সূরা বাকারাহ;(৪২তম পর্ব)

সূরা বাকারাহ; আয়াত ১৫৮-১৬২

সূরা বাকারাহ'র ১৫৮ নম্বর আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেছেন-


إِنَّ الصَّفَا وَالْمَرْوَةَ مِنْ شَعَائِرِ اللَّهِ فَمَنْ حَجَّ الْبَيْتَ أَوِ اعْتَمَرَ فَلَا جُنَاحَ عَلَيْهِ أَنْ يَطَّوَّفَ بِهِمَا وَمَنْ تَطَوَّعَ خَيْرًا فَإِنَّ اللَّهَ شَاكِرٌ عَلِيمٌ


"নিঃসন্দেহে সাফা ও মারওয়া আল্লাহ তা'লার নিদর্শনগুলোর অন্যতম। সুতরাং যারা কা'বা ঘরে হজ্ব বা ওমরাহ পালন করে, তাদের জন্য এ দু'টিতে প্রদক্ষিণ করলে কোন দোষ নেই। কেউ যদি স্বেচ্ছায় পূণ্য কাজ করে,তবে আল্লাহ তা'লা অবশ্যই তা অবগত হবেন এবং তার সে আমলের সঠিক মূল্য দেবেন।" (২:১৫৮)

হজ্ব অনুষ্ঠান হযরত ইব্রাহীম (আ.) এর যুগ থেকে প্রচলিত। দীর্ঘকাল ধরে অজ্ঞ ও মূর্তিপূজারী লোকেরা হজ্ব অনুষ্ঠানের সাথে অনেক কুসংস্কারকে জড়িয়ে ফেলেছিল। ইসলাম এই মহান ইবাদতের মূল দিকগুলো সংশোধন করেছে। হজ্বের একটি পালনীয় দিক হল, মসজিদুল হারামের পাশে অবস্থিত সাফা ও মারওয়া পাহাড়ের মধ্যে সাঈ করা বা দ্রুত আসা-যাওয়া করা। কিন্তু মূর্তিপূজারীরা এই দুই পাহাড়ের ওপর মূর্তি স্থাপন করে ওই মূর্তিগুলোর চারপাশে প্রদক্ষিণ করত। তাই মুসলমানরা হজ্ব পালনের সময় সাঈ করতে আগ্রহী হত না এবং তারা মনে করত এই দুই পাহাড়ের ওপর মূর্তি থাকায় সাঈ করা উচিত নয়। কিন্তু আল্লাহ এই আয়াত নাজেল করে স্মরণ করিয়ে দিলেন যে, এই দুই পাহাড় আল্লাহর শক্তির নিদর্শন এবং হজ্ব অনুষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা হযরত ইব্রাহীম (আ.) এর স্মৃতিবাহী। অজ্ঞ মানুষেরা এখানে শির্কে লিপ্ত হলেও মুসলমানদের উচিত হবে না, এ স্থানকে ছেড়ে যাওয়া। বরং সেখানে উপস্থিত থেকেই বিভ্রান্তদের কর্তৃত্ব ক্ষুণ্ন করা উচিত। হযরত ইব্রাহীম (আ.) যখন তার স্ত্রী ও সন্তান ইসমাইলকে নিয়ে মক্কায় আসেন তখন তিনি আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্দেশিত দায়িত্ব পালনের জন্য তাদেরকে এই শুষ্ক প্রান্তরে রেখে চলে যান। ইসমাইলের মা বিবি হাজেরা পানির সন্ধানে এই দুই পাহাড়ের মাঝে ছুটাছুটি করেন। এ অবস্থায় নবজাতক ইসমাইলের পায়ের আঙ্গুলের নীচ দিয়ে ঝর্ণা বের হয় যা জমজম নামে পরিচিতি লাভ করে। সেই তারিখ থেকেই আল্লাহর নির্দেশে যারাই আল্লাহর ঘর জিয়ারত করতে আসছেন তাদেরকে মা হাজেরার ত্যাগের মহিমান্বিত স্মৃতির সম্মানে সাফা ও মারওয়া পাহাড়ের মধ্যে ছুটাছুটি করতে হয়। সাঈ অনুষ্ঠান মা হাজেরার আন্তরিক প্রচেষ্টার প্রতি আল্লাহর করুণার নিদর্শন। আর এ থেকে আমাদের বোঝানো হয়েছে যে, আমরা যেন মানুষের কাছ থেকে কৃতজ্ঞতা ও প্রতিফল-প্রতিদান পাওয়ার আশা না করি। কারণ আল্লাহ মানুষের সৎকাজ সম্পর্কে অবহিত এবং তিনিই সৎকাজের পুরস্কার দিয়ে থাকেন।

