শাফায়াত

সকল ধর্মবিশ্বাসী,বিশেষত সাধারণভাবে সকল মুসলমানই শাফায়াতে বিশ্বাসী অর্থাৎ কিয়ামতের দিন আল্লাহর ওলিগণ একদল গুনাহগার বান্দার জন্য সুপারিশ ও ক্ষমা প্রার্থনা (শাফায়াত) করবেন এবং এর মাধ্যমে তাদেরকে দোযখের আগুন হতে মুক্তি দিবেন। আবার কারো কারো মতে শাফায়াতের অর্থ আল্লাহর ওলিগণ সুপারিশের মাধ্যমে ব্যক্তির মর্যাদা ও অবস্থানের উত্তরণ ঘটাবেন। কিন্তু এই সুপারিশের বৈশিষ্ট্য ও পরিমাণ নিয়ে ধর্মবিশ্বাসীদের মধ্যে মতভেদ রযেছে। যেমন ইহুদীরা তাদের ওলী ও নবীদের ক্ষেত্রে শর্তহীন সুপারিশের অধিকারে বিশ্বাসী। কোরআন এ বিশ্বাসকে সুস্পষ্টভাবে ভিত্তিহীন বলে ঘোষণা করেছে। মুসলমানদের মধ্যে ওয়াহাবীরা বিশ্বাস করে শুধু আল্লাহর নিকট শাফায়াত কামনা করা জায়েয,তিনি ব্যতীত অন্য কোন ব্যক্তির নিকট শাফায়াত কামনা করা শিরক বলে গণ্য। কিন্তু সাধারণভাবে মুসলমানরা বিশ্বাস করেন শাফায়াতের (আল্লাহর নিকট সুপারিশ ও ক্ষমা প্রার্থনা) অধিকার আল্লাহ তাঁর কোন কোন বিশেষ বান্দাকে দিয়েছেন এবং মুসলমানরা সরাসরি তাঁদের নিকট শাফায়াতের আবেদন করতে পারে। তবে এ বিশ্বাস রাখতে হবে যে,সুপারিশ গ্রহণের ও ক্ষমা করার অধিকার প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর এবং তাঁর ওলিগণ তাঁর অনুমতি সাপেক্ষে এই শাফায়াত করবেন অর্থাৎ এক্ষেত্রে তাঁরা স্বাধীন নন;বরং আল্লাহর ইচ্ছার অনুবর্তী। আমরা এখানে এ বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করব।

 

মুসলিম উম্মাহর মতৈক্য

ইসলামী উম্মাহর আলেমগণ শাফায়াতের বৈধতা এবং মহানবী (সা.) যে কিয়ামতের দিন শাফায়াতকারীদের অন্যতম এ বিষয়ে একমত,যদিও তাঁদের মধ্যে শাফায়াতের শাখাগত কোন কোন বিষয়ে কিছুটা মতভেদ রয়েছে। প্রথমে আমরা শিয়া ও সুন্নী উভয় মাজহাবের দৃষ্টিকোণ থেকে শাফায়াতের বিষয়টি আলোচনা করব।

১। আবু মনসুর মাতেরিদী (মৃত্যু ৩৩৩ হিজরী) পবিত্র কোরআনের সূরা আম্বিয়ার ২৮ নং আয়াত :

﴿وَلَا يَشْفَعُونَ إِلَّا لِمَنِ ارْتَضَى﴾

“তারা যার প্রতি তিনি (আল্লাহ) সন্তুষ্ট তার জন্য ব্যতীত অন্য কারো জন্য শাফায়াত করবে না” -এর তাফসীরে বলেছেন,এ আয়াতটি ইসলামে শাফায়াত গ্রহণযোগ্য হওয়ার বিষয়টি সমর্থন করে।

২। তাজুদ্দীন আবু বকর কালাবাজী (মৃত্যু ৩৮০ হি.) বলেছেন,‘আলেমদের মধ্যে এ বিষয়ে মতৈক্য রয়েছে যে,মহান আল্লাহ শাফায়াতের বিষয়ে যা কিছু বলেছেন এবং হাদীসসমূহে এ সম্পর্কে যা এসেছে তার সবকিছু বিশ্বাস করা ওয়াজিব।’

৩। শেখ মুফিদ (৩৩৬-৪১৩ হি.) বলেছেন,‘ইমামীয়া শিয়ারা এ বিষয়ে একমত যে,মহানবী (সা.) কিয়ামতের দিন তাঁর উম্মতের একদল গুনাহগার বান্দার জন্য শাফায়াত করবেন। তেমনি আমীরুল মুমিনীন (আ.) ও তাঁর বংশধারার পবিত্র ইমামগণ তাঁদের অনুসারীদের মধ্য হতে অনেক গুনাহগার বান্দার জন্য সুপারিশ ও ক্ষমা প্রার্থনা করবেন এবং মহান আল্লাহ তাঁদের শাফায়াতের কারণে অনেক গুনাহগার বান্দাকে জাহান্নাম হতে পরিত্রাণ দিবেন।’

৪। শেখ তূসী (৩৮৫-৪৬০ হি.) বলেছেন,‘শিয়ারা বিশ্বাস করে রাসূল (সা.),তাঁর অনেক সাহাবী,তাঁর বংশের ইমামগণ এবং মুমিন বান্দাদের অনেকেই শাফায়াত করবেন।’

৫। আবু হাফস নাসাফী (মৃত্যু ৫৩৮ হি.) বলেছেন,‘আল্লাহর নবিগণ মুসলিম উম্মাহর সৎকর্মশীল বান্দাদের কবীরা গুনাহকারীদের জন্য শাফায়াত করার অধিকার রয়েছে যা প্রমাণিত সত্য।’

৬। তাফতাজানী নাসাফীর মতের পর্যালোচনা করতে গিয়ে নির্দ্বিধায় তার মতকে সমর্থন করেছেন।

৭। কাজী আয়াজ ইবনে মূসা (জন্ম ৫৪৪ হি.) বলেছেন,‘আহলে সুন্নাত বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে শাফায়াতকে স্বীকার করে এবং পবিত্র কোরআনের আয়াতসমূহ এবং হাদীস তা ঘটবে বলে সাক্ষ্য প্রদান  ও সত্যায়ন করে।’

৮।

﴿وَاتَّقُوا يَوْمًا لَا تَجْزِي نَفْسٌ عَنْ نَفْسٍ شَيْئًا وَلَا يُقْبَلُ مِنْهَا شَفَاعَةٌ﴾

আয়াতটির তাফসীরে কাজী বাইদ্বাভী বলেছেন,‘অনেকেই এ আয়াতটিকে কবীরা গুনাহকারীদের জন্য শাফায়াতের বিপক্ষে দলিল হিসাবে উপস্থাপন করেছেন। কিন্তু আমাদের জানতে হবে যে,আয়াতটি কাফেরদের সম্পর্কিত। কারণ পবিত্র কোরআনের আয়াতসমূহ ও অসংখ্য রেওয়ায়েত রাসূলের উম্মতের জন্য শাফায়াতের বিষয়টি সত্যায়ন করেছে।’

৯। ফাততাল নিশাবুরী বলেছেন,‘মুসলমানদের মধ্যে এ বিষয়ে কোন মতৈক্য নেই যে,শাফায়াতের বিষয়টি সর্বসিদ্ধ এবং এর ফলশ্রুতিতে গুনাহগার মুমিনদের হতে শাস্তি দূরীভূত হবে।’১০

১০। ইবনে তাইমিয়া হাররানী (জন্ম ৭২৮ হি.) বলেছেন,‘মহানবীর জন্য কিয়ামতের দিন তিন ধরনের শাফায়াত রয়েছে... তৃতীয় প্রকারটি হলো জাহান্নামীদের জন্য।’১১

১১। নিজামুদ্দীন কুশচী (জন্ম ৮৭৯ হি.) বলেছেন, ﴿عَسَى أَنْ يَبْعَثَكَ رَبُّكَ مَقَامًا مَحْمُودًا﴾ আয়াতটির ২৬৬  ভিত্তিতে মুসলমানগণ শাফায়াত অবধারিত হওয়ার ঐকমত্য পোষণ করে।

১২। শারানী হানাফী বলেছেন,‘মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহী ওয়া আলিহী ওয়া সাল্লাম) কিয়ামতের দিন সর্বপ্রথম শাফায়াতকারী হবেন।’১২

১৩। আল্লামা মাজলিসী (জন্ম ১১১০ হি.) বলেছেন,‘শাফায়াতের বিষয়ে মুসলমানদের মধ্যে মতানৈক্য নেই। কারণ বিষয়টি ইসলামের অনস্বীকার্য বিষয়সমূহের অন্তর্ভুক্ত এ অর্থে যে,মহানবী (সা.) কিয়ামতের দিন তাঁর উম্মতের জন্য এমনকি পূর্ববর্তী নবিগণের উম্মতদের জন্যও শাফায়াত করবেন।’১৩

১৪। মুহাম্মাদ ইবনে আবদুল ওয়াহহাব (১১১৫-১২০৬ হি.) বলেছেন,‘রাসূল (সা.),পূর্ববর্তী নবিগণ,ফেরেশতামণ্ডলী,ওলিগণ ও নিষ্পাপ শিশুদের শাফায়াতের অধিকার রয়েছে এ বিষয়টি বর্ণিত সকল হাদীসের ভিত্তিতে প্রমাণিত সত্য।’১৪

