আল হাসানাইন (আ.)

হযরত আলী (আ.)-এর জীবনের স্মরণীয় কিছু দিক (শেষ অংশ)

0 বিভিন্ন মতামত 00.0 / 5

অনুবাদ : আবুল কাসেম

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

ওহুদের যুদ্ধ

তৃতীয় হিজরির শাওয়াল মাসে তিন হাজার কুরাইশ যোদ্ধা মদীনার নিকটবর্তী ওহুদপ্রান্তে বদর যুদ্ধে পরাজয়ের প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য সমবেত হয়। মহানবী (সা.) একহাজার সৈন্য নিয়ে মদীনা থেকে বের হয়ে ওহুদে পৌঁছলেন। দুই দল মুখোমুখি হলে তিনি শ্রেষ্ঠ বীর হযরত আলীর হাতে ইসলামের পতাকা দিলেন। তৎকালীন রীতি অনুযায়ী শ্রেষ্ঠ যোদ্ধার হাতে দলীয় পতাকা দেয়া হত এবং এরূপ বীরদের শ্রেষ্ঠত্বের ধারাবাহিকতা অনুসারে একে একে পতাকা ধারণ করত। ওহুদের যুদ্ধে নয় জন কুরাইশ যোদ্ধা একের পর পতাকা ধারণ করেছিল। তাদের সকলেই হযরত আলী(আ.)-এর তরবারির আঘাতে নিহত হয়েছিল। তাদের মৃত্যুর পর কুরাইশরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পলায়ন করছিল,কিন্তু মুসলমানরা মহানবী (সা.)-এর নির্দেশ অমান্য করে গণিমত (কাফেরদের ফেলে যাওয়া মালামাল) সংগ্রহে মগ্ন হলে পেছন থেকে মুশরিকদের এক দল তাদের আক্রমণ করে পর্যুদস্ত করে।

খন্দকের যুদ্ধ

পঞ্চম হিজরির জিলকদ মাসে মক্কার মুশরিকরা দশ হাজার সৈন্য নিয়ে মদীনা আক্রমণের পরিকল্পনা করে। মুসলমানরা হযরত সালমান ফারসির পরামর্শে বিশাল এক পরিখা খনন করে যাতে মুশরিক সেনাদল মদীনায় প্রবেশ করতে না পারে। আমর ইবনে আবদে উদ নামের আরবের এক প্রসিদ্ধ বীর তার ঘোড়া নিয়ে পরিখা অতিক্রম করে মুসলমানদের সামনে এসে মল্লযুদ্ধের আহ্বান জানাল। মুসলমানরা তার বিশাল দেহ ও রণমূর্তি দেখে তার মুখোমুখি হওয়ার সাহস করছিল না। সে তাদের আহ্বান করে বলছিল,‘তোমরা তো বিশ্বাস কর যে,তোমাদের কেউ নিহত হলে বেহেশতে যাবে তাহলে কেন অগ্রসর হচ্ছ না?’ তখন মহানবী (সা.) সাহাবীদের আহ্বান করে বললেন,‘তোমাদের মধ্যে কে তার সঙ্গে যুদ্ধ করতে প্রস্তুত আছ?’ হযরত আলী (আ.) বললেন,‘আমি।’ তখন তিনি তাঁর পাগড়ি খুলে আলী (আ.)-এর মাথায় বেঁধে দিলেন। আলী আমরের সামনে দাঁড়িয়ে বললেন,‘আমি তোমাকে তিনটি প্রস্তাব দিচ্ছি,এর মধ্যে যে কোন একটি মেনে নাও : এক. ইসলাম গ্রহণ করে মুসলমান হয়ে যাও;দুই. যে সৈন্যদলসহ এসেছ তা নিয়ে ফিরে যাও;তিন. যেহেতু আমার ঘোড়া নেই তাই যুদ্ধ করার জন্য ঘোড়া থেকে নেমে আস।’ সে বলল,‘আমি তোমার তৃতীয় প্রস্তাব মেনে নিচ্ছি।’ অতঃপর সে ঘোড়া থেকে নেমে আসল। উভয়ের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হলে সে তরবারি দিয়ে হযরত আলীর ওপর আঘাত হানল। তিনি ঢাল দিয়ে তা আটকানোর চেষ্টা করলে তা দ্বিখণ্ডিত হয়ে তাঁর মাথায় আঘাত হানল (ঐ স্থানেই পরবর্তীকালে ইবনে মুলজিমের তরবারির আঘাত লেগেছিল এবং তিনি তাতে শহীদ হয়েছিলেন)। তিনি রক্তাক্ত অবস্থায়ই তার সঙ্গে যুদ্ধ করতে থাকলেন। সুযোগ বুঝে তিনি আমরের পায়ে তরবারি দিয়ে আঘাত হানলে তার পাবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ল এবং তিনি আরেকটি আঘাত করে তাকে মাটিতে ফেলে দিলেন। অতঃপর তাকে হত্যা করলেন। যদিও তখন যুদ্ধের রীতি ছিল হত্যাকারী নিহত ব্যক্তির পোশাক ও অস্ত্রাদির অধিকারী হবে,কিন্তু হযরত আলী আবদে উদের দেহ থেকে বর্ম ও পোশাক না খুলেই চলে এলেন। হযরত ওমর তাঁকে বললেন,‘তার বর্মটির মূল্য একশ দিনার (স্বর্ণমুদ্রা) বা এক হাজার দিরহাম (রৌপ্য মুদ্রা) হবে। তবুও কেন তা গ্রহণ করলেন না।’ তিনি বললেন,‘আমি চাইনি তাকে নগ্নদেহে ফেলে রাখতে।’ এ খবর যখন আমরের বোনের নিকট পৌঁছল তখন সে বলল,‘যদি তাকে সে নগ্ন করত তবে মৃত্যু পর্যন্ত তার জন্য আমি ক্রন্দন করতাম। কিন্তু যে তাকে হত্যা করেছে সে মহৎ ছিল। তাই তার জন্য আমি ক্রন্দন করব না।’

