সূরা বাকারাহ;(২৬তম পর্ব)

সূরা বাকারাহ; আয়াত ৮০-৮৪

আল্লাহ রাব্বুল আলামিন সূরা বাকারাহ'র ৮০ নম্বর আয়াতে বলেছেন-


وَقَالُوا لَنْ تَمَسَّنَا النَّارُ إِلَّا أَيَّامًا مَعْدُودَةً قُلْ أَتَّخَذْتُمْ عِنْدَ اللَّهِ عَهْدًا فَلَنْ يُخْلِفَ اللَّهُ عَهْدَهُ أَمْ تَقُولُونَ عَلَى اللَّهِ مَا لَا تَعْلَمُونَ



" তারা বলে (বনী ইসরাইল),‘সীমিত কয়েকদিন ব্যতীত (জাহান্নামের) আগুন আমাদের স্পর্শও করবে না।’ (হে রাসূল!) তাদের বল,‘তোমরা কি আল্লাহর নিকট থেকে কোন প্রতিশ্রুতি নিয়েছ ? আর তিনি তাঁর প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেন না,অথবা (এরূপ যে,) তোমরা যে বিষয়ে জান না,আল্লাহর ওপর তা আরোপ করছ।"

গত পর্বে বলা হয়েছে,সাধারণ ইহুদীদের অনেকেরই ঐশী কিতাব সম্পর্কে কোন জ্ঞান ছিল না,অথচ তারা অযথাই ভাবতো যে,ইহুদী জাতি বুঝি শ্রেষ্ঠ জাতি এবং আল্লাহর প্রিয়। তারা ভুল ধারণার বশবর্তী হয়ে বলতো,'ইহুদীরা কোন গুনাহ করলেও আল্লাহ অন্যদের চেয়ে তাদেরকে কম শাস্তি দেবেন এবং শুধু অল্প কয়েক দিনের জন্যে তারা শাস্তি ভোগ করবে।' এ আয়াত ইহুদীদের ওই অলীক ধারণাকে সম্পূর্ণ মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে বলা হয়েছে,এটা আল্লাহর প্রতি তোমাদের মিথ্যা অপবাদ। কারণ তিনি শাস্তি বা পুরস্কারের ক্ষেত্রে তাঁর বান্দাদের ক্ষেত্রে কোন পার্থক্য করেন না। প্রকৃতপক্ষে বংশ ও গোত্রের ভিত্তিতে কোন রকম মর্যাদার দাবি করা কোন যুক্তিতেই গ্রহণযোগ্য নয়। শুধু মাত্র তাকওয়া ও সৎকাজ মানুষের মর্যাদার মাপকাঠি। পরকালেও আল্লাহ মানুষকে পুরস্কৃত বা সাজা দেবেন খোদাভীরুতা ও সৎ কাজের ভিত্তিতে।

এরপরের দুই আয়াত অর্থাৎ ৮১ ও ৮২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-


بَلَى مَنْ كَسَبَ سَيِّئَةً وَأَحَاطَتْ بِهِ خَطِيئَتُهُ فَأُولَئِكَ أَصْحَابُ النَّارِ هُمْ فِيهَا خَالِدُونَ () وَالَّذِينَ آَمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ أُولَئِكَ أَصْحَابُ الْجَنَّةِ هُمْ فِيهَا خَالِدُونَ

“হ্যাঁ,যে মন্দ কর্ম করে এবং তার দোষ-ত্রুটি তাকে পরিবেষ্টন করে,সুতরাং তারাই হল জাহান্নামী এ অবস্থায় যে,সেখানে তারা চিরকাল থাকবে। এবং যারা বিশ্বাসী ও সৎকর্মপরায়ণ তারাই জান্নাতবাসী,সেখানে তারা চিরস্থায়ী হবে।”

ইহুদীরা দোজখে যাবে না বলে যে ধারণা করতো,এর আগের আয়াতে তা উল্লেখ করে বিষয়টিকে আল্লাহর প্রতি ইহুদীদের অপবাদ বলে বর্ণনা করা হয়েছে। আর এই দুই আয়াতে পরকালে আল্লাহর সাজা ও পুরস্কারের মাপকাঠির বর্ণনা দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে,ইচ্ছাকৃতভাবে কেউ পাপ করলে এবং পাপের মধ্যে নিমজ্জিত হলে,তার অবস্থান যেন আগুনের মধ্যে,ফলে ওই আগুন থেকে পালানোর কোন উপায় তার নেই। আর এই শাস্তির ক্ষেত্রে ইহুদী জাতির সাথে অন্যান্য জাতির কোন পার্থক্য নেই। আর চিরস্থায়ী বেহেশতে প্রবেশের জন্য শর্ত হলো ঈমান ও সৎকাজ। শুধু ঈমান কিংবা শুধু সৎকাজের মাধ্যমে বেহেশতে যাওয়া সম্ভব নয়,বরং দু'টিই থাকতে হবে।