পবিত্র কোরআনে শাফায়াত

কোরআনের শাফায়াত সম্পর্কিত আয়াতসমূহকে কয়েক ভাগে ভাগ করা যায়।

১। যে সকল আয়াত শাফায়াতকে প্রত্যাখ্যান করে :

﴿ يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَنْفِقُوا مِمَّا رَزَقْنَاكُمْ مِنْ قَبْلِ أَنْ يَأْتِيَ يَوْمٌ لَا بَيْعٌ فِيهِ وَلَا خُلَّةٌ وَلَا شَفَاعَةٌ وَالْكَافِرُونَ هُمُ الظَّالِمُونَ﴾

“হে ঈমানদারগণ! তোমাদেরকে যে জীবিকা দেয়া হয়েছে তা হতে ব্যয় কর সেদিন আসার পূর্বে যেদিন কোন ক্রয় বিক্রয়,বন্ধুত্ব ও শাফায়াত নেই এবং কাফেররা বুঝতে পারবে তারাই জুলুমকারী ছিল।” (সূরা বাকারা : ২৫৪)

কিন্তু অন্যত্র কোরআনে আল্লাহর অনুমতি ব্যতিরেকে শাফায়াতকে প্রত্যাখ্যান করেছে। সুতরাং উক্ত আয়াতটিতে যে শাফায়াত আল্লাহর অনুমতি ব্যতীত সংঘটিত হবে তাকেই অস্বীকার করা হয়েছে।

২। ইহুদীদের বিশ্বাসের শাফায়াতকে বাতিল ঘোষণা :

﴿يَا بَنِي إِسْرَائِيلَ اذْكُرُوا نِعْمَتِيَ الَّتِي أَنْعَمْتُ عَلَيْكُمْ وَأَنِّي فَضَّلْتُكُمْ عَلَى الْعَالَمِينَ ﴾﴿ وَاتَّقُوا يَوْمًا لَا تَجْزِي نَفْسٌ عَنْ نَفْسٍ شَيْئًا وَلَا يُقْبَلُ مِنْهَا شَفَاعَةٌ وَلَا يُؤْخَذُ مِنْهَا عَدْلٌ وَلَا هُمْ يُنْصَرُونَ﴾

“হে বনি ইসরাঈল (ইসরাঈলের সন্তানগণ)! তোমাদের উপর যে নিয়ামত দিয়েছি তা স্মরণ কর। এবং নিশ্চয়ই আমি তোমাদেরকে বিশ্ববাসীদের উপর প্রাধান্য দিয়েছিলাম। সেদিনকে ভয় কর (সেদিন হতে নিজেকে রক্ষা কর) যেদিন একজনকে অপরের জন্য শাস্তি দেয়া হবে না এবং কারো শাফায়াত (সুপারিশ) গ্রহণ করা হবে না। কোন বিনিময় গৃহীত হবে না এবং তারা সাহায্য প্রাপ্তও হবে না।” ১৫

এ আয়াতে কোরআন বিশেষ ধরনের শাফায়াতকে বাতিল বলে ঘোষণা করা হয়েছে অর্থাৎ ইহুদীরা যে শর্তহীন শাফায়াতে বিশ্বাসী ছিল তা এ আয়াতে প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। কারণ এ ধরনের শাফায়াতের ক্ষেত্রে অনুমতির প্রয়োজন নেই ধারণা করা হয়েছে এবং শাফায়াতকারী ও যার জন্য শাফায়াত করা হবে উভয়ের জন্যই কোন শর্ত আরোপ করা হয় নি।

৩। কাফেরদের জন্য শাফায়াতকে প্রত্যাখ্যান :

﴿وَكُنَّا نُكَذِّبُ بِيَوْمِ الدِّينِ ﴿٤٦﴾ حَتَّىٰ أَتَانَا الْيَقِينُ ﴿٤٧﴾ فَمَا تَنفَعُهُمْ شَفَاعَةُ الشَّافِعِينَ﴾

“(কাফেররা বলবে) আমরা প্রতিদান দিবসকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করতাম। এমতাবস্থায় (মৃত্যুর মাধ্যমে) কিয়ামতের বিষয়ে দৃঢ় বিশ্বাস লাভ করলাম। সেদিন শাফায়াতকারীদের শাফায়াত তাদের কোন কল্যাণ বয়ে আনবে না।” ১৬

৪। মূর্তিদের শাফায়াতের অধিকার প্রত্যাখ্যান

﴿ وَيَعْبُدُونَ مِن دُونِ اللَّـهِ مَا لَا يَضُرُّهُمْ وَلَا يَنفَعُهُمْ وَيَقُولُونَ هَـٰؤُلَاءِ شُفَعَاؤُنَا عِندَ اللَّـهِ ۚ قُلْ أَتُنَبِّئُونَ اللَّـهَ بِمَا لَا يَعْلَمُ فِي السَّمَاوَاتِ وَلَا فِي الْأَرْضِ ۚ سُبْحَانَهُ وَتَعَالَىٰ عَمَّا يُشْرِكُونَ

“তারা (মুশরিকরা) আল্লাহর পরিবর্তে এমন কিছুর উপাসনা করে যা তাদের কোন অকল্যাণ ও কল্যাণই করতে পারে ন। তারা বলে এই মূর্তিগুলো আমাদের জন্য আল্লাহর নিকট শাফায়াতকারী,তাদেরকে বল তোমরা কি আল্লাহকে এমন এমন বিষয়ে জানাতে চাও আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীতে যে বিষয়ে তিনি অবহিত নন। তোমরা যাকে তাঁর শরীক কর তিনি তা হতে পবিত্র ও ঊর্ধ্বে।” ১৭

৫। শাফায়াত কেবল আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট :

﴿قُل لِّلَّـهِ الشَّفَاعَةُ جَمِيعًا لَّهُ مُلْكُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ ثُمَّ إِلَيْهِ تُرْجَعُونَ﴾ 

“শাফায়াত আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট। তিনিই আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর অধিপতি। অতঃপর তোমরা তার দিকেই প্রত্যাবর্তন করবে।” ১৮

৬। শাফায়াত আল্লাহ ব্যতীত অন্যদের জন্য শর্তাধীন :

﴿مَا مِن شَفِيعٍ إِلَّا مِن بَعْدِ إِذْنِهِ﴾

“তাঁর অনুমতি ব্যতীত কোন শাফায়াতকারী নেই।” ১৯

﴿وَلَا تَنفَعُ الشَّفَاعَةُ عِندَهُ إِلَّا لِمَنْ أَذِنَ لَهُ﴾

“কারো জন্য তার নিকট শাফায়াত তাঁর নিকট ফলপ্রসূ হবে না সেই ব্যক্তির জন্য ব্যতীত যাকে অনুমতি দেয়া হয়েছে।” ২০

উপরিউক্ত আয়াতসমূহকে সমন্বিত করে নিম্নোক্ত ফল পাওয়া যায় : যেহেতু কর্মের ক্ষেত্রে একত্ববাদের নীতির (তাওহীদে আফআলী) ভিত্তিতে বিশ্বে সকল কর্মের প্রকৃত প্রভাবক ও কর্তা হলেন... এবং কোন কর্মই তাঁর ইচ্ছা ও অনুমতি ব্যতিরেকে সম্পন্ন হয় না সেহেতু কোন কোন আয়াতে শাফায়াতকে নিরঙ্কুশভাবে আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট ঘোষিত হয়েছে। কিন্তু এ বিষয়টির সঙ্গে যে সকল আয়াতে তাঁর অনুমতি সাপেক্ষে অন্যদের শাফায়াতের স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে কোন বৈপরীত্য নেই। কারণ তিনিই তাঁর অনুমতি সাপেক্ষে বিশেষ শর্তাধীনে অন্যদের তা করার অধিকার দিয়েছেন যেমন নবী ও তাঁর ওলীদের এমনটি দিয়েছেন।

পবিত্র কোরআনে শাফায়াত

কয়েকটি কারণে মানব জাতির জন্য শাফায়াতের অপরিহার্যতা দেখা দেয়।

১। মানব জাতির গুনাহে পতিত হওয়া : কেউ কেউ বলেন,‘কিয়ামত দিবসে মানুষের একমাত্র মুক্তির উপকরণ হলো সৎকর্ম’। যেমন পবিত্র কোরআনে এসেছে :

﴿وَأَمَّا مَنْ آمَنَ وَعَمِلَ صَالِحًا فَلَهُ جَزَاءً الْحُسْنَىٰ

“এবং যে ব্যক্তি ঈমান আনবে ও সৎকর্ম করবে তার জন্য উত্তম প্রতিদান রয়েছে।” ২১

যদিও সাফল্য,সৌভাগ্য ও প্রতিদান লাভের বিষয়টি সৎকর্মের উপর অনেকটাই নির্ভর করে,কিন্তু অন্যান্য আয়াত হতে বোঝা যায়,শুধু সৎকর্মের মাধ্যমে মুক্তি পাওয়া সম্ভব নয় যদি না মহান আল্লাহর অপরিসীম রহমত তার সঙ্গে যুক্ত না হয়। যেমন,

