সূরা নিসা - প্রথম পর্ব

সূরা নিসায় মোট ১৭৬ টি আয়াত রয়েছে। এ আয়াতগুলো মদীনায় নাজিল হয়েছিল। এই সূরার অধিকাংশ আয়াতে পরিবারে মহিলাদের অধিকার এবং পারিবারিক বিষয়ে বক্তব্য থকায় এর নাম হয়েছে সূরা নিসা।
সূরা নিসার এক নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-"হে মানুষ! তোমরা তোমাদের প্রতিপালককে ভয় কর। যিনি তোমাদের একই ব্যক্তি হতে সৃষ্টি করেছেন এবং তা থেকে তার সহধর্মিনী সৃষ্টি করেছেন। যিনি তাদের দু'জন থেকে পৃথিবীতে বহু নর-নারী বিস্তার করেছেন। সেই আল্লাহকে ভয় কর,যার নামে তোমরা একে অপরের কাছে আবেদন কর। আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করাকে ভয় কর, নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের ওপর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখেন।"
সূরা নিসার প্রথম আয়াতেই দু'দু'বার খোদাভীরু হবার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। প্রত্যেক ব্যক্তির জন্ম প্রাথমিক শিক্ষা পরিবারেই হয়ে থাকে। তাই পরিবারের এই সব ভিত্তি যদি আল্লাহর আইন অনুযায়ী না হয়,তাহলে ব্যক্তি ও সমাজের মানসিক সুস্থতা বলতে কিছুই থাকবে না। আল্লাহ মানুষের মধ্যে নিজেকেই বড় ভাবার যে কোন ইচ্ছা বা ঝোঁক প্রবণতাকে প্রত্যাখ্যান করে বলছেন,সমস্ত মানুষকে একই ব্যক্তি হতে সৃষ্টি করা হয়েছে। তাই বংশ,বর্ণ ও ভাষাকে শ্রেষ্ঠত্বের লক্ষণ মনে না করে বরং খোদাভীরু হওয়াকে শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি মনে করা উচিত। এমনকি নারী ও পুরুষের মধ্যে মানসিক এবং দৈহিক পার্থক্য সত্ত্বেও তাদের কেউই একে অপরের চেয়ে বড় নয়। কারণ সমস্ত নারী ও পুরুষ একজন পুরুষ এবং নারী থেকে অস্তিত্ব লাভ করেছে। পবিত্র কোরআনের অন্য এক আয়াতে আল্লাহর আনুগত্যের পরই বাবা-মায়ের প্রতি আনুগত্যের কথা বলা হয়েছে। এভাবে তাদের উচ্চ মর্যাদার বিষয়টি স্পষ্ট করা হয়েছে। আর এই আয়াতে আল্লাহর নামের পর সমস্ত আত্মীয় স্বজনদের অধিকার রক্ষার আহবান জানানো হয়েছে এবং তাদের প্রতি যাতে কোন রকম অবিচার করা না হয় সে দিকেও সজাগ দৃষ্টি রাখতে বলা হয়েছে।
এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো,
প্রথমত : ইসলাম একটি সামাজিক ধর্ম। তাই এ ধর্মে সমাজ ও পরিবারে পরস্পরের সম্পর্কের প্রতি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। খোদাভীরু হবার জন্যে এবং আল্লাহর ইবাদত তথা দাসত্ব করার জন্যে অন্যদের অধিকার রক্ষা জরুরী।
দ্বিতীয়ত : মানব সমাজকে অবশ্যই ঐক্যবদ্ধ হতে হবে এবং প্রত্যেক মানুষকেই মানব সমাজের সম্মানিত সদস্য হিসেবে ধরে নিয়ে অন্যদের সমান অধিকার দিতে হবে। কারণ,মানুষের মধ্যে অঞ্চল,বর্ণ,গোষ্ঠী ও ভাষার ভিত্তিতে বৈষম্য করা নিষিদ্ধ। আল্লাহ প্রত্যেক মানুষকেই একই উপাদান থেকে সৃষ্টি করেছেন।
তৃতীয়ত : গোটা মানব জাতি একে অপরের আত্মীয়। কারণ,তাদের সবার আদি পিতা ও মাতা ছিলেন হযরত আদম (আঃ) এবং বিবি হাওয়া। তাই সব মানুষকেই ভালবাসতে হবে এবং তাদেরকে ঘনিষ্ঠ আত্মীয় স্বজনের মতই শ্রদ্ধা করতে হবে।
এবারে সূরা নিসার দুই নম্বর আয়াত নিয়ে আলোচনা করবো। এই আয়াতে বলা হয়েছে-"এতিমদের প্রাপ্য সম্পদ তাদেরকে দাও,নিজেদের খারাপ সম্পদ এতিমদের দিয়ে এতিমদের ভালো সম্পদ কেড়ে নিও না। তাদের সম্পদ তোমাদের সম্পদের সাথে মিশিয়ে গ্রাস করো না। নিশ্চয়ই এটা মহা পাপ।"
এই আয়াতে এতিমদের সম্পদ আত্মসাৎ করা অথবা ইসলামী উত্তরাধিকার আইন অনুযায়ী এতিমদের যতটুকু সম্পদ পাওনা তার চেয়ে কম দেয়াকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। একই সাথে এতিমদের ভালো সম্পদ নিয়ে এর বিনিময়ে তাদেরকে নিজের কম মূল্যবান সম্পদ দেয়া এবং যে কোন পন্থায় তাদের সম্পদ গ্রাস করাকেও মহাপাপ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কারণ,এতিমের অভিভাবকরা হল তাদের ধন সম্পদের আমানতদার এবং এতিম শিশুরা বড় হলে তাদের সম্পদ বুঝিয়ে দেয়াও এ সব অভিভাবকদের দায়িত্ব। তাই এতিমদের সম্পদকে নিজের সম্পদ মনে করে যাচ্ছে তাই কাজ করা যাবে না।
এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো,
এক. এতিমদের সম্পদ অবশ্যই তাদেরকে দিতে হবে। তারা তাদের সম্পদের কথা না জানলেও অথবা ভুলে গেলেও এটাই অভিভাবকদের কর্তব্য।
দুই. শিশুরাও সম্পদের মালিক হয়। অবশ্য তারা প্রাপ্ত বয়স্ক না হওয়া পর্যন্ত নিজস্ব সম্পদ দখলের অধিকার রাখে না।
তিন. ইসলাম বঞ্চিত ও অভিভাবকহীন ব্যক্তিদের প্রতি গুরুত্ব দেয় এবং তাদের সহায়তা করে।
এবারে সূরা নিসার তিন নম্বর আয়াতের দিকে নজর দিচ্ছি। এ আয়াতে বলা হয়েছে-"যদি তোমরা এতিম কন্যাদের প্রতি সুবিচার করতে পারবে না বলে আশঙ্কা কর,তাহলে তাদেরকে বিয়ে করোনা এবং পবিত্র ও পছন্দনীয় নারীদের মধ্য থেকে দু'জন,তিনজন বা চারজনকে বিয়ে কর। কিন্তু যদি আশঙ্কা কর ন্যায় বিচার করতে পারবে না,তাহলে একটি মাত্র বিয়ে করবে,অথবা তাও যদি না পার ,তবে তোমাদের অধিকারভূক্ত দাসীদেরকে বিয়ে করবে,এতে অবিচার না হবার সম্ভাবনা বেশী। "
এতিম সংক্রান্ত আয়াতের ধারাবাহিকতায় এই আয়াতে এতিম কন্যাদের কথা বলা হয়েছে। এতিম কন্যাদের কথা আলাদাভাবে উল্লেখ করার কারণ হলো তারা এতিম ছেলে শিশুদের তুলনায় বেশী বঞ্চিত ও অত্যাচারের শিকার হয়। তাই ন্যায় বিচারক মহান আল্লাহ বলছেন, এতিম কন্যাদের ওপর যে কোন অন্যায় আচরণ নিষিদ্ধ। অনেক স্বার্থান্বেষী মানুষ এতিম কন্যাদের সম্পত্তি দখলের জন্য তাদেরকে বিয়ে করতে চায় এবং এ জন্যে সব ধরনের কূটকৌশলের আশ্রয় নেয়। কিন্তু আল্লাহ বলছেন,তোমরা এতিম কন্যাদের বিয়ে করার ফলে তাদের প্রতি যদি সামান্য জুলুমেরও আশঙ্কা থাকে,তবে তাদের বিয়ে করো না।
বিভিন্ন সূত্রের বর্ণনায় বলা হয়েছে,এক শ্রেণীর লোভী মানুষ এতিম কন্যাদেরকে লালন পালনের নামে নিজেদের ঘরে নিয়ে আসতো এবং কিছুকাল পর ওইসব কন্যাদেরকে বিয়ে করে তাদের সম্পত্তি দখল করতো। তাদেরকে বিয়ের মোহরানাও প্রচলিত রীতির তুলনায় অত্যন্ত কম দেয়া হতো। এ অবস্থায় এতিম কন্যাদের ওপর যে কোন অবিচারকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে এই আয়াতসহ সূরা নিসার ১২৭ নম্বর আয়াত নাজিল হয়। বহু পুরুষ তাদের দ্বিতীয় বা তৃতীয় অথবা চতুর্থ স্ত্রী হিসেবে এতিম কন্যাদেরকে বিয়ে করতো। আল্লাহ তাদের মর্যাদা রক্ষার জন্য এ সব পুরুষদের উদ্দেশ্যে বলেছেন,যদি নতুন বিয়ের ইচ্ছে থাকে তাহলে কেন শুধু এতিম কন্যাদের দিকে দৃষ্টি দিচ্ছ ? অন্যান্য মেয়েদেরকেও বিয়ের প্রস্তাব দাও অথবা অন্তত তোমাদের অধিকারভুক্ত দাসীদেরকেই বিয়ে কর। এই আয়াতে পুরুষদেরকে চারটি বিয়ের অনুমতি দেয়া হয়েছে,যদিও এই রীতি ইসলামের আবিস্কার নয় বরং সামাজিক কারণে চার বিবাহ কোন কোন অবস্থায় অতীতের মত এ যুগেও অনেক ক্ষেত্রে প্রয়োজন হয়ে দাঁড়ায়। আসলে ইসলাম ধর্ম বহু বিবাহ প্রথা চালু করেনি,বরং সামাজিক বাস্তবতা হিসেবে বিরাজমান এই প্রথাকে বিশেষ নিয়মের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত করেছে। ইসলাম এক্ষেত্রে অর্থাৎ একাধিক বা চার বিবাহের ক্ষেত্রে স্ত্রীদের মধ্যে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার শর্ত বেঁধে দিয়েছে। পবিত্র কোরআনের এই আয়াতে আল্লাহ স্পষ্ট ভাবে বলে দিয়েছেন,"যদি তোমরা স্ত্রীদের সবার সাথে সমান ও ন্যায় আচরণ করতে পারবে না বলে ভয় কর,তাহলে একের বেশী স্ত্রী গ্রহণ করা বৈধ নয়।"
এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো,
এক.এতিম কন্যাদের সম্পদ ও সম্মান নিয়ে হেলাফেলা বন্ধের জন্য তাদের সাথে সব সময় এমনকি বিয়ের সময়ও ন্যায় বিচার করার নির্দেশ দিয়েছে ইসলাম।
দুই.স্বামী ও স্ত্রী নির্বাচনের অন্যতম শর্ত হলো,অন্তর দিয়ে পছন্দ করা পুরুষকে জোরপূর্বক কারো সাথে বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ করা বৈধ নয়।
তিন. একই সাথে চার জন স্ত্রী রাখা ইসলাম ধর্মে স্বীকৃত । কিন্তু কোন কোন পুরুষ যদি এ আইনের অপব্যবহার করে,তাহলে এ আইনটি ভাল নয় এমন বলা যাবে না। বরং এটা সমাজের বিশেষ প্রয়োজন বা চাহিদা মেটানোর প্রতি ইসলাম ধর্মের উদার নীতির প্রকাশ।
(৪-৬ নং আয়াত)
আজ চার থেকে ছয় আয়াতের অনুবাদ ও সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা উপস্থাপন করা হবে। তো প্রথমে চার নং আয়াতের অর্থ জানা যাক। এতে বলা হয়েছে, "তোমরা নারীগণকে তাদের মোহরানা বা একটা নির্দিষ্ট উপহার দিবে। যদি তারা সন্তুষ্টচিত্তে মোহরানার কিছু অংশ ছেড়ে দেয়,তোমরা তা স্বাচ্ছন্দে ভোগ করবে।"
গত পর্বে আমরা বলেছিলাম সূরা নিসার আয়াতগুলো শুরু হয়েছে পারিবারিক বিধি বিধানের বর্ণনা দিয়ে। পরিবার গঠন বা বিয়ের সময় বরের পক্ষ থেকে নববধুকে মোহরানা দেয়ার রীতি সব জাতির মধ্যেই প্রচলিত রয়েছে। দুঃখজনকভাবে কোন কোন জাতির মধ্যে বিশেষ করে ইসলামের আবির্ভাবের আগে আরবদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে মহিলাদের কোন মর্যাদা ছিল না। সে সময় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পুরুষরা স্ত্রীদেরকে মোহরানা দিত না অথবা দিলেও পরে তা জোর করে ফেরত নিত। পবিত্র কোরআন নারীর পারিবারিক অধিকার রক্ষার জন্য স্বেচ্ছায় ও সন্তুষ্টচিত্তে মোহরানা পরিশোধ করতে বিবাহিত পুরুষের প্রতি নির্দেশ দিয়েছে এবং এ ব্যাপারে সব ধরনের কঠোরতা ও কর্কশ আচরণ পরিহার করতে বলেছে। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ এও বলছেন,"মোহরানা ফিরিয়ে নেয়া বা এর অংশবিশেষ ফিরিয়ে নেয়াও তোমাদের জন্য বৈধ নয়। যদি তারা অর্থাৎ স্ত্রীরা নিজেরাই খুশী মনে মোহরানার কিছু অংশ ফিরিয়ে দিতে চায়, তাহলে তা গ্রহণ করা যেতে পারে।" এই আয়াতে উল্লেখিত না হলেও শব্দটির অর্থ হলো,মৌচাকের মৌমাছি। মৌমাছি যেমন কোন স্বার্থের আশা না করেই মানুষকে মধু দেয়,সে রকম পুরুষেরও উচিত জীবনসঙ্গীকে দাম্পত্য জীবনের মধু হিসেবেই মোহরানা দেয়া। আর যা উপহার হিসেবে দেয়া হয়,তা ফিরে পাবার আশা করা কি অন্যায় নয় ?
এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো,
প্রথমত : স্ত্রীর প্রাপ্য মোহরানা তার ক্রয় মূল্য নয়,বরং এটা স্ত্রীর প্রতি স্বামীর ভালবাসার নিদর্শন ও উপহার । কোরআনের আয়াতে 'মোহরানা' শব্দটিকে বলা হয়েছে, যা সাদাক্কাত বা আন্তরিকতা শব্দ থেকে উদ্ভূত।
দ্বিতীয়ত : মোহরানা স্ত্রীর অধিকার এবং স্ত্রী-ই এর মালিক। স্ত্রীকে মোহরানা দেয়া যেমন বন্ধ রাখা যায় না,তেমনি তা ফেরতও নেয়া যায় না।
তৃতীয়ত : মোহরানা মাফ করার জন্য স্ত্রীর বাহ্যিক সন্তুষ্টি যথেষ্ট নয়। এজন্যে স্ত্রীর প্রকৃত বা আন্তরিক সন্তুষ্টি জরুরী।
এবারে সূরা নিসার পঞ্চম আয়াত নিয়ে আলোচনা করবো। এই আয়াতে বলা হয়েছে,"আল্লাহ তোমাদের জন্য যে ধন সম্পত্তি তোমাদের উপজীবিকা করেছেন,তা অবোধ এতিমদের হাতে অর্পণ করো না, তবে তা হতে তাদের জীবিকা নির্বাহ করাও, তাদের পরিধান করাও এবং তাদের সাথে সদ্ভাবে কথা বল।"
এখানে এতিমদের কথা বলা হয়েছে। এতিমরা প্রাপ্ত বয়স্ক না হওয়া পর্যন্ত তাদের কাছে সম্পদ অর্পণ করা যাবে না। বরং ওইসব সম্পদ থেকে অর্জিত আয় দিয়ে তাদের ভরণ পোষণ করতে হবে। এরপর মহান আল্লাহ একটি গুরুত্বপূর্ণ নৈতিক উপদেশ দিয়ে বলেছেন,অবোধ এতিম শিশুদের সাথেও সুন্দর করে কথা বলতে হবে। অর্থাৎ অপ্রাপ্ত বয়স্ক এতিমদের সাথে কর্কশ ভাষায় কথা বলা যাবে না। যদি তাদেরকে তাদের সম্পদ না-ও দাও কিন্তু কথা বার্তা এবং আচরণে তাদের সাথে ভদ্রতা রক্ষা করতে হবে।
এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো,
এক. অর্থ ও সম্পদ সমাজ ব্যবস্থাকে গতিশীল এবং শক্তিশালী করার মাধ্যম । তবে শর্ত হল, অর্থ ও সম্পদ বুদ্ধিমান সৎ এবং ধার্মিক লোকদের অধিকারে রাখতে হবে।
দুই.ইসলামী সমাজের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা অভিজ্ঞ ও সৎলোকদের হাতে থাকা উচিত।
তিন.ইসলামের দৃষ্টিতে দুনিয়ার অর্থ সম্পদ খারাপ কোন কিছু নয়,বরং তা সমাজের অর্থনীতিকে সুদৃঢ় রাখার মাধ্যম,অবশ্য যদি তা অবিবেচক লোকদের হাতে না পড়ে।
এবারে সূরা নিসার ষষ্ঠ আয়াত নিয়ে আলোচনা করবো। এই আয়াতে বলা হয়েছে,"পিতৃহীনদের প্রতি লক্ষ্য রাখবে,তাদের শিক্ষা-দীক্ষা দিবে যতদিন তারা বিয়ের যোগ্য না হয়। কিন্তু তাদের মধ্যে বুদ্ধির পরিপক্ক বিকাশ দেখা গেলে তাদের সম্পদ তাদের কাছে ফিরিয়ে দেবে। তারা প্রাপ্ত বয়স্ক হবে বলে তাড়াতাড়ি তা অপব্যয় করো না ও খেয়ে ফেলোনা এবং যে ধনী সে পারিশ্রমিক নেয়া থেকে বিরত থাকবে। আর যে দরিদ্র,সে এতিমদের ভরণ পোষণের জন্য পারিশ্রমিক নেয়ার অধিকার রাখে। আর যখন তোমরা এতিমদের সম্পত্তি তাদের কাছে ফেরত দেবে,তখন তাদের জন্য সাক্ষী রেখো। হিসাব নেয়ার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট। "
এই আয়াতে এতিমদের সম্পত্তি রক্ষণাবেক্ষণ এবং তাদের কাছে সম্পদ ফেরত দেয়ার পদ্ধতি বর্ণনা করা হয়েছে যাতে সমাজের দুর্বল শ্রেণীর অধিকার রক্ষা পায়। এই পদ্ধতি হলো,
প্রথমত : এতিমরা যথন অর্থ ও সম্পদ রক্ষার মত উপযোগী জ্ঞানের অধিকারী হবে,তখনই তা তাদের কাছে তাদের সম্পদ ফেরত দিতে হবে।
দ্বিতীয়ত : এতিমদের সম্পদ তাদের কাছে ফেরত দেয়ার আগ পর্যন্ত রক্ষা করতে হবে। এতিমরা প্রাপ্ত বয়স্ক হবার আগেই তাদের সম্পদ খরচ করা যাবে না।
তৃতীয়ত : এতিমদের সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ও তাদের ভরণ পোষণের জন্য সেখান থেকে কোন মজুরী নেয়া যাবে না। অবশ্য যদি বয়স্ক বা দরিদ্র হন, তবে কিছু মজুরী নিতে পারেন। এছাড়াও এতিমদের সম্পদ ফেরত দেয়ার সময় সাক্ষী রাখতে হবে যাতে এ নিয়ে কোন মতবিরোধ বা সমস্যা দেখা না দেয়।
এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো,
প্রথমত : সম্পদের অধিকারী হবার জন্য শুধু শারীরিক পূর্ণতাই যথেষ্ট নয়, জ্ঞান বুদ্ধির দিক থেকেও পরিপক্ক হতে হবে। তরুণ ও যুবকরা যদি নিজেদের প্রাপ্য অর্থ সম্পদের অধিকারী হতে চায় তাহলে তাদেরকে অর্থ সম্পদ সম্পর্কে উপযুক্ত জ্ঞান ও বিবেচনা শক্তি অর্জন করতে হবে।
দ্বিতীয়ত : অর্থ ও সম্পদের ব্যাপারে দৃঢ়তা ও বিচক্ষণতা জরুরী। এক্ষেত্রে আল্লাহকেও মনে রাখতে হবে এবং সমাজে নিজের সম্মান রক্ষার জন্য সাক্ষী প্রমাণের ব্যবস্থাও রাখতে হবে।
তৃতীয়ত : স্বচ্ছল ও ধনী ব্যক্তিকে কোন কিছু পাওয়ার আশা না রেখেই সমাজ সেবা করতে হবে। সমাজ সেবার নামে দরিদ্রের সম্পদ থেকে আয় উপার্জনের চিন্তা অন্যায়।
(৭-১০ আয়াত)
সুপ্রিয় পাঠক ! কোরআনের আলোর আজকের পর্বে আমরা সুরা নিসার সপ্তম আয়াত থেকে আলোচনা করবো। এই আয়াতের অর্থ হলো, "বাবা-মা ও আত্মীয় স্বজনের পরিত্যাক্ত সম্পত্তিতে পুরুষের অংশ আছে এবং তাতে নারীরও অংশ আছে, উত্তরাধিকারগত সম্পদ কম বা বেশী যাই হোক না কেন তাতে নারীর অংশ নির্দিষ্ট।"
সুরা নিসার প্রথম কয়েকটি আয়াতে এতিম ও অনাথ শিশুদের প্রসঙ্গ সহ বিভিন্ন পারিবারিক সমস্যা সম্পর্কে ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গী তুলে ধরা হয়েছে। একটি হাদিস থেকে জানা যায়, রাসুল (সঃ)'র একজন সাহাবীর ইন্তেকালের পর তাঁর সমস্ত সম্পত্তি কয়েকজন ভাতিজা নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেয়। অথচ ঐ সাহাবীর স্ত্রী ও তাঁর কয়েকটি শিশুকে সম্পত্তির কোন অংশ দেয়া হয়নি। এর কারণ, অজ্ঞতার যুগে আরবদের বিশ্বাস ছিল শুধুমাত্র যুদ্ধ করতে সক্ষম পুরুষরাই উত্তরাধিকার বা মৃত ব্যক্তির রেখে যাওয়া সম্পত্তির অংশ পাবার যোগ্য। মহিলা বা শিশুরা যুদ্ধ করতে সক্ষম নয় বলে তারা উত্তরাধিকার সূত্রে কোন সম্পদের অংশ পাবার যোগ্য নয়। এ অবস্থায় পবিত্র কোরআনের এই আয়াত নাজিল হয়। এতে নারীর অধিকারের প্রতি সমর্থন জানিয়ে বলা হয়েছে মীরাস বা উত্তরাধিকারগত সম্পদে পুরুষদের যেমন অংশ আছে, তেমনি তাতে নারীদেরও অংশ রয়েছে। উত্তরাধিকারগত সম্পদ কম বা বেশী যাই হোক না কেন তাতে নারীর অংশ আল্লাহর পক্ষ থেকে সুনির্দিষ্ট। এই আয়াতে শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো,
প্রথমত : ইসলাম শুধু নামাজ রোজার ধর্ম নয়। দুনিয়ার জীবনও এ ধর্মের গুরুত্ব পেয়েছে। আর তাই ইসলাম অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নারী ও এতিমদের অধিকার রক্ষাকে ঈমানের শর্ত বলে মনে করে।
দ্বিতীয়ত : আল্লাহর বিধান অনুযায়ী উত্তরাধিকারগত সম্পদের ভাগ-বন্টন করতে হবে, সামাজিক প্রথা বা পরলোকগত কোন ব্যক্তির সুপারিশ অনুযায়ী নয়।
তৃতীয়ত : উত্তরাধিকারগত সম্পদ বন্টনের ক্ষেত্রে এর মোট পরিমান কোন বিবেচ্য বিষয় নয়। মোট পরিমান যাই হোক না কেন সমস্ত ওয়ারিস বা উত্তরাধিকারীর ন্যায়সঙ্গত অধিকার রক্ষাই গুরুত্বপূর্ণ । উত্তরাধিকারগত সম্পদের মোট পরিমান কম হবার অজুহাতে কোন উত্তরাধিকারীর অধিকারকে উপেক্ষা করা যাবে না।
এবারে সুরা নিসার ৮ নম্বর আয়াত নিয়ে আলোচনা করবো। এই আয়াতের অর্থ হলো, "সম্পত্তি বন্টনকালে উত্তরাধিকারী নয় এমন গরীব , আত্মীয়, পিতৃহীন ও অভাবগ্রস্ত লোক উপস্থিত থাকলে তাদেরকে তা থেকে কিছু দিও এবং তাদের সাথে সদালাপ করবে।"
পারিবারিক সম্পর্ক রক্ষা ও তা জোরদার করতে হলে সুন্দর ও মানবিক ব্যবহার জরুরী। তাই উত্তরাধিকারগত সম্পদ বন্টনের বিধান উল্লেখের পরপরই কোরআনের আয়াতে এ সম্পর্কিত দুটি নৈতিক বিধান উল্লেখ করা হয়েছে। এর একটি হলো, উত্তরাধিকারগত সম্পদ বন্টনের সময় আত্মীয় স্বজন বিশেষ করে এতিম ও দরিদ্র-আত্মীয় স্বজন উপস্থিত থাকলে তারা সম্পদের উত্তরাধিকারী না হওয়া সত্ত্বেও সব উত্তরাধিকারীর সম্মতি নিয়ে মোট উত্তরাধিকার থেকে তাদেরকে কিছু দেয়া যেতে পারে ও দরিদ্র আত্মীয় স্বজনের মধ্যে ধনী আত্মীয়ের প্রতি যদি হিংসা বিদ্বেষ থেকেও থাকে, তাহলে এই দানের ফলে তা প্রশমিত হতে পারে এবং পারিবারিক ও আত্মীয়তার বন্ধনও এতে শক্তিশালী হবে। দ্বিতীয় নৈতিক বিধানে বঞ্চিত ও দরিদ্র আত্মীয় স্বজনের সাথে সুন্দর এবং ভদ্রভাবে কথা বলার নিদের্শ দেয়া হয়েছে, যাতে তারা এমন ধারণা করার সুযোগ না পায় যে, দারিদ্রের কারণে তাদের সাথে নিদর্য় আচরণ করা হচ্ছে। তাহলে এই আয়াতের মূল শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো,
• বঞ্চিতদের স্বাভাবিক চাহিদার প্রতি গুরুত্ব দেয়া উচিত। জরুরী প্রয়োজন ছাড়াও তাদেরকে বিভিন্ন ব্যাপারে সাহায্য করতে হবে।
• উপহার দেয়া এবং সুন্দর ব্যবহারের মাধ্যমে আত্মীয়তার সম্পর্ক জোরদার করতে হবে। বস্তুগত তথা বৈষয়িক বিষয়ে উপকার করার পাশাপাশি ভালবাসাপূর্ণ আত্মিক সম্পর্কের মাধ্যম আত্মীয় ও আপনজনদের মধ্যে হিংসা বিদ্বেষ প্রতিরোধ করা উচিত।
এবারে সুরা নিসার ৯ নম্বর আয়াত নিয়ে আলোচনা করবো। এই আয়াতের অর্থ হলো, "নিজেদের অসহায় সন্তানদের ছেড়ে গেলে ভবিষ্যতে তাদের কি হবে এই ভেবে যারা উদ্বিগ্ন তাদের উচিত অন্য মানুষদের এতিম সন্তানের ব্যাপারেও অনুরুপ ভয় করা এবং আল্লাহকে ভয় করা ও সদভাবে কথা বলা উচিত।"
পবিত্র কোরআন এতিমদের ব্যাপারে মানুষের মধ্যে দয়া সঞ্চারের জন্য তাদের অসহায় সন্তানের একটি কল্পিত দৃষ্টান্ত দিচ্ছে। এতে বলা হয়েছে, ধরে নেয়া যাক, তারা এমন পাষান-হৃদয় মানুষের তত্ত্বাবধানে রয়েছে যিনি তাদের কচি মনের অনুভুতিকে কোন গুরুত্বই দেন না এবং তাদের সম্পদ ব্যবহারের ক্ষেত্রেও ন্যায় বিচার করেন না। এমন অবস্থায় মানুষ নিশ্চয়ই এই ভেবে উদ্বিগ্ন হবে যে তাদের মৃত্যুর পর অন্যরা তাদের সন্তানদের সাথে কেমন ব্যবহার করবে ? এরপর আল্লাহ বলেছেন, "হে মানুষ, অন্যদের এতিম সন্তানের সাথে আচরণের ব্যাপারে তোমাদেরকেও আল্লাহকে মনে রাখতে হবে। তাদের সাথে অন্যায় ব্যবহার না করে ভাল ও পছন্দনীয় আচরণ কর। এতিমদের মন জয় কর এবং তাদেরকে ভালবেসে তাদের স্নেহের চাহিদা পূরণ করবে।"
এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো,
• এতিম ও সমাজের বঞ্চিত লোকদের সাথে এমন ব্যবহার করা উচিত যেমন ব্যবহার অন্যরাও আমাদের সন্তানদের সাথে করবে বলে আমরা আশা রাখি।
• সমাজে ভাল ও মন্দ কাজের প্রতিফল দেখা যায়। এমনকি এই প্রতিফল আমাদের মৃত্যুর পর আমাদের সন্তানদের কাছেও পৌঁছে। তাই , আমাদের কাজ - কর্মের সামাজিক প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে আমরা যেন অসচেতন না থাকি।
• শুধু পোশাক ও খাবারই এতিমদের চাহিদা নয়। তাদের মনের øেহের চাহিদা মেটানো আরো গুরুত্বপূর্ণ।
এবারে সুরা নিসার ১০ নম্বর আয়াত নিয়ে আলোচনা করবো। এই আয়াতের অর্থ হলো, "যারা অন্যায়ভাবে এতিমদের সম্পত্তি গ্রাস করে, নিশ্চয়ই তারা তাদের পেট আগুন দিয়ে পূর্ণ করছে। শীঘ্রই তারা জ্বলন্ত আগুনে জ্বলবে।"
এই আয়াতে এতিমদের প্রতি অন্যায় আচরণের প্রকৃত স্বরুপ তুলে ধরে বলা হয়েছে, এতিমদের সম্পদ গ্রাস করা আগুন খাওয়ার সমতুল্য । কারণ, কিয়ামতের সময় তা আগুন হয়ে দেখা দেবে।
আমরা এই পৃথিবীতে যা যা করি, তার একটি বাহ্যিক চেহারা রয়েছে। কিন্তু এসব কাজের প্রকৃত চেহারা আমাদের কাছে স্পষ্ট নয়। এসব কাজের প্রকৃত চেহার পরকালেই স্পষ্ট হবে। পরকালের শাস্তি আমাদের কাজেরই ফল মাত্র। যে এতিমের সম্পদ গ্রাস করে, তার হৃদয় যেমন পুড়বে, তিমনি বিবেকও এই অপরাধের জন্য তাকে দংশন করবে। এই অপরাধ অত্যাচারীর সমস্ত অস্তিত্বকে অগ্নিদগ্ধ করবে। আগের আয়াতে এতিমদের ওপর অত্যাচারের সামাজিক প্রভাবের কথা বলা হয়েছে । আর এই আয়াতে এতিমদের সাথে অন্যায় আচরণের সুপ্ত প্রতিফলের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, যাতে ঈমানদার লোকেরা এতিমদের সম্পদে হাত দেয়ার আগে এই প্রতিফলের কথা মনে রেখে তা থেকে বিরত হয়। এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো,
প্রথমত : হারাম সম্পদ ভোগ করা , বিশেষ করে, এতিমদের সম্পদ গ্রাস করা বাহ্যিকভাবে উপভোগ্য মনে হলেও তা প্রকৃত পক্ষে আত্মা ও বিবেকের জন্য যন্ত্রণাদায়ক এবং এ অপরাধ মানুষের ভালো গুন বিনষ্ট করে।
দ্বিতীয়ত : পরকালে দোযখের আগুন আমাদের মন্দ কাজেরই প্রতিফল। আল্লাহ তার বান্দাদেরকে কখনও পুড়তে চান না। কিন্তু আমরা আমাদের নিজেদের গোনাহ হতেই অগ্নিদগ্ধ হচ্ছি।
(১১- ১৪ নং আয়াত)
আজ সূরা নিসার ১১ থেকে ১৪ আয়াতের অনুবাদ ও সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা উপস্থাপন করা হবে। প্রথমে দেখা যাক এই সূরার ১১ ও ১২ নম্বর আয়াতে কি বলা হয়েছে- "আল্লাহ তোমাদের সন্তানদের উত্তরাধিকারগত সম্পদ সম্পর্কে নির্দেশ দিচ্ছেন, এক পুত্রের অংশ দুই কন্যার সমান। কিন্তু দুয়ের বেশী কন্যা থাকলে তারা পাবে পরিত্যাক্ত সম্পত্তির দুই তৃতীয়াংশ, আর মাত্র এক কন্যা থাকলে তার জন্য অর্ধাংশ । মৃত ব্যক্তির সন্তান থাকলে তার অর্থাৎ মৃত ব্যক্তির পিতা ও মাতা প্রত্যেকেই পাবে ছয় ভাগের এক ভাগ। আর যদি মৃত ব্যক্তি নিঃসন্তান হয় এবং শুধু তার পিতা মাতাই উত্তরাধিকারী হলে তার মায়ের জন্য তিন ভাগের এক ভাগ,আর মৃত ব্যক্তির ভাই বোন থাকলে মা পাবে ১/৬ ভাগ। এসব কিছুই সে যা অসিয়ৎ করে গেছে, সেই অসিয়ৎ পালন এবং তাঁর ঋণ শোধের পর প্রযোজ্য । তোমাদের পিতা ও সন্তানদের মধ্যে কে তোমাদের জন্য বেশী উপকারী তা তোমরা জান না,এও আল্লাহর নির্দেশ । নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বজ্ঞ ও প্রজ্ঞাময়।"
"তোমাদের স্ত্রীদের রেখে যাওয়া সম্পত্তির অর্ধাংশ তোমাদের জন্য যদি তাদের কোন সন্তান না থাকে, তাদের সন্তান থাকলে ,তোমাদের জন্য তাদের পরিত্যাক্ত সম্পত্তির এক চতুর্থাংশ । এসব কিছুই তারা যা ওসিয়ৎ করে, তা দেয়ার পর এবং তাদের ঋণ শোধের পর। তোমাদের সন্তান না থাকলে , তাদের জন্য তোমাদের সম্পত্তির এক চতুর্থাংশ, আর তোমাদের সন্তান থাকলে তাদের জন্য তোমাদের সম্পত্তির ৮ ভাগের এক ভাগ। এসবই তোমরা যা ওসিয়ৎ করবে তা দেয়ার পর ও ঋণ শোধের পর প্রযোজ্য। যদি কোন পুরুষ মারা যায় (সন্তান ও পিতা-মাতাহীন অবস্থায়)এবং বৈমাত্রেয় ভাই-বোনই যদি তার একমাত্র উত্তরাধীকারী হয় অথবা কোন নারী যদি মারা যায় (সন্তান ও পিতা-মাতাহীন অবস্থায়,তার ভাই-বোনই যদি তা একমাত্র উত্তরাধীকারী হয় তাহলে তারা প্রত্যেকেই পাবে এক ষষ্ঠাংশ । তারা এর বেশী হলে সকলে অংশীদার হবে এক তৃতীয়াংশের। এটাও ওসিয়ৎ ও ঋণ শোধের পর প্রযোজ্য। যদি এটা কারও জন্য হানিকর না হয় । এটা আল্লাহর নির্দেশ । আল্লাহ সর্বজ্ঞ ,সহনশীল। "
