’-এ আয়াতটি অন্যতম প্রমাণ।

আমরা পরবর্তীকালে বর্ণনা করব যে,মানুষের এ শ্রেষ্ঠত্ব ও ঐশী মর্যাদা লাভের প্রকৃত কারণ হল তার আল্লাহর পবিত্র নামসমূহের রহস্য সম্পর্কে অবহিতি। ফেরেশতাগণ তাদের সকল মর্যাদার বৈশিষ্ট্য সত্ত্বেও এ জ্ঞান অর্জনে অক্ষম ছিলেন এবং একমাত্র হযরত আদম (আ.)-এর শিক্ষায় তাঁরা সে সম্পর্কে অবহিত হন। এ মর্যাদা আল্লাহ ব্যতীত অন্য কোন সত্তার স্থলাভিষিক্তের মধ্যে নেই এবং তাদের স্থলাভিষিক্ত হয়ে এ ধরনের মর্যাদা লাভ সম্ভব নয়।

তেমনি যদি ‘নিশ্চয় আমি পৃথিবীতে খলিফা নিযুক্তকারী’ আয়াতটির বাহ্যিক অর্থ ছাড়াও তার পরবর্তী আয়াতগুলোকে সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে দেখা হয় তাহলে আমাদের কাছে স্পষ্ট হবে যে,মহান আল্লাহ নিজের স্থলাভিষিক্ত ও প্রতিনিধি নিযুক্তির কথা বলছেন। কারণ,যদি মানুষ আল্লাহর প্রতিনিধি না হয় তবে ফেরেশতাদের হযরত আদমকে সিজদা করার নির্দেশ দানের কোন অর্থ হয় না। তদুপরি মহান আল্লাহ মানুষ সৃষ্টির পূর্বে অসংখ্য প্রাণী সৃষ্টি করেছেন,কিন্তু তাদের কাউকে সৃষ্টির সময়ই প্রতিনিধি নিযুক্তির কথা বলেননি।

এ থেকে প্রমাণিত হয় যে,হযরত আদম (আ.) তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের মাধ্যমে আল্লাহর খলিফা বা প্রতিনিধি হিসাবে মনোনীত হন। মহান আল্লাহ যখন তাঁকে তাঁর নামসমূহ শিক্ষা দিলেন এবং ফেরেশতারা তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব বুঝতে পারলেন তখনই তিনি তাদেরকে সিজদা করার নির্দেশ দিলেন। কারণ,কেবল আল্লাহর প্রতিনিধি তাঁর নামসমূহ সম্পর্কে অবহিত হতে সক্ষম ও তাঁর গুণাবলির পূর্ণ প্রকাশস্থল হয়েছেন।

মহান আল্লাহ হযরত আদম (আ.)-কে সৃষ্টি ও তাঁর মধ্যে রূহ ফুঁকে দেওয়ার মাধ্যমে তাঁকে পৃথিবীতে নিজের স্থলাভিষিক্ত করতে মনস্থ করলেন যাতে তিনি তাঁর নামসমূহ ও গুণাবলির প্রকাশ ঘটাতে পারেন। আল্লাহ তাঁর নামসমূহ শিক্ষা দানের মাধ্যমে তাঁকে সকল সৃষ্টির ওপর প্রাধান্য দিলেন,পূর্ণ মানবদের সৃষ্টি জগতের ওপর কর্তৃত্ব দান করলেন এবং আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীকে তাঁদের অনুগত করলেন।

ঐশী প্রতিনিধিত্ব মানবজাতির জন্য নির্দিষ্ট

আলোচ্য আয়াতের খলিফার পদটি কি শুধু হযরত আদম (আ.)-এর জন্য নির্দিষ্ট নাকি অন্যরাও তার অন্তর্ভুক্ত এ বিষয়ে মুফাস্সিরদের মধ্যে মতভিন্নতা রয়েছে। আমরা এখানে এ মতগুলো পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণ করব :

১. একদল মুফাস্সির স্থলাভিষিক্তের পদটি হযরত আদম (আ.)-এর জন্য নির্দিষ্ট বলেছেন। তাঁদের মতে অন্য কেউ এ প্রতিনিধিত্বের অধিকারী নয়।