﴿فَلَوْلَا فَضْلُ اللَّـهِ عَلَيْكُمْ وَرَحْمَتُهُ لَكُنتُم مِّنَ الْخَاسِرِينَ﴾

“যদি আল্লাহর অনুগ্রহ ও রহমত তোমাদের উপর না থাকত,তবে অবশ্যই তোমরা ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হতে।” ২২

﴿وَلَوْ يُؤَاخِذُ اللَّـهُ النَّاسَ بِظُلْمِهِم مَّا تَرَكَ عَلَيْهَا مِن دَابَّةٍ﴾

“যদি আল্লাহ মানব জাতিকে তাদের অন্যায়ের জন্য ধরতেন তবে পৃথিবীর উপর বিচরণশীল কোন প্রাণীকেই ছাড়তেন না।” ২৩

﴿وَلَوْ يُؤَاخِذُ اللَّـهُ النَّاسَ بِمَا كَسَبُوا مَا تَرَكَ عَلَىٰ ظَهْرِهَا مِن دَابَّةٍ﴾

“যদি আল্লাহ মানুষকে তার কৃতকর্মের জন্য পাকড়াও করতেন তবে ভূপৃষ্ঠের উপর চলমান কাউকে ছেড়ে দিতেন না।”

২। আল্লাহর রহমতের ব্যাপকতা :

﴿رَبَّنَا وَسِعْتَ كُلَّ شَيْءٍ رَّحْمَةً وَعِلْمًا

অর্থাৎ “হে আমাদের পালনকর্তা!আপনার রহমত ও জ্ঞান সকল কিছুকে পরিবেষ্টন করে আছে।” ২৫

فَإِن كَذَّبُوكَ فَقُل رَّبُّكُمْ ذُو رَحْمَةٍ وَاسِعَةٍ

“যদি তারা তোমার প্রতিপালককে মিথ্যা প্রতিপন্ন করে,তবে বল তোমাদের প্রভু অসীম রহমতের অধিকারী।” ২৬

শাফায়াত আল্লাহর ওলীদের রহমতের অন্যতম দৃষ্টান্ত।

৩। মানুষের অন্যতম মৌল আকাঙ্ক্ষা হলো মুক্তি। বুদ্ধিবৃত্তিক যুক্তি ও অভিজ্ঞতার আলোকে এটি প্রমাণিত যে,মানুষের অন্যতম মৌল আকাঙ্ক্ষা হলো পৃথিবী ও আখেরাতের শাস্তি হতে মুক্তি লাভ। যেহেতু মানুষের অন্যতম অভ্যন্তরীণ মৌল দিক এটি,সেহেতু মৃত্যুর পর বারজাখ (কবরের জীবন) হতে শুরু করে কিয়ামতের দিবস ও জাহান্নামে (সীমিত সময়ের জন্য) শাস্তি দানের মাধ্যমে তাকে পবিত্র করে তার সত্তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্যই শাফায়াত।

শাফায়াতের প্রভাব

শাফায়াতের প্রভাব ও ফলাফল সম্পর্কে দু’টি দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে

(১) শাফায়াত গুনাহকে মুছে দেয় ও শাস্তিকে লাঘব করে;(২) শাফায়াতের মাধ্যমে পুণ্য বৃদ্ধি পায় ও মর্যাদার উত্তরণ ঘটে। অধিকাংশ মুসলমান প্রথম অর্থে শাফায়াত গ্রহণ করেন। কিন্তু মুতাজিলাগণ দ্বিতীয় অর্থকে স্বীকার করে ও প্রথম অর্থকে গ্রহণযোগ্য মনে করে না। আমাদের মতে প্রথম অর্থ অধিকতর উপযুক্ত। এ যুক্তিতে :

১। শাফায়াতের বিষয়টি ইসলাম পূর্ব ইহুদী ও মুশরিকদের বিশ্বাসের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ইসলাম শাফায়াতের বিষয়ে তাদের মধ্যে প্রচলিত কসংস্কার মূলক বিশ্বাসসমূহকে পরিশুদ্ধ করে সঠিক ধারণাটি ইসলামী সমাজে উপস্থাপন করেন। ইসলাম পূর্ব ইহুদী ও মুশরিকদের শাফায়াত সম্পর্কিত বিশ্বাসের বিষয়ে যাদের ধারণা রয়েছে তারা জানেন যে,তারা যে ধরনের শাফায়াতে বিশ্বাসী ছিল এবং তাদের নবীদের ও পূর্ব পুরুষদের অধিকার বলে জানত,তা তাদের গুনাহসমূহের ক্ষমার জন্যই ছিল। কিন্তু তাদের এ বিশ্বাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে সমস্যা ছিল তা হলো তারা শাফায়াতের অধিকারকে শর্তহীন মনে করত। তাই ইসলাম শাফায়াতের প্রতি বিশ্বাসকে আল্লাহর অনুমতির শর্তাধীন বলে ঘোষণা করে বলে:

﴿مَن ذَا الَّذِي يَشْفَعُ عِندَهُ إِلَّا بِإِذْنِهِ﴾

“কে আছে এমন যে সুপারিশ (শাফায়াত) করবে তাঁর নিকট তাঁর অনুমতি ছাড়া”২৭  এবং

﴿وَلَا يَشْفَعُونَ إِلَّا لِمَنِ ارْتَضَىٰ

“যার প্রতি তিনি সন্তুষ্ট তার জন্য ব্যতীত অন্য কারো জন্য শাফায়াতকারীরা শাফায়াত করতে পারে না।” (সূরা আম্বিয়া : ২৮)

২। শিয়া ও সুন্নী উভয়সূত্রে বর্ণিত হাদীসসমূহ শাফায়াতের সর্বজনীনতার প্রতিই ইঙ্গিত করে,যেমন মহানবী (সা.) বলেছেন :

اذّخرتُ شفاعتی لأهل الکبائر من امّتی

‘আমার সুপারিশকে আমার উম্মতের কবীরা গুনাহকারীদের জন্য সঞ্চিত রেখেছি।’২৮

৩। কোন কোন আয়াতের ইশারা হতে বোঝা যায় আল্লাহ কোন কোন ক্ষেত্রে তওবা ও ক্ষমা প্রার্থনা ব্যতীতই গুনাহকে ক্ষমা করেন। এই সকল আয়াত গুনাহ মোচনের সাথেই অধিক সংগতিশীল। যেমন আল্লাহ বলেছেন :

﴿وَهُوَ الَّذِي يَقْبَلُ التَّوْبَةَ عَنْ عِبَادِهِ وَيَعْفُو عَنِ السَّيِّئَاتِ﴾

 “তিনি আল্লাহ বান্দাদের তওবাকে গ্রহণ করেন ও গুনাহসমূহকে ক্ষমা করেন।”

শাফায়াতকারীদের হতে শাফায়াতের আবেদন

আমরা পূর্বে উল্লেখ করেছি অনেক গুনাহকারীকে আল্লাহ শাফায়াতের মাধ্যমে ক্ষমা করেন। পবিত্র কোরআন শাফায়াতের বিষয়টি নির্দ্বিধায় স্বীকার করে নিয়ে তা আল্লাহর অনুমতি সাপেক্ষে হবে বলে ঘোষণা করেছে।

﴿مَن ذَا الَّذِي يَشْفَعُ عِندَهُ إِلَّا بِإِذْنِهِ﴾

 “কে আছে তাঁর অনুমতি ব্যতীত তাঁর কাছে সুপারিশ করতে পারে।” ৩০

অন্যত্র বলেছেন :

﴿مَا مِن شَفِيعٍ إِلَّا مِن بَعْدِ إِذْنِهِ

“কোন সুপারিশকারীই তাঁর অনুমতির পূর্বে সুপারিশ করতে পারে না।” ৩১

অন্যদিকে শাফায়াতের বিষয়ে মূর্তিপূজকদের বিশ্বাসকে এ কারণে বাতিল বলে ঘোষণা করেছে যে,তারা এমন বস্তুকে সুপারিশকারী বলে গ্রহণ করেছে যার কল্যাণ ও অকল্যাণের ক্ষমতা নেই ও আল্লাহর পক্ষ হতে সুপারিশের কোন অধিকারও নেই। তাই বলা হয়েছে :

﴿ وَيَعْبُدُونَ مِن دُونِ اللَّـهِ مَا لَا يَضُرُّهُمْ وَلَا يَنفَعُهُمْ وَيَقُولُونَ هَـٰؤُلَاءِ شُفَعَاؤُنَا عِندَ اللَّـهِ ۚ قُلْ أَتُنَبِّئُونَ اللَّـهَ بِمَا لَا يَعْلَمُ فِي السَّمَاوَاتِ وَلَا فِي الْأَرْضِ ۚ سُبْحَانَهُ وَتَعَالَىٰ عَمَّا يُشْرِكُونَ﴾