খায়বরের যুদ্ধ

মদীনার ইহুদীরা খুবই সম্পদশালী ছিল। তারা মহানবী (সা.)-কে অত্যন্ত কষ্ট দিত। মহানবী (সা.) তাদের এক গোত্র বনি নাযিরকে দমনের জন্য তাদের আবাসস্থল খায়বরের দিকে যাত্রা করলেন। সেখানে তাদের দুর্ভেদ্য দুর্গ ছিল। দীর্ঘদিন তিনি তাদের অবরোধ করে রাখলেন,কিন্তু তা ফলপ্রসূ হল না। তিনদিন পরপর তাদের সঙ্গে মুসলমানদের মুখোমুখি যুদ্ধ হয়। প্রথম দিন রাসূল (সা.) হযরত আবু বকরকে একদল সেনাসহ তাদের উদ্দেশে প্রেরণ করলেন। তিনি তাদের আক্রমণ করে পরাস্ত হয়ে ফিরে এলেন। মহানবী (সা.)-এর নিকট ফিরে এসে তিনি তাঁর সৈন্যদের বিরুদ্ধে কাপুরুষতার অভিযোগ আনলেন। সৈন্যরাও উল্টো তাঁকে ভীরু বলে অভিযুক্ত করল।

দ্বিতীয় দিন তিনি হযরত ওমরকে সেনাদলসহ যুদ্ধে প্রেরণ করলেন। তিনিও ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসলেন। তাঁর বিরুদ্ধেও সৈন্যরা ভীরুতার অভিযোগ আনল।

তৃতীয় দিনের আগের রাতে রাসূল (সা.) বললেন,‘আগামীকাল এমন এক ব্যক্তিকে প্রেরণ করব যে আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলকে ভালবাসে এবং আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলও তাকে ভালবাসে। সে প্রচণ্ড আক্রমণকারী,পলায়নকারী নয়।’ সকল সাহাবী আকাঙ্ক্ষা করতে লাগলেন ঐ ব্যক্তি যেন তিনি হন। তৃতীয় দিন সকালে রাসূল (সা.) জিজ্ঞাসা করলেন,‘আলী কোথায়?’ সকলে বললেন,‘তিনি চোখের ব্যথায় আক্রান্ত ও পীড়িত।’ মহানবী (সা.) বললেন,‘তাকে আন।’ হযরত আলীকে আনা হলে তিনি তাঁর মুখের লালা তাঁর চোখে লাগিয়ে দিলেন। আলী আরোগ্য লাভ করলেন। হযরত আলী বলেন,‘এরপর কখনও আমি চোখের ব্যথায় আক্রান্ত হইনি।’

