ইসলামের দৃষ্টিতে যোগ্য প্রশিক্ষক

ইতিহাসের সব পর্যায়েই নবী-রাসূলরা মানুষের জন্য চূড়ান্ত কল্যাণ নিশ্চিত করার চেষ্টা করেছেন। তারা ছিলেন-আদর্শ প্রশিক্ষক। মানুষ গড়ার এ কাজে তারা অনেক কষ্ট সহ্য করেছেন। সাধারণত: শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ ছাড়া মানুষের প্রতিভার বিকাশ ঘটে না। আর শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দেয়ার এ গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বটি পালন করে থাকেন শিক্ষকেরা। আদর্শ শিক্ষক মানুষকে চূড়ান্ত কল্যাণের পথে পরিচালিত করে। সুষ্ঠু ও সমৃদ্ধ সমাজ গড়ে তুলতেও প্রশিক্ষণের বিকল্প নেই। শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে মানুষ অজ্ঞতার অন্ধকার থেকে আলোকিত অঙ্গনে প্রবেশ করে এবং নিজেও একজন আলোকিত মানুষে পরিণত হওয়ার সুযোগ পায়। শিক্ষকই একজন শিক্ষার্থীর জ্ঞানবৃক্ষকে অস্তিত্ব দেয়। এ কারণে একজন শিক্ষকের উচিত ছাত্রদেরকে আদর্শ হিসেবে গড়ে তুলতে সার্বিক প্রস্তুতি নেয়া। সুশিক্ষিত না হলে একজন শিক্ষক সমাজকে সমস্যা ও দুর্দশার মুখে ঠেলে দিতে পারেন। এ কারণে ইসলাম ধর্মে শিক্ষকের ভূমিকার ওপর অত্যন্ত গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।
ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায়, ইসলামের প্রাথমিক যুগে মুসলিম দেশগুলোতে বহু শিক্ষাকেন্দ্র, বিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠেছিল। এ থেকেও ইসলাম ধর্মে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ব্যাপক গুরুত্বের বিষয়টি ফুঠে উঠে। ইসলামের দৃষ্টিতে, একজন শিক্ষককে বিষয়ভিত্তিক জ্ঞানের পাশাপাশি আচার-আচরণ ও নীতি-নৈতিকতার দিক থেকেও আদর্শস্থানীয় হতে হবে। আসলে ছাত্র ও শিক্ষকের সম্পর্কটা হলো আত্মিক। শিক্ষক তার ছাত্রদেরকে তার নিজের সন্তানের মতো মনে করেন এবং সে অনুযায়ী আচরণ করেন। আর এটাই হওয়া উচিত। বাবা ও মার পরেই যে ব্যক্তিটি শিশু-কিশোরদেরকে প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখেন তিনি হলেন- শিক্ষক। এ কারণে শিক্ষকতা পেশা সবচেয়ে স্পর্শকাতর ও গুরুত্বপূর্ণ।