“(এই অজ্ঞ ব্যক্তিরা) আল্লাহর পরিবর্তে এমন কিছুর উপাসনা করে যা তাদের কোন অকল্যাণ ও কল্যাণই করতে পারে না এবং তারা বলে এই মূর্তিগুলো আল্লাহর নিকট আমাদের জন্য সুপারিশকারী। বলুন,(হে নবী!) তোমরা কি আল্লাহকে এমন এমন বিষয়ে খবর দিতে চাও আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীতে যে বিষয়ে তিনি অবহিত নন। তোমরা তাঁর সঙ্গে যাকে শরীক কর তিনি তা হতে পবিত্র ও ঊর্ধ্বে।” ৩২

সুতরাং যে আয়াতটি মুশরিকদের মূর্তিকে সুপারিশকারী হিসেবে গ্রহণকে প্রত্যাখ্যান করেছে তাকে শাফায়াতকে সম্পূর্ণরূপে অস্বীকারের পক্ষে দলিল হিসাবে উপস্থাপন সুস্পষ্ট অপযুক্তি। কারণ ইসলামে সুপারিশকারীর উপাস্য হওয়া ও শর্তহীন সুপারিশের বিষয়গুলো আদৌ নেই। পবিত্র কোরআন ফেরেশতা মণ্ডলীকে সুপারিশকারী হিসেবে ঘোষণা করে বলেছে,তারা যার প্রতি আল্লাহর সন্তুষ্টি রয়েছে তার জন্য ব্যতীত সুপারিশ করে না।

﴿بَلْ عِبَادٌ مُّكْرَمُونَ ﴿٢٦﴾ لَا يَسْبِقُونَهُ بِالْقَوْلِ وَهُم بِأَمْرِهِ يَعْمَلُونَ ﴿٢٧﴾ يَعْلَمُ مَا بَيْنَ أَيْدِيهِمْ وَمَا خَلْفَهُمْ وَلَا يَشْفَعُونَ إِلَّا لِمَنِ ارْتَضَىٰ﴾

“বরং তারা আল্লাহর সম্মানিত বান্দা,তারা কখনোই আল্লাহর নির্দেশের অগ্রগামী হয় না এবং তাঁর নির্দেশেই কাজ করে। তিনি (আল্লাহ) তাদের অগ্র ও পশ্চাতে যা আছে সে সম্পর্কে অবহিত। তারা তাদের জন্যই শাফায়াত করে যাদের প্রতি তিনি সন্তুষ্ট।” ৩৩

সুতরাং মহানবী (সা.) ও অন্যান্যদের জন্য কিয়ামতের দিন শাফায়াতের বিষয়টি স্বীকৃত অর্থাৎ তাঁদের সুপারিশের অধিকার রয়েছে তখন মুমিনদের জন্য তাঁদের নিকট সুপারিশ কামনা বৈধ ও জায়েয হবে,যেমন দোয়ার ক্ষেত্রেও রয়েছে।

শাফায়াতকারীদের নিকট শাফায়াতের বিষয়ে ওয়াহাবীদের মত

ওয়াহাবিগণ যদিও শাফায়াতের বিষয়টিকে অস্বীকার করেন না,কিন্তু শাফায়াতের বিধান ও বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে তাদের বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। এ দৃষ্টিভঙ্গির কারণে তারা অন্যান্য মুসলমানদের শাফায়াত সম্পর্কিত বিশ্বাসকে শিরকমিশ্রিত মনে করে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টি এ ক্ষেত্রে উল্লেখ্য তা হলো শাফায়াতকারীদের নিকট শাফায়াত কামনা করা সম্পর্কিত। মুসলমানদের সকল মাজহাবের নিকট শাফায়াতের অধিকারপ্রাপ্ত ব্যক্তির কাছে শাফায়াত কামনা তাঁর জীবিত ও মৃত উভয় অবস্থায় জায়েয। কিন্তু ওয়াহাবীদের মতে এরূপ বিশ্বাস শিরকের শামিল। তারা বিশ্বাস করে শাফায়াত কামনার সঠিক পন্থা হলো বান্দা সরাসরি আল্লাহর নিকট চাইবে তাঁর রাসূল (সা.) অথবা শাফায়াতের অধিকারী বান্দা যেন তার জন্য সুপারিশ করে।

ইবনে তাইমিয়া বলেছেন,‘যদি কেউ বলে যে,যেহেতু রাসূল (সা.) আল্লাহর নৈকট্যপ্রাপ্ত সেহেতু আমি তাঁর নিকট চাই তিনি যেন এ বিষয়ে আল্লাহর নিকট সুপারিশ করেন’,তবে তার কাজটি মুশরিকদের অনুরূপ বলে গণ্য হবে।’৩৪

মুহাম্মদ ইবনে আবদুল ওয়াহাব বলেছেন,‘একমাত্র আল্লাহর নিকট শাফায়াত চাইতে হবে,কোন শাফায়াতকারীর নিকট নয়। অর্থাৎ এভাবে বলতে হবে যে,হে আল্লাহ! রাসূল (সা.)-কে কিয়ামতের দিন আমার জন্য শাফায়াতকারী করুন।’৩৫

ওয়াহাবীদের যুক্তিসমূহ

ওয়াহাবীরা তাদের দাবীর সপক্ষে নিম্নোক্ত প্রমাণসমূহ উপস্থাপন করেছে :

১। শাফায়াতের জন্য কোন শাফায়াতকারীকে আহ্বান করা আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে ডাকার শামিল এবং এটি ইবাদতের ক্ষেত্রে শিরক বলে পরিগণিত। কারণ মহান আল্লাহ বলেছেন :

﴿فَلَا تَدْعُوا مَعَ اللَّـهِ أَحَدًا﴾

“তোমরা আল্লাহর সাথে অন্য কিছুকে আহ্বান করো না।” (সূরা জ্বিন:১৮)

আল্লাহ ভিন্ন অন্য কিছুকে ডাকা সার্বিকভাবে হারাম নয় এবং তার অবধারিত পরিণতি শিরকে পতিত হওয়া নয়। কারণ যদি কোন ব্যক্তির জন্য কোন কাজ করা বৈধ ও শরীয়তসম্মত হয়,তবে তার নিকট ঐ কাজ করার আহ্বান জানানোও বৈধ ও জায়েয হবে। যদি মহানবী (সা.) ও আল্লাহর অন্যান্য ওলীদের কিয়ামতের দিন শাফায়াতের অধিকার থাকে,তবে তাঁদের নিকট শাফায়াত করার আবেদন জানানোও শরীয়তসম্মত হবে। প্রকৃতপক্ষে শাফায়াত হলো শাফায়াতের যোগ্য ব্যক্তির জন্য শাফায়াতের অধিকারী ব্যক্তির দোয়া ও আল্লাহর নিকট তার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা। সুতরাং যেমনভাবে প্রত্যেক মুমিনই তার যে কোন মুমিন ভাইয়ের নিকট দোয়া চাইতে পারে-যা ওয়াহাবীরাও বিশ্বাস করে-তেমনি আল্লাহ ব্যতীত অন্য কোন (দোয়া করার ও শাফায়াতের অধিকারী) ব্যক্তির নিকট শাফায়াত কামনা করাও জায়েয। তবে শাফায়াত ও কামনা ঐ সকল ব্যক্তির নিকট করতে হবে যাঁদের আল্লাহর পক্ষ থেকে শাফায়াত করার অধিকার রয়েছে,যেমন নবী,ফেরেশতা,ওলী ও পুণ্যবান ব্যক্তিবর্গ।

তিরমিযী আনাস ইবনে মালিক থেকে বর্ণনা করেছেন যে,তিনি রাসূল (সা.)-এর নিকট কিয়ামতের দিন শাফায়াতের আহ্বান জানান।৩৬

হযরত ইয়াকুব (আ.)-এর সন্তানরা তাদের পিতার নিকট তাদের গুনাহের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেন,

﴿يَا أَبَانَا اسْتَغْفِرْلَنَا ذُنُوبَنَا إِنَّا كُنَّا خَاطِئِينَ﴾

“(তারা বলল) হে আমাদের পিতা! আমাদের জন্য (আল্লাহর নিকট) ক্ষমা প্রার্থনা করুন। নিশ্চয়ই আমরা ভুল করেছি।” ৩৭

অন্যত্র আল্লাহ তাঁর বান্দাদেরকে আহ্বান জানিয়েছেন তাদের গুনাহসমূহের ক্ষমার জন্য মহানবীর শরণাপন্ন হতে,যাতে তিনি তাদের জন্য ক্ষমা চান,

﴿وَلَوْ أَنَّهُمْ إِذ ظَّلَمُوا أَنفُسَهُمْ جَاءُوكَ فَاسْتَغْفَرُوا اللَّـهَ وَاسْتَغْفَرَلَهُمُ الرَّسُولُ لَوَجَدُوا اللَّـهَ تَوَّابًا رَّحِيمًا﴾

“যদি তারা নিজেদের উপর জুলুম করার পর আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনার জন্য তোমার নিকট আসত এবং রাসূলও তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করতেন তবে অবশ্যই তারা আল্লাহকে ক্ষমাকারী ও দয়ালু হিসেবে পেত।”  ৩৮

