ইসলামের দৃষ্টিতে মানুষ

মানুষ হলো দেহ ও আত্মার সমন্বয়ে গঠিত অস্তিত্বঃ মৃত্যুর পর যার দেহ বিন্বনষ্ট হয়। কিন্তু আত্মা জীবনপথে অগ্রসর হয়। সে কেয়ামত সংঘটিত হওয়া পর্যন্ত বারযাখের জীবন অতিবাহিত করবে। কোরআন মাজীদ মানব সৃষ্টির বর্ণনা করতে গিয়ে শেষ পর্যায়কে মানুষের দেহে রূহ ফুঁকে দেয়ার পর্যায় বলে উল্লেখ করেছে।

অতপরঃ তাকে অন্য এক অস্তিত্বরূপে সৃষ্টি করেছি।”(সূরা মুমিনুন-১৪)

অপর এক শ্রেনীর আয়াতে মানুষের বারযাখের জীবনের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। যেমনঃ “এবং তাদের সম্মুখে (পশ্চাতে) রয়েছে বারযাখ সেদিন পর্যন্ত তাদেরকে পুনরুত্থিত করা হবে। (সূরা মুমিনিনঃ ১০০)

বারযাখের জীবন সম্পর্কে এরূপ আরো আয়াত রয়েছে।

প্রতিটি মানুষই পবিত্র ও তাওহীদী ফিতরাতের উপর সৃষ্টি হয় যে, যদি এভাবে থাকতে পারে এবং অন্য কোনো বহিঃনিয়ামক তাকে বিচ্যুত না করে তবে সত্য পথকে অতিক্রম করবে। কোনো ব্যক্তিই পাপী, খারাপ বা অসৎ চিন্তার অধিকারী হয়ে মাতৃগর্ভ থেকে জন্মগ্রহণ করে না। বরং অপছন্দীয় বিষয়গুলো উপজাতরূপে বাহ্যিক ও ইচ্ছাধীন নিয়ামকসমূহের ফলশ্রুতি।

উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত কুৎসিৎ মন-মানসিকতা এরূপ নয় যে, মানুষের প্রত্যয় ও সংকল্পের ছত্রছায়ায়ও অপরিবর্তিত থাকে। অতএব, ‘পাপ চিন্তা আদম সন্তানের সত্তাগত বিষয়’ খ্রিষ্টবাদের এ দাবি ভিত্তিহীন। পবিত্র কোরআনে এ সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে যে,- ডান-বামে কোনো প্রকার বিচ্যুতি ব্যতিরকে) সে ঐশী দ্বীনের দিকে মুখ ফিরাও যার ভিত্তিতে মহান আল্লাহ মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। (সূরা রূমঃ ৩০)

মহানবী (সা.)বলেনঃ এমন কেউ জন্মগ্রহণ করেনি যে,পবিত্র ফেতরাতের (তৌহিদ ও একত্ববাদের) উপর জগতে আসেনি। তৌহিদে সাদুকঃ পৃঃ ৩৩১)

মানুষ এক স্বাধীন ও যাচাই মতাসম্পন্ন অস্তিত্ব। অর্থাৎ বুদ্ধিবৃত্তিক শক্তির মাধ্যমে সে বিভিন্ন কর্মকে বিচার বিশ্লেষণ করে গ্রহণ ও বর্জন করতে পারে। পবিত্র কোরআনের ভাষায়ঃ “আমরা তাকে পথ প্রদর্শন করেছি (এখন সে ইচ্ছে করলে) কৃতজ্ঞ হতে পারে কিংবা অস্বীকার করতে পারে।” (ইনসানঃ৩)

অনুরূপ “বল সত্য তোমাদের প্রভু থেকে অবতীর্ণ হয়েছে, অতএব যদি কেউ চায় ঈমান আনতে পারে অথবা অস্বীকার করতে পারে। ”(সূরা কাহাফঃ ২৯)।”