শারীরিক ও আত্মিক-উভয় দিক থেকেই মানুষ হচ্ছে সবচেয়ে জটিল সৃষ্টি। এ কারণে মহান সৃষ্টিকর্তাই মানুষকে প্রশিক্ষণ দেয়ার সর্বোত্তম পন্থা সম্পর্কে অবহিত। আর প্রশিক্ষণের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উৎস হচ্ছে ঐশী গ্রন্থ কোরআন, রাসূল(সা.) এবং আহলে বাইত। ইসলামের দৃষ্টিতে, পূর্ণতার পথে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিটি মানুষেরই দুই ডানা প্রয়োজন। এর একটি হচ্ছে জ্ঞান এবং অপরটি ঈমান। যে শিক্ষকের ঈমান নেই তিনি শুধু তথ্য ও জ্ঞান দিয়ে ছাত্রদের সাহায্য করেন। ছাত্রের আত্মিক বিকাশ ও নৈতিক পূর্ণতার ক্ষেত্রে ঈমানহীন শিক্ষকের কোন ভূমিকা থাকে না।
আদর্শ শিক্ষকের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো- 'বিনয়'। ইমাম সাদেক (আ.) শিক্ষকদের বিনয়ী হওয়ার পরামর্শ দিয়ে বলেছেন, 'জ্ঞানের সর্বোচ্চ স্তর হচ্ছে বিনয়'। বিনয় হচ্ছে শিক্ষকদের সৌন্দর্য্য। একজন বিনয়ী শিক্ষক তাদের ছাত্রদেরকে শিক্ষা সংক্রান্ত বিষয়াদি ছাড়াও বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলার সুযোগ দেন।
এর মাধ্যমে ছাত্ররা শিক্ষকের কাছ থেকে জ্ঞান শেখার পাশাপাশি বিনয়ী হওয়ার মতো সৎ গুনের দীক্ষাও নেন। রাসূলে খোদা (সা.) হচ্ছেন-মানব জাতির সর্বোত্তম শিক্ষক। তিনি বিনয়ী হওয়াকে আল্লাহর নির্দেশের বাস্তবায়ন বলে মনে করেন। যিনি বিনয়ী তিনি সমালোচনা সহ্য করার ক্ষমতা রাখেন। ছাত্রদের সঙ্গে পরামর্শ করে চলার মানসিকতাও তিনি লালন করেন। বিনয় কখনোই একজন শিক্ষকের দুর্বলতা নয় বরং এটা তার এক বিশেষ গুণ। শিক্ষকের বিনয় ছাত্রদের মধ্যে আত্মিক প্রশান্তির জন্ম দেয়। যেহেতু অনিচ্ছা সত্ত্বেও ছাত্ররা শিক্ষকদের মাধ্যমে প্রভাবিত হয়, সে কারণে শিক্ষকের জন্য দয়াদ্র ও উদার হওয়া জরুরি। কাজেই এ বাস্তবতাকে উপলব্ধি করতে হবে যে, শিক্ষার্থীরা কেবল উপদেশের মাধ্যমে সংশোধিত ও আদর্শ হিসেবে গড়ে উঠে না বরং শিক্ষকের কথার পাশাপাশি তার কাজের গুরুত্বও এক্ষেত্রে অপরিসীম। শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ বিষয়ক বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ছাত্র ও শিক্ষকের মধ্যে সুন্দর সম্পর্কের ভিত্তি স্থাপন করার ক্ষেত্রে শিক্ষকের আচরন ও চিন্তা-বিশ্বাস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

আহলে বাইতের মহান ইমাম বাকের (আ.) ছিলেন একজন আদর্শ প্রশিক্ষক। তিনি কাজের মাধ্যমে তার সন্তানদের সৎ ও ঈমানদার হওয়ার শিক্ষা দিতেন। তার সন্তানেরা তার বাবার আচরণ দেখে শিখতেন এবং বাবাকে আদর্শ মানুষ হিসেবে অনুসরণ করতেন। ইমামের দৃঢ় ঈমান ও সদাচারণ তার সন্তানদেরকে ঈমানদার ও আদর্শ মানুষে পরিণত করেছিল। ইমাম সাদেক (আ.) তার বাবা সম্পর্কে বলেছেন, 'এক রাতে বাবা বাড়ী ফিরতে দেরি করছিলেন, তাই তাকে ডাকতে আমি মসজিদে গেলাম। তখন রাতের অর্ধেক পার হয়ে গেছে। আমি মসজিদে গিয়ে দেখলাম তিনি সিজদায় পড়ে রয়েছেন এবং তিনি ছাড়া মসজিদে আর কেউ নেই।
ইসলামের দৃষ্টিতে শিক্ষকের আরেকটি মৌলিক বৈশিষ্ট্য হচ্ছে- নম্রতা। সুরা তাহার ৪৪ নম্বর আয়াতে আল্লাহতায়ালা এ সম্পর্কে বলেছেন, "তার (ফেরাউন) সঙ্গে নম্রভাবে কথা বলবে,তাহলে হয়তো সে উপদেশ গ্রহণ করবে।"
আল্লাহর কাছে নম্রতা বা বিনয়ের সঙ্গে কথা বলার গুরুত্ব এত বেশি যে, তিনি ফেরাউনের মতো সবচেয়ে মারাত্মক কাফেরের ক্ষেত্রেও ওই পন্থা অবলম্বন করতে বলেছেন। কথা বলার সময় নম্রতা ও কোমলতা শ্রোতাদেরকে আকৃষ্ট করে এবং এতে বক্তার কথার প্রভাবও হয় অনেক বেশি। তবে এ কথাও ঠিক যে, শিক্ষকের শত চেষ্টা সত্ত্বেও অনেক ছাত্র সঠিক পথে এগোয় না। কিন্তু তাতে শিক্ষককে ধৈর্য্য হারালে চলবে না। এ কারণে একজন শিক্ষককে ধৈর্য্যশীল, নম্র ও ক্ষমাশীল হতে হবে। ইমাম সাদেক (আ.)ও সন্তান তথা তরুণদের সঙ্গে সদাচারের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। তিনি এ সম্পর্কে বলেছেন, " তরুণদের সঙ্গে কঠোর আচরণ করবেন না। তাদের সঙ্গে দয়াদ্র ও সুন্দর আচরণ করতে হবে।" কারো ভুল-ত্রুটি খুজে না বেড়ানো ও তিরস্কার না করার পাশাপাশি ধৈর্য্য ধারণ ও ক্ষমা করার মতো গুণাবলী ধারণ করতে পারলে সবার সঙ্গে সদাচরণ সম্ভব। অনেক ক্ষেত্রেই শিক্ষক তার ছাত্রদের মধ্যে অন্যায় আচরণ লক্ষ্য করেন এবং অযৌক্তিক কথা শোনেন।
এ জন্য ছাত্রকে বারবার তিরস্কার না করে তার ভেতর লুকিয়ে থাকা গুণাবলী আবিস্কার করার চেষ্টা করতে হবে। আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনের সুরা ইমরানে বলেছেন, আল্লাহ ধৈর্য্যশীলদের ভালোবাসেন।