রাসূল (সা.) যুদ্ধের পতাকা হযরত আলীর হাতে দিলেন এবং সৈন্যদের নিয়ে যাত্রা করতে বললেন। ইহুদীদের প্রসিদ্ধ বীর মারহাবের রণমূর্তিই মূলত পূর্ববর্তী সেনাদলের মধ্যে ভীতির সঞ্চার করেছিল। হযরত আলী ইহুদীদের দুর্গের নিকট পৌঁছলে মারহাব তাঁর সাথে মোকাবিলার জন্য বেরিয়ে আসল। যুদ্ধ শুরু হল এবং বেশ কিছুক্ষণ যুদ্ধের পর হযরত আলী তার ওপর বিজয়ী হলেন ও তাকে হত্যা করলেন। অতঃপর দুর্গের দরজা উপড়ে ফেললেন এবং তা ইহুদীদের খননকৃত পরিখার ওপর স্থাপন করলেন। এভাবে মুসলিম সৈন্যরা দুর্গের মধ্যে প্রবেশ করে তা দখল করল।

হযরত আলী মহানবী (সা.)-এর স্থলাভিষিক্ত

রাসূল (সা.) মদীনার নিকটে সংঘটিত সকল যুদ্ধে হযরত আলীকে সঙ্গে নিতেন এবং মদীনায় কাউকে না কাউকে অস্থায়ীভাবে স্থলাভিষিক্ত হিসাবে রেখে যেতেন। যেমন তিনি একবার অন্ধ সাহাবী ইবনে মাকতুমকে এবং আরেকবার সাহাবী আবদুল্লাহ হ্ইবনে মাসউদকে মদীনায় দায়িত্ব দিয়ে যান। সাধারণত এ ধরনের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে খুব অল্প সময়ের জন্য দায়িত্ব পালন করতে হত।

তাবুকের যুদ্ধের সময় মহানবী (সা.)-কে কিছুটা দীর্ঘ সময়ের জন্য মদীনা ত্যাগ করতে হয়েছিল। তাবুক মদীনা হতে নয়শ’ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এবং তিনি দুই মাসের অধিক সময়ের জন্য মদীনা ত্যাগ করছিলেন। এ অবস্থায় কখনই কাঙ্ক্ষিত ছিল না ইসলামী রাষ্ট্রের কেন্দ্রকে তিনি অরক্ষিত রেখে যাবেন কিংবা সাধারণ কোন ব্যক্তির হাতে তার দায়িত্ব অর্পণ করবেন। তাই এ যুদ্ধযাত্রার প্রাক্কালে তিনি আলী(আ.)-কে কেন্দ্রের সার্বিক দায়িত্ব পালনের জন্য নিযুক্ত করলেন। মুনাফিকরা বলা শুরু করল,‘রাসূল (সা.) তাঁর চাচাত ভাইয়ের প্রতি বিরক্ত হয়েছেন (তাই তাকে সঙ্গেনেননি)।’ এ কথা শুনে হযরত আলী (আ.) রণসজ্জায় সজ্জিত হয়ে মদীনার বাইরে রাসূল (সা.)-এর নিকট উপস্থিত হয়ে বললেন,‘হে আল্লাহর রাসূল! মুনাফিকরা বলাবলি করছে,আপনি আমার প্রতি বিরক্ত হয়ে আমাকে মদীনায় ছেড়ে যাচ্ছেন। আমাকে আপনার সঙ্গে যাওয়ার অনুমতি দিন।’ রাসূল (সা.) বললেন,‘হে আলী! তুমি কি এতে সন্তুষ্ট নও যে,তোমার মর্যাদা আমার কাছে মূসার কাছে হারুনের মর্যাদার ন্যায় হোক। তবে পার্থক্য এতটুকু যে,আমার পর কোন নবী নেই।’

কুরআন ও আলী (আ.)