মানুষকে যিনি সৃষ্টি করেছেন সেই আল্লাহই যেহেতু ধর্মীয় বিধি-বিধান দিয়েছেন তাই তার নির্দেশ ও আইন কানুন মানুষের প্রকৃতিগত চাহিদার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। মৃত্যুর মাধ্যমে মানুষের সাথে বস্তু জগতের সম্পর্ক,মালিকানা, কর্তৃত্ব সব কিছু ছিন্ন হয় এবং মানুষ অন্য জগতে প্রবেশ করে। কিন্তু প্রশ্ন হলো মানুষ মৃত্যুর আগে জীবদ্দশায় সে সব অর্জন করে সে সবের কি পরিণতি হয় এবং সে গুলো কার কাছে হস্তান্তর করা হয় ? কিছু গোত্রের মধ্যে মৃত ব্যক্তির ধন সম্পদ তার পিতা,পুত্র,ভাই এ ধরনের নিকটাত্মীয়দের মধ্যে ভাগ করে দেয়ার রীতি প্রচলিত আছে। ওই সব গোত্রে মৃত ব্যক্তির স্ত্রী ,কন্যা সন্তান বা মহিলারা কোন সম্পত্তি উত্তরাধিকার সূত্রে পান না। আর বর্তমান আধুনিক কিছু দেশে মৃত ব্যক্তির সম্পদকে রাষ্ট্রীয় সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করা হয় এবং ওই সম্পদে সন্তান-সন্ততি ও আত্মীয় -স্বজনের অধিকারের কোন স্বীকৃতি দেয়া হয় না। কিন্তু ইসলামের বিধান এ থেকে ভিন্ন। ইসলাম ধর্মে উত্তরাধিকার আইন অনুযায়ী মৃত ব্যক্তির রেখে যাওয়া সম্পদ ছেলে ও মেয়ে সন্তান,স্ত্রী এবং নিকট আত্মীয়দের মধ্যে বন্টন করে দেয়া হয়। একই সাথে ইসলাম ধর্মে মৃত ব্যক্তির জন্যও কিছু অধিকার দেয়া হয়েছে। মৃত ব্যক্তি তার সম্পদের এক-তৃতীয়াংশ ইচ্ছেমত ওসিয়ত করতে পারবে যাতে তা তার মৃত্যুর পর তার ইচ্ছে অনুযায়ী ব্যয় করা হয়। ইসলামের এ অসাধারণ উত্তরাধিকার আইনের ফলে যাদের যথেষ্ট সম্পদ আছে তারা জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত কর্মতৎপরতা চালায়। কারণ তারা জানে যে তাদের মৃত্যুর পর সম্পদের মালিক হবে তাদেরই সন্তান-সন্তুতি যারা কিনা তার নাম ও স্মৃতি চিরঞ্জীব রাখবে। এ জন্য ইসলাম ধর্মে প্রথম ধাপে উত্তরাধিকার ভাগ করা হয় সন্তানদের মধ্যে এবং এরপর নিকট আত্মীয়দের মধ্যে। উত্তরাধিকার আইন অনুযায়ী পুত্র সন্তানকে কন্যা সন্তানের দ্বিগুণ সম্পদ দেয়া হয়। কারণ ইসলামের দৃষ্টিতে সংসারের ভরণ পোষণের দায় দায়িত্ব পুরুষের। এ দায়িত্ব পালনের জন্যে পুরুষকে অধিক অর্থ উপার্জনের চেষ্টা চালাতে হয়। তাই তার মূলধন ও পুঁজির প্রয়োজন হয় বেশী। বাহ্যিকভাবে দেখলে মনে হবে ইসলামের উত্তরাধিকার আইন মহিলাদের বিপক্ষে । কিন্তু ইসলামের অন্যান্য আইন কানুনের দিকে তাকালে বুঝা যায়,আসলে উত্তরাধিকার আইন নারীর স্বার্থের অনুকূলে । কারণ ইসলামের পারিবারিক ব্যবস্থায় অর্থ উপার্জনের কোন দায়িত্ব স্ত্রীর উপর অর্পিত হয়নি। স্ত্রীর ভরণ পোষণ,পোশাক-আশাক, বাসস্থানসহ যাবতীয় চাহিদা মেটাবার দায়িত্ব স্বামীর। ফলে মহিলারা উত্তরাধিকার আইন অনুযায়ী একভাগ সম্পত্তি পেলেও পুরোটাই ব্যক্তিগত কাজে ব্যয় কিংবা নিজের জন্য সঞ্চয় হিসেবে রেখে দিতে পারেন। পুরুষ উত্তরাধিকারসূত্রে দুই ভাগ সম্পত্তি পেলেও তাকে কমপক্ষে অর্ধেক সম্পদ অথবা তারও বেশী স্ত্রীর মোহরানা ও ভরণ পোষণ বাবদ ব্যয় করতে হয়। প্রকৃতপক্ষে মহিলারা উত্তরাধিকার সূত্রে যে একভাগ সম্পত্তি পান সেটার মালিক এবং পুরুষ উত্তরাধিকার সূত্রে যে দুভাগ সম্পত্তি পায় তারও এক অংশের মালিক। অর্থাৎ মহিলারা একভাগ সম্পত্তি সঞ্চয় হিসেবে রাখতে পারে এবং স্বামীর সাথে অংশীদার আরেক ভাগ সম্পদ দৈনন্দিন ব্যয় হিসেবে বিবেচনা করতে পারে। অথচ স্ত্রীর সম্পত্তির ওপর পুরুষের কোন অধিকার নেই এবং পুরুষকে নারীর সব প্রয়োজন ও চাহিদা মেটাতে হয়। সূরা নিসার ১১ ও ১২ নম্বর আয়াতের মৃত ব্যক্তির বাবা-মা ,সন্তান-সন্ততি এবং স্ত্রীর মধ্যে সম্পদ বন্টনের নিয়ম বলা হয়েছে। অবশ্য ইসলামের উত্তরাধিকার আইনের খুঁটিনাটি সব কিছু এ দুই আয়াতে বলা হয়নি। নির্ভরযোগ্য হাদিসে এ সম্পর্কে বিস্তারিত বলা হয়েছে। অবশ্য বলে রাখা দরকার যে,মৃত ব্যক্তির সম্পত্তি উত্তরাধিকার আইন অনুযায়ী বন্টনের আগে প্রথমে মৃত ব্যক্তির ঋণ পরিশোধ এবং তার ওসিয়ত বাস্তবায়ন করতে হয়। কারণ উত্তরাধিকারদের চেয়ে মৃত ব্যক্তি এবং অন্যান্য মানুষের অধিকার অগ্রগণ্য।
এই আয়াতের শিক্ষণীয় কয়েকটি দিক হচ্ছে,
এক. উত্তরাধিকার সূত্রে সম্পত্তি পাওয়ার ক্ষেত্রে মহিলারা পুরুষদের অর্ধেক সম্পত্তি পেয়ে থাকে। এটা তাদের প্রতি অবিচার নয়। বরং এটা সামাজিক জীবনের পার্থক্য এবং মহাবিজ্ঞ আল্লাহ পাকের নির্দেশ থেকে উৎসারিত হয়েছে।
দুই. মানুষের অধিকার আদায় করা এতই গুরুত্বপূর্ণ যে এ দুই আয়াতে চার বার এ সম্পর্কে জোর দেয়া হয়েছে। যাতে মৃত ব্যক্তির উত্তরাধিকারীরা অন্য মানুষের অধিকারের কথা ভুলে না যায়।
এবারে সুরা নিসার ১৩ ও ১৪ নম্বর আয়াত নিয়ে আলোচনা করবো। এই দুই আয়াতে বলা হয়েছে,"এ সব আল্লাহর নির্ধারিত সীমা । কেউ আল্লাহ ও তার রাসূলের আনুগত্য করলে আল্লাহ তাকে জান্নাতে দাখিল করবেন। যার পাদদেশে নদী প্রবাহিত,সেখানে তারা স্থায়ী ভাবে বাস করবে এবং এটা মহাসাফল্য। আর কেউ আল্লাহ ও তার রাসূলের অবাধ্য হলে এবং তার নির্ধারিত সীমা লংঘন করলে তিনি তাকে আগুনে নিক্ষেপ করবেন। সেখানে সে স্থায়ী হবে এবং তার জন্য রয়েছে লাঞ্ছনাদায়ক শাস্তি।"
উত্তরাধিকার সম্পর্কিত আয়াতের পর এ দুই আয়াতে আল্লাহ পাক বিশ্বাসী ব্যক্তিদেরকে আর্থিক ব্যাপারে বিশেষ করে মৃত ব্যক্তির সম্পদ বন্টনের ক্ষেত্রে আল্লাহর নির্দেশ মেনে চলার আহবান জানিয়েছেন এবং তার নির্দেশ লংঘনের ব্যাপারে সতর্ক করে দিয়েছেন। কারণ আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করা ভয়াবহ কঠিন। এ দুই আয়াতে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে,আল্লাহর আনুগত্য মানে কেবল তার এবাদত বা উপাসনা নয়। বরং সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে মানুষের অধিকার মেনে চলা হচ্ছে আল্লাহর আনুগত্য ও ধার্মিকতার শর্ত। সেই ব্যক্তি ও সমাজই কল্যাণের অধিকারী হবে যে এই বিধান তার ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনে মেনে চলবে।
এ দুই আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় দিক হচ্ছে,
প্রথমত : দুনিয়া ও আখেরাতে কল্যাণের অধিকারী হওয়ার উপায় হচ্ছে ইসলামের বিধান মেনে চলা।
দ্বিতীয়ত : মানুষের অধিকার যারা গ্রাস করে তারা কাফেরদের পর্যায়ে পড়ে এবং তারা কঠিন শাস্তি ভোগ করবে।
তৃতীয়ত : মৃত ব্যক্তি তার ঋণ পরিশোধ অথবা সন্তানদের মধ্যে সম্পত্তি বন্টনের ক্ষেত্রে অনিয়ম হচ্ছে কিনা তা দেখার জন্য যদিও উপস্থিত নেই,তবুও মনে রাখা দরকার যে,আল্লাহ আছেন এবং যারা মানুষের অধিকার পদদলিত করে তাদের জন্য কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা করে রেখেছেন।
(১৫- ১৮ আয়াত)
আজকের আসরে যথারীতি সূরা নিসার ১৫ থেকে ১৮ আয়াতের অনুবাদ ও সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা উপস্থাপন করা হবে। শুরুতেই দেখা যাক ১৫ নং আয়াতে কি বলা হয়েছে, "তোমাদের নারীদের মধ্যে যারা ব্যাভিচার করে,তাদের বিরুদ্ধে তোমাদের মধ্য থেকে চারজন সাক্ষী তলব করবে,যদি তারা সাক্ষ্য দেয়,তবে তাদেরকে গৃহে অবরুদ্ধ করবে,যে পর্যন্ত না তাদের মৃত্যু হয় অথবা আল্লাহ তাদের জন্য কোন ব্যবস্থা না করেন।"
গত পর্বে আমরা আলোচনা করেছিলাম, সূরা নিসার প্রথম কয়েকটি আয়াত পরিবার সম্পর্কিত। যেসব নারী ও পুরুষ পারিবারিক পবিত্রতা লংঘনের মত অবৈধ ও নোংরা কাজে লিপ্ত হয় আজকের আলোচনায় তাদের শাস্তির বিধান উল্লেখ করা হবে। সূরা নিসার ১৫ নম্বর আয়াতে স্বামীর সাথে ঘর সংসার করছেন এমন মহিলারা যদি পর-পুরুষের সাথে ব্যাভিচারে লিপ্ত হন,তাহলে তাদের শাস্তি কি হবে,তা উল্লেখ করা হয়েছে। অবশ্য এটাও জানা জরুরী যে,ইসলাম পারিবারিক মর্যাদা রক্ষার লক্ষ্যে অন্যদের ব্যাপারে গোয়েন্দাগিরি নিষেদ্ধ করেছে। অন্যদের অবৈধ কাজ প্রমাণ করতেও ইসলাম উৎসাহ দেয় না। তাই তিন জন ন্যায়পরায়ন ব্যক্তিও যদি কোন বিবাহিতা মহিলার ব্যাভিচারের ব্যাপারে সাক্ষ্য দেয় তা গ্রহণযোগ্য হবে না। অবশ্য একসাথে চার জন ন্যায়পরায়ন ব্যক্তি এ ধরনের সাক্ষ্য দিলে তা গ্রহণযোগ্য হবে। আর এ ক্ষেত্রে বিবাহিতা ব্যাভিচারী মহিলার শাস্তির যে বিধান দেয়া হয়েছে,তা অস্থায়ী বিধান অর্থাৎ মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত তাকে স্বামীর ঘরে বন্দী রাখতে হবে। পরিবারের মান মর্যাদা রক্ষার জন্যেই আল্লাহ এ ধরনের নির্দেশ দিয়েছেন যাতে অসামাজিক কাজে লিপ্ত মানুষেরা এক জায়গায় সমবেত হয়ে একে অন্যের কাছে খারাপ কাজের বিভিন্ন পদ্ধতি ছড়িয়ে না দেয়। যেমন,আজকাল আমরা দেখছি গণ কারাগারগুলো অবৈধ তৎপরতা শিক্ষার কেন্দ্রে রূপান্তরিত হয়েছে। অবশ্য পরে বিবাহিত ব্যাভিচারীদের শাস্তির চূড়ান্ত বিধান তথা পাথর মেরে মৃত্যুদণ্ড দেয়ার বিধান আসার পর যাবজ্জীবন গৃহবন্দীত্বের দণ্ড পাওয়া বিবাহিত মহিলারা মুক্তি লাভ করেন।
এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো,
প্রথমত : মুমিনদের সম্মান রক্ষা তার রক্তের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ। তাই হত্যাকারী প্রমাণের জন্য দুইজন সাক্ষী প্রয়োজন হলেও ব্যাভিচারী প্রমাণের জন্য চারজন সাক্ষী প্রয়োজন। নিঃসন্দেহে ব্যাভিচার খুবই নোংরা কাজ, কিন্তু ব্যাভিচারীর সম্মান ক্ষুন্ন করার পদক্ষেপ আরো নিকৃষ্ট কাজ।
দ্বিতীয়ত : ইসলাম পারিবারিক ও সামাজিক শৃঙ্খলা রক্ষার নিশ্চয়তা বিধানের জন্য সমাজ ও পরিবারে সংঘটিত অপরাধের কঠিন শাস্তির নির্দেশ দিয়েছে। ব্যাভিচারীকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া এ ধরনের একটি শাস্তি।
এবারে সূরা নিসার ১৬ নম্বর আয়াত নিয়ে আলোচনা করা যাক। এই আয়াতে বলা হয়েছে,"আর তোমাদের মধ্যে যে দুজন ব্যাভিচারে লিপ্ত হবে, তাদের উভয়কেই শাস্তি প্রদান কর। কিন্তু তারা যদি তওবা করে এবং নিজেদের সংশোধন করে নেয়,তবে তাদের রেহাই দেবে,আল্লাহ ক্ষমাশীল, দয়াময়।"
অনেকের মতে, এই আয়াতের অর্থ সবার জন্য প্রযোজ্য এবং যে পুরুষ ব্যাভিচার করবে তা কোন নারীর সাথেই হোক বা পুরুষের সাথেই হোক তারা উভয় শাস্তির যোগ্য হবে। কিন্তু অধিকাংশ তাফসীরকারকদের মতে, এখানে অবিবাহিত নারী ও পুরুষ ব্যাভিচারীর কথা বলা হয়েছে। আর তাদের শাস্তি হলো,বেত্রাঘাত। কিন্তু আদালতে তাদের অপরাধ প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত এ শাস্তি কার্যকর করা যাবে না। আর ব্যাভিচারী নারী ও পুরুষ যদি তওবা করে এবং নিজেদের সংশোধন করে নেয়,তাহলে তাদেরকে অবশ্যই ক্ষমা করতে হবে এবং তাদের বিষয়টি আল্লাহর ইচ্ছার ওপর ছেড়ে দিতে হবে। আল্লাহও ক্ষমাশীল এবং দয়ালু । তিনি প্রকৃত তওবা বা ক্ষমা প্রার্থনা কবুল করেন।
এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো,
প্রথমত : ইসলামী সমাজে কোন অপরাধীকে প্রশ্রয় বা নিরাপত্তা দেয়া উচিত নয়। বরং অপরাধীকে তাদের অপরাধের উপযুক্ত শাস্তি দেয়া ইসলামী রাষ্ট্রের কর্মকর্তাদের দায়িত্ব।
দ্বিতীয়ত : অপরাধীদের জন্য সংশোধন ও ক্ষমার পথ বন্ধ করে দেয়া উচিত নয়। যারা আসলেই অনুতপ্ত ও লজ্জিত তাদেরকে সমাজে পুনর্বাসন করতে হবে।
এবারে সূরা নিসার ১৭ ও ১৮ নস্বর আয়াত নিয়ে আলোচনা করবো। এই দুই আয়াতে বলা হয়েছে,"আল্লাহ অবশ্যই সেইসব লোকের ক্ষমা গ্রহণ করবেন, যারা অজ্ঞতাবশত মন্দ কাজ করে এবং খুব দ্রুত তওবা করে। এরাই তারা যাদেরকে আল্লাহ পুণরায় দয়া করবেন এবং তাদের তওবা কবুল করবেন। আল্লাহ সর্বজ্ঞ প্রজ্ঞাময়।"
তওবা তাদের জন্য নয়, যারা আজীবন মন্দ কাজ করে এবং মৃত্যুর সময় উপস্থিত হলেই বলে আমি এখন তওবা করছি। তওবা তাদের জন্যেও নয় , যাদের মৃত্যু হয় অবিশ্বাসী অবস্থায়,এরাই তারা, যাদের জন্য আমি যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি প্রস্তুত রেখেছি।
আগের আয়াতে ব্যাভিচারীদের ক্ষমার সম্ভাবনার কথা উল্লেখের পর এ আয়াতে তওবা কবুল শর্ত ও সময়ের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। তওবা কবুলের প্রথম ও প্রধান শর্ত হলো,যে গোনাহ করা হয়েছে তা ভুলবশত করা হয়েছে এবং পাপের পরিণতির কথা চিন্তা না করেই নিতান্ত প্রবৃত্তির তাড়নায় তা করা হয়েছে অর্থাৎ অভ্যাসের প্রভাবে বা পাপের কদর্যতাকে গুরুত্বহীন ভেবে ঐ গোনাহ বা ব্যাভিচার করা হয়নি । তওবা কবুলের দ্বিতীয় শর্ত হলো,গোনাহর কদর্যতার কথা মনে আসার সাথে সাথেই অনুতপ্ত ও লজ্জিত হতে হবে । তওবাকে পিছিয়ে রেখে গোনাহর পুনরাবৃত্তি করলে এবং জীবনের শেষ প্রান্তে এসে গোনাহ করার কোন সুযোগ না থাকায় তওবা করলে তা কবুল হবে না । কারণ তওবা কবুলের শর্ত হলো সংশোধন করা । শেষ বয়সে সংশোধনের সম্ভাবনা থাকে না । তওবা পিছিয়ে দেয়া হলে গোনাহ অভ্যাসের অংশ হয়ে যায় এবং এ ধরনের মানুষ আর তওবার সুযোগই পায় না । এরা মুখে মুখে তওবা করলেও তাদের অন্তর গোনাহ বা পাপাচারে অভ্যস্ত হয়ে যায় বলে সুপথে ফেরার উপায় থাকে না ।
এ আয়াতে শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো,
প্রথমত : আল্লাহ পাপীদের প্রকৃত তওবা কবুল করাকে নিজের জন্য জরুরী বলে উল্লেখ করেছেন । তাই আমরা যতক্ষণ জীবিত আছি, ততক্ষণ এই সুযোগ ব্যবহার করা উচিত ।
দ্বিতীয়ত : যে মানুষ নিজের কূপ্রবৃত্তির তাড়না দমন রাখতে পারে না, সে জ্ঞানী হলেও বাস্তবে জাহেল ।
তৃতীয়ত : তওবা কবুলের প্রধান চাবী হলো, দ্রুত পাপ কাজ বন্ধ করে তওবা করা। কারণ গোনাহর পরিমাণ বেশি না হওয়া পর্যন্ত তওবা করা সহজ ।
চতুর্থত : বিপথ বা মৃত্যুর সম্মুখীন হয়ে তওবা করলে তার কোন মূল্য নেই । সাধারণ ও মুক্ত অবস্থায় করা তওবাই প্রকৃত তওবা ।
(১৯-২৩ আয়াত)
আজকের আসরে সূরা নিসার ১৯ থেকে ২৩ আয়াতের তর্জমা ও সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা উপস্থাপন করা। ১৯ নং আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেছেন,"হে ঈমানদারগণ! তোমাদের জন্য এটা বৈধ নয় যে, তোমরা জোর করে মহিলাদের বিয়ে করে তাদের উত্তরাধিকারী হবে। তাদের কাছ থেকে মোহরানার অংশবিশেষ আদায়ের জন্যেও চাপ প্রয়োগ করা বৈধ নয়, যদি না তারা প্রকাশ্য ব্যভিচারে লিপ্ত হয়। তাদের সাথে ভালো ব্যবহার করবে এবং তাদেরকে ভালো না লাগলেও তালাক দিও না । কারণ আল্লাহ যাতে ব্যাপক কল্যাণ ও মঙ্গল রেখেছেন তোমরা হয়তো তাই অপছন্দ করছো । "
এই আয়াতের প্রথম অংশে পারিবারিক বিষয়ে মহিলাদের অধিকারের প্রতি সমর্থন ঘোষণা করা হয়েছে এবং মহিলাদের ব্যাপারে যে কোন ধরনের অপছন্দনীয় আচরণ থেকে বিরত থাকতে পুরুষদের নির্দেশ দিয়েছে । আয়াতের শেষাংশে পরিবার ব্যবস্থা রক্ষার ব্যাপারে একটি মূলনীতি উল্লেখ করা হয়েছে । সম্পদের প্রতি লোভ স্ত্রী নির্বাচনের ক্ষেত্রে একটি অপছন্দনীয় রীতি। এ আয়াতে ঈমানদারদের উদ্দেশ্যে বলা হয়েছে, স্ত্রী নির্বাচনের এই মাপকাঠি বৈধ নয় । একই সাথে কোন কোন সমাজে স্ত্রীদেরকে মোহরানা দেয়ার পর তার কিছু অংশ জোর করে ফেরত নেয়াও খুবই নোংরা রীতি । বিশেষ করে মোহরানার অংক যদি খুব বড় হয়,তার অংশবিশেষ ফেরত দেয়া স্ত্রীদের জন্য খুবই কষ্টকর । পবিত্র কোরআন এ ধরনের কাজ করতে নিষেধ করেছে এবং স্ত্রীদের সম্পদ ও অধিকারের প্রতি সম্মান দেখাতে বলেছে । শুধুমাত্র স্ত্রীদের প্রকাশ্য ব্যভিচারের শাস্তি হিসেবে তাদের সাথে কঠোর আচরণ করা যেতে পারে বলে উল্লেখ করেছে। যেমন স্ত্রী প্রকাশ্যে ব্যভিচারী হলে তাকে মোহরানা না দিয়ে তালাক দেয়া যেতে পারে । এরপর মহান আল্লাহ এক সামগ্রীক নীতির বর্ণনা দিয়ে স্ত্রীদের সাথে ভালো আচরণ করতে পুরুষদের নির্দেশ দিয়েছেন। আল্লাহ বলছেন, কোন কারণে স্ত্রীর ওপর অসন্তুষ্ট হও অথবা স্ত্রীর প্রতি তোমাদের ভালবাসা কমে যায় এবং স্ত্রীকে ভালো না লাগে তাহলে দ্রুত তালাকের সিদ্ধান্ত নিও না ও তার সাথে খারাপ ব্যবহার করো না । কারণ,অনেক কিছুই মানুষের কাছে অপছন্দনীয় মনে হলেও আল্লাহ সে সবের মধ্যে অনেক কল্যাণ ও বরকত রেখেছেন।
এই আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো,
প্রথমত : স্ত্রী নির্বাচনের ক্ষেত্রে সম্পদের আকাঙ্ক্ষা যেন মানদণ্ড না হয়। ভালবাসাই বিয়ের মূল ভিত্তি হওয়া উচিত,সম্পদ নয়।
দ্বিতীয়ত : স্ত্রীই মোহরানার একমাত্র মালিক। পুরুষ স্ত্রীকে দেয়া মোহরানার বা স্ত্রীর অন্য কোন সম্পদের ওপর কোন ধরনের মালিকানার অধিকার রাখে না।
তৃতীয়ত : পরিবার ব্যবস্থা রক্ষার দায়িত্ব পুরুষের। কঠোরতা ও ভুল বোঝাবুঝি যেন খারাপ আচরণ এবং পরিশেষে তালাক বা বিচ্ছিন্নতার কারণ না হয় , সেদিকে লক্ষ্য রাখা পুরুষের দায়িত্ব।
এরপর ২০ ও ২১ নং আয়াতে বলা হয়েছে, "যদি তোমরা স্ত্রীর পরিবর্তে অন্য স্ত্রী গ্রহণের সিদ্ধান্ত নাও, সে ক্ষেত্রে তাদের একজনকে মোহরানা হিসেবে প্রচুর অর্থ দিয়ে থাকলেও তা থেকে কিছু ফেরত নিও না। তোমরা কি মোহরানা ফেরত নেয়ার জন্য স্ত্রীদের ওপর মিথ্যা অপবাদ চাপিয়ে দেবে এবং প্রকাশ্য পাপাচারে লিপ্ত হবে ? কিভাবে তা ফেরত নেবে যখন তোমরা একে অপরের সাথে সংগত হয়েছিলে এবং তারা বিয়ের সময় তোমাদের কাছ থেকে সুদৃঢ় অঙ্গীকার গ্রহণ করেছিল ?"
এই আয়াতে অজ্ঞতার যুগে আরব সমাজে বহুল প্রচলিত একটি নোংরা প্রথার উল্লেখ করা হয়েছে। ওই প্রথা অনুযায়ী পুরুষরা নতুন স্ত্রী গ্রহণ করতে চাইলে, প্রথম স্ত্রীর নামে মিথ্যা অপবাদ রটাতো,যাতে প্রথম স্ত্রী মানসিক চাপের শিকার হয়ে মোহরানা মাফ করে দেয় এবং স্বামী সহজেই তাকে তালাক দেয়। এরপর পুরুষ ওই মোহরানা দিয়েই দ্বিতীয় স্ত্রী গ্রহণ করতো। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ এই নোংরা প্রথা নাকচ করে দিয়ে বলছেন,তোমরা দাম্পত্য জীবনের চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছ এবং তাতে স্ত্রীকে মোহরানা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছ। আর এরই ভিত্তিতে অনেক বছর এক সাথে ঘর-সংসারও করেছ,এখন কিভাবে অন্যকে পাবার জন্য আগের চুক্তি ভঙ্গ করবে? এমনকি নিজের সতী স্ত্রীকেও অপবাদ দিতে দ্বিধাবোধ করছ না?
এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো,
• ইসলাম নারীর ন্যায্য অধিকারের সমর্থক এবং ইসলাম প্রথম স্ত্রীর অধিকার ক্ষুন্ন করে দ্বিতীয় স্ত্রী গ্রহণের অনুমতি পুরুষকে দেয়নি।
• মোহরানা ফেরত নেয়া বৈধ নয়। বিশেষ করে কেউ যদি স্ত্রীকে অপবাদ দিয়ে বা তার মর্যাদাহানি করে মোহরানা ফেরত নেয়ার যুক্তি দেখায়,তাহলে তা ওই পুরুষের পাপ আরও বৃদ্ধি করবে।
• বিয়ের চুক্তি একটি সুদৃঢ় চুক্তি। এই চুক্তির মাধ্যমে আল্লাহ নারী ও পুরুষকে পরস্পরের জন্য বৈধ করেছেন। তাই এ চুক্তি রক্ষা করা স্বামী ও স্ত্রী উভয়ের জন্যেই জরুরী।
এবারে সূরা নিসার ২২ ও ২৩ নম্বর আয়াত নিয়ে আলোচনা করা যাক। এই দুই আয়াতে বলা হয়েছে, "নারীদের মধ্যে তোমাদের পিতৃপুরুষ যাদের বিয়ে করেছে,তোমরা তাদের বিয়ে করো না,অতীতে যা হবার হয়েছে,এখন নয়। এটা অশ্লীল,অতিশয় ঘৃণ্য এবং নিকৃষ্ট আচরণ। তোমাদের জন্য অবৈধ করা হল তোমাদের মা,মেয়ে,বোন,ফুফু বা পিতার বোন,খালা বা মায়ের বোন, ভাই এবং বোনের মেয়ে,দুধ মা, দুধ বোন, শাশুড়ী এবং তোমাদের স্ত্রীদের মধ্যে যার সাথে সহবাস হয়েছে,তার পূর্ব স্বামীর ঔরসে জন্ম নেয়া কন্যা ও যারা তোমার অভিভাবকত্বে আছে। তবে যদি তাদের সাথে সহবাস না হয়ে থাকে, তাতে তোমাদের কোন অপরাধ নেই এবং তোমাদের জন্য নিষিদ্ধ তোমাদের ঔরসজাত পুত্রের স্ত্রী ও দুই বোনকে একসঙ্গে বিয়ে করা। অতীতে যা হবার হয়েছে, আল্লাহ ক্ষমাশীল ও দয়াময়।"
যেসব মহিলাকে বিয়ে করা হারাম এই দুই আয়াতে তাদের তালিকা দেয়া হয়েছে। এই সব মহিলাদের বিয়ে করা মানব প্রকৃতির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। সামগ্রীকভাবে তিনটি ক্ষেত্রে বিয়ে বৈধ নয়।
প্রথমত : রক্তের সম্পর্কের অধিকারী মহিলারা। যেমন-মা ,বোন, কন্যা, ফুফু, খালা, ভাগনী ও ভাইঝিকে বিয়ে করা হারাম।
দ্বিতীয়ত : বৈবাহিক সম্পর্কের মাধ্যমে সৃষ্ট বাধার ক্ষেত্রে যেমন স্ত্রীর মা, বোন ও স্ত্রীর পূর্ববর্তী স্বামীর ঔরসে জন্ম নেয়া কন্যাকে বিয়ে করা হারাম।
তৃতীয়ত : দুধের সম্পর্ক যেমন, দুধ মা ও দুধ বোনকে বিয়ে করা হারাম।
(২৪-২৫ আয়াত)
আজকের আসরে সূরা নিসার ২৪ ও ২৫ নং আয়াতের অনুবাদ ও সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা উপস্থাপন করা হবে। এই সূরার ২৪ নং আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেছেন, "নারীদের মধ্যে তোমাদের অধিকারভুক্ত দাসী তথা কাফেরদের সাথে যুদ্ধে অধিকার করা বন্দিনী ছাড়া সকল সধবা নারী তোমাদের জন্য নিষিদ্ধ। তোমাদের জন্য এটি আল্লাহর বিধান। উল্লেখিত নারীরা ছাড়া অন্য নারীদের অর্থ ও মোহরানার বিনিময়ে বিয়ে করা তোমাদের জন্য বৈধ। এসব বিয়ের উদ্দেশ্য পবিত্রতা ও সম্ভ্রম রক্ষা অবৈধ যৌন সম্পর্ক নয়। আর যে সব নারীকে তোমরা অস্থায়ীভাবে বিয়ের পর সম্ভোগ করেছ তাদেরকে নির্ধারিত মোহর দেয়া তোমাদের জন্য অবশ্য পালনীয় কতর্ব্য। মোহর নির্ধারনের পর কোন বিষয়ে পরস্পরে রাজী হলে তাতে তোমাদের কোন দোষ নেই। আল্লাহ সর্বজ্ঞ এবং প্রজ্ঞাময়।"
পূর্ববর্তী আয়াতের ধারাবাহিকতায় এই আয়াতে আরো দুই ধরনের বিয়ের কথা উল্লেখ করা হয়েছে এবং আল্লাহ তা'লা এই দুই ধরনের বিয়েকে বৈধ করে মুমিনদেরকে আল্লাহর বিধান মেনে চলার নির্দেশ দিয়েছেন। যুদ্ধ মানব সমাজের একটি তিক্ত বাস্তবতা। যুদ্ধে জড়িত উভয় পক্ষের বহু পুরুষ প্রাণ হারায় বলে বহু নারী ও পরিবার অভিভাবকহীন হয়ে পড়ে। অন্যদিকে, যুদ্ধ বিগ্রহের প্রাচীন প্রথায় যুদ্ধ-বন্দীদের রাখার জন্য কোন স্থান বা বিশেষ কারাগার ছিল না বলে পুরুষ যুদ্ধ-বন্দীদেরকে দাস এবং বন্দিনী নারীদেরকে দাসীতে পরিণত করা হত। ইসলাম এই প্রথাকে একতরফাভাবে নিষিদ্ধ না করলেও মুক্তিপণ প্রথার মত বিভিন্ন নিয়মের মাধ্যমে ক্রমান্বয়ে বন্দী মুক্তির সুযোগ সৃষ্টি করেছে। ইসলাম নারী বন্দিনীদের বিয়ে করাকে বৈধ বলে স্বীকৃতি দিয়েছে। কারণ,তাঁরা এর ফলে স্ত্রী ও মায়ের মর্যাদা পাচ্ছেন। কিন্তু সমস্যা দেখা দেয় সে সব নারী বন্দিনীদের ভবিষৎ নিয়ে যাদের স্বামী জীবিত রয়েছে। ইসলাম তাদের বন্দিদশাকে স্বামী থেকে বিচ্ছিন্নতা বা তালাকের মত বলে ধরে নিয়েছে এবং এ ক্ষেত্রেও তারা অন্তসত্ত্বা কিনা তা স্পষ্ট না হওয়া পর্যন্ত পুণরায় তাদের বিয়ে করার অনুমতি দেয়নি। বন্দিনী মহিলাদেরকে তাদের নিজেদের অবস্থার ওপর ছেড়ে দেয়া বা তাদের স্বাভাবিক চাহিদার প্রতি গুরুত্ব না দেয়ার চেয়ে ইসলামের এই বিধান বেশী যৌক্তিক ও উন্নত। অন্যদিকে বহু মুসলমান পুরুষও শহীদ হওয়ায় তাদের পরিবারবর্গ অভিভাবকহীন হয়ে পড়ে। ইসলাম এই সমস্যা সমাধানের জন্য দুই ধরনের পদ্ধতি পেশ করেছে। একটি হলো, পুরুষদেরকে বহু স্ত্রী রাখার অনুমতি দেয়া। আর দ্বিতীয় বিধান হলো,স্ত্রী হিসেবে বিয়ে করা এবং তাদের সাথে প্রথম স্ত্রীর মত আচরণ করা। পবিত্র কোরআনে উল্লেখিত এ ধরনের পরিকল্পনার বিষয়ে আমরা আগেও আলোচনা করেছি। এই আয়াতে আরো একটি পদ্ধতির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। আর এটি হলো,অস্থায়ী বিয়ে। স্থায়ী বিয়ের মত এ বিয়ের চুক্তিকেও আল্লাহ বৈধ এবং শর্তযুক্ত করেছেন। অস্থায়ী বিয়ের সময়সীমা সীমিত বা নির্ধারিত হলেও তা নবায়নযোগ্য। তবে অনেক বুদ্ধিজীবী ও পাশ্চাত্য পন্থী ব্যক্তি ইসলামের এই রীতি তথা অস্থায়ী বিয়েকে উপহাস করে একে মহিলাদের প্রতি অসম্মান বলে মন্তব্য করেছেন। অথচ পাশ্চাত্যে নারী ও পুরুষের সম্পর্কে কোন লাগাম ও নিয়ন্ত্রণ নেই। পাশ্চাত্যে বহু পুরুষের সাথে একজন নারীর অবাধ ও গোপন সর্ম্পককে বৈধ মনে করা হয়। তাহলে কি নারী ও পুরুষের লাগামহীন সম্পর্ক এবং তাদের মধ্যে পাশবিক তাড়নার সম্পর্ক নারী অধিকারের লঙ্ঘন নয়? আর নারী ও পুরুষের সম্পর্ক যদি বিয়ের চুক্তির মত নীতিমালার আওতায় পবিত্র থাকে তা কেন নারীর প্রতি অসম্মান হবে ?
