আল হাসানাইন (আ.)

লিও টলস্টয়ের দৃষ্টিতে শ্রেষ্ঠ ধর্ম

1 বিভিন্ন মতামত 04.0 / 5

আল হোসাইন (আ.)প্রখ্যাত রুশ সাহিত্যিক ও চিন্তাবিদ লিও টলস্টয় মারা গেছেন ১০১ বছর আগে ১৯১০ সালের ২০ নভেম্বর। "ওয়ার এন্ড পিস" বা "যুদ্ধ ও শান্তি" শীর্ষক উপন্যাস লিও টলস্টয়কে বিশ্বজোড়া খ্যাতি এনে দেয়। কিন্তু খৃস্ট ধর্মের নামে প্রচলিত নানা দিকের সমালোচনা করায় ১৯০১ সালে রাশিয়ার অর্থডক্স গীর্যা টলস্টয়কে সমাজচ্যুত বলে ঘোষণা করে এবং এখনও তার বিরুদ্ধে ওই ঘোষণা ফিরিয়ে নেয়নি। অন্যদিকে টলস্টয় ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে ভালো ধারণা পোষণ করতেন এবং এমনকি তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন বলেও শোনা যায়।
সম্প্রতি "মুহাম্মাদ রসুলাল্লাহ (সাঃ)" শীর্ষক একটি বই প্রকাশিত হয়েছে। এ বইয়ের অংশ বিশেষে লিও টলস্টয়ের অনুদিত বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ মোস্তফা (সাঃ)'র কিছু বক্তব্যের অনুবাদ স্থান পেয়েছে। এ বইয়ের ভূমিকায় জনাব ইব্রাহিমী রাদ লিখেছেন, ''' গত বছর আংকারায় তুর্কীভাষী লেখক ও কবিদের এক সমাবেশে শুনতে পাই যে টলস্টয় ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। কথাটা শুনে বিশ্বাস করতে পারিনি। তবে এ নিয়ে গবেষণা ও অনুসন্ধান চালানোর পর "টলস্টয়ের হারানো চিঠি" শীর্ষক একটি বই আমাকে দেখানো হয়।''
এ বইয়ে কয়েকটি চিঠি যুক্ত রয়েছে। এইসব চিঠি থেকে ইসলাম সম্পর্কে টলস্টয়ের দৃষ্টিভঙ্গি সুস্পষ্ট। কোনো একটি চিঠিতে একজন মা তার সন্তানের মুসলমান হয়ে যাওয়ার কথা উল্লেখ করে এ ব্যাপারে টলস্টয়ের পরামর্শ চেয়েছেন। তিন সন্তানের জননী ৫০ বছর বয়স্ক ইয়লনা ওকিলাভা টলস্টয়ের কাছে লিখেছেন, "আমার স্বামী মুসলমান। কিন্তু আমাদের সন্তান ছিল খৃস্টান। আমার কন্যার বয়স ১৩। এক পুত্রের বয়স ২৩। সে পিটার্সবার্গ টেকনোলজি ইনস্টিটিউটে পড়াশুনা করছে। আমার অন্য পুত্র ২২ বছর বয়স্ক। সে মস্কোর এলেক্সিও সামরিক কলেজে পড়াশুনা করছে। আমার ছেলেরা বাবার ধর্ম তথা ইসলাম গ্রহণ করতে চায়। তারা আমার অনুমতি চাইছে। আমি এখন কি করব? আমি জানি আমার পুত্রদের এই চিন্তা কোনো ছোটখাট কারণ বা পারিবারিক চিন্তা থেকে উৎসারিত হয়নি, অর্থ বা পদের লোভেও তাদের মধ্যে এ চিন্তার সূত্রপাত হয়নি। যেটা খুবই স্পষ্ট তা হল, ওরা ধর্মের বিষয়ে একটা পথ খুঁজে বেড়াচ্ছিল এবং এক্ষেত্রে ইসলামকে নিজ ধর্ম হিসেবে বেছে নিয়েছে ও মুসলমানদের সহযোগিতা করছে। আমি এমন একজন মা সন্তানদের প্রতি যার ভালবাসা কুলকিনারাহীন, এ মুহূর্তে আমার চোখ দু'টো অশ্রুসজল। আমি যেন ধীরে ধীরে জ্ঞান হারিয়ে ফেলছি এবং আপনার কাছে চিঠি লেখা ছাড়া আর কোনো পথ খুঁজে পাইনি। কেবল আপনিই আপনার জ্ঞান ও প্রজ্ঞা দিয়ে এ সমস্যার সমাধান দেখাতে পারেন। আমাকে কিছু সান্ব্ নার বাণী দিয়ে প্রশান্ত করুন। বিশ্বাস করুন, একমাত্র সন্তানদের ভালবাসি বলেই আমি এ চিঠি লিখলাম আপনার কাছে।"
