আরাফাতের দিনের ফজিলত

আরাফাত একটি অবিস্মরণীয় নাম। আরাফাত দিবস একটি মহিমান্বিত দিন। বিশ্ব মানবজাতির পিতা, মানবগোষ্ঠীর প্রথম পুরুষ হযরত আদম (আঃ) ও মা হাওয়ার স্মৃতি বিজড়িত আরাফাত ময়দানে সমবেত হয়ে থাকেন বিশ্বের হজ্বগামী লাখো মুসলমান। কাফনতুল্য ইহরাম বস্ত্র পরিহিত যেই আল্লাহ প্রেমিকরা-লাববাইকা, লাববাইকা আল্লাহুম্মা লাববাইক- ‘‘প্রভু হে! বান্দা হাযির, বান্দা হাযির’’ বলে আল্লাহর ঘরে হাযিরা দেন, তারাই এদিন আরাফাতের ময়দানে সমবেত হয়ে চোখের পানিতে বুক ভাসিয়ে রাববুল আলামীনের দরবারে সকাতরে এই বলে ফরিয়াদ জানান, রাববান্না যালামনা আনফুসানা ওয়া ইল্লাম তাগফিরলানা ওতার হামনা, লানা কূনান্না মিনাল খাসিরিন-- ‘‘মাবুদ! অন্যায় করেছি, অপরাধ করেছি, (মাফ চাই, তওবা করি, আর অন্যায় করবো না, রহম করো মাওলা!) তুমি যদি এ গুণাহগারদের মাফ না করো, আমাদের প্রতি সদয় না হও, নির্ঘাত আমাদের চরম ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে।’’ শূন্য মস্তক, সেলাইবিহীন বস্ত্র পরিহিত লাখো আল্লাহ প্রেমিকের কান্নার রোল এদিন আকাশে-বাতাসে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হয়ে উঠে ক্ষমাপ্রার্থী মানুষদের রোনাজারির আওয়াজে।
মক্কা থেকে ১৫ মাইল পূর্বে তাইফের পথে অবস্থিত মরু ময়দানের নামই আরাফাত। উত্তর দিক পর্বত শ্রেণী দ্বারা বেষ্টিত। ময়দানের উত্তর-পূর্ব কোণে জাবালে রহমত অবস্থিত। ইয়াওমুল আরাফাত ৯ যিলহজ্ব (সৌদী আরবের সময় অনুযায়ী) বিকেলে হজ্বের খুৎবা পঠিত হয়।
আরাফাত ময়দান পূর্ব-পশ্চিমে প্রস্থে ৪ মাইল ও দৈর্ঘ্যে ৭-৮ মাইল। হজ্বযাত্রীগণ ‘মাজসাঈন' নামক কা'বার সীমা নির্দেশক স্তম্ভশ্রেণীর ভিতর দিয়ে এখানে আগমন করেন। এর পূর্বে ‘উরানা' নামক নিম্ন ভূমি। এর পাশেই মসজিদে ইবরাহীম বা মসজিদে আরাফাত। ‘মাওকিফ' বা আরাফাতে অবস্থানের স্থান এ মসজিদের পূর্বসীমা হতে শুরু হয়ে উত্তরে ‘জাবাল-এ রহমত' ও পূর্বে তাইফ পর্বত শ্রেণীর শেষভাগ পর্যন্ত। এর পার্শ্ব দিয়েই নহর-এ-যুবাইদা প্রবাহিত। হযরত আদম (আঃ) ও বিবি হাওয়া বেহেশত থেকে পৃথিবীতে প্রেরিত হবার পর অপরাধ মাফ চেয়ে পূর্বোল্লোখিত প্রার্থনা জানাতে জানাতে এখানে এসেই উভয়ে পুনর্মিলিত ও পুনঃপরিচিত হন-- আল্লাহর দরবারে গৃহীত হয় তাদের তওবা। আরাফাত অর্থ পরিচয়। হযরত আদম (আঃ) ও বিবি হাওয়ার পুনঃপরিচয়ের ক্ষেত্র এবং উভয়ের ক্ষমা প্রাপ্তির স্থান হবার মর্যাদা লাভের কারণেই এ স্থানটি ‘ময়দান-এ আরাফাত' নামে পুণ্যস্থানরূপে খ্যাত। হযরত ইবরাহীম (আঃ)সহ বহু নবী রসুল ও