২. কারও কারও মতে হযরত আদম (আ.) ছাড়াও অন্যান্য পুণ্যবান মানব ঐশী প্রতিনিধিত্বের অধিকারী।

৩. কেউ কেউ বলেছেন,সকল পরিশুদ্ধ মুমিন ঐশী প্রতিনিধিত্ব লাভ করেছেন।

৪. কোন কোন মুফাস্সিরের মতে সকল মানুষ,এমনকি কাফের ও মুশরিকরাও ঐশী খেলাফতের অধিকারী।

৫. কেউ কেউ বলেছেন,এ খেলাফত মানবজাতির জন্য নির্দিষ্ট,তবে প্রত্যেক মানুষই পূর্ণতার যে পর্যায়ে রয়েছে সে অনুপাতে ঐশী প্রতিনিধিত্বের অধিকারী।

মানুষের ঐশী প্রতিনিধিত্বের মানদণ্ড হল মহান আল্লাহর সুন্দর নামসমূহের রহস্য সম্পর্কে অবগতি এবং মানুষ তা অর্জনের যোগ্যতা অনুযায়ী পূর্ণতার অধিকারী। অর্থাৎ মানুষ আল্লাহর নাম সম্পর্কিত জ্ঞানে যত বেশি প্রকৃতস্থ হবে তার মধ্যে তত বেশি পূর্ণতা সৃষ্টি হবে। প্রতিটি ব্যক্তির মধ্যে আল্লাহ পরিচিতির পর্যায় হিসাবে পূর্ণতা বিদ্যমান। যে ব্যক্তি তার ঐশী পরিচিতির জ্ঞানকে বাস্তব রূপ দান করবে ও সুপ্ত অবস্থা থেকে কার্যকর অবস্থায় পরিণত করবে সে আরও পূর্ণতার দিকে ধাবিত হবে এবং ঐশী প্রতিনিধিত্বের ক্ষেত্রেও উচ্চতর পর্যায়ে উন্নীত হবে। সুতরাং আল্লাহর নামের পরিচিতি ও মানবিক পূর্ণতার পরিবর্তনের সাথে সাথে ঐশী প্রতিনিধিত্বের পর্যায়েও পরিবর্তন ঘটে।

মতসমূহের পর্যালোচনা

প্রথম মত : এ মত অনুযায়ী ঐশী প্রতিনিধিত্বের বিষয়টি হযরত আদম (আ.)-এর জন্য নির্দিষ্ট। কিন্তু এ মতটি কয়েকটি কারণে গ্রহণযোগ্য নয়। আমরা প্রমাণ করব যে,এ পদটি হযরত আদম (আ.)-এর জন্য নির্দিষ্ট নয়;বরং মানবজাতি সার্বিকভাবে এ পদের উপযুক্ত। তবে হযরত আদম (আ.)-কে এ ঐশী মর্যাদার প্রতীক হিসাবে ফেরেশতাদের সামনে উপস্থাপন করা হয়েছিল। এ বিষয়ে মহানবী (সা.) বলেন :

‘যখন মহান আল্লাহ আদমকে সৃষ্টি করলেন তখন আমাকে ও আমার বংশধরকে তার ঔরসে স্থাপন করলেন এবং ফেরেশতাদেরকে আমাদের সম্মানে তাঁকে সিজদা করার নির্দেশ দিলেন। এ সিজদা আল্লাহর জন্য ইবাদাত এবং আদমের জন্য সম্মান প্রদর্শন ও আনুগত্যের স্বীকৃতি স্বরূপ ছিল এবং তা এ কারণে যে,আমরা তাঁর ঔরসে ছিলাম।’

প্রথম মতটি নিম্নোক্ত কারণে গ্রহণযোগ্য নয় :

প্রথমত আরবি ব্যাকরণে যখন কোন শব্দ কর্তৃবাচ্যে ব্যবহৃত হয় তখন তা অব্যাহত অর্থ বহন করে। আলোচ্য আয়াতে ‘আমি পৃথিবীতে খলিফা নিযুক্তকারী’ বাক্যে নিযুক্তকরণের বিষয়টি অব্যাহত ইঙ্গিত করছে যা হযরত আদমের পরেও অব্যাহত থাকবে।