মহানবী (সা.) হযরত আলীকে সমগ্র কুরআনের তাফসীর শিক্ষা দিয়েছিলেন। ঐতিহাসিক প্রমাণসমূহ এ সাক্ষ্য দান করে যে,রাসূল (সা.) তাঁর পরে হযরত আলীকে ইসলামের প্রচারের পূর্ণ দায়িত্ব দেওয়ার উদ্দেশ্যে প্রস্তুত করছিলেন। আমি(লেখক) আমার ‘মায়ালিমুল মাদরাসাতাইন’ গ্রন্থে তাবাকাতে ইবনে সাদ,সুনানে ইবনে মাজা,মুসনাদে আহমাদ ও অন্যান্য গ্রন্থ থেকে অসংখ্য হাদীস এ মর্মে উদ্ধৃত করেছি যে,মহানবী (সা.) প্রতি রাতে আলী (আ.)-এর সঙ্গে বিশেষ বৈঠক করতেন(তাঁকে শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যে)। হযরত আলী রাসূলের গৃহের দরজায় দাঁড়িয়ে ‘হে আল্লাহর রাসূল! আপনাকে সালাম’ বলে অনুমতি চাইতেন। রাসূল (সা.) অনুমতি দিলে তিনি গৃহে প্রবেশ করতেন। তখন রাসূল (সা.) তাঁর ওপর অবতীর্ণ আয়াতসমূহ আলীর জন্য পাঠ করতেন এবং ব্যাখ্যা দান করতেন। অতঃপর বলতেন,‘হে আলী,লিখে রাখ।’ হযরত আলী কখনও কখনও বলতেন,‘হে আল্লাহর রাসূল! আপনি আমার ভুলে যাওয়ার আশংকা করছেন?’ তিনি বলতেন,‘না। কারণ,আমি আল্লাহর নিকট দোয়া করেছি যেন তুমি কখনও ভুলে না যাও;বরং তুমি আমার ও তোমার অংশীদারদের (বংশধর) জন্য লিখে রাখ।’ যদি সে বৈঠকে ইমাম হাসান ও ইমাম হুসাইন উপস্থিত থাকতেন তবে বলতেন,‘এদের জন্য ও হুসাইনের বংশের ইমামদের জন্য লিখে রাখ।’ নবী বংশের পবিত্র ইমামদের নিকট এ গ্রন্থটি ছিল।

সে যুগে কোন লেখা স্থায়ীভাবে সংরক্ষণ করার জন্য পশুর শুষ্ক চামড়ার ওপর লেখা হত। হযরত আলী উটের শুষ্ক ও পাকা চামড়ার ওপর পবিত্র কুরআন সংকলিত করেছিলেন। তাঁর সংকলিত ব্যাখ্যা সম্বলিত কুরআন সত্তর হাত দীর্ঘ চর্মপত্রে লিপিবদ্ধ ছিল। আমি আমার তিন খণ্ডে রচিত ‘আল কুরআনুল কারিম’ গ্রন্থে রাসূল(সা.)-এর ওপর অবতীর্ণ দু’ধরনের ওহীর প্রতি ইশারা করেছি। এ দু’ধরনের ওহী হল : কুরআনী ওহী ও বর্ণনা বা ব্যাখ্যামূলক ওহী। কুরআনী ওহী হল যা কুরআনের মূল অংশ হিসাবে মুজিযাস্বরূপ,কেউ তার অনুরূপ আনতে পারবে না এরূপ চ্যালেঞ্জসহ তাঁর ওপর অবতীর্ণ হয়েছে এবং যার মধ্যে বিন্দুমাত্র কম-বেশি হওয়ার অবকাশ নেই। কিন্তু রাসূল (সা.)-এর নিকট শুধু কুরআনী ওহীই আসত না;বরংতাঁর ওপর যখন কোন আয়াত অবতীর্ণ হত তখন জিবরীল (আ.) ঐ আয়াতের ব্যাখ্যাও তাঁর জন্য নিয়ে আসতেন। যেমন পবিত্র কুরআনে নামাযের রাকায়াত সংখ্যা বর্ণিত হয়নি। শুধু বলা হয়েছে :

 أَقِمِ الصَّلَاةَ لِدُلُوكِ الشَّمْسِ إِلَىٰ غَسَقِ اللَّيْلِ

‘তুমি সূর্য হেলে যাওয়ার পর হতে রাতের ঘোর অন্ধকার পর্যন্ত নামায প্রতিষ্ঠা কর।’ হযরত জিবরীল (আ.) এ আয়াত বর্ণনা করেই তাঁর দায়িত্ব শেষ করেননি;বরং তিনি আল্লাহর পক্ষ হতে প্রতিটি নামাযের রাকায়াত সংখ্যা ও তা কীভাবে পড়তে হবে তা রাসূলের উদ্দেশে বর্ণনা করেছেন। কুরআন বহির্ভূত কিন্তু কুরআনের ব্যাখ্যা সংশ্লিষ্ট যে অংশ ওহীরূপে জিবরীল (আ.) নিয়ে আসতেন তা হল বর্ণনা বা ব্যাখ্যামূলক ওহী।

