সূরা বাকারাহ;(৪৪তম পর্ব)

সূরা বাকারাহ; আয়াত ১৬৭-১৭১

সূরা বাকারাহ'র ১৬৭ নং আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেছেন-


وَقَالَ الَّذِينَ اتَّبَعُوا لَوْ أَنَّ لَنَا كَرَّةً فَنَتَبَرَّأَ مِنْهُمْ كَمَا تَبَرَّءُ وا مِنَّا كَذَلِكَ يُرِيهِمُ اللَّهُ أَعْمَالَهُمْ حَسَرَاتٍ عَلَيْهِمْ وَمَا هُمْ بِخَارِجِينَ مِنَ النَّارِ

 

 

 

"যারা (বিভ্রান্ত নেতৃবৃন্দের) অনুসরণ করেছিল, তারা পুনরুত্থান বা কিয়ামতের দিন বলবে, হায়! যদি পৃথিবীতে একবার ফিরে যাবার সুযোগ হত তবে আমরাও তাদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করতাম, যেমন তারা আমাদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করল। এইভাবে আল্লাহ তাদের কার্যাবলী তাদের পরিতাপরূপে তাদের দেখাবেন, আর তারা কখনও দোযখের আগুন থেকে বের হতে পারবে না।" (২:১৬৭)

গত পর্বে আমরা বলেছিলাম, পাপাচারীরা যখন আল্লাহর শাস্তি দেখতে পাবে, তখন দুনিয়াতে যারা নেতা গোছের ছিল তারা তাদের অনুসারীদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করবে। কারণ আবেগে তাড়িত হয়ে যে আনুগত্য তৈরী হয় তা কিয়ামতের দিন ঘৃণা ও বিদ্বেষে রূপান্তরিত হবে।
এই আয়াতে বলা হচ্ছে, নরকবাসীরা দুনিয়ায় ফিরে আসার জন্য আল্লাহর কাছে তাদের আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করবে, তারা চাইবে দুনিয়াতে ফিরে গিয়ে তাদের সেই সব নেতা-নেত্রীকে তিরস্কার করবে যাদের কারণে তারা বিভ্রান্ত হয়েছে। কিন্তু সেদিন অনুতাপ আর দুঃখ কোনই কাজে আসবে না এবং পৃথিবীতে ফিরে আসারও কোন পথ থাকবে না। যারা মনে করে মানুষের স্বাধীনতা নেই এবং মানুষ যা-ই করে না কেন তা করতে সে বাধ্য থাকে বলেই করে-এ আয়াত তার বিরোধী। মানুষ যে তার কাজে কর্মে স্বাধীন এই আয়াতে তার সমর্থন রয়েছে। কারণ অনুতাপ, আফসোস এসব মানুষ এ জন্যে করে যে সে অন্য পথে চলতে পারত, অথচ নিজের ইচ্ছায় সে ভুল পথ বেছে নিয়েছিল।

এরপর ১৬৮তম আয়াতে বলা হয়েছে-

يَا أَيُّهَا النَّاسُ كُلُوا مِمَّا فِي الْأَرْضِ حَلَالًا طَيِّبًا وَلَا تَتَّبِعُوا خُطُوَاتِ الشَّيْطَانِ إِنَّهُ لَكُمْ عَدُوٌّ مُبِينٌ

"হে মানবজাতি! পৃথিবীতে যা কিছু বৈধ ও পবিত্র খাদ্য আছে, তা তোমরা আহার কর, তবে শয়তানের পথ অনুসরণ কর না, নিঃসন্দেহে সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু।" (২:১৬৮)