যেহেতু মানুষ নির্ভেজাল ফিতরাত ও ধী-শক্তির অধিকারী, সেহেতু সে ভালকে মন্দ থেকে পৃথক করতে পারে। অনুরূপ সে স্বাধীন ও নির্বাচন ক্ষমতার অধিকারী। ফলে সে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে। আর উৎকর্ষ ও বিকাশ এবং মহান প্রভুর প্রত্যাবর্তনের পথ সর্বদা তার জন্যে উন্মুক্ত। তবে তা ঐ সময় পর্যন্ত যখন আর তওবাহ গ্রহণযোগ্য নয় (মৃত্যুর সময়)। এ দৃষ্টিকোণ থেকে, নবীগণের (আ.) আহবান সমস্ত মানুষের জন্য উদাত্ত ছিল, এমনকি ফেরাউনের মতো ব্যক্তির জন্যও। যেমন পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হয়। “হে মুসা! ফেরাউনকে বল, ওহে পবিত্র হতে চাও কি? এবং তোমাকে তোমার প্রভুর দিকে পথ নির্দেশনা দেবো, যাতে ভয় কর।” (সূরা নাযিয়াতঃ ১৮-১৯)

সুতরাং মানুষকে কখনোই আল্লাহর রহমত ও অনুগ্রহ থেকে নিরাশ হওয়া উচিৎ নয়। যেমন, পবিত্র কোরাআনে মহান আল্লাহ বলেনঃ “আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না, (কারণ) তিনি সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেবেন।”(সূরা যুমারঃ ৫৩)

যেহেতু মানুষ বুদ্ধিবৃত্তির আলোয় উদ্ভাসিত ও নির্বাচন ক্ষমতার মতো অনুগ্রহের অধিকারী সেহেতু সে দায়িত্বশীল ও কর্তব্যপরায়ণ অস্তিত্বরূপে পরিগণিত। খোদার নবী ও ঐশী পথ প্রদর্শকগণের সম্মুখে তার কিছু কর্তব্য রয়েছে। অনুরূপ তার দায়িত্ব রয়েছে। স্বীয় মূল্যবান মনুষ্যত্বের সম্মুখে এবং অন্যান্য মানুষ ও বিশ্বের মোকাবিলায়। পবিত্র কোরআনের একাধিক আয়াতে মানুষের এ দায়িত্ব সম্পর্কে সুস্পষ্টরূপে বর্ণিত হয়েছে। যেমনঃ প্রতিশ্রুতি রক্ষা কর। যা সম্পর্কে প্রশ্নের সম্মুখীন হবে। সূরা ইসরা-৩৪)

“নিশ্চয় কর্ণ চুক্ষু ও মন সম্পর্কে প্রশ্ন করা হবে।” (সূরা ইসরাঃ ৩৬)

“মানুষ কি মনে করে তাদেরকে নিজের উপর ছেড়ে দেয়া হয়েছে?” (সূরা কিয়ামতঃ ৩৬)

মহানবী (সা.) বলেনঃ তোমাদের প্রত্যেকেই দায়িত্বপ্রাপ্ত এবং প্রত্যেকের নিকট তার দায়িত্ব সম্পর্কে প্রশ্ন করা হবে।

কেবল আধ্যাত্মিক পূর্ণতার দৃষ্টিকোণ ব্যতীত কোনো মানুষেরই অন্য কোনো মানুষের উপর কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই। শ্রেষ্ঠত্বের সুস্পষ্ট মানদন্ড হলো, জীবনের সর্বস্তরের তাকওয়া ও সৎকর্মপরায়ণ হওয়া। পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হয়েছেঃ

“হে মানব! আমরা তোমাদেরকে একজন নর এবং একজন নারী থেকে সৃষ্টি করেছি অতঃপর তোমাদেরকে বিভিন্ন শ্রেণী ও গোত্রে স্থান দিয়েছি যাতে পরস্পর পরস্পরকে জানতে পার। তোমাদের মধ্যে সেই মহান আল্লাহর নিকট সর্বাধিক সম্মানিত যে সর্বাধিক সংযমী। (সূরা হুজুরাতঃ১৩)

অতএব, বংশ ও ভৌগলিক অবস্থানের মতো বৈশিষ্ট্যগুলো ইসলামের দৃষ্টিতে শ্রেষ্ঠত্ব ও গৌরবের ভিত্তি হতে পারে না।