যে ধরনের ওহীই আসত মহানবী (সা.) তা লিখে রাখার জন্য ওহী লেখকদের ডেকে পাঠাতেন এবং আয়াতসমূহকে তিনি ব্যাখ্যাসহ লেখার নির্দেশ দিতেন। ওহী লেখকরাও তৎকালে প্রচলিত বিভিন্ন লিখন সামগ্রীতে,যেমন তক্তা,পশুর হাড়,চামড়ায় তা লিখে রাখতেন।

রাসূল (সা.) যেরূপে আয়াতসমূহ ব্যাখ্যাসহ বর্ণনা করতেন,তাঁরাও সেরূপে ব্যাখ্যাসহ তা লিপিবদ্ধ করতেন। সুতরাং রাসূল (সা.)-এর সময় সংকলিত কোন কুরআনই তাঁর পবিত্র মুখনিঃসৃত বর্ণনামূলক ওহী ব্যতীত লিপিবদ্ধ ছিল না। কিন্তু যেহেতু তাঁর এ বর্ণনা ও ব্যাখ্যা বিশেষ গোষ্ঠীর রাজনৈতিক স্বার্থের পরিপন্থী ছিল তারা সেগুলোসহ কুরআন সংকলনের বিরোধী ছিল। যেমন : পবিত্র কুরআনে বর্ণিত-وَالشَّجَرَ‌ةَ الْمَلْعُونَةَ فِي الْقُرْ‌آنِ ‘এবং ঐ বৃক্ষ যাকে কুরআনে অভিশপ্ত সাব্যস্ত করা হয়েছে- অভিশপ্ত বৃক্ষ যে বনি উমাইয়্যা তা কুরআনের এ আয়াতের সাথে উল্লিখিত থাকলে বনি উমাইয়্যার ক্ষমতা লাভের বিষয়টি অবৈধ প্রমাণিত হত। তাই তারা এর বিরুদ্ধে ছিল এবং তা সংকলিত হতে দেয়নি। কিন্তু কুরআন তার ব্যাখ্যাসহ রাসূলের পবিত্র আহলে বাইতের নিকট ছিল। সাহাবীরাও কম-বেশি কুরআনের সূরা ও আয়াতসমূহ ব্যাখ্যাসহ লিপিবদ্ধ করেছিলেন। সাহাবীদের সংকলিত কুরআনের মধ্যেযে পার্থক্য পরিলক্ষিত হত তা এ ব্যাখ্যার (বর্ণনামূলক ওহীর) বিদ্যমানতা ও অবিদ্যমানতার কারণে ছিল,মূল কুরআনে কম বা বেশি হওয়ার কারণে কখনই ছিলনা।

কুরআনের মূল আয়াত মহানবী (সা.)-এর ব্যাখ্যা ব্যতীত কখনই বোধগম্য নয়। তাইস্বয়ং আল্লাহ্ই তাঁকে মানুষের জন্য তা ব্যাখ্যা করতে বলেছেন। কিন্তু কুরাইশদের একাংশের জন্য ঐ ব্যাখ্যা বিপজ্জনক ছিল বলে তারা এ কাজে বাধা দিয়েছে। মুসনাদে আহমাদ এবং সুনানে ইবনে মাজাতে আবদুলাহ্ ইবনে আমর ইবনে আস থেকে বর্ণিত হয়েছে,‘আমি রাসূল (সা.) থেকে যা শুনতাম তা-ই লিপিবদ্ধ করতাম,কিন্তু কুরাইশরা (এর একাংশ) আমাকে বলল,তুমি কি আল্লাহর রাসূল (সা.) থেকে যা শোন,তা-ই লেখ,অথচ তিনি মানুষ হিসাবে কখনও রাগান্বিত হন (তখন কারও প্রতি অসন্তুষ্ট হন) এবং কখনও আনন্দিত হন (তখন কারও প্রতি সন্তুষ্ট থাকেন)। তাদের কথায় আমি (তাঁর বাণী) লিপিবদ্ধ করা হতে বিরত হলাম। পরে বিষয়টি আল্লাহর রাসূলকে বললাম। তিনি বললেন,লেখ। (কারণ) আমার মুখ থেকে সত্যব্যতীত কিছুই বের হয় না।’

 