দুঃখজনকভাবে, আল্লাহর এই বিধানের ব্যাপারে ইসলামের প্রাথমিক যুগেই দৃষ্টিভঙ্গীগত মতবিরোধ দেখা দিয়েছিল এবং অস্থায়ী বিয়ে নিষিদ্ধ করা হয়। ফলে গোপন সম্পর্ক ও ব্যভিচারের পথ প্রশস্ত হয়। কারণ, অস্থায়ী বিয়ে নিষিদ্ধ করা হলেও মানুষের স্বাভাবিক চাহিদা বন্ধ হয়ে যায়নি এবং অনেক মানুষ এই চাহিদা মেটানোর জন্য অবৈধ পস্থার আশ্রয় নেয়।
এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো,
প্রথমত : সামাজিক ও পারিবারিক বিষয়ে বাস্তববাদী হওয়া উচিত। এ ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত অভিরুচি বা গোষ্ঠীগত দৃষ্টিভঙ্গীর অনুসরণ না করে আল্লাহর বিধানই মেনে নেয়া উচিত। কারণ, আল্লাহ মানুষের স্রষ্টা ও সর্বজ্ঞ হিসেবে তাদের ব্যক্তিগত এবং সামাজিক চাহিদা সম্পর্কে বেশী অবগত।
দ্বিতীয়ত : বিয়ে স্থায়ী বা অস্থায়ী যাইহোক না কেন, তা নারী ও পুরুষের সম্ভ্রম এবং চারিত্র্যিক পবিত্রতা রক্ষার এক শক্তিশালী দূর্গ।
তৃতীয়ত : বিয়ের মোহরানা নির্ধারণের ক্ষেত্রে উভয় পক্ষের সন্তুষ্টিই এর বৈধতার মূল শর্ত। শুধু পাত্র পক্ষই মোহরানা নির্ধারনের অধিকারী নয়।
এবারে সুরা নিসার ২৫ নম্বর আয়াত নিয়ে আলোচনা করবো। প্রথমে আয়াতটির অর্থ জানা যাক-"তোমাদের মধ্যে যারা স্বাধীন ও ঈমানদার নারী বিয়ে করার মত আর্থিক সঙ্গতি রাখে না, তারা নিজেদের অধিকারভুক্ত ঈমানদার ক্রীতদাসীদের বিয়ে করবে। আল্লাহ তোমাদের ঈমান সম্পর্কে বেশী জানেন। তোমরা একে অপরের সমান। সুতরাং তাদেরকে বিয়ে করবে তাদের মালিকের অনুমতি নিয়ে। তারা ব্যভিচারী অথবা উপপতি গ্রহণকারিণী না হয়ে সতী-সাধবী হয়ে থাকলে তাদের মোহরানা ন্যায় সঙ্গতভাবে দেবে। বিয়ের পর তারা যদি ব্যভিচার করে, তবে তাদের শাস্তি স্বাধীন নারীর অর্ধেক । এ ধরনের বিয়ে তাদের জন্যেই , যারা স্ত্রী না থাকার কারণে পাপে লিপ্ত হতে পারে বলে ভয় করে। কিন্তু ধৈর্য ধরা ও স্বাধীন নারীদের বিয়ে করাই তোমাদের জন্য উত্তম। আল্লাহ ক্ষমাশীল এবং দয়ালু।"
আগের আয়াতে দাসী ও যুদ্ধ বন্দিনী নারীদের বিয়ে করাকে বৈধ বলে উল্লেখের পর এ আয়াতে মোহরানার অর্থ পরিশোধে অক্ষম মুসলিম পুরুষদেরকে যুদ্ধ বন্দিনী নারী বিয়ে করতে উৎসাহ দেয়া হয়েছে। এই উভয় শ্রেণীর নারী ও পুরুষ যাতে অনৈতিক পন্থায় জৈবিক চাহিদা পূরণ থেকে বিরত থাকে, সে জন্যেই আল্লাহ এ নির্দেশ দিচ্ছেন। উপরন্তু এ ব্যবস্থার ফলে বন্দিনীরা স্বামীহীন অবস্থায় থাকবে না। একটি লক্ষনীয় দিক হলো,ইসলাম যে কোন নারী ও পুরুষের বিয়ের জন্য ঈমানদার হওয়াকে মূল শর্ত বলে উল্লেখ করেছে। এ থেকে বোঝা যায়, যদি কোন ঈমানদার যুবক ও ঈমানদার যুবতি সম্পূর্ণ অপরিচিতও হয় এবং সামাজিক ক্ষেত্রে তারা একই শ্রেণীর নাও হয়ে থাকে তবুও তারা দাস্পত্য জীবনে সুখী হতে পারে। কিন্তু তাদের যদি ঈমানই না থাকে,তাহলে তারা যত সুন্দর বা সুন্দরী এবং অর্থ সম্পদ ও উচ্চ পদের অধিকারী হোক না কেন তাদের সুখ বা সুন্দর জীবনে স্বপ্নই থেকে যাবে। কারণ,সময়ের পরিক্রমায় এসব বাহ্যিক দিকগুলো বিলীন হয়ে যায়।
এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো,
• প্রয়োজনে দাসীকে বিয়ে করার বিষয়টি মেনে নেয়া উচিত। কিন্তু পাপের কলঙ্কে লিপ্ত হওয়া কখনও উচিত নয়।
• যারা বিয়ের খরচ বহন করতে অক্ষম,ইসলামে তাদের জন্যেও অচলাবস্থার কোন অবকাশ নেই।
• বিয়ের মূল ভিত্তি ও এর স্থায়ীত্বের শর্ত হলো, চারিত্রিক পবিত্রতা বজায় রাখা এবং অবৈধ সম্পর্ক থেকে দূরে থাকা।
• অসৎ চরিত্রের লোকেরা সমাজেও অসৎ কাজের বিস্তার ঘটায়। এইসব লোকদেরকে আল্লাহ পরকালে কঠোর শাস্তি দিবেন। এ ধরনের অসৎ লোকদের এ পৃথিবীতেও শাস্তি দেয়া উচিত, যাতে তাদের দেখে অন্যরাও শিক্ষা পেতে পারে।
(২৬-৩১ আয়াত)
আজ সূরা নিসার ২৬ থেকে ৩১ আয়াতের অনুবাদ ও সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা উপস্থাপন করা হবে।এই সূরার ২৬,২৭ ও২৮ নং আয়াতে বলা হয়েছে,"আল্লাহ এই সব বিধান বর্ণনা করে তোমাদের জন্য সৌভাগ্যের পথ স্পষ্ট করতে চান এবং পূর্ববর্তীদের জীবন-চরিত্র তুলে ধরতে চান। আল্লাহ তোমাদের গোনাহগুলো ক্ষমা করে পুণরায় তোমাদেরকে অনুগ্রহ করতে চান। আল্লাহ সর্বজ্ঞ ও প্রজ্ঞাময়। আল্লাহ তোমাদের প্রতি ক্ষমাশীল হতে চান,কিন্তু যারা কামনা-বাসনার অনুসারী,তারা তোমাদের ঘোর অধঃপতন চায়। আল্লাহ তোমাদের দায়িত্বের বোঝা হাল্কা করতে চান। কারণ মানুষ সৃষ্টিগতভাবেই দূর্বল।"
পূর্ববর্তী আয়াতে বিয়ে করতে উৎসাহ দেয়া এবং এ সম্পর্কিত বিধান ও শর্ত উল্লেখের পর এ তিন আয়াতে এটা মনে করিয়ে দেয়া হচ্ছে যে,এ সব বিধি বিধান দেয়া হয়েছে মানুষের কল্যাণের জন্যেই। আল্লাহ মানুষের সৌভাগ্য নিশ্চিত করা এবং তাদেরকে অপবিত্রতা থেকে দূরে রাখার জন্য এই সব বিধান দিয়েছেন। মানুষকে পথ দেখানো আল্লাহর একটি রীতি। আর এ জন্যেই তিনি নবী- রাসুল এবং ধর্ম গ্রন্থ পাঠিয়েছেন। কিন্তু একদল লোক যারা কিনা নিজেরাও বিভ্রান্ত তারা চায় অন্যরাও তাদের মত পথভ্রষ্ট হোক। আর এ জন্যে তারা অন্যদেরকেও কূ-প্রবৃত্তি ও যৌন লালসার দাস বানানোর ষড়যন্ত্র করে। শেষের আয়াতটিতে আল্লাহ বলছেন,আমার বিধি বিধান কঠিন কিছু নয়। বরং মানুষের দূর্বল মনের কথা বিবেচনা করে বহু বিবাহ ও বিভিন্ন ধরনের বিয়ের বৈধ পন্থা দেখিয়ে দেয়া হয়েছে,যাতে তারা প্রবৃত্তির তীব্র তাড়নাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে এবং নিজেকে ও সমাজকে পবিত্র রাখতে পারে।
এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো,
• ধর্মীয় বিধি-বিধান মানবজাতির জন্য আল্লাহর অনুগ্রহ । কারণ,এসব বিধান মানুষকে জীবন যাপনের সঠিক পথ দেখায়।
• যৌন কামনা মানুষের অন্যান্য কামনার মতই স্বাভাবিক ও প্রাকৃতিক। কিন্তু অবাধ যৌনাচার ও অবৈধ সম্পর্ক পরিবার ব্যবস্থা এবং সমাজ ব্যবস্থাকেও ধ্বংস করে।
• ইসলাম সহজ সরল কর্তব্য কাজের ধর্ম এবং সব সমস্যার সমাধান দিতে পারে বলে এ ধর্মে অচলাবস্থার কোন অবকাশ নেই। তাই, ইসলাম ধর্মের মূল ভিত্তি হলো,বিভিন্ন দায়িত্বের পরিধি বর্ণনা করা যাতে সেগুলো পালন করা মানুষের পক্ষে সম্ভব হয়।
এবারে সুরা নিসার ২৯ ও ৩০ নম্বর আয়াত নিয়ে আলোচনা করা যাক। এই দুই আয়াতে বলা হয়েছে, "হে বিশ্বাসীগণ,তোমরা একে অপরের সম্পত্তি অন্যায়ভাবে গ্রাস করো না,কিন্তু পরস্পরের সম্মতির ভিত্তিতে তোমাদের মধ্যে ব্যবসা বৈধ এবং তোমরা নিজেদের হত্যা করো না,আল্লাহ তোমাদের প্রতি পরম দয়াময় এবং যে কেউ সীমালংঘন করে এবং অন্যায়ভাবে তা করবে,সে শিগগিরই আগুনে দগ্ধ হবে। আল্লাহর পক্ষে এটা খুবই সহজ।
আগের আয়াতে চারিত্র্যিক পবিত্রতা রক্ষা এবং কারো সম্ভ্রমহানি করা ও ব্যভিচার থেকে দূরে থাকার জন্য মানুষকে আহবান জানানোর পর এই দুই আয়াতে অন্যের সম্পদ ও জীবনের ওপর আগ্রাসন চালানো থেকেও বিরত থাকতে বলা হয়েছে। মহান আল্লাহ বলছেন, অন্যদের জীবন ও সম্পদকে নিজের জীবন ও সম্পদের মতই গুরুত্ব দেবে। অন্যের ওপর অত্যাচার এবং অন্যের সম্পদ গ্রাস করা অবৈধ। অবশ্য পারস্পরিক সন্তুষ্টির ভিত্তিতে ব্যবসায়িক লেনদেন বৈধ। অন্যদের হত্যার মত আত্মহত্যা ও অত্যাচারী ও আগ্রাসী মানসিকতারই লক্ষণ। তাই আত্মহত্যার জন্যেও কঠোর শাস্তি ভোগ করতে হবে। পরকালে জাহান্নামের আগুন হত্যাকারীদেরকে দগ্ধ করবে।
এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো,
প্রথমত : ইসলামে ব্যক্তি-মালিকানা স্বীকৃত এবং ব্যক্তির মালিকানাকে ইসলাম সম্মান করে। তাই ব্যক্তিগত সম্পদের লেনদেনের ক্ষেত্রে মালিকের সন্তুষ্টিকে প্রধান শর্ত করা হয়েছে।
দ্বিতীয়ত : সঠিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার অভাবেই সমাজে বৈষম্য,হত্যাকাণ্ড ও দ্বন্দ্ব দেখা দিচ্ছে।
তৃতীয়ত : মানুষের জীবনের প্রতি শ্রদ্ধা দেখাতে হবে। নিজেকে এবং অন্যদের হত্যা করা সম্পূর্ণ হারাম।
চতুর্থত : আল্লাহ তার বান্দাদের প্রতি দয়ালু । কিন্তু আল্লাহ অত্যাচারীদের প্রতি অত্যন্ত কঠোর। কারণ,আল্লাহর কাছে মানুষের অধিকার সবচেয়ে বেশী গুরুত্বপূর্ণ।
এবারে সুরা নিসার ৩১ নম্বর আয়াতের দিকে নজর দেয়া যাক । এই আয়াতে বলা হয়েছে, "হে ঈমানদারগণ,তোমরা যদি নিষিদ্ধ ঘোষিত বড় বড় পাপ থেকে দূরে থাক, তাহলে আল্লাহ তোমাদের ছোট পাপগুলো গোপন রাখবেন এবং তোমাদেরকে সম্মানজনক স্থান দেবেন।"
এই আয়াত থেকে যেটা বোঝা যায়, তা হলো, গোনাহ বা পাপ আল্লাহর কাছে দু'ধরনের। প্রথমত : ছোট গোনাহ ও দ্বিতীয়ত : বড় গোনাহ। অবশ্য এটা স্পষ্ট যে, গোনাহ বড় হোক বা ছোট হোক তা আল্লাহর নির্দেশের বিরোধী বলে খুবই নোংরা ও অপছন্দনীয় কাজ। পাপের পরিণতি এবং এর কুফলের ব্যাপকতা অনুযায়ী গোনাহকে ছোট ও বড় গোনাহ এ দু'ভাগে ভাগ করা যায়। বিভিন্ন হাদীসে ও বর্ণনায় এসব গোনাহর বৈশিষ্ট্য বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। যে গোনাহর পরিধি বা সীমানা যত বেশী বিস্তৃত এবং যে গোনাহ যত বেশী মানুষ, পরিবার ও সমাজের ক্ষতি করে তাকে তত বড় বা কুৎসিততর গোনাহ বলা হয়। একজন সাধারণ মানুষ কোন ছোট গোনাহ করলে তাকে ছোট গোনাহ বলে ধরা হয়। কিন্তু কোন বড় ব্যক্তিত্ব বা নেতা যেমন কোটি জনতার নেতা যদি খুব ছোট গোনাহও করে থাকেন তাহলেও তা বহু মানুষের বিভ্রান্তির জন্য দায়ী বলে তাকে অনেক বড় গোনাহ বলে ধরা হয়। মোট কথা ,এই আয়াতে আল্লাহ দয়াপরবশ হয়ে বলছেন,মানুষ যদি বড় বড় গোনাহ থেকে দূরে থাকে তাহলে আমি তাদের ছোট ছোট গোনাহ উপেক্ষা করবো এবং তাদেরকে ক্ষমা করে তাদেরকে বেহেশতে স্থান দেব।
এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো,
প্রথমত : আল্লাহ মানুষের ছোট-খাট অপরাধ মাফ করে দেবেন। তাই আমাদেরও উচিত অন্যদের ছোট-খাট অপরাধ ক্ষমা করে দেয়া,সামান্য অপরাধের ব্যাপারে ছিদ্রান্বেষী হওয়া উচিত নয়।
দ্বিতীয়ত : যদি আমাদের কাজ কর্ম ও চিন্তাধারার মূলনীতি সঠিক হয়, তাহলে আমরা তওবা করার আগেই আল্লাহ আমাদের ছোট-খাটো অপরাধ ক্ষমা করে দেবেন।
তৃতীয়ত : আমরা যেন মানুষের সম্ভ্রম,সম্পদ ও জীবনের ওপর সব ধরনের আগ্রাসন থেকে দূরে থাকতে পারি এবং আল্লাহর বিধান যথাযথভাবে মেনে চলতে পারি।
(৩২ - ৩৩ আয়াত)
আজকের আসরে সূরা নিসার ৩২ ও ৩৩ আয়াতের অনুবাদ ও সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা উপস্থাপন করা হবে। ৩২ নং আয়াতে বলা হয়েছে, "যার মাধ্যমে আল্লাহ তোমাদের কাউকে কারো ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন, তোমরা তার লালসা করো না। পুরুষ যা অর্জন করে,তা তার প্রাপ্য অংশ এবং নারী যা অর্জন করে,তা তার প্রাপ্য অংশ। তোমরা আল্লাহর অনুগ্রহ প্রার্থনা কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ সব বিষয়ে অবহিত।"
সৃষ্টি জগত পার্থক্য ও বৈচিত্র্যে ভরপুর। মহান আল্লাহ সৃষ্টি জগত পরিচালনার জন্য মানুষ, উদ্ভিদ, নানা জীব-জন্তু, কীট-পতঙ্গ ও সরিসৃপসহ বহু জীবন্ত সত্ত্বা সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহ মানুষের মধ্যেও একদলকে নারী ও অন্য একদলকে পুরুষ হিসেবে সৃষ্টি করেছেন। প্রত্যেক মানুষের শারীরিক ও মানসিক গঠন ভিন্ন ধরনের। সৃষ্টিজগত এত বিশাল হওয়া সত্ত্বেও এর যথাযথ পরিচালনার জন্যেও শতশত কোটি সৃষ্টি বা অস্তিত্বের প্রয়োজন। আর প্রতিটি সৃষ্টিরই রয়েছে বিশেষ দায়িত্ব। তেমনি মানব সমাজেও শারীরিক ও মানসিক দিক থেকে প্রত্যেক মানুষেরই বিশেষ মেধা ও ক্ষমতা থাকায় সমাজের বিভিন্ন চাহিদা পূরণ সম্ভব হয়। মানুষের মধ্যে এসব পার্থক্যের অর্থ কিন্তু বৈষম্য নয়। তার কারণ হচ্ছে,
প্রথমত : আল্লাহর কাছে কোন সৃষ্টিরই কোন পূর্ব প্রত্যাশা ছিল না, যে কেউ তার দাবী করতে পারে।
দ্বিতীয়ত : মানুষের মধ্যে এই পার্থক্য কৌশলময়। জুলুম, হিংসা বা কৃপণতার কোন ভূমিকা এতে নেই। তবে, আল্লাহ যদি সব সৃষ্টি বা মানুষের কাছে একই ধরনের কাজের আশা করেন, তাহলে তা হবে অন্যায়। কারণ, সবাই একই ধরনের ক্ষমতা, শক্তি ও সুযোগ-সুবিধার অধিকারী নয়। কোরআন ও হাদীসের বর্ণনা অনুযায়ী আল্লাহ মানুষের কাছ থেকে তাদের সামর্থ অনুযায়ী কাজ আশা করেন। যেমন, সুরা তালাক্কের সপ্তম আয়াতে আল্লাহ বলেছেন, আল্লাহ কারো কাছ থেকেই তার জন্য অপির্ত দায়িত্বের বেশী কিছু চান না। অবশ্য মানুষ ও অন্যান্য সৃষ্টির মধ্যে একটা বড় পাথর্ক্য হলো, একমাত্র মানুষই চিন্তাভাবনার ক্ষমতা রাখে এবং সৎ পথ বা অধঃপতনের পথ বেছে নেয়ার ক্ষেত্রে স্বাধীন। তাই স্বাভাবিকভাবেই অর্জন যোগ্য বিষয়ে মানুষের উন্নতি নির্ভর করে তাদের প্রচেষ্টার ওপর। এ ক্ষেত্রে অলসতা ও নিস্ক্রিয়তার জন্য আল্লাহ দায়ী নন। তাই এ আয়াতে মানুষের ক্ষমতার বাইরে থাকা আল্লাহর নেয়ামতগুলোর কথা ও মানুষের পক্ষে অর্জনের যোগ্য বিভিন্ন নেয়ামতের কথা উল্লেখ করে আল্লাহ বলছেন, আল্লাহ কোন কোন মানুষকে এমন বৈশিষ্ট্য দান করেছেন যা অন্য অনেককেই দেননি,ফলে তা নিয়ে তোমরা একে অপরকে হিংসা করো না। এ ক্ষেত্রে অসম্ভব কিছু কামনা করা উচিত নয়। আর অর্জন যোগ্য বিষয়ে নারী ও পুরুষেরা তাদের প্রচেষ্টার ফলই পেয়ে থাকে। তোমরাও চেষ্টা ও পরিশ্রম কর এবং তা যেন সফল হয় সে জন্যে আল্লাহর দয়া প্রার্থনা কর।
এই আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো,
প্রথমত : অন্যদের প্রতিভা ও নেয়ামতের দিকে নজর না দিয়ে আমাদের নিজেদের যোগ্যতা, প্রতিভা এবং সুযোগ-সুবিধের দিকে লক্ষ্য করা উচিত। অন্যের নেয়ামতের ব্যাপারে হিংসা না করে নিজের নেয়ামত ও প্রতিভাকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করতে হবে।
দ্বিতীয়ত : অসম্ভব আকাঙ্খা বা দূরাশার মূলোৎপাটন করতে হবে। কারণ, দূরাশাই নৈতিক অধপতনের অন্যতম মূল কারণ।
তৃতীয়ত : মানুষের নিজের চেষ্টা ও অধ্যবসায় গুরুত্বপূর্ণ হলেও আমাদের আায় উপার্জনে আল্লাহর কোন ভূমিকা নেই এমন ধারণা করা উচিত নয়। আমরা চেষ্টাও করবো এবং আল্লাহর কাছেও সাহায্য চাইবো।
চতুর্থত : পুরুষের মত মহিলারাও মালিকানার অধিকারী হতে পারেন। মোহরানা বা উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া সম্পত্তি ছাড়াও মহিলারা চাকরী ও ব্যবসার মাধ্যমে সম্পদের মালিক হতে পারেন।
এবারে সুরা নিসার ৩৩ নম্বর আয়াত নিয়ে আলোচনা করবো। এই আয়াতে বলা হয়েছে, "আমি প্রত্যেকের জন্য উত্তরাধিকার বা মীরাস নির্ধারণ করেছি, যা তাদের বাবা,মা ও আত্মীয় স্বজন ত্যাগ করে যায় এবং তোমরা যাদের সাথে অঙ্গীকারবদ্ধ তাদের অংশ প্রদান কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ সব বিষয়ে সাক্ষী।"
আগের আয়াতে বলা হয়েছে নারী ও পুরুষ যা অর্জন করে তা তাদের নিজস্ব সম্পদ। আর এই আয়াতে বলা হচ্ছে, প্রত্যেক নারী ও পুরুষ উত্তরাধিকার সূত্রে যা পায়,সেগুলোও তাদের নিজস্ব সম্পদ। এরপর আরো বলা হয়েছে, উপার্জন ও উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া সম্পদ ছাড়াও কারো সাথে বৈধ চুক্তির ভিত্তিতে মানুষ যেসব সম্পদ অর্জন করে, সেগুলোর মালিকও তারাই। ইসলাম পূর্ব যুগে আরবদের মধ্যে এক ধরনের চুক্তি প্রথা প্রচলিত ছিল। এই প্রথা অনুযায়ী দুই ব্যক্তি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হত যে, তারা জীবনে একে অপরকে সহায়তা করবে। একজন কোন ক্ষতির সম্মুখীন হলে অন্যজন সেই ক্ষতিপূরণ করবে এবং তাদের কারো মৃত্যুর পরে অন্যজন মৃত ব্যক্তির সম্পদ উত্তরাধিকার হিসেবে ভোগ করবে। ইসলাম অনেকটা বীমার মত এই চুক্তিপ্রথা মেনে নিয়েছে। তবে এ ক্ষেত্রে উত্তরাধিকার পাবার জন্য মৃত ব্যক্তির উত্তরাধিকারী না থাকার বিষয়কে শর্ত করে দিয়েছে।
এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো,
প্রথমত : ইসলামের উত্তরাধিকার আইন সম্পূর্ণরূপে খোদায়ী আইন। কেউ এর মূলনীতি বা এর কোন অংশ বিশেষে পরিবর্তন আনার অধিকার রাখেনা।
দ্বিতীয়ত : চুক্তি ও প্রতিজ্ঞা পালন করা ধর্মীয় দৃষ্টিতেও ফরজ বা অবশ্য পালনীয়। বিশেষ করে, যেসব চুক্তি অর্থ লেন-দেন সম্পর্কিত তা মেনে চলা বাধ্যতামূলক। কারণ, এসব চুক্তি লঙ্ঘনের ফলে অন্যপক্ষ আর্থিকভাব ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
তৃতীয়ত : প্রতিজ্ঞা এবং চুক্তিকে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মৃত্যুর পরও কার্যকরী রাখতে হবে। মৃত্যুর কারণে চুক্তির অমর্যাদা করা উচিত নয়।
( আয়াত- ৩৪)
আজকের আসরে আমরা সূরা নিসার ৩৪ নং আয়াতের ওপর আলোচনা করবো। এ আয়াতে বলা হয়েছে,"পুরুষেরা নারীদের অভিভাবক ৷ কারণ, আল্লাহ তাদের একের ওপর অপরকে শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন এবং পুরুষেরা নিজের ধন-সম্পদ থেকে ব্যয় করে ৷ সতী-সাধবী স্ত্রীরা অনুগত এবং বিনম্র ৷ স্বামীর অনুপস্থিতিতে তারা তাঁর অধিকার ও গোপন বিষয় রক্ষা করে ৷ আল্লাহই গোপনীয় বিষয় গোপন রাখেন৷ যদি স্ত্রীদের অবাধ্যতার আশংকা কর তবে প্রথমে তাদের সৎ উপদেশ দাও ৷ এরপর তাদের শয্যা থেকে পৃথক কর এবং তারপরও অনুগত না হলে তাদেরকে শাসন কর ৷ এরপর যদি তারা তোমাদের অনুগত হয়, তবে তাদের সাথে কর্কশ আচরণ করো না৷ নিশ্চয়ই আল্লাহ সমু্ন্নত-মহীয়ান ৷"
পবিত্র কোরআনের এই আয়াতে স্বামী ও স্ত্রীর পারস্পরিক সম্পর্কের ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা দেয়া হয়েছে ৷ কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপার হলো, পবিত্র কোরআনের পারিবারিক বিষয় সম্পর্কিত অনেক আয়াতের মত এই আয়াতেরও অপব্যবহার বা অপব্যাখ্যার সুযোগে কিছু অজ্ঞ লোক ইসলাম ধর্ম ও পবিত্র কোরআন সম্পর্কে প্রশ্ন সৃষ্টি করছে এবং এসব নিয়ে ঠাট্টা বিদ্রুপ করে থাকে ৷ অজ্ঞ ও অসুস্থ শ্রেণীর একদল পুরুষ এ আয়াতের ভিত্তিতে নিজেদেরকে মালিক এবং স্ত্রীদেরকে বাদী বা দাসী বলে মনে করে ৷ তাদের মতে, স্ত্রীদেরকে অন্ধের মত স্বামীর যে কোন নির্দেশ মানতে হবে এবং স্ত্রীদের সিদ্ধান্ত নেয়ার বা মত প্রকাশের কোন অধিকার নেই ৷ এইসব পুরুষদের ভাবখানা এমন যে, তাদের যে কোন নির্দেশ যেন খোদারই নির্দেশ এবং স্ত্রীরা তাদের নির্দেশ অমান্য করলেই তাদেরকে কঠোর শাস্তি দিতে হবে৷ এই বিভ্রান্তির কারণ হলো আয়াতের প্রকৃত অর্থকে গুরুত্ব না দিয়ে নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গী অনুযায়ী অর্থ করা ৷ এই আয়াতের প্রকৃত অর্থ হলো, আয়াতের প্রথম অংশে পুরুষদেরকে পরিবারের ও স্ত্রীদের সব বিষয়ের তত্ত্বাবধায়ক বা অভিভাবক বলা হয়েছে ৷ আধুনিক সমাজ-বিজ্ঞানে পরিবারকে বৃহত্তর সমাজের প্রথম ও প্রধান একক বলে গুরুত্ব দেয়া হয় ৷ একজন পুরুষের সাথে একজন নারীর বিয়ের মাধ্যমেই এই পরিবার গঠিত হয় এবং সন্তান সন্তুতি জন্মের ফলে পরিবারের আয়তন বৃদ্ধি পায় ৷ স্বাভাবিকভাবেই পরিবার নামের এই ছোট্ট সমাজের বিভিন্ন দিক পরিচালনার জন্যে একজন পরিচালক থাকা দরকার ৷ তা-না হলে পরিবারে বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্য দেখা দেবে৷ পরিত্র কোরআন নারী ও পুরুষ তথা স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে স্বামীকে দুটি কারণে পরিবারের পরিচালক বলে উল্লেখ করেছে ৷ প্রথমত : পুরুষরা মহিলাদের চেয়ে শারীরিক দিক থেকে বেশী শক্তিশালী৷ আর তাই পুরুষদের আয় উপার্জন ও পরিশ্রমের ক্ষমতা বেশী৷ আর দ্বিতীয় যুক্তি হলো, জীবন যাপনের সমস্ত খরচ যেমন- খাদ্য,বাসস্থান,পোশাক ও জীবন যাপনের অন্যান্য সব খরচ যোগানোর দায়িত্ব স্বামীর৷ অন্যদিকে ইসলামের দৃষ্টিতে নিজের ও সংসারের কোন ধরনের খরচ যোগানোর সামান্য বাধ্যবাধকতাও স্ত্রীর নেই এমনকি তাঁর নিজস্ব আয় উপার্জন থাকলেও তা খরচ করা তার জন্য জরুরী নয়৷ অন্যকথায়, ইসলাম পরিবারের কল্যাণ ও সুখ সমৃদ্ধি কঠিন দায়িত্ব পুরুষের ওপর অর্পন করেছে৷ আর এই দায়িত্ব পালনের জন্য পরিবার বিষয়ের সমস্ত ক্ষমতা পুরুষের ওপর ন্যস্ত করা হয়েছে৷ পুরুষরা এ ক্ষেত্রে দায়িত্বশীল হলেও স্ত্রীদের ওপর বলদর্পী বা কতৃত্বকামী হবার কোন অধিকার তাদের নেই৷ পরিবার পরিচালনার ক্ষেত্রেই পুরুষের দায়িত্ব সীমিত৷ নিজের কোন কাজে স্ত্রীকে দাসী হিসেবে ব্যবহার করা বা স্ত্রীর ওপর জুলুম করার কোন অধিকার পুরুষের নেই৷ পুরুষ বা স্বামী যখন কোন অন্যায় করে বা স্ত্রীর ভরণ পোষণের খরচ দিতে অস্বীকার করে কিংবা স্ত্রী ও সন্তান সন্ততির জীবন দূর্বিষহ করে তোলে তাহলে স্ত্রীর অনুরোধে বিচারক বা কাজী এক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ করতে পারে৷ এমনকি প্রয়োজন হলে পুরুষ বা স্বামীকে তার অঙ্গীকার পূরণে বাধ্য করতে পারে৷
সামগ্রীকভাবে এটা মনে রাখতে হবে যে, পারিবারিক পরিবেশে পুরুষের পরিচালনার অর্থ কোনক্রমেই স্ত্রীর ওপর পুরুষের কতৃত্ব নয় ৷ নারী ও পুরুষ তথা মানুষের মধ্যে শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি হলো খোদাভীতি ও ঈমান৷ আয়াতের দ্বিতীয় অংশে দুই ধরনের স্ত্রীর কথা বলা হয়েছে৷ সতী স্ত্রীরা পারিবারিক ব্যবস্থার প্রতি অঙ্গীকারাবদ্ধ৷ তারা শুধু স্বামীদের উপস্থিতিতেই নয়, তাদের অনুপস্থিতিতেও স্বামীর ব্যক্তিত্ব, গোপনীয়তা ও অধিকার রক্ষা করে৷ এই শ্রেণীর স্ত্রীরা প্রশংসা পাবার যোগ্য৷ অন্য এক শ্রেণীর স্ত্রী দাম্পত্য জীবনে স্বামীর অনুগত নয় ৷ এ ক্ষেত্রেই আল্লাহ পবিত্র কোরআনে বলেছেন, "স্ত্রীর অবাধ্যতার আশংকা থাকলে তাদেরকে উপদেশ দাও ও সতর্ক কর। "
যদি উপদেশ দেয়া ও সতর্ক করার পরও কাজ না হয় তাহলে স্বামী তার ওপর রাগ করে কিছুকাল দাম্পত্য জীবনে স্ত্রীকে উপেক্ষা করতে পারে এবং এভাবে তার উপর নিজের ক্ষোভ বা অসন্তুষ্টি প্রকাশ করতে পারে ৷ যদি এরপরও স্ত্রী দাম্পত্য জীবনের দায়িত্ব পালনে বিরত হয় এবং কিছুটা কঠোর হওয়া ছাড়া অন্যকোন পথ বাকী না থাকে তাহলে স্ত্রীকে শাসন করার অনুমতি স্বামীকে দেয়া হয়েছে ৷ অবশ্য হালকা ও মোলায়েম শাসন স্ত্রীকে তার ভুল ধরিয়ে দিতে পারে ৷ স্ত্রীর অবাধ্যতার মাত্রা অনুযায়ী যে তিন পর্যায়ের ব্যবস্থার কথা পবিত্র কোরআনে উল্লেখ করা হয়েছে তা স্ত্রীর সাথে স্বামীর সম্ভোগ সম্পর্কিত ৷ অনেক সময় স্ত্রীরা কথাবার্তার মাধ্যমে স্বামীর অবাধ্য হয় ৷ এক্ষেত্রে মৌখিক উপদেশই যথেষ্ট ৷ কখনো কখনো স্ত্রীরা কাজ কর্মের মাধ্যমে স্বামীর অবাধ্য হয় ৷ এক্ষেত্রে কাজের মাধ্যমে ব্যবস্থা নিতে হবে এবং স্ত্রীর শয্যা থেকে দূরে থাকতে হবে ৷ কিন্তু অনেক সময় স্ত্রীর অবাধ্যতার মাত্রা হয় অত্যন্ত কঠোর ৷ এ অবস্থায় শারীরিকভাবে তাকে শাসন করা উচিত ৷ একইভাবে স্বামী যদি তার দায়িত্ব পালনে বিমূখ হয় তাহলে বিচারকের মাধ্যমে তার বিচার এবং প্রয়োজনে শারীরিকভাবেও তাকে শাসন করতে হবে ৷ কারণ স্ত্রীর ভরণ-পোষণ করা স্বামীর দায়িত্ব সত্ত্বেও তা থেকে বিমূখ হওয়া স্ত্রীর অধিকারের লঙ্ঘন এবং তাই বিয়ের চুক্তির লঙ্ঘনের দায়ে আদালতে স্বামীর বিচার হতে পারে ৷ কিন্তু স্বামী স্ত্রীর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক পারিবারিক ও ব্যক্তিগত হওয়ায় ইসলাম এ ধরনের সমস্যা পরিবারের মধ্যেই মিটিয়ে ফেলাকে প্রাধান্য দেয় ৷ পুরুষ যেখানে তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে বাদী সেখানে স্ত্রীকে শারীরিকভাবে শাসন করার ক্ষমতা থাকার কারণে তা প্রয়োগ করা হলে পরিবারের সম্মান ক্ষুন্ন হবে ৷আগেই বলা হয়েছে,এই শাসন হতে হবে অবশ্যই মোলায়েম, কঠোর বা প্রতিশোধ মূলক নয় ৷ ইসলামের এই বিধানের দিকে তাকালে দেখা যাবে, ইসলাম বিভিন্ন পর্যায়ে অত্যন্ত সুক্ষ্ম পন্থায় পরিবার ব্যবস্থাকে ক্ষতি ও ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষার ব্যবস্থা নিয়েছে ৷
এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো,
স্বামীর আনুগত্য করা দূর্বলতার লক্ষণ নয় বরং পরিবারের প্রতি সম্মান ও পরিবার টিকিয়ে রাখার জন্যই তা জরুরী ৷
শুধু নামায রোজাই সত্‍ কাজ নয় পরিবারের অধিকার রক্ষা এবং পারিবারিক দায়িত্ব পালনও সত্কাজের অন্তর্ভূক্ত ৷
এছাড়া স্ত্রীর ভুল বা অপরাধের ব্যাপারে অজুহাত প্রবণ বা প্রতিহিংসা পরায়ণ হওয়া উচিত নয়৷ তাঁর কল্যাণ ও সংশোধনের ইচ্ছাকেই এ ক্ষেত্রে আচরণের মাপকাঠি করতে হবে৷ পুরুষদের এটা মনে রাখতে হবে, পরিবার পরিচালনার দায়িত্বটা তাদের ওপর অর্পণ করা হলেও আল্লাহ তাদের আচরণ ও তৎপরতা লক্ষ্য করছেন এবং স্ত্রী ও সন্তানদের সাথে আচরণের ব্যাপারে কিয়ামতের দিন জবাবদিহি করতে হবে ৷
( ৩৫ থেকে ৩৯ আয়াত )
আজকের আসরে সূরা নিসার ৩৫ থেকে ৩৯ আয়াতের অনুবাদ ও সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা উপস্থাপন করা হবে। প্রথমেই দেখা যাক ৩৫ নং আয়াতে কি বলা হয়েছে-
"যদি তোমরা উভয়ের মধ্যে বিচ্ছেদের আশঙ্কা কর,তবে তার বংশ থেকে একজন সালিশ নিয়োগ কর৷ যদি তারা মীমাংসা কামনা করে,তবে আল্লাহ তাদের মধ্যে মীমাংসার অনুকূল অবস্থা সৃষ্টি করবেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বজ্ঞ এবং সবার মনের কথা জানেন ৷"
এই আয়াতে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে মতভেদ দ্বন্দ্ব নিরসনের জন্য পারিবারিক আদালত গঠনের প্রস্তাব দিয়ে বলা হচ্ছে, যদি স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়া বিবাদ চরমে পৌঁছে, তাহলে উভয় পক্ষের পরিবারকে এই দ্বন্দ্ব মিটিয়ে ফেলার উদ্যোগ নিতে হবে ৷ বিবাদ যেন তালাক পর্যন্ত না গড়ায় সেজন্য তাদেরকে সক্রিয় থাকতে হবে এবং স্বামী ও স্ত্রী উভয়ের অধিকার রক্ষার জন্য উভয় পক্ষের পরিবার থেকে একজন করে সালিশ বা মধ্যস্থতাকারী নিয়োগ করতে হবে ৷ সালিশদের কাজ হলো স্বামী ও স্ত্রীর আচরণ সংশোধনের লক্ষ্যে তাদের মধ্যে সমঝোতা সৃষ্টি করা৷ সমঝোতা প্রতিষ্ঠাই তাদের কাজ ৷ কারো বিচার করে শাস্তি দেয়া তাদের কাজ নয় ৷ ইসলামী এই প্রথার বিশেষ কিছু সুবিধে রয়েছে ৷
