সূরা বাকারাহ;(৫৫তম পর্ব)

সূরা বাকারাহ;আয়াত ২১৫-২১৮

সূরা বাকারাহ'র ২১৫তম আয়াতে বলা হয়েছে-

يَسْأَلُونَكَ مَاذَا يُنْفِقُونَ قُلْ مَا أَنْفَقْتُمْ مِنْ خَيْرٍ فَلِلْوَالِدَيْنِ وَالْأَقْرَبِينَ وَالْيَتَامَى وَالْمَسَاكِينِ وَابْنِ السَّبِيلِ وَمَا تَفْعَلُوا مِنْ خَيْرٍ فَإِنَّ اللَّهَ بِهِ عَلِيمٌ

"(হে নবী) তারা আপনাকে প্রশ্ন করে যে,কি জিনিস তারা দান করবে? বলে দিন-যে বস্তুই তোমরা দান কর,তা হবে পিতা-মাতার জন্যে,আত্মীয়-আপনজনের জন্যে,এতীম-অনাথদের জন্যে,অসহায়দের জন্যে এবং মুসাফিরদের জন্যে। আর তোমরা যে কোন সৎকাজ কর না কেন,নিঃসন্দেহে তা ভালভাবেই আল্লাহর জানা রয়েছে।" (২: ২১৫)

বঞ্চিতদের সহায়তা করা ও তাদের দিকে লক্ষ্য রাখা মুমিনদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য যা কোরআনের বহু আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে। তাই ইসলামের প্রাথমিক যুগে মুসলমানরা রাসূল (সা.)'র কাছে প্রশ্ন করেছিল- কাকে ও কতটুকু দান করা যাবে? দানের পরিমাণ ও ধরণ স্পষ্ট ও স্থির নয় বলে এটা নির্ভর করে মানুষের ক্ষমতা ও অভাবগ্রস্তের চাহিদার পরিমাণের ওপর। তাই এ প্রশ্নের উত্তরে কোরআন বলেছে : দানের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হলো প্রয়োজনীয় ও লাভজনক বিষয় দান করা,তা পরিমাণে যাকে যতটুকুই দেয়া হোক না কেন এ ক্ষেত্রে সবার দিকেই লক্ষ্য রাখতে হবে,বয়স্ক বাবা-মা,অভাবগ্রস্ত নিজ পরিবারের সদস্য,দরিদ্র আত্মীয়-স্বজন এবং সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর লোক যারা সাহায্যের প্রত্যাশী-সবার দিকেই খেয়াল রাখতে হবে। আয়াতের শেষাংশে বলা হয়েছে- শুধু দান নয় অন্যদের জন্য কল্যাণকর যেকোন কাজ সম্পর্কে আল্লাহ অবহিত। তাই মানুষকে নিজের সৎ কাজের বিষয়ে জানানোর চেষ্টা না করে গোপনে দান খয়রাত করা উচিত।

এই আয়াত থেকে আমরা এটা শিখলাম যে দান ও সাহায্যের ক্ষেত্রে বাবা-মা ও আত্মীয় স্বজন অন্যদের চেয়ে অগ্রাধিকার পাবে এবং সৎকাজের ফল কখনও নষ্ট হয় না,সেটা মানুষ জানুক আর নাই জানুক,আল্লাহ পাক তা ভালোকরেই জানেন।

সূরা বাকারাহ'র ২১৬তম আয়াতে বলা হয়েছে-

كُتِبَ عَلَيْكُمُ الْقِتَالُ وَهُوَ كُرْهٌ لَكُمْ وَعَسَى أَنْ تَكْرَهُوا شَيْئًا وَهُوَ خَيْرٌ لَكُمْ وَعَسَى أَنْ تُحِبُّوا شَيْئًا وَهُوَ شَرٌّ لَكُمْ وَاللَّهُ يَعْلَمُ وَأَنْتُمْ لَا تَعْلَمُونَ

"তোমাদের জন্য যুদ্ধের বিধান দেয়া হল যদিও তোমাদের কাছে তা অপছন্দনীয়। পক্ষান্তরে তোমাদের কাছে হয়তো কোন একটা বিষয় পছন্দসই নয়,অথচ তা তোমাদের জন্য কল্যাণকর। আর হয়তোবা কোন একটি বিষয় তোমাদের কাছে পছন্দনীয় অথচ তোমাদের জন্যে তা অকল্যাণকর। বস্তুতঃ আল্লাহই জানেন,তোমরা জান না।" (২: ২১৬)

