শিশুর ভবিষ্যৎ গঠনে পিতা-মাতার ভূমিকা

শিশুদের সুন্দর জীবন গঠনে পিতা-মাতার অবদান অনস্বীকার্য। পিতা-মাতা যেভাবে তাকে গড়ে তোলেন সেভাবেই তারা গড়ে ওঠে। শিশুরা নিষ্পাপ। তারা ফুলের মতো। তারা পিতা-মাতার চক্ষুশীতল করার নিয়ামক। আমাদের প্রিয় নবী (স.) শিশুদের খুব ভালোবাসতেন। তিনি একটি হাদিসে বলেছেন, ‘প্রত্যেক মানব শিশু ইসলামি ফিতরাতের ওপর জন্মগ্রহণ করে।’ এরপর তার পিতা-মাতা, পরিবার তাকে যেদিকে নিয়ে যায়, সে ঐদিকেই চলে যায়।
তা ছাড়া প্রত্যেক শিশু পৃথিবীতে আগমন করে সর্বপ্রথম তার মাকে দেখে। তার মা-বাবাকে চিনে। সে জন্য পিতা-মাতাকে সে অনুসরণ করে। পিতা-মাতা কী করে, কী বলে, সে ঐভাবে করতে ও বলতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। সে কারণে প্রত্যেক পিতা-মাতাকে শিশুদের সামনে সুন্দর আচার-আচরণ উপহার দিতে হবে ও শিশুদের জীবন গঠনে কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে। যার মাধ্যমে ঐ শিশু বড় হয়ে কখনো পিতা-মাতার অবাধ্য হবে না এবং উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাপনে নিজেদের জড়াবে না।
রসূলের (স.) হাদিস অনুযায়ী প্রত্যেক শিশু যখন কথা বলতে শেখে, তখন তার মুখে কালেমা উঠিয়ে দেয়া উচিত। অনেক মা বিভিন্ন ছড়া-গান ইত্যাদি শেখান ও বলতে বলতে দোলনাতে ঘুম পাড়ান। কিন্তু কলেমা ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’ শিক্ষা দেন না। এটা ঠিক নয়, বরং প্রত্যেক মুসলিম মায়ের উচিত বাচ্চা যখনই কথা বলতে শিখবে, তখনই সবার আগে যে স্রষ্টা তাকে এই সুন্দর পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন তার পরিচয় অবহিত করা। আলিফ, বা, তা, ছা—ইত্যাদি শিক্ষা দেয়া। রসূল (স.) বলেছেন, ‘উত্লুবুল ইলমু মিনাল মাহদে ইলাল লাহদে’—অর্থাত্ দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত জ্ঞান অন্বেষণে অতিবাহিত করবে। স্রষ্টার নির্দেশিত জ্ঞানচর্চার সময় জীবনের প্রারম্ভ হতে অন্তিম মুহূর্ত পর্যন্ত।
যে কোনো জিনিসের শুরুটা যদি সুন্দর হয় তাহলে তা আলোর উন্মীলনে ভরপুর হয়ে যায়। আর শুরুটা যদি ভালো না হয় তাহলে পরে যতকিছু করা হোক না কেন প্রত্যাশিত ফলাফল পাওয়া সুকঠিন হয়ে দাঁড়ায়। রসূলের (স.) নির্দেশ, ছোটবেলা থেকেই পিতা-মাতা শিশুর আত্মিক উন্নতিকল্পে স্রষ্টা সম্পর্কিত বিষয়গুলো শিক্ষা দেবেন। মহান রাব্বুল আলামিন আল্লাহ তায়ালা কুরআনে বলেছেন, ‘ইকরা বিইসমি রাব্বিকাল্লাজি খালাক’ অর্থাত্ ‘পড় তোমার সেই রবের নামে, যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন।’ সঙ্গে সঙ্গে রসূল (স.) বলেছেন, ‘ত্বলাবুল ইলমু ফারিদাতুন আলা কুল্লি মুসলিমাতুউ ওয়া মুসলিমা’ অর্থাত্ ‘প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীর ওপর জ্ঞানচর্চা করা ফরজ বা অত্যাবশ্যক।’ এ কারণে প্রত্যেক মুসলিম পিতা-মাতার উচিত হলো শিশুদের সব কিছুর আগে কুরআন শিক্ষা দেয়া।