এরপর ১৫৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

إِنَّ الَّذِينَ يَكْتُمُونَ مَا أَنْزَلْنَا مِنَ الْبَيِّنَاتِ وَالْهُدَى مِنْ بَعْدِ مَا بَيَّنَّاهُ لِلنَّاسِ فِي الْكِتَابِ أُولَئِكَ يَلْعَنُهُمُ اللَّهُ وَيَلْعَنُهُمُ اللَّاعِنُونَ

"আমি মানুষের জন্য কিতাবে যে সকল স্পষ্ট যুক্তি বা নিদর্শন ও উপদেশ দিয়েছি-তা যারা গোপন করে আল্লাহ নিশ্চয়ই তাদের অভিশাপ দেন এবং অভিশাপকারীগণও তাদেরকে অভিশাপ দেন।" (২: ১৫৯)

এই আয়াতে ইহুদী ও খ্রিস্টান পণ্ডিতদের সম্পর্কে বলা হয়েছে, তারা ইসলামের নবীর আবির্ভাবের স্পষ্ট নিদর্শনগুলো তাদের গ্রন্থে পাবার পরও তা গোপন করেছে এবং এভাবে মানুষের মুক্তি ও কল্যাণের জন্য আল্লাহর নবীরা যে রকম কষ্ট ও ত্যাগ স্বীকার করেছেন তাকে বিফল বা বরবাদ করে দিচ্ছে। কোন অজ্ঞ লোক যদি সত্যকে গোপন করে তাহলে সে অপেক্ষাকৃত কম শাস্তি পাবে। কিন্তু কোন জাতির শিক্ষিত, পণ্ডিত বা বুদ্ধিজীবীরা যদি সত্য গোপন করে থাকে, তাহলে তা হবে খোদা, নবী-রাসুল ও মানুষের ওপর বড় ধরনের জুলুম। ফলে এই ধরনের জ্ঞানপাপিরা অভিশপ্ত হবে।

এই আয়াতে সমাজের বিজ্ঞ এবং শিক্ষিত ব্যক্তিদের যারা সৎপথ উপলব্ধি করতে পারে তাদের উচিত হবে সত্যপন্থীদের সাথে তাদের সম্পর্কের বিষয়টি সমাজে সুস্পষ্ট করে দেয়া এবং প্রকাশ্যে বিভ্রান্তদের সমালোচনা করা।

এর পরের আয়াত অর্থাৎ ১৬০ নং আয়াতে আল্লাহ তা'লা ব্যতিক্রমী একটি দলের কথা উল্লেখ করেছেন। এই আয়াতে বলা হয়েছে-

إِلَّا الَّذِينَ تَابُوا وَأَصْلَحُوا وَبَيَّنُوا فَأُولَئِكَ أَتُوبُ عَلَيْهِمْ وَأَنَا التَّوَّابُ الرَّحِيمُ

"কিন্তু যারা তাওবা (ক্ষমা প্রার্থনা) করে ও সৎ কাজের মাধ্যমে নিজেদের সংশোধন করে, আর যে সত্য গোপন করেছিল তা প্রকাশ করে আমি তাদের ক্ষমা করে দেই। আমি ক্ষমাশীল, দয়াময়।" (২:১৬০)