প্রথমত : এরফলে পারিবারিক সমস্যার কথা দুই পরিবারের বাইরে কেউ জানতে পারে না এবং এতে করে পরিবারের মর্যাদা অক্ষুন্ন থাকে৷
দ্বিতীয়ত : মধ্যস্থতাকারীরা সংশ্লিষ্ট পরিবারের মধ্য থেকে নির্বাচিত হওয়ায় পারিবারিক সমস্যা সমাধানের জন্য তারা আন্তরিক হয়ে থাকেন ৷
তৃতীয়ত : মধ্যস্থতাকারীরা উভয়পক্ষের মাধ্যমে মনোনীত হন বলে দু'পক্ষের পরিবারই তাদের রায় মেনে নেয় ৷
চতুর্থত : পারিবারিক আদালত সত্য ও মিথ্যা নির্ণয় বা স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে কোন একজনকে শাস্তি দেয়ার জন্য গঠিত হয় না ৷ কারণ,এসব প্রশ্ন তাদের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা আরো বাড়িয়ে দেয়৷ বরং পারিবারিক আদালত স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে মতভেদের বিষয়গুলো উপেক্ষা এবং উভয়ের মধ্যে সমঝোতা সৃষ্টির পথ নির্নয়ের চেষ্টা করে ৷
এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো,
প্রথমত : পরিবারগুলোর মধ্যে বিবাদ ও তিক্ততার ব্যাপারে আত্মীয় স্বজন এবং সমাজের দায়িত্ব রয়েছে ৷ তাদের উচিত নয় এ ব্যাপারে উদাসীন থাকা ৷ রোগ দেখা দেয়ার আগে জীবন প্রতিরোধের ব্যবস্থা নেয়া উচিত তেমনি তালাক বা বিচ্ছিন্নতা দেখা দেয়ার আগেই তা প্রতিরোধের ব্যবস্থা নিতে হবে ৷
দ্বিতীয়ত : সালিশ বা মধ্যস্থতাকারী নির্বাচনের ক্ষেত্রেও নারী ও পুরুষের সমান অধিকার রয়েছে ৷ উভয়ই শুধুমাত্র একজন মধ্যস্থতাকারী নিয়োগ করতে পারবেন৷
তৃতীয়ত : মানুষ যদি সৎ উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ কর্ম করে থাকে তাহলে আল্লাহও তাদেরকে সাহায্য করেন এবং এরফলে তারা ঐসব কাজে সফল হয়৷
এবারে সুরা নিসার ৩৬ নম্বর আয়াত নিয়ে আলোচনা করা যাক ৷
"তোমরা আল্লাহর বন্দেগী বা দাসত্ব কর ৷ কোন কিছুকে তার শরীক করবে না ৷ বাবা-মা আত্মীয়স্বজন এতিম বা দরিদ্র নিকট ও দূরের প্রতিবেশী সঙ্গী সাথী, পথচারী এবং তোমাদের অধিকারভূক্ত দাস দাসীদের প্রতি সদ্ব্যবহার করবে ৷ নিশ্চয়ই আল্লাহ দাম্ভিক ও অহংকারীকে ভালোবাসেন না৷"
একজন মোমেন ব্যক্তির পারিবারিক দায়িত্ব সম্পর্কিত কয়েকটি আয়াতের পর পরবর্তী কয়েকটি আয়াতে মোমেন ব্যক্তির সামাজিক দায়িত্বগুলোর কথা উল্লেখ করা হয়েছে৷ এই ধারাক্রমের কারণ হলো, মানুষ যেন এটা না ভাবে যে তারা শুধু স্ত্রী ও সন্তানদের ব্যাপারেই দায়িত্বশীল ৷ বরং আল্লাহর উপর ইমান রাখা ও আল্লাহর ইবাদত করা ছাড়াও মানুষের উচিত তাদের বাবা মা, আত্মীয়স্বজন , বন্ধু বান্ধব, প্রতিবেশী এবং দাসদাসী ও অধীনস্থদের সাথে ভালো ব্যবহার করা বা তাদের সেবায় নিয়োজিত থাকা ৷ বিশেষকরে এতিম ও অনাথদের ব্যাপারে দায়িত্ব অনুভূতি থাকা এবং তাদের সেবা ও উপকার করার ব্যাপারে উদাসীন না থাকা খুবই জরুরী ৷ একটি দুঃখজনক ব্যাপার হলো, অনেক ছেলে মেয়েরা বিয়ের পর বাবা মাকে ভুলে যায় এবং আত্মীয় স্বজনের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রাখে ৷
এ আয়াতের গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, দয়া ও দান খয়রাত করাকে মানুষের দায়িত্ব বলে উল্লেখ করা হয়েছে ৷ সাধারণত দরিদ্র ও নিঃস্বদের সাহায্য করার ক্ষেত্রে দান খয়রাত শব্দটি ব্যবহৃত হয় ৷ কিন্তু শুধু গরিব বা দরিদ্রদের দয়া করতে হবে এমন কোন বাধ্য বাধকতা নেই ৷ অন্যদের জন্য যেকোন ভালো বা কল্যাণকর কাজ করা উচিত ৷ যেমন- বাবা মায়ের সেবা করা এবং তাদেরকে ভালোবাসাও সবচেয়ে ভালো কাজের অন্যতম দৃষ্টান্ত ৷ আয়াতের শেষাংশে বাবা-মা , এতিম, বন্ধু-বান্ধব, প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজন ও পথচারীদের সাথে ভালো ব্যবহারের উপর জোর দেয়া হয়েছে এবং যারা এদের সাথে ভালো ব্যবহার করে না তাদেরকে অহংকারী ও দাম্ভিক বলে উল্লেখ করা হয়েছে ৷
এ আয়াতে শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো,
প্রথমত : এ আয়াতে যেমন আল্লাহর ইবাদত বন্দেগী করাকে মানুষের দায়িত্ব বলা হয়েছে তেমনি মানুষ ও আল্লাহর সৃষ্টির সেবা করা এবং তাদের দয়া করাকেও মানুষের দায়িত্ব বলে উল্লেখ করা হয়েছে ৷ এটাই ইসলাম ধর্মের পরিপূর্ণতা ও সামাজিক বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গীর প্রমাণ ৷
দ্বিতীয়ত : শুধুমাত্র নামায রোজা ও অন্যান্য আনুষ্ঠানিক ইবাদতই যথেষ্ঠ নয় ৷ জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রেও আল্লাহকে মনে রেখে তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য সাধনা করতে হবে ৷ তা না হলে মানুষ শিরকে জড়িয়ে পড়তে বাধ্য ৷
তৃতীয়ত : মহান আল্লাহর পর বাবা-মা, সন্তানদের জন্ম দেয়া ও লালন পালনে মৌখিক ভূমিকা রাখেন ৷ তাই বিভিন্ন দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি বাবা-মায়ের সন্তুষ্টি অর্জন ও তাদের সুখ এবং বিশ্রামের ব্যবস্থা করাও সন্তানের দায়িত্ব ৷ চতুর্থত: এতিম, প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব ও অধিনস্থ কর্মচারীদের অধিকার রক্ষা করা প্রত্যেক মানুষের জন্যেই জরুরী ৷
এই সূরার ৩৭ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তা'লা বলেছেন,"যারা কৃপণতা করে ও মানুষকে কৃপণতার শিক্ষা দেয় এবং আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে তাদের যা দান করেছেন তা গোপন করে , আল্লাহ তাদের ভালোবাসেন না ৷ তিনি সত্য প্রত্যাখ্যানকারীদের জন্য লাঞ্চনাদায়ক শাস্তি প্রস্তুত রেখেছেন৷"
এই আয়াতে বলা হচ্ছে, একদল মানুষ প্রচুর অর্থ ও সম্পদের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও নিজেরা তো দান খয়রাত করেই না একইসাথে অন্যরাও গরীবদের দান করুক তা চায় না৷ কৃপণতা এবং সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গী তাদের মধ্যে এত বিস্তৃত যে, এমনকি তারা নিজেদের বেলায়ও জীবন উপকরণ পরিপূর্ণভাবে ব্যবহার করে না৷ দরিদ্র ও বঞ্চিত মানুষেরা তাদের সম্পদের কথা জেনে ফেলে হয়তো হাত পাততে আসবে এ ভয়ে তারা সম্পদ লুকিয়ে রাখে ৷ পবিত্র কোরআন এই কৃপণতাকে ঈমানের পরিপন্থী বলে উল্লেখ করেছেন এবং এ ধরনের মানুষকে সত্য প্রত্যাখ্যানকারী বা কাফের হিসেবে অভিহিত করে বলেছে, কঠিন শাস্তি ও লাঞ্চনাই তাদের প্রাপ্য ৷
এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো,
প্রথমত : কৃপণতার মতো কোন কোন মানসিক রোগ অনেক শারীরিক রোগের মতই ব্যাপক ও সংক্রমক৷ কৃপণ লোকেরা অন্যদের দয়া ও দান খয়রাতের জন্যও বাধা ৷
দ্বিতীয়ত : আল্লাহর দেয়া বিভিন্ন নেয়ামতের শোকর করার একটা পন্থা হলো, নিয়ামতগুলোর কথা উল্লেখ্য করা ও সেগুলো ভোগ করা ৷ আল্লাহর দেয়া নিয়ামতের কথা গোপন করার অর্থ হলো নিয়ামতের প্রতি অকৃতজ্ঞতা ৷
এবারে সুরা নিসার ৩৮ ও ৩৯ নম্বর নিয়ে আলোচনা করবো ৷ এই দুই আয়াতে বলা হয়েছে, "যারা মানুষকে দেখানোর জন্য দান করে এবং পরকাল ও আল্লাহর প্রতি যাদের ঈমান নেই, আল্লাহ তাদের ভালোবাসেন না এবং যাদের সহচর শয়তান সে কতই না নিকৃষ্ট সঙ্গী ৷ যদি তারা আল্লাহ ও পরকালের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করতো এবং আল্লাহ তাদের যা দিয়েছেন তা থেকে দান করতো তাহলে তাদের কি ক্ষতি হতো ? আল্লাহ তাদের বিষয়ে ভালো জানেন৷"
আগের আয়াতের বক্তব্য পূর্ণ করার জন্য এই দুই আয়াতে বলা হচ্ছে, কৃপণতার মনোভাব মানুষকে আল্লাহ ও পরকালের উপর বিশ্বাস থেকে দূরে সরিয়ে নেয় ৷ কারণ যাকাত দেয়া ও দান খয়রাত করা ঈমানের জন্য জরুরী এবং যারা এই ফরয বা আল্লাহর নির্দেশিত অবশ্যপালনীয় কর্তব্য পালনে বিরত থাকে তারা নিজেদের সম্পদকে আল্লাহর চেয়েও বেশি গুরুত্ব দেয় ৷ সাধারণত এ ধরনের লোক কোন সময়ই তেমন কোন দান খয়রাত করে না ৷ যদি কখনো দান খয়রাত করেও থাকে তা সামাজিক মর্যাদা বা সম্মান রক্ষার জন্যে করে থাকে ৷
এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো,
প্রথমত : যারা লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে দান খয়রাত করে, তাদের ক্ষেত্রে দান করা আর না করার মধ্যে কোন পার্থক্য নেই ৷ বরং লোক দেখানোর দান খয়রাত গোনাহ বলে এজন্য শাস্তিও পেতে হবে ৷
(৪০-৪৩ আয়াত)
আজকের আসরে সূরা নিসার ৪০ থেকে ৪৩ আয়াতের অনুবাদ ও সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা উপস্থাপন করা হবে। এই সূরার চল্লিশ নং আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেছেন,"নিঃসন্দেহে আল্লাহ অণু পরিমাণও জুলুম করেন না এবং অণু পরিমাণ পূণ্যকার্য হলেও তিনি তা দ্বিগুণ করে দেন এবং আল্লাহ তার কাছ থেকে মহাপুরস্কার দান করে থাকেন ৷"
আগের আয়াতে বলা হয়েছে,যারা বঞ্চিত ও দরিদ্রদের দান খয়রাত করে না, তারা আল্লাহর নেয়ামতের ব্যাপারে কুফরি করছে অর্থাৎ আল্লাহর নেয়ামতকে অস্বীকার করছে এবং এই কুফরির জন্য তাদেরকে শাস্তি পেতে হবে ৷ আর এ আয়াতে বলা হচ্ছে, "আল্লাহর দেয়া শাস্তির অর্থ তিনি বান্দাদের ওপর জুলুম করেন না, বরং এসব শাস্তি মানুষেরই কাজের পরিণাম মাত্র ৷"
পাপের উৎস হল, হয় অজ্ঞতা অথবা ভুল চিন্তাধারা বা উন্মাদনা, কিংবা লোভ লালসা বা শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের খাহেশ৷ কিন্তু আল্লাহ এসব ত্রুটি বিচ্যুতি থেকে মুক্ত বলে, নিজের সৃষ্টির ওপর জুলুম করার কোন প্রয়োজনই তাঁর নেই৷ মানুষ নিজেই নোংরা কাজে লিপ্ত হয়ে নিজের ওপর জুলুম করে৷ আয়াতের অন্য অংশে বলা হয়েছে, "আল্লাহ সৎ কাজ করতে মানুষকে আহবান জানাচ্ছেন, যারা এই আহবানে সাড়া দিবেন আল্লাহ তাদেরকে দুনিয়া ও পরকালে পুরষ্কার দেবেন এবং সে পুরস্কার ও হবে কয়েকগুন ৷ এটা মানুষের প্রতি আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ।" অন্যান্য আয়াতে আল্লাহ আন্তরিক দান খয়রাতের জন্য ৭০০ গুন প্রতিদান দেয়ার কথা বলেছেন ৷
এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো,
*পৃথিবীতে আমাদের বিপদ ও দূর্যোগ আল্লাহর পক্ষ থেকে জুলুম নয়,বরং এগুলো আমাদের কৃপণতা এবং কুফরি মনোভাবের ফল৷ অর্থাৎ আমরা নিজেরাই নিজেদের ওপর জুলুম করি ৷
* আল্লাহ আনুপাতিক হারে পাপের শাস্তি দিয়ে থাকেন, পাপের তুলনায় এক বিন্দুও বেশী শাস্তি তিনি দেন না ৷ কিন্তু তিনি ভালো কাজের পুরষ্কার অনেকগুণ বেশী দিয়ে থাকেন ৷
এবারে সুরা নিসার ৪১ ও ৪২ নম্বর আয়াত নিয়ে আলোচনা করবো ৷ এই দুই আয়াতে বলা হয়েছে, "হে নবী সে দিন তাদের কি অবস্থা হবে,যখন আমি প্রত্যেক ধর্ম সম্প্রদায় থেকে একজন সাক্ষী উপস্থিত করব এবং আপনাকেও তাদের প্রতি সাক্ষী করবো ? যারা অবিশ্বাসী হয়েছে এবং নবী রাসুলদের বিরুদ্ধাচারণ করেছে, তারা সেদিন বলবে, হায়! আমরা যদি মাটির সাথে মিশে যেতাম ৷ আর সেদিন তারা আল্লাহর কাছে কোন কথাই গোপন করতে পারবে না ৷"
আল্লাহ যে কারো ওপর জুলুম করেন না, তার সবচেয়ে ভালো প্রমাণ হলো, পরকালে আল্লাহর বিচারালয়ে মানুষের কৃতকর্মের অনেক সাক্ষী থাকবে৷ মানুষের শরীরের বিভিন্ন অংশের সাক্ষ্য ছাড়াও, ফেরেশতাদের সাক্ষ্য এমনকি নবী রাসুলদেরও সাক্ষ্য নেয়া হবে৷ অবশ্য ইসলামের নবী (সঃ) তাঁর উম্মতদের সাক্ষী হওয়া ছাড়াও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী হিসেবে অন্যান্য নবীদের জন্যেও সাক্ষী হবেন৷পরকালের বিচারে নবীজির উপস্থিতি ও সাক্ষ্য দেখে বলবে হায়, আমাদের যদি জন্মই না হত কিংবা মৃত্যুর পর যদি চিরকাল মাটিতেই মিশে থাকতাম৷ কিন্তু তখন এই সব আক্ষেপ আর হা গুতাশ কোন কাজে আসবে না৷ কারণ,পৃথিবীতে তাদেরকে যে জীবন ও সময় সুযোগ দেয়া হয়েছে তা শেষ হয়ে গেছে৷ তাই কিয়ামতে এতসব সাক্ষ্য প্রমাণ থাকবে বলে কোন খারাপ কাজই ঢেকে রাখা যাবেনা ৷ এছাড়াও আল্লাহর কাছে কারো কোন কথা ও চিন্তাও গোপন থাকে না৷
এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো,
* মানুষের মানুষের কৃতকর্মের বড় সাক্ষী হবেন মানুষের বিচারের জন্য বিচার দিবসে আল্লাহ এটাই দেখবেন যে, কারা তাদের কাছে পাঠানো নবীদের নির্দেশ অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করেছে এবং কারা তা করেনি৷ আর এরই ভিত্তিতে তিনি মানুষকে শাস্তি বা পুরস্কার দিবেন৷
* কিয়ামত বা পুনরুত্থান হল অনুতাপ আর অনুশোচনার দিন৷ সেদিন অনেকেই বলবে, হায় যদি মাটি হতাম বা মাটি থেকে আবার আমাদের জীবিত করা না হত!
এবারে সুরা নিসার ৪৩ নম্বর আয়াতের অর্থ নিয়ে আলোচনা করা যাক৷ এই আয়াতে বলা হয়েছে, "হে মুমিনগণ,তোমরা মাতাল অবস্থায় নামাজের কাছে যেও না, যে পর্যন্ত তোমরা যা বল ,তা বুঝতে না পার৷ আর মুসাফির না হয়ে থাকলে অপবিত্র অবস্থায় নামাজের স্থান বা মসজিদেও যাবে না, যে পর্যন্ত না তোমরা গোসল করবে৷ তবে এসব স্থান অতিক্রম করা যাবে৷ আর যদি তোমরা অসুস্থ হও অথবা সফরে থাক, অথবা তোমাদের মধ্যে কেউ শৌচাগার থেকে আসে, অথবা তোমরা স্ত্রী-গমন কর এবং এসব ক্ষেত্রে পানি না পাও তাহলে পবিত্র মাটি দিয়ে তোমাদের মুখ ও হাত মুছে ফেল অর্থাৎ তায়াম্মুম কর৷ নিশ্চয়ই আল্লাহ পাপ মোচনকারী, ক্ষমাশীল৷"
এই আয়াতে নামাজের কিছু বিধান বর্ণনার আগে প্রথমে নামাজের মূল চেতনা বা আল্লাহর দিকে মনোনিবেশ করার কথা বলা হয়েছে৷ এরপর গোসল ও তায়াম্মুমের বিধান উল্লেখ করা হয়েছে ৷ নামাজসহ অন্যান্য ইবাদতের মূল লক্ষ্য হল মানুষ যেন তাঁর স্রষ্টার প্রতি স্থায়ীভাবে মনোযোগী হয় এবং একমাত্র আল্লাহর ওপরই নির্ভর করে৷ যে মানুষের হৃদয় আল্লাহর প্রেমে বা আল্লাহর আকর্ষণে বাঁধা, তিনি সব মুখাপেক্ষীতা ও সব নির্ভরশীলতা থেকে মুক্ত হন৷ তাই যেসব বিষয় মানুষকে নামাজে পূর্ণ সচেতনতার পথে বাধা সৃষ্টি করে, সে সব বর্জন করতে বলা হয়েছে৷ যেমন- এ আয়াতে মদ বা মাদকতা সৃষ্টিকারী দ্রব্য নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং অন্য কয়েকটি আয়াতে অসুস্থ ও তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় নামাজ না পড়ার নির্দেশ দেখা হয়েছে৷ নামাজে দাঁড়ালে মানুষকে এটা মনে রাখতে হবে যে, তাঁরা আল্লাহর সামনে উপস্থিত৷ তাঁদের এটাও বুঝতে হবে যে তাঁরা আল্লাহর সামনে কি বলছেন এবং আল্লাহর কছে কি প্রার্থনা করছেন ? মানুষের মনকে আল্লাহমুখী বা আল্লাহর প্রতি মনোযোগী করা ছাড়াও মানুষের শরীরকেও সব ধরনের কদর্যতা থেকে পবিত্র ও পরিষ্কার রাখতে হবে৷ তাই স্ত্রী- মিলনের পর বা অপবিত্র অবস্থায় নামাজ পড়া তো দূরের কথা নামাজের স্থান মসজিদেও যাওয়া যাবেনা৷ জরুরী অবস্থা দেখা দিলে মসজিদের এক দরজা দিয়ে প্রবেশ করে দ্রুত অন্য দরজা দিয়ে বেরিয়ে যেতে হবে৷ কিন্তু সফরে থাকা অবস্থায় ফরজ গোসলের জন্য প্রয়োজনীয় পানি পাওয়া না গেলে বা কোন অসুস্থতার কারণে পানি ব্যবহার করা ক্ষতিকর হলে মানুষ পবিত্র মাটি ছুঁয়ে তথা তায়াম্মুমের মাধ্যমে পবিত্র হয়ে নামাজ আদায় করতে বলা হয়েছে।
এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো,
নামাজ অর্থ শুধু বারবার কিছু কথা বলা আর অঙ্গভঙ্গী করা নয় ৷ নামাজের প্রাণ হলো আল্লাহর প্রতি মনোযোগ আর এ জন্যে সচেতনতা জরুরী ৷
মসজিদ ও ইবাদতের স্থান পবিত্র এবং এসবের মর্যাদা রয়েছে ৷ তাই অপবিত্র অবস্থায় এসব স্থানে যাওয়া উচিত নয়৷ মন ও শরীর পবিত্র করা আল্লাহর সামনে উপস্থিত হবার ও আল্লাহর সাথে কথা বলার পূর্বশর্ত ৷ সফর ও অসুস্থতার সময়ও নামাজ পড়তে হবে৷ তবে এসব ক্ষেত্রে নামাজের বিধানে কিছু ছাড় দেয়া হয়েছে৷
(৪৪-৪৭ আয়াত )
পবিত্র কোরআনের তাফসীর বিষয়ক অনুষ্ঠানের অনুরোধের এই আসরে আজ সূরা নিসার ৪৪ থেকে ৪৭ নং আয়াতের অনুবাদ ও সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা উপস্থাপন করা হবে। এ সূরার ৪৪ ও ৪৫ নং আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেছেন- "আপনি কি তাদের দেখেননি, যারা কিতাবের কিছু অংশ বা তাওরাত পেয়েছিল , কিন্তু তারা ভ্রান্ত পথ কিনে নিয়েছে এবং তারা চায় আপনিও পথভ্রষ্ট হন৷ আল্লাহ আপনার শত্রুদের অবস্থা ভালোভাবে জানেন, আল্লাহই অভিভাবক এবং সাহায্যকারী হিসেবে যথেষ্ট৷"
এই আয়াতে একদল ইহুদী পন্ডিতের কথা বলা হচ্ছে, যারা ইসলামের আবির্ভাবের সময় মদীনায় ছিলেন আল্লাহর বাণী সম্পর্কে জানার কারণে তারা ইসলামের নবী ও পবিত্র কোরআনের প্রতি সবার আগে ঈমান আনবেন এটাই ছিল স্বাভাবিক এবং কাঙ্ক্ষিত ৷ কিন্তু এর পরির্বতে তারা প্রথম থেকেই নবী করিম (সঃ)-এর সাথে শত্রুতা শুরু করে এমনকি মক্কার মুশরিকদের সাথেও তারা ঐক্যবদ্ধ হয়৷ এই আয়াতে তাদেরকে স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে যে, এই ইহুদী পন্ডিতরা তাওরাত বা ঐশি বাণীর সাথে পরিচিত হওয়া সত্ত্বেও তাকে নিজেদের ও অন্যদের জন্য মুক্তি এবং সৌভাগ্যের মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করেনি৷ বরং তারা অন্যদের পথভ্রষ্ট করতো এবং তাদের ঈমানের পথে বাধা সৃষ্টি করতো, এরপর মুসলমানদের উদ্দেশ্য করে আল্লাহ বলছেন, তোমরা তাদের শত্রুতার জন্য ভয় পেয়ো না৷ কারণ, তারা আল্লাহর কর্তৃত্ব থেকে মুক্ত নয়৷ আর তোমাদের জন্যে রয়েছে আল্লাহর সাহায্য৷
এই আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় দিক হচ্ছে
শুধুমাত্র আল্লাহর বাণী ও তাঁর বিধান সম্পর্কে জ্ঞানই মুক্তি এবং সৌভাগ্য অর্জনের জন্যে যথেষ্ট নয়৷ অনেক ধর্মীয় পন্ডিত নিজেরাও পথভ্রষ্ট ছিলেন এবং অন্যদেরকেও পথভ্রষ্ট করেছেন ৷ মুসলিম সমাজের আসল শত্রুরা ধর্ম ও জনগণের বিশ্বাসের শত্রু ৷ তারা সমাজের ভেতরে থাকুক বা বাইরেই থাকুক তাতে কোন পার্থক্য নেই ৷ আল্লাহর সাহায্য পাবার শর্ত হলো, তার মনোনীত প্রতিনিধি তথা ধর্মীয় নেতার আনুগত্য করা ৷ নিজের বা অন্যদের বস্তুগত বা দুনিয়াবী শক্তির ওপর নির্ভর করলে আল্লাহর সাহায্য পাওয়া যাবে না ৷
এবারে সুরা নিসার ৪৬ নম্বর আয়াত নিয়ে আলোচনা করবো ৷ এই আয়াতে বলা হয়েছে, "ইহুদীদের মধ্যে কিছু লোক মূল অর্থ থেকে তাদের কথার মোড় ঘুরিয়ে নেয় এবং বলে আমরা শুনেছি, কিন্তু অমান্য করছি ৷ তারা মহানবীর উদ্দেশ্যে বেয়াদবী করে আরো বলে, শোন, না শোনার মত৷ মুখ বাঁকিয়ে ধর্মের প্রতি তাচ্ছিল্য প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে তারা বলে "রায়িনা" বা আমাদের রাখাল ৷ অথচ তারা যদি বলতো যে, আমরা শুনেছি ও মান্য করেছি এবং যদি বলতো শোন ও আমাদের প্রতি লক্ষ কর তবে তা তাদের জন্য ভালো ও সংগত হতো। কিন্তু আল্লাহ তাদের প্রতি অভিশাপ দিয়েছেন, তাদের কুফরীর জন্য৷ তাই তাদের অতি অল্প সংখ্যকই ঈমান আনবে৷
ইসলামের শত্রুরা এই পবিত্র ধর্মের বিরোধীতা করেছে বিভিন্ন কুৎসিত পন্থায় ৷ এর মধ্যে অন্যতম হলো, ঠাট্রা-বিদ্রুপ করা ৷ এই আয়াতে এই সব বিদ্রুপের কয়েকটি দৃষ্টান্ত উল্লেখ করা হয়েছে৷ ইসলামের অকাট্য যুক্তির মোকাবেলা করতে ব্যর্থ হয়েই তারা এভাবে ইসলামের প্রতি বিদ্বেষ প্রকাশ করত ৷ যেমন- কোন কোন ইহুদী রাসুল (সঃ)'র সাথে কথা বলার সময় এমন সব শব্দ বা বাক্য ব্যবহার করত, যার ভাল ও মন্দ দু'রকম অর্থই হতে পারে ৷ এরা অবশ্য মুখ বিকৃত করে মন্দ অর্থেই ওই শব্দগুলো উচ্চারণ করতো৷ অথচ এমন ভাবও দেখাতো যে, তারা এসব ভালো অর্থেই বলছে ৷ মুসলমানরাও প্রতারিত হয়ে রাসুল (সঃ)'কে যেন এসব বাক্যে সম্বোধন না করে সেজন্যে এই আয়াত উল্লেখিত কয়েকটি শব্দ ছাড়াও সুরা বাকারার ১২ নম্বর রুকুতে "রায়িনা" শব্দটি দিয়ে রাসুলে খোদাকে সম্বোধন না করতে মুসলমানদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে৷ এসব ইহুদীরা রাসুলে খোদার সামনে বলতো "সামেনা" ও "আসাইনা" ৷ এর অর্থ আমরা শুনেছি ও তা অমান্য করেছি৷ এর ভালো অর্থ হচ্ছে আমরা অপনার বাণী শুনেছি এবং আপনার বিরোধীদের বিভ্রান্তিমূলক কথা অমান্য করেছি৷ কিন্তু এর খারাপ অর্থ হলো, আমরা আপনার কথা শুনেছি সত্য, কিন্তু আমরা তা আমল করবো না৷ দ্বিতীয় একটি বাক্য যা ঐ ইহুদীরা রাসুলের সামনে বলতো তা হলো, তোমরা আমার কথা শোন এবং আল্লাহ করুন, তোমাদেরকে তিনি যেন কোন কথাই না শোনান৷ এর ভাল অর্থ হলো, কোন কষ্টদায়ক কথা যেন শোনানো না হয়, অর্থাৎ আপনি যাই বলুন তার উত্তরে যেন আপনাকে কোন খারাপ কথা শুনতে না হয়৷ বরং যেন ভালো কথাই শোনেন৷ আর এর খারাপ অর্থ হলো, অনুকুল ও আনন্দদায়ক কোন কথাই যেন আপনাকে না শোনানো হয়৷ তৃতীয় বাক্য 'রায়েনা'র ভাল অর্থ হলো, আমাদের দিকে লক্ষ্য রাখুন বা আমাদেরকে বোঝার জন্য আরো সময় দিন ৷ এর মন্দ অর্থ হলো, বোকা বানানো৷ ইহুদীদের ভাষায় এটি একটি গালি হিসেবেও ব্যবহৃত হত৷ ইহুদীরা এসব দ্ব্যর্থবোধক কথা বলার পরিবর্তে স্পষ্ট শব্দগুলো ব্যবহার করতে পারতো ৷ যেমন- তারা সামেনা ও আসাইনার পরিবর্তে বলতে পারতো সামেনা ও আতাইনা অর্থাৎ আমরা শুনে নিয়েছি এবং মান্যও করেছি৷
"ইসমা গাইরা মুসমার" পরিবর্তে শুধু ইসমা বা আপনি শুনে নিন বলতে পারতো এবং রায়েনার পরিবর্তে বলতে পারতো উনজুরনা অর্থাৎ আমাদের মঙ্গলের দিকে লক্ষ্য রাখুন ৷ কিন্তু তারা এসব সমোয়োচিত ও মঙ্গলজনক কথা না বলে বিদ্রুপাত্বক কথাগুলো বলেছে৷ রাসুলের মনে কষ্ট দেয়ার জন্যে ঐসব ইহুদীরা আল্লাহর রহমত থেকে বঞ্চিত হয়৷ তাই তারা ঈমান আনতে পারেনি ৷ কিন্তু যেসব ইহুদী এসব কাজ থেকে দূরে ছিল তারা ঈমান আনতে পেরেছে ।
এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো,
*বিরোধীদের সাথেও ন্যায় আচরণ করতে হবে৷ এ আয়াতে সব ইহুদীদের নিন্দা করা হয়নি৷ একদল ইহুদীর খারাপ কাজের দায় তাদের সবার ওপর চাপানো যায় না৷
* ধর্মীয় বিধানই হোক বা ধর্মীয় নেতাই হোক তাদের কারো উদ্দেশ্যেই ঠাট্রা বিদ্রুপ করা জায়েজ নয়৷
* মানুষের মঙ্গল ও কল্যাণ নবীদের দাওয়াত গ্রহণ এবং খোদায়ী বিধান মেনে চলার ওপরই নির্ভর করছে ৷
এবারে সুরা নিসার ৪৭ নম্বর আয়াত নিয়ে আলোচনা করবো৷ এই আয়াতে বলা হয়েছে, "হে আহলে কিতাব! ইসলামের নবীর কাছে আমরা যা নাজিল করেছি, তার ওপর অর্থাৎ পবিত্র কোরআনের ওপর ঈমান আন যা তোমাদের কাছে অবতীর্ণ গ্রন্থগুলোর সত্যতার প্রমাণ দিচ্ছে ৷ এর ওপর বিশ্বাস কর, এমন হবার আগেই যখন আমি মুছে দিব অনেক চেহারা তারপর তাদেরকে পেছন থেকে উল্টিয়ে দেব, যেমন করে অভিশপ্ত করেছি শনিবার অমান্যকারী ইহুদীদেরকে ৷ আর আল্লাহর নির্দেশ কার্যকরী হবেই৷"
আগের আয়াতে আহলে কিতাব ও বিশেষ করে ইহুদীদের উদ্দেশ্যে বক্তব্যের পর এ আয়াতেও তাদের উদ্দেশ্যে বলা হচ্ছে, তোমরা তো আল্লাহর কিতাবের সাথে পরিচিত , তাই তোমাদের উচিত ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করা ৷ তোমরা তো মুশরিক বা অংশীবাদীদের মত নও যে, আল্লাহর ওপর ঈমানের অভিজ্ঞতা তোমাদের রয়েছে৷ এছাড়াও ইসলাম ধর্মের গ্রন্থ পবিত্র কোরআনের সাথে তোমাদের ধর্মীয় গ্রন্থেরও মিল ও সমন্বয় রয়েছে৷ কারণ, এসব গ্রন্থই একই আল্লাহর কাছ থেকে এসেছে৷ এরপর আল্লাহ একটি গুরুত্বপূর্ণ নীতির কথা উল্লেখ করে বলেছেন, তোমরা হিংসা ও একগুঁয়েমীর কারণে সত্যকে উপেক্ষা করে প্রকৃতপক্ষে নিজেদের চিন্তা ও মানবীয় প্রকৃতিকেই উপেক্ষা এবং বিকৃত করেছ৷ আর এর ফলে, তোমাদের মানবীয় চেহারা ধীরে ধীরে মুছে যাচ্ছে৷ মানুষের চিন্তা ভাবনা ও অভ্যাস শরীর ও চেহারায় প্রভাব ফেলে৷ তাই পবিত্র কোরআনে সত্য থেকে মানুষের দূরে থাকাকে চেহারা বিকৃত হওয়া এবং ক্রমেই মানবীয় চেহারা মুছে যাওয়ার সাথে তুলনা করেছে যা তাকে অধঃপতন ও চূড়ান্ত ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায়৷
এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো,
প্রথমত : অন্য ধর্মের অনুসারীদেরকে ইসলামের দিকে আহবানের সময় তাদের ভাল দিকগুলোকে স্বীকৃতি দেয়া ও মেনে নেয়া উচিত৷
দ্বিতীয়ত : সমস্ত খোদায়ী ধর্মের শিক্ষা এবং নবীদের বক্তব্য মূলত একই এবং এসবের উদ্দেশ্য বা লক্ষ্যেও কোন পার্থক্য নেই৷
তৃতীয়ত : ইসলাম ধর্ম একত্ববাদী অন্যান্য ঐশী ধর্মের অনুসারীদেরকেও আল্লাহর ওপর ঈমান আনতে এবং ইসলাম ধর্ম গ্রহণের আহবান জানায়৷
চতুর্থত : ধর্মকে অবমাননার জন্য পৃথিবীতেই শাস্তি নেমে আসে।
( ৪৮-৫২ আয়াত)
আজকের আসরে সূরা নিসার ৪৮ থেকে ৫২ নং আয়াতের অনুবাদ ও সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা উপস্থাপন করা হবে। তো শুরুতেই দেখা যাক ৪৮ নং আয়াতে কি বলা হয়েছে, "আল্লাহ তাঁর সাথে শরিক করার অপরাধ ক্ষমা করেন না,এ ছাড়া যাকে ইচ্ছে তার পাপ ক্ষমা করেন ৷ যে আল্লাহর শরিক করে সে মহাপাপ করলো৷"
আগের আয়াতে ইহুদী ও খ্রীষ্টানদের উদ্দেশ্যে কিছু সাবধান বাণী উচ্চারণের পর আল্লাহ এ আয়াতে মুসলমানদেরকেও এটা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন যে, যেসব বিশ্বাস বা কাজ মানুষকে খাঁটি একত্ববাদ থেকে দূরে সরিয়ে দেয় অর্থাৎ মানুষ যেসব কাজ বা বিশ্বাসের মাধ্যমে আল্লাহর সাথে অন্যকিছু বা কাউকে শরিক করে সেসব বড় গোনাহ ৷ আল্লাহ ক্ষমাশীল ও দয়ালু হওয়া সত্ত্বেও এইসব গোনাহ ক্ষমা করবেন না৷ কারণ, অংশীবাদিতা মানুষের ঈমানের ভিত্তিকে নষ্ট করে দেয়৷ আল্লাহর ক্ষমাশীলতা বলতে এখানে যা বোঝানো হয়েছে তা হলো, ক্ষমা না চাইলেও বা তওবা না করলেও আল্লাহ কোন কোন পাপ ক্ষমা করে দেন ৷ কিন্তু আল্লাহ শির্কের অপরাধ তওবা করে পুনরায় ঈমান না আনা পর্যন্ত ক্ষমা করেন না ৷ বিভিন্ন বর্ণনা অনুযায়ী পবিত্র কোরআনের এ আয়াত মুমিনদের জন্য সবচেয়ে আশাব্যাঞ্জক৷ কারণ,মুমিনদের গোনাহ যত বড় বা বেশীই হোক না কেন,তাদেরকে আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হতে নিষেধ করা হয়েছে৷
এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো,