পবিত্র কুরআনের পূর্ণাঙ্গ ব্যাখ্যা হযরত আলী (আ.)-এর নিকট ছিল এবং রাসূল(সা.)-এর ইন্তেকালের পর তিনি তাঁর পূর্ব নির্দেশ অনুযায়ী তা পর্যায়ক্রমে সাজিয়ে বিন্যস্ত করেন। যদিও তাঁর সংকলিত কুরআন কুরাইশরা গ্রহণ করতে অস্বীকার করেছিল এবং বলেছিল,‘আমাদের নিকট (ব্যাখ্যাহীন) যে কুরআন রয়েছে তা-ই আমাদের জন্য যথেষ্ট।’ অথচ তাদের সংকলিত সে কুরআনে জিবরীল (আ.) কর্তৃক আনীত ব্যাখ্যা বিদ্যমান ছিল না (যদিও কুরআন বোঝার জন্য তা আবশ্যক ছিল)। হযরত আলী (আ.) কুরাইশদের উদ্দেশে বলেন,‘এরপর,তোমরা (রাসূলের ব্যাখ্যা সম্বলিত) এ কুরআন আর দেখবে না।’ তিনি সেটিকে ইমাম হাসান ও হুসাইনের নিকট হস্তান্তর করেন। ইমাম হুসাইন (আ.) কারবালার উদ্দেশে যাত্রার পূর্বে তা উম্মুল মুমিনীন উম্মে সালামার নিকট গচ্ছিত রাখেন এবং অসিয়ত করেন তাঁর শাহাদাতের পর সেটি তাঁর পুত্র আলী ইবনুল হুসাইনকে দেওয়ার। এভাবে তাপরবর্তী ইমামদের হাতে স্থানান্তরিত হয়েছে। পরবর্তী ইমামগণ কুরআনের বিভিন্ন আয়াতের ব্যাখ্যা এ গ্রন্থ থেকেই করতেন এবং কখনও নিজেদের প্রবৃত্তির বশে মনগড়া কিছু বলতেন না। কারণ,তাঁরা নিজেরাই বলতেন,‘যদি কেউ কুরআনের বিষয়ে মনগড়া কিছু বলে তবে সে ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে।’ সুতরাং কুরআনের ক্ষেত্রে তাঁরা সকলেই মহানবী (সা.)-এর ব্যাখ্যার ওপর নির্ভর করতেন যেটি স্বয়ং আলী (আ.) তাঁর মুখনিঃসৃত বাণী থেকে লিপিবদ্ধ করেছিলেন। এ যুক্তিতে তাঁরাও হযরত আলী (আ.)-এর ন্যায় পবিত্র কুরআনের পূর্ণ জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন।

 

হযরত আলী ও গাদীরে খুম

রাসূল (সা.) তাঁর সমগ্র জীবনে আলীকে তাঁর স্থলাভিষিক্ত হিসাবে প্রস্তুত করার কাজেরত ছিলেন। তাঁর জীবনের শেষ হজ্ব সম্পাদনের পর তাঁর স্বহস্তে প্রশিক্ষিত এ শিষ্যকে তিনি মহান আল্লাহর নির্দেশে (সূরা মায়েদা : ৬৭) ‘গাদীরে খুম’ নামক স্থানে স্বীয় স্থলাভিষিক্ত হিসাবে ঘোষণা করেন। যদিও রাসূল (সা.) তাঁর নবুওয়াতী জীবনের বিভিন্ন সময় মুসলমানদের বিভিন্ন ব্যক্তি ও দলের সামনে আলীর স্থলাভিষিক্ত হওয়ার বিষয়টি উত্থাপন করেছেন,এমনকি তাঁর বংশের বার জন ইমাম ও প্রতিনিধির নামও অনেক ক্ষেত্রে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু মুসলমানদের বিশাল কোন সমাবেশে এ ঘোষণা তিনি ইতোপূর্বে দেননি। (যেহেতু স্থলাভিষিক্তের বিষয়টি নবুওয়াতী মিশনের পূর্ণতার জন্য অপরিহার্য ছিল সেহেতু তিনি চেয়েছেন ইসলামী ভূখণ্ডের সকল প্রান্ত থেকে মুসলমানরা এ সমাবেশে আসুক। মহানবী (সা.) এ উদ্দেশ্যে এ হজ্বে আসার পূর্বেই সকলকে এতে যোগদান করার জন্য বিভিন্ন স্থানে বার্তা পাঠিয়েছিলেন। এ হজ্বে কমপক্ষে সত্তর হাজার মুসলমান অংশগ্রহণ করেছিলেন)।