চারিত্রিক মূল্যবোধসমূহ যেগুলো প্রকৃতপক্ষে মনুষ্যত্বের ভিত্তিগুলো যাদের মূল শিকড় ফিতরাতে প্রোথিত, সেগুলো সর্বদা স্থির ও চিরন্তন। এ মূল্যবোধসমূহ সময় ও সামাজিক অবস্থার পরিবর্তনে পরিবর্তিত হয় না। যেমন প্রতিশ্রুতি রক্ষা করার মাধূর্য, কিংবা উত্তমের জবাব উত্তমরূপে প্রদান ইত্যাদি বিষয়গুলো হলো চিরন্তন; সর্বদা ছিল এবং থাকবে। এ চারিত্রিক মূল্যবোধসমূহ কখনোই পরিবর্তন হয় না। অনুরূপ, প্রতারণা ও প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ মন্দ ও নিন্দনীয় বলে বিবেচিত হয়। অতএব, বুদ্ধিবৃত্তিক দৃষ্টিকোণ থেকে মানুষের সামাজিক জীবনে এক শ্রেণীর মূল্যবোধ বিদ্যমান, যা মানব প্রকৃতিতে লুক্কায়িত এবং নির্দিষ্ট ও ধ্রুব।

হ্যাঁ, এ চারিত্রিক মূল্যবোধগুলোর পাশাপাশি এক শ্রেণীর রীতি এবং প্রথাও পরিলক্ষিত হয়, যেগুলো স্থান ও কালের পরিবর্তনে প্রভাবিত ও ইচ্ছামত পরিবর্তন হয়। এ বিষয়গুলো চারিত্রিক ভিত্তিমূলের সাথে সম্পর্কিত নয়।

পবিত্র কোরআন এ ধরনেরই কিছু বুদ্ধিবৃত্তিক ও চারিত্রিক ধ্রুব মূলনীতির কথা উল্লেখ করেছে।

যেমনঃ “উৎকৃষ্টের পুরস্কার উৎকৃষ্ট ব্যতীত কিছু হতে পারি কি? (সূরা আর-রহমান-৬০)

“সৎকর্মশীলদের কোনো প্রকার ভর্ৎসনা করা হবে না।” (সূরা তাওবা: ৯১)

“আল্লাহ সৎকর্মশীলদের পুরস্কার থেকে বঞ্চিত করেন না।” (সূরা ইউসূফ-৯০)

“মহান আল্লাহ ন্যায়পরায়ণতা, সৎকর্ম এবং আত্মীয়-স্বজনদের করার নির্দেশ দেন; আর কুকর্ম ও অশ্লীলতা পরিহার করতে বলেন।”(সূরা নাহল-৯০)

মানুষের কর্মফল অন্য জগতে বিদ্যমান। তথাপি এ জগতও এর ভাল-মন্দ প্রভাব থেকে মুক্ত আর এটি সেই সত্য যা ওহীর মাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে। তাছাড়া মানুষের জ্ঞানও একটা নির্দিষ্টি সীমা পর্যন্ত। পবিত্র কোরআনে এ সম্পর্কিত অনেক আয়াত রয়েছে। এগুলোর মধ্যে দু’টো এখানে আমরা উল্লেখ করব। যেমনঃ “যদি জনপদসমূহের মানুষ ঈমান আনতো এবং সংযমী হতো আসমান ও জমিনের বরকতের দ্বারসমূহ তাদের জন্য উন্মুক্ত করে দিতাম; কিন্তু তারা (আল্লাহর নিদর্শনসমূহকে) অস্বীকার করল। অতঃপর আমরাও তাদেরকে তাদের কর্মফল স্বরূপ শাস্তি দিয়েছি।” সূরা আ’রাফ-৯৬)

হযরত নূহ (আ.) তাঁর উম্মতকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে, পাপ মুক্ত হওয়া আর প্রভুর রহমতের দ্বারসমূহ উন্মুক্ত হওয়া ও আল্লাহপ্রদত্ত নেয়ামত বৃদ্ধি পাওয়ার মধ্যে সম্পর্ক বিদ্যমান। যেমনঃ (আমরা গোত্রকে) বললাম, আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রর্থনা কর, তিনি পাপসমূহ ক্ষমাকারী। এমতাবস্থায় তোমাদের জন্য আকাশ থেকে প্রচুর বারি বর্ষণ করবেন। সম্পদ সন্তান দিয়ে তোমাদেরকে সহায্য করবেন। আর তোমাদের জন্যে উদ্যান ও ঝরনাধারা সমূহ সৃষ্টি করবেন। (সূরা নূহ: ১০-১২)