কাজেই শিক্ষকের ধৈর্য্যশীল হওয়া জরুরি। অল্প বয়সী ছাত্র-ছাত্রীদের মাঝে দুষ্টুমি ও জেদের মাত্রা বেশি দেখা যায়। কিন্তু এসব শিশুর মাঝেই লুকিয়ে আছে ব্যাপক প্রতিভা। সে কারণে ছাত্রদের সঙ্গে সব সময় সুন্দর আচরণ করতে হবে। এতে ছাত্র ও শিক্ষক-উভয়ই উপকৃত হবে। যেমনিভাবে রাসূল(সা.) সব সময় ধৈর্য্যের সঙ্গে আচরণ করতেন। ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায়, অনেকেই রাসূলের সঙ্গে খুব খারাপ আচরণ করেছেন,কিন্তু এরপরও রাসুল(সা.) ধৈর্য্য ধারণ করতেন এবং অনেক কিছুই এড়িয়ে যেতেন। এর ফলে প্রথমে যেসব ব্যক্তি রাসুলের ওপর ক্ষুব্ধ ছিলেন তারাও ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছেন। রাসূলের সদাচরণ শত্রুদের মনকেও জয় করতে পেরেছিল।

২য় পর্ব

শিক্ষকরা মানুষ গড়ার কারিগর ও জীবনের ফুল-বাগানের স্থপতি। তাদেরই স্নেহ-ভরা শিক্ষণ ও প্রশিক্ষণে বিকশিত হয় মানবীয় প্রতিভা, সমাজ হয় গতিশীল এবং জন্ম নেয় সৃষ্টিশীলতার নিত্য-নবীন প্রাণ-প্রবাহ।
শিক্ষকদের অতি উচ্চ মর্যাদা সম্পর্কে এটুকু বলাই যথেষ্ট যে মানব জাতির সবচেয়ে বড় শিক্ষক বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)ও শিক্ষক হিসেবে গর্ব অনুভব করতেন। তিনি তাঁর অন্যতম দোয়ায় বলেছেন, "হে আল্লাহ! আপনি শিক্ষকদেরকে ক্ষমা করুন, তাদেরকে দান করুন দীর্ঘ জীবন এবং তাদের উপার্জনকে করুন বরকতময়।"

শিক্ষণ ও প্রশিক্ষণ খুবই সূক্ষ্ম ও জটিল প্রক্রিয়া। যোগ্য নাগরিক গড়ে তোলার জন্য যোগ্য শিক্ষকদের রয়েছে ব্যাপক গুরুত্ব। একজন যোগ্য শিক্ষকের রয়েছে নানা বৈশিষ্ট। যেমন, ভাল শিক্ষক কখনও শিক্ষার্থী বা ছাত্রের ব্যক্তিত্বকে হেয় করেন না। মানুষের মানবীয় মর্যাদা মহান আল্লাহরই দেয়া শ্রেষ্ঠ উপহার এবং এ মর্যাদার কারণেই তারা সৃষ্টির সেরা জীব বা আশরাফুল মাখলুকাত হিসেবে সম্মানিত। তাই ভাল শিক্ষক শিক্ষণের সময় ছাত্র ও শিক্ষকের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের পরিবেশ গড়ে তোলেন এবং কখনও কোনো ছাত্রকে অপমানজনক কথা বলেন না।
বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) বলেছেন, "কোনো মুসলমানকেই ছোট মনে করো না, কারণ, তাদের মধ্যে কম সম্মানিত ব্যক্তিও মহান আল্লাহর কাছে উচ্চ মর্যাদার অধিকারী।"
একজন যোগ্য বা ভাল শিক্ষক কখনও ছাত্রদের মধ্যে বৈষম্য করেন না। মহানবী (সা.) বলেছেন, যেসব শিক্ষক ছাত্রদের মধ্যে বা শিষ্যদের মধ্যে বৈষম্য করেন, তারা আল্লাহ থেকে সবচেয়ে দূরে অবস্থানকারী দুই গ্রুপের মধ্যে অন্যতম।