দ্বিতীয়ত সূরা হজ্বের ৬৫ নং আয়াতসহ পবিত্র কুরআনের যে সকল আয়াতে আল্লাহর পক্ষ থেকে পৃথিবীর সকল কিছু মানবজাতির অধীন ও অনুগত করার কথা বলা হয়েছে তাতে সমগ্র মানবজাতিকেই অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে,কাউকে বিশেষায়িত করা হয়নি এবং মানুষ আল্লাহর প্রতিনিধি হিসাবেই এ অধিকার লাভ করেছে। অনেক হাদীসেও পৃথিবীকে সব মানুষের সেবায় নিয়োজিত করার কথা বলা হয়েছে।

তৃতীয়ত মানুষের ঐশী প্রতিনিধিত্বের মানদণ্ড হল আল্লাহর সুন্দর নামসমূহের পরিচয় জানা এবং এ বিশেষত্ব শুধু হযরত আদম (আ.)-এর জন্য নয়; বরং অন্যান্য মানুষও ধর্মীয় শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ছায়ায় ঐ নামগুলোকে বক্ষে ধারণ ও কর্মে বাস্তবায়িত করে ঐশী খেলাফতের মর্যাদায় পৌঁছতে পারে।

চতুর্থত সূরা আরাফের ‘প্রকৃতপক্ষে আমি তোমাদের সৃষ্টি করেছিলাম,অতঃপর তোমাদের আকৃতি দান করেছিলাম এবং এরপর ফেরেশতাদের আদমকে সিজদা করতে বলেছিলাম’-এ আয়াতে সকল মানুষকে লক্ষ্য করে সম্বোধন থেকে বোঝা যায় ঐ মর্যাদা হযরত আদমের জন্য নির্দিষ্ট ছিল না এবং তাঁকে মানবজাতির প্রতিনিধি ও আদর্শ হিসাবে ফেরেশতাদের সামনে উপস্থাপন করে সিজদা করতে বলা হয়েছিল।

পঞ্চমত আহলে বাইতের পবিত্র ইমামদের সূত্রে বর্ণিত হয়েছে,পৃথিবী কখনও আল্লাহর প্রতিনিধিবিহীন থাকবে না এবং আদমের সন্তানদের মধ্য থেকে নিষ্পাপ ব্যক্তিদের কেউ না কেউ এ প্রতিনিধি হিসাবে থাকবেন। এ থেকে বোঝা যায়,হযরত আদম ব্যতীত অন্যরাও আল্লাহর প্রতিনিধি ও স্থলাভিষিক্ত।

এছাড়া কোন কোন হাদীসে আল্লাহর প্রতিনিধিত্ব সম্পর্কিত আয়াতের মনোনীত ব্যক্তিরা হযরত আদম (আ.) ও পূর্ণ মানবগণ বলে উল্লিখিত হয়েছে। কিন্তু এ সম্পর্কিত হাদীসসমূহ পর্যালোচনা করলে দেখা যায় সেগুলোতে হযরত আদম (আ.) ও অন্যান্য পূর্ণমানবের ঐশী প্রতিনিধিত্বের বিষয়টি ইশারা করলেও অন্যদের তাতে অন্তর্ভুক্ত হওয়াকে প্রত্যাখ্যান করেনি। এ সম্পর্কে আয়াতুল্লাহ্ জাওয়াদী আমুলী বলেন :

