জার্মান নও-মুসলিম ভ্যারিনিকা

মিসেস ভ্যারিনিকা ছিলেন একজন জার্মান কমিউনিস্ট। ইসলাম গ্রহণের কাহিনী তুলে ধরতে গিয়ে তিনি বলেছেন, "কমিউনিস্ট মতাদর্শে আল্লাহ বা খোদার কোনো স্থান নেই। এ মতাদর্শে সব কিছুই বস্তু ও বাহ্যিক কাঠামো-কেন্দ্রিক। তাই আমি মুসলমান হওয়ার আগে কমিউনিস্ট থাকাকালে এটা জানতাম না যে মানুষের আত্মা শরীরের চেয়েও বেশি শক্তিশালী। আমি ভাবতাম মানুষের কেবল একটা শরীরই রয়েছে এবং এ শরীর মৃত্যুর পর পচে নিঃশেষ হয়ে যাবে। ফলে শেষ হয়ে যাবে জীবনের সব কিছুই। আমি চিকিতসা বিদ্যার ছাত্রী ছিলাম এবং চিকিতসা বিদ্যা সংশ্লিষ্ট একটি পরীক্ষাগারে কাজ করতাম। সে সময় আমি খুব পেরেশানি ও মানসিক চাপের শিকার হয়েছিলাম। ডাক্তারদের জানিয়েছিলাম আমার এই সমস্যার কথা। তারা যেসব পরামর্শ দিতেন সেগুলো পালন করতে গিয়ে কোনো উপকার পাইনি,বরং আমার মানসিক অবস্থা আরো খারাপ হয়ে পড়ত। তীব্র মানসিক চাপের প্রভাব আমার হৃদযন্ত্রেও ছড়িয়ে পড়ে। ফলে হার্টের ডাক্তারের শরণাপন্ন হই। তিনি বলেন,আপনার হার্ট বা হৃদযন্ত্র সুস্থই আছে। কিন্তু যে মানসিক চাপ বা স্ট্রেস আপনার রয়েছে তা আপনার শরীরকেও জড়িয়ে ফেলেছে।"
 
জার্মান নও-মুসলিম ভ্যারিনিকা-কে ভর্তি করা হয় গির্জার হাসপাতালে। সেখানে একজন খ্রিস্টান চিকিতসক তাকে ধর্ম ও আল্লাহ বা স্রস্টার পরিচয় সম্পর্কে ধারণা দেন। তিনি তাকে বলেন, তোমার জন্য এমন এক ব্যক্তি দরকার যিনি ওপর থেকে ও ভেতর থেকে তোমাকে সহায়তা দেবে। কেবল তোমার বন্ধু ও পরিবার তোমার আত্মাকে শান্ত করতে পারবে না।
 
এই ডাক্তারের কথাগুলো নিয়ে ভ্যারিনিকা বেশ কিছুকাল ভাবতে থাকেন। এরপর মাঝে-মধ্যে গির্জায় যেতে থাকেন। সেখানকার পাদ্রিরাও ধর্ম ও স্রস্টার বিষয়টি আরো ভালোভাবে বুঝতে তাকে সহযোগিতা করেন,যদিও খ্রিস্ট ধর্মের অনেক শিক্ষাই ভ্যারিনিকার কাছে গ্রহণযোগ্য বলে মনে হয়নি।
 
একদিন ভ্যারিনিকা জার্মানির একটি টেলিভিশনের বিশেষ এক অনুষ্ঠান দেখছিলেন। ওই অনুষ্ঠানে একজন মুসলিম মহিলাকে আমন্ত্রণ জানানো হয় যাতে তার চিন্তাধারাকে চ্যালেঞ্জ করা ও ইসলামকে পরিত্যক্ত, একঘরে এবং অযৌক্তিক ধর্ম হিসেবে তুলে ধরা সম্ভব হয়। পর্দা বা হিজাব পরা ওই মহিলা ভ্যারিনিকার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।
 
