নৈতিকতা, ধর্ম ও জীবন- ১১ পর্ব

ইসলাম ধর্ম মানুষকে আশাবাদী হতে বলে। এ কারণে ঈমানদার ব্যক্তিরা হতাশ ও নিরাশ হন না। পবিত্র কুরআনেও বারবারই এ বিষয়ে গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। আর পবিত্র কুরআনই হচ্ছে একমাত্র জীবন বিধান,যা মানুষের জন্য প্রকৃত কল্যাণ ও সুখ নিশ্চিত করে। এই জীবন বিধানে  মানুষের ছোট-বড় সব চাহিদার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এ কারণে আমরা দেখতে পাই, ইসলাম ধর্ম  মানুষকে শুধুমাত্র ইবাদত-বন্দেগিই করতে বলে না। পাশাপাশি চিন্তা-চেতনার পরিশুদ্ধতা ও বিবেককে কাজে লাগানোর ওপরও গুরুত্ব দেয়া হয়েছে এ ধর্মে। ইসলাম ধর্মে নীতি-নৈতিকতার অর্থ শুধু ওয়াজ-নসিহত ও দিক-নির্দেশনা দেয়া নয়। সৃষ্টিকর্তা আল্লাহকে সঠিকভাবে চেনা-জানার ওপরও ব্যাপক গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। ইসলামি নৈতিকতার মূল বৈশিষ্ট্য হলো, আল্লাহকে ভালোভাবে জানা-বোঝার মাধ্যমে বিবেককে জাগ্রত করা।

 

ঈমানদার মানুষের আরেকটি বড় গুণ হচ্ছে, আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল করা। এর অর্থ হলো, আল্লাহর ওপর নির্ভরতা, আল্লাহর কাছে নিজেকেসোপর্দ করা এবং তারই ওপরভরসা করা। সব কাজের ক্ষেত্রেই আল্লাহর ওপর নির্ভরতা অর্থাত চূড়ান্ত ফয়সালার ক্ষমতা যে আল্লাহর হাতে, তা মনেপ্রাণে স্বীকার করার নামই হচ্ছে, আল্লাহর ওপর তাওয়াককুল করা। হাদিসে এসেছে, রাসূল(সা.) আল্লাহর ওপর তাওয়াককুল বা নির্ভর করা সম্পর্কে হজরত জিব্রাইল(আ.)কে জিজ্ঞেস করেছিলেন। জিব্রাইল(আ.) বলেছেন, আল্লাহর ওপর নির্ভরতার অর্থ হলো কোনো মানুষের ওপর নির্ভর না করা। যে ব্যক্তি আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল করে সে আল্লাহ ছাড়া আর কাউকে ভয় পায় না এবং তার সব কাজের উদ্দেশ্য হয় আল্লাহতায়ালা। সে শুধুমাত্র আল্লাহর ওপর আশা-ভরসা রাখে। মানুষ সাধারণভাবে তার জীবনে বিপদ-আপদ, অভাব-অনটন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও রোগব্যাধির মতো নানা সমস্যার মুখোমুখি হন। কিন্তু এসব সমস্যার মুখে দিশাহারা হয়ে নিরাশার সাগরে হাবুডুবু খেলে চলবে না, এ অবস্থাতেও আল্লাহর ওপর নির্ভর করতে হবে।

 

