বর্তমান বিশ্বের পরিবারগুলোর অবস্থা

পরিবার ব্যবস্থা বিধাতার অন্যতম বড় অনুগ্রহ। কিন্তু বর্তমান বিশ্বে পরিবার নামক সুখের নীড়গুলোকে নির্মূল করার অপচেষ্টা ক্রমেই জোরদার হচ্ছে।
পরিবার এমন একটি ব্যবস্থা যা ধার্মিক ও ধর্মহীন সমাজেও গ্রহণযোগ্য। ভবিষ্যত প্রজন্মকে বিবেকবান মানুষ বা যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা সমাজ ব্যবস্থার মূল লক্ষ্য। পরিবারগুলো মানুষের স্নেহ-ভালবাসার চাহিদাসহ অন্য অনেক চাহিদাও মেটায়। তাই ব্যক্তি ও সমাজের মধ্যে সুস্থ সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার জন্য পরিবার-ব্যবস্থার গুরুত্ব অপরিসীম।
জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ১৯৮৪ সালে পারিবারিক সংকটগুলো নিরসনের জন্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে একটি ৫-সালা পরিকল্পনা গ্রহণ করতে সদস্য দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানায়। সাধারণ পরিষদ ১৯৮৯ সালে এক প্রস্তাবে ১৯৯৩ সালকে বিশ্ব পরিবার বর্ষ হিসেবে অনুমোদন করে এবং ১৫ ই মে-কে বিশ্ব পরিবার দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। বিশ্বব্যাপী মূল্যবোধের দিকে ফিরে যাওয়ার সংস্কৃতি জোরদার করা এবং পরিবারগুলোর ভিত্তিকে শক্তিশালী করা ছিল এসব কর্মসূচির উদ্দেশ্য। বর্তমানে এ দিবসটি প্রত্যেক দেশেই পরিবারের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের দিন এবং এ সংক্রান্ত নানা কর্মসূচি পালনের উপলক্ষ্যে পরিণত হয়েছে।
পরিবারগুলোর বন্ধন বা পরিবার-ব্যবস্থাকে জোরদার করা বর্তমান বিশ্বে খুবই জরুরি হয়ে পড়েছে। যদিও পাশ্চাত্যে পরিবারকে সমাজের ভিত্তি বলা হচ্ছে এবং বিশ্ব পরিবার দিবসও আনুষ্ঠানিকভাবে পালন করা হচ্ছে, কিন্তু তিক্ত বাস্তবতা হল, পাশ্চাত্যে পরিবারগুলো দিনকে দিন আগের চেয়েও বেশি দুর্বল হয়ে পড়ছে।
বর্তমানে পাশ্চাত্যে ঐতিহ্যবাহী ধারার পরিবার বলতে আর কিছুই নেই, বরং পরিবারগুলো এক কর্তার আওতাধীন পরিবার বা উপ-পরিবার কিংবা সিকি-পরিবারে পরিণত হয়েছে। সেখানে তালাকের হার ক্রমেই বাড়ছে এবং টিকে-থাকা মুষ্টিমেয় পরিবারগুলোর অস্তিত্বও হুমকির মুখে রয়েছে। কারণ, পাশ্চাত্যে তালাক বা বিবাহ-বিচ্ছেদকে খুবই সহজ করে দেয়া হয়েছে। যেমন, পাশ্চাত্যে স্বামী ও স্ত্রী কোনো গুরুতর কারণ ছাড়াই যদি বলে যে, আমাদের আর একসাথে জীবন-যাপন করতে ভাল লাগছে না, তাহলে এই অনুভূতিই তালাকের গ্রহণযোগ্য কারণ হিসেবে বিবেচিত হয়। পাশ্চাত্যে স্বামীরা খুব সহজেই পরিবারকে ত্যাগ করছেন। ফলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই স্ত্রীরা তাদের সন্তানসহ একাকী জীবন যাপন করতে বাধ্য হচ্ছেন।