কোনো জাতির অগ্রগতি বা পশ্চাদপদতার উৎস হিসেবে বাহ্যিক কারণগুলোর কথা বাদ দিলে তা মূলত তাদের বিশ্বাস, আচরণ ও চারিত্রিক বিষয়ের মূলে নিহিত। ঐশরিক ক্বাজা ও ক্বাদরের সাথে এ মুল নীতিটির কোনো বিরোধ নেই। কারণ, এ নিয়মটি সামগ্রিকভাবে স্বয়ং প্রভু কর্তৃক নির্ধারিত তাক্দীরের বহিঃপ্রকাশ। অর্থাৎ প্রভুর সামগ্রিক ইচ্ছা তাতে সংশ্লিষ্ট হয় যে, জাতিসমূহ তাদের বিশ্বাস ও আচার-আচরণের মাধ্যমে তাদের ভাগ্য পরিবর্তন করবে। যেমনঃ যে সমাজ ন্যায়পরায়ণতা ও সুবিচারের ভিত্তিতে তাদের সামাজিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করবে, সে সমাজ সুন্দর ও আরামদায়ক জীবনের অধিকারী হবে। আর যে জাতি এর ব্যতিক্রম কোনো সামাজিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করবে, সে জাতির ভবিষ্যত হবে এক নিদারুণ হতাশাব্যঞ্জক। আর এটা সেই নীতি যা কোরআনের পরিভাষায় সুন্নাতে এলাহী নামকরণ করা হয়েছে। যেমনটি পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হয়েছে,“যখন ভয় প্রদর্শনকারী তাদের নিকট উপস্থিত হল, তখন তাঁর নিকট পলায়ন করা ব্যতীত তাদের আর কোনো লাভ হলো না, পৃথিবীতে অহংকার ও ঘৃণা প্রতারণার কারণে। (জেনে রাখ) ঘৃণা, প্রতারণা প্রতারণাকারী ব্যতীত কাউকে আক্রান্ত করে না। তবে কি তারা তাদের পূর্বপুরুষদের মধ্যে প্রচলিত রীতিনীতি ভিন্ন অন্য কোনো রীতির জন্য অপো করেছে? আল্লাহর নিয়মে কোনো পরিবর্তন ও রদবদল দেখতে পাবে না।” (সূরা ফাতিরঃ ৪৩) অনুরূপ “তোমরা উৎকৃষ্ট যদি তোমরা ঈমান আন...এ দিনগুলো (জয়-পরাজয়) মানুষের মধ্যে পর্যায়ক্রমে আবর্তন করবে।”(সূরা আলে ইমরানঃ১৩৯-১৪০)

মানব ইতিহাসে ভবিষ্যত উজ্জ্বল। যদিও মানবজীবন সাধারণত অসমতা ও সংকট সমস্যসঙ্কুল, তবু এ অবস্থার অবশেষে যবর্নিকাপাত ঘটবে এবং মানব ইতিহাস এমন এক উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দিকে অগ্রসর হচ্ছে, যেখানে ন্যায়পরায়ণতা মুখ্য ভূমিকা পালন করবে। কোরআনের ভাষায় পুণ্যবানগণ পৃথিবীর শাসনভার গ্রহণ করবেন। কোরআন বলে:“ আমরা যিকরের (সম্ভবত তৌরাতকে বুঝানো হয়েছে) পর যাবুরে লিখেছিলাম যে, পুণ্যবানগণ পৃথিবীর শাসক হবেন।” (সূরা আম্বিয়া-১০৫)

অনুরূপ “তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান এনেছে এবং সৎকর্ম সম্পাদন করে, তাদেরকে মহান আল্লাহ এ প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে, পৃথিবীতে তাদেরকে খেলাফত প্রদান করবেন। যেমন করে পূর্ববর্তীদেরকে খেলাফত দিয়েছিলেন।”(সূরা নূর-৫৫)

অতএব, ভবিষ্যতের ইতিহাসে, সত্য-মিথ্যার অবিরাম সংঘর্ষের আবর্তে চুড়ান্ত বিজয় হবে সত্যের, যদিও তা সুদূর পরাহত হয়ে থাকে।”