মহানবী (সা.) যখন আরাফার মহাসমাবেশে বক্তব্য দানের জন্য উঠলেন তখন হযরত জিবরীল (আ.) অবতীর্ণ হয়ে হযরত আলীকে তাঁর স্থলাভিষিক্ত ঘোষণার নির্দেশ নিয়ে আসলেন। কিন্তু রাসূল (সা.) পরিস্থিতি বিবেচনা করে তা ঘোষণা হতে বিরত থাকলেন। তিনি এ বিষয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন যে,কুরাইশ ও অন্য আরবরা তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনবে : তিনিও আরব গোত্রপতিদের মত (স্বীয় পুত্রের অনুপস্থিতিতে) নিজের চাচাত ভাইকে স্থলাভিষিক্ত প্রতিনিধি হিসাবে ঘোষণা করেছেন। তাই তিনি যথাযথ সময়ের অপেক্ষা করতে লাগলেন।

অতঃপর হজ্বের আনুষ্ঠানিকতা শেষ হয়ে গেলে সকল হাজী স্ব স্ব দেশে প্রত্যাবর্তনের জন্য যাত্রা শুরু করলেন। রাসূল (সা.)ও তাঁদের সঙ্গে যাত্রা করে ‘জোহফা’ নামক স্থানে পৌঁছলেন যেখান থেকে ইয়েমেন,সিরিয়া ও মদীনার পথ পৃথক হয়ে যায়। ঠিক সে সময় পবিত্র কুরআনের নিম্নোক্ত আয়াত অবতীর্ণ হয় : ‘হে রাসূল! তোমার ওপর তোমার প্রতিপালকের পক্ষ থেকে যা অবতীর্ণ হয়েছে তা প্রচার করে দাও;যদি তুমি তা না কর,তবে তোমার রেসালাতের দায়িত্বই পালন করলে না।’

রাসূল (সা.) অনতিবিলম্বে সকলকে যাত্রা বিরতি করার নির্দেশ দিলেন। তিনি নিজের জন্য তাঁবু খাটালেন এবং অন্যদেরকে তাঁবু স্থাপনের আদেশ দিলেন। সে সাথে বললেন,‘যারা আগে চলে গিয়েছে তাদের ফিরে আসতে বল এবং যারা এখনও এসে পৌঁছায়নি তাদের জন্য অপেক্ষা কর।’ অতঃপর গাদীরে খুমে সকলকে নিয়ে যোহরের নামায পড়লেন। নামাযান্তে উটের ওপর বসার আসনগুলো দিয়ে উঁচু করে এক মঞ্চ তৈরি করা হল। তিনি তাতে আরোহণ করে বললেন,‘আমি কি মুমিনদের ওপর তাদের নিজেদের থেকেও অগ্রাধিকার রাখি না?’ সকলে উত্তর দিলেন,‘হ্যাঁ।’ তখন তিনি হযরত আলী (আ.)-এর হাত এতটা উঁচু করে ধরলেন যে,তাঁদের উভয়ের শুভ্রবগল দেখা যাচ্ছিল। এরপর তিনি বললেন,‘আমি যার মাওলা,এ আলীও তার মাওলা (অভিভাবক)। হে আল্লাহ্! যে তাকে বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করে,তুমিও তাকে বন্ধু হিসাবে গ্রহণ কর এবং যে তার সঙ্গে শত্রুতা পোষণ করে,তুমিও তাকে শত্রু হিসাবে গ্রহণ কর এবং যে তাকে সাহায্য করে,তুমিও তাকে সাহায্য কর,আর যে তাকে পরিত্যাগ করে,তুমিও তাকে পরিত্যাগ কর।’১০

মুসনাদে আহমাদ ও অন্যান্য গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে,মহানবী (সা.) তখন বললেন,‘আমি তোমাদের মধ্যে দু’টি মূল্যবান ও ভারী বস্তু রেখে যাচ্ছি : আল্লাহর কিতাব ও আমার আহলে বাইত। যদি তোমরা এ দু’টিকে আঁকড়ে ধর,তাহলে আমার পর বিচ্যুত হবে না। নিশ্চয়ই সূক্ষ্মদর্শী,সর্বজ্ঞাত (আল্লাহ্) আমাকে জানিয়েছেন যে,এ দু’টি হাউজে কাউসারে আমার সাথে মিলিত হওয়া পর্যন্ত একে অপর থেকে পৃথক হবে না।’১১

