আল কোরআনের অলৌকিকতা (চতুর্থ পর্ব)

পবিত্র কোরআন সুপথ বা হেদায়াত লাভের ঐশী মহাগ্রন্থ। প্রতিদিন লাখ লাখ মুসলমান এবং এমনকি অনেক অমুসলমানও বিভিন্ন ভাষায় অধ্যয়ন করছেন এই অনন্য কিতাব। এ আসমানি কিতাব সব সময়ই মানুষকে জ্ঞান অর্জন করতে ও জ্ঞানের বিভিন্ন বিষয় থেকে শিক্ষা নেয়ার আহ্বান জানায়। ফরাসি চিন্তাবিদ জোয়েল লুবিন মনে করেন কোরআনের বাণীগুলো যুক্তিপূর্ণ ও বুদ্ধিবৃত্তিক হওয়ায় বিশ্বের কোটি কোটি মুসলমানের জীবনে এ মহাগ্রন্থ যোগায় অশেষ প্রাণশক্তি এবং কোরআনই তাদের জীবনের মূল অক্ষ বা কেন্দ্র-বিন্দু। জোয়েল লুবিন লিখেছেন, “কোরআন এমন এক গভীর সাগর যা থেকে সঞ্চারিত হয়েছে জ্ঞানের অনেক নদ-নদী। এভাবে বিশ্ববাসীর কাছে কল্যাণ পৌঁছে দিয়েছে এ গ্রন্থ। এটা স্পষ্ট কোরআন সব সময়ই জীবিত থাকবে। প্রত্যেক যুগেই জ্ঞান-পিপাসু ও গবেষকরা নিজস্ব চিন্তাশক্তি এবং উপলব্ধি-ক্ষমতার আলোকে কোরআন থেকে উপকৃত হচ্ছে। “
কোরআনের দৃষ্টিতে বিশ্ব জগতের পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে মহান আল্লাহর সৃষ্টি-কৌশল, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও নৈপুণ্যের নানা নিদর্শন। এ মহাগ্রন্থ সৃষ্টি-জগত নিয়ে চিন্তা-ভাবনা ও গবেষণার আহ্বান জানায়। বৈজ্ঞানিক বিষয়সহ মানুষের অজানা অনেক বিষয় তুলে ধরেছে কোরআন। আধুনিক যুগের বৈজ্ঞানিক তথ্যের সাথে কোরআনের তুলে ধরা এ সংক্রান্ত তথ্যগুলোর মিল বিজ্ঞানীদের বিস্মিত করেছে। তাই এ বিষয়গুলো কোরআনের অলৌকিকতার নিদর্শন হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। যেমন, মহান আল্লাহ বহু শতক আগে কোরআনে ঘোষণা করেছেন যে, তিনি উদ্ভিদসহ জীবন্ত সব কিছুকে জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি করেছেন। সুরা ইয়াসিনের ৩৬ নম্বর আয়াতে আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা বলেছেন,
“পবিত্র তিনি যিনি জমিন থেকে উৎপন্ন উদ্ভিদকে, তাদেরই মানুষকে এবং যা তারা জানে না, তার প্রত্যেককে জোড়া জোড়া করে সৃষ্টি করেছেন।”
সুরা “রাদ”-এ মহান আল্লাহও বলেছেন, ” তিনিই ভূমণ্ডলকে বিস্তৃত করেছেন এবং তাতে পাহাড় পর্বত ও নদ-নদী স্থাপন করেছেন এবং প্রত্যেক ফলের মধ্যে দু’দু প্রকার সৃষ্টি করে রেখেছেন। তিনি দিনকে রাত্রি দিয়ে আবৃত করেন। এতে তাদের জন্যে নিদর্শন রয়েছে,যারা চিন্তা করে। ”
উল্লেখ্য পবিত্র কোরআন নাজেল হওয়ার যুগে মানুষ সমস্ত জীবন্ত সৃষ্টিকুলের লিঙ্গ ভেদ তথা পুংলিঙ্গ ও স্ত্রী লিঙ্গ থাকার বিষয়ে অবগত ছিল না। কোরআনই প্রথম এ তথ্য দিয়েছে। এ বিষয়টি মহান আল্লাহর ক্ষমতা ও একত্বের নিদর্শন। সুরা জারিয়াতের ৪৮ ও ৪৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে,
“আমি ভূমিকে বিছিয়েছি। আমি কত সুন্দরভাবেই না বিছাতে সক্ষম। আমি প্রত্যেক বস্তু জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি করেছি, যাতে তোমরা হৃদয়ঙ্গম কর।”
সর্বপ্রথম যে বিজ্ঞানী উদ্ভিদের মধ্যে পুলিঙ্গ ও স্ত্রী লিঙ্গ থাকার কথা উল্লেখ করেছেন তিনি হলেন সুইডিশ বিজ্ঞানী কার্ল লিনে। খৃস্টিয় অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে তিনি এ মত প্রকাশ করেন। তার ওই বক্তব্যে অনেকেই বিস্মিত হয় এবং তারা গির্জার কর্মকর্তাদেরকে তার বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তোলে। ফলে কয়েক বছর ধরে ইউরোপে তার লেখনীকে ভুল মতামত হিসেবে ধরা হত। কিন্তু এর কিছু পরই বিজ্ঞানীরা লিনের মতামতকে সত্য বলে স্বীকৃতি দেন এবং তা একটি বৈজ্ঞানিক মূল নীতি হিসেবে গৃহীত হয়।
পবিত্র কোরআনে উদ্ভিদের প্রজনন বা পরাগায়ন সম্পর্কে বক্তব্য এসেছে। এ মহাগ্রন্থে বলা হয়েছে, উদ্ভিদ ও গাছপালার ফুলের পরাগায়ন বাতাসের মাধ্যমে ঘটে। সুরা হিজরের ২২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে,
“আমি বায়ুর বিভিন্ন প্রবাহ পাঠিয়ে থাকি (মেঘ ও গাছপালাকে) গর্ভবতী করার জন্য। আমি আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করি এবং তোমাদেরকে তা পান করাই। … …”
প্রাচীন কালেও মানুষ খেজুরের মত কোনো কোনো গাছের স্ত্রী ও পুরুষ প্রজাতি থাকার বিষয়ে জানতে পেরেছিল। তারা বুঝতে পেরেছিল, নর খেজুর গাছের ফুলের পরাগ-রেণু স্ত্রী খেজুর গাছের ফুলের গর্ভাশয়ে মিলিত না হলে ওই গাছে খেজুর ফলবে না। কিন্তু বিজ্ঞানীরা সব উদ্ভিদ বা জীবের ক্ষেত্রেই স্ত্রী ও পুরুষ প্রজাতি থাকার কথা জানতেন না। অবশ্য সব উদ্ভিদের পরাগায়ন একই ধরণের নয়। কোনো কোনো উদ্ভিদের ফুলের পরাগায়ন কীট-পতঙ্গ, পাখি, প্রজাপতি ও মৌমাছির মাধ্যমেও সম্পন্ন হয়। তুলা, ডাল জাতীয় উদ্ভিদ, ডালিম ও মাল্টা জাতীয় ফল গাছের ফুলের পরাগায়ন বাতাসের মাধ্যমে হয়। পুরুষ ফুলের পরাগরেণু যখন পরিণত বা পরিপক্ব হয় তখন এসব রেণুধারী কোষ বা বৃন্তের মুখ খুলে যায় এবং পাউডারের মত রেণুগুলো বাতাসের মাধ্যমে স্ত্রী ফুলে ছড়িয়ে পড়ে। স্ত্রী ফুলের গর্ভাশয়ে এসব পরাগ-রেণুর মাধ্যমে পরাগায়ন ঘটে এবং গর্ভাশয়টি ফলে পরিণত হয়। মৌমাছি বা প্রজাপতি জাতীয় কীট-পতঙ্গ ফুলে মধু খেতে গিয়ে এক ফুল থেকে অন্য ফুলে পরাগ-রেণু বহনের মাধ্যমেও একইভাবে পরাগায়ন ঘটায়।
পবিত্র কোরআনের বৈজ্ঞানিক তথ্যের আরেকটি দিক হল, সৃষ্টিকুলের ভারসাম্য। উদ্ভিদ জগতেও ভারসাম্য দেখা যায়। সুরা হিজরের ১৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, ” আমি ভূপৃষ্ঠে প্রত্যেক বস্তু সু-পরিমিতভাবে উৎপন্ন করেছি।” এখানে যে বিষয়ের দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে তা হল গাছ-পালা জন্মের ক্ষেত্রে যেসব উপাদানের প্রভাব রয়েছে সেগুলো পরিমাণ ও গুণগত দিক থেকে ভারসাম্যপূর্ণ। বিভিন্ন ঋতুতে বাতাস, মাটি ও তাপমাত্রার ভিন্ন ভিন্ন অবস্থার আলোকে নানা ধরণের গাছপালা, ফুল ও ফল জন্মে। সম্প্রতি উদ্ভিদ বিজ্ঞানের গবেষণায় দেখা গেছে, প্রত্যেক গাছ-পালার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বা অংশ ও উপাদানের সুনির্দিষ্ট হিসাব, মাপ বা ওজন রয়েছে। এসব অংশের কোনটি কম বেশি হলে তা অন্য উদ্ভিদে পরিণত হয়।