শির্ক মানুষকে আল্লাহর রহমত থেকে দূরে সরিয়ে দেয় ৷ অংশীবাদী নিজেই নিজেকে আল্লাহর বিশেষ রহমত থেকে বঞ্চিত করে৷ আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করার অর্থ হলো, আল্লাহর ব্যাপারে মিথ্যা বলা এবং এটা আল্লাহর ওপর সবচেয়ে বড় অপবাদ৷
এবারে এই সূরার ৪৯ ও ৫০ নম্বর আয়াত নিয়ে আলোচনা করবো৷ এই দুই আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেছেন, "তুমি কি তাদের দেখনি ? যারা নিজেদের পবিত্র ও নিষ্পাপ মনে করে ? বরং আল্লাহই যাঁকে ইচ্ছা তাঁকে পবিত্র করেন, তাদের ওপর বিন্দুমাত্র জুলুম করা হবে না৷ লক্ষ্য কর, তারা কিভাবে আল্লাহ সম্পর্কে মিথ্যা অপবাদ আরোপ করছে এবং এটিই প্রকাশ্য পাপ হিসেবে যথেষ্ট৷"
এই আয়াতে আল্লাহ তা'লা বলছেন তোমরা কেন একে অপরকে বিভ্রান্ত এবং নিজেদেরকে সব সময় সঠিক ও নির্ভুল মনে করছ? অথচ আল্লাহ তোমাদের মনের খবর জানেন৷ তোমাদের মধ্যে কারা প্রশংসা পাবার যোগ্য সেটাও আল্লাহই ভালো জানেন৷ আল্লাহই কাজের মাধ্যমে মানুষকে অপবিত্রতা থেকে পবিত্র করেন এবং তাদের প্রশংসা করেন৷ অন্যকথায়, আল্লাহ যেসব বৈশিষ্ট্যকে ভালো মনে করেন, সেসবই হচ্ছে সৎগুন। স্বার্থপর ও অহংকারী লোকেরা যেসব বিষয়কে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি বলে মনে করে সেগুলো সৎগুন নয় ৷ এ ধরনের মানুষ ঐসব খারাপ দিককে আল্লাহর ওপরও চাপিয়ে দেয় ৷ এসব হলো, আল্লাহর ওপর মিথ্যা চাপিয়ে দেয়া তথা আল্লাহকে অপবাদ দেয়া ৷ ধার্মিক লোকেরা ধর্ম পালন করতে অহঙ্কারী হয়ে পড়লে তবে তা হবে মারাত্মক বিপর্যয়৷ এটা এমন এক বড় বিপদ যা ঐশী ধর্মের প্রত্যেক অনুসারীকেই ফাঁদে ফেলতে পারে ৷ ইসলাম ধর্ম অন্যান্য ধর্মের চেয়ে উন্নত বলে এটা ধরে নেয়া যায় না যে, প্রত্যেক মুসলমানই অন্যদের চেয়ে ভালো ৷ অর্থাৎ এ আয়াতে ধর্মীয় অহঙ্কারের বিপদ থেকে দূরে থাকতে মুসলমানদের সাবধান করে দেয়া হয়েছে৷ হযরত আলী (আঃ) বলেছেন ,"খোদাভীরু লোকেরা প্রশংসা শুনে ভয় পায়৷" খোদাভীরু লোকেরা আত্ম প্রশংসা তো করেনই না, বরং কেউ প্রশংসা করলে অহংকার সৃষ্টির ব্যাপারে ভয় করেন ৷
এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো,
প্রথমত : আল্লাহ যদি কোন মানুষের প্রশংসা করেন সেটাই গ্রহণযোগ্য ও মূল্যবান ৷ আত্ম প্রশংসার কোন মূল্য নেই৷
দ্বিতীয়ত : নিজের প্রশংসা ও প্রচার অহংকারের বহিঃপ্রকাশ ৷ এটা আল্লাহর দাসত্বের চেতনারও পরিপন্থী ৷
তৃতীয়ত : নিজেকে আল্লাহর কাছাকাছি বা অতি ঘনিষ্ঠ মনে করার অর্থ হলো, আল্লাহর ওপর সবচেয়ে বড় অপবাদ দেয়া ৷ এ ধরনের অহঙ্কারের জন্য কঠোর শাস্তি ভোগ করতে হবে৷
এবারে সুরা নিসার ৫১ ও ৫২ নম্বর আয়াত নিয়ে আলোচনা করব৷ এই আয়াতে বলা হয়েছে, "তুমি কি তাদের লক্ষ্য করোনি, যারা ঐশি গ্রন্থের কিছু অংশ প্রাপ্ত হয়েছে, তারা মূর্তি এবং শয়তানদের বিশ্বাস করেছে ? তারা অবিশ্বাসীদের সম্পর্কে বলে আমরা তো ইসলামের প্রতি বিশ্বাসীদের চেয়ে বেশী সুপথ গামী ৷ এদের ওপরই আল্লাহ অভিশাপ দিয়েছেন ৷ আল্লাহ যাকে অভিশাপ দেন তুমি তার জন্য কোন সাহায্যকারী পাবে না ৷"
ইতিহাসে এসেছে ওহুদ যুদ্ধের পর মদীনার একদল ইহুদী মক্কায় গিয়ে মুসলমানদের বিরুদ্ধে মুশরিকদের সাথে জোটবদ্ধ হয় ৷ তারা মুশরিকদের সুদৃষ্টি পাবার জন্য তাদের মূর্তি গুলোকে সেজদা করে এবং বলে যে, মূর্তিপূজা মুসলমানদের ঈমানের চেয়ে ভালো৷ মুসলমানদের বিরুদ্ধে কোন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হবে না বলে ইহুদীরা মহানবীর সাথে চুক্তিবদ্ধ থাকলেও তারা সেই চুক্তি লঙ্ঘন করে এবং মুসলমানদের বিরুদ্ধে কোরাইশদের সাথে ঐক্যজোট গঠন করে৷ এ থেকে বোঝা যায় ইহুদীরা নিজেদের অশুভ লক্ষ্য অর্জনের জন্য তাদের নীতি বিসর্জন দিতে প্রস্তুত ছিল৷ ইহুদীরা ঐশী ধর্মগ্রন্থ তাওরাতের অনুসারী বলে দাবী করা সত্ত্বেও মূর্তিপূজারীদের কুসংস্কারাচ্ছন্ন বিশ্বাসকে ইসলামের চেয়ে উত্তম বলে ঘোষণা দেয়, এমনকি তারা ইসলামের বিরুদ্ধে সংগ্রামের জন্য মুশরিকদের সাথে জোট বাঁধে ৷ এত বড় অপরাধের জন্য আল্লাহ তাদের ওপর অভিশাপ দিয়েছেন এবং তারা আল্লাহর রহমত থেকে বঞ্চিত হয়েছে৷
এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো,
প্রথমত : ইহুদীরা ইসলাম ধর্মের বিরুদ্ধে শত্রুতার জন্যে ধর্মহীন কাফেরদের সাথেও ঐক্যজোট করতে প্রস্তুত৷ তাই তাদের ব্যাপারে সাবধান থাকা উচিত৷
দ্বিতীয়ত : হিংসা ও ঘৃণা মানুষকে অন্ধ করে ফেলে। যারা ইসলামের সাথে শত্রুতা করছে তারা ইসলাম ধর্মকে খারাপ মনে করে তা করছে না৷ ইসলাম ধর্ম তাদের জড়বাদী অশুভ লক্ষ্য অর্জনের পথে বাধা বলেই তারা এর বিরোধী ৷
তৃতীয়ত : মানুষের প্রকৃত সাহায্যকারী হলেন আল্লাহ৷ কেউ যদি নিজের খারাপ কাজের জন্য আল্লাহর রহমত থেকে বঞ্চিত হয় , তাহলে সে যেন নিজেই নিজেকে সাহায্যকারী থেকে দূরে সরিয়ে নিল৷
(৫৩-৫৭ আয়াত)
আজ সূরা নিসার ৫৩ থেকে ৫৭ আয়াতের অনুবাদ ও সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা উপস্থাপন করা হবে। শুরুতেই দেখা যাক ৫৩,৫৪ও৫৫ নং আয়াতে কি বলা হয়েছে, "(মুশরিকদের সাথে জোট বাঁধার জন্য সচেষ্ট) ইহুদীরা কি এটা মনে করে যে, রাষ্ট্রের শাসনে তাদের অংশ আছে ? যদি থাকে, সেখানেও তারা লোকদেরকে এক কনাও দেবে না ৷ অথবা আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে মুসলমানদের যা দিয়েছেন সে জন্য কি তারা হিংসা করে ? আমরা ইব্রাহীমের বংশধরদেরও গ্রন্থ এবং বিজ্ঞান দান করেছিলাম৷ তাদেরকে দিয়েছিলাম বিশাল রাজ্য৷ তাদের মধ্যে একদল লোক তাওরাত, ইঞ্জিল ও যাবুরে বিশ্বাস করেছে, আর অন্যরা ঈমান তো আনেইনি , বরং অন্যদেরকেও ঈমান আনতে বাধা দিয়েছে৷ জাহান্নামের আগুনই তাদেরকে পোড়ানোর জন্যে যথেষ্ট৷"
আগের আয়াতের ব্যাখ্যায় আমরা বলেছিলাম ইহুদীরা মদীনার মুসলমানদের পরাজিত করতে মক্কার মুশরিকদের সাহায্য চেয়েছিল এবং এজন্যে তাদের সাথে জোটবদ্ধ হয়েছিল ৷ এই আয়াতে তাদের উদ্দেশ্য করে বলা হচ্ছে, তোমরা কি রাষ্ট্র ক্ষমতা হাতে পাবার আশায় এসব কাজ করছো? অথচ রাষ্ট্র ক্ষমতা পাবার কোন যোগ্যতা তোমাদের নেই৷ কারণ, আধিপত্যের নেশা তোমাদের মধ্যে এত প্রবল যে, তোমরা ক্ষমতায় গেলে কাউকে কোন অধিকারই দেবেনা এবং সমস্ত সুযোগ সুবিধা ও অধিকার তোমরা নিজেরাই ভোগ করবে ! এছাড়াও মুসলমানরা রাষ্ট্র ক্ষমতা পেয়েছে বলে তোমরা হিংসা করছ কেন? এর আগেও আল্লাহ ইব্রাহীম (আঃ)'এর বংশধরদের মধ্য থেকে হয়রত মূসা , দাউদ ও সোলায়মান (আঃ) সহ অনেক নবীকে কি ধর্মগ্রন্থ ও রাষ্ট্র ক্ষমতা দেননি ? তাই মোহাম্মদ (সাঃ) ও ইব্রাহীম (আঃ)'র বংশধররা যদি ঐশীগ্রন্থ ও রাষ্ট্র ক্ষমতা পেয়ে থাকেন তাহলে অবাক হবার কি আছে ? এমনকি ইসলাম বিদ্বেষ তোমাদের এত অন্ধ করে দিয়েছে যে, তোমরা মুশরিকদেরকে মুসলমানদের চেয়েও ভালো মনে করছ ? এরপর আল্লাহ মুসলমানদের উদ্দেশ্য করে বলছেন, অবশ্য মূসা , দাউদ ও সোলায়মান (আঃ)'র যুগেও একদল লোক তাদের ওপর ঈমান এনেছিল এবং অন্য একদল তাদের বিরোধীতা করেছিল ৷ তাই এখনও ইহুদীরা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ না করায় নিরাশ হয়ো না ৷ জেনে রাখ, এ ধরনের ঘটনা সব যুগেই ঘটেছে৷
এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো,
প্রথমত : মুসলমানদের বোঝা উচিত কারা তাদের শত্রু ৷ এইসব শত্রুর হাত থেকে ইসলাম ধর্ম ও নিজেদের অবস্থানকে রক্ষা এবং তা শক্তিশালী করার পদক্ষেপ নিতে হবে৷ কারণ, ইসলামের শত্রুরা ক্ষমতায় আসলে তারা মুসলমানদেরকে উপেক্ষা করবে৷
দ্বিতীয়ত : কৃপণতা ,সংকীর্ণতা ও অন্যায় বিচার বা অপবাদ দেয়া বস্তুপূজা এবং ক্ষমতা লিপ্সারই লক্ষণ৷
তৃতীয়ত : অন্যের কাছে যা আছে তা আল্লাহরই দেয়া নেয়ামত৷ এ জন্যে হিংসা করার অর্থ হলো, আল্লাহর ইচ্ছার ব্যাপারে অসন্তুষ্ট হওয়া৷ অন্যের সম্পদ বা ক্ষমতা কমে যাক এমনটি আশা করার চেয়ে নিজের জন্যে আল্লাহর দয়া ও অনুগ্রহ পাবার আশা করা উচিত৷
এবারে সুরা নিসার ৫৬ নম্বর আয়াত নিয়ে আলোচনা করবো,এই আয়াতে বলা হয়েছে, "যারা আমার নিদর্শনগুলোকে অস্বীকার করেছে, তাদেরকে আমি শিঘ্রই দোযখের আগুনে প্রবেশ করাবো৷ যখন তাদের চামড়া পুড়ে যাবে,তখন আমি তাদের চামড়া বদলে দেব, যেন তারা শাস্তির আস্বাদ গ্রহণ করে৷ নিশ্চয়ই আল্লাহ পরাক্রান্ত,প্রজ্ঞাময় ৷"
সুরা নিসার আগের কয়েকটি আয়াতে নবী রাসুল ও তাঁদের প্রতি একদল মানুষের শত্রুতা এবং হিংসার কথা উল্লেখ করা হয়েছে ৷ ৫৫ নম্বর আয়াতে এসব লোকদের জন্য জাহান্নামের আগুনই যথেষ্ট বলে আল্লাহ মন্তব্য করেছেন ৷ এই আয়াতে তাদের কুফুরির উপযুক্ত ও কঠোর শাস্তির কথা বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করে বলা হয়েছে , যারা সারাজীবন ধরে সত্যের বিরোধীতা করেছে এবং প্রতি মুহূর্তে যাদের খোদাদ্রোহীতা বৃদ্ধি পেয়েছে তারা চিরকাল শাস্তি পাবার যোগ্য৷ অর্থাৎ কাফের ও পথভ্রষ্টরা যেন এ ধারণা না করে যে পরকালে দোযখের আগুন তাদেরকে একবারই দগ্ধ করবে না বরং বারবার তাদের শরীরে নতুন চামড়া দেখা দেবে এবং এভাবে তারা স্থায়ীভাবে দগ্ধ হতে থাকবে৷
এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো,
প্রথমত : পরকালের স্থায়ী শাস্তির যন্ত্রণা দুনিয়ার মত কিছুকাল পর কমে যায় না৷
দ্বিতীয়ত : পরকালে মানুষের পুনরুত্থান হবে দৈহিক ও আত্মিক ৷ তাই পাপী মানুষের চামড়া ও শরীরের অন্যান্য অংশ শাস্তির যন্ত্রণা ভোগ করবে৷ তাই পরকালে শুধু আত্মিক শাস্তি দেয়া হবে এমন ধারনা ঠিক নয়৷
তৃতীয়ত : পরকালের শাস্তি আমাদের কাজের ফল হিসেবেই দেখা দিবে, কারণ, আল্লাহ তাঁর বান্দাদের ওপর জুলুম করেন না ৷ আল্লাহ ন্যায় বিচারক ও প্রজ্ঞাময় এবং বান্দাদের সাথে তাঁর আচরণও প্রজ্ঞাপূর্ণ৷
এবারে ৫৭ নং আয়াতের দিকে নজর দেয়া যাক। এই আয়াতে বলা হয়েছে, "যারা ঈমান এনেছে ও সৎ কাজ করে, নিশ্চয়ই আমি তাদেরকে এমন বেহশতে প্রবেশ করাবো, যার বাগানের নীচ দিয়ে নদী প্রবাহিত ৷ সেখানে তারা চিরকাল থাকবে৷ সেখানে তাদের জন্য পবিত্র সঙ্গিনী থাকবে এবং তাদেরকে চিরস্নিগ্ধ ছায়ায় স্থান দেয়া হবে ৷"
আগের আয়াতে পরকালে অবিশ্বাসীদের কঠোর শাস্তির কথা উল্লেখের পর এ আয়াতে মুমিনদেরকে মহাপুরস্কার দেয়ার সুসংবাদ দেয়া হয়েছে ৷ এ আয়াতে বলা হচ্ছে, "যদি তোমরা আল্লাহ ও রাসুলের ওপর ঈমান আন এবং সৎ কাজ কর, তাহলে পরকালে এমন বেহেশত দেয়া হবে যার সবুজ শ্যামল ও বৃক্ষ শোভিত বাগানের পাশ দিয়ে বয়ে যাবে নদী৷ সেখানে শাখা প্রশাখা যুক্ত গাছের ছায়া হবে খুবই স্নিগ্ধ৷ এছাড়াও তাদের আনন্দ পূর্ণতর করার জন্য সেখানে থাকবে সঙ্গিনী ৷ যারা পৃথিবীতে প্রচুর ভোগ ও বিলাসিতা বর্জন করেছে এবং অপবিত্রতা থেকে মুক্ত থেকেছে তারাই পবিত্র বেহেশতে স্থান পাবে ৷"
এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো,
প্রথমত : মানুষ পথ বেছে নেয়ার ক্ষেত্রে স্বাধীন হলেও কাজের পুরস্কার বা শাস্তি ভোগের ক্ষেত্রে স্বাধীন নয়৷ কুফরীর পরিণতি হলো, শাস্তি ও যন্ত্রণা এবং ঈমানের ফল হলো প্রশান্তি ও নিরাপত্তা৷
দ্বিতীয়ত : পবিত্রতা ও পবিত্র চরিত্র নারী এবং পুরুষ সবার জন্যেই সমান গুরুত্বপূর্ণ ৷ আর এ জন্যেই আল্লাহ বেহেশতের সঙ্গিনীদের সৌন্দর্যের কথা উল্লেখ না করে তাদের পবিত্রতার কথা উল্লেখ করেছেন।
(৫৮-৫৯ আয়াত)
আজ সূরা নিসার ৫৮ ও ৫৯ নং আয়াতের অনুবাদ ও সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা উপস্থাপন করা হবে। তো প্রথমেই দেখা যাক এই সূরার ৫৮ নং আয়াতে কি বলা হয়েছে, "আল্লাহ মালিকের কাছে আমানত ফিরিয়ে দিতে তোমাদের নির্দেশ দিচ্ছেন৷ তোমরা যখন মানুষের মধ্যে বিচার করবে, তখন ন্যায় বিচার কর৷ অবশ্যই আল্লাহ তোমাদের উত্তম উপদেশ দান করেন৷ নিশ্চয়ই আল্লাহ শোনেন ও দেখেন৷"
কোন কোন মানুষ ধর্মকে ব্যক্তিগত ব্যাপার বলে মনে করেন ৷ কিন্তু ঐশী ধর্মগুলো বিশেষকরে,ইসলাম ধর্ম পবিত্র কোরআন ও মহানবীর শিক্ষাকে ব্যক্তি এবং সমাজ উভয়ের জন্যেই সৌভাগ্যের মাধ্যম বলে মনে করে৷ ইসলাম ধর্ম ঈমান ও ধার্মিকতার শর্ত হিসেবে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা এবং আমানত রক্ষার কথা বলে৷ কোন কোন হাদীসে এসেছে, কোন ব্যক্তি দীর্ঘ সময় ধরে সেজদা ও রুকু করছে কিনা তা লক্ষ্য করোনা, বরং তাদের আমানতদারী এবং সত্যবাদীতার দিকে লক্ষ্য কর৷ কারণ, আমানতের খিয়ানত করা কপটতা ও দ্বিমুখীতার লক্ষণ৷ আমানতের ব্যাপক অর্থ রয়েছে ৷ যেমন- সম্পদের আমানত, জ্ঞানের আমানত ও পারিবারিক আমানত৷ এমনকি সমাজের নেতৃত্বও আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি আমানত। যোগ্য ও সৎ ব্যক্তির কাছে সমাজের নেতৃত্ব দেয়া হচ্ছে কিনা সে ব্যাপারে জনগণের পূর্ণ সচেতন থাকা উচিত৷ কারণ, অযোগ্য লোকের নেতৃত্ব ও তার অত্যাচার অবিচার বহু সামাজিক সংকট সৃষ্টি করে৷ মানুষের কাছে তিন ধরনের আমানত রয়েছে ৷ প্রথম আমানত হলো মানুষের প্রতি খোদার আমানত৷ আল্লাহর বিধান মেনে চলা এবং তাঁর বিধান অমান্য না করাই হলো এই আমানত ৷ দ্বিতীয় আমানত হলো, মানুষের পরস্পর আমানত৷ বিন্দুমাত্র কম না করে মালিকের কাছে এই আমানত ফিরিয়ে দেয়া উচিত৷ তৃতীয় আমানত হলো , মানুষের নিজের কাছে রাখা আমানত ৷ যেমন-বয়স ,শক্তি , আত্মিক ও শারীরিক ক্ষমতা৷এসবই আমাদের কাছে রাখা আমানত৷ এমনকি আমরা নিজেরাই তো নিজেদের মালিক নই৷ বরং আমরা আমাদের দেহ ও মনের আমানতদার ৷ আমাদের প্রকৃত মালিককে তথা আল্লাহকে খুশি করার জন্য এসবকে সবচেয়ে ভালো পন্থায় ব্যবহার করতে হবে৷
এই আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় দিক হলো,
প্রত্যেক আমানতের মালিক রয়েছে৷ প্রকৃত মালিকের কাছেই আমানত ফিরিয়ে দেয়া উচিত৷ রাষ্ট্র পরিচালনা ও বিচার করার মত আমানত অযোগ্য লোকদের হাতে ছেড়ে দেয়া ঈমানের লক্ষণ নয়৷ আমানতের মালিক যদি কাফেরও হয় তাও তার কাছে ফিরিয়ে দিতে হবে৷
এবারে সুরা নিসার ৫৯ নম্বর আয়াত নিয়ে আলোচন করবো ৷ এই আয়াতে বলা হয়েছে,"হে বিশ্বাসীগণ,যদি তোমরা আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাস কর তবে,তোমরা আল্লাহর আনুগত্য কর এবং রাসুলের অনুগত হও, আর তোমাদের মধ্য থেকে ঐসব নেতৃবৃন্দের যারা আদেশ দেয় কোন বিষয়ে তোমাদের মধ্যে মতভেদ ঘটলে সে ব্যাপারে আল্লাহর কোরআন ও রাসুলের শরণাপন্ন হও ৷ এটাই কল্যাণকর ও শ্রেষ্ঠ পরিণতি ৷"
আগের আয়াতের ব্যাখ্যায় আমরা বলেছিলাম, যোগ্য ও সৎ মানুষের কাছে রাষ্ট্র পরিচালনা এবং ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব দেয়া উচিত৷ এ আয়াতে মুমিনদের বলা হচ্ছে ,আল্লাহ ও রাসুল (সাঃ)'র আনুগত্য করা ছাড়াও ন্যায় পরায়ণ শাসকদেরও আনুগত্য করতে হবে৷ আল্লাহ ও কিয়ামতের প্রতি বিশ্বাসের জন্যে এটাও জরুরী ৷ ঐতিহাসিক বর্ণনা অনুযায়ী মহানবী (সাঃ) তাবুক যুদ্ধে রওনা হবার সময় আলী ইবনে আবু তালেব (আঃ) কে মদিনায় নিজের স্থলাভিষিক্ত করে যান৷ মহানবী (সাঃ) তাঁকে বলেন , "হে আলী তোমার সাথে আমার সম্পর্ক মুসার সাথে হারুনের সম্পর্কের মত, যদিও আমার পরে কোন নবী আসবে না।" এ সময় ওই আয়াত নাজিল হয় এবং হযরত আলী (আঃ)'র অনুসরণ করতে মুসলমানদের নির্দেশ দেয়া হয় ৷ উলিল আমর বা নির্দেশদাতা নেতাকে চিহ্নিত করা এবং তাঁর বৈশিষ্ট্য নিয়ে যাতে মতভেদ দেখা না দেয়, সেজন্যে আয়াতের পরবর্তী অংশে আল্লাহ বলেছেন আল্লাহর গ্রন্থ কোরআনে এবং রাসুলের হাদীসে যা এসেছে তার শরণাপন্ন হও৷ এটাই তোমাদের জন্য সবচেয়ে বড় বিচারক এবং এ দুয়ের অনুসরণের ফলাফলই সর্বোত্তম ৷ এটা স্পষ্ট , মহানবী ও উলিল আমরের অনুসরণ করার অর্থ হলো,আল্লাহরই নির্দেশ মানা ৷ তৌহিদ বা একত্ববাদের সাথে এর কোন সংঘাত নেই৷ কারণ, আল্লাহই মহানবী ও উলিল আমরের নির্দেশ মান্য করতে বলেছেন৷
তাহলে এই আয়াতে আমরা যা শিখলাম তা হলো,
প্রথমত : মহানবী (সাঃ) ও উলিল আমরের নির্দেশ মেনে চলা একটি স্পষ্ট আইন৷ এ সার্বজনীন আইন কোন শর্তযুক্ত নয়৷ আর এই আয়াত থেকে বোঝা যায় রাসুলে খোদা ও উলিল আমর নিস্পাপ এবং ভুলত্রুটি থেকে মুক্ত৷
দ্বিতীয়ত : ইসলামী সরকারকে মেনে নেয়া সব মুসলমানেরই দায়িত্ব৷ ইসলামী রাষ্ট্রের ন্যায় পরায়ন শাসকের আনুগত্য করা ও তাঁকে সাহায্য করাও প্রত্যেক মুসলমানের কর্তব্য৷
তৃতীয়ত : মহানবী (সাঃ) দু'টি পদ বা বিভাগের দায়িত্বশীল ছিলেন ৷ তিনি একদিকে আল্লাহর বিধান প্রচার করতেন এবং অন্যদিকে সমাজের চাহিদা অনুযায়ী রাষ্ট্রীয় বিধান প্রণয়ন করতেন ৷
চতুর্থত : মুসলমানদের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে মতভেদ দূর করার সবচেয়ে ভালো পন্থা হলো, পবিত্র কোরআনের ও রাসুলের অনুসরণ করা ৷ মুসলমানদের প্রত্যেক মাজহাবই পবিত্র কোরআন ও রাসুলের সুন্নতকে গ্রহণযোগ্য বলে মনে করা ৷
(৬০-৬৩ আয়াত)
আজ সূরা নিসার ৬০ থেকে ৬৩ নং আয়াতের অনুবাদ ও সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা উপস্থাপন করা হবে। তো দেখা যাক এই সূরার ৬০তম আয়াতে কি বলা হয়েছে, "আপনি কি তাদের লক্ষ্য করেননি, যারা দাবী করে যে, আপনার ওপর ও আপনার আগে যে সব ধর্মীয়গ্রন্থ নাজিল হয়েছে,তাতে তারা বিশ্বাস করে অথচ তারা খোদাদ্রোহী জালেম শাসক, মূর্তি বা শয়তানের কাছে বিচার প্রার্থী হয়; যদিও এদেরকে প্রত্যাখ্যান করতে তাদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে৷ শয়তান তাদেরকে ভীষণভাবে পথভ্রষ্ট করতে চায়।"
সুরা নিসার ৫৯ নম্বর আয়াতে মুসলমানদের মধ্যে যে কোন বিরোধ মীমাংসার জন্য পবিত্র কোরআনে ও রাসুলের শরণাপন্ন হতে বলা হয়েছে৷ আর এই আয়াতে আল্লাহ অসৎ ব্যক্তি এবং জালেম শাসকদের কাছে বিচারপ্রার্থী হতে নিষেধ করেছেন এবং একে পথভ্রষ্টতা বলে উল্লেখ করা হয়েছে ৷ এ ব্যাপারে ইতিহাসের বর্ণনায় এসেছে মদীনায় কোন এক ইহুদী ও এক মুসলমানের মধ্যে কোন ব্যাপারে বিরোধ দেখা দিলে ওই ইহুদী মহানবী (সাঃ)'র বিশ্বস্ততা এবং আমানতদারীর জন্য তাঁকে বিচারক করার পরামর্শ দেয়৷ কিন্তু মুসলমান ব্যক্তিটি তার অবৈধ স্বার্থ পূরনের জন্য এক ইহুদী পন্ডিতকে বিচারক মানার দাবী জানায় ৷ কারণ ওই মুসলমান লোকটি জানতো ইহুদী পন্ডিতকে ঘুষ দিয়ে বিচারের রায় তার পক্ষে আনা সম্ভব ৷ এই আয়াতে এ ধরনের জঘণ্য মনোভাবের নিন্দা করা হয়েছে।
এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো,
প্রথমত : তাগুতি শক্তি ও মিথ্যা আদর্শের অনুসারীদের কাছ থেকে দূরত্ব বজায় রাখা ছাড়া ঈমানের দাবী করা হলে তা প্রকৃত ঈমান নয়, বরং তা হলো অন্তসার শুন্য ঈমান ৷
দ্বিতীয়ত : যারা ঈমান আনার দাবী করে অথচ বাস্তবে খোদাদ্রোহী শক্তি, জালেম ও শয়তানদের সহযোগী হয়, তারা আসলে আল্লাহ এবং তাঁর নবীর বিরুদ্ধেই জোটবদ্ধ হয়েছে৷
তৃতীয়ত : খোদাদ্রোহী ও ধর্ম বিরোধী শক্তি কিংবা ধর্ম নিরপেক্ষতার নামে ধর্মহীন শাসন ব্যবস্থা মেনে নেয়ার অর্থ হলো সমাজে শয়তানের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার সুযোগ দেয়া ৷ উল্লেখ্য, বর্তমান যুগেও মুসলমানদের বিরোধ মীমাংসার জন্য পবিত্র কোরআন ও মহানবীর আদর্শই হল মানদন্ড৷
এবারে সুরা নিসার ৬১ নম্বর আয়াত নিয়ে আলোচনা করা যাক ৷ এই আয়াতে বলা হয়েছে,"যখন তাদের বলা হয়, আল্লাহ যা নাজিল করেছেন, তার দিকে এবং রাসুলের দিকে এস,তখন আপনি মোনাফিকদের দেখবেন, তারা আপনার আহবান মেনে নিতে সম্পূর্ণ বিমুখ।"
এই আয়াতে বিধর্মীদেরকে বিচারক হিসেবে মেনে নেয়াকে কপটতা বা মোনাফেকীর লক্ষণ বলে উল্লেখ করা হয়েছে৷ একই সাথে এটাও বলা হয়েছে মোনাফেকরাই আল্লাহর কিতাব ও মহানবীর আদর্শ বা সুন্নাত থেকে দূরে সরে যায় এবং কাফেরদের মতামতই তাদের কাছে ভালো লাগে ৷ আসলে এইসব লোকেরা নিজেরাও আল্লাহর বিধান থেকে দূরে থাকে এবং অন্যদেরকেও আল্লাহর পথ থেকে দূরে সরিয়ে পথভ্রষ্ট করে৷ কেউ যেন তাদের বিরোধীতা করতে না পারে সে জন্যেই তারা অন্যদেরও পথভ্রষ্ট বা বিভ্রান্ত করার কাজে ব্যস্ত থাকে৷
এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো,
প্রথমত : মানুষকে আল্লাহর দিকে ডাকা আমাদের সবারই কর্তব্য৷ এমনকি বহু মানুষ এই আহবান গ্রহণ করবে না, বা আল্লাহর নির্দেশ মান্য করবেনা এটা জানা সত্ত্বেও আমাদেরকে এই দায়িত্ব পালন করতে হবে৷
দ্বিতীয়ত : সত্য ধর্মের আহবান উপেক্ষা করা বা প্রকৃত ইসলামী নেতৃত্বের বিরোধীতা করা মোনাফেকদের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য৷
এবারে সুরা নিসার ৬২ ও ৬৩ নম্বর আয়াত নিয়ে আলোচনা করবো৷ এই দুই আয়াতে আল্লাহ তা'লা বলেছেন,"তাদের কাজ কর্মের জন্য যখন কোন বিপদ তাদের ওপর নেমে আসবে তখন তাদের কি অবস্থা হবে ? এরপর তারা আল্লাহর নামে শপথ করে আপনার কাছে এসে খোদাদ্রোহীদের কাছে বিচারপ্রার্থী হবার ব্যাপারে বলবে আমরা কল্যাণ ও সম্রীখোতি ছাড়া কিছুই কামনা করিনি৷ অর্থাৎ আমরা দু'পক্ষের মধ্যে সমঝোতা সৃষ্টির চেষ্টা করেছি ! কিন্তু তাদের অন্তরে যা আছে আল্লাহ তা জানেন ৷ তাই হে নবী , আপনি তাদের শাস্তি দেয়ার বিষয়টি উপেক্ষা করুন,তাদের উপদেশ দিন এবং তাদের কাজের পরিণতির কথা স্পষ্টভাবে বলে দিন৷
আগের আয়াতে আল্লাহ এবং রাসুলের পরিবর্তে বিধর্মী ও খোদাদ্রোহীদের কাছে বিচার প্রার্থী মোনাফিকদের কথা উল্লেখের পর এ আয়াতে তাদেরকে দৈহিক শাস্তি দেয়ার পরিবর্তে উপদেশ দিতে এবং তাদের মন্দ কাজের পরিণতি সম্পর্কে সাবধান করতে বলা হয়েছে৷ আল্লাহই তাদেরকে শাস্তি দেয়ার বিষয়টি দেখবেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে৷ মোনাফিকরা যুক্তি দেখাতো যে, কোন বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য মহানবীর কাছে যাওয়া হলে তিনি নিশ্চয়ই দু পক্ষের কোন এক পক্ষকে দোষী সাব্যস্ত করবেন৷ আর এতে ওই পক্ষ মহানবী (সাঃ)'র প্রতি অসন্তষ্ট হবে! এটা নাকি মহানবীর সম্মানের জন্য শোভনীয় নয়৷ তাই মোনাফেকরা বলতো আমরা মহানবীর জনপ্রিয়তা রক্ষার স্বার্থেই বিচার কাজের জন্য তাঁর কাছে যাইনি ৷ এটা স্পষ্ট যে, এ ধরনের অজুহাত দায়িত্ব থেকে পলায়ন ছাড়া অন্য কিছু নয়৷ মহানবী (সাঃ)-এর মর্যাদা যদি এভাবেই রক্ষার দরকার হত তাহলে আল্লাহই তার নির্দেশ দিতেন৷ কারণ, তিনিই বেশী জানেন ও বোঝেন৷
এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো,
প্রথমত : ব্যক্তি ও সমাজের অধিকাংশ সমস্যা মানুষেরই কাজের ফল৷ মানুষ এইসব সমস্যার কারণ সম্পর্কে হয় অজ্ঞ অথবা এইসব সমস্যার কারণ জানার চেষ্টাও করেনা৷
দ্বিতীয়ত : অজুহাত দেখানো মোনাফেকদের কাজ৷ মোনাফেকরা মহানবী (সাঃ)'র অবস্থান বা সম্মান রক্ষার অজুহাত দেখিয়ে মহানবী (সাঃ)কে দূবর্ল করার চেষ্টা চালিয়েছিল৷
তৃতীয়ত : মিথ্যাবাদী ও মোনাফেকরা নিজেদের অসৎ উদ্দেশ্য বা তৎপরতা ধামাচাপা দেয়ার জন্যেই কসম খেয়ে থাকে৷
(৬৪-৬৮ আয়াত)
আজকের আসরে সূরা নিসার ৬৪ থেকে ৬৮ নং আয়াতের তর্জমা ও সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা উপস্থাপন করা হবে। এই সূরার ৬৪ নং আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেছেন, "আমরা সব নবী রাসুলকেই এ উদ্দেশ্যে পাঠিয়েছি যে, আল্লাহর নির্দেশে মানুষ তার আনুগত্য করবে ৷ যদি তারা নিজেদের ওপর জুলুম করার পর অর্থাৎ আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করে আপনার কাছে তথা মোহাম্মদ(সাঃ)'র কাছে আসে এবং আল্লাহর কাছে ক্ষমা চায়, আর রাসুলও তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে, তবে তারা আল্লাহকে ক্ষমাশীল ও দয়াময়রূপে পাবে৷"
গত কয়েকটি পর্বে আমরা বলেছি, মোনাফিকরা বিচারক হিসেবে রাসুলকে মনোনীত না করে বিধর্মীদের কাছে বিচারের জন্য যেত৷ এ আয়াতে বলা হয়েছে বিভিন্ন বিষয়ে মহানবী (সাঃ)'র আনুগত্য করাই জনগণের দায়িত্ব ৷ মহানবী (সাঃ) শুধু আল্লাহর বাণী প্রচারের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত নন, তিনি একই সাথে রাষ্ট্রেরও প্রধান ৷ তাই মুসলমানদের উচিত সব বিষয়ে একমাত্র তাঁরই আনুগত্য করা, অন্যদের নয়৷ উল্লেখ্য রাসুল (সাঃ)'র আনুগত্য করা আল্লাহরই নির্দেশ ৷ কারণ, আল্লাহর নির্দেশ ছাড়া কারো আনুগত্য করা হলে তা হবে শির্ক ও কুফুরী কাজ ৷ অবশ্য নবীরা আল্লাহর নির্দেশের বিরোধী কোন নির্দেশ দেন না৷ এরপর বলা হয়েছে , রাসুলের নির্দেশ অমান্য করার গোনাহ মোচনের জন্য আগে মহানবী (সাঃ) এর সন্তুষ্টি অর্জন করতে হবে, এরপর মহানবী (দঃ)তার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করলে তখনই আল্লাহ ঐ ক্ষমা গ্রহণ করবেন৷ এ আয়াত শুধু যে রাসুল (সাঃ)'র যুগের জন্য প্রযোজ্য তা নয়,এই আয়াতের নির্দেশ সব যুগের জন্যেই প্রযোজ্য ৷ এ যুগেও কেউ যদি আল্লাহ ও রাসুলের নির্দেশ অমান্য করার কারণে অনুতপ্ত হয়ে মহানবী (সাঃ)'র মাজারে যায় এবং তার জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করতে মহানবীকে অনুরোধ করে তাহলে মহানবী (সাঃ)'র শাফায়াতের ওসিলায় তার তওবা কবুলের সম্ভাবনা রয়েছে৷
এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো,
প্রথমত : ধমীয় নেতাদের অনুসরণের মধ্যেই রয়েছে মানুষের মুক্তি৷ নামাজ ও মুক্তির জন্যে শুধু মৌখিক ঈমানই যথেষ্ট নয়, ধর্মীয় নেতাদের আনুগত্য করাও জরুরী৷
দ্বিতীয়ত : নবীদের দেখানো শিক্ষা ও আদর্শ থেকে দূরে সরে গিয়ে জালেম বা বিজাতীয়দের শরণাপন্ন হওয়া নিজের ওপরই জুলুম মাত্র৷ এটা নবী বা ধর্মীয় নেতাদের প্রতি জুলুম নয়৷
তৃতীয়ত : আল্লাহর প্রিয় বান্দা বা অলী আওলিয়াদের মাজার জিয়ারত করা এবং গোনাহ মোচন ও সুপারিশের জন্য তাঁদেরকে ওসিলা করা পবিত্র কোরআনেরই পরামর্শ ৷
এবারে সুরা ৬৫ নম্বর নিয়ে আলোচনা করা যাক৷ এই আয়াতে বলা হয়েছে, "হে নবী আপনার প্রতিপালকের শপথ, তারা কখনও ঈমানদার হতে পারবেনা, যে পর্যন্ত তারা আপনাকে তাদের অভ্যন্তরীণ বিরোধের বিচারক না করে এবং আপনার সিন্ধান্ত সম্পর্কে তাদের মনে কোন অনীহা বা দুঃখ না থাকে এবং যে পর্যন্ত তারা আপনার বিচারকে সম্পূর্ণরুপে মনে প্রাণে মেনে নেয়৷"