মার্কিন পরিসংখ্যান বিভাগ ২০০৬ সালে জানিয়েছে, ১৮ বছরেরও কম বয়সের মার্কিন তরুণ-তরুণী বা বালক-বালিকার শতকরা ৪২ দশমিক ৮ শতাংশ এমন পরিবারে বসবাস করছে যেখানে নারীই পরিবারের অভিভাবক বা উপার্জনকারী। যেসব বাবা কন্যা থেকে দূরে থাকেন সেসব কন্যারা পিতার স্নেহ থেকে বঞ্চিত হওয়ায় নড়বড়ে ব্যক্তিত্বের অধিকারী হয়। এইসব কন্যারা পুরুষদের বিশ্বাস করতে পারে না।
বিশেষজ্ঞদের মতে, পাশ্চাত্যে পরিবারগুলো দুর্বল হয়ে পড়ার আরেকটি কারণ হল, স্বামী ও স্ত্রীরা নিজ নিজ দায়িত্ব বা অধিকার সম্পর্কে খবর রাখেন না, কিংবা দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে চান। পশ্চিমা নারী খুব সহজেই স্বামীকে ত্যাগ করে এবং পরিবারের প্রতি অঙ্গীকার ভাঙ্গার জন্য তারা প্রচুর অজুহাতও দেখিয়ে থাকে। ফলে পরিবারগুলোকে রক্ষার কোনো মাধ্যমও সেখানে নেই। পরিবারত্যাগী বা পরিবারেরআশ্রয়হারা পশ্চিমা স্ত্রী বা স্বামীরা সমাজ ও সরকারের সহায়তাও পায় না। ফলে পরিবারগুলো খুব সহজেই ও খুব দ্রুত অধঃপতন বা ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যায়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শতকরা ৫০ ভাগ শিশু অবিবাহিত মেয়েদের গর্ভে জন্ম নিয়ে থাকে। দেশটির বিপুল সংখ্যক নারী-পুরুষ বিয়ে ছাড়াই পরস্পরের সাথে স্বামী-স্ত্রীর মতই বসবাস করছেন এবং আনুষ্ঠনিক বিয়ের প্রতি তাদের আগ্রহ খুবই কম। ফলে ধ্বসে পড়ছে পরিবার। পরিবারগুলো এক কর্তার পরিবারে রূপ নিচ্ছে, কিংবা কয়েকটি পরিবার একই ছাদের নিচে বসবাস করা সত্ত্বেও তাদের মধ্যে পরিবারের প্রতি দায়িত্ববোধ না থাকায় এইসব সংকটের সমাধান হচ্ছে না।
বিশেষজ্ঞদের মতে, পাশ্চাত্যে পরিবার ব্যবস্থায় ধ্বস নামার আরেকটি বড় কারণ হল, ব্যক্তি-কেন্দ্রীকতা বা আত্মকেন্দ্রিকতার প্রসার। বর্তমান যুগের পশ্চিমা নারীরা বিয়েও করতে চায় না এবং মাও হতে চায় না। আর অনেকেই কেবল এক সন্তানের মা হওয়াকেই যথেষ্ট বলে মনে করে।
বিশেষজ্ঞরা আরও মনে করেন, আজকাল মাতৃত্বেরও বিশ্বায়ন করা হচ্ছে। ধনী দেশগুলোর স্বামী-স্ত্রী তাদের সন্তানকে ভ্রুণ অবস্থায় দরিদ্র দেশের কোনো নারীর গর্ভে স্থাপন করছেন এবং ওই দরিদ্র নারীর গর্ভেই জন্ম নিচ্ছে তাদের সন্তান। সন্তান জন্ম দেয়ার কষ্ট বা প্রসব বেদনা থেকে দূরে থাকা বা শরীরকে ফিট রাখা কিংবা সামাজিক স্ট্যাটাস বজায় রাখার নামেই এই পন্থা বেছে নিচ্ছেন অনেকেই। অথচ মাতৃত্ব নারীর প্রকৃতিগত স্বভাব এবং এর মাধ্যমেই বিকশিত হয় নারীর অন্য অনেক প্রতিভা।
