শিশু লালন-পালনে গণমাধ্যমের ভূমিকা


বর্তমানে আমরা মিডিয়া যুগে বসবাস করছি। মিডিয়া বা গণমাধ্যমের ওপর নির্ভরতা দিনদিনই আরো বাড়ছে। শিশু-কিশোররা এখন বাবা-মা'র চেয়ে তথ্যের জন্য রেডিও-টিভি ও ইন্টারনেটের মতো গণমাধ্যমের ওপর বেশি নির্ভর করে। কার্টুনসহ নানা ভিডিও গেইম দেখে তারা বিশ্ব সম্পর্কে নিজেদের জ্ঞানকে সমৃদ্ধ করে। তাদের আচার-আচরণেও ওই সব মিডিয়ার প্রভাব পড়ে। প্রতিদিনই তারা কার্টুন ও গেইম দেখে বড় একটা সময় ব্যয় করে। এ কারণে কার্টুন ও গেইমের সিডি ও ডিভিডির ব্যবসা এখন জমজমাট। এ কারণে শিশু লালন-পালনে মিডিয়ার ভূমিকা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।আল হোসাইন (আ.)

শিশুরাই আগামী দিনের কর্ণধার। আগামী বিশ্ব কেমন হবে,তা নির্ভর করছে তাদের শিক্ষা, যোগ্যতা ও দক্ষতার ওপর। বর্তমান অশান্ত বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য আমাদের সন্তানদেরকে সেভাবে গড়ে তুলতে হবে। ধর্মহীনতা, হিংস্রতা, উগ্রতা ও গোঁড়ামির মতো অসৎ গুণাবলী যাতে তাদের মধ্যে দানা বেঁধে না উঠে, সে বিষয়ে পূর্ণ সতর্ক থাকতে হবে। এ জন্য গণমাধ্যমের সহযোগিতা প্রয়োজন। এ কারণে সন্তান লালন-পালন হলো একটি কঠিন শিল্প, যাতে সফল হওয়ার জন্য বাবা-মায়ের সৃজনশীলতা প্রয়োজন। পাশাপাশি শক্তি,সময় ও অর্থ ব্যয়ের মানসিকতা থাকতে হবে। সন্তানের অবসর সময়টা কীভাবে কাটবে, সে বিষয়ে সঠিক পরিকল্পনা প্রণয়ন ও তা বাস্তবায়ন করাটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। শিশু-কিশোরদের অবসর সময়কে সঠিকভাবে কাজ লাগাতে পারার ওপর তাদের ভবিষ্যতও অনেকাংশে নির্ভরশীল। অনেক শিশু-কিশোর এবং একইসঙ্গে তাদের বাবা-মা টেলিভিন দেখে ও কম্পিউটার গেইম খেলে অবসর সময় কাটান।

মনে রাখতে হবে, পরিকল্পনাহীনভাবে দীর্ঘ সময় ধরে টিভি দেখা এবং কম্পিউটার গেইম খেলার কারণে শিশুদের মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে। দীর্ঘ সময় ধরে টিভি দেখা বা ভিডিও গেম খেলার চেয়ে বড় বিষয় হলো, শিশু-কিশোররা টিভিতে কী ধরনের অনুষ্ঠান দেখছে এবং কী ধরনের গেইম খেলছে। কারণ, এখন অধিকাংশ কার্টুন ও গেমই সহিংসতাপূর্ণ দৃশ্যে পরিপূর্ণ। এ ধরনের সহিংস ভিডিও গেইম ও টিভি অনুষ্ঠানশিশুদের মনে বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে। তারাও হিংস্র হয়ে গড়ে উঠতে পারে। এ কারণে শিশুদের সঠিক উপায়ে গড়ে তোলার বিষয়ে বিশ্বব্যাপী ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে গবেষণা হচ্ছে। বেশিরভাগ গবেষণাতেই দেখা যাচ্ছে, সহিংস কার্টুন ও গেমগুলো শিশুদেরকে সহিংস ও আগ্রাসী করে তুলতে পারে। অনেকে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হচ্ছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বর্তমান বিশ্বে প্রায় দুইশ' কোটি শিশু-কিশোর রয়েছে। আর জন্মের পর থেকেই শিশুরা টেলিভিশনের সংস্পর্শে আসে।ছোট্ট ও অবুঝ শিশুটি যখন ঘরে শুয়ে বা বসে থাকে,তখনও তাদের কানে টিভির শব্দ পৌঁছে যায়। কারণ বেশিরভাগ ঘরেই এখন দিনের বেশিরভাগ সময় টিভি চালু থাকে।

গবেষণায় দেখা গেছে, দশ বছর বয়স পর্যন্ত শিশুদের ওপর টেলিভিশনের প্রভাব পড়ে সবচেয়ে বেশি। ৯০ শতাংশ শিশুই ৬ বছর বয়স থেকে টিভির নিয়মিত দর্শকে পরিণত হয়। এ কারণে শিশু-কিশোরদের আচার-আচরণ এবং মন-মনসিকতা গঠনে অন্য সব গণমাধ্যমের চেয়ে টিভির প্রভাব পড়ে অনেক বেশি।
ইরানের বিশিষ্ট গণযোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ড. নাসের বাহুনার মনে করেন, গণমাধ্যম ব্যবহারের মধ্যদিয়ে দর্শকরা তাদের অজান্তেই শিক্ষা গ্রহণ করে এবং তথ্য সংগ্রহ করে। পরবর্তীতে এসব তথ্য তার মন-মানসিকতার ওপর ক্রমেই প্রভাব ফেলে। শিশুরা টিভিঅনুষ্ঠান ও ভিডিও গেইম দেখে সেগুলো অনুকরণ করে এবং আরো বেশি সামাজিক হয়ে উঠে। ড. বাহুনারের মতে, গণমাধ্যমের একটি বড় দায়িত্ব হচ্ছে-শিশুদের ব্যক্তিত্ব গঠনে সহায়তা করা।