কুরআনের আলো যে হূদয়ে একবার প্রজ্বলিত হবে, সেখানে কখনো অবিশ্বাস ও অসত্যের অন্ধকার স্থায়ী জায়গা করে নিতে পারে না। কুরআন তেলাওয়াত শেখার পর মাতৃভাষা অর্থাত্ বাংলায় অর্থসহ কুরআন তার হাতে তুলে দিতে হবে। সে কুরআনের অর্থ বুঝে পড়তে থাকলে তার মাঝে ন্যায়-অন্যায়, সত্য-মিথ্যার পার্থক্য নির্ণয় করার বিচারিক প্রজ্ঞার উন্মেষ ঘটবে। সে তখন কারো দ্বারা প্রতারিত হবে না। এরপর রসূলের (স.) জীবনবৃত্তান্ত সম্পর্কে তাকে একটি সম্যক ধারণা দিতে হবে। রসূলের একটি ভালো জীবনী গ্রন্থ পড়তে দিতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে রসূলের কিছু হাদিসও তাদের শিক্ষা দেয়া জরুরি। বিশেষ করে মেশকাত শরিফের কিতাবুল আদব বা আচার-আচরণ সম্পর্কিত বিষয়গুলো তাদের জ্ঞাত করতে হবে, যাতে করে তারা বড়দের সঙ্গে সুন্দর আচার-আচরণ করা শেখে। প্রধান প্রধান ধর্মগুলো সম্পর্কে তাদের পরিষ্কার ধারণা দিতে হবে।
তা ছাড়া ইসলামের বিভিন্ন বিষয়ে যেসব গ্রন্থ রয়েছে, সেগুলোও তাদের অধ্যয়ন করতে দিতে হবে। এরপর শিশুবেলা থেকেই তাদের নামাজের প্রশিক্ষণ দিতে হবে। মহানবী (স.) বলেছেন, ‘যখন তোমাদের সন্তানদের বয়স সাত বছর হয়, তখন তাদের নামাজের প্রশিক্ষণ দাও।’ একজন মানুষের গোটা জীবনের সব আমল আল্লাহর দরবারে তখনই গ্রহণযোগ্য হয়, যখন তার নামাজটা সুচারুরূপে সম্পন্ন করা হয়।
রসূল (স.) বলেন, হাশরের ময়দানে সর্বপ্রথম হিসাব হবে নামাজের। যার নামাজের হিসাব সঠিক হবে, তার অন্যান্য আমলে যদি কিছু ঘাটতি থাকে তাহলে আল্লাহ তায়ালা ঐ ব্যক্তির সে ঘাটতি পূরণ করে দেবেন। আর যদি নামাজের হিসাব বেকার হয় তাহলে অন্যান্য আমল পর্যাপ্ত পরিমাণ থাকলেও তা আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। অন্য আরেকটি বর্ণনায় বলা হয়েছে, ‘ইন্নাস ছলাতা মিফতাহুল জান্নাহ’—অর্থাত্ নামাজ বেহেশতের চাবি। বিচার দিবসে রসূল (স.) তার যে উম্মতগণকে চিনবেন সেটাও নামাজের অজুর চিহ্ন দেখে। তা ছাড়া মানুষ যখন মারা যায়, তখন তার সব আমল বন্ধ হয়ে যায় তিনটি ছাড়া। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো সত্ (চরিত্রবান, নামাজি) সন্তানদের দোয়া। সে জন্য পিতা-মাতা যদি তাদের সন্তানদের নামাজি বানিয়ে রেখে যান তাহলে তাদের দোয়া কবরে থাকাকালীন সময় পেতে পারেন।
এ সব গুরুত্বের কারণে রসূল (স.) প্রত্যেক পিতা-মাতাকে নির্দেশ দিয়েছিলেন, সাত বছর বয়স থেকেই সন্তানদের নামাজের প্রশিক্ষণ দিতে। এরপর ১০ বছর বয়সেও যদি নামাজ না পড়ে তাহলে মৃদু প্রহার করে হলেও একাজ আদায় করতে। যে ছেলে বা মেয়েকে তার পিতা-মাতা শিশুবেলা থেকে নামাজে অভ্যস্ত করতে সক্ষম হয়েছেন, যা সে কখনো ছেড়ে দেয় না। ঐসব শিশু প্রাপ্ত বয়সে কখনোই ছিনতাই-চাঁদাবাজি, অপহরণ, লুণ্ঠন, চুরি, ডাকাতি, সুদ, ঘুষ, দুর্নীতি ও মানব বিধ্বংসী কোনো গর্হিত কাজে জড়াতে পারে না। কেননা, কুরআনে বলা হয়েছে, ‘নিশ্চয় নামাজ মানুষকে সব ধরনের অন্যায় ও অশ্লীল কাজ থেকে বিরত রাখে।’
নামাজের সঙ্গে সঙ্গে দৈনন্দিন জীবনযাপনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে   তাদের পুতপবিত্র আখলাক বা চরিত্র, আদব বা ভদ্রতা শিক্ষা  দিতে হবে। রসূল (স.) বলেছেন-যে বড়দের শ্রদ্ধা-সম্মান করে না, ছোটদের আদর-স্নেহ করে না, সে আমার উম্মত নয়। ছোটবেলা থেকে তাদের সালাম শিক্ষা দেয়া, বড়দের শ্রদ্ধা করতে শেখানো উচিত।