কোরআনের বিজ্ঞান সম্পর্কিত তথ্যের অলৌকিকতা জ্ঞান-বিজ্ঞানের অনেক অজানা রহস্যের পর্দা উন্মোচিত করেছে। তবে পবিত্র কোরআনের মূল লক্ষ্য হল মানুষকে সুপথ দেখানো। তবুও এ মহাগ্রন্থে মাঝে মধ্যে ইশারায় ইঙ্গিতে যেসব বৈজ্ঞানিক তথ্য দেয়া হয়েছে তা থেকেই বোঝা যায় এমন এক উৎস থেকে এসব তথ্য দেয়া হয়েছে যাঁর জ্ঞান-ভাণ্ডার অশেষ বা অসীম এবং যিনি অতুলনীয় মহা-কৌশলী। আর এই মহান সত্তাই বিশ্ব জগতের একমাত্র স্রষ্টা এবং তিনিই উপাসনা বা এবাদতের যোগ্য একমাত্র সত্তা। সুরা ফোরকানের ৬ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন,
” হে রাসূল! আপনি বলুন, একে তিনিই অবতীর্ণ করেছেন, যিনি নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলের গোপন রহস্য অবগত আছেন। তিনি ক্ষমাশীল, মেহেরবান। ”

কোরআনের নানা তথ্যের অলৌকিকতার মধ্যে কোনো কোনো ঘটনা ঘটার ব্যাপারে ভবিষ্যদ্বাণী অন্যতম। যেমন,রোমের কাছে ইরানের পরাজয়ের ভবিষ্যদ্বাণী। ৬১৫ খৃস্টাব্দে ইরানে সাসানীয় রাজবংশের শাসন চলাকালে রোমান সাম্রাজ্য ইরানের কাছে পরাজিত হয়। কিন্তু খুবই শিগগিরই ইরান রোম সাম্রাজ্যের কাছে পরাজিত হবে কোরআন জোরালো ও স্পষ্টভাবে ভবিষ্যদ্বাণী করেছে।
সুরা রোমের দুই থেকে চার নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, “রোমকরা পরাজিত হয়েছে,নিকটবর্তী এলাকায় এবং তারা তাদের পরাজয়ের পর শিগগিরই বিজয়ী হবে,কয়েক বছরের মধ্যে। অগ্র-পশ্চাতের কাজ আল্লাহর হাতেই। সেদিন মুমিনরা আনন্দিত হবে।”
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, কোরআনের ওই ভবিষ্যদ্বাণী সফল হয়েছিল।
কোরআনের ভবিষ্যদ্বাণীর আরেকটি দৃষ্টান্ত সুরা কাওসার। বিশ্বনবী (সাঃ)’র পুত্র সন্তান মারা যাওয়ায় এবং তাঁর দ্বিতীয় কোনো জীবিত পুত্র সন্তান না থাকায় কোনো কোনো অজ্ঞ মুশরিকরা বলত, মুহাম্মাদ(সাঃ)-এর বংশ নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। যে লোকটি রাসূল (সাঃ)-কে “আবতার” বা বংশধরহীন বলে উল্লেখ করত পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাকেই “আবতার” বলে উল্লেখ করেছেন। বাস্তবেও হয়েছে তাই। লোকটির সন্তানাদি থাকা সত্ত্বেও দুই-তিন প্রজন্ম পরই তার বংশ নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। কিন্তু বিশ্বনবী (সাঃ)’র পবিত্র বংশধারা তাঁর কন্যা হযরত ফাতেমা (সাঃ)’র মাধ্যমে অব্যাহত থাকে এবং তা আজো অব্যাহত রয়েছে। পবিত্র বৃক্ষের মত এর শাখা-প্রশাখা আজো প্রবর্ধমান।
মহান আল্লাহ সুরা কাওসারে বলেছেন, ” নিশ্চয় আমি আপনাকে কাওসার (তথা ব্যাপক কল্যাণ ও বরকত) দান করেছি। অতএব আপনার পালনকর্তার উদ্দেশ্যে নামায পড়ুন এবং কোরবানী করুন। যে আপনার শত্রু, সেই তো লেজকাটা, নির্বংশ।”
১৯৮১ সালে তৎকালীন ফরাসি প্রেসিডেন্ট ফ্রাসোঁয়া মিতেরা মমি করে রাখা ফেরাউনের লাশ পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও গবেষণার জন্য তা ফ্রান্সে পাঠাতে মিশর সরকারের কাছে অনুরোধ করেন।
ফেরাউনের লাশবাহী বিমান যখন ফ্রান্সের মাটিতে অবতরণ করে তখন দেশটির সরকার প্রধান ও মন্ত্রী পরিষদসহ অনেক উচ্চ-পদস্থ ফরাসী কর্মকর্তা লাশটিকে সম্বর্ধনা জানাতে বিমানবন্দরে উপস্থিত হন। মনে হচ্ছিল যেন ফেরাউন এখনও জীবিত রয়েছেন এবং তিনিই ফ্রান্সের প্রকৃত শাসক।
অভ্যর্থনা অনুষ্ঠানের পর ফেরাউনের লাশ ফ্রান্সের একটি বিশেষ সংরক্ষণাগার কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয়। দেশটির সেরা শল্যবিদ বা সার্জন ও লাশ বা শরীর পরীক্ষার বিশেষজ্ঞ এবং গবেষক ও প্রত্নতাত্ত্বিকদের সেখানে জড় করা হয়। ফেরাউনের মমিকৃত লাশ পরীক্ষা করা এবং এর অজানা রহস্যগুলো উদঘাটনই ছিল এ পদক্ষেপের উদ্দেশ্য।
ফেরাউনের লাশ সংক্রান্ত গবেষক টিমের প্রধান ছিলেন মরিস বুকাইলি। ফেরাউনের লাশ সংরক্ষণ অন্য গবেষকদের উদ্দেশ্য হলেও বুকাইলি নিজে ফেরাউনের মৃত্যুর রহস্য উদঘাটনে উদগ্রীব ছিলেন। সারা রাত ধরে তিনি গবেষণা চালান। কয়েক ঘণ্টা গবেষণার পর ফেরাউনের লাশে লবণের কিছু অবশিষ্টাংশ পাওয়া যায়। ফলে স্পষ্ট হয় যে সাগরে ডুবেই ফেরাউনের মৃত্যু হয়েছে। মৃত্যুর পর তার লাশ সাগর থেকে উঠিয়ে এনে মমি করা হয়। কিন্তু বুকাইলির বিস্ময়ের মাত্রা ব্যাপক হয়ে উঠেছিল একটি প্রশ্নকে ঘিরে- এ লাশ কিভাবে অন্য লাশগুলোর চেয়ে বেশি মাত্রায় সংরক্ষিত বা অক্ষত রয়েছে? বুকাইলি যখন ফেরাউনের মৃত্যুর কারণ নিয়ে চূড়ান্ত প্রতিবেদন তৈরি করছিলেন এবং তাতে এটা লেখেন যে ফেরাউন সাগরে ডুবেই মারা গেছে তখন উপস্থিত সঙ্গীদের মধ্যে একজন তাকে বললেন, এ গবেষণার ফলাফল প্রকাশে তাড়াহুড়া না করাটাই ভাল হবে। কারণ, এ গবেষণার ফলাফল মুসলমানদের মতের পক্ষে যাচ্ছে। বুকাইলি তা নাকচ করে দেন। কারণ, তার মতে এমন ফলাফলে উপনীত হওয়া অসম্ভব। বিজ্ঞানের ব্যাপক উন্নতি এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষার অত্যন্ত উন্নত মানের বা নিঁখুত সাজ-সরঞ্জাম ও উন্নত কম্পিউটার ছাড়া এটা প্রমাণ করা সম্ভব নয় বলে বুকাইলি মনে করতেন।
এরপর বুকাইলিকে বলা হল, মুসলমানদের ধর্মগ্রন্থে এসেছে ফেরাউন ডুবে মারা গেছে, মৃত্যুর পরও তার শরীর অক্ষত থেকে যায়। এ কথা শুনে বিস্ময়ে হতবাক বুকাইলি ভাবলেন, এটা কি মোটেও যৌক্তিক? কারণ, মুহাম্মাদ (সাঃ)’র যুগের আরব জাতি ও অন্যরা মিশরীয়দের মাধ্যমে ফেরাউনের লাশ মমি করার কথা জানত না।
মরিস বুকাইলি সারা রাত ফেরাউনের লাশের দিকে চোখ রেখে ভাবতে লাগলেন কিভাবে কোরআন ডুবে যাওয়া ফেরাউনের লাশ উদ্ধারের কথা জানল? অথচ খৃস্টানদের ধর্মগ্রন্থ বাইবেল এই গল্প বর্ণনার সময় ফেরাউনের লাশ উদ্ধার সম্পর্কে কিছুই বলেনি। নিজেকে প্রশ্ন করলন, এটা কি সেই ফেরাউন যে হযরত মূসা (আঃ)-কে গ্রেফতারের জন্য তার পেছনে ছুটেছিল? এখন থেকে প্রায় ১৪০০ বছর আগে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) তা জানতেন- এটা কি বিশ্বাস করা সম্ভব?