আগের আয়াতে বিজাতীয়দের কাছে বিচারপ্রার্থী না হতে মুমিনদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে এবং বিচারের জন্য মহানবীর কাছেই যেতে বলা হয়েছে ৷ এই আয়াতে বলা হচ্ছে, বিচারের জন্য শুধু রাসুলের কাছে গেলেই চলবেনা ৷ তিনি বিচারের যে রায় দিবেন, সে ব্যাপারে মুখে কোন বিরোধীতা তো দূরে থাক অন্তরেও কোন ব্যথাও অনুভব করা যাবে না ৷ কারণ, ন্যায় বিচারের রায় যে পক্ষের জন্য ক্ষতিকর হয় সে পক্ষ প্রায়ই অন্তরে ব্যাথা অনুভব করে থাকে ৷ ইতিহাসে এসেছে, একবার মহানবীর দুই সাহাবীর মধ্যে খেজুর বাগানে পানি সেচ নিয়ে বিরোধ দেখা দেয় ৷ তারা ঘটনার বিচার করতে রাসুল (সাঃ)'র কাছে আসেন৷ কিন্তু রাসুলের বিচারের রায় ওই দুই সাহাবীর মধ্যে যে সাহাবীর বিপক্ষে গেল সেই সাহাবী রাসুল (সাঃ) কে এই বলে অভিযুক্ত করল যে, আত্মীয়তার কারণেই তিনি অন্য সাহাবীর পক্ষে রায় দিয়েছেন৷
উল্লেখ্য ,অন্য সাহাবী সত্যিই রাসুল (সাঃ)'র আত্মীয় ছিলেন৷ মহানবী (সাঃ) সাহাবীর এই কথা শুনে অত্যন্ত ব্যথিত হলেন এবং তাঁর চেহারার রং পাল্টে যায়৷ আর এ সময়ই এই আয়াত নাজেল হয় মুসলমানদের প্রতি সাবধান বাণী নিয়ে৷
এবারে সুরা নিসার ৬৬ থেকে ৬৮ নম্বর আয়াত নিয়ে আলোচনা করবো৷ এই দুই আয়াতে বলা হয়েছে,"যদি আমি তাদের আদেশ দিতাম যে তোমরা নিহত হও অথবা নিজ আবাসস্থল ত্যাগ কর, তাহলে তাদের অল্প সংখ্যকই তা করত৷ যে বিষয়ে তাদের বলা হয়েছিল, তা যদি তারা করত, তাহলে তা নিশ্চয়ই তাদের জন্য বেশী কল্যাণকর হত ও তাদের ঈমানও সুদৃঢ় হত৷ এ অবস্থায় আমরা তাদেরকে আমার কাছ থেকে বৃহত্তর পুরস্কার দিতাম এবং নিশ্চয়ই তাদেরকে মুক্তির পথ প্রদর্শন করতাম৷"
আগের আয়াতের ধারাবাহিকতায় এ আয়াতে সেইসব লোকদের উদ্দেশ্যে কথা বলা হয়েছে, যারা মহানবীর ন্যায় বিচারে মনে কষ্ট পেয়েছে৷ তাদেরকে বলা হচ্ছে আমরা তো তোমাদের কাঁধের ওপর কষ্টকর দায়িত্ব ও সমস্যার বোঝা চাপিয়ে দেইনি যে তোমরা দুঃখ বা ক্ষোভ অনুভব করছ ! অতীতে অন্য নবীদের উম্মতকে যেমন ইহুদীদেরকে বাছুর পূজার কাফফারা হিসেবে মৃত্যুর বিধান দিয়েছিলাম এবং তাদের বলেছিলাম নিজ মাতৃভূমি বা স্বদেশ থেকে বেরিয়ে যাও যাতে তোমরা গোনাহ থেকে পবিত্র হতে পার৷ যদি এমন নির্দেশ তোমাদের দেয়া হত তাহলে তোমাদের মধ্যে কম লোকই তা পালন করতে৷ এরপর মুসলমানদের বলা হচ্ছে যদি আল্লাহর নির্দেশ মান, তাহলে তাতে তোমাদেরই কল্যাণ হবে৷ কারণ,এতে একদিকে যেমন সঠিক সরল তথা মুক্তির পথ পাবে, তেমনি তাতে আরো অটল থাকবে এবং কিয়ামতেও তোমরা আল্লাহর কাছ থেকে মহাপুরস্কার লাভ করবে৷
( ৬৯-৭৩ আয়াত)
আজ সূরা নিসার ৬৯ থেকে ৭৩ নং আয়াতের অনুবাদ ও সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা উপস্থাপন করা হবে। এই সূরার ৬৯ ও৭০ নং আয়াতে বলা হয়েছে-"যারা আল্লাহ ও রাসুলের আনুগত্য করবে,(শেষ বিচারের দিন) আল্লাহ যাদের প্রতি অনুগ্রহ করেছেন সে তাদের সঙ্গী হবে, তারা হলেন নবী , সত্যবাদী, শহীদ ও সৎকর্মশীলগণ। আর তারা সঙ্গী হিসেবে কতই না উত্তম। এটাই আল্লাহর অনুগ্রহ, আর আল্লাহ যথেষ্ট পরিজ্ঞাত।"
আমরা এর আগের ক'টি আয়াত থেকে জেনেছিলাম, যারা মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী চলে তারা দুনিয়াতেই অশেষ কল্যাণ ও সৌভাগ্যের অধিকারী হয়৷ তারা মহান আল্লাহর বিশেষ হেদায়েতও লাভ করেন। এ আয়াতে বলা হচ্ছে ,এ ধরনের ব্যক্তিগণ পরকালেও পয়গম্বর ও সৎকর্মশীলদের সথে অবস্থান করবেন এবং তাদের সান্নিধ্য লাভে ধন্য হবেন৷ প্রত্যেক নামাজে আমরা যখন সূরায়ে ফাতিহা পড়ি তখন বলে থাকি, হে আল্লাহ আমাদেরকে সঠিক ও সোজা পথ প্রদর্শন কর, তাদেরই পথ যারা তোমার বিশেষ কল্যাণের অধিকারী হয়েছে৷
সূরা নিসার উল্লেখিত আয়াতগুলো থেকে আমরা বিশেষ কল্যাণপ্রাপ্ত মহান ব্যক্তিদের স্পষ্ট পরিচয় লাভ করতে পারছি৷ তারা হচ্ছেন, পয়গম্বর, সত্যবাদী,শহীদ ও সৎকর্মশীলগণ ৷ তাই আমাদের সব সময়ই দোয়া করা উচিত যাতে বেহেশতে এ ধরনের মহান ব্যক্তিদের সান্নিধ্য লাভ করতে পারি।
এ আয়াত দুটোর শিক্ষণীয় দিকগুলো হচ্ছে,
প্রথমত : দুনিয়া ও আখেরাতে ভালো মানুষের সান্নিধ্য লাভের জন্যে আল্লাহ ও তার রাসুলের আনুগত্য করা জরুরী ৷
দ্বিতীয়ত : সততা ও ঈমান এ দুটো গুনকে বন্ধু নির্বাচনের ক্ষেত্রে প্রধান শর্ত হিসেবে গ্রহণ করা উচিত ৷
এবারে সুরা নিসার ৭১ নম্বর আয়াত নিয়ে আলোচনা করা যাক৷ এই আয়াতে বলা হয়েছে,"হে ঈমানদারগণ ! নিজেদের অস্ত্র তুলে নাও এবং পূর্ণ সতর্কতার সাথে পৃথক পৃথক সৈন্যদলে কিংবা সমবেতভাবে বেরিয়ে পড়।"
ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান ৷ তাই মানুষের ব্যক্তিগত জীবনের খুঁটিনাটি বিষয় থেকে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনের যাবতীয় দিক নির্দেশনা রয়েছে পবিত্র কোরআনে। অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশীক শক্তির হাত থেকে দেশ ও সমাজকে রক্ষা করা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তাই, ধর্ম ও ইসলামী রাষ্ট্রের সীমান্ত রক্ষার জন্যে পবিত্র কোরআন মুমিনদেরকে সব সময় প্রস্তুত থাকতে বলেছে, আর এ পথে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারকারীকে উচ্চ মর্যাদা প্রদানের ঘোষণা দেয়া হয়েছে।
এর আগের আয়াতগুলোতে শহীদদের সম্পর্কে বলা হয়েছে, তাদেরকে সৎকর্মশীল ও নবী রাসুলদের মর্যাদায় ভূষিত করা হবে৷ এ আয়াতে বলা হচ্ছে মুমিন মুসলমানরা যেন শত্রুর যে কোন হামলা থেকে আত্মরক্ষা করার মত সামরিক শক্তি অর্জন করে। এখানে "হাজরা" শব্দের অর্থ হচ্ছে আত্মরক্ষা বা প্রতিহত করা৷ অর্থাৎ মুমিন মুসলমানরা কারো উপর আক্রমনের জন্যে উদ্যত হবেনা বরং কারো দ্বারা আক্র্রান্ত হলে স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও ঈমান রক্ষার জন্যে তা প্রতিহত করার ব্যবস্থা নেবে৷
এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো,
প্রথমত : মুসলমানদের উচিত শত্রুপক্ষের সামরিক শক্তি সম্পর্কে খোঁজ খবর রাখা এবং সে অনুপাতে নিজেদের প্রতিরক্ষা শক্তি গড়ে তোলা৷
দ্বিতীয়ত : প্রত্যেক মুসলমানের সামরিক প্রশিক্ষণ নেয়া জরুরী৷ যাতে আক্রান্ত হলে দেশ ও ধর্ম রক্ষার জন্যে প্রত্যেকে আত্মরক্ষামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে৷
এরপর এই সূরার ৭২ ও ৭৩ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে,"তোমাদের মধ্যে এমনও কেউ কেউ রয়েছে যাদের চিত্ত দুর্বল এবং অন্যদের মনোবল দুর্বল করার ক্ষেত্রে তাদের ভূমিকাও অনেক । তোমাদের উপর কোন বিপদ আসলে তারা বলবে ,আল্লাহ আমার প্রতি অনুগ্রহ করেছেন যে,আমি তাদের সাথে যাইনি৷ পক্ষান্তরে তোমাদের প্রতি আল্লাহর পক্ষ থেকে কোন অনুগ্রহ আসলে তারা বলতে শুরু করবে হায় ! আমি যদি তাদের সাথে থাকতাম তাহলে আমিও সফলতা লাভ করতাম।"
আগের আয়াত গুলোতে মুসলমানদেরকে বহিঃশত্রুর ব্যাপারে পূর্ণ সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে, আর বর্তমান আয়াতে অভ্যন্তরীণ শত্রু বা মুনাফেকদের ব্যাপারে সতর্ক করে দেয়া হয়েছে । সুযোগ সন্ধানীরা যে সব সময় নিজ স্বার্থ লাভের জন্যে সচেষ্ট এবং দ্বীনের জন্যে যে তারা সামান্য ত্যাগ করতেও রাজী নয় এ আয়াতে তাদের প্রতিই অঙ্গুলি নির্দেশ করা হয়েছে । পবিত্র কোরআন এ ধরনের স্বার্থান্বেষী মহলের পরিচয় তুলে ধরতে গিয়ে বলেছে ,মুসলমানদের বিপদের দিনে তারা সরে পড়ে এবং আত্মপ্রসাদ লাভ করে, যেন খুব বুদ্ধিমানের কাজ তারা করে ফেলেছে, কিন্তু মুসলমানদের যখন বিজয় আসে তখন তারা আফসোস করে বলে যদি তাদের সঙ্গে থাকতাম তাহলে তো এখন গণিমতের মাল থেকে আমিও কিছু পেতাম৷
এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো,
প্রথমত : জেহাদের ময়দানেই কে প্রকৃত মুসলমান আর কে মুনাফেক তার আসল পরিচয় ফুটে উঠে৷
দ্বিতীয়ত : জেহাদের ময়দানে মুনাফেকদের উপস্থিতির ফলে অনেক সময় মুমিনদের মনোবল দুর্বল হতে পারে তাই মুনাফেকদেরকে চিহ্নিত করে তাদেরকে বহিস্কার করা জরুরী৷
তৃতীয়ত : বিপদের সময় মুসলমানদের কাছ থেকে আলাদা হয়ে অন্যের আশ্রয় নেয়া মুনাফেকীর আলামত ৷
( ৭৪ -৭৬ আয়াত)
আজ সূরা নিসার ৭৪ থেকে ৭৬ নং আয়াতের অনুবাদ ও সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা উপস্থাপন করা হবে। সূরা নিসার ৭৪ নং আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেছেন, "সুতরাং যারা পরকালের বিনিময়ে পার্থিব জীবন বিক্রয় করে,তারা আল্লাহর পথে সংগ্রাম করুক এবং যারা আল্লাহর পথে সংগ্রাম করে তারা শহীদ হোক কিংবা বিজয়ী হোক আল্লাহ তাদেরকে মহাপুরস্কার দান করবেন ৷"
গত আলোচনায় বলেছিলাম, মোনাফিক লোকদের লক্ষণ হলো, তারা বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে জিহাদে অংশ নেয়া থেকে বিরত থাকে,এমনকি অন্যদেরকেও বিরত রাখে ৷ এই আয়াতে ওই বক্তব্যের জের ধরে বলা হচ্ছে-জিহাদ থেকে পালিয়ে যাওয়া আল্লাহ ও পরকালের প্রতি অবিশ্বাসের লক্ষণ ৷ যদি কেউ পরকালের মহাপুরস্কারের প্রতি বিশ্বাস রাখে এবং দুনিয়ার অস্থায়ী জীবনকে পরকালের স্থায়ী জীবনের জন্য ক্ষেত্র মনে করে, তাহলে তার উচিত আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধ করা ৷ কারণ মুমিন বা বিশ্বাসী মুসলমানরা জানেন ধর্মের পবিত্রতা রক্ষা করা তাদের দায়িত্ব এবং তারা এই দায়িত্ব পালনের জন্যই সচেষ্ট। যুদ্ধের ফলে জয় বা পরাজয় যাই হোক না কেন তা তাদের জন্য সমান ৷ জয় বা পরাজয় উভয় ক্ষেত্রেই তারা বিজয়ী ৷ কারণ আল্লাহর পথে থাকা এবং আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কাজ করাই বেশী গুরুত্বপূর্ণ, শত্রুর ওপর বিজয়ী হওয়া এর তুলনায় কম গুরুত্বপূর্ণ ৷
এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো,
প্রথমত : ধর্মযুদ্ধ বা জিহাদের উদ্দেশ্য হলো আল্লাহর ধর্ম রক্ষা করা,দেশের সীমানা বৃদ্ধি,প্রতিশোধ নেয়া কিংবা উপনিবেশ প্রতিষ্ঠা ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা জিহাদের উদ্দেশ্য নয় ৷
দ্বিতীয়ত : ঈমানদারদের পরীক্ষার একটি ক্ষেত্র হলো যুদ্ধের ময়দান ৷ যুদ্ধই মুমিন ও মোনাফিকের মধ্যে পার্থক্য সূচিত করে ৷
তৃতীয়ত : সত্যের সংগ্রামে পলায়ন ও পরাজয়ের কোন অস্তিত্ব নেই৷ মানুষ হয় শহীদ হবে অথবা গাজী বা বিজয়ী হবে ৷
এরপর ৭৫ নং আয়াতে বলা হয়েছে ,"তোমাদের কি হয়েছে যে তোমরা আল্লাহর পথে লড়াই করছ না অসহায় নারী,পুরুষ ও শিশুদের রক্ষার জন্যে? যারা বলে হে আমাদের প্রতিপালক ! জালেমের এই জনপদ থেকে আমাদেরকে উদ্ধার কর । তোমার কাছ থেকে কাউকে আমাদের অভিভাবক কর এবং তোমার কাছ থেকে আমাদের জন্য সাহায্যকারী পাঠাও ৷"
আগের আয়াতে আল্লাহ ও পরকালের প্রতি বিশ্বাসের কারণে জিহাদে অংশ নেয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে ৷ আর এই আয়াতে মানবিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে বলা হচ্ছে-যারা অত্যাচারীদের হাতে নিপীড়িত তাদেরকে মুক্ত করার জন্য যুদ্ধ করা উচিত এবং নীরব থাকা উচিত নয় ৷ এই আয়াত থেকে এটা স্পষ্ট যে, জালেমদের হাত থেকে নিপীড়িত লোকদের রক্ষা করা ও তাদের মুক্তি দেয়া ইসলামী সংগ্রাম তথা জিহাদের অন্যতম উদ্দেশ্য ৷ মজলুমদের পক্ষ হয়ে যুদ্ধ করা আল্লাহর রাস্তায় জিহাদের শামিল ৷ স্বধর্মী ও স্বজাতির প্রতি মুমিনের বিশেষ দায়িত্ব রয়েছে ৷ স্বদেশ ও স্বধর্মের লোক যখন কষ্ট পাচ্ছে তখন শুধু নিজের এবং পরিবারের সুখের চিন্তা করা মুমিনের লক্ষণ নয় ৷
এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হচ্ছে,
প্রথমত : ইসলামী জিহাদ শুধু ধর্মের স্বার্থেই হয় না, মানবীয় স্বার্থ রক্ষাও এর লক্ষ্য। মানুষকে মুক্তি দেয়ার সংগ্রাম ধর্মেরই সংগ্রাম ৷
দ্বিতীয়ত : মজলুম ও নিপীড়িত জনগণের ফরিয়াদ এবং কান্নার ব্যাপারে উদাসীন থাকা একটি বড় পাপ ৷ সাহস ও শক্তি নিয়ে মজলুমের পক্ষে প্রতিরোধ গড়ে তোলা উচিত ৷
এরপর ৭৬ নং আয়াতে বলা হয়েছে, "যারা বিশ্বাসী তারা আল্লাহর পথে যুদ্ধ করে এবং যারা অবিশ্বাসী তারা তাগুত বা অসত্যের পক্ষে যুদ্ধ করে ৷ সুতরাং তোমরা শয়তানের অনুসারী ও সহযোগীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ কর ৷ নিশ্চয় শয়তানের কৌশল দুর্বল ৷"
ইসলামী জিহাদ ও অবিশ্বাসীদের যুদ্ধের উদ্দেশ্য স্পষ্ট করার জন্য মহান আল্লাহ এ আয়াতে বলছেন,"ঈমানদাররা শুধু আল্লাহর ধর্ম রক্ষা এবং তা শক্তিশালী করার জন্য যুদ্ধ করে, ক্ষমতা বা পদের জন্য নয় ৷ মুমিনের জন্য শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি যথেষ্ট ৷ কিন্তু কাফেররা খোদাদ্রোহী শক্তি ও জালেমদের শাসন শক্তিশালী করার জন্য যুদ্ধ করে। তাদের লক্ষ্য অন্যদের ওপর কর্তৃত্ব করা এবং নিজ দেশের সীমানা বৃদ্ধি করা ৷" এরপর আল্লাহ আধিপত্যকামী এই গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে উৎসাহ যুগিয়ে বলছেন, "তোমরা মনে করো না যে, কাফেররা শক্তিশালী ও তোমরা দুর্বল ৷ বরং বাস্তবতা এর বিপরীত। তোমরা আল্লাহর প্রতি ঈমানের কারণে সর্বোচ্চ শক্তির অধিকারী৷অন্যদিকে তোমাদের শত্রুরা শয়তানের অনুসারী বলে অত্যন্ত দুর্বল ৷ তাই কাফের ও তাগুতি শক্তির সাথে সংগ্রাম করতে ভয় পেয়ো না এবং সর্বশক্তি দিয়ে কুফুরি শক্তির সাথে যুদ্ধ কর ৷ তোমরাই শ্রেষ্ঠ এবং শয়তানের অনুসারীরা আল্লাহর ইচ্ছার মোকাবেলায় অত্যন্ত দুর্বল ও অক্ষম ৷"
এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো,
প্রথমত : ফি সাবিলিল্লাহ অর্থ-আল্লাহর পথে থাকা। জীবনের সব ক্ষেত্রে এটাই মুমিন ও ইসলামী সমাজের লক্ষ্য৷
দ্বিতীয়ত : ঘরে বসে থাকা এবং উদাসীনতা মুমিনের লক্ষণ নয়৷ বরং খোদাদ্রোহী ও অসত্যের বিরুদ্ধে সংগ্রামই মুমিনের লক্ষ্য৷
তৃতীয়ত : কাফের, তাগুত বা ইসলাম বিরোধী স্বৈরশক্তি ও শয়তান এরা একই ত্রিভুজের তিন দিক এবং এগুলো একটি অপরটির উপর নির্ভরশীল ৷ অর এ জন্যই এগুলো একে অপরকে শক্তিশালী করার জন্য সচেষ্ট ৷
(৭৭ - ৭৯ আয়াত)
আজকের আসরে সূরা নিসার ৭৭ থেকে ৭৯ আয়াতের অনুবাদ ও সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা উপস্থাপন করা হবে। এ সূরার ৭৭ নং আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেছেন,"আপনি কি তাদের দেখেননি,যাদেরকে (মক্কায়) বলা হয়েছিল তোমরা জিহাদ থেকে তোমাদের হাতকে নিবৃত রাখ, শুধু নামাজ পড় এবং জাকাত দাও,(তখন তারা প্রতিবাদী হয়েছিল ও যুদ্ধের দাবী জানিয়েছিল ৷) কিন্তু যখন মদিনায় তাদেরকে জিহাদের আদেশ দেয়া হলো, তখন তাদের এক দল জনগণকে এমন ভয় করতে আরম্ভ করলো যেমন করে ভয় করা হয় আল্লাহকে, এমন কি তার চেয়েও বেশি ভয়। তারা বলল, হে আমাদের প্রতিপালক, কেন আমাদেরকে যুদ্ধের আদেশ দিলে? কেন আমাদেরকে আরো কিছুকাল অবসর দিলে না? হে নবী আপনি তাদের বলুন, পার্থিব জীবন খুবই সামান্য এবং খোদাভীরুদের জন্য পরকালই কল্যাণকর ৷তোমাদের ওপর সামান্য পরিমাণ জুলুমও করা হবে না ৷"
ঐতিহাসিক বর্ণনা অনুযায়ী মুসলমানরা যখন মক্কায় ছিল, তখন মুশরিকদের উৎপীড়ন ও নির্যাতনের কারণে তাদের মধ্যে একদল মহানবী (সাঃ)এর কাছে এসে বললো, ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হবার আগে আমরা মুশরিকদের কাছে প্রিয় ছিলাম ৷ কিন্তু এখন তাদের কাছে আর আমাদের সম্মান নেই এবং আমরা সব সময়ই শত্রুদের অত্যাচার ও উৎপীড়নের শিকার হচ্ছি ৷ আমাদেরকে যুদ্ধ করতে দিন যাতে আমরা পুনরায় সম্মান অর্জন করতে পারি ৷ মহানবী (সাঃ) তাদেরকে বললেন, আমি এ মুহূর্তে জিহাদের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্দেশ পাই নি, আপনারা নামাজ আদায় ও জাকাত দেয়ার মত ব্যক্তিগত এবং সামাজিক দায়িত্ব পালন করুন ৷ এরপর যখন মদিনায় হিজরতের পর আল্লাহর পক্ষ থেকে জিহাদের নির্দেশ আসলো তখন যুদ্ধের জন্য অতি আগ্রহী ঐ ব্যক্তিরা বিভিন্ন অজুহাত দেখাতে লাগলো এবং জিহাদে অংশ নেয়া থেকে বিরত হলো ৷ ঠিক তখনই এ আয়াত নাজেল হয় এবং এতে ঐ লোকদের দ্বিমুখী আচরণের প্রতিবাদ করা হয়েছে ৷ যদিও ইসলামের প্রাথমিক যুগের একদল মুসলমানের ঐ রকম কপট আচরণ ছিল এই আয়াত নাজিলের উপলক্ষ্য কিন্তু বাস্তবে এ ধরণের ঘটনার নজীর সব যুগেই দেখা যায় ৷ সমাজে সব সময়ই এমন একদল লোক থাকে যারা চরম পন্থা অনুসরণ বা বাড়াবাড়ি করতে অভ্যস্ত ৷ এইসব লোক কখনও কখনও সমাজের নেতার চেয়েও বেশী সক্রিয় হয়ে ওঠেন, আবার কখনও সমাজের সাধারণ লোকের চেয়েও ধীরগতির হন ৷ আসলে এ ধরনের লোক নিজেদের দায়িত্ব বোঝার ও তা পালনের চেষ্টা করে না ৷ বরং তারা সাগরের ঢেউয়ের মত উত্তাল হয় এবং যখন ঢেউ তীরে পৌছে, তখনই বুদবুদের মত মিলিয়ে যায় ৷ এ ধরণের মানুষ মুখে মুখে খুব সাহসিকতা দেখালেও অন্তরের দিক থেকে খুবই ভীরু ৷এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হচ্ছে,
প্রথমত : ধর্মীয় বিধান পর্যায়ক্রমিক ৷ ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গী অনুযায়ী একমাত্র তারাই জিহাদ ও সংগ্রামের যোগ্যতা অর্জন করতে সক্ষম,যারা নামাজ পড়েছে, যাকাত দিয়েছে এবং নিজের ভেতরের শয়তান ও প্রবৃত্তির সাথে সংগ্রাম করেছে৷
দ্বিতীয়ত : সামাজিক সমস্যাদির ব্যাপারে কখনোই উত্তেজিত হয়ে কিছু করা ঠিক নয় ৷ এ সব ক্ষেত্রে ন্যায় পরায়ন ও দূরদর্শী নেতৃবৃন্দ যা বলেন তাই মেনে চলা উচিত ৷
এরপর ৭৮ ও ৭৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, "তোমরা যেখানেই থাক না কেন, মৃত্যু তোমাদের নাগাল পাবেই, এমনকি সুউচ্চ ও সুদৃঢ় দুর্গে থাকলেও তোমরা মৃত্যু এড়াতে পারবে না ৷ যদি মোনাফিকরা বিজয়ী হয় বা তাদের ওপর কোন কল্যাণ অবতীর্ণ হয় তখন তারা বলে এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে হয়েছে৷ আর যদি তাদের জন্য খারাপ কিছু ঘটে, তখন তারা বলে এটা নবীর কাছ থেকে হয়েছে ৷ আপনি বলুন সব কিছুই আল্লাহর পক্ষ থেকে হয় ৷ ওই সম্প্রদায়ের কি হয়েছে যে তারা সত্য বুঝতে ও মানতে প্রস্তুত নয়? হে নবী! আপনার ওপর যে কল্যাণ নাজিল হয় তা আল্লাহর পক্ষ থেকে হয়, আর আপনার ওপর মন্দ যা কিছু হয় তা আপনার নিজের কারণেই হয়। আমরা আপনাকে মানুষের জন্য রাসুল হিসাবে পাঠিয়েছি ৷ আল্লাহই সাক্ষী হিসাবে যথেষ্ট ৷"
আগের আয়াতে দূর্বলমনা মুসলমানদের কথা বলা হয়েছে ৷ জিহাদে অংশ না নেয়ার জন্য তারা অজুহাত দেখাতো এবং জিহাদ বিলম্বিত করার দাবী জানাতো৷ এই দুই আয়াতে তাদের উদ্দেশ্যে বলা হচ্ছে,মনে করো না জিহাদ থেকে পালিয়ে গেলেই মৃত্যু থেকে রক্ষা পাবে ৷ খুব সুদৃঢ় দরজা বিশিষ্ট সুরক্ষিত দূর্গে বাস করলেও মৃত্যু ঠিকই তোমাদেরকে সময়মত গ্রাস করবে ৷ তারাই সৌভাগ্যবান যারা নিজেদের জীবনকে আল্লাহর রাস্তায় বিলিয়ে দিয়ে অর্থাৎ শহীদ হয়ে অমরত্ব লাভ করবে ৷ এরপর মহানবী (সাঃ)এর প্রতি মোনাফিকদের অশোভন আচরণের দিকে ইঙ্গিত করে আল্লাহ তা'লা বলছেন, "যখনই তোমরা যুদ্ধে জয়ী হও তখন একে আল্লাহর দয়া বলে উল্লেখ কর, কিন্তু পরাজিত হলে একে অদক্ষ পরিচালনার ফল বলে মন্তব্য কর ৷ অথচ সব কিছু আল্লাহর ইচ্ছাতেই ঘটে ৷ আল্লাহর ইচ্ছা ছাড়া জয় বা পরাজয় কোনটাই সম্ভব নয় ৷ তবে আল্লাহর ইচ্ছাও অযৌক্তিক নয় ৷ যদি তোমরা তোমাদের দায়িত্ব ঠিক মত পালন কর তাহলেই আল্লাহ তোমাদের সাহায্য করেন এবং বিজয়ী করার সিদ্ধান্ত নেন ৷ আর তোমরা যদি নিস্ক্রিয় থাকো তাহলে পরাজয়কে আল্লাহ তোমাদের ভাগ্যলিপি করেন ৷"
আল্লাহর সাথে মানুষের সম্পর্ক হলো ভূপৃষ্ঠের সাথে সূর্যের সম্পর্কের মত ৷ সূর্যের চারদিকে ঘুরার সময় পৃথিবীর যে দিকে রোদ পড়ে সে দিকটা আলোকিত হয় এবং তাপ সঞ্চয় করে। যে দিকে রোদ পড়ে না সে দিকটা অন্ধকার ও শীতল হয়৷ পৃথিবীর আলো আসে যেহেতু আসে সূর্য থেকে তাই বলা যায় অন্ধকারে পড়ার জন্য পৃথিবীই দায়ী ৷ মানুষের অবস্থাও একই রকম ৷ মানুষ আল্লাহ মুখী হলেই সাহায্য পায়, বিজয়ী হয় কিন্তু আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করলে সকল অস্তিত্বের স্রষ্টার দয়া থেকে সে বঞ্চিত হয় ৷ অবশ্য এটা শুধু ঈমানদার ও পবিত্র অন্তরের অধিকারীরাই বুঝতে পারেন এবং মেনেও নেন ৷ কিন্তু অসুস্থ হৃদয়ের লোকেরা তা বুঝেও না এবং মেনেও নেয় না ৷ কারণ এসব লোক আল্লাহর পরিবর্তে নিজেদেরকেই সব কিছুর কেন্দ্র বলে মনে করে ৷ শুধু নিজেদেরকেই ন্যায়পন্থী মনে করে এবং তাদের পক্ষে নয় এমন সবাইকে বিভ্রান্ত বলে মনে করে। অথচ সত্য ও মিথ্যার মানদণ্ড হলেন আল্লাহ,তারা নয়৷
এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো,
প্রথমত : মৃত্যু যখন অবধারিত অর্থাৎ একদিন সবাইকেই যখন মরতে হবে তখন জিহাদ থেকে পালিয়ে যাওয়া অর্থহীন ৷
দ্বিতীয়ত : নিজের পাপকে অন্যের ওপর চাপিয়ে দেয়া ঠিক নয় ৷ নিজের অপরাধ বা ভুল ঢাকার জন্য দায়িত্ব এড়ানো উচিত নয় ৷
তৃতীয়ত : জীবন ও মৃত্যু তিক্ততা ও মিষ্টতা এবং অন্য সব কিছুই আল্লাহর বিজ্ঞ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ঘটে ৷
আর মহানবীর মিশন বিশ্বজনীন, এই মিশন কোন নির্দিষ্ট এলাকা বা জাতির জন্য সিমীত নয় ৷
তাই আমরা যেন সৃষ্টি জগত ও মানুষের সাথে আল্লাহর সম্পর্কের বাস্তবতা বুঝতে পারি এবং কখনোই নিজেদের অপরাধ যেন আল্লাহ ও অন্যের ঘাড়ে চাপানোর মত ভুল না করি। আল্লাহ আমাদের সকলকে পবিত্র কোরআন সঠিকভাবে উপলব্ধি করার ও সে অনুযায়ী আমল করার তাওফিক দান করুন।
(৮০-৮২ আয়াত)
আজ সূরা নিসার ৮০ থেকে ৮২ নং আয়াতের অনুবাদ ও সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা উপস্থাপন করা হবে। সূরা নিসার ৮০ নম্বর আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেছেন, "কেউ রাসুলের অনুসরণ করলে সে তো আল্লাহরই অনুসরণ করলো ৷ আর যারা আপনার অর্থাৎ রাসুলের অনুগত্য করলো না, তারা জেনে রাখুক আমরা আপনাকে তাদের প্রহরী করিনি ৷"
সমাজ বা রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য নেতৃত্ব এবং রাষ্ট্রীয় বা প্রশাসনিক কাঠামো নির্ধারণ করা অপরিহার্য ৷ আমরা আগেও বহুবার বলেছি ইসলাম ধর্ম শুধুমাত্র কিছু ব্যক্তিগত ইবাদত ও বিধি-বিধানের সমষ্টি নয় ৷ বরং ইসলাম বিশ্বাস করে ব্যক্তির সৌভাগ্য সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যক্তির সক্রিয় উপস্থিতি এবং সমাজের উন্নতি ও সৌভাগ্যের ওপর নির্ভরশীল ৷ জাকাত, হজ্ব ও জিহাদের মত ইসলামী বিধানগুলো প্রমাণ করে যে ইসলাম শুধু ব্যক্তিগত ধর্ম নয়, বরং এই ধর্মের বিধান সমাজ ও রাষ্ট্রকে নিয়েই ৷ ইসলামের অনেক বিধান রয়েছে যা সমাজে বাস্তবায়িত করার জন্যই দেয়া হয়েছে এবং তা বাস্তবায়নের জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন ৷ পবিত্র কোরআনের দৃষ্টিতে মহানবী (সাঃ) শুধু আল্লাহর বিধান প্রচারের জন্য দায়িত্বশীল নন ৷ তিনি নিজেই ইসলামী সমাজের শাসনকর্তা এবং তাঁর আনুগত্য করার অর্থ হলো আল্লাহরই নির্দেশ মান্য করা ৷ আর তার নির্দেশ অমান্য করার অর্থ হল-খোদাদ্রোহীতা বা কুফরি করা ৷ মহানবী (সাঃ) এর রাষ্ট্রীয় নির্দেশ ছাড়াও তার বক্তব্যের বিশেষ মর্যাদা রয়েছে ৷ পবিত্র কোরআন তথা আল্লাহর বাণীর পরই মহানবী (সঃ)এর বাণী তথা সুন্নাতকে সর্বোচ্চ মর্যাদা দেয়া হয় ৷ নবী এবং এমনকি রাষ্ট্র প্রধান হিসাবেও মহানবী (সাঃ) এর দায়িত্বের একটি সীমাবদ্ধতার কথা এ আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে ৷ এতে বলা হয়েছে, মহানবী (সাঃ) জনগণকে সত্য মেনে নিতে এবং তা বাস্তবায়নে জনগণকে বাধ্য করার জন্য দায়িত্ব প্রাপ্ত নন ৷ সমাজকে সু-পথ দেখানো এবং নেতৃত্ব দেয়াই তার দায়িত্ব ৷ খোদায়ী বিধান পালনে জনগণকে বাধ্য করা তার দায়িত্ব নয় ৷
এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হচ্ছে,
প্রথমত: আল্লাহর আনুগত্যের অর্থ শুধু নামাজ, রোজা পালন নয়, সমাজের ধর্মীয় নেতার আনুগত্য করাও আল্লাহর নির্দেশের অন্তর্ভূক্ত৷
দ্বিতীয়ত: ধর্মের প্রচারই নবীগণের দায়িত্ব ৷ ধর্ম চাপিয়ে দেয়া তাঁদের দায়িত্ব নয়৷ মানুষকে স্বেচ্ছায় ধর্ম নির্বাচন করতে হবে ৷
এরপর ৮১ নং আয়াতে বলা হয়েছে,"আপনার সামনে উপস্থিত মোনাফিকরা বলে আমরা অনুগত ৷ কিন্তু তারা যখন আপনার কাছ থেকে বের হয়ে যায়, তখন তাদের একদল রাতে মিলিত হয়ে উল্টো কথা বলে ৷ কিন্তু রাতে তারা যা শলাপরামর্শ করে আল্লাহ তা লিপিবদ্ধ করেন ৷ তাই আপনি তাদের উপেক্ষা করুন এবং আল্লাহর উপর ভরসা রাখুন, কার্য সম্পাদনে বা পৃষ্টপোষতার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট ৷"
এই আয়াতে পুনরায় মোনাফিকদের বিপদ সম্পর্কে মহানবী (সাঃ) ও মুসলমানদেরকে সাবধান করে দিয়ে বলা হচ্ছে,মুসলমানদের মধ্যে মোনাফিক লুকিয়ে আছে ৷ এরা উপরে উপরে মহানবী (সাঃ) এর আনুগত্য ও মুসলমানদের সাহায্য করার কথা বললেও রাতের বেলায় গোপন বৈঠকে ভিন্ন সিদ্ধান্ত নিচ্ছে এবং মুসলমানদের পরিকল্পনা বানচালের চেষ্টা করছে ৷ এ ধরনের লোকদের মোকাবেলার উপায় হলো, তাদেরকে চিনে রাখা এবং তাদের কাছ থেকে দূরত্ব বজায় রাখা
এই আয়াতে থেকে আমারা এই শিক্ষা নিতে পারি যে,ঘরের শত্রুদের সম্পর্কে সচেতন থাকা উচিত ৷ শুধু সীমান্তের বাইরেই শত্রু আছে এমন ধারণা করা ঠিক নয় ৷
এবারে সূরা নিসার ৮২ নম্বর আয়াত নিয়ে আলোচনা করা যাক ৷ এ আয়াতে বলা হয়েছে,"তবে কি তারা কোরআন সম্পর্কে চিন্তা করে না? কোরআন যদি আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো হত, তবে তারা এর মধ্যে বহু অসঙ্গতি বা ভুল খুঁজে পেত ৷"
