ইহুদিদের হাতে বন্দী হযরত সালমান (রা.) যেভাবে বিশ্বনবী (সা.)-কে চিনেছিলেন


বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)’র অতি প্রিয় ও অনুগত  সাহাবি হযরত সালমান ফার্সি (রা.) ১৩৯৯ বছর আগে ৩৫ হিজরির ৮ ই সফর ইরাকের মাদায়েন শহরে ইন্তেকাল করেছিলেন।
সেখানে আজও তাঁর মাজার জিয়ারত করেন উতসুক, ধর্মপ্রাণ, ঐতিহ্য-প্রিয় ও শেকড়-সন্ধানী মুসলমানরা। হযরত সালমান ফার্সি (রা.)’র অতি উচ্চ মর্যাদা তুলে ধরতে গিয়ে রাসূল (সা.) বলেছিলেন: “সালমান মিন্না আহলি বাইত” । এর অর্থ সালমান আমাদের আহলে বাইতের (পবিত্র নবী বংশের) অংশ। রক্ত-সম্পর্কিত আত্মীয় না হওয়া সত্ত্বেও তিনিই একমাত্র সাহাবি যাকে রাসূল (সা.) নিজ পবিত্র পরিবারের সদস্য বলে অভিহিত করেছেন।
 হযরত সালমান (রা.) ছিলেন অনারব ও ইরানের শিরাজ অঞ্চলের অধিবাসী। তাঁর আরেকটি নাম ছিল রুজবেহ। জরথুস্ত ধর্মের অদ্ভুত প্রথায় বিতৃষ্ণ সালমান  মাতৃভূমি শিরাজ ত্যাগ করে সত্য ধর্মের সন্ধানে বেরিয়ে পড়েন। নেস্তোরিয়ান খ্রিস্টানদের সঙ্গে পরিচয় ঘটার পর সত্য-সন্ধানের এই ভ্রমণ শুরু করেন তিনি।
ব্যাপক ভ্রমণের পর তিনি সিরিয়ায় কয়েকজন সন্ন্যাসীর কাছে একত্ববাদের শিক্ষা পান। এই সন্ন্যাসীরা হযরত ঈসা (আ.)’র খাঁটি একত্ববাদী ধর্মের ওপর অটল থাকার জন্য লোকালয় ছেড়ে নির্জন মরুভূমিতে বসবাস করছিলেন। কারণ, খ্রিস্ট ধর্মের নেতা সেজে বসা পল ( মূলত ইহুদি ) একত্ববাদী খ্রিস্ট ধর্মগ্রন্থ ইঞ্জিলকে বিকৃত করে  এতে অযৌক্তিক ত্রিত্ববাদ চালু করেন। খাঁটি খ্রিস্ট ধর্মে (একত্ববাদী) বিশ্বাসী ওই সন্ন্যাসীরা যখন একে একে মারা যাচ্ছিলেন তখন তাদের মধ্যে বেঁচে থাকা সর্বশেষ সদস্য মৃত্যু বরণের মুখে সালমান (রা.)-কে আরব দেশে যাওয়ার পরামর্শ দেন। সালমান (রা.) যেন শেষ নবী(সা.)’র আবির্ভাবের সময় পর্যন্ত আরব দেশে থেকে যান সেই পরামর্শ দিতেও ভুল করেননি সেই সন্ন্যাসী।   সালমান (রা.) আরব দেশে আসলে ইহুদিরা তাঁকে অপহরণ করে এবং তাঁকে দাস হিসেবে বিক্রি করে। বহু বছর ধরে তিনি ইহুদি মালিকের জন্য খেজুর বাগান গড়ে তুলতে ব্যাপক পরিশ্রম করেছিলেন।   একদিন তিনি খেজুর বাগানে দেখলেন নুরানি চেহারার এক ব্যক্তি একত্ববাদ ও ঐশী ন্যায়বিচারের কথা বলছেন। সালমান (রা.)’র হৃদয়ে জ্বলে উঠলো আলোর স্ফুলিঙ্গ। আগন্তুক ব্যক্তিকে পরীক্ষার জন্য সদকা বা দান হিসেবে কিছু খেজুর দিতে চাইলেন তিনি। কারণ, তিনি ধর্মগ্রন্থে পড়েছিলেন যে শেষ নবী (সা.)’র অন্যতম নিদর্শন হল তিনি এবং তার বংশধরদের জন্য দান-খয়রাত ও সদকা নেয়া নিষিদ্ধ। রাসূল (সা.) দান করা খেজুরগুলো তাঁর সাহাবিদের দিয়ে দিলেন। কিন্তু তিনি নিজে এবং  সঙ্গে থাকা চাচাতো ভাই ও জামাতা হযরত আলী (আ.) বিনম্রভাবে  জানান যে তাঁরা দানের খেজুর নেবেন না। সালমান (রা.)’র মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে  বেহেশতী আনন্দে! আরে! একেই তো আমি খুঁজছি এতদিন! এবার তিনি কিছু খেজুর নিয়ে সেগুলো রাসূল (সা.) ও হযরত আলী (আ.)-কে উপহার হিসেবে পেশ করলে তাঁরা তা গ্রহণ করলেন। সঙ্গে সঙ্গে হযরত সালমান (রা.) উচ্চারণ করলেন দুটি বাক্য_ আল্লাহ ছাড়া কোনো প্রভু বা মাবুদ নেই এবং মুহাম্মাদ (সা.) আল্লাহর রাসূল।
মহানবী (সা.) ওই কৃপণ ও অর্থপিশাচ ইহুদিদের হাত থেকে নও-মুসলমান সালমান (রা.)-কে মুক্ত করার জন্য বিপুল অর্থ শোধ করেন এবং তাদের আরো কিছু কঠোর শর্ত পূরণ করলেন।
মক্কার দশ হাজারেরও বেশি মূর্তি পূজারী মুশরিক ও ইহুদিরা একজোট হয়ে যখন  ইসলামকে নির্মূলের লক্ষ্যে মদীনা আক্রমণের উদ্যোগ নেয় তখন পবিত্র এই শহরের চারদিকে সবচেয়ে অরক্ষিত দিকগুলোয় খন্দক বা পরিখা খননের পরামর্শ দিয়েছিলেন এই বিখ্যাত সাহাবী। রাসূল (সা.) তাঁর ওই পরামর্শ গ্রহণ করেছিলেন। ইতিহাসে এই যুদ্ধ খন্দকের যুদ্ধ নামে খ্যাত। যুদ্ধক্ষেত্রে খন্দকের ব্যবহার আরব অঞ্চলে ছিল অপ্রচলিত। এমন অপ্রত্যাশিত প্রতিরক্ষা-ব্যবস্থা দেখে শত্রুরা হতভম্ব হয়ে পড়েছিল।
 বিশ্বনবী (সা.)’র ইন্তেকালের পর হযরত সালমান ফার্সি (রা.) সব সময় আমিরুল মু’মিনিন হযরত আলী (আ.)’র অন্যতম প্রধান সহযোগী হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে গেছেন ইসলামের গৌরবময় ইতিহাসে। সালমান (আ.) মাদায়েন প্রদেশের গভর্নর নিযুক্ত হয়েছিলেন। এই প্রদেশ ছিল ইসলাম-পূর্ব যুগে প্রাচীন ইরানের সাসানীয় সাম্রাজ্যের রাজধানী। #  (রেডিও তেহরান)