সূরা বাকারাহ;(৪৫তম পর্ব)

সূরা বাকারাহ; আয়াত ১৭২-১৭৬

সূরা বাকারাহ'র ১৭২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-


يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا كُلُوا مِنْ طَيِّبَاتِ مَا رَزَقْنَاكُمْ وَاشْكُرُوا لِلَّهِ إِنْ كُنْتُمْ إِيَّاهُ تَعْبُدُونَ



"হে ঈমানদারগণ! তোমরা পবিত্র বস্তু সামগ্রী আহার কর, যেগুলো আমি তোমাদেরকে জীবিকা হিসাবে দান করেছি এবং শুকরিয়া আদায় কর আল্লাহর যদি তোমরা তাঁরই বন্দেগী কর।" (২: ১৭২)

এই পৃথিবী একটা বাগানের মত। পবিত্র ও সৎ মানুষ হলো এর ফুল ও উদ্ভিদ। আল্লাহর নেয়ামত বা অনুগ্রহসমূহ হল সেই পানির মত যা বাগানের মালি তার ফুলগাছগুলোকে বড় করে তোলার জন্য বাগানে প্রবাহিত করেন। কিন্তু ঘাস ও আগাছাও যদি ওই পানি থেকে উপকৃত হয় তাহলে কি কিছু করার আছে? তাই মহান আল্লাহ ঈমানদার বিশ্বাসীদেরকে তার অসংখ্য নেয়ামত থেকে উপকৃত হবার পরামর্শ দিয়ে বলছেন, অহেতুক কোন কিছুকে যেন তারা নিজেদের জন্য হারাম বা নিষিদ্ধ ঘোষণা না করে। কারণ এসব নেয়ামত তো মূলত: মানুষের জন্যেই সৃষ্টি করা হয়েছে। অবশ্য আল্লাহ জীবিকাকে পেট পূজা ও স্বাদ-আস্বাদনের জন্য দান করেননি। কারণ আল্লাহর বাগানের ফল পবিত্র জিনিস। তাই সবচেয়ে ভালো পন্থায় তা ব্যবহার করতে হবে। আর এটাই হল প্রকৃত কৃতজ্ঞতা প্রকাশ।

এই সূরার ১৭৩ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

إِنَّمَا حَرَّمَ عَلَيْكُمُ الْمَيْتَةَ وَالدَّمَ وَلَحْمَ الْخِنْزِيرِ وَمَا أُهِلَّ بِهِ لِغَيْرِ اللَّهِ فَمَنِ اضْطُرَّ غَيْرَ بَاغٍ وَلَا عَادٍ فَلَا إِثْمَ عَلَيْهِ إِنَّ اللَّهَ غَفُورٌ رَحِيمٌ

"তিনি তোমাদের জন্য হারাম করেছেন মৃত জীব, রক্ত, শুকরের মাংস এবং সেসব জীব-জন্তু যা আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো নামে উৎসর্গ করা হয়। অবশ্য যে লোক অনন্যোপায় হয়ে পড়ে এবং নাফরমানী ও সীমালঙ্ঘনকারী না হয়, তার জন্য কোন পাপ নেই। নিঃসন্দেহে আল্লাহ মহান ক্ষমাশীল, অত্যন্ত দয়ালু।" (২: ১৭৩)