ইসলাম বিরোধীরা মহানবীর অকাট্য যুক্তির মোকাবেলায় কোন যুক্তি দেখাতে না পেরে তার সম্পর্কে বিভিন্ন অপবাদ প্রচার করতো ৷ যেমন তারা বলতো,পবিত্র কোরআন মোহাম্মদেরই চিন্তার ফসল অথবা অন্যদের কাছে শিখেই মোহাম্মদ এসব কথা বলছে ৷ এই অপবাদের জবাবে আল্লাহ এ আয়াত নাজেল করেন ৷ এতে বলা হয়েছে, তারা কেন কোরআন সম্পর্কে চিন্তা করছে না? বিভিন্ন যুদ্ধ, পরিস্থিতি ও ঘটনা উপলক্ষ্যে ২০ বছরেরও বেশী সময়ে অবতীর্ণ হওয়া কোরআনের বাণীগুলো যদি মোহাম্মদেরই কথা হত, তাহলে এতে বিভিন্ন ধরণের অনেক অমিল বা ভুল দেখা যেত ৷ অর্থাৎ বিষয়বস্তু বা তথ্য গঠন বা বাক্যরীতির দিক থেকে এতে অনেক ভুল দেখা যেত৷ কিন্তু এসব ক্ষেত্রেই কোরআনের সম্পূর্ণ নির্ভুলতা এর অন্যতম অলৌকিকত্বেরই প্রমাণ৷ কারণ শক্তিশালী লেখকেরও আজকের এবং ২০ বছর পরের লেখায় পার্থক্য দেখা যায় ৷ লেখকদের লেখা প্রায়ই পরিবর্তনশীল ৷
এই আয়াতের একটি লক্ষ্যণীয় দিক হচ্ছে-
অনেকেই ইসলাম ধর্মকে জ্ঞান ও প্রজ্ঞার বিরোধী মনে করেন ৷ অথচ এ আয়াতে স্পষ্টভাবে আল্লাহর আয়াত সম্পর্কে চিন্তা ও গবেষণা করতে বলা হয়েছে, যাতে এর মাধ্যমে ইসলাম ধর্মের সত্যতা বোঝা সম্ভব হয় ৷
(৮৩-৮৬ নং আয়াত)
কোরআনের আলোর এ পর্বে আমরা সূরা নিসার ৮৩ নম্বর আয়াত দিয়ে আলোচনা শুরু করবো ৷ এ আয়াতে বলা হয়েছে, অর্থাৎ "মোনাফিকদের কাজের ধরণ হলো, যখনই শান্তি ও নিরাপত্তা এবং পরাজয় বা ভয়ের কোন সংবাদ তাদের কাছে পৌছে তখনই তারা তা রটনা করে, অথচ যদি তারা রাসুলের কাছে কিংবা নেতৃস্থানীয় মুসলমানদের কাছে এসব সংবাদ পৌছে দিত, তাহলে বুদ্ধিমান ও বিচক্ষণ লোকেরা সংবাদগুলোর সত্যতা বুঝতে পারতো ৷ তোমাদের প্রতি যদি আল্লাহর অনুগ্রহ ও করুণা না হত, তাহলে তোমাদের অল্প ক'জন ছাড়া সবাই শয়তানের অনুসরণ করতে ৷"
আগের কয়েকটি আয়াতে ইসলামের প্রাথমিক যুগে মহানবী (সা:) ও মুসলমানদের সাথে মোনাফিকদের বিদ্বেষী আচরণ সম্পর্কে কথা বলা হয়েছে ৷ এই আয়াতেও মোনাফিকদের অন্য একটি অন্যায় আচরণের কথা উল্লেখ করে বলা হয়েছে, বিভিন্ন গুজব রটনা করা বিশেষ করে যুদ্ধের মত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্পর্কে গুজব রটনা ছিল মোনাফিকদের অন্যতম কাজ ৷ এ ধরণের গুজব প্রচারের ফলে অনেক সময় মানুষ অযথাই ভীত হয়ে পড়তো, অথবা অবাস্তব ধরনের নিরাপত্তা অনুভব অনুভব করতো বা অতিরিক্ত আশাবাদী হয়ে উঠতো ৷ এরপর ইসলামী সমাজের নেতৃবৃন্দ সম্পর্কে জনগণকে একটি সামগ্রিক নির্দেশ দিয়ে বলা হচ্ছে, রাষ্ট্র সম্পর্কিত বিষয়ে মুসলিম জনগণের উচিত নেতৃবৃন্দের শরণাপন্ন হওয়া এবং গুজব জাতীয় সংবাদও তাদের কাছে পৌছে দেয়া যাতে তারা সঠিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে জনগণকে সত্য বা বাস্তবতা জানাতে পারেন ৷ এরপর এই আয়াতে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তুলে ধরে বলা হয়েছে, মোনাফিকদের এই পদ্ধতি মানুষকে খোদাদ্রোহীতা ও শয়তানের অনুসরণের দিকে টেনে নিচ্ছিল এবং আল্লাহর অনুগ্রহ ও মহানবী (সা:) এর পথ নির্দেশনা না থাকলে অধিকাংশ মানুষই পথভ্রষ্ট হতো ৷ অর্থাৎ যে কোন সংকট বা সমস্যার সময় তারা শয়তানের কূ-মন্ত্রণার শিকার হতো ৷ এই আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় দিক হচ্ছে,
প্রথমত: মানুষের মধ্যে গুজব ছড়ানো মোনাফিকদেরই কাজ ৷ তাই গুজব সম্পর্কে সাবধান থাকতে হবে ৷
দ্বিতীয়ত: মুসলমানদের সামরিক বিষয় সম্পর্কিত সংবাদ তাদের নেতাদের নিয়ন্ত্রণে থাকা উচিত ৷
তৃতীয়ত: শুধুমাত্র সুবিবেচক ও গভীর দৃষ্টির অধিকারী মানুষই সত্য উপলদ্ধি করতে পারে ৷ সাধারণ মানুষের উচিত তাদের অনুসরণ করা ৷
এবারে সূরা নিসার ৮৪ নম্বর আয়াত নিয়ে আলোচনা করা যাক ৷ এ আয়াতে বলা হয়েছে, অর্থাৎ "হে নবী, আল্লাহর পথে যুদ্ধ করুন, মুমিনদেরকেও এ ব্যাপারে উত্সাঘহ দিন, আপনাকে শুধু নিজের কাজের জন্যই দায়ী করা হবে ৷ অচিরেই আল্লাহ কাফেরদের শক্তি সংযত করবেন ৷ আল্লাহ শক্তিতে প্রবল এবং শাস্তিদানে কঠোর ৷"
ঐতিহাসিক বর্ণনায় এসেছে, ওহুদ যুদ্ধে মুসলমানদের পরাজয়ের পর আবু সুফিয়ান পরবর্তী হামলার সময় নির্ধারণ করে ৷ নির্দিষ্ট সময়ে মহানবী (সা:)ও মুসলমানদেরকে অগ্রসর হবার নির্দেশ দিলেন ৷ কিন্তু ওহুদ যুদ্ধে পরাজয়ের তিক্ত স্মৃতির কারণে বহু মুসলমান এই নির্দেশ পালন করেনি ৷ আর এই পটভূমিতেই নাজেল হলো এ আয়াত ৷ এ আয়াতে রাসূল (সা:)কে বলা হলো, 'এমনকি কেউ না আসলেও আপনি সেনাবাহিনী সংঘবদ্ধ করা ও যুদ্ধ ক্ষেত্রে এগিয়ে যাবার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত ৷ একই সাথে আপনি মুসলমানদেরকে জিহাদে অংশ নেয়ার আহ্বান জানানোর কাজও অব্যাহত রাখুন ৷ ' মহানবী(সা:)ও তাই করলেন ৷ অল্প সংখ্যক মুসলমানও তাঁর সাথে অগ্রসর হলেন ৷ কিন্তু নির্দিষ্ট যুদ্ধ ক্ষেত্রে শত্রু বাহিনী উপস্থিত হল না এবং কোন সংঘর্ষও হয়নি ৷ এভাবে মুসলমানদের উপর কাফেরদের আঘাত প্রতিরোধ করার খোদায়ী ওয়াদা বাস্তবায়িত হয়েছিল ৷ এই আয়াতে শিক্ষণীয় দিকগুলো হচ্ছে,
প্রথমত: সংগ্রাম ও বিপদের সময় সমাজের নেতাকেই সবার আগে অগ্রসর হতে হবে ৷ এমনকি তিনি যদি এ পথে সম্পূর্ণ একাকীও হন, তাহলেও তাকে সংগ্রাম করতে হবে ৷ আর এ অবস্থায় আল্লাহর পক্ষ থেকেও তার কাছে সাহায্য পৌঁছবে ৷
দ্বিতীয়ত: নবীগণের দায়িত্ব হলো, জনগণের কাছে ধর্ম ও ধর্মীয় বিধানের দায়িত্ব পৌছে দেয়া ৷ তাদের উপর কিছু চাপিয়ে দেয়া নবীগণের দায়িত্ব নয় ৷
তৃতীয়ত: প্রত্যেকেই তার নিজের কাজের জন্য দায়ী ৷ এমনকি নবীগণও মানুষের কাজ কর্মের জন্য দায়ী নন ৷ নবীগণ শুধু তাদের নিজ দায়িত্বের ব্যাপারেই দায়ী ৷
চতুর্থত: খোদায়ী শক্তি সবচেয়ে বড়, অবশ্য এই শক্তির সাহায্য পাবার শর্ত হলো, মানুষকে নিজ নিজ দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে হবে ৷
এবারে সূরা নিসার ৮৫ নম্বর আয়াত নিয়ে আলোচনা করা যাক ৷ এই আয়াতে বলা হয়েছে, অর্থাৎ "যে কেউ ভালো কাজের সুপারিশ করবে, এর পুরস্কারে তার অংশ থাকবে ৷ আর যে মন্দ কাজের উত্সাযহ দেয়, তাতেও অর্থাৎ ঐ কাজের শাস্তিতে তার অংশ থাকবে ৷ আল্লাহ সব কিছুর ওপর নজর রাখেন ৷"
আগের আয়াতে মুমিনদেরকে জিহাদের দিকে আহ্বানের ব্যাপারে মহানবী (সা:)কে দায়িত্বশীল বলে উল্লেখ করার পর এ আয়াতে একটি সার্বজনীন বিধানের কথা উল্লেখ করা হয়েছে ৷ এতে বলা হয়েছে, শুধু মহানবী নয়, প্রত্যেকেই অন্যদেরকে ভালো কাজের দিকে আহ্বানের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত এবং এ আহ্বান হতে হবে ভালো পন্থায় ৷ অবশ্য প্রত্যেকেই শুধু তার নিজ কাজের জন্যই দায়ী ৷ কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে, সমাজের ভালো মন্দ বা অন্যদের ব্যাপারে উদাসীন থাকতে হবে ৷
ইসলাম ব্যক্তি কেন্দ্রীক ধর্ম নয় যে, সবাই শুধু নিজের স্বার্থ নিয়েই ব্যস্ত থাকবে এবং অন্যদেরকে সত্যের দিকে আহ্বান করা ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রামের ব্যাপারে উদাসীন থাকবে ৷ সত্কাহজের আদেশ দেয়া ও অসত্‍ কাজের ব্যাপারে নিষেধ করা প্রত্যেক মুসলমানেরই দায়িত্ব ৷ প্রত্যেকেরই উচিত নিজের জীবনে, পরিবারে, নিজ কর্মস্থলে, নিজ মহল্লায় এবং নিজের আওতাভুক্ত এলাকায় এই দায়িত্ব পালন করা ৷ মানুষ শুধু নিজ কাজেরই পুরস্কার বা শাস্তি পাবে না, অন্যদের ভালো বা মন্দ কাজের উত্সা হদাতা হিসাবে তাদের পুরস্কার ও শাস্তিরও অংশ বিশেষ তার প্রাপ্য ৷ এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হচ্ছে,
প্রথমত: দু'জন মুসলমানের মধ্যে সমঝোতা সৃষ্টি, সমবায়, সমাজে ভালো কাজে সহায়তা করা, কাফেরদের সাথে যুদ্ধে মুসলমানদের সাহায্য করা-এসব হলো সত্কাাজের কিছু দৃষ্টান্ত ৷
দ্বিতীয়ত: মানুষ স্থান ও সময়ের সীমাবদ্ধতার কারণে অনেক সময় সব ভালো কাজে অংশ নেয়ার সুযোগ পায় না ৷ কিন্তু ঐসব ভালো কাজের ব্যাপারে উত্সাকহ দিয়েও পুরস্কারের অংশ বিশেষ লাভ করতে পারে ৷
(৮৬-৮৮ নং আয়াত)
কোরআনের আলোর এ পর্বে আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি ৷ সূরা নিসার ৮৬ নম্বর আয়াত থেকে এবারের আলোচনা শুরু করছি ৷ এ আয়াতে বলা হয়েছে, "কেউ যখন তোমাদের সালাম দেয় ও শুভেচ্ছা জানায়, তখন তোমরা তার চেয়েও ভালোভাবে সালামের জবাব এবং শুভেচ্ছা জানাবে অথবা অনুরুপভাবেই জবাব দিবে ৷ আল্লাহ সব বিষয়ে হিসাব গ্রহণকারী ৷"
এই আয়াতে মুসলমানদের পারস্পরিক আচরণের ধরণ উল্লেখ করে বলা হচ্ছে, ভ্রাতৃত্ব ও ভালোবাসা অন্যদের সাথে কথায় ও কাজে সম্পর্কের ভিত্তি হওয়া উচিত ৷ কারো সাথে দেখা হলে একে অপরকে সালাম করা এবং বন্ধুদের সাথে ও পারিবারিক সাক্ষাতে উপহার বিনিময় করা এসবের ওপর ইসলাম অত্যধিক গুরুত্ব আরোপ করেছে ৷ এই আয়াতে সালাম ও উপহার দেয়াকে সার্বজনীন বলে উল্লেখ করা হয়েছে এবং কেউ কখনো শুভেচ্ছা ও সালাম জানালে তাকে আরো ভালো কিছু দেয়া বা ভালো জবাব দেয়া কিংবা অন্তত: অনুরূপ জবাব দেয়ার পরামর্শ দেয়া হয়েছে ৷ অর্থাৎ কারো সম্বর্ধনা বা সালামের জবাব আরো উষ্ণভাবে দেয়া উচিত ৷ ঐতিহাসিক বর্ণনায় এসেছে, ইমাম হাসান মুজতবার এক দাসী তাকে একটি ফুলের তোড়া উপহার দিলে তিনি তাকে মুক্ত করে দেন এবং এর ব্যাখ্যা হিসাবে পবিত্র কোরআনের এই আয়াতের কথা উল্লেখ করেন ৷ এই আয়াতে শিক্ষণীয় কয়েকটি দিক হচ্ছে,
প্রথমত: অন্যদের যে কোন ধরণের শুভেচ্ছা ও সৌজন্যতার জবাব সবচেয়ে ভালো পন্থায় এবং সংক্ষিপ্ততম সময়ে দেয়া উচিত ৷
দ্বিতীয়ত: কল্যাণকামীতা বা উপহার প্রত্যাখ্যান করা অপছন্দনীয় কাজ ৷ উপহার গ্রহণ করা উচিত এবং আরো ভালোভাবে উপহারের জবাব দিতে হবে ৷
তৃতীয়ত: অন্যদের সালাম ও সৌজন্যতা উপেক্ষা করার পরিণতি ভালো হয় না ৷ এ জন্যে মানুষকে পৃথিবীতে ও পরকালে নেতিবাচক পরিণতি ভোগ করতে হবে ৷
এবারে সূরা নিসার ৮৭ নম্বর আয়াত নিয়ে আলোচনা করা যাক ৷ অর্থাৎ "আল্লাহ এক এবং তিনি ছাড়া অন্য কোন মাবুদ নেই, তিনি তোমাদেরকে কিয়ামতের দিন-যে দিনের ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই, তোমাদেরকে একত্র করবেন ৷ হে মানুষ- কে আল্লাহর চেয়ে বেশী সত্যবাদী ?"
এর আগে ৮৬ নম্বর আয়াত শেষে বলা হয়েছিল, আল্লাহ মানুষের সব কাজের হিসাব রাখেন এবং কোন ভাল ও মন্দ কাজ তার কাছে গোপন থাকে না ৷ এই আয়াতে বলা হচ্ছে সেই আল্লাহ এক, সৃষ্টির শুরু হয়েছিল যাঁর হাতে এবং শেষও হবে তাঁর হাতে ৷ তিনি সমস্ত মানুষকে একটি নির্দিষ্ট দিনে এক জায়গায় জড়ো করবেন এবং এরপর সবাইকে তাদের কাজের প্রতিফল দিবেন ৷ এরপর স্মরণ করিয়ে দেয়া হচ্ছে কেন কেউ কেউ বিচার দিবসের ব্যাপারে সন্দেহ করছে? তাহলে তারা কি আল্লাহর চেয়েও সত্যবাদী কারো অস্তিত্বের কথা জানে? আর আল্লাহর মিথ্যা বলার কি প্রয়োজনই বা রয়েছে? মানুষ প্রয়োজনের তাগিদে কিংবা ভয় পেয়ে অথবা অজ্ঞাত কারণে মিথ্যা বলতে পারে ৷ কিন্তু আল্লাহর কোন কিছুরই প্রয়োজন হয় না এবং তিনি কোন কিছুর মুখাপেক্ষী নন ৷ আল্লাহ সর্ব শক্তিমান ও সর্বজ্ঞ ৷ তাই আল্লাহর পক্ষ থেকে কিয়ামত বা বিচার দিবস সম্পর্কে মিথ্যা ওয়াদা করার কোন যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই ৷ এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হচ্ছে,
প্রথমত: এখন থেকেই বিচার দিবস বা কিয়ামতের কথা স্মরণ করে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য প্রচেষ্টা চালাতে হবে এবং আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো উপাসনা বা দাসত্ব পরিহার করতে হবে ৷
দ্বিতীয়ত: কিয়ামতের ব্যাপারে আল্লাহর ওয়াদা ও ন্যায়বিচারের মত বহু যু্ক্তি থাকায় এতে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই ৷ যে আল্লাহ তোমাদেরকে অনস্তিত্ব বা শুন্য থেকে সৃষ্টি করেছেন, তিনি কি আমাদেরকে পুনরায় সৃষ্টি করতে সক্ষম নন?
এবারে সূরা নিসার ৮৮ নম্বর আয়াত নিয়ে আলোচনা করা যাক ৷ এ আয়াতে বলা হয়েছে, অর্থাৎ "হে বিশ্বাসীগণ, কেন মোনাফেকদের সম্পর্কে তোমরা দু দলে বিভক্ত হয়ে গেলে? অথচ আল্লাহ তাদের কৃতকর্মের জন্য তাদেরকে পূর্ববস্থায় ফিরিয়ে দিয়েছেন! আল্লাহ যাদেরকে তাদের কৃতকর্মের জন্য পথভ্রষ্ট করেছেন, তোমরা কি তাদের সুপথে আনতে চাও? যাকে আল্লাহ পথভ্রষ্ট করেন, তুমি তার জন্যে মুক্তির কোন পথ পাবে না ৷"
এই আয়াতে মোনাফেকদের সাথে একদল মুসলমানের সহজ-সরল আচরণের সমালোচনা করে বলা হয়েছে, তোমাদের মধ্যে একদল কেন এত সরল-মনা? তারা মনে করে, মোনাফেকরা তাদের সাথে রয়েছে ৷ তারা কখনই তোমাদের সাথে ছিল না এবং তারা কখনও মন থেকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেনি ৷ এই সব কপট লোকেরা শুধু মুখে মুখেই ইসলাম ধর্মের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেছিল ৷ ঈমানের লক্ষণ হল, আল্লাহ ও রাসূলের নির্দেশ বাস্তবে পালন করা ৷ শুধু বাহ্যিক চাল-চলন ও কথাবার্তার মাধ্যমে আল্লাহ ও রাসুলের নির্দেশ মান্য করা যথেষ্ট নয় ৷ কপট বা মোনাফেকরাই এ ধরণের আচরণ করে থাকে ৷ 'মুখে মধু অন্তরে বিষ' নীতির চর্চাকারীরা আল্লাহর পক্ষ থেকে শাস্তি পাবার কারণে সৌভাগ্য ও মুক্তির সোপান থেকে বঞ্চিত৷ তারা মনে করে, জনগণকে তো ভালোই ধোঁকা দিয়েছি ৷ কিন্তু বাস্তাবে এরা নিজেদেরকেই ধোঁকা দিয়েছে ৷ এই আয়াত থেকে বোঝা গেল অন্তরে ঈমান না এনে যারাই বাহ্যিক আচরণের মাধ্যমে জনগণকে ধোঁকা দিয়ে ঈমানদার সাজার চেষ্টা করবে, তারা মুক্তির পথ থেকে বঞ্চিত হবে ৷ এমনকি মহানবী(সা:)ও তাদেরকে সুপথ বা মুক্তির পথ দেখাতে সফল হবেন না ৷ যদিও এখানে বলা হয়েছে যে, আল্লাহ তাদেরকে পুনরায় পথভ্রষ্ট অবস্থায় ফিরিয়ে নেন, কিন্তু এর আগেই সাবধান করে বলা হয়েছে, এসবই তাদের কাজের ফল মাত্র ৷ আল্লাহ সুপথ পাবার ক্ষেত্রগুলো সবার জন্য সমানভাবে সৃষ্টি করেছেন ৷ কিন্তু কেউ যদি সুপথ বা মুক্তির পথ না ধরে বরং একে নিয়ে ছল চাতুরী করে এবং আল্লাহর নির্দেশকে হেয় করে তাহলে সে তো সু-পথ পাবেই না একই সাথে সু-পথ পাবার পরবর্তী ক্ষেত্রগুলো থেকেও সে বঞ্চিত হবে ৷ ঠিক এ অর্থেই আল্লাহ তাদের পথভ্রষ্ট করেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে ৷ এ অবস্থার বাইরে আল্লাহ কখনই কাউকে পথভ্রষ্ট করেন না ৷ যার চিন্তাভাবনা সম্পুর্ণ বিপরীত ও কপটতায় পরিপূর্ণ এবং যার তত্পররতা শুধু শত্রুর জন্যেই নিবেদিত সে ব্যক্তিও সু-পথ পাবে-এমন প্রত্যাশা কোনমতেই যৌক্তিক ও ঠিক নয় ৷ এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হচ্ছে,
প্রথমত: মানুষের অধ:পতনের জন্য মানুষ নিজেই দায়ী ৷ আল্লাহ কাউকে বিনা কারণে পথভ্রষ্ট করেন না ৷
দ্বিতীয়ত: মোনাফেকদের মোকাবেলার ব্যাপারে সরল বিশ্বাসী ও অদূরদর্শী হওয়া উচিত নয় ৷ মোনাফেকদের মন জয়ের প্রচেষ্টা থেকে বিরত থাকতে হবে এবং তাদের জন্য আমাদের বিন্দুমাত্র মনে দু:খ রাখাও ঠিক নয় ৷
আমরা যেন আল্লাহর নির্দেশাবলী মেনে চলতে পারি এবং কথায়, কাজে ও চিন্তায় সব ধরণের কপটতা থেকে মুক্ত থাকি আল্লাহর কাছে এ তৌফিক চেয়ে এ পর্বের আলোচনা শেষ করছি ৷ #
(৮৯-৯১ আয়াত)
কোরআনের আলোর এ পর্বে আমরা সূরা নিসার ৮৯ নম্বর আয়াত থেকে আলোচনা শুরু করবো ৷ এ আয়াতে বলা হয়েছে, অর্থাৎ "মোনাফিকরা চায় তারা যেমন কাফের, তোমরাও তেমনি কাফের হয়ে যাও যাতে তোমাদের ও তাদের মধ্যে কোন পার্থক্য না থাকে ৷ অতএব তাদের মধ্য থেকে কাউকে বন্ধ হিসাবে গ্রহণ করো না, যে পর্যন্ত না তারা তওবা এবং আল্লাহর পথে হিজরত না করে ৷ এরপর যদি তারা বিমুখ হয় এবং কাফেরদের সথে সহযোগিতা অব্যাহত রাখে, তাহলে তাদেরকে পাকড়াও কর এবং যেখানে পাও হত্যা কর ৷"
আগের আলোচনায় আমরা বলেছি, মুসলমানদের মধ্যে এমন এক দল সরলমনা লোক আছে যারা মোনাফেকদের পক্ষে কথা বলে এবং তাদেরকে সমর্থন করে ৷ এই আয়াতে এসব সরলমনা লোককে সতর্ক করে দিয়ে বলা হচ্ছে, মোনাফেকরা এত বেশী নিকৃষ্ট স্বভাবের যে, তারা শুধু নিজেরাই কাফের নয় বরং তারা চায় তোমরাও তাদের মত কাফের হয়ে যাও যাতে তাদের সাথে তোমাদের কোন পার্থক্য না থাকে ৷ আসলে এসব লোক তোমার সাথে বন্ধুত্ব করার যোগ্যতা রাখে না ৷ সুতরাং তারা কুফরী ও মুনাফেরীর পথ থেকে ইসলামের পথে ফিরে না আসা পর্যন্ত তাদেরকে বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করো না ৷ কিন্তু তারা যদি তা না করে, অর্থাৎ কুফরির পথ থেকে ফিরে না আসে তাহলে তাদেরকে যেখানে পাওয়া যাবে সেখানেই গ্রেফতার এবং প্রয়োজনে হত্যা করতে হবে ৷ কারণ তারা ইসলামের নামকে অপব্যবহার করছে ৷
কিন্তু অন্যদিকে, পবিত্র কোরআনে মুসলিম দেশে বসবাসকারী ইহুদী ও খ্রিস্টানদের প্রতি যথোপযুক্ত সম্মান প্রদর্শন ও তাদেরকে সহযোগিতা করতে বলা হয়েছে এবং কারোরই তাদের উপর আক্রমণ চালানোর অধিকার নেই ৷ কিন্তু মোনাফেকরা যেহেতু ইসলামের নামে অন্যায় ও ক্ষতি করার চেষ্টা করে, সেজন্য তাদের ব্যাপারে সবচেয়ে কঠোর নির্দেশ জারী করা হয়েছে ৷
এই আয়াতের শিক্ষণীয় কয়েকটি দিক হচ্ছে,
প্রথমত: মোনাফেকদের সৃষ্ট বিপদের ব্যাপারে সচেতন থাকতে হবে এবং তাদেরকে কখনই বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করা যাবে না ৷ কারণ তারা কাফেরদের চেয়েও নিকৃষ্ট ৷
দ্বিতীয়ত: প্রকৃত ঈমানের নিদর্শন হচ্ছে, আল্লাহর পথে হিজরত ৷ যে ধর্মের জন্য দেশ ত্যাগে রাজি হবে না সে প্রকৃত ঈমানদার নয় ৷
তৃতীয়ত: তওবার মাধ্যমে সব ধরণের গোনাহ থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যায় ৷
এবারে সূরা নিসার ৯০ নম্বর আয়াত নিয়ে আলোচনা করা যাক ৷ এ আয়াতে বলা হয়েছে, অর্থাৎ "কিন্তু যারা এমন কোন সম্প্রদায়ের সাথে মিলিত হয় যাদের সাথে তোমরা চুক্তিবদ্ধ এবং তারা তোমাদের কাছে এমন অবস্থায় আসে যে, তাদের অন্তর তোমাদের ও স্বজাতির সাথে যুদ্ধ করতে ইচ্ছুক নয় ৷ অবশ্য আল্লাহ যদি ইচ্ছে করতেন এবং তোমাদের ওপর তাদের ক্ষমতা দিতেন তাহলে তারা অবশ্যই তোমাদের সাথে যুদ্ধ করতো ৷ কিন্তু তারা যদি তোমাদের কাছ থেকে চলে যায়, তোমাদের সাথে যুদ্ধ না করে এবং তোমাদেরকে শান্তি ও সমঝোতার প্রস্তাব দেয়, তাহলে আল্লাহ তাদের ওপর আক্রমণ চালাবার কোন পথ তোমাদের জন্য রাখেননি ৷"
এই আয়াতে মোনাফেকদের দুটি দল বা শ্রেণীর ব্যাপারে কিছুটা নমনীয়তা প্রদর্শনের কথা বলা হয়েছে ৷ যারা মুসলমানদের সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে এবং মুসলমানদের সাথে যুদ্ধ করার নীতি থেকে সরে দাঁড়িয়েছে-তারা ঐ দু্ই দলের অন্তর্ভূক্ত ৷ অর্থাৎ প্রথম দলটি মুসলমানদের সাথে চুক্তি করার কারণে এবং অন্য দলটি যুদ্ধে নিরপেক্ষতা ঘোষণার কারণে মুসলমানদের কাছ থেকে নমনীয় আচরণ পাবে ৷ এই আয়াতে শিক্ষণীয় দুটি দিক হলো,
প্রথমত: সব ধরণের চুক্তি এমনকি কাফেরদের সাথে স্বাক্ষরিত রাজনৈতিক ও সামরিক চুক্তির প্রতিও সম্মান দেখাতে হবে-যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা চুক্তি লঙ্ঘন করবে ৷
দ্বিতীয়ত: ইসলাম ধর্মে যে জিহাদ বা সংগ্রামের কথা বলা হয়েছে, তা প্রতিশোধ গ্রহণ বা আধিপত্য কায়েমের জন্যে নয় ৷ শত্রু পক্ষ যদি চুক্তি মেনে চলে অথবা শান্তির প্রস্তাব দেয় এবং যুদ্ধের নীতি থেকে সরে দাঁড়ায় তাহলে কেউই তাদের ওপর আক্রমণ করার অধিকার রাখে না ৷
এবারে সূরা নিসার ৯১ নম্বর আয়াত নিয়ে আলোচনা করা যাক ৷ এ আয়াতে বলা হয়েছে, অর্থাৎ " খুব শীঘ্রই তুমি এমন একদলকে পাবে যারা তোমাদের এবং তার জাতির সাথে শান্তি ও নিরাপদে থাকতে চায় ৷ কিন্তু যখনই তাদেরকে ফ্যাসাদ বা মুর্তি পুজার প্রতি মনোনিবেশ করানো হয়, তখন তারা তাদের পূর্বাবস্থায় ফিরে যায় ৷ ফলে তারা যদি তোমাদের সাথে বিবাদ করা থেকে বিরত না হয়, শান্তির প্রস্তাব না দেয় এবং শত্রুতার হাতকে গুটিয়ে না নেয়, তাহলে তাদেরকে যেখানেই পাও গ্রেফতার এবং হত্যা কর ৷ আমি তোমাদেরকে তাদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য অধিকার ও ক্ষমতা দান করেছি ৷"
মক্কার একদল মুশরেক যখনই হযরত মুহাম্মদ (সা:) এর কাছে আসত তখনই বলতো, তারা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছে ৷ কিন্তু আবার যখন মক্কায় ফিরে যেত তখন তারা আগের মতো মুর্তি পুজা করতো এবং কাফেরদের সাথে যাতে সম্পর্ক খারাপ না হয় সেজন্য তাদের সাথে একাত্বতা প্রকাশ করতো ৷ এভাবে তারা উভয় পক্ষের কাছ থেকেই স্বার্থ আদায় করতো এবং উভয় পক্ষের বিপদ থেকেই নিরাপদে থাকত ৷ আসলে তারা অন্তর থেকে কাফেরদের সাথে ছিল এবং তারা মুসলমানদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ষড়যন্ত্রে অংশ নিত ৷ এরই পরিপ্রেক্ষিতে এই আয়াতটি নাযিল হয় এবং মোনাফেকদের এই দলের ব্যাপারে কঠোর হবার নির্দেশ দেয়া হয় ৷ কারণ এ ধরণের লোক মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ কাফেলায় শত্রুপক্ষের গুপ্তচর হিসাবে কাজ করে এবং তাদের পক্ষ থেকে ঐসব কাফেরদের চেয়েও মারাত্মক বিপদের আশংকা রয়েছে যেসব কাফের কোন বিবেচনা ছাড়াই দ্রুত যুদ্ধ ঘোষণা করে ৷ সূরা নিসার ৯০ নম্বর আয়াতে মোনাফেকদের যে দুটি দলের ব্যাপারে মুসলমানদেরকে নমনীয়তা প্রদর্শন করতে বলা হয়েছে তাদের বিপরীতে এই আয়াতে উল্লেখিত মোনাফেক দলটি প্রতারক, ধোঁ‍কাবাজ ষড়যন্ত্রকারী ৷ এরা যুদ্ধের ব্যাপারে নিরপেক্ষতা প্রদর্শন তো করেই না বরং যুদ্ধের আগুনকে আরো প্রজ্জ্বলিত করে ৷ এ কারণে এদের ব্যাপারে নির্দেশের সাথে আগের দুদলের ক্ষেত্রে নির্দেশের তফাৎ রয়েছে ৷ মোনাফেকদের ষড়যন্ত্রকারী ও ভন্ড দলটির ব্যাপারে ইসলামের নির্দেশ হলো, এদেরকে যেখানেই পাওয়া যাবে সেখানেই গ্রেফতার এবং প্রয়োজনে হত্যা করতে হবে ৷
সূরা নিসার ৯১ নম্বর আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় দিক হচ্ছে,
প্রথমত: মুসলমানদেরকে শত্রুর প্রকারভেদ সম্পর্কে সচেতন হতে হবে এবং শত্রুর ধরণ বুঝে তার সাথে সেরকম ব্যবহার করতে হবে ৷
দ্বিতীয়ত: ইসলামী শাসন ব্যবস্থা উত্খােতের ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে ৷
তৃতীয়ত: মোনাফেকদের চেনার উপায় হলো, তারা শুধু দুনিয়াবী সুখ-শান্তি নিয়ে ব্যস্ত থাকে এবং ঈমান বা ধর্মীয় বিশ্বাস রক্ষার বিষয়টি তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয় ৷
আমরা যেন সব ধরণের মোনাফেকী, কপটতা ও ভন্ডামী থেকে দূরে থাকতে পারি আল্লাহর কাছে এই তৌফিক কামনা করে কোরআনের আলোর এ পর্বের আলোচনা শেষ করছি ৷
(৯২-৯৪ আয়াত)
কোরআনের আলোর এ পর্বে আমরা সূরা নিসার ৯২ নম্বর আয়ত থেকে আলোচনা শুরু করবো ৷ এ আয়াতে বলা হয়েছে, অর্থাৎ "কোন ঈমানদারের জন্যই অপর কোন ঈমানদারকে হত্যা করা বৈধ নয় ৷ কিন্তু কেউ যদি ভুলক্রমে কোন মুমিনকে হত্যা করে এবং তার স্বজনরা হত্যাকারীকে ক্ষমা না করে, তাহলে সে একজন মুসলমান ক্রীতদাসকে মুক্ত করবে এবং নিহত ব্যক্তির স্বজনদেরকে হত্যার বদলা বা রক্তমূল্য পরিশোধ করবে ৷ কিন্তু নিহত ব্যক্তি যদি শত্রু পক্ষের হয়, তাহলে শুধু একজন মুসলমান ক্রীতদাসকে মুক্ত করবে ৷ আর যদি সে তোমাদের সাথে চুক্তিবদ্ধ কোন সম্প্রদায়ের হয়, তাহলে তার স্বজনদেরকে রক্তমূল্য অর্পন এবং একজন মুসলমান ক্রীতদাসকে মুক্ত করবে ৷ অবশ্য এ ক্ষেত্রে যার সামর্থ নেই সে আল্লাহর কাছ থেকে গোনাহ মাফ করানোর জন্য একাধারে দু'মাস রোজা রাখবে; আল্লাহ মহাজ্ঞানী ও প্রজ্ঞাময় ৷ "
হাদীসে এসেছে, এক মুসলমান মক্কায় দীর্ঘদিন ধরে কিছু মুশরেকের হাতে নির্যাতিত হয় ৷ মদীনায় হিজরত করার পর নির্যাতনকারীদের একজনের সাথে তার সাক্ষাৎ হয় ৷ মুসলমান লোকটি তাকে দেখেই ক্রোধান্বিত হয়ে ওঠে ৷ অথচ মুশরেক ব্যক্তি যে এরই মধ্যে মুসলমান হয়েছে তা তার জানা ছিল না ৷ সে তাকে অত্যাচারী ও কাফের ভেবেই হত্যা করে ৷ এরপর এ খবর রাসূলে খোদার কাছে পৌছার পর এই আয়াতটি নাযিল হয় ৷
এর আগের অনুষ্ঠানে আমরা বলেছি এ ধরনের অত্যাচারী ও কাফেরের শাস্তি হলো গ্রেফতার এবং প্রয়োজনে হত্যা করা ৷ কিন্তু এটা স্পষ্ট যে, ব্যাপক তদন্ত ও গভীর পর্যালোচনার পরই কেবল এ ধরণের পদক্ষেপ নেয়া যাবে এবং তা হতে হবে মুসলিম শাসকের তত্ত্বাবধানে ৷ অর্থাৎ যে কেউ তার ইচ্ছেমত রক্তপাত ঘটাতে পারবে না ৷ ফলে মদীনায় ঐ মুসলমানের পদক্ষেপটিও ভুল ছিল এবং কোরআনের এই আয়াতে উল্লেখিত নির্দেশ অনুযায়ী শাস্তিস্বরূপ রক্তমূল্য পরিশোধ করতে হবে ৷ এখানে লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো, নিহত ব্যক্তির আত্মীয়-স্বজনরা ইসলামের শত্রু হলে কিংবা মুসলমানদের সাথে কোন শান্তি চুক্তিতে আবদ্ধ না হলে নিহতের পরিবারকে রক্তমূল্য পরিশোধ করতে হবে না ৷ কারণ এতে করে শত্রুপক্ষের আর্থিক সামর্থ জোরদার হবার আশঙ্কা রয়েছে এবং তা মুসলমানদের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে ৷ নিহতের আত্মীয় স্বজনকে রক্তমূল্য পরিশোধ করার নীতি সমাজে অনেক ইতিবাচক প্রভাব রাখতে পারে ৷ এর ফলে - প্রথমত: নিহতের পরিবার তাদের একজন সদস্যের মৃত্যুর কারণে যে আর্থিক ক্ষতির শিকার হয়েছে তা কিছুটা পুষিয়ে নিতে পারে ৷ দ্বিতীয়ত: সমাজের প্রতিটি মানুষ রক্তপাত ঘটানোর ক্ষেত্রে সতর্ক হয় যাতে ভুলক্রমেও কোন হত্যাকান্ড না ঘটে সে ব্যাপারে সচেতন থাকে ৷ তৃতীয়ত: রক্তমূল্য পরিশোধ করার নির্দেশের মাধ্যমে মানুষের প্রাণ ও সামাজিক নিরাপত্তার প্রতি সম্মান দেখানো হয়েছে ৷
সূরা নিসার ৯২ নম্বর আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হচ্ছে,
প্রথমত: মানুষের রক্তপাত ঘটানো আল্লাহর প্রতি ঈমানের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় ৷ কেউ যদি ভুলক্রমেও কাউকে হত্যা করে, তাকে এ জন্য কঠিন শাস্তি পেতে হবে ৷