অস্থির বুকাইলি সে রাতেই বাইবেল ও তৌরাত পড়া শুরু করেন। তৌরাতের একটি অধ্যায়ে তিনি পড়ছিলেন, ” “পানি ফিরে এসে ফেরাউনসহ তার পিছে পিছে আসা ঘোড়াগুলো ও তার সেনাদের সবাইকে গ্রাস করে। তাদের কেউই রক্ষা পায়নি।” এ অংশটুকু পড়ে বিস্মিত হলেন বুকাইলি।
কিছু দিন পর ফরাসী সরকার কাঁচের কফিনে করে ফেরাউনের মমি আবারও মিশরে ফেরত পাঠায়। কিন্তু বুকাইলির মাথা তখনও ফেরাউনের সম্পর্কে কোরআনের বক্তব্য নিয়ে বিভোর ছিল। তিনি ফেরাউনের লাশ রক্ষা পাওয়া সংক্রান্ত কোরআনের বক্তব্য সম্পর্কে সুনিশ্চিত হওয়ার জন্য মুসলিম দেশগুলো সফরের সিদ্ধান্ত নেন। ফরাসি সার্জন বুকাইলি সৌদি আরবে চিকিৎসা সংক্রান্ত এক সম্মেলনে “ডুবে-যাওয়া ফেরাউনের লাশ রক্ষা পাওয়া” সম্পর্কে গবেষণালব্ধ নতুন তথ্য উল্লেখ করেন। ওই সম্মেলনে মানব দেহ-বিশ্লেষক একদল মুসলিমও উপস্থিত ছিলেন। এ অবস্থায় সেখানে একজন মুসলমান পবিত্র কোরআন খুলে সুরা ইউনুসের ৯২ নম্বর আয়াত তেলাওয়াত করলেন, যেখানে বলা হয়েছে,
” ” অতএব আজকের দিনে রক্ষা করছি আমি তোমার দেহকে যাতে তোমার পরবর্তীদের জন্য নিদর্শন হতে পারে। আর নিঃসন্দেহে বহু লোক আমার মহাশক্তির প্রতি লক্ষ্য করে না।”
বুকাইলি এ আয়াত শুনে সবার সামনে দাঁড়িয়ে যান এবং মুসলমান হওয়ার কথা ও পবিত্র কোরআনের প্রতি বিশ্বাসী হওয়ার কথা ঘোষণা করলেন। কোরআনের সত্যতা এভাবে প্রকাশিত হতে দেখে অনেকের চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ল অশ্রু এবং হৃদয়গুলোয় বইল পরিবর্তনের ঝড়।
বুকাইলি বহু বছর ধরে তার গবেষণায় বিজ্ঞানের নতুন তথ্যগুলোর সাথে কোরআনের মিল-অমিল খুঁজতে গিয়ে একটি অমিলও পাননি। ফলে কোরআনে কোনো ভুল না থাকার ব্যাপারে তার ঈমান কেবলই দৃঢ়তর হয়েছে। তিনি এসব গবেষণার ফলাফল তুলে ধরেছেন “কোরআন, তাওরাত, বাইবেল ও বিজ্ঞান” শীর্ষক বইয়ে। ১৪০০ বছর আগেও কোরআন বিজ্ঞানের এত সূক্ষ্ম দিক এত নির্ভুল বা নিখুঁতভাবে তুলে ধরায় তার অশেষ বিস্ময় বিধৃত হয়েছে এ বইয়ে। ফলে তা পশ্চিমা বিজ্ঞানীদের মধ্যেও বিস্ময়ের ঝড় তুলেছে। বহু ভাষায় অনুদিত বইটি বেশ ক’বার ছাপাতে হয়েছে। অনেক অমুসলিম এ বই পড়ে মুসলমান হয়েছেন।
ফেরাউন সংক্রান্ত গবেষণার সাথে কোরআনের দেয়া তথ্যের মিল পেয়ে বুকাইলি উচ্চারণ করেছিলেন কোরআনের এ আয়াত: ” এরা কি লক্ষ্য করে না কোরআনের প্রতি? এটা যদি আল্লাহ ছাড়া অন্য কারও পক্ষ থেকে হত, তবে এতো অবশ্যই বহু বৈপরীত্য বা ভুল দেখতে পেত।” (নিসা-৮২)
পবিত্র কোরআন নাজেল হওয়ার পর থেকে সব যুগের মানুষকে হেদায়াত বা সুপথ তথা সৌভাগ্যের পথ দেখিয়ে আসছে। আল্লাহর পরিচয়, বুদ্ধিবৃত্তিক জ্ঞান, সৃষ্টি জগত, বিচার দিবস বা পুনরুত্থান দিবস, অতীতের বিভিন্ন জাতির ইতিহাস, নৈতিকতা, পারিবারিক আইন, রাষ্ট্রীয় আইন, সামাজিক সম্পর্ক ও অর্থনৈতিক বিধানসহ পবিত্র কোরআনে সব ধরনে জরুরি বিধান ও জ্ঞানের বিষয় আলোচিত হয়েছে। এসব বিষয়ে কোরআনের তথ্য, বিধান ও বক্তব্য সব যুগের জন্যই প্রযোজ্য এবং চিরনতুন। কোরআনের বিধান ও শিক্ষায় সামান্যতম বিকৃতি ঘটেনি।
মানুষের জ্ঞান যে একদিন আমাদের সৌরজগতের বাইরেও লক্ষ কোটি গ্রহ-নক্ষত্র নিয়ে গঠিত সুদূর ছায়াপথ পর্যন্ত বিস্তৃত হবে এবং তারা নিজ অস্তিত্বের গভীর ও সূক্ষ্ম বিষয়গুলো উপলব্ধি করবে, পবিত্র কোরআন সেই ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল ১৪০০ বছর আগে। সুরা ফুসিলাতের ৫৩ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, “শিগগিরই আমি তাদেরকে আমার নিদর্শনাগুলো দেখাব পৃথিবীর দিগন্তে এবং তাদের নিজেদের মধ্যে,ফলে তাদের কাছে ফুটে উঠবে যে,আল্লাহ বা কোরআন সত্য। …”
কানাডিয় পাদ্রী ও গণিতের অধ্যাপক গ্যারি মিলার পবিত্র কোরআনের ভুল-ত্রুটি খুঁজে বের করে ইসলামকে হেয় করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু গভীর মনোযোগ দিয়ে কোরআন অধ্যয়ন ও এ মহাগ্রন্থের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে মিলার এ মহাগ্রন্থকে “সবচেয়ে বিস্ময়কর গ্রন্থ” বলে উল্লেখ করেন এবং ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হন। একদিন কানাডায় তার এক পুরনো বন্ধু তাকে বলেন যে, “তুমি কি নিশ্চিত যে, কোরআনের প্রতি ঈমান এনে সঠিক পথই ধরেছ?” উত্তরে মিলার বললেন, “১৪০০ বছর আগে অজ্ঞ লোকরা এ দাবি করত যে কোরআন একদল শয়তানের বক্তব্য ও যাদুর প্রভাব। আমার বন্ধুর অবস্থান তাদের মতই। মহান আল্লাহ তাদের এসব অপবাদের জবাবে সুরা শোয়ারায় বলেছেন,
‘এই কোরআন জিন বা শয়তানরা অবতীর্ণ করেনি। তারা এ কাজের উপযুক্ত নয় এবং তারা এর সামর্থ্যও রাখে না, তাদেরকে তো (আকাশে সংবাদ) শোনার জায়গা থেকে দূরে রাখা রয়েছে।’ “(২১০-১২)
মিলার আরো বলেছেন, “কোরআনকে জানার পর এটা বুঝতে পেরেছি যে, কোনো মানুষই এমন একটি গ্রন্থ রচনা করতে সক্ষম নয়। বরং কোরআন যে মহান আল্লাহরই বাণী তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এ বইয়ে সব ধরণের সন্দেহের যৌক্তিক জবাব দেয়া হয়েছে। এ গ্রন্থ মহানবী (সা:)’র খোদাপ্রদত্ত অলৌকিক নিদর্শন বা মোজেজা।”
কোরআন অদৃশ্যের ও অতীতের অনেক খবর দিয়েছে। বিগত অনুষ্ঠানেও আমরা কোরআনের সফল ভবিষ্যদ্বাণী সম্পর্কে আলোচনা করেছি। মহান আল্লাহ সুরা হুদের ৪৯ নম্বর আয়াতে বলেছেন,
“এসব অদৃশ্যের খবর যা আমি আপনার কাছে ওহী হিসেবে নাজেল করেছি। ইতিপূর্বে এটা আপনার এবং আপনার জাতির জানা ছিল না।”