বিশিষ্ট গণমাধ্যম বিশেষজ্ঞ নেইল পোস্টম্যানের মতে, চারশ' বছর আগেও পাশ্চাত্যে শিশুদেরকে ভিন্নভাবে সংজ্ঞায়িত করা হতো।শিশুদের নিয়ে গবেষণা শুরু হয়েছে সেই ষোল শতাব্দি থেকে। এর আগে শিশুদের পছন্দ-অপছন্দ,আগ্রহ ও আসক্তির প্রতি গুরুত্ব দেয়া হতো না এবং তারা পুরোপুরি বাবা-মার নির্দেশে চলতো।
নেইল পোস্টম্যানের মতে, রেনেসার আগ পর্যন্ত শিশুদের শারিরীক ও মানসিক গঠনের প্রতি গুরুত্ব না দিয়ে বাবা-মায়েরা, যা ভালো মনে করতো তাই করতো।আর শিশুরা এভাবেই বড় হয়ে ওঠতো। আঠারো শতাব্দির দিকে শিশুদের বেড়ে ওঠার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্ব পায়। একটু সচেতন হলো শিশুদের মধ্যে ভালো গুণাবলীকে প্রস্ফুটিত করার ক্ষেত্রে গণমাধ্যম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। মানুষ সৃষ্টিগতভাবেই অনুসন্ধিতসু। নতুন কিছু আবিস্কার ও সৃষ্টির মধ্যদিয়ে শিশুদের মন-প্রাণ আনন্দে ভরে উঠে। এ ধরনের আনন্দ ও উৎসাহ ওই শিশুর জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত প্রভাব ফেলে।শিশুদের দূরদৃষ্টি এবং সুপরিকল্পনার ক্ষমতা বাড়ানোর ক্ষেত্রে মিডিয়া কার্যকরি ভূমিকা রাখতে পারে।

আরেকটি বিষয় হলো, শিশুকে সঠিক মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য ধর্মের বিকল্প নেই। ধর্মের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টির জন্য সেই শিশুকালেই তৎপর হতে হবে। ধর্মসহ যে কোনো কিছু শিক্ষা দেয়ার ক্ষেত্রে শিশুদেরকে আকর্ষণীয় ভাষা ও উদাহরণ তুলে ধরতে হবে। বিশেষকরে গল্পের আকারে কোন কিছু উপস্থাপন করা হলে শিশুরা বেশি আকৃষ্ট হয়। অবশ্য যখনি শিশুটি আরো বড় হয় এবং তাদের চিন্তা ও যুক্তির ক্ষমতা বাড়তে থাকে ও ভালো-মন্দ জ্ঞান হয় তখন শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনা যেতে পারে। শিল্পকর্ম ও প্রদর্শনীর মতো বিষয়গুলো তখন একটি কার্যকরি মাধ্যম হতে পারে।
শিশু বয়সেই আল্লাহর অস্তিত্ব, তার অনুগ্রহ ও দয়া সম্পর্কে জ্ঞান দিতে হবে। বৃষ্টি বর্ষণ, ফুল ফোটা, পশু-পাখির ছানা এবং প্রকৃতির নানা সৌন্দর্য্য শিশুদের মধ্যে আল্লাহর অস্তিত্ব সম্পর্কে ভালো ধারণা সৃষ্টি করতে পারে। গণমাধ্যমের নীতি নির্ধারকদেরকে এমন ছবি ও দৃশ্য দিয়ে শিশুদের জন্য অনুষ্ঠান তৈরি করতে হবে, যাতে তাদের মনে আল্লাহ সম্পর্কে ভালো ধারণা তৈরি করে। তারা যাতে এটা ভাবে যে, আল্লাহ অত্যন্ত দয়ালু ও তিনি এই পৃথিবীকে অত্যন্ত চমতকারভাবে সৃষ্টি করেছেন।

শিশুদেরকে ভবিষ্যতের ব্যাপারে আশাবাদী করে তুলতে হবে। তাদের সামনে আদর্শ ও প্রশংসনীয় মানুষদের জীবন-চরিত উপস্থাপন করতে হবে। তবে তারা কী ধরনের মিডিয়া ব্যবহার করছে,সে দিকে অভিভাবকদের খেয়াল রাখতে হবে। মিডিয়া নির্বাচনের ক্ষেত্রে বাবা-মা'র পক্ষ থেকে দিকনির্দেশনার প্রয়োজন রয়েছে। বর্তমান পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় বহুজাতিক কোম্পানিগুলো শুধু মুনাফা লাভের চিন্তায় রয়েছে। তারা শিশুদের ওপর এর প্রভাব নিয়ে খুব একটা ভাবে না। কাজেই টিভি অনুষ্ঠান এবং ভিডিও গেইম নির্বাচনে সতর্কতা অবলম্বন ছাড়া কোনো উপায় নেই। পুঁজিবাদের ধোকায় পড়ে বাজারে যা আসছে তাই শিশুদের হাতে তুলে দেয়া চলবে না। তাহলে শিশুর মন-মানসিকতায় মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব পড়তে পারে।