পবিত্র কুরআনের সূরা আল ইমরানের ১৫৯ নম্বর আয়াতে এ সম্পর্কে বলা হয়েছে, যারা আল্লাহ্‌র উপরে নির্ভর করে, আল্লাহ্‌ তাদেরকে ভালোবাসেন।পবিত্র কুরআনের আরো কয়েকটি আয়াতেও এ বিষয়টির ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। এসব আয়াতে বলা হয়েছে, যে ব্যক্তি আল্লাহর ওপর নির্ভর করে, আল্লাহই তার জন্য যথেষ্ট। নীতি-নৈতিকতা বিষয়ে যারা গভীর চিন্তা-গবেষণা ও পড়াশোনা করেছেন,তারা মনে করেন, একত্ববাদে বিশ্বাসের সরাসরি ফলাফল হচ্ছে আল্লাহর ওপর নির্ভরতা। কারণ একজন ঈমানদারের দৃষ্টিতে পৃথিবীতে যা কিছু ঘটে, তা সরাসরি আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্কিত। এ কারণে একজন ঈমানদার ব্যক্তি আল্লাহকে সব শক্তি ও জয়ের উতস হিসেবে মনে করে। আল্লাহর ওপর নির্ভর করার মাধ্যমে মানুষ নিজেকে অন্তহীন শক্তির উতসের সঙ্গে সম্পর্কিত করে। আল্লাহ ছাড়া অন্য সব শক্তিকেই তার কাছে তুচ্ছ মনে হয়।

 

তবে  আল্লাহর ওপর নির্ভরতার পাশাপাশি চেষ্টা-প্রচেষ্টা চালানোর ওপরও ইসলাম ধর্মে ব্যাপক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি আরো স্পষ্ট হবে। যেমন ধরুন- একটি বাঘ এসে পড়েছে, তখন তার কবল থেকে আত্মরক্ষার চেষ্টা করতেই হবে। সবচেয়ে ভালো হয়, যেখানে বাঘের ভয়, সেখান থেকে নিজেকে দূরে রাখা। এ ধরনের পরিস্থিতিতে নিজের জ্ঞান-বুদ্ধিকে কাজে লাগানো না হলে, সেটা ইসলামের দৃষ্টিতে অলসতা, অসাবধানতা ও অমনোযোগিতা হিসেবে গণ্য হবে। এ ক্ষেত্রে ইসলামের প্রাথমিক যুগের একটি ঘটনা তুলে ধরা যেতে পারে। একবার এক বোকা লোক রাসুল (সা.)’র সঙ্গে দেখা করতে এলেন। দেখা হওয়ার পর রাসুল (সা.) তাকে জিজ্ঞেস করলেন, 'আপনার উট কোথায় রেখে এসেছেন?' বোকা লোকটি বললেন, 'আল্লাহপাকের ওপর তাওয়াক্কুল করে রেখে এসেছি।' এ কথা শুনে বিশ্বনবী(সা.) বললেন, 'প্রথমে আপনি উটটি বেঁধে রেখে আসুন। তারপর আপনি তাওয়াক্কুল করুন।'

 

পৃথিবীতে জীবনযাপনের জন্য কিছু নিয়মনীতি ইসলাম ধর্মেই বাতলে দেয়া হয়েছে। এসব নিয়মনীতি মেনে চলতে হবে। মানুষের সব ধরনের কাজকর্ম বাস্তবায়নের জন্য আল্লাহপাক নিয়ম ও বিধি করে দিয়েছেন। তা অবলম্বন করে তারপর তাওয়াক্কুল বা আল্লাহর ওপর নির্ভর করতে হবে। অর্থাত চূড়ান্ত ফয়সালার বিষয়টি আল্লাহর ওপর ছেড়ে দিতে হবে। আল্লাহর ওপর নির্ভরতার অর্থ হলো, এটা স্বীকার করা যে, সব ক্ষমতার মালিক হচ্ছেন আল্লাহ। তিনি সব কিছু করতে পারেন। অর্থাত সব কিছুই আল্লাহর ব্যবস্থাধীন। যানবাহনে উঠলেই যে গন্তব্যস্থলে পৌঁছা যাবে, তার নিশ্চয়তা নেই। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন যদি পৌঁছার তওফিক দেন, তাহলেই কেবল পৌঁছা যাবে। পৃথিবীর সব ক্ষেত্রেই শুধুমাত্র মহান আল্লাহর ইচ্ছাই বাস্তবায়ন হয়। এক মুহুর্তের ব্যবধানে অনেক কিছু ঘটে যেতে পারে।  যে কোনো বিপদ-আপদ, জয়-পরাজয়ের সঙ্গে আল্লাহর ইচ্ছা ও ক্ষমতার বিষয়টি সম্পর্কিত।