‘ঐশী প্রতিনিধিত্বের বিষয়টিকে পূর্ণ মানবদের জন্য নির্ধারিত হওয়ার ধারণাটি বিশ্বের সৃষ্টিগত (তাকভীনী) ও বিধানগত (তাশরীয়ী) ব্যবস্থার মধ্যে পার্থক্য না করার কারণে ঘটেছে। কারণ,বিশ্বের বিধি-বিধানগত ব্যবস্থায় খলিফা ও ঐশী প্রতিনিধিত্বের জন্য অনেক শর্ত রাখা হয়েছে,যেমন সত্যবাদিতা,বিশ্বস্ততা,পবিত্রতা,পাপ থেকে মুক্ত থাকা ইত্যাদি। কিন্তু সৃষ্টিগত ব্যবস্থায় ঐশী প্রতিনিধিত্বের জন্য যা প্রয়োজন তা হল সৃষ্টিশীলতা,আল্লাহর নামসমূহকে নিজের অভ্যন্তরে প্রতিফলিত করার প্রচ্ছন্ন যোগ্যতা ইত্যাদি। যদিও রক্তপাত,বিশৃংখলা সৃষ্টি,শস্যক্ষেত্র ধ্বংস,জীবজন্তু হত্যা করা ইত্যাদি কর্ম অবশ্যই ঐশী প্রতিনিধিত্বের সাথে অসামঞ্জস্যশীল কাজ। কিন্তু এরূপ কর্ম করা মানুষের অকৃতজ্ঞতা ও নিজের মর্যাদার অসম্মানের পরিচয় বহন করে। তবে তার অর্থ এটা নয় যে,সার্বিকভাবে সকল মানুষের জন্য সৃষ্টিগতভাবে ঐশী প্রতিনিধিত্বের মর্যাদা নির্ধারিত হয়নি।’১০

কেউ কেউ সকল মানুষের ঐশী প্রতিনিধিত্বের বিষয়কে খণ্ডনের জন্য স্রষ্টার সঙ্গে মানুষের অমিলের বিষয়কে উপস্থাপন করেছেন। তাদের মতে কেউ কারও প্রতিনিধি হতে হলে তাদের উভয়ের মধ্যে বৈশিষ্ট্যের ক্ষেত্রে অবশ্যই মিল থাকতে হবে। কিন্তু সকল মানুষের মধ্যে ঐশী পূর্ণতার গুণাবলী সম্পূর্ণ মাত্রায় থাকা সম্ভবপর নয়। তাই যে সকল মানুষের মধ্যে একটি নির্দিষ্ট মাত্রা পর্যন্ত পূর্ণতার গুণ রয়েছে যেমন মুমিন ও আত্মসংযমী ব্যক্তিরা তারাও একটি পর্যায় পর্যন্ত ঐশী প্রতিনিধি হিসাবে গণ্য হতে পারেন এবং পূর্ণতম মানুষ আল্লাহর পূর্ণতম খলিফা ও প্রতিনিধি। এ পূর্ণতম মানুষ আল্লাহর প্রথম সৃষ্টি বা তাঁর গুণাবলির প্রথম প্রকাশ হিসাবে আবির্ভূত হন।

এ মতের পর্যালোচনায় বলা যায়,ঐশী প্রতিনিধিত্বের বাস্তব নমুনা ও দৃষ্টান্ত হিসাবে উপস্থাপিত হওয়ার বিষয়টি অন্য মানুষের ঐশী প্রতিনিধিত্বের প্রচ্ছন্ন যোগ্যতার অধিকারী হওয়াকে নাকচ করে না। কারণ,তারা বর্তমানে প্রচ্ছন্ন ক্ষমতার অধিকারী হলেও পরবর্তীকালে ঐশী পূর্ণতার বৈশিষ্ট্যগুলোকে কার্যকর রূপ দিতে পারে। তাদের মধ্যে এ বৈশিষ্ট্যটি সুপ্ত আকারে পূর্ণমাত্রায় বিদ্যমান বিধায় সৃষ্টিগতভাবে তারা প্রতিনিধিত্বের যোগ্যতাসম্পন্ন।১১

চতুর্থ মতের সমর্থকরা তাঁদের মতের সপক্ষে কয়েকটি যুক্তি উপস্থাপন করেছেন।

প্রথমত কোন কোন হাদীসে এসেছে যে,আল্লাহ ফেরেশতাদের সমবেত করে মানুষের নামাযের ইমামতী করার নির্দেশ দিলে ফেরেশতারা মানুষের ইমাম হতে অস্বীকৃতি জানালেন। এরূপ হাদীস থেকে বলা যায় সকল মানুষ ঐশী প্রতিনিধিত্বের অধিকারী।

তাফসীরে নুরুস সাকালাইনে হযরত জিবরাঈল (আ.) থেকে বর্ণিত হয়েছে,তিনি বলেন : ‘যেদিন থেকে আমরা হযরত আদম (আ.)-কে সিজদা করার নির্দেশপ্রাপ্ত হয়েছি সেদিন থেকে আমরা মানুষের অগ্রগামী হই না।’১২