টলস্টয় উদ্বিগ্ন ওই মায়ের চিঠির উত্তরে লিখেছেন, '' আপনার ছেলেরা ধর্মকে এমন গুরুত্ব দেয়ায় এবং মানুষকে সাহায্য করছে বলে তাদের খুবই প্রশংসা করা ও ধন্যবাদ দেয়া জরুরি। এই মানবীয় আকাঙ্ক্ষা অব্যাহত রাখার জন্য ইসলাম ধর্মের দিকে তাদের ঝুঁকে পড়া ও মুহাম্মদের ধর্মের অনুসারী হওয়া তাদের জন্য খুবই জরুরি। অবশ্য যারা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন, নিজ ধর্ম, ধর্মের বিধান ও ধর্ম সম্পর্কে জানার বিষয়গুলো অন্যদের কাছে তুলে ধরা তাদের দায়িত্ব। কিন্তু এ ব্যাপারে যেটা বলা দরকার: আপনার সন্তানরা তাদের আগের ধর্ম অর্থাৎ খৃস্ট ধর্ম ত্যাগ করেছে এবং মুসলমান হয়েছে। আর এ ব্যাপারে অন্যদের কাছে যুক্তি বা কারণগুলো তুলে ধরতে তারা বাধ্য নয় এবং তাদের এই যৌক্তিক ও ব্যক্তিগত আকাঙ্ক্ষা কেবল তাদের প্রভু ও তাদের নিজের মধ্যকার বিষয়। তাদের এই নির্বাচন সম্পর্কে মোটেই লজ্জিত হবেন না বা নিজেকে অপরাধী বলে মনে করবেন না। "
মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। নিজের জ্ঞান বা প্রতিভা খাটিয়ে সে নিজের জীবনের পথ খুঁজে নিতে সক্ষম। তাই মানুষ সবার শ্রদ্ধা পাবার দাবি রাখে। আর এ জন্যই প্রত্যেক ঐশী ধর্ম মানুষ ও তার মর্যাদাকে গুরুত্ব দিয়েছে। মানবজাতিকে নৈতিকতা ও মূল্যবোধের দিকে পরিচালিত করার ক্ষেত্রে ধর্মের ভূমিকা রয়েছে। কারণ, ধর্মগুলো নৈতিক ও আধ্যাত্মিক মূল্যবোধে সমৃদ্ধ। কিন্তু কোন ধর্মটি সবচেয়ে পূর্ণাঙ্গ ও অবিকৃত? লিও টলস্টয় তার চিঠিতে ইসলামের প্রশংসা করেছেন এবং তার মতে ইসলাম ধর্ম মানুষকে সম্মান ও মর্যাদার শীর্ষে নিতে সক্ষম ও এ ধর্মই মানুষকে সঠিক পথ দেখায়। এ প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন, "ইসলাম ধর্ম ও নবী মুহাম্মদের শিক্ষা খৃস্ট ধর্মের তুলনায় অনেক উন্নত ও মূল্যবান এবং এ ধর্মের গুণও বেশি- যারা এ মত পোষণ করেন আমি সর্বান্তকরণে তাদের সাথে একমত। যারা এ ধর্মের সেবা করছেন আমি তাদের অভিনন্দন জানাই।"
লিও টলস্টয় ওই চিঠিতে আরো লিখেছেন, "এ মুহূর্তে যে এই কথাগুলো আপনাদের উদ্দেশ্যে লিখছে সে একজন খৃস্টান। আমি বহু বছর ধরে খৃস্ট ধর্মের শিক্ষার সাথে পরিচিত, কিন্তু আমি এটা স্বীকার করছি যে, ইসলাম ধর্ম ও নবী মুহাম্মদের শিক্ষার সবগুলো বাহ্যিক বৈশিষ্ট্য খৃস্ট ধর্মের চেয়ে অনেক অনেক বেশি পূর্ণাঙ্গ ও মূল্যবান। আসলে ইসলাম ধর্মের বাহ্যিক দিকগুলোর সাথে খৃস্ট ধর্মের কোনো