গ্যারি মিলার কোরআনের এ পদ্ধতিকে নজিরবিহীন বলে মনে করেন। তিনি এ প্রসঙ্গে বলেছেন, «আসলে কোনো ধর্মীয় গ্রন্থই এভাবে কথা বলেনি। কোরআনে এমন কিছু তথ্য রয়েছে যা অতীত সম্পর্কিত অথবা ভবিষ্যদ্বাণী। কিন্তু বাইবেলে কোনো ঘটনা সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চাইলে এ গ্রন্থ তা জানাতে সক্ষম নয়, এ ব্যাপারে গ্রন্থটি অন্য উৎসের কাছে যেতে বলে। কোরানের কোনো আয়াত সম্পর্কে যাদের মনে কোনো সন্দেহ রয়েছে এ মহাগ্রন্থ তাদেরকে কোরআন নিয়ে আরো বেশি চিন্তাভাবনার আহ্বান জানায়। কোরআনে যেসব তথ্য দেয়া হয়েছে সেগুলো কেউই অস্বীকার করতে পারে না। কারণ, মানুষের জ্ঞান থেকে এসব তথ্য দেয়া হয়নি, বরং আল্লাহই এসব তথ্য দিয়েছেন এবং তিনি অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে পুরোপুরি অবহিত। মহান আল্লাহ সুরা আলে ইমরানের ৪৪ নম্বর আয়াতে বলেছেন,
“এ হলো গায়েবী সংবাদ, যা আমি আপনাকে পাঠিয়ে থাকি। আর আপনি তো তাদের কাছে ছিলেন না, যখন পানিতে কলম নিক্ষেপ করে তারা প্রতিযোগিতা করছিল যে, কে প্রতিপালন করবে মারইয়ামকে এবং আপনি তাদের কাছে ছিলেন না, যখন তারা ঝগড়া করছিলো।”»
মহান আল্লাহ কোরআনের মাধ্যমে অদৃশ্যের খবর রাসূল (সা:)-কে জানিয়ে দিয়ে মুনাফিক ও তাদের সহযোগী, মুশরিক ও ইহুদিদের ষড়যন্ত্র উন্মোচিত করে তাদেরকে কলঙ্কিত করেছেন।
পবিত্র কোরআন নিকট ও দূর ভবিষ্যতে কি ঘটতে যাচ্ছে সে সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করেছে। ইসলামের নানা বিজয় ও বিস্তার এবং শত্রুদের একের পর এক পরাজয় ও নিশ্চিহ্ন বা নির্মূল হওয়া সম্পর্কেও সুসংবাদ দিয়েছে এ মহাগ্রন্থ। যেমন, সুরা আনফালের ৭ ও ৮ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে: “আর যখন আল্লাহ দুটি দলের একটির ব্যাপারে তোমাদের সাথে ওয়াদা করেছিলেন যে, সেটি তোমাদের হস্তগত হবে, আর তোমরা কামনা করছিলে যাতে কোন রকম কণ্টক নেই তথা সেই নিরস্ত্র দলটি তোমাদের ভাগে আসুক; অথচ আল্লাহ চাইতেন সত্যকে স্বীয় কালামের মাধ্যমে সত্যে পরিণত করতে এবং কাফেরদের মূল কর্তন করে দিতে, যাতে করে সত্যকে সত্য এবং মিথ্যাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করে দেন,যদিও পাপীরা অসন্তুষ্ট হয়।”"
উল্লেখ্য এ আয়াত বদর যুদ্ধের আগে নাজেল হয়েছিল। এ সময় কাফেরদের তুলনায় মুসলমানদের সংখ্যা ছিল খুবই কম এবং অস্ত্র ও অর্থ-সম্পদও ছিল নগণ্য। মুসলিম বাহিনীর মধ্যে মাত্র দুজন সেনা ছিলেন অশ্বারোহী। কাফেরদের সেনা সংখ্যা ছিল অনেক এবং তারা বিপুল অস্ত্র, সম্পদ ও সাজ-সরঞ্জামের অধিকারী ছিল।
অথচ এ সময়ই কোরআন কাফেরদের নির্মূল হওয়ার খোদায়ী প্রতিশ্রুতির কথা উল্লেখ করেছে এবং কোরআনের ওয়াদা অনুযায়ী মুসলমানরাই কাফেরদের ওপর বিজয়ী হয়েছে।
আবু লাহাব সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে ভবিষ্যদ্বাণীও গ্যারি মিলারকে বিস্মিত করেছে। আবু লাহাব ছিল ইসলামের ঘোর শত্রু। সে সব সময় রাসূল (সা.)’র পিছে লেগে থাকত। রাসূল (সা.) যেখানেই ধর্মের দাওয়াত দিতেন সেখানেই আবু লাহাব মানুষকে বিপরীত কথা বলত। সে জনগণকে বলত, মুহাম্মাদ(সা.) যদি তোমাদের বলেন যে এটা সাদা, তোমরা জেনে রাখবে যে তা অবশ্যই কালো, সে যদি বলে রাত তবে তোমরা জানবে যে তা অবশ্যই দিন।
রাসূল (সা.)’র চাচা আবু লাহাবের মৃত্যুর দশ বছর আগেই পবিত্র কোরআন ভবিষ্যদ্বানী করেছিল যে আবু লাহাব আগুনে পতিত হবে এবং কাফের হিসেবেই মারা যাবে। সুরা “মাসাদ”-এ বলা হয়েছে: “আবু লাহাবের হাত দুটি ধ্বংস হোক এবং ধ্বংস হোক সে নিজে, কোন কাজে আসেনি তার ধন-সম্পদ ও যা সে উপার্জন করেছে। শিগগিরই সে প্রবেশ করবে লেলিহান অগ্নিতে এবং তার স্ত্রীও-যে ইন্ধন বহন করে,তার গলদেশে খর্জুরের রশি নিয়ে।”
আবু লাহাব তার সম্পর্কিত এ সুরা শোনার পর মুসলমান হওয়ার দাবি করে জনগণের সামনে রাসূল (সা.)কে বলে যে, “মুসলমান হওয়া সত্ত্বেও আমি কি জাহান্নামে যাব? এ কেমন ওহী তুমি আনছ?”
কিন্তু ইতিহাস বলে আবু লাহাব মুসলমান হবে বলে কথা দিয়েও কখনও মুসলমান হয়নি। সে নবী(স.) ও ইসলামের বিরুদ্ধে শত্রুতা অব্যাহত রেখেছিল এবং কাফের অবস্থায় মারা যায়। সুরা “মাসাদ”-এর ওপর আস্থা রেখে রাসূল (সা.) আবু লাহাবের হুমকিগুলো মোকাবেলা করতেন দৃঢ়চিত্তে।
পবিত্র কোরআনের সুরা আম্বিয়ার ১০৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, “সেদিন আমি আকাশকে গুটিয়ে নেব,যেমন গুটানো হয় লিখিত কাগজপত্র। যেভাবে আমি প্রথমবার সৃষ্টি করেছিলাম,সেভাবে আগের অবস্থানে ফিরিয়ে নেব সৃষ্টিকে। আমার ওয়াদা নিশ্চিত,আমি তা অবশ্যই পূর্ণ করব। “
আধুনিক যুগের বিজ্ঞানীরাও বলছেন, বিশ্বজগত যেভাবে সব সময়ই প্রসারিত হয়েছে, তেমনি এক বিশেষ প্রক্রিয়ায় তা আবারও সংকীর্ণ হবে ও ধ্বংস হয়ে যাবে। বিশেষ কিছু উপকরণের সীমাবদ্ধতা ও বিদ্যমান উপকরণের কারণে বিশ্ব আরও সম্প্রসারিত বা বিস্তৃত হতে সক্ষম নয়।
মহান আল্লাহ বিশ্বের মহাপ্রলয় বা ধ্বংসের দিন ঠিক করে রেখেছেন। কিন্তু আল্লাহ ছাড়া আর কেউই এর দিন-ক্ষণ সম্পর্কে জানেন না।
ডক্টর গ্যারি মিলার মুসলমানদের উদ্দেশ্য করে বলেছেন, আপনারা কোরআনের সৌন্দর্য নিয়ে গভীর চিন্তা-ভাবনা করুন। আমি এমন সময় কোরআন নিয়ে চিন্তাভাবনা করেছি যখন পাশ্চাত্যে খুব কম লোকই কোরআন নিয়ে ভাবত।