যদি ওয়াহাবীরা আল্লাহর রাসূলের নিকট চাওয়াকে তাঁর মৃত্যুর পর শিরক মনে করে,তবে আমরা বলব,যেহেতু তাদের মতে আল্লাহ ভিন্ন কাউকে আহ্বান করা সর্বতোভাবে হারাম ও শিরক,সেহেতু তাঁর জীবদ্দশায়ও তা হারাম ও শিরক হওয়া বাঞ্ছনীয়। অন্যদিকে প্রমাণিত সত্য যে,রাসূলের দৈহিক মৃত্যু হয়েছে,কিন্তু তাঁর আত্মা জীবিত এবং দোয়া,শাফায়াত কামনা প্রভৃতি সকল কিছু শ্রবণ রুহ ও আত্মার সাথে সম্পর্কিত,দেহের সাথে নয়।

২। কোরআনের সাক্ষ্য অনুযায়ী মহান আল্লাহ রাসূলের সময়সাময়িক যুগের মূর্তিপূজকদের এ কারণে মুশরিক বলেছে যে,তারা খোদা ভিন্ন অন্য কিছুর শাফায়াত কামনা করত।

﴿وَيَعْبُدُونَ مِن دُونِ اللَّـهِ مَا لَا يَضُرُّهُمْ وَلَا يَنفَعُهُمْ وَيَقُولُونَ هَـٰؤُلَاءِ شُفَعَاؤُنَا عِندَ اللَّـهِ﴾

“তারা আল্লাহ ভিন্ন অন্য কিছুর উপাসনা করত যা তাদের কোন অকল্যাণ ও কল্যাণ করার ক্ষমতা রাখে না এবং বলত এগুলোই আল্লাহর নিকট আমাদের জন্য সুপারিশকারী।” ৩৯

 

 

 

আমাদের জবাব

রাসূলের যুগের মুশরিকগণ তাদের উপাস্য মূর্তিগুলোকে তাদের শাফায়াতকারী মনে করত এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু আয়াতটিতে এটিও বলা হয়েছে যে,তারা ঐ মূর্তিগুলোর উপাসনা করত। যেহেতু তারা তাদের ইবাদত করত ও একই সাথে তাদেরকে শাফায়াতকারী মনে করত সেহেতু আল্লাহ তাদের তীব্র ভর্ৎসনা করেছেন।

উপরন্তু তারা এমন কিছুর জন্য শর্তহীন সুপারিশের অধিকারে বিশ্বাসী ছিল যে,যাদের সুপারিশের কোন অধিকারই আল্লাহ দেন নি। এ বিষয়গুলোই তাদের শাফায়াতের বিশ্বাসকে শিরকমিশ্রিত করেছে। কিন্তু যদি কেউ এমন কোন ব্যক্তির জন্য শাফায়াতের অধিকার রয়েছে বলে বিশ্বাস করে যাঁকে স্বয়ং আল্লাহ এমন অধিকার দিয়েছেন এবং এ শাফায়াত তিনি আল্লাহর অনুমতি সাপেক্ষেই করেন বলে জানে,পরিশেষে এ শাফায়াতের বিশ্বাস শাফায়াতকারীর উপাস্য হওয়াতে পর্যবসিত হয় না,তবে তা কোন অবস্থাতেই হারাম হতে পারে না। অর্থাৎ যদি কেউ শাফায়াতকারীকে উপাস্য মনে না করে এবং এর অধিকারী আল্লাহর অনুমতিপ্রাপ্তদের মধ্য হতে হয় তবে তা হারাম হবে না।

৩। পবিত্র কোরআনে শাফায়াতকে আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট বলেছে :

﴿قُل لِّلَّـهِ الشَّفَاعَةُ جَمِيعًا﴾

“বলুন সকল সুপারিশ আল্লাহর জন্যই নির্দিষ্ট।” (সূরা যুমার:১৮)

উল্লিখিত আয়াত হতে বোঝা যায় শাফায়াত শুধু আল্লাহর নিকট চাইতে হবে।

আমাদের জবাব

শাফায়াত যেহেতু মানুষের ভাগ্যের উপর প্রভাবশীল একটি বিষয় এবং মহান আল্লাহর প্রতিপালক গুণের একটি প্রকাশ সেহেতু সত্তা ও উৎপত্তিগত দৃষ্টিতে তা আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট। কিন্তু এ বিষয়টি তাঁর নবিগণ ও সৎকর্মশীল বান্দাদের শাফায়াতের অধিকারের সঙ্গে অসংগতিশীল নয়। কারণ তাঁরা স্বাধীনভাবে শাফায়াতের অধিকার রাখেন না,বরং আল্লাহর ইচ্ছার অধীনে ও অনুমতি সাপেক্ষে শাফায়াত করেন। এ বিষয়টি পবিত্র কোরআনে সুস্পষ্টভাবে ইঙ্গিত করেছে

 ﴿مَن ذَا الَّذِي يَشْفَعُ عِندَهُ إِلَّا بِإِذْنِهِ﴾

“কে তাঁর অনুমতি ব্যতিরেকে তাঁর নিকট সুপারিশ করতে পারে।” এবং

﴿مَا مِن شَفِيعٍ إِلَّا مِن بَعْدِ إِذْنِهِ

“তাঁর অনুমতি ব্যতীত কোন শাফায়াতকারী থাকবে না।” অর্থাৎ তাঁর অনুমতির পরই কেউ শাফায়াত করতে পারবে।

৪। যদিও শাফায়াত কামনা দোয়ার শামিল,কিন্তু মৃত ব্যক্তির নিকট তা কামনা করা বৃথা। কারণ মৃত ব্যক্তি কবরে কিছু শোনে না,কারণ তার জীবন নেই।

উত্তর : আমরা ‘মৃত্যু পরবর্তী কবরের জীবনে’র আলোচনায় এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছি এবং প্রমাণ করেছি কবরে মানুষের জীবন রয়েছে। ‘মৃতরা শুনতে পায় না’- এ সম্পর্কিত ওয়াহাবীদের উপস্থাপিত আয়াতসমূহের সঠিক ব্যাখ্যাও আমরা উপস্থাপন করেছি।

 

শাফায়াত প্রত্যাখ্যানকারীদের যুক্তিসমূহের পর্যালোচনা

১। শাফায়াত গুনাহর প্রতি উদ্দীপনা সৃষ্টি করে,কারো কারো মতে শাফায়াতের প্রতি বিশ্বাস গুনাহ করার সাহস যোগায় এবং অন্যায়কারীদের ঔদ্ধত্যকে বাড়িয়ে দেয়। তাই তা ইসলামী শরীয়তের প্রাণের সাথে সংগতিশীল নয়।

পর্যালোচনা

প্রথমত যদি এমনটিই হয়ে থাকে,তবে ‘তওবা করার সুযোগ দান ও ক্ষমার সুসংবাদও মানুষকে গুনাহ করতে উদ্বুদ্ধ করার কথা ও গুনাহের উদ্দীপক বলে গণ্য হবে। অথচ তওবা হলো ইসলামের অন্যতম মৌলিক বিশ্বাসের অন্তর্ভুক্ত এবং সকল মুসলমান এ বিষয়ে একমত।

দ্বিতীয়ত প্রতিশ্রুত শাফায়াতের বিষয়টি তখনই মানুষের মধ্যে ঔদ্ধত্য সৃষ্টি করবে যখন সকল ধরনের অপরাধী ও যে কোন চরম মন্দ কোন বৈশিষ্ট্যের ও যে কোন ধরনের শাস্তিও উপযুক্ত তার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হবে. কিন্তু যখন শাফায়াতের বৈশিষ্ট্যটি অনির্দিষ্ট হবে কোন ধরনের অপরাধী ও কোন কোন গুনাহের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য,কিয়ামতের দিন কোন সময় (যেহেতু কিয়ামতের প্রতি দিন পৃথিবীর ৫০০০০ বছরের সমান) গৃহীত হবে তা কারো জানা নেই এবং কেউই জানে না তার ভাগ্যে ঐ শাফায়াত জুটবে কি না,তাই শাফায়াতের বিষয়টি গুনাহের প্রতি উৎসাহিত করার সুযোগ নেই।

তৃতীয়ত পবিত্র কোরআনের আয়াতসমূহ এবং নিষ্পাপ রাসূল (সা.) ও ইমামদের বাণীসমূহ নিয়ে একটু চিন্তা করলেই বোঝা যায় শাফায়াতের জন্য আল্লাহ বিশেষ শর্ত ও বৈশিষ্ট্যের নীতি গ্রহণ করেছেন। আল্লাহ বলেন :

 ﴿يَوْمَئِذٍ لَّا تَنفَعُ الشَّفَاعَةُ إِلَّا مَنْ أَذِنَ لَهُ الرَّحْمَـٰنُ وَرَضِيَ لَهُ قَوْلًا﴾

 “সেদিন (কিয়ামতের দিন) কারো সুপারিশই ফল বয়ে আনবে না তার সুপারিশ ব্যতীত যাকে পরম করুণাময় অনুমতি দান করবেন এবং তার কথায় সন্তুষ্ট হবেন। ৪০

অন্যত্র বলেছেন,

﴿مَا لِلظَّالِمِينَ مِنْ حَمِيمٍ وَلَا شَفِيعٍ يُطَاعُ

“অর্থাৎ জুলুমকারীদের কোন বন্ধু ও সুপারিশকারী নেই যার সুপারিশ গ্রাহ্য হতে পারে।” ৪১