এবারে সূরা বাকারাহ'র ৮৩ নম্বর আয়াতের দিকে যাচ্ছি। এ আয়াতে বলা হয়েছে-


وَإِذْ أَخَذْنَا مِيثَاقَ بَنِي إِسْرَائِيلَ لَا تَعْبُدُونَ إِلَّا اللَّهَ وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَانًا وَذِي الْقُرْبَى وَالْيَتَامَى وَالْمَسَاكِينِ وَقُولُوا لِلنَّاسِ حُسْنًا وَأَقِيمُوا الصَّلَاةَ وَآَتُوا الزَّكَاةَ ثُمَّ تَوَلَّيْتُمْ إِلَّا قَلِيلًا مِنْكُمْ وَأَنْتُمْ مُعْرِضُونَ

“(সে সময়কেও স্মরণ কর) যখন আমরা বনী ইসরাইল হতে দৃঢ় অঙ্গীকার নিয়েছিলাম যে,আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারও উপাসনা করবে না এবং পিতা-মাতা,আত্মীয়-স্বজন,ইয়াতিম (পিতৃহীন) ও মিসকিনদের (নিঃস্বদের) সাথে সদাচার করবে এবং মানুষের সাথে উত্তম (নম্রস্বরে) কথা বলবে এবং নামায প্রতিষ্ঠা (নিয়মিত নামায আদায়) ও যাকাত প্রদান করবে। কিন্তু তোমাদের মধ্যে স্বল্প সংখ্যক ব্যতীত সকলেই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলে এ অবস্থায় যে,তোমরা পরান্মুখ (বিরুদ্ধভাবাপন্ন) ছিলে।”

এর আগে কয়েকটি আয়াতে বনী ইসরাইল আল্লাহর সাথে যে অঙ্গীকার করেছিলো,শুধু সে কথাই বলা হয়েছিল। কিন্তু অঙ্গীকারের বিষয়বস্তুর বর্ণনা দেয়া হয়নি। তবে এ আয়াতে এবং এর পরের আয়াতগুলোয় বনী ইসরাইলীদের অঙ্গীকারের কিছু অংশ তুলে ধরা হয়েছে। ইহুদীরা তাদের ওয়াদা লঙ্ঘন করায় এসব আয়াতে আল্লাহপাক তাদেরকে কঠোরভাবে ভর্ৎসনা করেন। নবীদের মাধ্যমে আল্লাহর প্রেরিত নির্দেশ,মানুষের বিবেক ও প্রকৃতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। আল্লাহ প্রত্যেক মানুষের প্রকৃতির মধ্যেই সঁপে দিয়েছিলেন ধর্মীয় মূল্যবোধ ও প্রবণতা। সব নবীর মূল কথা তৌহিদ ও এক আল্লাহর উপাসনা করা। অর্থাৎ মানুষের কাজ যদি আল্লাহকেন্দ্রীক হয় তবেই তা কল্যাণ বয়ে আনবে। আল্লাহর এবাদতের পর তার দ্বিতীয় নির্দেশ হলো পিতা-মাতার আনুগত্য এবং তাদের প্রতি উত্তম আচরণ করা। কারণ তাদের মাধ্যমেই আমরা জন্মলাভ করি এবং আল্লাহর দয়া ও অনুগ্রহ আসে তাদের মাধ্যমে। বাবা-মায়ের প্রতি সদাচরণের পাশাপাশি সমাজের দুঃস্থ বিশেষ করে আত্মীয়-স্বজনদেরকে সাহায্যের কথাও বলা হয়েছে। যাতে মানুষ শুধু নিজের কথা এবং পরিবারের কথাই না ভাবে এবং সমাজের প্রতিও লক্ষ্য রাখে। মানব সেবার পাশাপাশি বিশেষ উপায়ে আল্লাহর উপাসনা অর্থাৎ নামাজের কথা বলা হয়েছে। কারণ স্রষ্টার সাথে মানুষের নিরবচ্ছিন্ন সম্পর্কের প্রয়োজন উপেক্ষা করা সম্ভব নয়। শুধু আচার-আচরণেই নয়,একজন খোদাভীরুকে কথা বার্তায়ও হতে হবে সুন্দর। শুধু নিজ ধর্মের ও গোত্রের লোকদের সাথেই নয় বরং মুমিন,কাফের নির্বিশেষে সবার সাথে তাকে সদালাপী হতে হবে।