ইসলাম ধর্মে কোন স্থবিরতা বা অচলাবস্থা নেই। আল্লাহ সব সময় মানুষের জন্য ‘আশা' ও ফিরে আসার পথ খোলা রেখেছেন, যাতে সবচেয়ে বেশী পাপী মানুষও আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ না হয়। এটা মনে রাখতে হবে যে, পাপের ফলে যে পরিমাণ ক্ষতি করা হয়েছে, ততটুকু সৎকাজ করেই তা পুষিয়ে দিতে হবে, তারপরই ক্ষমা পাওয়া যাবে। তাই যে সত্য গোপন করা হয়েছে তা জনগণের কাছে প্রকাশ করতে হবে-যাতে মানুষ বিভ্রান্তির মধ্যে না থেকে সত্যকে জানতে পারে।

এই সূরার ১৬১ ও ১৬২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

إِنَّ الَّذِينَ كَفَرُوا وَمَاتُوا وَهُمْ كُفَّارٌ أُولَئِكَ عَلَيْهِمْ لَعْنَةُ اللَّهِ وَالْمَلَائِكَةِ وَالنَّاسِ أَجْمَعِينَ ((خَالِدِينَ فِيهَا لَا يُخَفَّفُ عَنْهُمُ الْعَذَابُ وَلَا هُمْ يُنْظَرُونَ

"যারা কাফের হয়েছে এবং কাফের অবস্থায় মারা গেছে তাদের ওপর আল্লাহর, ফেরেশতাদের এবং সমগ্র মানব জাতির অভিশাপ।
এরা চিরকাল অভিশপ্ত অবস্থার মধ্যেই থাকবে। তাদের শাস্তি কমানো হবে না এবং তাদের কোন অবকাশ দেয়া হবে না।" (২:১৬১-১৬২)

পূর্ববর্তী আয়াতে বলা হয়েছে-যদি সত্য গোপনকারীরা মানুষের কাছে সত্য প্রকাশ করে, তাহলে তারা আল্লাহর দয়া পাবে। এই আয়াতে পুনরায় হুমকি দিয়ে বলা হয়েছে, যদি সত্য গোপনকারীরা সত্যকে গোপন করেই রাখে, তাহলে ফেরেশতা, মানুষ ও আল্লাহর অভিশাপ তাদের ওপর নেমে আসবে। কারণ মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তওবা কার্যকরী হয়। মৃত্যুর পরের জগতে যাওয়ার পর তওবা বা ক্ষমা প্রার্থনা করে কোন লাভ হবে না। ফেরাউনও নিশ্চিত মৃত্যুর সম্মুখীন হওয়ার পর অর্থাৎ ডুবে যাবার সময় তাওবা করেছিল কিন্তু সে তাওবায় কোন কাজ হয়নি। এজন্যই আল্লাহর প্রিয় বান্দা ও নবীরা এ দোয়া করতেন যে, মৃত্যুর সময় যেন মুসলমান হয়ে মৃত্যুবরণ করতে পারি। কারণ কুফরী বা অবিশ্বাসী অবস্থায় মৃত্যু এমন এক বিপদ যা থেকে রক্ষা পাবার কোন উপায় নেই। দুনিয়ায় ও পরকালে আল্লাহর রহমত থেকে বঞ্চিত হওয়া এমন এক শাস্তি যা সত্য গোপনকারীরা পেয়ে থাকে। সকল বিবেকবান মানুষ এই নোংরা অশুভ কাজকে ঘৃণা করেন। আল্লাহর শাস্তি ন্যায়বিচার ও প্রজ্ঞা নির্ভর, এ ক্ষেত্রে তিনি প্রতিশোধ গ্রহণকারী ও জালেম নন। তাই যারা জেনে শুনে সত্যকে গোপন করে, তাদের শাস্তি কমানো হবে না এবং তাদেরকে মুক্তির কোন সুযোগও দেয়া হবে না। কারণ তাদের মন্দ কাজের প্রভাব কমে না এবং ওই প্রভাব কার্যকরী হতেও দেরী হয় না।