পবিত্র কোরআনের ভাষায় “সত্য দ্বারা মিথ্যাকে আঘাত করব যাতে তাকে ধ্বংস করে দেয়, অতঃপর অকস্মাৎ তা বিনাশিত হয়।”(সূরা আম্বিয়া-১৮)

কোরআনের দৃষ্টিকোণ থেকে মানুষ এমন এক বিশেষ মর্যাদার অধিকারী যার ফলে সে ফেরেস্তাদের সিজদা লাভের যোগ্য হয়েছে। যেমনটি পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হয়েছেঃ “আদম সন্তানকে মর্যাদা প্রাদন করেছি তাদেরকে জলে-স্থলে বাসস্থান দিয়েছি এবং পবিত্র রুজি দিয়েছি; আর স্বীয় সৃষ্টির অধিকাংশের উপর তাকে শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছি।” (সূরা ইসরা-৭০)

যেহেতু মানুষের জীবনের ভিত্তি হলো মর্যাদা ও সম্মান রক্ষা করার মধ্যে, সেহেতু এ দৃষ্টিকোণ থেকে যে সকল কষ্ট এ ঐশী অনুগ্রহকে অসার করে, ইসলামের মতে তা নিষিদ্ধ। সুস্পষ্টরূপে আমরা বলতে পারি; যে কোনো প্রকার অনাকাঙ্খিত ও ঘৃণ্য মতা প্রদর্শন কিংবা এ ধরনের ক্ষমতার নিকট নত হওয়া সম্পূর্ণরূপে অগ্রহনযোগ্য।

আমিরুল মু’মিনীন হযরত আলী (আ.) বলেনঃ ‘অন্য কারো দাসত্ব স্বীকার করো না, যখন আল্লাহ তোমাকে স্বাধীন করে সৃষ্টি করেছেন।’ অনুরূপ বলেনঃ মহান আল্লাহ মু’মিনীনের সকল কর্ম তার উপর ন্যাস্ত করেছেন (এবং তাকে কর্ম সম্পাদন করা বা ত্যাগ করার ক্ষেত্রে স্বাধীনতা দিয়েছেন) কেবল নিজেকে হীন প্রতিপন্ন করা ব্যতীত।

স্পষ্টতঃই আল্লাহ কর্তৃক অনুমোদিত শাসন ব্যবস্থার সাথে প্রাগুক্ত নিয়মের কোনো বিরোধ নেই। এ ব্যাপারে বিস্তারিত ব্যাখ্যা পরবর্তীতে প্রদান করা হবে।

ইসলামের দৃষ্টিকোণ থেকে মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিক জীবনের এক বিশেষ মর্যাদা বিদ্যমান। কারণ অন্যান্য প্রাণীর উপর মানুষের শ্রেষ্টত্বের ভিত্তি হলো তার চিন্তাশক্তি ও বুদ্ধিবৃত্তি। আর এ কারণেই পবিত্র কোরআনের বিভিন্ন আয়াতে মানুষকে চিন্তা ও বুদ্ধিবৃত্তির প্রতি আহবান করা হয়েছে। যেখানে চিন্তা ও বুদ্ধিবৃত্তির লালন সৃষ্টিকুলে জ্ঞানীজনের বিশেষত্ব গণনা করা হয়েছে। যেমনঃ “তারা হলো এমন কেউ যারা আল্লাহকে স্মরণ করে দাঁড়ানো অবস্থায়। তারা আকাশ ও পৃথিবীর সৃষ্টি সম্পর্কে চিন্তা করে এবং বলে প্রভু হে! এ পৃথিবীকে তুমি অনর্থক সৃষ্টি করনি। (সৃষ্টি সম্পর্কে চিন্তা করার আবশ্যকতা বিষয়ে একাধিক আয়াত বিদ্যমান।”(সূরা আল-ইমরান-১৯১)

এ দৃষ্টিকোণ থেকেই কোরআন মানুষকে নির্বিচারে পূর্ব পুরুষদের অন্ধ অনুকরণ করতে নিষেধ করে।