 

এ সম্পর্কে ইরানের বিশিষ্ট চিন্তাবিদ শহীদ মুর্তজা মোতাহারি বলেছেন, ‘আপনি যদি পবিত্র কুরআনে বর্ণিত তাওয়াককুলের তাতপর্য নিয়ে গবেষণা করেন, তাহলে বুঝতে পারবেন যে, তাওয়াককুল হচ্ছে একটি সজীব ও গৌরবময় বিষয়। অর্থাত যেখানেই কুরআন মানুষকে কাজ করতে বলেছে এবং মানুষের মন থেকে ভয়-ভীতি দূর করতে চেয়েছে, তখনি আল্লাহ বলেছেন- আল্লাহর ওপর নির্ভর করে এগিয়ে যাও এবং চেষ্টা করো।  হাদিসে এসেছে, রাসূল (সা.) একবার এক দল লোককে দেখলেন কোনো কাজ না করে বসে বসে সময় কাটাচ্ছে। তিনি তাদেরকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের জীবন চলে কীভাবে? খরচ চালাও কীভাবে?  তারা উত্তরে বলেছিল, আমরা হলাম আল্লাহর ওপর নির্ভরকারী। এ কথা শুনে রাসুল (সা.) বলেন, তোমরা আসলে আল্লাহর ওপর নির্ভরকারী নও বরং সমাজের জন্য বাড়তি বোঝা।    

 

আসলে শরীয়তের পরিভাষায় তাওয়াক্কুল হলো- সামর্থ্য অনুযায়ী চেষ্টা তদবির করে ফলাফলের জন্য আল্লাহর উপর ভরসা করা। তাওয়াক্কুলের সঠিক প্রয়োগ ব্যক্তির তাকওয়া এবং সামর্থ্যের উপর নির্ভর করে। যেমন ধরুন, একজন ব্যক্তি প্রত্যন্ত অঞ্চলে বাস করেন। মধ্যরাতে সেখানে যাতায়াতের সুবিধা নেই বললেই চলে। এ অবস্থায় ওই ব্যক্তি অসুস্থ হয়ে পড়লেন। কিন্তু কাছাকাছি কোনো ডাক্তার নেই। এ অবস্থায় তার জন্য তাওয়াক্কুল হলো, তার জ্ঞান ও সামর্থ্যের মধ্যে রোগ নিরাময়ের যে উপায় জানা আছে, তা অবলম্বন করে আল্লাহর উপর ভরসা করা। কিন্তু একই অবস্থা যদি চিকিৎসা সুবিধা আছে এমন এলাকা বা শহরের ক্ষেত্রে ঘটে, তাহলে পুরোপুরি চিকিতসা নেয়ার পর আল্লাহর উপর ভরসা করাই হবে তাওয়াক্কুল। কাজেই উপকরনাদি ব্যবহারে কোন দোষ নেই, কারন উপকরনাদি আল্লাহর পক্ষ থেকে আসা নেয়ামত। কিন্তু দোষ হবে তখনি যখন কেউ মনে করবে যে, উপকরনের কারনেই ফল হচ্ছে। আসলে এটা বিশ্বাস করতে হবে যে, শুধুমাত্র আল্লাহ ইচ্ছে করলেই উপকরনাদি কাজে লাগবে। আর পাশাপাশি মনে রাখতে হবে, মানুষ তার চূড়ান্ত ফল পাবে কিয়ামতের দিন। পৃথিবীর জীবনের সাফল্য ও ব্যর্থতাই চূড়ান্ত নয়।(রেডিও তেহরান)