বিষাদসিন্ধু ও প্রাসঙ্গিক কিছু কথা

ঊনবিংশ শতাব্দীর সপ্তম দশকের দিকে সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ লেখকদের অন্যতম মীর মোশাররফ হোসেন সাহিত্যের আসরে প্রবেশ করেন। মোশাররফ হোসেনের পূর্বে বাংলা গদ্যে উল্লেখযোগ্য কোন সাহিত্যসেবীর পরিচয় মেলে না। মোশাররফ হোসেনের সব চাইতে উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ ‘বিষাদসিন্ধু'। ‘বিষাদসিন্ধু'র রয়েছে তিনটি পর্ব, যথা-‘মহরম পর্ব', ‘উদ্ধার পর্ব' ও ‘এজিদ বধ পর্ব'। এ তিনটি পর্ব রচিত হয়েছিল যথাক্রমে ১৮৮৫, ১৮৮৭ ও ১৮৯১ খৃস্টাব্দে।
‘‘ইতিহাসে উল্লেখ আছে, ইসলামের সর্বশেষ ও শ্রেষ্ঠ নবী হযরত মুহম্মদের (সা.) প্রিয় দৌহিত্র হযরত ইমাম হাসান ও হযরত ইমাম হোসেন কর্তৃক দামেস্ক অধিপতি মাবিয়ার পুত্র এজিদের খলিফা হিসেবে স্বীকৃতি লাভের প্রচেষ্টাকে কেন্দ্র করে কারবালা প্রান্তরে হৃদয় বিদারক হত্যাকান্ড অনুষ্ঠিত হয়। মীর সাহেব এই রাজনৈতিক বিরোধ অপেক্ষা জয়নাবের প্রতি এজিদের রূপাকাঙ্ক্ষাকে কারবালার জেহাদের মূল উৎস হিসেবে বর্ণনা করেছেন। ঐতিহাসিক ঘটনা ও চরিত্রের সঙ্গতি রক্ষা অপেক্ষা সাহিত্যরস পরিবেশনের তাগিদে লেখক কল্পনার সংমিশ্রণ ঘটিয়েছেন। ধর্মীয় ইতকথা নয়, রস-সাহিত্য সৃষ্টিই ছিল মীর মোশাররফ হোসেনের মুখ্য উদ্দেশ্য। সেকালে হিন্দু সমাজে বিদ্যা সাগর রচিত ‘সীতার বনবাস' গ্রন্থ যেরূপ সমাদৃত ছিল, অনুরূপভাবে মীর মোশাররফ হোসেনের ‘বিষাদ সিন্ধু' মুসলিম সমাজে অত্যন্ত আদরণীয় একটি গ্রন্থ ছিল।’’ (বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস-অধ্যাপক সুফী মোতাহার হোসেন)
মীর মোশাররফ হোসেন পুঁথির কাহিনী অবলম্বন করে সাধু ভাষায় ‘বিষাদসিন্ধু' রচনা করেছেন। এই গ্রন্থের মাল-মশলা সংগ্রহের ব্যাপারে গ্রন্থের মুখবন্ধে লেখক দাবি করেছেন-‘‘পারস্য ও আরব্য গ্রন্থ হইতে মূল ঘটনার সারাংশ লইয়া ‘বিষাদসিন্ধু' রচিত হইল। প্রাচীন কাব্য গ্রন্থের অবিকল অনুবাদ করিয়া প্রাচীন কবিগণের রচনা কৌশল এবং মাস্ত্রের মর্যাদা রক্ষা অত্যন্ত দুরূহ। সাদৃশ লোকের পক্ষে তদ্বিষয়ে যথার্থ গৌরব রক্ষার আকাঙ্ক্ষা বামনের বিধু ধারণের আকাঙ্ক্ষা বলিতে হইবে। তবে মহরমের মূল ঘটনাবলী বঙ্গ ভাষাভাষী প্রিয় পাঠক-পাঠিকাগণের সহজে হৃদয়ঙ্গম করাইয়া দেওয়াই আমার মুখ্য উদ্দেশ্য।’’
কিন্তু লেখকের এই দাবি ‘বিষাদসিন্ধুর' সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয় বলে অনেকে মনে করেন। ভূমিকায় বর্ণিত লেখকের দুইটি দাবিই অচল। লেখক ‘বিষাদসিন্ধুর' মাধ্যমে পাঠকদেরকে মূল ঘটনার সাথে পরিচয় ঘটাতে পারেননি। মূল ঘটনাটি ছিল ইসলামের শাসন ব্যবস্থা খেলাফত থেকে মূলকিয়াতের (রাজতন্ত্র) দিকে প্রত্যাবর্তন-যা কবি ইকবাল অতি সংক্ষেপে তার ‘রুমূয-ই-বেখুদী'তে এভাবে বর্ণনা করেছেন :
‘‘হুসায়ন-বলে সত্য চির জীবন্ত,
মিথ্যা ধনীর অন্তিম শ্বাস নিভন্ত।
খিলাফত যবে কুরান-রশ্মি ছিন্ন করে,
মারণ-বিষে মুক্তি-কণ্ঠ রুদ্ধ করে।
শ্রেষ্ঠ জাতির; দীপ্ত চূড়াশির তুলে,
কিবলা হতে বারিদ সম জোর চলে।
রক্ত-ধারায় কারবালারে সিক্ত করে।..