ইসলামে ব্যক্তিগত পরিমন্ডলে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও অন্যান্য স্বাধীনতা, আধ্যাত্মিকতা উৎকর্ষের সাথে বিরোধ না থাকা এবং সামাজিক কল্যাণকে ব্যাহত না করার শর্তাধীন। প্রকৃতপক্ষে ইসলামে তাকলিফের (আদেশ-নিষেধ) দর্শন হলো, মানুষকে দায়িত্ব প্রদান করে তার সত্তাগত মর্যাদা রা করা এবং সামাজিক কল্যাণের নিশ্চয়তা বিধান করা। মূর্তিপূজা ও মদপানের মতো অপকর্মের বিরুদ্ধে ইসলামের রুখে দাঁড়ানোর কারণ হলো মানবীয় মর্যাদা ও সম্মান রক্ষা করার জন্যেই। আর এখানেই ইসলামী বিধানে শাস্তির দর্শন সুস্পষ্টরূপে প্রতীয়মান হয়।

পবিত্র কোরআনে কেসাসের বিধান মানুষের জীবন দায়ক বলে মনে করা হয়েছেঃ “হে জ্ঞানীগণ, কেসাস তোমাদের জীবন রক্ষাকারী (বিধান)।” (সূরা বাকারাঃ১৭৯)

মহানবী (সা.) বলেনঃ “যখন কোনো ব্যক্তি গোপনে কোনো পাপাচারে লিপ্ত হয়, সে কেবল নিজেরই ক্ষতি করে। কিন্তু যদি প্রকাশ্যে গুনাহে লিপ্ত হয় এবং কোনো প্রকার বাধার সম্মুখীন না হয় তবে সে সমাজের ক্ষতি করে।

ইমাম সাদিক (আ.)হাদীস বর্ণনা করার পর বলেনঃ‘এ হুকুমের কারণ হলো এই যে, কোনো ব্যক্তি প্রকাশ্যে পাপাচারে লিপ্ত হয় এবং স্বীয় আচরণের মাধ্যমে আল্লাহর বিধান লঙ্ঘন করে; আর আল্লাহর শত্রুরা তাকে অনুসরণ করে।’

ইসলামের ব্যক্তি স্বাধীনতার একটি সুস্পষ্ট উদাহরণ হলো যে, দ্বীন গ্রহণ করার ব্যাপারে কোনো প্রকার বাধ্যবাধকতা নেই। যেমনঃ “দ্বীন গ্রহণ করার ব্যাপারে কোনো প্রকার বাধ্যবাধকতা নেই; সঠিক পথ,মিথ্যা থেকে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে।”(সূরা বাকারা-২৫৬)

কারণ,ইসলামে গ্রহণযোগ্য দ্বীন হলো, ঈমান ও আন্তরিক বিশ্বাস। আর তা এমন নয় যে, জোর জবরদস্তির মাধ্যমে মানুষের অন্তরে স্থান দেয়া যায়। বরং, কিছু ভূমিকার অবতারণার উপর তা নির্ভর করে। এই ভুমিকাগুলোর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হলো, মিথ্যা থেকে সত্যের পৃথকীকরণ। যখন এ ধরনের পরিচিতি মানুষের জন্য অর্জিত হবে, স্বাভাবিকভাবেই মানুষ সত্যকে বেছে নেবে। এটা সত্য যে, ‘জিহাদ’ হলো ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ ফরজ। কিন্তু, তার অর্থ এ নয় যে, ইসলাম গ্রহণে অপরকে বাধ্য করা। বরং এর অর্থ, আল্লাহর বাণী বিশ্বাসের নিকট পৌছে দেয়ার পথে সকল বাধার অপসারণ যাতে “তাবাইয়্যানার রোশদ” (সত্য সুস্পষ্ট হওয়া) এর বাস্তবায়ন হয়। যেমনটি অর্থ ক্ষমতার ব্যবসায়ীরা স্বীয় বস্তুবাদী ও শয়তানী কামনা চরিতার্থ করার জন্যে মুক্তির বাণী বিশ্বাসীর কানে পৌছে দেয়ার পথে বাধা সৃষ্টি করে স্বাভাবিক ভাবেই নবুওয়াতের দর্শনের (অর্থাৎ বাণী প্রচার ও মানবতার পথ পদর্শন) দাবি হলো, এ পথ থেকে সকল প্রকার বাধা- বিপত্তিকে অপসারণ করবে যাতে বিশ্ব মানবতার নিকট সত্য বাণী পৌছে দেয়ার জন্যে উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি হয়। উপরোক্ত আলোচনা থেকে মানুষ ও বিশ্ব সম্পর্কে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি ফুটে উঠে।