তাদের অনুসারীগণ এ ময়দানে এসে আল্লাহর নিকট কান্নাকাটি করেছেন। আল্লাহর পথের অনুসারী মানুষরা যুগ যুগ ধরে হজ্ব দিবসে নিজেদের গুণাহখাতা ও অপরাধসমূহের কথা স্মরণ করে এখানে আসছেন। মহানবী (সাঃ) ঘোষণা করেছেন, কোনো লোক যথার্থ অর্থে হজ্ব পালন করার পর নিস্পাপ শিশুতুল্য হয়ে যায়। এমনকি ৪০ দিনের মধ্যে কেউ তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করলে, সাক্ষাৎকারীর ছোট খাটো অপরাধসমূহ আল্লাহ ক্ষমা করে দেন। মেশকাত। মহানবী (সাঃ) ইরশাদ করেছেন, ‘‘আরাফাতের দিন আল্লাহ তায়ালা সর্বনিম্ন আসমানে অবতরণ করেন এবং ফেরেস্তাদের নিকট নিজের বান্দাদের ব্যাপারে গর্ব করে বলেন,-- দেখো, আমার বান্দাগণ ধূলী ধূসরিত হয়ে চতুর্দিক থেকে আমার কাছে আসছে। আমি তোমাদের সাক্ষী রেখে বলছি যে, তাদের আমি ক্ষমা করে দিলাম। অতঃপর ফেরেস্তারা বলবে, হে পরোয়ারদেগার!অমুক ব্যক্তি যে বিলম্বে এসেছে ? তখন আল্লাহ বলেন, আমি তাকেও মাফ করে দিলাম।'-- (শরহে সুন্নাহ) মহানবী (সাঃ) এ ব্যাপারে আরো ইরশাদ করেন যে, ‘আরাফাতের দিনের রোযা সম্বন্ধে আমি মনে করি যে, আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদেরকে এর বরকতে তার পূর্ববর্তী ও পরবর্তী বছরের গুণাহসমূহ মাফ করে দেবেন। (মুসলিম শরীফ)
অতীতে আরাফাতের দিন আমাদের সমাজে বহু লোক রোজা রাখতেন। কিন্তু আজকাল তা বড় একটা দেখা যায় না। এ দিনের রোযার ফজিলত স্মরণ করে রোযা পালন করা হজ্ব পালনের সাথে সাথে প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর রওযা পাক যিয়ারত করা একান্ত প্রয়োজন। যাঁর দ্বারা পথহারা মানুষ পথের দিশা পেয়েছে, তাঁর রওযায় গিয়ে তাকে জানাতে হবে অন্তর নিংড়ানো সালাম, --
আসসালাতু আসসালামু আলাইকা ইয়া রাসূলাল্লাহ! আসসালাতু আসসালামু আলাইকা ইয়া নাবীয়াল্লাহ- বলে। মহানবী (সাঃ) ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি হজ্ব করে আমার কবর যিয়ারত করলো, সে যেন আমার জীবদ্দশায় আমার সাথে এসে সাক্ষাৎ করলো।’’ -- (মেশকাত)
ইয়াওমুল আরাফাত বা আরাফাত দিবসের দোয়া প্রার্থনা ও হজ্ব অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে একজন মুসলমান যখন নিজের অতীত অপরাধসমূহ আল্লাহর কাছ থেকে মাফ করিয়ে নেয় এবং ভবিষ্যৎ জীবনে আল্লাহর বিধানের উপর অটল থাকার ওয়াদা করে, তারপরই আসে আল্লাহর দীনের উদ্দেশ্যে চরম ত্যাগের সংকল্প গ্রহণের পালা। পরদিনই আল্লাহর জন্যে বিশ্ব ইতিহাসের মহাত্যাগের মহাপরাকাষ্ঠা প্রদর্শনকারী হযরত ইবরাহীম (আঃ) ও ইসমাইল (আঃ)-এর সেই অপূর্ব ত্যাগের