আমি আপনাদের সুরা আনকাবুতের ৫১ ও ৫২ নম্বর আয়াত নিয়ে ভাবতে বলছি। এ দুই আয়াতে বলা হয়েছে: “এটাকি তাদের জন্যে যথেষ্ট নয় যে,আমি আপনার কাছে কিতাব নাযিল করেছি, যা তাদের কাছে সব সময় পাঠ করা হয়। এতে অবশ্যই বিশ্বাসী লোকদের জন্যে রহমত ও উপদেশ আছে। বলুন,আমার ও তোমাদের মধ্যে আল্লাহই সাক্ষীরূপে যথেষ্ট। তিনি জানেন যা কিছু নভোমণ্ডলে ও ভূ-মণ্ডলে আছে। আর যারা মিথ্যায় বিশ্বাস করে ও আল্লাহকে অস্বীকার করে,তারাই ক্ষতিগ্রস্ত।”
পবিত্র কোরআন গোটা মানব জাতিকে চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলেছে যে, সারা বিশ্বের সব মানুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টা ও সাধনার বলেও কোরআনের বক্তব্যের মত বক্তব্য উপস্থাপন অসম্ভব। মুফাসসিরদের মতে, এর কারণ, হল কোরআন অদৃশ্যের জ্ঞান তুলে ধরেছে যা মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। তাই আল কোরআনের এ চ্যালেঞ্জও এ মহাগ্রন্থের অন্যতম মোজেজা বা অলৌকিকতা।
ইসলামের প্রাথমিক যুগে পবিত্র কোরআনের মত সংকলন রচনার জন্য বিশ্বনবী(সা.)’র শত্রুরা বেশ উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে কাজ শুরু করেছিল। তাদের মধ্যে অনেকেই আরবী সাহিত্য, বাগ্মীতা ও কবিতা বা অলংকারিক ভাষা ব্যবহারে সুদক্ষ ছিল। কাব্য ও সাহিত্যে পারদর্শিতা নিয়ে এবং গোত্রীয় রীতি ও সংস্কৃতি নিয়ে তাদের মধ্যে গর্ব আর অহংকার প্রকাশের প্রতিযোগিতা হত। কিন্তু পবিত্র কোরআন তাদের সাহিত্য, সংস্কৃতি, মূর্তিপূজা ও প্রথাগুলোকে কুসংস্কার এবং অজ্ঞতাসুলভ বলে নিন্দা জানায়। এসব বিষয় নিয়ে তাদের গর্ব ও অহংকারেরও কঠোর নিন্দা জানিয়েছে এ মহাগ্রন্থ। একইসাথে কোরআন তাদেরকে এ মহাগ্রন্থের অনুরূপ রচনার চ্যালেঞ্জও জানিয়েছে।
মক্কার মুশরিকরা কোরআনকে মোকাবেলার জন্য নানা পদক্ষেপ নেয়। প্রথমেই তারা পবিত্র কাবা ঘরে বিশ্বনবী(সা.)-কে কোরআন তেলাওয়াত করা থেকে বিরত রাখার জন্য পদক্ষেপ নেয়। যে মুহাম্মাদ (সা.) যদি কাবা ঘরের পাশে ও মাকামে ইব্রাহিমে নামাজ পড়া অব্যাহত রাখেন তাহলে তাঁর গর্দান গুড়িয়ে দেয়া হবে বলে আবু জাহেল হুমকি দেয় । অবশ্য মহান আল্লাহ তাঁর প্রিয়তম রাসূলকে কাফেরদের আঘাত থেকে রক্ষার ব্যবস্থা করেছেন। কোনো কোনো মুশরিক জনগণকে এ পরামর্শ দেয় যে, তারা যেন কোরআনের তেলাওয়াত না শোনে, অথবা এমন হৈ-চৈ করে যাতে কোরআনের মধুর শব্দ মানুষ শুনতে না পারে। কিন্তু মহান আল্লাহ কোরআন তেলাওয়াত ও নামাজ পড়া অব্যাহত রাখতে রাসূল (সা.)-কে নির্দেশ দেন।
বিশ্বনবী(সা.)’র অলৌকিক নিদর্শন কোরআন মক্কার জনগণকে প্রভাবিত করতে পারে এ আশঙ্কা করছিল মক্কার কাফের ও মুশরিকরা। মক্কার জনগণ প্রভাবিত হলে রাসূল (সা.)’র বিরোধিতার কোনো অজুহাত অবশিষ্ট থাকবে না বলে তারা শঙ্কিত ছিল। তাই তারা কোরআনকে স্রস্টার বা আল্লাহর বাণী বলে স্বীকার করত না যাতে জনগণের মধ্যে এর প্রতি বিশ্বাস ও শ্রদ্ধা না জাগে।
মক্কার কাফেররা বলত, কোরআন স্রস্টার বাণী নয়, বরং মানুষেরই বাণী এবং কোরআনের বাণীগুলো যাদু-মন্ত্র মাত্র। কোরআনের কোনো কোনো আয়াতের অংশ বিশেষকে দেখিয়ে মক্কার কাফের মুশরিরকদের কেউ কেউ বলত, এ মহাগ্রন্থ রূপকথার বই।
জাহেলি যুগের কোনো কোনো সাহিত্যিক জনগণের মধ্যে সন্দেহ সৃষ্টির জন্য বলত যে, কোরআনের মত বাক্য রচনা কোনো কঠিন কাজ নয় এবং তারা কোরআনের সুরা ও আয়াতগুলোর মত সুরা ও আয়াত রচনা করতে সক্ষম।
ঐতিহাসিকরা জানিয়েছেন, অনেক কাফের-মুশরিক কোরআনের সুরা ও আয়াতগুলোর মত সুরা ও আয়াত রচনার চেষ্টা চালিয়েছেন। তারা ব্যাপক প্রচেষ্টা চালানোর পর যা রচনা করেছেন বিশেষজ্ঞরা সেগুলোকে কোরআনের তুলনায় মূল্যহীন ও পরিহাসতুল্য বলে উল্লেখ করেছেন। নবুওতের মিথ্যা দাবিদার মুসায়লামা কোরআনের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে গিয়ে সুরা ফিলের অনুকরণে কিছু বাক্য রচনা করেছিলেন। সারবস্তুহীন ও অত্যন্ত হাল্কা চালের এসব বাক্যের মধ্যে ছিল না কোরআনের ধারে কাছে ঘেঁষার মত ভাষাশৈলী বা সৌন্দর্য। এসব ফন্দির জবাবে সুরা আনকাবুতে বলা হয়েছে, “তারা বলে, তার পালনকর্তার পক্ষ থেকে তার প্রতি কিছু নিদর্শন অবতীর্ণ হল না কেন? বলুন, নিদর্শন তো আল্লাহর ইচ্ছাধীন। আমি তো একজন সুস্পষ্ট সতর্ককারী মাত্র। এটাকি তাদের জন্যে যথেষ্ট নয় যে,আমি আপনার কাছে কিতাব নাযিল করেছি, যা তাদের কাছে সব সময় পাঠ করা হয়। এতে অবশ্যই বিশ্বাসী লোকদের জন্যে রহমত ও উপদেশ আছে। ” (৫১-৫২) আয়াতুল্লাহ তাবারসির মতে, এ আয়াতে উল্লেখিত “যথেষ্ট” শব্দ থেকে বোঝা যায়, কোরআন অলৌকিকতা হিসেবে যথেষ্ট ও শ্রেষ্ঠ মোজেজা এবং এ মোজেজার ফলে অন্য সব মোজেজার প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে। তারপরও যদি কোরআনের ঐশী হওয়া বা এর অলৌকিকতা নিয়ে কারো কোনো সন্দেহ থাকে তাদের উদ্দেশ্যে সুরা আসরায় চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলা হয়েছে: “বলুনঃ যদি মানব ও জ্বিন এই কোরআনের অনুরূপ কিছু রচনার জন্যে একত্র হয়,এবং তারা পরস্পরের সাহায্যকারী হয়;তবুও তারা কখনও এর অনুরূপ কিছু রচনা করে আনতে পারবে না।” (৮৮) কোরআনের অন্যত্র ওই চ্যালেঞ্জ কিছুটা সহজ করে দিয়ে বলা হয়েছে, “তারা কি বলে? কোরআন তুমি তৈরি করেছ? তুমি বল, তবে তোমরাও অনুরূপ দশটি সূরা বানিয়ে নিয়ে আস এবং আল্লাহ ছাড়া যাকে পার ডেকে নাও, যদি তোমাদের কথা সত্য হয়ে থাকে।”(হুদ-১৩)
এরপর ওই চ্যালেঞ্জ আরো সহজ করে বলা হয়েছে,
“এ সম্পর্কে যদি তোমাদের কোন সন্দেহ থাকে যা আমি আমার বান্দার কাছে অবতীর্ণ করেছি, তাহলে এর মত একটি সূরা রচনা করে নিয়ে এস। তোমাদের সব সাক্ষী বা সাহায্যকারীদেরও সঙ্গে নাও-এক আল্লাহকে ছাড়া, যদি তোমরা সত্যবাদী হয়ে থাকো।” (বাকারা-২৩)