ইসলামের দৃষ্টিতে পরিবার সমাজের ভিত্তিমূল। এ ধর্ম পরিবারকে দেয় বিশেষ গুরুত্ব। ইসলাম পরিবারের সদস্যদের মধ্যে সম্পর্ক জোরদারের জন্য নানা ব্যবস্থা রেখেছে। এ ব্যবস্থা অনুযায়ী নারী ও পুরুষের জন্য কিছু আলাদা অধিকার ও দায়িত্ব নির্ধারণ করেছে। ইসলামী রাষ্ট্র হিসেবে ইরানের সংবিধানে পরিবারকে দেয়া হয়েছে উচ্চ মর্যাদা। পরিবারকে মানুষের পূর্ণতার মাধ্যম বলে উল্লেখ করা হয়েছে এ সংবিধানে। এর দশ নম্বর অনু্চ্ছেদ অনুযায়ী পরিবার গঠনকে সহজ করা ও এর পবিত্রতা রক্ষা এবং ইসলামী আইন ও নৈতিকতার আলোকে পারিবারিক সম্পর্ক বিন্যস্ত করা ইসলামী সরকারের দায়িত্ব।
শহীদ অধ্যাপক আয়াতুল্লাহ মুর্তাজা মোতাহহারি বলেছেন,”নারী ও পুরুষের পারিবারিক অধিকারের ব্যাপারে ইসলামের রয়েছে বিশেষ দর্শন। গত ১৪০০ বছরে যা বিগত হয়েছে এবং আজ যা ঘটছে তার মধ্যে রয়েছে পার্থক্য। ইসলাম নারী ও পুরুষের জন্য সব ক্ষেত্রেই একই ধরনের অধিকার, একই ধরণের দায়িত্ব ও একই ধরণের শাস্তির ব্যবস্থা করেনি। বরং ইসলাম কিছু কিছু অধিকার, দায়িত্ব ও শাস্তিকে পুরুষের জন্য বেশি উপযুক্ত এবং কিছু কিছু অধিকার, দায়িত্ব ও শাস্তিকে নারীর জন্য বেশি উপযুক্ত বলে মনে করে।”
ইসলামের দৃষ্টিতে পরিবারে নৈতিকতা অধিকারের চেয়ে বেশি গুরুত্ব পায়, আর অধিকার নৈতিকতার সেবায় নিয়োজিত। শুস্ক বিধান ও অধিকারের চেয়ে এখানে প্রেম, ভালবাসা, সমবায়, ত্যাগ ও দয়ার গুরুত্ব বেশি। এগুলোর অভাবে স্বামী-স্ত্রী তাদের দায়িত্বগুলো ভালভাবে পালন করতে পারে না। যখন ভালবাসা ও ত্যাগ-তিতিক্ষার অভাব দেখা দেয় তখনই পরিবারে আইন ও অধিকারের প্রয়োগ করার দরকার হয়। ইসলামের বিধান অনুযায়ী সন্তানের প্রতি যেমন রয়েছে মা-বাবার দায়িত্ব, তেম্নি মা-বাবার প্রতিও রয়েছে সন্তানের দায়িত্ব।
মুসলিম পরিবারগুলো মানুষ গড়ার প্রশিক্ষণ-কেন্দ্র। এখানে সন্তানরা বাবা মায়ের কাছে এটা শেখে যে, ব্যক্তির চাওয়া-পাওয়ার চেয়ে পরিবারের চাওয়া-পাওয়া বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু পাশ্চাত্যে ঠিক এর উল্টোটাই শেখানো হচ্ছে। মোট কথা ইসলামের দৃষ্টিতে সফল পরিবার হল সেইসব পরিবার যেখানে এর সদস্যরা পরস্পরের প্রতি দয়াদ্র এবং তারা একে-অপরকে সুস্থতা ও উন্নতির জন্য সহায়তা করে।(সংগৃহীত)