হযরত আলীর মৃত্যুর পরে শুধু খোলাফায়ে রাশেদুনের পরিসমাপ্তি ঘটেনি বরং ‘‘যে আদর্শ, রীতি-নীতি ও পদ্ধতির ওপর খোলাফায়ে রাশেদুনের মর্যাদা ও গৌরব প্রতিষ্ঠিত ছিল তা বিলুপ্ত হয়। ইসলামী গণতন্ত্র ও শরীয়াতের বিধির পরিবর্তে উমাইয়া আমলে রাজতন্ত্র, একনায়কত্ব ও স্বেচ্ছাচারিতা কায়েম হয়। উত্তরাধিকার সূত্রে রাজ্য লাভ নির্বাচনকে নির্মূল করে।.. বায়তুলমাল ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে পরিণত হয়।... মুয়াবিয়া কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত উমাইয়া যুগে অনাচার ও অনৈসলামিক কার্যকলাপ শুরু হয়।’’ (ইসলামের ইতিহাস-ড. সৈয়দ মাহমুদুল হাসান) আর তাই নিয়ে এজিদের সাথে হযরত হোসাইনের বিরোধিতার পরিণতিতে কারবালায় হৃদয় বিদারক ঘটনা ঘটে। এ সত্য ঘটনাকে পাশ কাটিয়ে লেখক জয়নবের কল্পিত প্রণয় কেন্দ্রিক ‘‘বিষাদসিন্ধু’’ রচনা করায় গ্রন্থখানার ঐতিহাসিক উপন্যাসের মর্যাদা লোপ পেয়েছে।

‘‘‘বিষাদসিন্ধু' ঐতিহাসিক উপন্যাস নয়, জীবন চরিতও নয়, তেমনি ‘আঁটঘাট বাঁধা' বিধিবদ্ধ' organic plot'-এর উপন্যাসও নয়। এ ইতিহাস, উপন্যাস, সৃষ্টিধর্মীয় রচনা ও নাটক ইত্যাদি সাহিত্যের সর্ববিধ সংমিশ্রণে রোমান্টিক আবেগ মাখানো এক সংকর সৃষ্টি। এতে উপন্যাসের লক্ষণ আছে প্রচুর, একটা মূল আবেগও আছে, শিথিল বিন্যস্ত প্লটকে একত্রীকরণের চেষ্টা আছে, সংলাপ আছে এবং সমগ্র আখ্যানকে একটা পরিণতি দেবার সজ্ঞান প্রচেষ্টাও আছে। তবু ‘বিষাদসিন্ধু' সমালোচনার মাপকাঠিতে কোন বিশেষ এক ধরনের সৃষ্টি নয়।’’ (বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত)
এই সুবিখ্যাত গ্রন্থখানার কাহিনী শাহ গরীবুল্লাহ ও মুহম্মদ এয়াকুবের জঙ্গনামাকে ভিত্তি করে গড়ে উঠলেও ভাষারীতির দিক থেকে তিনি উপরোক্ত পুঁুথিকারকে অনুসরণ করেননি। ‘‘মীর মোশাররফ হোসেন পুঁথির কাহিনীকে অবলম্বন করে সাধু ভাষায় ‘বিষাদসিন্ধু' রচনা করেছেন। ইসলামের ইতিহাসের বিয়োগান্ত ঘটনা কারবালার করুণ কাহিনী নিয়ে ‘বিষাদসিন্ধু' রচিত হলেও তার শিল্প রীতিতে মুসলিম ঐতিহ্য ও পরিবেশনের পূর্ণ রূপায়ন ঘটেনি; মুসলিম ইতিহাসভিত্তিক এই শিল্পকর্মে এমন কোন বিশিষ্ট ঐতিহ্যের ছাপ নেই যাকে মুসলিম স্বাতন্ত্র্যবাদিতার পরিচয়-চিহ্ন হিসাবে গ্রহণ করা যেতে পারে।” (বাংলা কাব্যে মুসলিম ঐতিহ্য-মোহাম্মদ মাহফুজ উল্লাহ) (দৈনিক সংগ্রাম)