সভ্যতার ইতিহাসের ইতালিয় অধ্যাপক মিসেস লরা ওয়াকসিয়া ভাগলিরি লিখেছেন, ” কোরআনের অনুরূপ অন্তত: একটি সুরা রচনার যে চ্যালেঞ্জ মুহাম্মাদ(সা.) দিয়েছেন আরব দেশে মুশরিকদের মধ্যে অনেক প্রতিভাবান সাহিত্যিক থাকা সত্ত্বেও তারা কোরআনের সাথে তুলনা করার মত একটি বাক্যও রচনা করতে সক্ষম হয়নি। বরং তারা সশস্ত্র হয়ে মুহাম্মাদ(সা.) এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে, কিন্তু তারা কোরআনের মহত্ত্ব ও বিশালত্বের কাছে অক্ষমই থেকেছে। কারণ, এ মহাগ্রন্থের আধ্যাত্মিক পূর্ণতা ছাড়াও বাহ্যিক সৌন্দর্য ও ভাষাশৈলীও অসাধারণ। কোরআনের উচ্চাঙ্গের চেতনা ও ভাবার্থ নকল করা সম্ভব নয়।”
মিসেস লরা আরো বলেছেন, ” আমরা কোরআনের মধ্যে এমন সব জ্ঞান দেখি যা মানবীয় প্রতিভা ও যোগ্যতার আয়ত্তাধীন নয়। পৃথিবীর সেরা জ্ঞানী, রাজনীতিবিদ ও দার্শনিকরাও এ ধরণের জ্ঞান সম্পর্কে অবহিত নন। যাঁর জ্ঞান সমস্ত আকাশ ও জমিন বেষ্টন করে আছে কেবল সেই মহান আল্লাহর পক্ষেই সম্ভব কোরআন রচনা করা”।
অতীত যুগের মত সমসাময়িক বা বর্তমান যুগেও অনেকে কোরআনের অনুরূপ গ্রন্থ রচনার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু কেউই এখনও সফল হননি। সম্প্রতি “আমেরিকা অন লাইন” নামের একটি কোম্পানি কোরআনের কিছু আয়াতের রীতি বা স্টাইল অনুসরণ করে কিছু ভুল ও বিকৃত ধারণাযুক্ত সুরা রচনা করেছে। ইন্টারনেটে প্রকাশিত এসব খুবই সারবস্তুহীন, দুর্বল ও হাস্যকর। মিশরের আলআজহার বিশ্ববিদ্যালয় ও একদল মুসলিম লেখকসহ বিশ্বের মুসলিম সমাজ এই অশুভ তৎপরতার নিন্দা জানিয়েছে। ব্রিটেনের একটি সাইটও অনুরূপ পদক্ষেপ নিয়ে কিছু জাল সুরা রচনার করেছে। কিন্তু ইসলাম সম্পর্কে অমুসলিম বিশেষজ্ঞরাই সেগুলোকে কোরআনের যৌক্তিক বাণীর মোকাবেলায় হাস্যকর বলে উল্লেখ করেছেন। কোরআন সম্পর্কে যার খুব সামান্য জ্ঞান আছে তারাও এটা বুঝবেন যে এসব বাক্য কোরআনের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে সক্ষম নয়।
এটা দিবালোকের মত স্পষ্ট যে প্রকৃত কোরআন বিশ্বের দেড়শ কোটি মুসলমানের কাছে অবিকৃত অবস্থায় সুরক্ষিত রয়েছে। বিশ্বনবী(সা.)’র কাছে শেষ ঐশী গ্রন্থ হিসেবে ২৩ বছরে পর্যায়ক্রমে নাজেল হয়েছিল এই চিরন্তন মোজেজা।
কোরআনের মোজেজা সম্পর্কে রাসূল (সা.) বলেছেন, “কোরআন এমন একটি সুদৃঢ় ও অবিচ্ছিন্ন রশি যার এক প্রান্ত রয়েছে মহান আল্লাহর হাতে এবং অন্য প্রান্ত রয়েছে মানুষের হাতে। আল্লাহর এ রশি আঁকড়ে ধরার মধ্যে রয়েছে মানুষের ইহকালীন ও পারলৌকিক সৌভাগ্য।”
পবিত্র কোরআনে রয়েছে ১১৪টি সুরা। সবচেয়ে দীর্ঘ সুরা “আল-বাকারা”-য় রয়েছে ২৮৬ বাক্য বা আয়াত। কোরআনের সবচেয়ে ছোট সুরা”আল কাওসার”-এ রয়েছে মাত্র তিনআয়াত। কোরআনের ১১৪ টি সুরার মধ্যে ৮৬টি সুরা নাজেল হয়েছে মক্কায়। দীর্ঘ ১৩ বছরে নাজেল হয়েছে এসব সুরা। ইসলাম-পূর্ব যুগে আরবদের সামাজিক কাঠামো ছিল গোত্র-ভিত্তিক। গোত্র-প্রধানের কথাই ছিল সেখানকার আইন। গোত্রীয় চুক্তিগুলোই ছিল ব্যক্তির ও সমাজের নানা অধিকার রক্ষার মাধ্যম। গোত্রগুলোর মধ্যে যুদ্ধ ও রক্তপাত লেগেই থাকত। চিন্তাগত দিক থেকে আরবরা ছিল বহুত্ববাদী বা মুশরিক। তারা কল্পিত নানা দেব-দেবীর পূজা করত। অবশ্য একত্ববাদে বিশ্বাসী অল্প সংখ্যক একদল আরব “হুনাফা” নামে খ্যাত ছিলেন। সে যুগে ইহুদিদের কয়েকটি গোত্র আরবের মদীনায় বসবাস করত এবং কিছু খ্রিস্টান বসবাস করত সিরিয়া ও ইয়েমেনে।
ইসলাম-পূর্ব যুগে আরব ভূখণ্ডে নৈতিক মূল্যবোধের চরম অবক্ষয় ঘটেছিল। সমাজের অর্ধেক অংশ নারীর কোনো সম্মান ছিল না। নবজাতক কণ্যাদের জীবন্ত কবর দেয়া হত অথবা চরম অবহেলায় তাদেরকে লালন-পালন করা হত। চুরি, লুণ্ঠণ, ব্যাভিচার, শ্লীলতাহানি, সংঘাত, রক্তপাত ও চুক্তি লঙ্ঘন ছিল ব্যাপক প্রচলিত ঘটনা। বেশীরভাগ আরবই ছিল অশিক্ষিত ও অজ্ঞ। কোরআনেও এসেছে,তৎকালীন আরব সমাজ ছিল পশ্চাদপদ, অধঃপতিত ও অজ্ঞ। অবশ্য আরবদের মধ্যে কবিতা ও বাগ্মীতার ব্যাপক বিকাশঘটেছিল। বেশিরভাগ কবিতারই বিষয় ছিল গোত্রীয় গুণকীর্তণ। বংশের মর্যাদা সম্পর্কেঅতিরঞ্জণ, বড়াই ও বিভ্রান্তিমূলক বক্তব্য ছিল এসব কবিতার প্রধান বিষয়।
মক্কী সুরাগুলো সাধারণত ছোট। ছোট ছোট বাক্যের এসব সুরায় মুশরিকদের বহু খোদা ও তাদের অংশীবাদী বিশ্বাস এবং যেসব যুক্তি দেখিয়ে তারা আল্লাহ ছাড়া অন্য কিছুর উপাসনা করত সেসব যুক্তির অসারতা তুলে ধরা হয়েছে।এ ছাড়াও এ সুরাগুলোমুশরিকদের নানা সন্দেহ ও প্রশ্নের জবাব দিয়েছে এবং তারা নিজেদের মনমত বিভিন্ন মোজেজা দেখাতে রাসূল (সা.)’র কাছে যেসব দাবি জানাত অযৌক্তিকতা তুলে ধরেছে। মাক্কী সুরাগুলোর ছন্দ, শব্দের ধ্বনি-মাধুর্য ও গদ্য অত্যন্ত উচ্চ মানের। একত্ববাদ, পরকালের জীবন ও অস্তিত্বের জগত বা সৃষ্টিতত্ত্ব এসব সুরার বিষয়বস্তু।
কোরআন নাজেল হওয়ার পর এর তেলাওয়াত রাসূল (সা.)’র নিয়মিত কর্মসূচীতে পরিণত হয়। তিনি নিজ নামাজে এবং বিশেষ করে নৈশ এবাদতে নিয়মিত কোরআন তেলাওয়াত করতেন। এই তেলাওয়াত তাঁর আত্মিক শক্তি বৃদ্ধি করত এবং বিভিন্ন সমস্যা ও সংকট মোকাবেলার জন্য তাঁকে প্রস্তুত করত।
বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) কোরআনের বক্তব্যগুলো তুলে ধরার জন্য পবিত্র কাবা ঘরের পাশে বসতেন এবং নামাজে দাঁড়িয়ে অথবা নামাজের বাইরে খুবই মধুর সুরে এ মহাগ্রন্থের সুরাগুলো তেলাওয়াত করতেন। এভাবে কোরআনের আয়াত সবার কানে পৌঁছত। কোরআনের অমিয় বাণী মুশরিকদের চিন্তাধারা ও বিশ্বাসের বিপরীত হওয়া সত্ত্বেও এরপ্রবল আকর্ষণ বহু মানুষকেবাণীগুলো শুনতেকাছে টানত এবং তারা সুযোগ পেলেই কোরআনের হৃদয়-স্পর্শী বাণীর ধারায় প্রাণ জুড়াতেচাইত।