দ্বিতীয়ত: ইসলাম ধর্ম দাস প্রথার প্রসার না ঘটিয়ে ক্রীতদাসদের মুক্ত করার বিভিন্ন পথ বাতলে দিয়েছে ৷ যেমন, হত্যাকারীকে তার হত্যার ক্ষতিপূরণ হিসাবে একজন দাসকে তার বন্দীদশা থেকে মুক্ত করার বিধান রাখা হয়েছে ৷ এভাবে একজন বন্দী মানুষ নব জীবন ফিরে পায় ৷
তৃতীয়ত: ইসলাম শুধু এবাতদের নিয়ম-কানুনই বাতলে দেয়নি, একই সাথে সুষ্ঠুভাবে দেশ পরিচালনা এবং সমাজে ন্যায়বিচার ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠার জন্য দেওয়ানী ও ফৌজদারী আইনও বাতলে দিয়েছে ৷
এবারে সূরা নিসার ৯৩ নম্বর আয়াত নিয়ে আলোচনা করা যাক ৷ এ আয়াতে বলা হয়েছে, অর্থাৎ "যে ব্যক্তি স্বেচ্ছায় কোন ঈমানদারকে হত্যা করবে, তার শাস্তি জাহান্নাম সে চিরকাল সেখানেই থাকবে ৷ আল্লাহ তার প্রতি ক্ষুব্ধ হয়েছেন, তাকে অভিসম্পাত করেছেন এবং তার জন্য কঠোর শাস্তি প্রস্তুত রেখেছেন ৷"
হাদীসে এসেছে, ওহুদ যুদ্ধ চলাকালে একজন মুসলমান অপর এক মুসলমানকে ব্যক্তিগত শত্রুতার জের হিসাবে হত্যা করে ৷ রাসূলে খোদা (সা:) ওহীর মাধ্যমে এ সম্পর্কে অবহিত হন এবং যুদ্ধ থেকে ফেরার পথে হত্যাকারীকে কেসাস করার অর্থাৎ অনুরূপ শাস্তি দেয়ার নির্দেশ দেন এবং তার ক্ষমা প্রার্থনাও তিনি প্রত্যাখ্যান করেন ৷
এর আগের আয়াতে ভুলক্রমে হত্যার শাস্তি সম্পর্কে আলোচনার পর এবারের আয়াতে ইচ্ছাকৃতভাবে হত্যার শাস্তি সম্পর্কে বর্ণনা দেয়া হয়েছে ৷ স্বেচ্ছায় হত্যাকারী ব্যক্তি আল্লাহর পক্ষ থেকে অভিশপ্ত এবং সে সব সময় দোযখের আগুনে জ্বলবে ৷ অবশ্য এর আগের এক আয়াতে আমরা এ ধরণের অপরাধের দুনিয়াবী শাস্তি সম্পর্কেও বলেছি ৷ আর তা হলো কেসাস বা হত্যার বদলে হত্যা ৷
সূরা নিসার ৯৩ নম্বর আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হচ্ছে,
প্রথমত : অপরাধীর বিচারের ক্ষেত্রে স্বেচ্ছায় অপরাধকারী এবং ভুলবশত: অপরাধকারীর শাস্তি সম্পূর্ণ আলাদা ৷
দ্বিতীয়ত : সমাজকে স্থিতিশীল ও দূর্নীতিমুক্ত করার একটি উপায় হলো সমাজে কঠিন ফৌজদারী আইন বাস্তবায়ন করা ৷
এবারে সূরা নিসার ৯৪ নম্বর আয়াত নিয়ে আলোচনা করা যাক ৷ এ আয়াতে বলা হয়েছে, অর্থাৎ "হে ঈমানদারগণ, তোমরা যখন আল্লাহর পথে বের হও তখন সব কিছু যাচাই করে নিও এবং কেউ যদি তোমাদেরকে ইসলাম ও শান্তির কথা বলে তাহলে যুদ্ধে গনিমত ও পার্থিব সম্পদ লাভের উদ্দেশ্যে তাকে বলো না যে, তুমি মুসলমান নও ৷ বস্তুত: আল্লাহর কাছে অনেক সম্পদ রয়েছে ৷ তোমরাওতো এর আগে তার মতই ছিলে ৷ আল্লাহ তোমাদের ওপর অনুগ্রহ করেছেন ৷ অতএব সত্যতা যাচাই করে নাও ৷ আল্লাহ তোমাদের কাজকর্মের খবর রাখেন ৷"
ঐতিহাসিক বর্ণনায় এসেছে, খায়বার যুদ্ধে মদীনার পার্শ্ববর্তী এলাকার ইহুদী ও মুসলমানদের মধ্যে যুদ্ধ সংঘটিত হবার পর রাসূল (সা:) ঐ এলাকার ইহুদী অধ্যুষিত একটি গ্রামের লোকজনকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ ও ইসলামী শাসন ব্যবস্থা মেনে নেবার আহ্বান জানানোর জন্য একদল মুসলমানকে সেখানে পাঠান ৷ মুসলিম সৈন্যদের গ্রামে প্রবেশের খবর শুনে একজন ইহুদী তার ধন সম্পদ ও পরিবারের সদস্যদেরকে পাহাড়ে লুকিয়ে রেখে তৌহিদ ও শাহাদাতের বাণী উচ্চারণ করতে করতে মুসলমান সৈন্যদেরকে ঐ গ্রামে স্বাগত জানায় ৷ কিন্তু ইহুদী লোকটি ভয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছে এই ভেবে একজন মুসলমান তাকে হত্যা করে এবং তার ধন সম্পদ যুদ্ধে প্রাপ্ত গণিমত হিসাবে গ্রহণ করে ৷ এ ঘটনার পরই পবিত্র কোরআনের এই আয়াতটি নাযিল হয় ৷ এ আয়াতের মাধ্যমে এ ধরনের আচরনের নিন্দা জানানো হয় এবং ঘোষণা দেয়া হয়, যে সৈন্য সমাবেশ, গনিমতের মাল ও দুনিয়াবী সম্পদ লাভ করা ইসলামের লক্ষ্য নয় বরং ধর্মের প্রতি আহ্বান এবং মুসলমান ও কাফেরদের মধ্যে শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠাই ইসলামের মূল লক্ষ্য ৷ এই আয়াতে শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো,
প্রথমত: যুদ্ধ ও জিহাদ হতে হবে শত্রুদের লক্ষ্য উদ্দেশ্য ও তাদের অবস্থান সম্পর্কে সঠিক তথ্যের ভিত্তিতে ৷ এ ক্ষেত্রে আবেগ ও বস্তুগত স্বার্থকে প্রশ্রয় দেয়া যাবে না ৷
দ্বিতীয়ত: কেউ নিজেকে মুসলমান হিসাবে দাবী করলে এবং তার দাবী মিথ্যা ও ভন্ডামী বলে প্রমাণিত না হলে তাকে অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে গ্রহণ করতে হবে ৷
তৃতীয়ত: ক্ষমতার অপব্যবহার করা যাবে না এবং বিনা কারণে প্রতিপক্ষের সম্পদ আটক এবং তাদের বিরুদ্ধে হত্যার নির্দেশ জারী করা যাবে না ৷
চতুর্থত: যুদ্ধের ময়দানে লড়াইরত মুজাহিদদের মধ্যেও দুনিয়াবী আকর্ষণ দেখা দিতে পারে ৷ কাজেই এ ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে ৷
পঞ্চমত: মানুষকে তার জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে এমনকি তার শত্রুদের ব্যাপারেও ভারসাম্যপূর্ণ আচরণ এবং মধ্যপন্থা অবলম্বন করতে হবে ৷
(৯৫-৯৯ আয়াত)
কোরআনের আলোর এ পর্বে আমরা সূরা নিসার ৯৫ ও ৯৬ নম্বর আয়াত থেকে আলোচনা শুরু করবো ৷ এ দুটি আয়াতে বলা হয়েছে, অর্থাৎ " মুমিনদের মধ্যে যারা কোন সঙ্গত কারণ না থাকা সত্ত্বেও জিহাদে অংশ নেয় না এবং যারা জান-মাল দিয়ে আল্লাহর পথে জিহাদ করে তারা সমান নয় ৷ আল্লাহতায়ালা, যারা জিহাদে অংশ নেয়নি তাদের তুলনায় জিহাদকারীদের মর্যাদা বাড়িয়ে দিয়েছেন, যদিও আল্লাহ প্রত্যেককেই পুরস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন ৷ মহা পুরস্কারের ক্ষেত্রে আল্লাহ মুজাহিদদেরকে যারা জিহাদে অংশ নেয়নি, তাদের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন ৷ এসব তার পক্ষ থেকে পদমর্যাদা, ক্ষমা ও দয়া ৷ আল্লাহ ক্ষমাশীল ও দয়াময় ৷ "
এর আগের আলোচনায় আমরা বলেছি, আল্লাহ শত্রুদের ব্যাপারে কোন তাড়াহুড়ামূলক পদক্ষেপ নিতে নিষেধ করেছেন ৷ এই আয়াতে শত্রুদের মোকাবেলায় জিহাদে সক্রিয়ভাবে অংশ নেয়ার জন্য মুসলমানদেরকে আহ্বান জানানো হয়েছে ৷ ভীতু ও সুবিধাবাদী মুসলমানদেরকে জিহাদে অংশ নিতে উত্সাবহিত করার লক্ষ্যে এটা স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে যে, যারা জিহাদে অংশ না নিয়ে শুধু নামাজ ও দোয়ার ওপর নির্ভর করে এবং যারা জিহাদে অংশ নিয়েছে; তাদের মর্যাদা সমান নয় ৷ এরপর আল্লাহ বলেছেন, মুজাহিদদের মর্যাদা অন্যদের চেয়ে বেশী ৷ এই আয়াতেরই শেষে আবার বলা হচ্ছে, শুধু মর্যাদাই নয় তাদের জন্য মহা পুরস্কার অপেক্ষা করছে ৷ আর ঐ পুরস্কারের সাথে রয়েছে আল্লাহর বিশেষ দয়া, রহমত ও ভালোবাসা ৷ অবশ্য আল্লাহ তার বান্দাদের ওপর কঠিন কোন দায়িত্ব চাপিয়ে দেন না ৷ সুতরাং যারা অসুস্থ এবং শারীরিক দিক থেকে যুদ্ধে অংশ নিতে অক্ষম তাদেরকে জিহাদে অংশ নেয়ার দায়িত্ব থেকে মুক্তি দেয়া হয়েছে ৷ তবে তারা যদি মুজাহিদদেরকে আর্থিক সাহায্য দিয়ে, মুজাহিদদের পক্ষে প্রচার চালিয়ে এবং অন্যকোনভাবে সহযোগিতা করে, তাহলে তারাও জিহাদে অংশগ্রহণকারীদের মতই আল্লাহর প্রতিশ্রুত পুরস্কার পাবে ৷ এই আয়াতে যদিও তিন তিন বার যারা যুদ্ধে অংশ নেয়নি, তাদের তুলনায় যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের শ্রেষ্ঠত্বের কথা বলা হয়েছে কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে, অন্যদের সেবা ও শ্রমকে উপেক্ষা করা হয়েছে বরং আল্লাহ সব মুসলমানকেই পুরস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন ৷ অর্থাৎ এখানে মুজাহিদদেরকে শ্রেষ্ঠতর হিসাবে উল্লেখ করা হলেও অন্যদের উপেক্ষা করা হয়নি ৷ এই দুটি আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হচ্ছে,
প্রথমত: ইসলামী রাষ্ট্রে ন্যায়বিচারের অর্থ এই নয় যে, সেখানে সব মুসলমানই সমান ৷ বরং এ ক্ষেত্রে জিহাদে অংশ নেবার মত বিষয়গুলো যে কোন মুসলমানের জন্যই ইতিবাচক দিক ৷ ফলে রাষ্ট্রের জনগণ ও কর্মকর্তাদেরকে অবশ্যই এসব বিষয় মেনে চলতে হবে ৷ তবে মুজাহিদদের প্রত্যাশাও অযৌক্তিক হওয়া চলবে না ৷
দ্বিতীয়ত: আল্লাহর রহমত লাভের শর্ত হলো, পবিত্র থাকা ও পবিত্র হওয়া ৷ অর্থাৎ প্রথমে ক্ষমা এবং এরপর রহমত ৷
তৃতীয়ত: মহান আল্লাহ দয়াবান ও ক্ষমাশীল ৷ তবে আল্লাহর এই বিশেষ গুনাবলী থেকে লাভবান হতে পারার বিষয়টি মানুষের নিজের ইচ্ছা ও কর্মের ওপর নির্ভর করে ৷
এবারে সূরা নিসার ৯৭ নম্বর আয়াত নিয়ে আলোচনা করা যাক ৷ এ আয়াতে বলা হয়েছে, অর্থাৎ " যারা নিজের ওপর অত্যাচার করেছে, তাদের প্রাণ হরণের সময় ফেরেশতারা বলবে তোমরা কি অবস্থায় ছিলে? তারা উত্তরে বলবে, আমরা আমাদের শহরে অসহায় ছিলাম ৷ ফেরেশতারা বলবে, আল্লাহর পৃথিবী কি প্রশস্ত ছিল না? তোমরা হিজরত করতে পারতে ৷ অতএব, এদের বাসস্থান হলো জাহান্নাম এবং তা অতি মন্দ স্থান ৷"
ইতিহাসে এসেছে, মক্কার কিছু মুসলমান প্রাণের ভয়ে ভীত হয়ে মাঝে মধ্যেই সেখানকার কাফেরদের সাথে সহযোগিতা করতো এবং কেউ কেউ কাফেরদের পক্ষে যুদ্ধে অংশ নিয়ে নিহতও হয়েছিল ৷ এরই পরিপ্রেক্ষিতে কোরআনের এই আয়াতটি নাযিল হয় এবং এ ধরণের মুসলমানদেরকে পাপী ও অপরাধী হিসাবে ঘোষণা করা হয় ৷ এই আয়াতে আরো বলা হয়েছে, স্বদেশ প্রেমের অজুহাতে শত্রুদের সাথে সহযোগিতা গ্রহণযোগ্য নয় বরং এ ক্ষেত্রে ধর্ম রক্ষাই জরুরী বা মুখ্য বিষয় ৷ অর্থাৎ ধর্ম রক্ষার জন্য প্রয়োজন হলে এক স্থান থেকে অন্যস্থানে হিজরত করতে হবে ৷ এখানে লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো মৃত্যুর সময় ফেরেশতাদের সাথে মানুষের সাক্ষাৎ হয় এবং ফেরেশতারা তখন মানুষের সাথে কথা বলে ও পাপী মানুষদেরকে তিরস্কার ও ভত্র্সরনা করে ৷ এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হচ্ছে,
প্রথমত : শুধু আল্লাহই নন ফেরেশতারাও মানুষের কর্ম সম্পর্কে অবহিত ৷
দ্বিতীয়ত : ধর্ম বিরোধী সমাজ থেকে হিজরত করা মুসলমানদের জন্য ফরজ এবং কাফেরদের সাথে সহযোগিতা করা হারাম ৷
তৃতীয়ত : দেশ প্রেম নয় বরং খোদাপ্রেমই মানুষের জীবনের মূখ্য বিষয়, ফলে ধর্ম বিরোধী সমাজে পরিবর্তন আনতে হবে নতুবা অন্য কোথাও হিজরত করতে হবে ৷
এবারে সূরা নিসার ৯৮ ও ৯৯ নম্বর আয়াত নিয়ে আলোচনা করা যাক ৷ এ আয়াতে বলা হয়েছে, অর্থাৎ "কিন্তু পুরুষ, নারী ও শিশুদের মধ্যে যারা অসহায় এবং মুক্তির জন্য কোন উপায় বের করতে পারে না ও কোন পথও জানেনা ৷ আশা করা যায়, আল্লাহ তাদেরকে ক্ষমা করবেন ৷ আল্লাহ পাপ মার্জনাকারী, ক্ষমাশীল ৷"
এর আগের আয়াতে হিজরত করাকে ধর্ম রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় বলে উল্লেখ করা হয়েছে ৷ কিন্তু এই আয়াতে বলা হচ্ছে যারা হিজরত করতে অক্ষম ও মুক্তির জন্য কোন উপায় বের করতে পারে না, তারা এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম এবং আল্লাহ তাদের কাছ থেকে অপ্রত্যাশিত কিছু আশা করে না ৷ ইসলাম ধর্মে কোন দায়িত্ব পালনের শর্ত হলো তা পালনের জন্য শক্তি ও সামর্থ থাকা ৷ যারা মানসিক ও শারীরিকভাবে অসুস্থ, তাদের জন্য ঐশী দায়িত্ব পালন জরুরী নয় ৷ এই আয়াতে এ ধরনের অসুস্থ পুরুষ ও নারীদেরকে শিশুদের পর্যায়ভুক্ত ও দূর্বল বলে বিবেচনা করা হয়েছে ৷ এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হচ্ছে,
প্রথমত: শক্তি ও সামর্থ থাকলে ধর্ম রক্ষার জন্য হিজরত শুধু পুরুষদের জন্যই নয় বরং নারী ও শিশুসহ পরিবারের সব সুস্থ সদস্যের জন্যেই বাধ্যতামূলক ৷
দ্বিতীয়ত: যে কোন বিষয়ে সঙ্গত কারণ আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য ৷ অর্থাৎ সঙ্গত কারণে কোন দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে মানুষ সে ক্ষেত্রে ক্ষমা পাবে ৷ কিন্তু মিথ্যা অজুহাত গ্রহণযোগ্য নয় ৷
(১০০-১০৩ আয়াত)
কোরআনের আলোর এ পর্বে আমরা সূরা নিসার ১০০ নম্বর আয়াত থেকে আলোচনা শুরু করবো ৷ এ আয়াতে বলা হয়েছে, অর্থাৎ "যে কেউ আল্লাহর পথে দেশ ত্যাগ করে, সে এর বিনিময়ে প্রশস্ত স্থান ও সচ্ছলতা পাবে ৷ এছাড়া কেউ যদি আল্লাহ ও রাসুলের উদ্দেশ্যে দেশ ত্যাগ করে এবং পথে মৃত্যুমুখে পতিত হয়, তবে তার প্রতিদান আল্লাহর উপর ন্যস্ত আছে ৷ আল্লাহ ক্ষমাশীল ও দয়াময় ৷ "
এর আগের পর্বে আমরা বলেছি, ঈমানদার মুসলমানরা তাদের শহর ও দেশের প্রতি অন্ধ অনুরক্ত নন ৷ তাদের কাছে দেশ প্রেমের চেয়ে খোদাপ্রেম অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ণ ৷ সুতরাং কারো যদি তার শহরে নিজের ধর্ম রক্ষা ও মেনে চলতে অসুবিধা হয়, তাহলে তাকে হিজরত করতে হবে ৷ কিন্তু এই আয়াতে বলা হচ্ছে, ‌তোমরা ভেবো না যে পৃথিবী শুধু তোমার শহর ও দেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ বরং আল্লাহর পৃথিবী অনেক বড় এবং যে কেউ ধর্ম রক্ষার জন্য হিজরত করলে নিশ্চিতভাবে ধর্মের জন্য কাজ করা তার পক্ষে সহজ হবে এবং কাজের সুযোগও বৃদ্ধি পাবে ৷ এছাড়া পৃথিবীতেও সে আরো ব্যাপক সুযোগ সুবিধার অধিকারী হবে ৷ অন্যদিকে কেউ যদি হিজরত করতে গিয়ে পথে মৃত্যুবরণও করে, তাহলে আল্লাহ তাকে পুরস্কৃত করবে এবং এই মৃত্যু তার জন্য ক্ষতিকর নয় ৷ এই আয়াতে হিজরত বলতে ধর্ম রক্ষার জন্য দেশত্যাগকে বোঝানো হলেও ইসলাম ধর্মে আল্লাহর উদ্দেশ্যে সব ধরণের দেশ ত্যাগই হিজরতের সমতুল্য ৷ উদাহরণ স্বরুপ জ্ঞান অর্জন ও ধর্ম প্রচারের জন্য দেশত্যাগও হিজরতের অন্তর্ভূক্ত ৷ এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হচ্ছে,
প্রথমত: মানুষের কাজ হলো নিষ্ঠার সাথে তার দায়িত্বগুলো পালন করা ৷ এ ক্ষেত্রে সফল হবার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ নয় ৷ অর্থাৎ মানুষকে প্রথমে হিজরতের জন্য ঘর থেকে বের হতে হবে; লক্ষ্যস্থলে পৌঁছতে না পারলেও অসুবিধা নেই ৷
দ্বিতীয়ত: ঘরে বসে থেকে কোন ধরণের উন্নতি করা সম্ভব নয় ৷ উন্নয়নের জন্য চেষ্টা চালাতে হবে, তত্প র হতে হবে এবং হিজরত করতে হবে ৷
তৃতীয়ত: কাজ নির্বাচনের ক্ষেত্রে সতর্ক থাকতে হবে এবং এমন কোন কাজ নির্বাচন করতে হবে যা সম্পন্ন করতে গিয়ে মৃত্যু ঘটলেও তা আল্লাহর পথে মৃত্যু হিসাবে বিবেচিত হবে এবং তার জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে পুরস্কার রয়েছে ৷
এবারে সূরা নিসার ১০১ নম্বর আয়াত নিয়ে আলোচনা করা যাক ৷ এ আয়াতে বলা হয়েছে, অর্থাৎ "তোমরা যখন সফর কর তখন নামাজ সংক্ষেপ করলে তোমাদের কোন ক্ষতি নেই; যদি তোমরা আশংকা কর যে, কাফেররা তোমাদের ক্ষতি করবে ৷ নিশ্চয় কাফেররা তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু ৷"
এই আয়াতে জিহাদে অংশগ্রহণকারী ও সফরকারীদের নামাজ সম্পর্কে নির্দেশ দেয়া হয়েছে ৷ ইসলামের প্রাথমিক যুগে মুসলমানরা নামাজ সংক্ষেপ করাকে অপরাধ বা গোনাহ মনে করতেন ৷ আল্লাহ কোরআনের এই আয়াত নাযিলের মাধ্যমে মুসলমানদেরকে জিহাদ ও হিজরতের সময় শত্রুদের আক্রমণ থেকে রক্ষা পাবার জন্য নামাজ সংক্ষেপের নির্দেশ দিয়েছেন যাতে শত্রুরা মুসলমানদের কোন ক্ষতি করার সুযোগ না পায় ৷ এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হচ্ছে,
প্রথমত: নামাজেও শত্রুদের ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে, উদাসীন হলে চলবে না ৷ কারণ ইসলাম শুধু এবাদত সর্বস্ব ধর্ম নয় ৷ মুসলমান সৈন্যরা বিপদের মধ্যে থাকলে প্রয়োজনে নামাজ সংক্ষেপ করতে হবে, যাতে শত্রুরা কোন ক্ষতি করতে না পারে ৷
দ্বিতীয়ত: কোন অবস্থাতেই নামাজ ত্যাগ করা যায় না ৷ এমনকি কঠিন বিপদের সময়ও সংক্ষেপে নামাজ আদায় করতে হবে ৷
এবারে সূরা নিসার ১০২ ও ১০৩ নম্বর আয়াত নিয়ে আলোচনা করা যাক ৷ এ আয়াতে বলা হয়েছে, অর্থাৎ "হে নবী, আপনি যখন তাদের সাথে জিহাদে অংশ নিবেন ও তাদের সাথে নামাজ আদায় করবেন তখন তাদের একদল যেন আপনার সাথে নামাজে দাঁড়ায় ও নিজেদের অস্ত্র সাথে রাখে ৷ যাদের সেজদা সম্পন্ন হলো তারা যেন সরে গিয়ে পেছনে দাঁড়ায় এবং অপর দল যারা নামাজে শরিক হয়নি, তারা নামাজে অংশ নেবে-তারা যেন সতর্ক ও সশস্ত্র থাকে ৷ কাফেররা চায় তোমরা তোমাদের অস্ত্রশস্ত্র ও আসবাবপত্রের ব্যাপারে অসতর্ক থাক, যাতে তারা তোমাদের উপর হঠাত্‍ আক্রমণ চালাতে পারে ৷ যদি তোমরা বৃষ্টির জন্য কষ্ট পাও অথবা অসুস্থ থাক, তাহলে অস্ত্র রেখে দিলে তোমাদের জন্য কোন গোনাহ নেই, শুধুমাত্র আত্মরক্ষার অস্ত্র সাথে রাখবে ৷ নিশ্চয়ই আল্লাহ কাফেরদের জন্য অবমাননাকর শাস্তি রেখেছেন ৷ এরপর যখন নামাজ শেষ করবে তখন দাঁড়িয়ে, বসে ও শুয়ে আল্লাহকে স্মরণ করবে ৷ যখন তোমরা নিরাপদ হবে, তখন যথাযথভাবে নামাজ আদায় করবে ৷ নির্ধারিত সময়ে নামাজ আদায় করা মুসলমানদের জন্য ফরজ ৷"
এর আগের আয়াতে জিহাদে অংশগ্রহণকারী ও সফরকারীদের জন্য নামাজ সংক্ষেপ করার নির্দেশ দেবার পর এই আয়াতে জিহাদের ময়দানে জামায়াতে নামাজ আদায়ের পদ্ধতি সম্পর্কে বর্ণনা দেয়া হয়েছে ৷
এই আয়াতে বলা হয়েছে, জিহাদের ময়দানে নামাজ পড়ার জন্য মুসলিম সৈন্যদেরকে প্রথমে পৃথক দুটি দলে বিভক্ত হতে হবে ৷ এরপর একটি দল জামায়াতের ইমামের সাথে নামাজে দাঁড়াবে ও নিজেদের অস্ত্র সাথে রাখবে এবং প্রথম রাকাতের দ্বিতীয় সেজদা শেষ হবার পর তারা নিজেরাই ব্যক্তিগতভাবে খুব দ্রুত দ্বিতীয় রাকাত শেষ করবে ৷ জিহাদে অংশগ্রহণকারীদের জন্য ফরজ নামাজ যেহেতু দুই রাকাতের বেশী নয়, সেহেতু প্রথম দলের নামাজ এখানেই শেষ হবে ৷ এরপর প্রথম দল দ্রুত সরে গিয়ে দ্বিতীয় দলের স্থলাভিষিক্ত হবে, যাতে দ্বিতীয় দল দ্বিতীয় রাকাতের নামাজে অংশ নিয়ে জামায়াতে নামাজ পড়ার ফজিলতের অংশীদার হতে পারেন ৷ এখানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো জিহাদের ময়দানেও অবশ্যই নামাজ পড়তে হবে ৷ আর সম্ভব হলে তখনও জামায়াতে নামাজ আদায় করতে হবে এবং বিশেষ ঐ পদ্ধতির কারণে সব মুজাহিদরাই জামায়াতে নামাজ পড়তে পারছেন ৷ এছাড়াও এই আয়াতে যে কোন পরিস্থিতিতে শত্রুদের ব্যাপারে সতর্ক থাকার এবং অস্ত্র সাথে রাখার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে ৷ এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হচ্ছে,
প্রথমত: জামায়াতে নামাজ পড়ার গুরুত্ব এত বেশী যে, যুদ্ধের ময়দানেও এক রাকাত নামাজের মাধ্যমে হলেও তাতে অংশ নিতে বলা হয়েছে ৷
দ্বিতীয়ত: মুসলমানদেরকে সব সময় সতর্ক থাকতে হবে এমনকি নামাজেও শত্রুদের বিপদ সম্পর্কে উদাসীন হলে চলবে না ৷
তৃতীয়ত: নামাজের জন্য বিশেষ সময় নির্ধারণের মাধ্যমে মুসলমানদেরকে সময়ানুবর্তী ও সুশৃঙ্খল হবার প্রতি উত্সাষহিত করা হয়েছে ৷
(১০৪-১০৯ আয়াত)
এবারে আমরা সূরা নিসার ১০৪ নম্বর আয়াত দিয়ে আলোচনা শুরু করছি ৷ এ আয়াতে বলা হয়েছে, হে মুমিনগণ, জিহাদের ময়দানে শত্রুদের অনুসরণে শিথিল হয়ো না, যদি তোমরা কষ্ট পাও তবে তারাও তোমাদের অনুরুপ কষ্ট পায় এবং আল্লাহর কাছ থেকে তোমাদের যে ভরসা আছে, তাদের সে ভরসাও নেই ৷ আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময় ৷"
ঐতিহাসিক বর্ণনায় বলা হয়েছে, ওহোদ যুদ্ধে মুসলমানরা পরাজিত হলে মক্কার কাফেররা মদীনায়ও হামলার সিদ্ধান্ত নেয়, যাতে ইসলাম ও অবশিষ্ট মুসলমানরা পৃথিবীর বুক থেকে নিশ্চিহ্ন হয় ৷ এ অবস্থায় এই আয়াত নাযিল হলে মহানবী (সা:) সব মুসলমানকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হবার নির্দেশ দেন ৷ এ নির্দেশ পেয়ে যুদ্ধাহত মুসলমানরাও যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয় ৷ মুসলমানরা সবাই যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে শুনে মক্কার কাফের বাহিনী নতুন করে হামলার চিন্তা পরিত্যাগ করে ৷
যুদ্ধের সাধারণ বিষয় হলো এটা যে, বিশ্বাসী ও অবিশ্বাসী উভয় পক্ষেরই কিছু সেনা হতাহত ও বন্দী হয় ৷ কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো-তাদের লক্ষ্য ও পরিণতি ৷ ইসলামের সেনারা আল্লাহর গায়েবী সাহায্যের উপর ভরসা রাখে ৷ কিন্তু কাফের সেনাদের সে আশ্রয় বা ভরসা নেই ৷ আহত ও শহীদ মুসলমানরা বেহেশতের মত মহাপুরস্কার পাবে ৷ কিন্তু নিহত কাফেররা পরকালে বিশ্বাসী নয় বলে তাদের কোন ভালো পরিণতি নেই ৷ এই আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় দিক হলো,
প্রথমত: অবিশ্বাসী শত্রুদের কাছে কোন কোন সময় পরাজয়ের কারণে তাদের প্রতি কঠোরতায় শিথিলতা করা উচিত নয় ৷ আল্লাহর রহমতের উপর ভরসা রেখে মুসলমানদেরকে সব সময়ই মনোবল শক্তিশালী রাখতে হবে ৷
দ্বিতীয়ত: আল্লাহর দয়ার উপর ভরসা করা মুসলমান যোদ্ধাদের সবচেয়ে বড় পুঁজি ৷ তাই শহীদ হওয়া এবং বিজয় উভয়ই তাদের জন্য সৌভাগ্য ৷
তৃতীয়ত: ধর্মীয় দায়িত্ব পালনের জন্য যেসব কষ্ট ও ত্যাগ-তীতিক্ষা করা হয়েছে, সেসব বিফলে যাবে না৷ আল্লাহ সব কিছুই মনে রাখেন এবং আল্লাহ তাঁর হেকমত বা প্রজ্ঞা অনুযায়ী পুরস্কৃত করেন ৷
এবারে সূরা নিসার ১০৫ ও ১০৬ নম্বর আয়াত নিয়ে আলোচনা করা যাক ৷ এ দুটি আয়াতে বলা হয়েছে, অর্থাৎ " নিশ্চয়ই আমি আপনার প্রতি সত্যসহ গ্রন্থ অবতীর্ণ করেছি, যাতে আপনি মানুষদেরকে আদেশ দেন বা তাদের ব্যাপারে ন্যায় বিচার করেন, যা আল্লাহ আপনাকে শিখিয়েছে ৷ আপনি বিশ্বাসঘাতকদের পক্ষে বিতর্ককারী হবেন না ৷ আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করুন ৷ নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমাশীল, দয়াময় ৷"
কোন কোন বর্ণনায় এসেছে, এক মুসলমান একটি ঢাল চুরি করে কেলেঙ্কারী বা বদনাম এড়ানোর জন্য ঢালটি এক ইহুদীর কাছে ঘরে নিক্ষেপ করে এবং ঐ ইহুদীকে চোর হিসাবে সাব্যস্ত করার জন্য তার বিরুদ্ধে স্বাক্ষ্য দিতে নিজ বন্ধুদের অনুরোধ জানায় ৷ মহানবী (সা:) এইসব সাক্ষ্যের ভিত্তিতে ঐ মুসলমান ব্যক্তিকে নির্দোষ ঘোষণা করেন এবং ইহুদী ব্যক্তিটিকে চুরির জন্য অভিযুক্ত করেন ৷ এ অবস্থায় আল্লাহ ওহী নাযেল করে তাঁকে আসল ঘটনা জানিয়ে দেন ৷
বিচার করার সময় বিচারককে উভয় পক্ষের কাছ থেকে নির্ভরযোগ্য প্রমাণ আদায়ের চেষ্টা করতে হবে এবং এমন উপায় বের করতে হবে, যাতে অপরাধীরা আইনের অপব্যবহারের সুযোগ পায় ৷ ঢাল চুরির ঘটনায় আইনের অপব্যবহার রোধের জন্য ওহী নাযেল করার দরকার ছিল এবং আল্লাহর সাহায্যের ফলে নবুওতের সত্যতা ও আল্লাহর সাথে মহানবী(সা:)এর সম্পর্কের বিষয়টি প্রমাণিত হবার পাশাপাশি নির্দোষ ব্যক্তিও শাস্তির হাত থেকে রক্ষা পেল ৷ এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হল,
প্রথমত : পবিত্র কোরআনের বাণী নাযেলের উদ্দেশ্য হল মানুষের কাছে সত্য ও বাস্তবতা তুরে ধরা ৷ কারণ পবিত্র কোরআন সমস্ত সত্য ও মানুষের প্রকৃত অধিকারের ভিত্তি ৷ তাই বিচার কার্যের জন্যও পবিত্র কোরআনই সর্বোত্তম মানদণ্ড ৷ অর্থাৎ বিচারকদেরকে পবিত্র কোরআনের আইন অনুযায়ী বিচার করতে হবে ৷
দ্বিতীয়ত : কেউ শাস্তি পেলেই তা ঐ ব্যক্তির অপরাধের প্রমাণ নয় বা তার বিরুদ্ধে অপরাধের অভিযোগ আনা ঠিক হবে না ৷ কোন বিধর্মীও যদি নির্দোষ হয়, তাহলেও তাকে রক্ষা করতে হবে ৷
এবারে সূরা নিসার ১০৭, ১০৮ ও ১০৯ নম্বর আয়াত নিয়ে আলোচনা করা যাক ৷ এই তিনটি আয়াতে বলা হয়েছে, অর্থাৎ " যারা নিজের বিরুদ্ধে বিশ্বাসঘাতকতা করে আপনি তাদের পক্ষে কথা বলবেন না, নিশ্চয়ই আল্লাহ বিশ্বাসঘাতক পাপীদের ভালোবাসেন না ৷ তারা মানুষের কাছে পাপ গোপন করে, কিন্তু আল্লাহর কাছ থেকে গোপন করতে পারে না ৷ কারন তিনি তাদের সাথে রয়েছেন, যখন তারা রাতে এমন বিষয়ে পরামর্শ করে যাতে আল্লাহ সম্মত নন ৷ তারা যা কিছু করে সবই আল্লাহর আয়ত্তাধীন ৷ সাবধান, তোমরা পার্থিব জীবনে না হয় বিশ্বাসঘাতকদের পক্ষে কথা বলছো, কিন্তু কিয়ামতের দিন আল্লাহর সামনে কে তাদের পক্ষে কথা বলবে অথবা সেদিন কে তাদের উকীল হবে ?"
মহান আল্লাহ এই তিন আয়াতে তিন শ্রেণীর মানুষের প্রতি হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করেছেন ৷ বিচারকদের বলা হচ্ছে, বিশ্বাসঘাতকদের পক্ষে যেন তারা বিচার না করে এবং সত্য লঙ্ঘন না করে ৷ আল্লাহ তাদের কাজ সম্পর্কে জানেন না এটাও যেন তারা মনে না করে বরং আল্লাহ তাদের সব কাজই দেখছেন ৷ এরপর বিশ্বাসঘাতক অপরাধী ও তাদের সহযোগী এই দুই শ্রেণীকে বলা হচ্ছে, তোমাদের প্রতারণা যদি ইহকালে সফলও হয় তবুও পরকালে তা কোনই কাজে আসবে না ৷ ১০৭ নম্বর আয়াতে একটা চমৎকার বিষয় বলা হয়েছে ৷ আর তা হলো, বিশ্বাসঘাতকরা যতটা না অন্যদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করছে, তার চেয়েও বেশী জুলুম ও বিশ্বাসঘাতকতা করছে নিজের ওপর ৷ কারণ প্রথমত: সে খোদার দেয়া পবিত্র বৈশিষ্ট্য হারিয়েছে এবং পবিত্র ও ন্যায় বিচারকামী মন থেকে বঞ্চিত হয়েছে ৷ দ্বিতীয়ত: সে তার আচরণের মাধ্যমে নিজের ওপর অন্যদের জুলুম ও বিশ্বাসঘাতকতার পথ সুগম করেছে ৷ এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হচ্ছে,
প্রথমত: পবিত্র কোরআনের দৃষ্টিতে সমাজের সমস্ত মানুষ একটি দেহের মত ৷ এখানে অন্যের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা নিজের ওপর বিশ্বাসঘাতকতারই শামিল ৷
দ্বিতীয়ত: তাক্বওয়া বা খোদাভীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চালিকাশক্তি হল, আল্লাহ সব কিছু দেখছে, শুনছেন এবং আমাদের সব কথা ও কাজের ওপর তার পূর্ণ কর্তৃত্ব আছে বলে বিশ্বাস করা ৷
তৃতীয়ত: কাজী হয়তো বাহ্যিক প্রমাণের ভিত্তিতে অপরাধীকে ছেড়ে দিবেন ৷ কিন্তু কিয়ামতের দিন আল্লাহ বাস্তবতার ভিত্তিতে প্রতিফল দিবেন এবং নিপীড়িত ব্যক্তিরা ইহকালে তাদের অধিকার ফিরিয়ে আনতে ও তাদের অধিকার প্রমাণ করতে ব্যর্থ হলেও মহান আল্লাহ কিয়ামতের দিন তাদেরকে ন্যায্য প্রতিদান দিবেন ৷
আমরা যেন আমাদের ধর্মীয় দায়িত্ব পালনে দৃঢ়তার পাশাপাশি সামাজিক ক্ষেত্রেও ন্যায়বিচার এবং আমানতদারী বজায় রাখতে পারি আল্লাহর কাছে এ তৌফিক কামনা করছি ৷(সংগৃহিত)