ইমাম সাদিক (আ.) হতে বর্ণিত হয়েছে,তিনি বলেছেন,

إنَّ شفاعتنا لن تنالُ مستخفاً بالصلاة

‘আমাদের শাফায়াত নামাজের ক্ষেত্রে শিথিলতা প্রদর্শনকারীদের জন্য হবে না।’৪২

সুতরাং সুস্পষ্ট যে এ সকল শর্ত কাউকে গুনাহ করতে উৎসাহিত করতে পারে না। বরং মানুষকে আল্লাহর আনুগত্য অর্জনে প্রচেষ্টা চালাতে উদ্বুদ্ধ করে যাতে করে নবী (সা.) ও আল্লাহর ওলীদের শাফায়াতের উপযুক্ত হতে পারে।

চতুর্থত শাফায়াতের প্রতিশ্রুতি মানুষকে গুনাহ করতে উৎসাহিত তো করেই না,বরং গুনাহকারীকে ভবিষ্যতের ক্ষেত্রে আশাবাদী করে এভাবে যে,তার মধ্যে বিশ্বাস জন্মায় সে নিজের ভাগ্যকে পরিবর্তন করতে পারবে। কারণ তার অতীতের মন্দকর্ম তার ভাগ্যের উপর অবিচ্ছেদ্য কালো পর্দা টেনে দেয় নি,তাই সে আল্লাহর ওলীদের সাহায্য নিয়ে এবং আল্লাহর পথে চলার দৃঢ় প্রত্যয় গ্রহণ করে নিজের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটিয়ে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ রচনা করতে পারবে এমন বিশ্বাস করে। সুতরাং শাফায়াত তাদের মধ্যে এ আশা জাগরুক রাখে যে,আল্লাহর ওলীদের দোয়ার বরকতে ক্ষমা লাভের মাধ্যমে আল্লাহর অনুগ্রহের ছায়ায় আশ্রয় গ্রহণের সুযোগ তাদের রয়েছে।

২। শাফায়াত পক্ষপাতিত্বমূলক মধ্যস্থতা গ্রহণের শামিল।

বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনা

কারো কারো মতে শাফায়াত হলো এক প্রকার পক্ষপাতিত্ব এবং এ লক্ষ্যে একদল মধ্যস্থতাকারীর শরণাপন্ন হওয়া। ফলে একদল ব্যক্তির অধিকার ক্ষুণ হয় এবং এর মাধ্যমে আইনকে কলুষিত করা হয়। কিন্তু বস্তুত শাফায়াত আল্লাহর ওলীদের হতে ঐ সকল গুনাহগারের জন্য বিশেষ সাহায্য যারা আল্লাহ ও তাঁর ওলীদের সঙ্গে সর্ম্পকচ্ছেদ করে নি। প্রকৃত শাফায়াত তাদের ভাগ্যেই জুটবে যাদের হৃদয়ে ও মানসে পবিত্রতা ও পূর্ণতার প্রতি ঝোঁক রয়েছে। কিন্তু যাদের কোনরূপ ইতিবাচক বৈশিষ্ট্য নেই তাদের অন্ধকার হৃদয়ে শাফায়াতকারীদের ঐশী আলো প্রতিফলিত হবে না ও তাদের হৃদয় আলোকিতও হবে না।

সুতরাং সাধারণ মানুষদের মাঝে সুপারিশের নামে প্রচলিত পক্ষপাতিত্বের সাথে ইসলামের শাফায়াতের ব্যাপক পার্থক্য রয়েছে। যেমন,

১) পৃথিবীতে প্রচলিত সুপারিশের ক্ষেত্রে অপরাধী ব্যক্তি নিজে সুপারিশকারীকে মনোনিত করে কোন বিশেষ বিভাগের প্রধানের কাছে সুপারিশ করবে। যেহেতু সুপারিশকারীর ঐ প্রতিষ্ঠানে বিশেষ প্রভাব রয়েছে,সেহেতু সে যেন সেই প্রভাবকে কাজে লাগিয়ে তার অপরাধ ক্ষমা করিয়ে দেয় এবং তার উপর প্রযোজ্য আইনের বিধানকে নিষ্ক্রিয় করে দেয়ার লক্ষ্যে সে এ পদক্ষেপ নেয়। কিন্তু ইসলামী শরীয়তে শাফায়াতের মূল চাবিকাঠি ও ক্ষমতা আল্লাহর হাতে ন্যস্ত এবং তিনিই শাফায়াতকারীকে মনোনীত করেন। মহান আল্লাহ পূর্ণতা ও মর্যাদার বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে শাফায়াতকারীকে শাফায়াতের অধিকার দেন এবং মনোনীত শাফায়াতকারীর মাধ্যমে নিজের রহমত ও ক্ষমাকে বান্দাদের মধ্যে বণ্টন করেন।

২) ইসলামের শাফায়াতের ক্ষেত্রে শাফায়াতকারী প্রভু বা পালনকর্তা হতে এই অধিকার লাভ করেন। কিন্তু পৃথিবীতে প্রচলিত সুপারিশের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ ক্ষমতা সুপারিশকারীর হাতে ন্যস্ত এবং সে আইনের বিরুদ্ধে তার ইচ্ছামত অন্যায় সুপারিশ করে। সে তার প্রভাবকে কাজে লাগিয়ে বিচারককে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে অন্যায় বিচারে বাধ্য করে। কিন্তু ঐশী সুপারিশে মহান আল্লাহর জ্ঞান ও ইচ্ছার বিপরীতে কিছুই ঘটে না,শুধু কাঙ্ক্ষিত বিষয়টির পরিবর্তন সাধিত হয়।

৩) পৃথিবীতে প্রচলিত সুপারিশসমূহ মূলত আইনের ক্ষেত্রে বৈষম্যতে পর্যবসিত হয়। এটি এভাবে ঘটে যে,সুপারিশকারী আইন প্রণয়নকারী অথবা আইন বাস্ত-বায়নকারীর উপর প্রভাব বিস্তার করে,ফলে আইনের প্রয়োগ শুধু দুর্বল ও ক্ষমতাহীনদের উপর কার্যকর হয়। এর বিপরীতে ঐশী শাফায়াত কিয়ামতের দিন কোন ব্যক্তিই আল্লাহর উপর প্রভাব সৃষ্টি করতে সক্ষম হবে না এবং কোন অবস্থাতেই আইনের বাস্তবায়নে বাধা সৃষ্টি করতে পারবে না। তাই শাফায়াত হলো আল্লাহর অসীম রহমত ও ক্ষমার উপযুক্ত ব্যক্তিকে পবিত্রকরণের প্রক্রিয়া। এ কারণেই একদল লোক কিয়ামতের দিন শাফায়াত হতে বঞ্চিত থাকবে,কারণ তারা এতটা পাপিষ্ঠ যে,আল্লাহর অসীম রহমতেরও অন্তর্ভুক্ত হওয়ার যোগ্য নয়। প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর নীতিতে কোন বৈষম্য নেই।

৪) শাফায়াত লাভকারী ব্যক্তিকে বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হতে হবে। যেমন :

ক) আল্লাহ তার প্রতি সন্তুষ্ট থাকবেন এবং সেও আল্লাহর শাস্তির ভয়ে ভীত থাকবে

﴿وَلَا يَشْفَعُونَ إِلَّا لِمَنِ ارْتَضَىٰ وَهُم مِّنْ خَشْيَتِهِ مُشْفِقُونَ﴾

 “তারা (ফেরেশতারা) আল্লাহর সন্তুষ্টি প্রাপ্তদের ব্যতীত অন্যদের জন্য সুপারিশ করবে না এবং তারা তাঁর শাস্তি-র ভয়ে ভীত।” ৪৩

খ) আল্লাহর সঙ্গে কৃত প্রতিশ্রুতি রক্ষাকারী হওয়া,যেমন তাঁর প্রতি ঈমান আনা ও তাঁর একত্বে বিশ্বাসী হওয়া। তাঁর প্রেরিত নবীকে সত্যায়ন করা,নবীর স্থলাভিষিক্ত ইমামদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ না করা এবং সৎকর্মশীল হওয়া। আল্লাহ বলেছেন :

﴿لَّا يَمْلِكُونَ الشَّفَاعَةَ إِلَّا مَنِ اتَّخَذَ عِندَ الرَّحْمَـٰنِ عَهْدًا﴾

অর্থাৎ “যে করুণাময় আল্লাহর কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করেছেন,সে ব্যতীত আর কেউ শাফায়াতের অধিকারী হবে না। (সূরা মারিয়াম : ৮৭)

গ) পাপিষ্ঠ ও অত্যাচারী হওয়া যাবে না :

﴿مَا لِلظَّالِمِينَ مِنْ حَمِيمٍ وَلَا شَفِيعٍ يُطَاعُ

 “জুলুমকারীদের কোন বন্ধু ও সুপারিশকারী নেই যার কথা শ্রবণ করা হবে।”

ঘ) নামাজের ক্ষেত্রে শিথিলতা করবে না :