বিশ্বনবী (সা.) আহলে বাইতের অন্যতম সদস্য হযরত ইমাম জাফর সাদিক (আ.) ছাত্রদের শিক্ষা দেয়ার ক্ষেত্রে বৈষম্য না করা ও সব ছাত্রকেই সমান চোখে দেখে সমপরিমাণ বা সমমানের শিক্ষা দেয়ার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। ছাত্রদের মধ্যে শিক্ষার উপকরণগুলো সমানভাবে বণ্টন করাও এ জন্য গুরুত্বপূর্ণ। পরীক্ষা নেয়া ও নম্বর দেয়ার ক্ষেত্রেও শিক্ষককে বৈষম্য থেকে দূরে থাকতে হবে যাতে দূর্বল ছাত্রকে সনাক্ত করা যায়। ইসলাম ইয়াতিম ছাত্রদের সাথে বেশি দয়াদ্র আচরণ করতে পরামর্শ দেয়। আমিরুল মুমিনিন হযরত আলী (আ.) এ ব্যাপারে শিক্ষকদের বলেছেন, "ইয়াতিমকে ঠিক সেই শিক্ষাই দাও যা তোমরা নিজ সন্তানকে দিয়ে থাক এবং তাকে নিজ সন্তানের মতই শাসন করবে।" ইয়াতিম শিশুর মা-বাবা নেই বলে তারা শিক্ষকের ওপর বেশি নির্ভরশীল। তাই ইসলাম ইয়াতিমকে বেশি গুরুত্ব দিতে ও তাদেরকে বেশি ভালবাসতে শিক্ষকদের নির্দেশ দিয়েছে। সুরা আদ দোহায় মহান আল্লাহ বলেছেন, " অতঃপর (হে রাসূল!) আপনি এতীমের প্রতি কখনও কঠোর হবেন না;"(৯৩: ৯)

শিক্ষকের মধ্যে থাকতে হবে জ্ঞান, ধৈর্য, দয়া, ন্যায়বিচার ও অন্যান্য পছন্দনীয় গুণ। এ ছাড়াও তার মধ্যে থাকতে হবে ভালভাবে বোঝানোর ক্ষমতা বা দক্ষতা। মিষ্টভাষী হওয়া ও সদালাপী হওয়াও শিক্ষকের জন্য জরুরি। পবিত্র কোরআন শিক্ষক ও প্রশিক্ষক এবং বক্তব্য উপস্থাপনার শিল্পের গুরুত্ব তুলে ধরেছে। হযরত মুসা (আ.)'র ঘটনায় এ সম্পর্কে বক্তব্য এসেছে। নবী হিসেবে ফেরাউনের কাছে আল্লাহর একত্ববাদের ও ঐশী পথ-নির্দেশনা বা হেদায়াতের দায়িত্ব পাওয়ার পর তিনি আল্লাহর কাছে প্রার্থনায় বলেছেন: "মূসা বললেনঃ হে আমার পালনকর্তা আমার বক্ষ প্রশস্ত করে দিন, আমার কাজ সহজ করে দিন এবং আমার জিহবা থেকে জড়তা দূর করে দিন, যাতে তারা আমার কথা বুঝতে পারে।..."