বিশ্বনবী (সা.)’র এ ধরণের পদক্ষেপের ফলে মক্কার অনেকেই ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিল। ওসমান বিন মাযউন, যমাদ বিন সাআলবাহ, আদাস এবং উৎবার গোলাম ছিলেন এদের মধ্যে অন্যতম। শুধু মূর্তি পূজারী নয়, আহলে কিতাবদেরও কেউ কেউ পবিত্র কোরআনের প্রভাবে মুসলমান হয়েছিল। খ্রিস্টানদের অনেকেরই চোখ পবিত্র কোরআনের আয়াত শোনার পর অশ্রু-সজল হয়ে পড়ত। সুরা মায়েদার ৮২ ও ৮৩ নম্বর আয়াতে এ সম্পর্কে বলা হয়েছে:
“আপনি সব মানুষের চেয়ে ইহুদী ও মুশরেকদেরকে মুসলমানদের বেশি শত্রুতায় লিপ্ত পাবেন এবং আপনি সবার চেয়ে মুসলমানদের সাথে বন্ধুত্বে বেশিকাছে তাদেরকে পাবেন, যারা নিজেদেরখ্রিস্টান বলে। এর কারণ,তাদের মধ্যে আলেম রয়েছে, দরবেশ রয়েছে এবং তারা অহঙ্কার করে না।
আর তারা রসূলের প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে, তা যখন শুনে, তখন আপনি তাদের চোখ অশ্রু সজল দেখতে পাবেন; কেননা, তারা সত্যকে চিনে নিয়েছে। তারা বলেঃ হে আমাদের প্রতি পালক, আমরা মুসলমান হয়ে গেলাম। তাই, আমাদেরকেও মান্যকারীদের অন্তর্ভুক্তকরুন।”
এ অবস্থায় মহানবী (সা.)কেপ্রকাশ্যে কোরআন তেলাওয়াত এবং ইসলামের দাওয়াত দেয়া থেকে বিরত রাখতে মুশরিকরা নানা প্রলোভন ও হুমকির আশ্রয় নেয়। কিন্তু এতে কোনো ফল হয়নি, বরং তারা কোনো না কোনোভাবে পবিত্র কোরআনের শ্রেষ্ঠত্ব বা ঐশী অলৌকিকতাকে স্বীকার করেছে। মুসলিম ঐতিহাসিক ইবনে আসাকার লিখেছেন: “একদিন নেতৃস্থানীয় কুরাইশরা মসজিদুল হারামে রাসূল-সা.’র কাছে আসে। তাদের মধ্যে ওতবা ইবনে রবিয়া অন্য কুরাইশদের বলল, আমাকেই মুহাম্মদেরসা. সাথে কথা বলতে দাও, কারণ তার সঙ্গে আমার আচরণ তোমাদের চেয়ে বেশী নম্র। কুরাইশদের সম্মতি নিয়ে সে মুহাম্মাদ (সা.)’র কাছে এসে তাঁকে বলল, হে আমার ভাতিজা, বংশ ও উচ্চ অবস্থানের দিক থেকে তুমি আমাদের সবার চেয়ে বেশি যোগ্য, কিন্তু তুমি এমন কিছু দাবি করছ যা অতীতে আমাদের জাতি ও তোমার নিজ গোত্রও কখনও করেনি। তুমি যদি অর্থ-সম্পদের প্রত্যাশী হয়ে থাক, তাহলে আমরা তোমাকে এত বেশি অর্থ-সম্পদ দেব যে তুমিই হবে আমাদের মধ্যে সবচেয়ে ধনী, যদি নেতৃত্বের প্রত্যাশী হয়ে থাক তাহলে তোমাকে শীর্ষ নেতৃত্ব দেয়া হবে এবং তোমার সাথে পরামর্শ না করে কেউ কোনো কাজ করবে না।”
বিশ্বনবী (সা.) ওতবার কথা শুনছিলেন। তিনি বললেন,” তোমার কথা কি শেষ হয়েছে? সে বলল,” হ্যা”। এ অবস্থায় মহানবী(সা.) সুরা ফুসিলাতের আয়াত তেলাওয়াত শুরু করেন এবং এক পর্যায়ে সিজদার আয়াত থাকায় সিজদায় গেলেন। সিজদায় গিয়ে তিনি মহান আল্লাহ’র প্রশংসা জ্ঞাপন করলেন। ওতবা মাথার পেছনে হাত দিয়ে অপেক্ষা করছিল। ওতবার দিকে কোনো গুরুত্ব না দিয়েই রাসূল(সা.) সিজদা থেকে উঠলেন। হতবাক ওতবা সেখান থেকে কুরাইশদের কাছে ফিরে এসে বলল, “তোমরা আমাকে যে কথা বলতে বলেছিলে তা আমি মুহাম্মদ সা. -কে বলেছি, কিন্তু সে এমন কিছু কথা উচ্চারণ করল যে, আল্লাহর শপথ, সেগুলো আমার কান কখনও শোনেনি, তাই আমি বুঝতে পারছিলাম না যে তাকে কি জবাব দেব। কুরাইশরা আমার এ কথা শোন! তোমরা এ ব্যক্তিকে তার নিজের অবস্থায় ছেড়ে দাও। কারণ, সে তার বিশ্বাস থেকে ফিরবে না। তাকে আরবদের মধ্যে একাকী থাকতে দেয়াই ভাল হবে। কারণ, সে যদি আরব গোত্রগুলোর ওপর বিজয়ী হয়, তাহলে তার মর্যাদা, সম্মান ও গৌরব বা নেতৃত্ব হবে তোমাদেরই সম্মান, গৌরব ও নেতৃত্বের শামিল। কিন্তু আরবরা যদি তার ওপর জয়ী হয় তাহলে তোমরা যেন মুহাম্মাদকে (সা.) অন্যদের হাত দিয়ে নিজেদের পথ থেকেই সরিয়ে দিলে।”
কুরাইশ নেতারা অবাক হয়ে ওতবার দিকে তাকিয়ে বলল, ” হে ওতবা! তুমিও কি মুহাম্মাদেরসা.প্রেমিক হয়ে গেলে?”
পবিত্র কোরআনের মুফাসসির সাইয়েদ কুতুব লিখেছেন, “একবার আমি ও আমার একদল বন্ধু মিশরের একটি জাহাজে চড়ে আটলান্টিক সাগর দিয়ে নিউইয়র্ক যাচ্ছিলাম। জাহাজটিতে ছিল ১২০ জন নারী ও পুরুষ। ১২০ জনের মধ্যে আমরা মাত্র ছয় জন ছিলাম মুসলমান। একজন খ্রিস্টান মিশনারী কর্মকর্তাও আমাদের সাথে ছিলেন। এ ধর্ম প্রচারের কাজে জড়িত ছিলেন তিনি এবং আমাদের কাছেও খ্রিস্ট ধর্মের দাওয়াত দেয়ার ইচ্ছে ছিল তার।শুক্রবার আমার মাথায় জুমার নামাজ আদায়ের চিন্তা আসল।
আমি সাগরের বুকে জাহাজের পাটাতনে জুমার জামায়াত আদায় করার উদ্যোগ নিলাম। নামাজ শুরু করার পর চারদিক থেকে অমুসলিম যাত্রীরা আমাদের নামাজ দেখার জন্য সবিস্ময়ে ভীড় জমায়। তাদের কেউ কেউ সন্তুষ্টিসূচক মন্তব্য করেন। তাদের মধ্যে ছিলেন ইউগোস্লাভিয়ার একজন মহিলা।” তিনি বললেন: ” আমি আপনাদের এবাদতের কথাগুলোর অর্থ না বুঝলেও এসব কথার মধ্যে এমন কিছু বাক্য শুনতে পেয়েছি যেগুলোর সুর ছিল ভিন্ন ধরণের এবং সেগুলো এত অপূর্ব ও হৃদয়-স্পর্শী ছিল যে আমার শরীর কেঁপে উঠেছে। আমার মনে হয় আপনাদের নামাজের জামায়াতের ইমাম যখন ওই বাক্যগুলো উচ্চারণ করছিলেন তখন তার পুরো সত্তা বা আপাদমস্তক খোদার প্রেমে নিমজ্জিত ছিল! “
সাইয়েদ কুতুব লিখেছেন,”ওই মহিলা আসলে নামাজে পঠিত সুরার কথাই বলেছেন, যা আমি পড়েছিলাম। কোরআন তেলাওয়াতের অশেষ আকর্ষণে ভরা ও হৃদয়-নিংড়ানো বিশেষ সুর এমনই যে ওই মহিলাকোনো একটি শব্দেরও অর্থ না বোঝা সত্ত্বেও এত ব্যাপক মাত্রায় অভিভুত ও প্রভাবিত হয়েছিলেন!”