إنَّ شفاعتنا لا تنال مستخفاً بالصلوة

‘নিশ্চয়ই আমদের শাফায়াত নামাজের ক্ষেত্রে শিথিলতা প্রদর্শনকারীদের ভাগ্যে জুটবে না।৪৫

সুতরাং শাফায়াত গুনাহের প্রতি উৎসাহ দানকারীও নয় এবং অন্যায়ের প্রতি সবুজ সংকেত দানও নয়। এটি পক্ষপাতিত্বমূলক মধ্যস্থতাও নয়। নয় সৎকর্ম থেকে ফিরিয়ে রাখার উপকরণ,বরং এর গুরুত্বপূর্ণ প্রশিক্ষণমূলক ও গঠনমূলক ভূমিকা রয়েছে। এভাবে এরূপ কয়েকটি বিষয়ের প্রতি ইঙ্গিত করা হচ্ছে :

ক) আশাকে জাগরুক রাখা

প্রধানত মানুষের উপর তার মন্দ প্রবৃত্তির প্রভাবের কারণে মানুষ বড় ধরনের গুনাহে লিপ্ত হয় এবং এর ফলশ্রুতিতে তার হৃদয়ের উপর হতাশার ছায়া পড়ে। এই হতাশাই তাকে আরো অপরাধে কলুষিত হতে বাধ্য করে। এই হতাশার বিপরীতে আল্লাহর ওলীদের শাফায়াতের আশা তাকে আরো অধিক গুনায় পতিত হওয়া হতে রক্ষা করে এভাবে যে,তাকে আশা দেয় যদি সে নতুন করে গুনায় পতিত না হয় ও নিজেকে সংস্কারে ব্রত হয়,তাহলে সম্ভাবনা রয়েছে মহান আল্লাহ কর্তৃক পবিত্র ব্যক্তিবর্গদের শাফায়াতের বদৌলতে তার পূর্ববর্তী কর্মসমূহকে ক্ষমা করে দেয়ার।

খ) আল্লাহর ওলীদের সাথে আধ্যাত্মিক সম্পর্ক স্থাপন :

নিশ্চিতভাবে যে ব্যক্তি শাফায়াতের আশা রাখে সে প্রচেষ্টা চালায় আল্লাহর ওলীদের সাথে সম্পর্ক স্থাপনের। ফলে যে সকল কাজ তাদের খুশী করে তা করার চেষ্টা করে যাতে করে এই সম্পর্ক দুর্বল ও বিচ্ছিন্ন না হয়।

গ) শাফায়াতের জন্য প্রয়োজনীয় শর্তসমূহ অর্জনের প্রচেষ্টা :

শাফায়াতের আকাঙ্ক্ষী ব্যক্তি তার পূর্ববর্তী কর্মসমূহের বিষয়ে নতুন করে চিন্তা করে ভবিষ্যতের জন্য উন্নততর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। কারণ উপযুক্ত ক্ষেত্র প্রস্তুত ব্যতিরেকে শাফায়াত লাভ করা যায় না। বস্তুত শাফায়াত একটি বিশেষ অনুগ্রহ যা একদিকে শাফায়াত লাভকারী ব্যক্তির মধ্যে ক্ষেত্র প্রস্তুত হওয়া এবং অন্যদিকে শাফায়াতকারী ব্যক্তির সৎকর্ম ও আল্লাহর নিকট সম্মান ও উচ্চ মর্যাদার সমন্বয়ে সাধিত হয়ে থাকে।

৩। আমাদের জন্য সুপারিশকারীর প্রয়োজন কেন?

কেউ কেউ এ প্রশ্ন উত্থাপন করেন যে,কেন আল্লাহ সরাসরি আমাদের গুনাহসমূহকে ক্ষমা না করে সুপারিশকারীর মধ্যস্থতায় তা করবেন?

উত্তর : মহান আল্লাহ বিশ্বজগতকে সর্বোত্তমরূপে সৃষ্টি করেছেন :

﴿ الَّذِي أَحْسَنَ كُلَّ شَيْءٍ خَلَقَهُ﴾ 

“যিনি সকল কিছুকে সর্বোত্তমরূপে সৃষ্টি করেছেন।” ৪৬

বিশ্বজগৎ মানুষের পথপ্রাপ্তি,পূর্ণতা ও বিকাশের লক্ষ্যে কার্যকারণের নীতির ভিত্তিতে সৃষ্ট হয়েছে। এখানে মানুষের সকল প্রাকৃতিক চাহিদা সাধারণ উপায় উপকরণের মাধ্যমে পূরণ হয়ে থাকে।

আল্লাহর অবস্তুগত নিয়ামতসমূহ,যেমন পথ নির্দেশনা,ক্ষমা লাভ প্রভৃতি বিশেষ প্রক্রিয়ায় মানুষের উপর অবতীর্ণ হয়ে থাকে। কারণ প্রজ্ঞাময় আল্লাহর ইচ্ছা এটাই যে,তাঁর আধ্যাত্মিক নিয়ামতগুলো বিশেষ মাধ্যমের দ্বারা মানুষের জন্য আসবে। সুতরাং বস্তুগত নিয়ামতের বিষয়ে যেমন প্রশ্ন করা যায় না যে,কেন আল্লাহ পৃথিবীকে সূর্য দ্বারা আলোকিত করেছেন,কেন সরাসরি (বস্তুর সাহায্য ছাড়া) আলোকিত করলেন না? তেমনি অবস্তুগত নিয়ামতের ক্ষেত্রেও এ প্রশ্ন সঠিক নয় যে,কেন আল্লাহ তাঁর ওলীদের মাধ্যমে নিজ ক্ষমা বান্দাদের জন্য নির্দিষ্ট করেছেন?

শহীদ আয়াতুল্লাহ্ মুর্তাজা মুতাহ্হারী বলেছেন,‘মহান আল্লাহর কর্ম শৃঙ্খলাপূর্ণ। যদি কেউ বিশ্বের শৃঙ্খল-ব্যবস্থার প্রতি উপেক্ষার ভাব দেখায় তবে সে বিচ্যুত। এ কারণেই মহান আল্লাহ গুনাহকারী ব্যক্তিকে নির্দেশনা দিয়ে নিজের উপর জুলুম করে থাকলে তার ক্ষমার জন্য রাসূল (সা.)-এর দ্বারস্থ হওয়ার কথা বলেছেন যাতে করে তিনি তার জন্য আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করেন। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেন :

 ﴿وَلَوْ أَنَّهُمْ إِذ ظَّلَمُوا أَنفُسَهُمْ جَاءُوكَ فَاسْتَغْفَرُوا اللَّـهَ وَاسْتَغْفَرَلَهُمُ الرَّسُولُ لَوَجَدُوا اللَّـهَ تَوَّابًا رَّحِيمًا﴾

“যদি তারা (গুনায় পতিত হওয়ার মাধ্যমে) নিজের উপর জুলুম করে আপনার নিকট আসে এবং রাসূলও তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেন তবে অবশ্যই তারা আল্লাহকে তওবা গ্রহণকারী ও দয়ালু হিসেবে পেত।” (সূরা নিসা:৬৪) ৪৭

শাফায়াতের অন্যতম কারণ হলো মহান আল্লাহ তাঁর নবী ও ওলিগণকে শাফায়াতের অধিকার দানের মাধ্যমে সম্মানিত করতে চেয়েছেন। তাঁদের প্রার্থনা ও আবেদন গ্রহণ তাঁদের প্রতি এক প্রকার মর্যাদা দানের শামিল। যেহেতু আল্লাহর ওলী,সৎকর্মশীল বান্দা,ফেরেশতামণ্ডলী এবং আরশ বহনকারী বিশেষ ফেরেশতাগণ সমগ্র জীবন আল্লাহর নির্দেশের অনুগত থেকে জীবন কাটিয়েছেন এবং কখনোই আল্লাহর বন্দেগী,আনুগত্য ও উপাসনার গণ্ডির বাইরে পা বাড়ান নি,সেহেতু তাঁরা সম্মান পাওয়ার উপযুক্ত। তাঁদের মর্যাদা দানের ক্ষেত্রে এর চেয়ে বড় কী হতে পারে যে,আল্লাহর অনুগ্রহ ও ক্ষমা পাওয়ার উপযুক্ত পাপী বান্দাদের তাঁদের দোয়ার বরকতে ক্ষমা করা হবে ও তাঁদের প্রার্থনা আল্লাহ কর্তৃক গৃহীত হবে।

৪। শাফায়াত আল্লাহর জ্ঞান ও ইচ্ছার মধ্যে পরিবর্তনকারী অর্থাৎ তাঁর সর্বজ্ঞ হওয়ার পরিপন্থী।

রশিদ রেজা বলেছেন,‘আল্লাহর বিধানই হলো ন্যায় এবং ঐশী কল্যাণের নীতির ভিত্তিতে তা প্রতিষ্ঠিত। অন্যদিকে শাফায়াত বা সুপারিশ বলে যে বিষয়টি মানুষের মাঝে প্রচলিত আছে তার অর্থ হলো মধ্যস্থতা ও সুপারিশকারী অপরাধীর উপর প্রকৃত বিধান কার্যকর হওয়ার প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করে। যদি সুপারিশের পর বাস্তবায়িত বিধানটি ন্যায়ের অনুরূপ হয় তবে যেহেতু প্রথম বিধানটি (সুপারিশের পূর্বের) তার বিপরীত ছিল তাই সেক্ষেত্রে দু’টি অবস্থা হতে পারে :