তুলনাই হয় না। যদি সব মানুষের জন্য ইসলাম ও খৃস্ট ধর্মের মধ্য থেকে যে কোনো একটিকে বেছে নেয়ার সুযোগ দেয়া হয় এবং ওই ধর্ম অনুযায়ী নিজ প্রভুর এবাদত বা উপাসনা করার সুযোগ থাকে, তাহলে প্রথমেই মানুষকে এটা দেখতে হবে যে, কয়েক খোদার উপাসনা একই সময়ে সম্ভব নয়। আর উপাসনা বা এবাদতের ক্ষেত্রে কয়েক খোদার উপাসনা একত্ববাদী ধর্মের পরিপন্থী। আর ইসলাম কেবল এক প্রভুর এবাদত করতে বলে, আর কারো নয়। এ কারণেই ইসলাম ধর্ম খৃস্ট ধর্মের চেয়ে উন্নত এবং সুস্থ বিবেক-বুদ্ধি সম্পন্ন যে কোনো মানুষ অন্য কোনো ধর্মের দিকে না গিয়ে অবশ্যই ইসলামকেই বেছে নেবে। "
লিও টলস্টয় ওই চিঠিতে আরো লিখেছেন, " মানব সভ্যতা তার বিকাশের জন্য ধর্মের কাছে ঋণী। মুহাম্মদ রয়েছেন ইসলাম ধর্মের শীর্ষে। তার প্রচারিত শিক্ষাগুলোর মধ্যে সব ধর্মের মূল শিক্ষাগুলো রয়েছে এবং খৃস্ট ধর্মের অনেক বাস্তবতার সমান্তরালে ও কাছে রয়েছে সেসব শিক্ষা। কারণ, প্রভু বা স্রষ্টাই হচ্ছেন ধর্মগুলোর মূল ভিত্তি। ধর্মগুলো মানুষকে খোদায় বিশ্বাসী হতে উৎসাহ দেয়। আর যেই ধর্ম এই দায়িত্ব পালনে ও এই বাণী প্রচার ভালোভাবে সম্পন্ন করে সেই ধর্ম বেশি শ্রদ্ধাভাজন হবে, আর সেই ধর্মই হল ইসলাম।"
টলস্টয় তার এসব মতামত ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছে প্রচারের অনুরোধ জানিয়েছেন। তিনি ধর্মের বাস্তবতাগুলোর প্রতি বিশ্বাস ও ধর্মের প্রতি বিশ্বাসকে মানুষের সবচেয়ে সুন্দর কাজ বলে অভিহিত করেছেন। নতুন প্রজন্ম যদি তাদের মানবীয় ও পারিবারিক দায়িত্বগুলোর মত নিজের দায়িত্বগুলো পালন করতে পারে তাহলে সমাজে শান্তি ফিরে আসবে বলে টলস্টয় মনে করেন।
বিশ্বনন্দিত রুশ চিন্তাবিদ ও সাহিত্যিক টলস্টয় ধর্মগুলোর বিচ্যুতি ও বিশেষ করে বিভ্রান্ত বাহাই মতবাদ সম্পর্কে লিখেছেন, "নতুন প্রজন্ম ধর্মগুলো ও বিশেষ করে ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে কতটা জ্ঞান রাখে তা আমি জানি না। তারা বিভিন্ন সূত্র থেকে এ সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করতে পারে, তবে এমন কিছু মতবাদ দেখা যায় যেগুলো ইসলামের নামে মানুষকে বিভ্রান্ত করছে। এসব মতবাদের মধ্যে বাহাই মতবাদ অন্যতম। ইসলামের নামে প্রথমে ইরানে এ মতবাদের সূচনা হয় এবং পরে এশিয়া মাইনরে এ মতবাদ কিছুটা জোরদার হয়েছে। বাহাইরা কাবা ঘরকে কেবলা মনে করে না, তারা বাহাউল্লাহর বাসস্থানকে কেবলা মনে করে। এদের চিন্তাভাবনা বিভ্রান্ত এবং কারো কাছেই এসব চিন্তাধারা গ্রহণযোগ্য হওয়া উচিত নয়। যদি আমার এসব মতামত অন্ততঃ ভুল চিন্তাধারাকে অগ্রাহ্য করার ক্ষেত্রে সহায়ক হয় তাহলে আমি খুশি হব।

আপনার মতামত

মন্তব্য নেই
*
*

আল হাসানাইন (আ.)