পৃথিবীর নেতিবাচক দিক

আলী (আঃ) পৃথিবীকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন। তিনি বলেছেন যে, উপরে ওঠার সিঁড়ি হলো পবিত্রতা,সততা ইত্যাদি গুণাবলি। কিন্তু যখনি তিনি পৃথিবীর অসুন্দর রূপ নিয়ে কথা বলেছেন তখনি মনে হয়েছে তিনি যেন এমন কোনো ঘৃণিত শত্র” সম্পর্কে কথা বলছেন যে কিনা মানুষকে সবসময় ধোকা দেয়। তিনি পৃথিবীকে এমন এক সাপের সাথে তুলনা দেন,যে সাপ দেখতে বেশ সুন্দর এবং নাদুস নুদুস অথচ তার দাঁতের নিচে আছে মারাত্মক বিষ। অন্যত্র তিনি বলেছেন-পৃথিবী তাঁর কাছে এমন একটা পাতার মতো অর্থহীন যার মুখে বসে আছে আস্ত এক ফড়িং কিংবা ছাগলের নাকের পানির মতোই তুচ্ছ। ঘৃণিত এই পৃথিবী এমন এক জগত,যে আল্লাহর কাছ থেকে মানুষেকে দূরে সরিয়ে রাখে এবং মানবিকতাকে ধ্বংস করে দেয়।
আলী (আঃ) এরকম পৃথিবীকে প্রত্যাখ্যান করে বলেছেন-হে পৃথিবী! তোর ঘাড়ের লাগাম খুলে দিয়ে তোকে মুক্ত করে দিয়ে আমি তোর শক্ত বাঁধন থেকে মুক্ত হয়েছি। তোর বিচ্যুতির স্থান থেকে দূরত্ব খুঁজেছি। কোথায় তারা যাদেরকে নিয়ে তুই খেল-তামাশা করেছিস,কোথায় সেসব জাতি যাদেরকে তোর চাকচিক্যের চমক দিয়ে প্রতারিত করেছিস? আমার কাছ থেকে দূরে সরে যাও! খোদার কসম!আমি তোর কাছে মাথানত করবো না যাতে আমাকে তুই লাঞ্ছিত করতে না পারিস,তোর বশীভূত আমি হবো না যাতে আমাকে তুই নিয়ন্ত্রণ করতে না পারিস।
আলী (আঃ) এর মতে মানুষ যদি পৃথিবীর মোহে পড়ে যায় তাহলে সে তার উন্নত সকল মূল্যবোধকে হারাতে বসে। এ কারণেই তিনি পৃথিবীর নশ্বরতা নিয়ে বারবার কথা বলেছেন। হযরত আলী (আঃ) পৃথিবীকে কঠিন ঝড়ের সাথে তুলনা করেন,যেই ঝড় সমুদ্রের বুকের নৌকায় বসবাসকারীদেরকে মুহূর্তের মধ্যে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করে দেয়,আবার কাউকে কাউকে সমুদ্রের জলে ডুবিয়ে মারে, কেউবা ঢেউয়ের বুকে ডুবতে ডুবতে বেঁচে যায় এবং ভবঘুরে বানিয়ে ছেড়ে দেয়। আলী (আঃ) এরকম পৃথিবীর পূজা করা থেকে লোকজনকে বিরত থাকার জন্যে বলেন-হে আল্লাহর বান্দাগণ! তোমাদের উপদেশ দিচ্ছি দুনিয়ার মোহ ত্যাগ করো।কেননা এই পৃথিবী তোমাকে ছেড়ে যেতে হবে। তুমি তো সেই পথিকের মতো যে পথিক একটু পথ গিয়েই ভাবে পথের শেষ প্রান্তে পৌঁছে গেছি। তারপরও তোমার চেষ্টার ক্ষান্তি নেই। অথচ এরিমাঝে হঠাৎ মৃত্যু এসে কড়া নাড়ে তোমার দরোজায়।
পৃথিবী সম্পর্কে মানুষকে এভাবে ভীতি প্রদর্শন করানোর পর ইমাম আলী (আঃ) আল্লাহর সকল বান্দাকে স্মরণ করিয়ে দেন,তারা যেন সুস্বাস্থ্য এবং সময়-সুযোগকে গণীমৎ ভাবে এবং মৃত্যুর বাস্তবতাকে যথার্থভাবে মেনে নিয়ে অতীতের ভুল শুধরে নেওয়ার চেষ্টা করে। তিনি বলেন-হে আল্লাহর বান্দাগণ! সাবধান হও! তোমার মুখে ভাষা থাকতে থাকতে,তোমার শরীর সুস্থ থাকতে থাকতে , শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো খেদমতের জন্যে প্রস্তুত থাকতে থাকতে এবং ফিরে আসার পথ উন্মুক্ত থাকতে থাকতে সাবধান হও! সুযোগ এবং সামর্থ হারাবার আগেভাগেই হুশিয়ার হও! অনিবার্য মৃত্যুর দূত তোমার দরোজায় টোকা দেওয়ার আগে ভাগেই হুশিয়ার হও!
ইমাম আলী (আঃ) বোঝাতে চেয়েছেন যে শারিরীক সামর্থ থাকতে থাকতেই আল্লাহর ইবাদাত বন্দেগি বেশি বেশি করে নাও! যে-কোনো সময় মৃত্যু এসে যেতে পারে কিংবা বার্ধক্যের সময় ইচ্ছা থাকলেও ইবাদাত বন্দেগি যৌবনকালের মতো করা সম্ভব হয় না।
দুনিয়ার চাকচিক্য এমন যে এই মোহ থেকে নিজেকে মুক্ত রাখার জন্যে একটা শক্তির প্রয়োজন হয় যে শক্তি মানুষের প্রতিরোধ ক্ষমতা এবং ইচ্ছাশক্তি বৃদ্ধি করে। সেইসাথে এই শক্তি পৃথিবীকে নশ্বর হিসেবে সবসময় সামনে তুলে ধরে আর অবিনশ্বর পারলৌকিক জীবনের দিকে নিয়ে যায় এবং এভাবে নিজের সত্যিকারের সৌভাগ্য নিশ্চিত করে। ইমাম আলী (আঃ) পরহেজগারী এবং খোদাভীতিকেই এই শক্তি তথা মানুষের ভাগ্য নিয়ন্তা বলে বোঝাতে চেয়েছেন। যারা নিজেদেরকে আল্লাহর সাথে দৃঢ়ভাবে রজ্জুবদ্ধ করেছে এবং স্রষ্টা ও সৃষ্টিজগতের বাস্তবতার দিকে অগ্রসর হয়েছে তাদের ব্যাপারে সুসংবাদ দেওয়া হয়েছে যে-আল্লাহ রাব্বুল আলামিন পরকালের শেষ বিচারের দিন কঠিন মুসবতের সময় বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাদের সহযোগী হবেন।