আসলে এই মুসলিম মহিলাই যেন পথহারা ভ্যারিনিকার জন্য মুক্তির দূত হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন। হিজাব-পরা ওই মুসলিম মহিলার অভ্যন্তরীণ প্রশান্ত অবস্থা এবং আধ্যাত্মিক ও যৌক্তিক বক্তব্য ভ্যারিনিকার ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলে। এই প্রভাব ছিল এত গভীর যে তিনি আলোচনা অনুষ্ঠানটি শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ওই টেলিভিশনে ফোন করেন এবং যে কোনো ভাবেই হোক, ওই মুসলিম মহিলা আলোচকের ফোন নাম্বার সংগ্রহ করেন। ভ্যারিনিকা পরিচয় পর্ব শেষে তার কাছে ইসলামী বই-পুস্তক চান ও ইসলামকে জানার ব্যাপারেও তার দিক-নির্দেশনা দেয়ার অনুরোধ জানান।
 
মানসিক প্রশান্তি, সুখ ও নিরাপত্তা সব মানুষেরই অন্যতম প্রধান চাহিদা। ইসলামের শিক্ষা মানুষের চরিত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনে তাকে দেয় কাঙ্ক্ষিত পূর্ণতা। এই পূর্ণতা অর্জনেরই প্রাথমিক শর্ত হল মানসিক প্রশান্তি।
 
ইসলাম বিশ্বাসীদেরকে বা মুমিনদেরকে দেয় পর্যাপ্ত মানসিক প্রশান্তি। পবিত্র কুরআনের সুরা বনি-ইসরাইলের ৮২ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ এ প্রসঙ্গে বলেছেন:
 
“আমি কুরআনে এমন বিষয় নাযিল করি যা মুমিনের জন্য রোগের সুচিকিৎসা এবং রহমত। আর এতে তো জালেম বা গোনাহগারদের জন্য শুধু ক্ষতিই বৃদ্ধি পায়।”
 
একজন হিজাব-পরা মুসলিম মহিলার মধ্যে আত্মিক প্রশান্তির ঐশ্বর্য লক্ষ্য করে মুগ্ধ হয়েছিলেন এক সময়ের নাস্তিক ও কমিউনিস্ট ভ্যারিনিকা। এরপর তিনি ইসলাম সম্পর্কে পড়াশুনা শুরু করেন। পবিত্র কুরআনের বাণী ও শিক্ষাগুলো তার কাছে ইসলামের প্রকৃত ছবি তুলে ধরে। আর এ অবস্থায় তিনি গ্রহণ করেন পবিত্র এই ধর্ম। ভ্যারিনিকা ইসলাম সম্পর্কে গবেষণা ও পড়াশুনার সময়ই মহান আল্লাহর অস্তিত্ব অনুভব করতে সক্ষম হন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন :
 
“সত্যের পথে প্রতিটি পর্যায়ে আমি এগিয়ে যাওয়ার পর মহান আল্লাহ আমার জন্য আরো একটি পথ খুলে দিতেন এবং এগিয়ে যাওয়ার পথে তিনিই আমাকে দিক-নির্দেশনা দিতেন। আর এভাবে আল্লাহই আমাকে খোদাবিহীন বা নাস্তিকতাপূর্ণ জীবনের পঙ্কিলতা থেকে উদ্ধার করেছেন নিজ হাতে। আর পবিত্র কুরআন ছিল আমার জন্য সর্বোত্তম গাইডবুক।”
 
জার্মান নও-মুসলিম ভ্যারিনিকা যতই আল্লাহর পথে এগুচ্ছিলেন ততই অনুভব করছিলেন যে হতাশা ও বেদনার মেঘগুলো কেটে যাচ্ছে তার দেহ ও মন থেকে, বরং আশা ও  আধ্যাত্মিক প্রফুল্লতায় সজীব এবং প্রাণবন্ত হয়ে উঠছে তার মন-প্রাণ। কিন্তু হিজাব পরার সিদ্ধান্ত পরিবার থেকেই বাধার মুখোমুখি করে ভ্যারিনিকাকে। তার পরিবার ছিল বেশ ধনী ও অভিজাত। অভিজাত এলাকার অধিবাসী ভ্যারিনিকা ইসলামী হিজাব পরে শহরের সবচেয়ে দামী অঞ্চলে চলাফেরা করবে, এই দৃশ্য ছিল এই পরিবারের অন্য সদস্যদের জন্য অকল্পনীয় ও অগ্রহণযোগ্য। আসলে ইসলাম সম্পর্কে পশ্চিমা প্রচার মাধ্যমগুলোর বিষাক্ত প্রচারণার প্রভাবেই জার্মানরা মুসলমানদেরকে ও তাদের হিজাবকে ঘৃণার চোখে দেখে।
 
