সিরিয়ায় ওয়াহাবি তাণ্ডব : মাজার ভেঙে সাহাবীর অক্ষত লাশ চুরি

আল হোসাইন (আ.)সিরিয়ার উগ্র ওয়াহাবিরা রাজধানী দামেস্কের কাছে বিশ্বনবী (সা.)’র সাহাবী ও আমিরুল মু’মিনিন হযরত আলী (আ.)’র অন্যতম সেনাপতি শহীদ হুজর ইবনে আদি আল কিন্দি (রা.)-র মাজার ভেঙে দিয়েছে এবং কবর খুঁড়ে তাঁর অক্ষত ও রক্তমাখা লাশ অন্যত্র সরিয়ে নিয়েছে।
 
কথিত ফ্রি সিরিয়ান আর্মি বা সিরিয়ার সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠীর আদরাল বালাদ অঞ্চলের সমন্বয় ইউনিট ফেসবুকে এ সংক্রান্ত সচিত্র সংবাদ প্রকাশ করে লিখেছে, “ফ্রি সিরিয়ান আর্মির বীর সেনারা দামেস্কের উপকণ্ঠে অবস্থিত ‘হুজর ইবনে আদি’র মাজারের কবর খুঁড়ে তার লাশ অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে আবার দাফন করেছে যাতে এই মাজার আল্লাহর শানে শির্ককারীদের কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হতে না পারে।”
 
লেবাননের ইসরাইল-বিরোধী জনপ্রিয় ইসলামি প্রতিরোধ আন্দোলন হিজবুল্লাহর নেতা সাইয়্যেদ হাসান নাসরুল্লাহ সিরিয়ায় মুসলমানদের পবিত্র স্থানগুলোর অবমাননার বিরুদ্ধে সম্প্রতি কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছিলেন। দখলদার ইহুদিবাদী ইসরাইলের বিরুদ্ধে কিংবদন্তীতুল্য কয়েকটি সফল প্রতিরোধ যুদ্ধের রূপকার সাইয়্যেদ হাসান নাসরুল্লাহ সতর্ক করে দিয়ে বলেছিলেন, সিরিয়ায় হযরত ইমাম হুসাইন (আ.)’র বোন হযরত জয়নাব (সা.)’র পবিত্র মাজার হতে মাত্র কয়েকশ' মিটার দূরে অবস্থান করছে কয়েকটি ধর্মান্ধ সন্ত্রাসী গ্রুপ। আল-কায়েদার সমর্থিত ওয়াহাবি ও তাকফিরি (যারা কথায় কথায় ওয়াহাবি নয় এমন সব মুসলমানদেরকে কাফির বলতে অভ্যস্ত) গ্রুপগুলো হযরত জয়নাব (সা.)’র পবিত্র মাজার গুড়িয়ে দেয়ার হুমকি দিয়ে আসছে।
 
এর আগে সাম্প্রতিক সময়ে ওয়াহাবিরা সিরিয়ায় অবস্থিত বিশ্বনবী (সা.)'র খ্যাতনামা সাহাবী হযরত আম্মার ইবনে ইয়াসির (রা.)'র পবিত্র মাজারে হামলা চালিয়েছিল এবং তারা সিরিয়ায় হযরত ইমাম হুসাইন (আ.)'র কন্যা হযরত সকিনা (সালামুল্লাহ আলাইহা)'র পবিত্র মাজারেও মর্টারের গোলা বর্ষণ করে এই মাজারের ক্ষতি সাধন ও অবমাননা করেছে।
 
হুজর ইবনে আদি (রা.) ও তাঁর ভাই হানি ইবনে আদি তরুণ বয়সে বিশ্বনবী (সা.)’র কাছে হাজির হয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। বিশ্বনবী (সা.) এরপর অল্প কিছুকাল বেঁচেছিলেন।
 
হুজর ইবনে আদি (রা.) ছিলেন আমিরুল মু’মিনিন হযরত আলী (আ.)’র ঘনিষ্ঠ সঙ্গী এবং তিনি জামাল, নাহরাওয়ান ও সিফফিনের যুদ্ধে হযরত আলী (আ.)’র পক্ষে লড়াই করেছিলেন। তাঁর বীরত্বপূর্ণ লড়াই ও নেতৃত্ব এসব যুদ্ধ জয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল বলে ইতিহাসে উল্লেখ করা হয়।
 