রাসূল (সা.) সাধারণত আনুষ্ঠানিকভাবে কোন সভা আয়োজিত হলে তাতে বিশেষ পাগড়ি পড়তেন যার নাম ছিল ‘সাহাব’। তিনি গাদীরের সমাবেশে তাঁর এ বিশেষ পাগড়ি আলী (আ.)-এর মাথায় পরিয়ে দিলেন। তখন উপস্থিত সকলে হযরত আলীকে অভিনন্দন জ্ঞাপন করলেন। হযরত আবু বকর ও হযরত ওমরও তাঁকে অভিনন্দন জানালেন। হযরত ওমর তাঁকে উদ্দেশ করে বললেন,‘হে আবু তালিবের সন্তান! তুমি এখন থেকে সকল মুমিন নর ও নারীর নেতা ও অভিভাবক হয়ে গেলে।’১২(সমাপ্ত)

তথ্যসূত্র

১.সীরাতে ইবনে হিশাম,২য় খণ্ড,পৃ. ৫২০;বিহারুল আনওয়ার,২১তম খণ্ড,পৃ. ২০৭

২.তারীখে তাবারী,২য় খণ্ড,পৃ. ৩০০

৩.প্রাগুক্ত

৪.সীরাতে ইবনে হিশাম,২য় খণ্ড,পৃ. ৫২০

৫.সূরা বনি ইসরাঈল : ৭৮

৬.প্রাগুক্ত : ৬০

৭.সূরা নাহল : ৪৪

৮.মুসনাদে আহমাদ,২য় খণ্ড,পৃ. ১৬২;আল মাকতাবুল ইসলামী প্রকাশনা,বৈরুত,প্রকাশকাল ১৩৮৯ হিজরি

৯.সূরা মায়েদা : ৬৭

১০.সহীহ তিরমিযী,৫ম খণ্ড,২০তম অধ্যায় (বাবু মানাকিবি আলী ইবনে আবি তালিব),পৃ. ৬৩৩,হাদীস নং ৩৭১৩;সহীহ ইবনে মাজা,১ম খণ্ড,বাবু ফাজায়িলি আলী ইবনে আবি তালিব,পৃ. ৪৩,হাদীস নং ১১৬ এবং পৃ. ৪৫,হাদীস নং ১২১;মুসনাদে আহমাদ,৪র্থ খণ্ড,পৃ. ৩৭২ ও ২৮১;মুসতাদরাক আলাস সহীহাইন,৩য় খণ্ড,পৃ. ১০৯-১১০;খাসায়িস,নাসায়ী,পৃ. ২২ ও ১২২;আন নিহায়া ফিগারিবিল হাদীস,ইবনে আসীর,৫ম খণ্ড,পৃ. ২২৮;আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া,ইবনে কাসীর,১২তম খণ্ড,পৃ. ২১৯;সাওয়ায়েকে মুহরিকা,৯ম অধ্যায়,হাদীস নং৪,পৃ. ১২২;তারিখুল কাবীর;বুখারী,১ম খণ্ড,পৃ. ৩৭৫

১১.মুসনাদে আহমাদ,৩য় খণ্ড,পৃ. ১৪ ও ১৮ (আবু সাঈদ খুদরী সূত্রে বর্ণিত);সুনানে তিরমিযী,৫ম খণ্ড,পৃ. ৩২৯,হাদীস নং ৮৩৭৬;মুসতাদরাক,৩য় খণ্ড,পৃ. ১০৯ ও১৪৮,ফাজায়িলুস সাহাবা,পৃ. ৩৭৪,মুজামুল আওসাত,তাবরানী,৩য় খণ্ড,পৃ. ৩৭৪;মুজামুল কাবীর,৫ম খণ্ড,পৃ. ১৬৬ ও ১৬৯

১২.মুসনাদে আহমাদ,৪র্থ খণ্ড,পৃ. ২৮১;তারীখে ইসলাম,যাহাবী,পৃ. ৬৩৩;আন নিহায়া ফি গারিবিল হাদীস,ইবনে আসির,৫ম খণ্ড,পৃ. ২২৮;তারিখে বাগদাদ,৮ম খণ্ড,পৃ. ২৯০;আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া,৭ম খণ্ড,পৃ. ৩৮৬

(ঢাকা থেকে প্রকাশিত ত্রৈমাসিক পত্রিকা ‘প্রত্যাশা’, ১ম বর্ষ ৩য় সংখ্যা)

 

আপনার মতামত

মন্তব্য নেই
*
*

আল হাসানাইন (আ.)