কিন্তু ভ্যারিনিকা বুঝেশুনেই হিজাব করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। এ প্রসঙ্গে জার্মান তিনি বলেছেন:
 
"আমি যখন হিজাব বেছে নেই তখন অনুভব করেছি, আমার যেন পুনর্জন্ম হয়েছে। হিজাব আমাকে দিয়েছে নিরাপত্তা, প্রশান্তি নব-জীবন ও পুনর্জন্মের আনন্দ।"
হিজাব পরায় ভ্যারিনিকাকে হারাতে হয়েছে অনেক বন্ধু ও ঘনিষ্ঠ ব্যক্তির সাহচর্য। কিন্তু মুসলমান হওয়াসহ হিজাব পরার ফলে অর্জিত খোদাপ্রেম ও খোদার ইবাদতের আনন্দ, মানসিক প্রশান্তি ও ভবিষ্যত জীবন সম্পর্কে উজ্জ্বল আশাবাদের বিপরীতে বন্ধুদের হাতছাড়া করার মত সমস্যাগুলো তার কাছে অতি তুচ্ছ বলেই মনে হয়েছে।
 
আর এইসব প্রশান্তি, ঈমানী দৃঢ়তা ও আনন্দের কারণেই ২০০১ সালের ১১ ই সেপ্টেম্বরের ঘটনার পর জার্মানিতে ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রচারণা এবং অবমাননার কয়েকটি ঘটনার পরও ইসলামের প্রতি ভ্যারিনিকার গভীর ভালবাসায় কোনো ফাটল ধরেনি।
 
হিজাবের গুরুত্ব সম্পর্কে নওমুসলিম ভ্যারিনিকা বলেছেন: "পাশ্চাত্যের কেউ কেউ মনে করেন হিজাব বা পর্দা এক ধরনের সীমাবদ্ধতা বা বন্দিত্বের প্রতীক। অথচ আমি হিজাব পরার কারণেই অভ্যন্তরীণ বা মানসিক প্রশান্তি অর্জন করেছি। আর মুসলমানদের অবস্থা সম্পর্কে সঠিক ধারণা নেই তাদের এবং তারা হিজাবের তাতপর্য ও বাস্তবতাও উপলব্ধি করতে সক্ষম নয়। "
 
নামাজ কায়েম করা, রোজা রাখা ও রাসূল (সা.)'র সুন্নাত সম্পর্কে জানাকে ইসলামের সবচেয়ে মধুর ও সুন্দর দিক বলে মনে করেন জার্মান নও-মুসলিম ভ্যারিনিকা। তিনি মনে করেন মুসলমান হওয়ার পর এখন তার আত্মা খোদায়ী আত্মা এবং এই আত্মা ভারমুক্ত ও উড়তে সক্ষম। অথচ খ্রিস্ট ধর্ম তাকে স্বনির্ভর হতে বলত। আর এই ধর্মমতে মানুষকে স্বনির্ভরতার ভার সহ্য করতে হবে পৃথিবীকে আঁকড়ে ধরে যা ভ্যারিনিকার কাছে খুবই অবাস্তব ও ভারী বলে মনে হয়েছে।
 
ভ্যারিনিকা বর্তমানে বসবাস করছেন ইরানে। তার নতুন নাম মরিয়ম ফাজেলি। তার মতে মানুষের বিবেক ও প্রকৃতি খোদা-সন্ধানী। খোদাদত্ত এই গুণকে কাজে লাগানোর উদ্যোগ নিলে আল্লাহ তাকে জীবনের বাকি পথে সহায়তা করেন। বহু বই পড়েও মানুষ প্রকৃত আধ্যাত্মিক জ্ঞান অর্জন করতে পারে না, বরং এ জন্য মনের মধ্যে গভীর আকুতি থাকা ও  ধৈর্যশীল প্রচেষ্টা জরুরি বলেও সাবেক ভ্যারিনকা বা বর্তমান মরিয়ম মনে করেন।