খাওয়া ও পান করা একটি স্বাভাবিক বিষয় এবং সব মানুষের জন্যেই খাদ্যগ্রহণ একটি মৌলিক চাহিদা। কিন্তু অন্য অনেক বিষয়ের মত এ ক্ষেত্রেও চরমপন্থা ও বাড়াবাড়ির ঘটনা ঘটে। অনেকে কোন মানদণ্ড ও বিধান ছাড়াই যা ইচ্ছা তা-ই খেয়ে থাকেন ও পান করেন। তারা এটা ভেবেও দেখতে চান না যে, এটা বিবেক সম্মত বা অবৈধ কিনা। তারা এটা ভাবতে চায় না যে, এসব বস্তু বৈধভাবে এসেছে নাকি অবৈধভাবে উপার্জিত? তারা শুধু পেট পূজা ও প্রবৃত্তির পূজায় লিপ্ত। অন্যদিকে আরেক দল আছেন যারা গ্রহণযোগ্য কোন যুক্তি ছাড়াই বৈধ অনেক কিছু খাওয়া থেকে বিরত থাকেন, তাদের ধারণা যে তারা নিজের প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করছেন। তাই এই আয়াতে বলা হয়েছে পৃথিবীতে যা কিছু আছে আল্লাহ তা তোমাদের জন্যেই সৃষ্টি করেছেন। তাই যা কিছু হালাল, পবিত্র এবং স্বাস্থ্য সম্মত তা খাও এবং অনর্থক এটা হালাল ওটা হারাম কর না। এটা মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্য শয়তানের কর্মসূচী মাত্র। যেমনটি হযরত আদম ও হাওয়া শয়তানের ধোকায় পড়ে নিষিদ্ধ গাছের ফল খেয়েছিলেন। একই সাথে মদের মত নিষিদ্ধ বা হারাম পানীয় পান করা শয়তানের কাজ এবং হালাল খাবারও কুসংস্কার বশে বা খেয়ালীপনার বশে না খাওয়াটা শয়তানের কাজ।

এরপর ১৬৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

إِنَّمَا يَأْمُرُكُمْ بِالسُّوءِ وَالْفَحْشَاءِ وَأَنْ تَقُولُوا عَلَى اللَّهِ مَا لَا تَعْلَمُونَ

"শয়তান তো কেবল তোমাদেরকে মন্দ ও অশ্লীল কাজের আদেশ দেয় এবং আল্লাহ সম্পর্কে যা জানো না এমন কিছু বলার নির্দেশ দেয়।" (২:১৬৯)

আগের আয়াতে বলা হয়েছে, শয়তান তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু। এই আয়াতে বলা হচ্ছে, শয়তানের শত্রুতার লক্ষণ হলো- সে সব সময় তোমাদেরকে নোংরা ও অশ্লীল কাজের দিকে আহ্বান জানাবে, যা তোমাদের জন্য দুর্ভাগ্য ও লাঞ্ছনা ছাড়া অন্য কিছু বয়ে আনবে না। অবশ্য আমরা নিজেরা কর্তৃত্ব করার সুযোগ করে না দিলে শয়তান আমাদের ওপর কর্তৃত্ব করতে পারে না। শয়তানের নির্দেশ বলতে অন্যায়ের প্রতি শয়তানের প্ররোচনা বা কুমন্ত্রণাকে বোঝানো হয়েছে। যাদের ঈমান যত দুর্বল তাদের ওপর শয়তানের কুমন্ত্রণাও তত বেশী কার্যকরী হয়। শয়তান পাপ কাজের দিকে আমন্ত্রণ জানায় এবং এর কৈফিয়ত বা অজুহাতের পথও দেখিয়ে দেয়। আল্লাহকে অপবাদ দেয়া অন্যায়ের বা পাপের বিভিন্ন পন্থাগুলোর অজুহাত ও পরিবেশ সৃষ্টি করে। মানুষ অজ্ঞতাবশত: কোন পাপ কাজ করে বসে এবং পরে নিজেকে ভাল দেখানোর জন্য সে ওই কাজের জন্য আল্লাহকে দায়ী করে বা অপবাদ দেয়।

এরপর ১৭০ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

وَإِذَا قِيلَ لَهُمُ اتَّبِعُوا مَا أَنْزَلَ اللَّهُ قَالُوا بَلْ نَتَّبِعُ مَا أَلْفَيْنَا عَلَيْهِ آَبَاءَنَا أَوَلَوْ كَانَ آَبَاؤُهُمْ لَا يَعْقِلُونَ شَيْئًا وَلَا يَهْتَدُونَ

"যখন তাদের বলা হয় যে, আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন, তোমরা তা অনুসরণ কর, তারা বলে বরং আমরা তাই অনুসরণ করব যাতে (যে ধর্মাদর্শে) আমাদের পিতৃপুরুষগণকে পেয়েছি। যদিও তাদের পূর্বপুরুষদের কোন জ্ঞান ছিল না এবং তারা সৎপথেও ছিল না।" (২:১৭০)