পবিত্র কোরআন সাধারণত: মানুষকে কোন কাজ করতে নিষেধ করার আগে, প্রথমে ওই কাজের হালাল ও বৈধ পন্থাগুলো বর্ণনা করেছে। এরপর হারাম বিষয়গুলো উল্লেখ করেছে। পূর্ববর্তী আয়াতে পবিত্র ও নিষিদ্ধ নয় এমন খাবার খেতে বলার পর এ আয়াতে বলা হয়েছে, তোমাদের জন্য সব কিছুই বৈধ এবং শুধু অল্প কিছু জিনিস-তাও তোমাদের আত্মা ও শরীরের জন্য ক্ষতিকর হওয়ায় হারাম করেছেন। রক্ত, মৃত জীব ও শূকরের মাংস বাহ্যিক অপবিত্রতার জন্য নিষিদ্ধ। কিন্তু মূর্তি পুজারীরা, মূতি পুজার জন্য যেসব পশু উৎসর্গ করে অথবা মূর্তি বা দেব-দেবীর নাম মুখে নিয়ে যেসব পশুর মাথা বিচ্ছিন্ন করা হয়-তা শির্ক বা অপ্রকাশ্য অপবিত্রতার জন্য নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
ইসলাম একটি সামাজিক ও সহজ ধর্ম। এখানে কোন পর্যায়েই অচলাবস্থা নেই। মানুষের জন্য করণীয় সব কিছুই দরকারের সময় ইসলাম মনে করিয়ে দিয়েছে। আর এটাই আল্লাহর দয়া ও করুণার লক্ষণ। তাই জরুরী অবস্থার যে নিয়ম সে নিয়মের অপব্যবহার করা উচিত নয়।

এরপর ১৭৪ নম্বর আয়াতে আল্লাহ পাক বলেছেন-

إِنَّ الَّذِينَ يَكْتُمُونَ مَا أَنْزَلَ اللَّهُ مِنَ الْكِتَابِ وَيَشْتَرُونَ بِهِ ثَمَنًا قَلِيلًا أُولَئِكَ مَا يَأْكُلُونَ فِي بُطُونِهِمْ إِلَّا النَّارَ وَلَا يُكَلِّمُهُمُ اللَّهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَلَا يُزَكِّيهِمْ وَلَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ

"আল্লাহ তার গ্রন্থে যে নির্দেশ দিয়েছেন তা যারা গোপন রাখে ও বিনিময়ে স্বল্প মূল্য গ্রহণ করে, তারা নিজেদের পেটে আগুন ছাড়া অন্য কিছুই পুরে না। কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাদের সঙ্গে কথা বলবেন না এবং তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।" (২:১৭৪)

আগের আয়াতে বিভিন্ন হারাম খাদ্য যেমন, শুকরের মাংস ও মরা জন্তুর বিষয়ে বলা হয়েছে। এ আয়াতে একটি সামগ্রীক নীতি উল্লেখ করা হয়েছে। আর তা হলো- যদি মানুষ অবৈধ পন্থায় টাকা আয় করে সে টাকা দিয়ে যাই করুক না কেন তা যদি হালাল খাদ্যও হয় তবে তা হবে আগুন খাওয়ার মত এবং তাতে নিজের জন্য যন্ত্রণাই অর্জিত হবে। অবৈধ টাকা বা অর্থ আয়ের একটি পদ্ধতি হলো সত্য গোপন বা বিকৃতির মোকাবেলায় নীরব থাকা। যেমন অনেক ইহুদী ও খ্রিস্টান পণ্ডিত এমনটি করতেন। তারা তাওরাত ও ইঞ্জিলের মাধ্যমে ইসলামের নবীর লক্ষণগুলো জানা সত্ত্বেও এবং তাঁকে চেনা সত্ত্বেও সামান্য সম্পদ ও পদ হারাবার ভয়ে সত্যকে গোপন ও উপেক্ষা করত। আল্লাহ পাক এদের শাস্তি সম্পর্কে বলেছেন, যারা আল্লাহর বাণীকে পৃথিবীর মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে রাজী হয়নি তারা পরকালে আল্লাহর ভালবাসাপূর্ণ বক্তব্য শোনা থেকে বঞ্চিত হবে।

এরপর ১৭৫ ও ১৭৬ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

أُولَئِكَ الَّذِينَ اشْتَرَوُا الضَّلَالَةَ بِالْهُدَى وَالْعَذَابَ بِالْمَغْفِرَةِ فَمَا أَصْبَرَهُمْ عَلَى النَّارِ () ذَلِكَ بِأَنَّ اللَّهَ نَزَّلَ الْكِتَابَ بِالْحَقِّ وَإِنَّ الَّذِينَ اخْتَلَفُوا فِي الْكِتَابِ لَفِي شِقَاقٍ بَعِيدٍ