১) মহান আল্লাহকে ন্যায়পরায়ণ নন বলতে হবে,যা অবশ্যই ঠিক নয়।

২) বলতে হবে আল্লাহ ন্যায়পরায়ণ,তবে তাঁর জ্ঞান অপূর্ণ ছিল। কারণ সুপারিশকারীর সুপারিশের পর তাঁর সিদ্ধান্ত ও জ্ঞানে পরিবর্তন এসেছে ও বাস্তবায়নযোগ্য ন্যায়সঙ্গত নতুন বিধান তাঁর হস্তগত হয়েছে।

এইরূপ চিন্তা অগ্রহণযোগ্য। কারণ আল্লাহর জ্ঞান তাঁর সত্তাগত এবং তাতে কোন পরিবর্তন আসতে পারে না। যদি ধরে নিই প্রথম বিধানটিই ন্যায় ছিল এবং দ্বিতীয় বিধানটি তার বিপরীত,তাহলে বিষয়টি দাঁড়াবে আল্লাহ শাফায়াতকারীর প্রতি ভালোবাসার কারণে ন্যায়কে পদদলিত করে নতুন বিধান কার্যকর করেছেন। এইরূপ চিন্তা আল্লাহর ন্যায়পরায়ণতার নীতির পরিপন্থী। তাই শাফায়াতের বিষয়টি বিভিন্নমুখী প্রশ্নের সম্মুখীন এবং যুক্তি ও বুদ্ধিবৃত্তি তার বিপরীতে অবস্থান নিয়েছে। ৪৮

 

আমাদের জবাব

এই সমালোচনাটির উদ্ভব এজন্য হয়েছে যে,সমলোচক জ্ঞানের বিষয়বস্তুর মধ্যে পরিবর্তনকে আল্লাহর জ্ঞান ও ইচ্ছার মধ্যে পরিবর্তন ভেবে নিয়েছেন। অর্থাৎ এ দুয়ের মধ্যে পার্থক্য করতে ব্যর্থ হয়েছেন। আমাদের বুঝতে হবে যে,বিষয়টির মধ্যে পরিবর্তন হয়েছে,তা হলো অপরাধী ও পাপীর অবস্থার অর্থাৎ তার অবস্থার পরিবর্তনের ফলে আল্লাহর অনুগ্রহের উপযুক্ত হয়েছে। অর্থাৎ পূর্বে তার মধ্যে এ অবস্থা বিরাজমান ছিল না। তাই আল্লাহর জ্ঞানে কোন পরিবর্তন সাধিত হয় নি। সুতরাং আল্লাহর ক্ষেত্রে পূর্বেই দু’ধরনের ইচ্ছা ছিল এবং আল্লাহ পূর্ব হতেই জানতেন ঐ ব্যক্তির মধ্যে পরিবর্তন আসবে এবং তাঁর দ্বিতীয় ইচ্ছার অধীনে সে রহমতে শামিল হবে। তাই তাঁর ইচ্ছার মধ্যে কোন পরিবর্তন সাধিত হয় নি,বরং দু’টি স্বতন্ত্র ইচ্ছা দু’টি ভিন্ন বিষয়ের উপর কার্যকর যার কোনটিই অপরটিকে প্রত্যাখ্যান করে না। বরং দু’টিই তাঁর ন্যায়ের অনুগত। এ কারণেই এতে আল্লাহর জ্ঞান ও ইচ্ছার মধ্যে কোন পরিবর্তনের সম্ভাবনা আসে না। বরং নতুন জ্ঞান ও ইচ্ছা নতুন এক বিষয়ের উপর আরোপিত হয় যা পূর্ব হতেই তিনি জ্ঞাত। যেমন আমরা জানি যে,রাত্রিতে সকল স্থান অন্ধকারে নিমজ্জিত হবে তাই এই জ্ঞানের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিই যে,তখন বৈদ্যুতিক আলো ব্যবহার করব। আবার জানি যে,সকালে সূর্য উদিত হবে,তখন বৈদ্যুতিক আলো নিভিয়ে ফেলব। এই দুই জ্ঞান পরস্পর বিপরীত নয়,বরং বিষয়বস্তুর ভিন্নতায় ভিন্নরূপ বিধি বা নীতির প্রয়োগ হয়েছে মাত্র।

শাফায়াতের ক্ষেত্রেও আমরা বলি যে,মহান আল্লাহ পূর্ব হতেই জানতেন কোন ব্যক্তির মধ্যে বিভিন্ন অবস্থার সৃষ্টি হবে এবং তার বিভিন্ন অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহর বিশেষ ইচ্ছা তার উপর প্রযোজ্য হবে। ফলে অবস্থা ও বিষয়ের পরিবর্তনে তার উপর বিভিন্ন রূপ ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটবে। তাই এক্ষেত্রে আল্লাহর আদি ও অনন্ত জ্ঞান ও ইচ্ছায় কোন পরিবর্তন ও ভুলের বিষয় উত্থাপনের সুযোগ নেই। কারণ প্রতিটি জ্ঞানই তার নির্দিষ্ট বিষয়ের জন্য সঠিক এবং প্রতিটি ইচ্ছাই কল্যাণের নীতিতে তার উপযুক্ত বিষয়বস্তুর জন্য প্রজ্ঞাজনোচিত।

 তথ্যসূত্র :

১। মাতেরিদী মতবাদে বিশ্বাসী যা আশআরী ও মুতাজিলা মতবাদের মধ্যপন্থি একটি মতবাদ।

২। তাভিলাতু আহলিস সুন্নাহ,পৃ. ১৪৮।

৩। আত তাওয়াররুফ লি মাজাহাবি আলহিত তাসাউফ,পৃ. ৫৪-৫৫।

৪। আওয়াইলুল মাকালাত,পৃ. ১৫।

৫। আততিবইয়ান,১ম খণ্ড,পৃ. ২১৩-২১৪।

৬। আল আকায়েদুন নাসাফীয়া,পৃ. ১৪৮।

৭। প্রাগুক্ত।

৮। নাভাভী,শারহে সহীহ মুসলিম,৩য় খণ্ড,পৃ. ৩৫।

৯। আনওয়ারুত তানযীল,১ম খণ্ড,পৃ. ১৫২।

১০। রওজাতুল ওয়ায়েযীন,পৃ. ৪০৬।

১১। মাজমাতুর রাসাইল আল কুবরা,১ম খণ্ড,পৃ. ৪০৩।

১২। সূরা বনি ইসরাঈল : ৭৯।

১৩। আল ইয়াকিত ওয়াল জাওয়াহির,১ম খণ্ড,পৃ. ১৭০।

১৪। বিহারুল আনওয়ার,৮ম খণ্ড,পৃ. ২৯।

১৫। আল হাদীয়াতুস সানীয়াহ,পৃ. ৪২।

১৬। সূরা বাকারা : ৪৭-৪৮।

১৭। সূরা আল মুদাসসির : ৪৬-৪৮।

১৮। সূরা ইউনুস : ১৮।

১৯। সূরা যুমার : ৪৪।

২০। সূরা ইউনুস : ৩।

২১। সূরা সাবা : ২৩।

২২। সূরা কাহ্ফ : ৮৮।

২৩। সূরা বাকারা : ৬৪।

২৪। সূরা নাহল : ৬১।

২৫। সূরা ফাতির : ৪৫।

২৬। সূরা মুমিন : ৭।

২৭। সূরা আনআম : ১৪৭।

২৮। সূরা বাকারা : ২৫৫।

২৯। সুনানে ইবনে মাজা,২য় খণ্ড,পৃ. ১৪৪১।

৩০। সূরা শুরা : ২৫।

৩১। সূরা বাকারা : ২৫৫।

৩২। সূরা ইউনুস : ১৮।

৩৩। সূরা ইউনুস : ১৮।

৩৪। সূরা আম্বিয়া : ২৬-২৮।

৩৫। জিয়ারাতুল কুবুর,পৃ. ১৫৬।

৩৬। আল হাদিয়াতুস সানিয়া,পৃ. ৪২।

৩৭। সহীহ তিরমিযী,৪র্থ খণ্ড,পৃ. ৪২,‘পুল সিরাত সম্পর্কে যা বর্ণিত হয়েছে’ অধ্যায়।

৩৮। সূরা ইউসুফ : ৯৭।

৩৯। সূরা নিসা : ৬৪।

৪০। সূরা ইউনুস : ১৮।

৪১। সূরা ত্বাহা : ১০৯।

৪২। সূরা মুমিন : ১৮।

৪৩। বিহারুল আনওয়ার,৮২তম খণ্ড,পৃ. ২৩৫।

৪৪। সুরা আম্বিয়া : ২৮।

৪৫ । বিহারুল আনওয়ার,১১তম খণ্ড,পৃ. ১০৫।

৪৬। সূরা সিজদা : ৭।

৪৭। মাজমুয়ে আসার,১ম খণ্ড,পৃ. ২৬৩।

৪৮। তাফসীরে আল মিনার,৪র্থ খণ্ড,পৃ. ৩০৭।