এরপর ৮৪ নম্বর আয়াতে আল্লাহ পাক বলেছেন-


وَإِذْ أَخَذْنَا مِيثَاقَكُمْ لَا تَسْفِكُونَ دِمَاءَكُمْ وَلَا تُخْرِجُونَ أَنْفُسَكُمْ مِنْ دِيَارِكُمْ ثُمَّ أَقْرَرْتُمْ وَأَنْتُمْ تَشْهَدُونَ

"সেই সময়ের কথা স্মরণ কর,যখন তোমাদের নিকট থেকে অঙ্গীকার নিয়েছিলাম যে,তোমরা কেউ কারো রক্তপাত করবে না এবং পরস্পরকে নিজেদের মাতৃভূমি থেকে বহিষ্কার করবে না। এরপর তোমরা ত্রুটি স্বীকার করেছিলে এবং এ ব্যাপারে তোমরাই তার সাক্ষী।" (২:৮৪)

এর আগের আয়াতে আল্লাহর ৬টি নির্দেশ বর্ণনার পর এ আয়াতে আরো দু'টি নির্দেশের কথা বলা হয়েছে। একটি মানুষের প্রাণের নিরাপত্তা সংক্রান্ত এবং অন্যটি হলো মাতৃভূমি ও ঘর-বাড়ির ওপর মানুষের অধিকার সংক্রান্ত। একটা সমাজের ন্যূনতম প্রাথমিক চাহিদাগুলোর একটি হলো জনগণের প্রাণের নিরাপত্তা। সকল ঐশী ধর্মে প্রাণের নিরাপত্তা ও মাতৃভূমিতে বসবাসের অধিকারের কথা বলা হয়েছে। বেঁচে থাকার অধিকার প্রত্যেক মানুষের। সে যে জাতি,ধর্ম বা গোত্রেরই হোক না কেন কেউ মানুষের এ অধিকার হরণ করতে পারে না। তাই হত্যা করা কবিরা গুনাহ এবং দুনিয়াতে এর শাস্তি মৃত্যুদণ্ড আর পরকালের শাস্তি হলো চিরস্থায়ী জাহান্নাম। মাতৃভূমির প্রতি ভালোবাসা মানুষের স্বভাবজাত ও প্রবৃত্তিগত ব্যাপার। তাই ধর্মও এ অনুভূতির প্রতি সম্মান দেখিয়ে থাকে। এজন্য মাতৃভূমিতে বসবাসের অধিকার থেকে কেউ কাউকে বঞ্চিত করতে পারে না।

৮০ থেকে ৮৪ নম্বর আয়াতের প্রধান শিক্ষণীয় বিষয়গুলো একে একে এবার তুলে ধরছি।
এক. ধর্মের দৃষ্টিতে বর্ণবাদ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ এবং পৃথিবীর সব মানুষ আল্লাহর কাছে সমান।
দুই. আল্লাহর দেয়া পুরস্কার ও শাস্তির মাপকাঠি হলো মানুষের ঈমান ও কাজ। সৎকাজ ছাড়া কেউ যদি নিছক আশা করে তাতে কোন লাভ হবে না।
তিন. অনেক সময় পাপ মানুষের অস্তিত্বে এমনভাবে প্রবেশ করে যে,তার হৃদয় ও আত্মাকে পুরোপুরি ঢেকে ফেলে এবং তার কথা-বার্তা ও কাজ-কর্মে মন্দ ছাড়া কিছু থাকে না।
চার. মানুষের কল্যাণের জন্য আল্লাহপাক মানুষের কাছ থেকে যেসব অঙ্গীকার নিয়েছেন তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো-তওহীদ ও এক আল্লাহর উপাসনা,পিতা-মাতার প্রতি সদাচরণ,দুঃস্থ লোক জন,আত্মীয়-স্বজন ও এতিমদের সাহায্য,মানুষের সাথে সদালাপ,নামাজ কায়েম,যাকাত দান,হত্যা ও রক্তপাত পরিহার এবং অন্যের ঘর-বাড়ি ও মাতৃভূমির ওপর আগ্রাসন চালানো থেকে বিরত থাকা।