"তারাই সুপথের বিনিময়ে কুপথ এবং ক্ষমার পরিবর্তে শাস্তি ক্রয় করেছে, নরকের আগুন সহ্য করতে তারা কতই না ধৈর্যশীল। এই শাস্তির কারণ এ জন্য যে, আল্লাহ সত্যসহ কিতাব নাজেল করেছেন, কিন্তু যারা কিতাবের মধ্যে মতভেদ সৃষ্টি করেছে, তারা সত্যের বিরুদ্ধে সংগ্রামে খুবই কঠোর।" (২:১৭৫-১৭৬)

এই দুই আয়াতে দুর্নীতিপরায়ণ পণ্ডিত বা জ্ঞান পাপীদের মাধ্যমে সত্য গোপন করার পরিণাম উল্লেখ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, পণ্ডিতদের এই বিশেষ পাপের ফলে তারা হেদায়াত বা মুক্তির আলো থেকে বঞ্চিত হয়ে বিভ্রান্তি ও লাঞ্চনার মধ্যে নিমজ্জিত হয়। শুধু জ্ঞান থাকলেই মানুষ সৌভাগ্যের অধিকারী হয় না বরং তা একটি জাতি ও প্রজন্মের বিভ্রান্তিরও কারণ হয়। অসৎ পণ্ডিতরা শুধু যে নিজেদেরকেই মুক্তির পথ থেকে বঞ্চিত করে তা নয়, শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বহু মানুষের বিভ্রান্তিরও কারণ হয় তারা।
তাই স্বাভাবিকভাবেই এ ধরনের পণ্ডিতদের শাস্তি শুধু তাদের নিজেদের বিভ্রান্তির সাথে সম্পর্কিত নয়, অর্থাৎ বহু লোকের বিভ্রান্তির দোষে দোষী বলে তাদেরকে এইসব মানুষকে বিভ্রান্ত করার শাস্তি পেতে হবে। আর এ ধরনের শাস্তি কতই না ভয়াবহ। ১৭৬ নম্বর আয়াতে সত্য বিকৃতি বা গোপন করাকে সত্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম থেকে উৎসারিত বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কারণ এইসব মানুষ সত্যকে জেনে শুনেও মেনে নিতে প্রস্তুত হয়নি বরং সত্যের বিরুদ্ধে সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়েছে এবং বিভিন্ন পন্থায় মানুষের মধ্যে সত্য সম্পর্কে সন্দেহ ও বিভেদ সৃষ্টি করেছে।

এবারে সূরা বাকারার ১৭২ থেকে ১৭৬ নম্বর আয়াতের মূল শিক্ষাগুলো তুলে ধরছি-
এক. ইসলাম খাদ্যের বিষয়ে গুরুত্ব দিয়েছে এবং হালাল ও হারাম খাদ্যের বিষয়ে বারবার পরামর্শ দিয়েছে ও সতর্ক করে দিয়েছে।
দুই. শুধু দোয়া ও ইবাদতের সময় আল্লাহকে স্মরণ করা নয়, খাওয়া- দাওয়ার সময়ও আল্লাহকে স্মরণ করতে বলেছে ইসলাম। তাই যেসব প্রাণীকে আল্লাহর নাম নিয়ে জবাই করা হয়নি তা খাওয়া বৈধ নয়।
তিন. হারাম উপায়ে অর্জিত অর্থ দিয়ে হালাল খাবারও যদি তৈরী করা হয়-তবে তা হবে পেটে আগুন ঢোকানোর মতই যন্ত্রণাদায়ক।
চার. যদিও দুনিয়াতে আল্লাহ হযরত মূসা (আঃ)-এর মত নবীদের সাথে সরাসরি কথা বলেছেন, কিন্তু কিয়ামতের দিন আল্লাহর সমস্ত সৎ বান্দারাও আল্লাহর কথা শুনতে পাবে।