সূরা আরাফের ১১ নং আয়াত যেখানে সমগ্র মানবজাতিকে সম্বোধন করে হযরত আদমের সিজদার বিষয়টি উল্লিখিত হয়েছে তা থেকে বোঝা যায়,হযরত আদম (আ.) প্রতীকীভাবে মানবজাতির প্রতিনিধিত্ব করেছেন।

চতুর্থ মতটির সপক্ষে যে বর্ণনাগুলো আনা হয়েছে তা সকল মানুষের জন্য প্রচ্ছন্নভাবে ঐশী প্রতিনিধিত্বের মর্যাদা রয়েছে বলে প্রমাণ করে এবং এ বিষয়টি যে হযরত আদম (আ.) ও অন্যান্য পূর্ণ মানবদের জন্য সীমাবদ্ধ নয় তাও প্রাসঙ্গিকভাবে বর্ণনা করে;কিন্তু কারও জন্যই ঐশী প্রতিনিধিত্বের বিষয়টি কার্যকর রূপে বাস্তবে রয়েছে তা প্রমাণ করে না।১৩

পঞ্চম মত অনুযায়ী মানুষের ঐশী প্রতিনিধিত্বের মানদণ্ড হল ঐশী নামসমূহ সম্পর্কে অবহিতি অর্থাৎ আল্লাহর খলিফা তাঁর সুন্দর নামসমূহের প্রকাশস্থল। কোন কোন সৃষ্টি আল্লাহর বিশেষ কিছু নামকে ধারণ করে। তারা আংশিক প্রতিনিধিত্বের অধিকারী। অন্যভাবে বলা যায় ঐশী প্রতিনিধিত্বের বিষয়টি অস্তিত্বগতভাবে পূর্ণতার সাথে সম্পর্কিত এবং তার বিভিন্ন পর্যায় রয়েছে। তার পূর্ণতম পর্যায় পূর্ণতম মানবের জন্য নির্দিষ্ট। অন্যান্য পূর্ণ মানব ও পরিশুদ্ধ ব্যক্তি তাঁর থেকে নিম্নের পর্যায়ে রয়েছেন।

সুতরাং ঐশী খেলাফতের বিষয়টি হযরত আদম (আ.)-এর জন্য নির্দিষ্ট নয় এবং তা অন্যান্য পূর্ণ মানব ও পুণ্যাত্মা ব্যক্তিদের মধ্যেও সীমাবদ্ধ নয়;বরং সাধারণভাবে সমগ্র মানবজাতিও প্রতিনিধিত্বের যোগ্যতা রাখে;এ বৈশিষ্ট্য প্রচ্ছন্নভাবে তাদের সবার মধ্যে বিদ্যমান। তবে প্রত্যেক ব্যক্তিই আল্লাহর সুন্দরতম নামসমূহের যতটুকু নিজে ধারণ করেছে ও যতটুকু পূর্ণতা অর্জন করেছে সে বাস্তবে ঐ পর্যায়ের ঐশী প্রতিনিধিত্বের অধিকারী হয়েছে।

(চলবে)

টীকা ও তথ্যসূত্র

১. মহান আল্লাহ হাদীসে কুদসীতে বলেন : ‘আমি গুপ্ত ভাণ্ডার ছিলাম এবং নিজেকে পরিচিত করাতে চাইলাম। তাই জগৎ সৃষ্টি করলাম যাতে আমাকে চিনতে পারে।’ (আল্লামা বাকের মাজলিসী,বিহারুল আনওয়ার,৮৪তম খণ্ড,পৃ. ১৯৮);

২. বিহারুল আনওয়ার,আল্লামা মুহাম্মাদ বাকের মাজলিসী,২য় খণ্ড,পৃ. ৩২,মুয়াসসাসা আল ওয়াফা,বৈরুত,১৪০৩ হিজরী;

৩. মুফরাদাতু আলফাজিল কুরআন,রাগেব ইসফাহানী,দারুল কালাম ওয়াদ দারুস সামিয়া,দামেস্ক,১৪১৬ হিজরী,শব্দমূলের আলোচনা দ্রষ্টব্য;