সুন্দর ও আকর্ষণীয় এবং সহজবোধ্য ভাষায় কথা বলতে পারাটা ভাল শিক্ষকের অন্যতম গুণ। অনেকে ভালভাবে বুঝতে পারলেও অন্যদের ভালভাবে বুঝিয়ে দিতে পারেন না।
নৈতিক ও ধর্মীয় শিক্ষা দেয়া উপযুক্ত শিক্ষকের অন্যতম দায়িত্ব। ছাত্র বা শিষ্যদের আধ্যাত্মিক উন্নয়নও তার লক্ষ্য হওয়া উচিত। হযরত ইমাম হোসাইন (আ.) বলেছেন, "যে ব্যক্তি কোনো পথ-হারা মানুষকে আল্লাহ বা সত্যের পথের দিশা দেখাবে এবং পথহারা ব্যক্তিও যদি এতে সাড়া দেয় তাহলে ঐ ব্যক্তি একজন দাসকে মুক্ত করার পূণ্য বা সওয়াব অর্জন করবে।"
নবী-রাসূলদের কাহিনীসহ বিভিন্ন শিক্ষামূলক গল্প বর্ণনা শিশু-কিশোরদেরকে ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক শিক্ষায় শিক্ষিত করার একটি কার্যকর পদ্ধতি। এসব গল্প তাদেরকে সাফল্য ও ব্যর্থতার রহস্য শিখিয়ে দেয়। পবিত্র কোরআন মানুষকে অতীতের ঘটনা থেকে শিক্ষা নিতে বলে। আর এ জন্যই এই মহাগ্রন্থ তুলে ধরেছে অতীতের জাতিগুলোর শিক্ষনীয় ইতিহাস। এইসব বর্ণনার শেষাংশে জাতিগুলোর সৌভাগ্য ও ধ্বংস বা অধঃপতনের মূল কারণগুলোও তুলে ধরেছে কোরআন।

যোগ্য শিক্ষককেও কোরআনের শিক্ষণ-পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে। অতীতের আলেম ও বিশেষজ্ঞরা বলে গেছেন, প্রশিক্ষণ ও শিক্ষা দেয়ার উদ্দেশ্য হল ভাল গুণগুলোকে মানুষের জন্য স্বভাবে বা অভ্যাসে পরিণত করা। ভাল নৈতিক গুণগুলো যদি মানুষের বদ্ধমূল স্বভাবে পরিণত না হয় তাহলে সেগুলোর গুরুত্ব খুব একটা থাকে না। তাই এসব গুণকে স্বভাবে পরিণত করার জন্য বার বার অনুশীলনের ব্যবস্থা করতে হবে শিক্ষককেই। ভাল স্বভাব বা গুণকে জাগিয়ে তোলার জন্য সতর্ক করে দেয়া ও স্মরণ করিয়ে দেয়াও অত্যন্ত মোক্ষম পদ্ধতি যা কোরআন আমাদের সামনে তুলে ধরেছে। এ কারণেই কোরআনের কাহিনীগুলোতেও একই ঘটনা ও শিক্ষনীয় দিকগুলোর পুনরাবৃত্তি দেখা যায়।

আরেকটি দিক মনে রাখা জরুরি, শিক্ষক যতক্ষণ নিজেকে পরিশুদ্ধ, আত্মগঠিত ও আত্মসচেতন করতে সক্ষম নন, ততক্ষণ তার কথা বা ভাল উপদেশেও সুফল আশা করা অন্যায়। পবিত্র কোরআন আমাদের বলে, তোমরা কেন সেকথা বল যা নিজে কর না?
তাই ভাল ও সুযোগ্য ছাত্র গড়ে তোলার জন্য আগে শিক্ষকদেরকেই উন্নত গুণ, নৈতিকতা ও আধ্যাত্মিক যোগ্যতা অর্জন করতে হবে। বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) মানব জাতির কাছে ইসলামের শিক্ষা প্রচারের আগেই নিজেকে শ্রেষ্ঠ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন । মানুষের সবগুলো শ্রেষ্ঠ নৈতিক গুণ তাঁর মধ্যে বদ্ধমূল স্বভাবে পরিণত হয়েছিল। সত্যধর্ম প্রচার শুরু করার আগেই তিনি সবচেয়ে সৎ ব্যক্তি তথা আল-আমিন বা সত্যবাদী এবং আমানতদার হিসেবে সব মহলেই খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। ইসলাম ধর্মের শিক্ষাগুলোকে যথাযথভাবে মানব জাতির কাছে তুলে ধরার জন্য তিনি সাধনায় নিয়োজিত হয়েছিলেন এবং হেরা গুহায় সাধনার সময় তিনি এ কঠিন দায়িত্ব পালনের যোগ্যতা অর্জনের জন্য আল্লাহর দরবারে অনেক দোয়া ও মুনাজাত করতেন।