পূর্ব পুরুষদের প্রথা ও সংস্কৃতি রক্ষা করা ভাল। কিন্তু ঐসব প্রথা হতে হবে বিবেক ও ঐশী দিক নির্দেশনার সাথে সংগতিপূর্ণ। পূর্ববর্তীদের কুসংস্কারকে জাতিগত চেতনার কারণে অন্ধভাবে অনুসরণ করা ঠিক হবে না। মানুষের মধ্যে শয়তানের প্রভাব সৃষ্টির বিভিন্ন পন্থার মধ্যে অন্যতম হল পূর্বপুরুষদের অন্ধ অনুসরণ এবং পূর্ববর্তীদের কূ-প্রথাকে কোন প্রশ্ন ছাড়াই অনুসরণ করা। অথচ তারা নিজেরাও জানে যে ওই প্রথা বা কাজ ভুল এবং ধর্মও তাকে এ ধরনের কাজ করতে নিষেধ করে।

সূরা বাকারার ১৭১তম আয়াতে বলা হয়েছে-

وَمَثَلُ الَّذِينَ كَفَرُوا كَمَثَلِ الَّذِي يَنْعِقُ بِمَا لَا يَسْمَعُ إِلَّا دُعَاءً وَنِدَاءً صُمٌّ بُكْمٌ عُمْيٌ فَهُمْ لَا يَعْقِلُونَ

"আর এই অমান্যকারীদের দৃষ্টান্ত হল তার মত, যেন কোন ব্যক্তি এমন কিছুকে (পশুকে) ডাকে, যা (পশু) হাঁক-ডাক ছাড়া আর কিছুই বুঝতে পারে না। তারা বধির, বোবা ও অন্ধ, তাই (তারা) কিছুই বুঝতে পারে না।" (২: ১৭১)

পূর্ববর্তী আয়াতে বলা হয়েছে, অবিশ্বাসীরা পূর্বপুরুষদের কুসংস্কারাচ্ছন্ন চিন্তা-ভাবনার অন্ধ অনুসরণ করে অথচ ঐসব চিন্তা-ভাবনার না ছিল কোন যৌক্তিক ভিত্তি এবং না ছিল ঐশী নির্দেশনার সাথে কোন সম্পর্ক। এই আয়াতে বলা হচ্ছে-কাফেররা নিজেরা কোন চিন্তা-ভাবনা করে না। তারা সত্যের ব্যাপারে তাদের চোখ ও কান বন্ধ করে রেখেছে-যাতে কিছুই না দেখে এবং না শোনে। এদের দৃষ্টান্ত ঠিক ভেড়ার পালের মত। রাখালরা যতই তাদেরকে ভয় দেখাক না কেন, রাখালের কোন কথার অর্থ তারা বোঝে না। তারা শুধু চিৎকার ও ধ্বনি শুনতে পায়। অবিশ্বাসীরাও জন্তু-জানোয়ারের মত চোখ, কান ও জিহবার অধিকারী। তারা তাদের বিবেক ও চিন্তা-ভাবনাকে কাজে লাগায় না। আর এ কারণে তারা সত্যকে না দেখতে পেয়ে পূর্বপুরুষদের ভ্রান্ত প্রথা ও বিশ্বাসের অনুসরণ করে। পূর্ব পুরুষেরা যা বলে গেছে তাই অন্ধভাবে অনুসরণ করে।

এবারে সূরা বাকারার ১৬৭ নম্বর আয়াত থেকে ১৭১ নম্বর আয়াতগুলোর শিক্ষণীয় বিষয়গুলো তুলে ধরছি-
এক. মানুষ পশু নয় যে পেটের দাস হবে। তাই ঐশী বিধান অনুযায়ী পবিত্র ও হালাল খাবার থেকেই খাবারের চাহিদা মেটাতে হবে।
দুই. যারাই মানুষকে নোংরা ও অশ্লীল কাজের দিকে আহ্বান জানাবে তারাই শয়তান, যদিও বাহ্যিকভাবে তারা মানুষের মত।
তিন. পূর্বপুরুষদের প্রথা, সংস্কৃতি চিন্তাধারা তখনই মেনে নেয়া যায় যদি তা বিবেক ও জ্ঞানভিত্তিক হয়। তা না হলে এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে কুসংস্কার ছড়িয়ে দেয়ার ফলে মানব জাতির জন্য অধঃপতন ডেকে আনবে।
চার. মানুষের মূল্য থাকে তখনই যখন সে বিবেক ও চিন্তা-ভাবনাকে কাজে লাগায়। তা না হলে পশুদেরও চোখ, কান ও জিহবা আছে।