কোরআনের ১১৪ টি সুরার মধ্যে ৮৬টি সুরা নাজেল হয়েছে মক্কায়। দীর্ঘ ১৩ বছরে নাজেল হওয়া এসব সুরা সাধারণত ছোট এবং বাক্যগুলোও ছোট ছোট । এসব সুরামুখস্ত করার জন্য বিশেষভাবে সচেষ্ট হয়েছিলেন বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) ও তাঁর সাহাবারা। বিশ্বনবী (সা.)চেয়েছিলেন, কোরআনের বাণীগুলো মুখস্ত করার পর পরই মানুষের কাছে তুলে ধরবেন যাতে মানুষ এ মহাগ্রন্থের শিক্ষাগুলোকে বাস্তবে প্রয়োগ করে। সর্বশেষ রাসূল হিসেবে মানুষকে মহান আল্লাহর বাণী বা কিতাব ও প্রজ্ঞা শেখানো ছিল বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)’র দায়িত্ব। তাই তিনি কোরআন হেফজ বা মুখস্ত করার জন্য অত্যন্ত উদগ্রীব ও সচেষ্ট থাকতেন।
অত্যন্ত কঠিন সময়েও মহান আল্লাহর প্রিয় হাবিব (সা.) কোরআনের আয়াত আবৃত্তি করতেন। ঐশী আয়াতগুলো ভালভাবে রপ্ত করার জন্য তাঁর উৎকণ্ঠার শেষ ছিল না, কারণ, কখনও কোনো আয়াতের শব্দ তিনি ভুলে যান কিনা, কিংবা ভুলক্রমে শব্দকে বদলে ফেলেন কিনা- এ আশঙ্কা তাঁকে বিচলিত করছিল। এ সময় মহান আল্লাহ তাঁকে এ নিশ্চয়তা দিলেন যে, কোরআন তাঁর স্মৃতিতে অম্লান ও অক্ষয় হয়ে থাকবে এবং আল্লাহই তা রক্ষা করবেন। তিনি তাঁর প্রিয়তম বন্ধুর জন্য কোরআনের শব্দগুলোর উচ্চারণ ও অর্থও সহজ করে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
পবিত্র কোরআনের সুরা কিয়ামতের ১৬ ও ১৭ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে: “তাড়াতাড়ি শিখে নেয়ার জন্যে আপনি দ্রুত ওহী আবৃত্তি করবেন না।এর সংরক্ষণ ও পঠন আমারই দায়িত্ব। “
বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)’র ঘনিষ্ঠ আপনজন উম্মুল মুমিনিন হযরত খাদিজা (সা.) ও আমীরুল মুমিনিন হযরত আলী (আ.)’র মত ব্যক্তিত্ব এবং আরো একদল ব্যক্তি পবিত্র কোরআনের গভীর প্রভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। ফলে তাঁরাও পবিত্র কোরআন মুখস্ত করতেন। এর ফলে মহানবী (সা.)’র সাহাবাদের মধ্যে নৈতিক ও মানবীয় নানা গুণ বিকশিত হয় এবং অল্প সময়ের মধ্যে পবিত্র কোরআনের কয়েক হাজার ক্বারী ও হাফেজ গড়ে উঠেন। সে যুগে মানুষের কাছে লেখার সামগ্রী তেমন একটা ছিল না এবং লেখকদের সংখ্যাও ছিল খুবই কম। কিন্তু তা সত্ত্বেও রাসূল (সা.) কোরআন লিপিবদ্ধ করতে উৎসাহ দিতেন। তিনি নিজে কোন কিছু লিখতে ও পড়তে জানতেন না বলে কোরআনের বাণী লেখাসহ আরো অনেক বিষয় লিপিবদ্ধ করার জন্য লেখক দরকার হত। তাই বিশ্বনবী (সা.) প্রথমে মক্কায় ও পরে মদীনায় সবচেয়ে শিক্ষিত ব্যক্তিদের লেখক হিসেবে নিযুক্ত করেছিলেন।
মক্কায় সবার আগে ওহী লিখে রাখার দায়িত্ব পেয়েছিলেন আমীরুল মুমিনিন হযরত আলী (আ.)। বিশ্বনবী (সা.)’র জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত আলী (আ.) এ দায়িত্ব অব্যাহত রেখেছিলেন। আলী (আ.) যেন নাজেল-হওয়া সব আয়াত লিখে রাখেন সে জন্য মহানবী (সা.) ব্যাপক জোর দিতেন। কোরআনের একটি শব্দও যেন অলিখিত না থাকে সে জন্যে তিনি সতর্ক করতেন।
আমীরুল মুমিনিন হযরত আলী (আ.) নিজ খেলাফতের যুগে কুফার মসজিদে সমবেত জনগণকে বলেছিলেন, “আমি জীবিত থাকতেই তোমাদের প্রশ্নগুলোর উত্তরআমার কাছ থেকে জেনে নাও। মহান আল্লাহর কোরআন সম্পর্কে তোমরা আমার কাছে প্রশ্ন কর। আল্লাহর শপথ, কোরআনের এমন কোনো আয়াত নাজেল হয়নি, যা প্রিয় নবী (সা.)আমাকে আবৃত্তি করে শোনাননি এবং ওই আয়াতের তাফসির ও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ আমাকে শেখাননি।”
এক ব্যক্তি আমীরুল মুমিনিনকে প্রশ্ন করলেন, ” আপনার অনুপস্থিতিতে যখন কোনো আয়াত নাজেল হত তখন কি হত?”আলী (আ.) বললেন, “(এমনটি ঘটলে) যখন রাসূল (সা.)’র কাছে যেতাম তিনি বলতেন, তোমার অনুপস্থিতিতে কিছু আয়াত নাজেল হয়েছে। এরপর তিনি সেসব আয়াত আবৃত্তি করে আমাকে শোনাতেন এবং সেগুলোর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ আমাকে শিখিয়ে দিতেন।”
বিশ্বনবী (সা.)’র জীবিত থাকাকালীন সময়ে কোরআন ঠিক যে ধারাক্রমে আল্লাহর পক্ষ থেকে নাজেল হয়েছিল হুবহু সেই ধারাক্রম বজায় রেখে লিপিবদ্ধ বা সংকলিত করা হত। অবশ্য আয়াতগুলো লেখা হয়েছিল পৃথক নানা মাধ্যমে। যেমন, কাগজে, হাঁড়ে, খেজুর গাছের চামড়ায় বা বাকলে। প্রত্যেক সুরা শুরু হত ” বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম” শীর্ষক আয়াত দিয়ে। এ আয়াতের অর্থ “শুরুকরছি আল্লাহর নামে যিনি পরম করুণাময়, অতি দয়ালু।”নাজেল হওয়ার ধারাক্রম অনুযায়ী আয়াতগুলো সুরার অন্তর্ভূক্ত হত। সুরাগুলোর মধ্যে আয়াত অন্তর্ভুক্ত করা হত খোদ বিশ্বনবী (সা.)’র নির্দেশে।
অবশ্য ওহী নাজেল শেষ না হওয়া পর্যন্ত সুরাগুলোর ক্রমধারা নির্ধারণ করা হয়নি। এর কারণ, বিশ্বনবী (সা.)’র জীবিত থাকাকালীন অবস্থায় যে কোনো সময়ে নতুন সুরা বা আয়াত নাজেল হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। বেশিরভাগ লেখক ও গবেষকের মতে, কোরআনের সুরাগুলোর একত্রীকরণ ও ধারাক্রম সাজানো হয়েছে মহানবী (সা.)’র ওফাতের পর সাহাবীদের মাধ্যমে। এ কাজে নিয়োজিত সাহাবীদের মধ্যে আমীরুল মুমিনিন হযরত আলী (আ.) ছিলেন সবার শীর্ষে বা নেতৃত্বে। অবশ্য কোনো কোনো সূত্রকোরআনের সুরাগুলোর একত্রীকরণ ও ধারাক্রম সাজানোর কাজে হযরত আলী (আ.)’ র অবিরাম প্রচেষ্টার কথা উল্লেখ করেননি। কিন্তু বিভিন্ন বর্ণনা অনুযায়ী কোরআনের শিক্ষা উপলব্ধির আলোকোজ্জ্বল নানা দিগন্ত খুলে দিয়েছিলেন তিনি। বিশ্বনবী (সা.)’র ওফাতের পর অন্য সব কাজের আগে কোরআনের সুরাগুলোর একত্রীকরণ, সংকলন ও তাফসির লেখার কাজেই মশগুল ছিলেন আলী (আ.) এবং৬ মাস পর তা সম্পন্ন হয়। ইবনে নাদিম লিখেছেন, সর্বপ্রথম সংকলিত সহিফা আলী(আ.)’র সহিফা। মুহাম্মাদ বিন সিইরিন আকরামা থেকে বর্ণণা করেছেন, ” প্রথম খলিফার খেলাফতের প্রথম দিকে আলী (আ.) নিজ ঘরে থাকতেন এবং তিনি কোরআণের বাণীগুলো একত্র বা সংকলন করেন।
*বি.দ্র.
*বি.দ্রপ্রথম খলিফা তার শাসনামলে পবিত্র কোরআনের পূর্ণাঙ্গ সংস্করণ প্রকাশের উদ্যোগ নেন। তিনি হাফেজদেরকে স্মৃতি থেকে ও ওহী লেখকদেরকে বিভিন্ন মাধ্যমের ওপর লেখা কোরআনের অংশগুলো একত্রিত করতে বলেন। কোরআনের বিভিন্ন অংশ একত্রিত করার কাজে হযরত জায়েদ বিন সাবেত ভূমিকা রেখেছিলেন।
তৃতীয় খলিফার শাসনামলে ব্যাপক বিস্তৃত মুসলিম বিশ্বের নানা স্থানে কোরআনের উচ্চারণে পার্থক্য দেখা দেয় এবং সে সময় কোরআনের লিখিত কপিগুলোও নানা দিক থেকে দূর্বল ছিল। ফলে ২৫ হিজরীতে কোরআনের উচ্চারণ-রীতি বা আবৃত্তি নিয়ে ক্বারী ও কোরআনের শিক্ষকদের মধ্যে মতভেদ বেড়ে যায়। কেউ কেউ অন্য এক দলের কোরআন তেলাওয়াত বা আবৃত্তিকে বিকৃত উচ্চারণ বলে ঘোষণা দেন। ফলে তৃতীয় খলিফা অভিন্ন আবৃত্তিতে কোরআন একত্রিত করার জন্য ওহী লেখকদের নিয়ে একটি কমিটি গঠন করেন। এরপর বিছিন্নভাবে লেখা কোরআনের অংশগুলো যা কখনও কাগজে, কখনও হাড়ে, গাছের বাকলে ও চামড়া ইত্যাদি মাধ্যমের ওপর লেখা ছিল- সেগুলো পুড়ে ফেলার নির্দেশ দেন যাতে মতভেদ ও দ্বন্দ্বের উৎস সমূলে বিলুপ্ত হয় এবং মুসলমানরা সবাই একই লিপি ও অভিন্ন উচ্চারণ-রীতির কোরআনের অধিকারী হয়। আল্লামা হিল্লির মতে তৃতীয় খলিফা নতুন সংকলিত এই কোরআন হযরত আলী (আ.) র মাধ্যমে স্বাক্ষরিত বা সত্যায়িত করিয়ে নিয়েছিলেন।
কোরআনের আনুষ্ঠানিক লিপি সংশোধনের কাজ শুরু হয়েছিল ৫০ হিজরীতে। হযরত আলী (আ)-এর ছাত্র আবুল আসওয়াদ দুয়েলির অনুরোধে কুফার শাসক কোরআনের লিপিতে নানা চিহ্ন তথা জের, যবর, যতি চিহ্ন প্রভৃতি যুক্ত করেন।