৪. আযওয়াল বায়ান ফি ইযাহিল কুরআন বিল কুরআন,মুহাম্মদ আমিন ইবনে মুহাম্মাদ মুখতার,গবেষণা ও পরিবর্ধন : মুহাম্মদ সালিম,দারুল ইয়াহয়িহা,বৈরুত;

৫. তাসনীম,তাফসীরে কুরআনে কারিম,আয়াতুল্লাহ্ জাওয়াদী আমুলী,৩য় খণ্ড,পৃ. ৬০,মারকাযে নাশরে ইসরা,কোম,১৩৮০ ফারসি সাল;

৬. তাফসীরে কাশশাফ,আল্লামা মাহমুদ ইবনে উমর যামাখশারী,১ম খণ্ড,পৃ. ২২৪,বৈরুত,দারুল ফিকর,১৩৯৭ হিজরী;জাওয়ামেয়ুল জামে ফি তাফসীরিল কুরআন,ফাযল ইবনে হাসান আত্ তাবারসী,১ম খণ্ড,পৃ. ১৭৬,বৈরুত,দারুল আজওয়া,১৪০৮ হিজরী;মাজমাউল বায়ান ফি তাফসীরিল কুরআন,আল্লামা তাবারসী,১ম খণ্ড,পৃ. ৪১,বৈরুত,দারুত তুরাস ওয়া মুয়াসসাতুত তারিখ,১৪১২ হিজরী;

৭. আত তাফসীরুল কাশশাফ,মুহাম্মাদ জাওয়াদ মুগনিয়া,১ম খণ্ড,পৃ. ৮০,দারুল ইল্ম লিল মালাইন,বৈরুত,১৯৯০; তাফসীরুল মানার,মুহাম্মাদ রশিদ রেযা,১ম খণ্ড,পৃ. ২৫৮,দারুল যিকর,১৪১৪ হিজরী;

৮. তাসনীম,আয়াতুল্লাহ্ জাওয়াদী আমুলী,৩য় খণ্ড,পৃ. ৪০;আল মিযান ফি তাফসীরিল কুরআন,আল্লামা সাইয়্যেদ মুহাম্মাদ হুসাইন তাবাতাবায়ী,অনুবাদ : আয়াতুল্লাহ্ মাকারেম শিরাজী,১ম খণ্ড,পৃ. ১৫৮,বুনিয়াদে এলমী ওয়া ফেকরি আল্লামা তাবাতাবায়ী,১৩৭০ ফারসি সাল,আল্লামা তাবাতাবায়ী এ মতের সপক্ষে পবিত্র কুরআনের সূরা আরাফ : ৬৮,সূরা ইউনুস : ১৪ এবং নাহল ৬২ নং আয়াতকে প্রমাণ হিসাবে উপস্থাপন করেছেন;

৯. বিহারুল আনওয়ার,আল্লামা মুহাম্মাদ বাকের মাজলিসী,১৮তম খণ্ড,পৃ. ৩৪৬,বৈরুত,মুয়াসসেসাতুল ওয়াফা,১৪০৩ হিজরী;

১০. শায়খ আবদে আলী ইবনে জুমআ আরুসী,হুয়াইজী,নুরুস সাকালাইন,কোম,ইনতিশারাতে ইসমাঈলীয়ান,১৪১৫ হিজরী,১ম খণ্ড,পৃ. ৫১,হাদীস নং ৮০; বাহরানী,সাইয়্যেদ হাশেম,তাফসীরে বুরহান,কোম,ইনতিশারাতে ইসমাঈলীয়ান,১৪১৭ হিজরী,১ম খণ্ড,পৃ. ৭৩,হাদীস নং ২;

১১. উসূলে কাফী,আল্লামা কুলাইনী,তেহরান,দারুল কুতুব আল ইসলামিয়া,১৩৮৮ হিজরী,১ম খণ্ড,পৃ. ১৭৮ ও ১৭৯;

১২. তাসনীম,আয়াতুল্লাহ্ জাওয়াদী আমুলী,৩য় খণ্ড,পৃ. ৪৯;

১৩. প্রাগুক্ত,তাসনীম,৩য় খণ্ড,পৃ. ৪৬।