স্মৃতি কুরবানীর পশু যবেহ করতে হয়। এ সময়ে পশুর গলে ছুরি ধরে প্রতি হজ্জযাত্রী সহ সারা দুনিয়ার মুসলমান নবী ইবরাহীম (আ.) এর কণ্ঠ নিঃসৃত ঐ দৃপ্ত শপথ বাণীরই ঘোষণা দেন। ইন্নাসালাভী ওয়া নুসুকী ওয়া মাহইয়া ইয়া ওমামাতী লিল্লাহি রাবিবল আলামীন। অর্থাৎ আমার নামায, দোয়া, আমার ত্যাগ কুরবানী, আমার বেঁচে থাকা, আমার মৃত্যুবরণ সব কিছুই বিশ্বপ্রতিপালক আল্লাহর জন্য নিবেদিত। কুরবানী পশু যবহের প্রাক্কালে এ ঘোষণাদানের তাৎপর্য হলো, মহান পয়গাম্বর হযরত ইবরাহীম (আ.) যেভাবে আল্লাহর নির্দেশের সামনে নিসংকোচে আত্মসমর্পণ করেছেন এবং নিজের আপন সত্তাকে অগ্নিকুন্ডে নিক্ষেপ করেছেন, প্রাণাধিক পুত্রের গলে দ্বিধাহীন চিত্তে ছুরি চালাতে উদ্যত হয়েছেন তেমনি আমার জীবনের প্রতিটি কর্মকান্ডেও একই ত্যাগ ও আল্লাহ প্রেমের ভাবকে জাগ্রত করে তুলতে হবে। সেই ত্যাগের স্পৃহা দিয়েই নিজের ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে আল্লাহর বিধানকে প্রতিষ্ঠিত ও বিজয়ী করে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করতে হবে। কুরবানীর দিনে পশু যবহের প্রাক্কালে সারা দুনিয়ার মুসলমান যেমন হযরত ইবরাহীমের কণ্ঠনিসৃত সেই বিপ্লবী ঘোষণার প্রতিধ্বনি করেন, তেমনি এ দিবসে বিশ্বের আনাচে-কানাচে, জলস্থলে, অন্তরীক্ষে যে মুসলমান যেখানেই থাক না কেন, আরাফাতের ময়দানে সমবেত লাখো হাজীর কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে সবাইকে আল্লাহর কাছে মিনতি জানাতে হবে- রাববানা যালামনা অনফুসানা, ওয়া ইল্লাম তাগফিরলানা ওতারহামনা লানা কুনান্না মিনাল খাসিরিন। হযরত আদম (আ.) সামান্য ভুলের জন্যে যেভাবে ভয়ে জড়সড় হয়ে কেঁদে কেঁদে এ দোয়া উচ্চারণ করেছেন, আজকের এদিন আমাদেরকেও নিজ নিজ কৃত গুনাহ, অপরাধ ও ভুল-ভ্রান্তির কথা স্মরণ করে একই মানোভাব নিয়ে আল্লাহর দরবারে শোকাতর কণ্ঠে ক্রন্দনরত অবস্থায় প্রার্থনা জানাতে হবে। অন্যথায় কোনো হাজী হজ্জ গমন করার মধ্য দিয়ে দেশ দেখা ও মক্কা নগরীর দামী মাল সহজ মূল্যে খরিদ করারই শুধু সুযোগ পাবেন। এছাড়া অন্য কিছু ভাগ্যে জুটবে না। তেমনি বাইরে থেকে পশু কুরবানীর দানের মধ্য দিয়ে যারা ঈদুল আযহা উদযাপন করলেন তারা শুধু গোশত ভক্ষণেই তৃপ্তি পাবেন। মোটকথা হজ্জের মহিমান্বিত এদিনে আনুষাঙ্গিক যাবতীয় আকর্ষণ ও উপলক্ষের চাইতে হজ্জ ও কুরবানী অনুষ্ঠানের মূল উদ্দেশ্যেই আমাদের জীবনে মুখ্য থাকা কর্তব্য। আমাদের ব্যক্তি ও সমাজ জীবন হজ্জের আদর্শে মহীয়ান ও গরিয়ান হোক, এটাই একমাত্র সকলের কামনা হওয়া উচিত।