হযরত আলী (আ.)’র খেলাফতের জামানার আগে তিনি কাদেসিয়ার যুদ্ধ এবং সিরিয়া ও মাদায়েন বিজয়ে বীরত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিলেন। তিনি সিরিয়ার মারজুল উজরা বা আদরাল বালাদ (যেখানে তাঁর মাজার সম্প্রতি ধ্বংস করল ওয়াহাবিরা) জয় করেছিলেন। মুসলিম বাহিনীর মাদায়েন বিজয়ের অভিযানে তিনি অলৌকিকভাবে দজলা নদী পার হয়েছিলেন। হযরত আলী (আ.) তাঁর এই মহান সেনাপতির শাহাদতের সুসংবাদ দিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, "হে কুফাবাসী! তোমাদের শ্রেষ্ঠ সাত ব্যক্তিকে হত্যা করা হবে 'আজরা' এলাকায়। তাদের অবস্থা হবে 'আসহাবুল আখদুদ'-এর মত (তথা পবিত্র কুরআনে উল্লেখিত সুরা বুরুজ-এর শহীদানদের মত)।"
 
৬৬০ সালে উমাইয়া শাসক মুয়াবিয়ার নির্দেশে বিদ্রোহের শাস্তি হিসেবে এক প্রহসনের বিচারে হুজরকে তাঁর পুত্র ও কয়েকজন সঙ্গীসহ শহীদ করা হয়।
বিশ্বনবী (সা.)’র স্ত্রী হযরত আয়েশা হুজর (রা.)-কে হত্যার জন্য মুয়াবিয়াকে তিরস্কার করেছিলেন। তিনি বিশ্বনবী (সা.)’র এই হাদিস মুয়াবিয়াকে স্মরণ করিয়ে দেন যে,  “মারজুল উজরায় এমন একদল ব্যক্তিকে হত্যা করা হবে যে হত্যাকাণ্ডের জন্য আকাশের ফেরেশতারা ক্ষুব্ধ হবে।”
 
মুয়াবিয়া সাফাই দিতে গিয়ে বলেছেন, দুঃখজনকভাবে কোনো বুদ্ধিমান ব্যক্তি আমার কাছে না থাকায় আমাকে হুজর হত্যাকাণ্ড থেকে কেউ বিরত রাখতে পারেনি।
 
বলা হয়- হযরত আয়েশা এক ব্যক্তিকে মুয়াবিয়ার কাছে পাঠিয়েছিলেন হুজর হত্যা ঠেকানোর জন্য। কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে গিয়েছিল। হযরত আয়েশা মুয়াবিয়াকে স্মরণ করিয়ে দেন যে,  রাসূল (সা.) বলেছেন, আমার পরে সাত ব্যক্তিকে হত্যা করা হবে, এদের হত্যাকাণ্ডে আল্লাহ ও আসমানের অধিবাসীরা ক্ষুব্ধ হবেন।   
 
হুজর (রা.) সব সময় ওজু অবস্থায় থাকতেন এবং ওজু ভেঙে গেলে আবার ওজু করতেন। ওজু করার পরই বেশ সময় নিয়ে দু'রাকাত নফল নামাজ আদায় করতেন। শাহাদাতের আগ মুহূর্তেও তিনি দু'রাকাত  নফল নামাজ আদায় করেন। তিনি মৃত্যুর ভয়ে ওই নামাজ লম্বা করেছেন বলে অভিযোগ করা হলে জবাবে বলেন, এই নামাজই ছিল তাঁর জীবনের সবচেয়ে সংক্ষিপ্ত নামাজ। শাহাদাতের সময় তাঁর শরীর ছিল শেকল দিয়ে বাধা এবং ডান্ডাবেড়ি পরানো। তিনি এসব শেকল ও ডান্ডাবেড়ি তাঁর মৃত্যুর পরও লাশ থেকে না খোলার ওসিয়ত করে যান এবং বলেছিলেন, এই অবস্থাতেই আমি কিয়ামতের দিন মুয়াবিয়ার বিরুদ্ধে আল্লাহর দরবারে নালিশ জানাব। খোদাভীতি ও পরহিজগারীর জন্য হুজর (রা.)-কে 'হুজরুল খাইর' বা নেককার হুজর বলা হত এবং তিনি মুস্তজাবুদদোয়া (যার দোয়া কবুল করা হয়) হিসেবেও খ্যাত ছিলেন।
 
বলা হয়- মৃত্যুর সময় মুয়াবিয়া তীব্র ব্যথা ও দীর্ঘ যন্ত্রণায় কাতর হয়ে বলেছিল: হে হুজর! আমার এ যন্ত্রণা তোমার জন্যই দীর্ঘ হচ্ছে।