ধর্ম রক্ষার জন্য শত্রুদের সাথে প্রয়োজনে লড়াই করা মুমিনদের জন্য ফরজ বা বাধ্যতামূলক । কিন্তু মানুষ স্বাভাবিকভাবেই আনন্দ ও স্বাচ্ছন্দ পছন্দ করে এবং যুদ্ধে যাওয়াকে পছন্দ করে না। এই আয়াতে বলা হয়েছে- যদিও শত্রুর সঙ্গে মোকাবেলা করা কঠিন এবং যুদ্ধ আনন্দের বিষয় নয়,তারপরও ধর্মযুদ্ধে বা অন্যায়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধে মানুষের পার্থিব ও পারলৌকিক কল্যাণ রয়েছে। প্রবৃত্তির তাড়নায় কেউ যেন খোদার নির্দেশ ও বিধানকে মন্দ বা ক্ষতিকারক বলে মনে না করে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়,শিশুরা ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে ঔষধ দেয়াকে ভয় পায় বলে ইঞ্জেকশন নিতে চায় না,সে এটা বুঝে না যে,তার সুস্থতা এর ওপর নির্ভর করে। আবার দেখা যায় শিশুটি এমন এক সুস্বাদু খাবার পছন্দ করে বসে যা অসুখের সময় তার জন্য ক্ষতিকারক। তাই সব আনন্দই ভাল নয় এবং সব কষ্টই মন্দ নয়।

এই আয়াত থেকে আমরা যা শিখলাম তা হলো-

প্রথমত : একমাত্র আল্লাহর বিধান বা নির্দেশ পালনের মধ্যেই মানুষের স্বার্থ ও কল্যাণ নিহিত।

দ্বিতীয়ত : মানুষের জ্ঞান সীমিত এবং আল্লাহর জ্ঞান অসীম। তাই আল্লাহর বিধানের কাছে আমাদের আত্মসমর্পন করা উচিত। আমরা আল্লাহর নির্দেশনার সুফল বুঝতে না পারলেও এবং আল্লাহর নির্দেশ বাস্তবায়ন করা কঠিন হলেও তাঁর বিধানের কাছে আমাদের আত্মসমর্পন করতে হবে।

এই সূরার ২১৭ ও ২১৮ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

يَسْأَلُونَكَ عَنِ الشَّهْرِ الْحَرَامِ قِتَالٍ فِيهِ قُلْ قِتَالٌ فِيهِ كَبِيرٌ وَصَدٌّ عَنْ سَبِيلِ اللَّهِ وَكُفْرٌ بِهِ وَالْمَسْجِدِ الْحَرَامِ وَإِخْرَاجُ أَهْلِهِ مِنْهُ أَكْبَرُ عِنْدَ اللَّهِ وَالْفِتْنَةُ أَكْبَرُ مِنَ الْقَتْلِ وَلَا يَزَالُونَ يُقَاتِلُونَكُمْ حَتَّى يَرُدُّوكُمْ عَنْ دِينِكُمْ إِنِ اسْتَطَاعُوا وَمَنْ يَرْتَدِدْ مِنْكُمْ عَنْ دِينِهِ فَيَمُتْ وَهُوَ كَافِرٌ فَأُولَئِكَ حَبِطَتْ أَعْمَالُهُمْ فِي الدُّنْيَا وَالْآَخِرَةِ وَأُولَئِكَ أَصْحَابُ النَّارِ هُمْ فِيهَا خَالِدُونَ () إِنَّ الَّذِينَ آَمَنُوا وَالَّذِينَ هَاجَرُوا وَجَاهَدُوا فِي سَبِيلِ اللَّهِ أُولَئِكَ يَرْجُونَ رَحْمَةَ اللَّهِ وَاللَّهُ غَفُورٌ رَحِيمٌ

"হে নবী! তারা আপনাকে হারাম মাসে যুদ্ধ করার বিষয়ে প্রশ্ন করে। আপনি বলুন : তাতে যুদ্ধ করা ভীষণ অন্যায়। কিন্তু আল্লাহর পথে (আদেশ পালনে) বাধাদান করা,আল্লাহকে অস্বীকার করা,পবিত্র মসজিদে বাধা দেয়া বা মসজিদুল হারামের অবমাননা করা এবং এর বাসিন্দাদের সেখান থেকে বহিষ্কার করা,আল্লাহর কাছে আরো বড় বা গুরুতর অন্যায় । কারণ হত্যার চেয়ে অশান্তি গুরুতর। (হে বিশ্বাসীরা!) তোমরা জেনে রাখো,তারা তো সর্বদাই তোমাদের সাথে যুদ্ধ করতে থাকবে,যাতে করে তোমাদেরকে দ্বীন থেকে ফিরিয়ে দিতে পারে যদি সম্ভব হয়। তোমাদের মধ্যে যারা নিজের দ্বীন থেকে ফিরে দাঁড়াবে এবং কাফের অবস্থায় মৃত্যুবরণ করবে,দুনিয়া ও আখেরাতে তাদের যাবতীয় আমল বিনষ্ট হয়ে যাবে। আর তারাই হলো দোযখবাসী। তাতে তারা চিরকাল বাস করবে।

যারা ঈমান এনেছে এবং যারা আল্লাহর পথে স্বদেশ ত্যাগ করে এবং ধর্মযুদ্ধ করে,তারাই আল্লাহর রহমত বা অনুগ্রহ প্রত্যাশী এবং আল্লাহ ক্ষমাশীল ও দয়াময়।" (২:২১৮)

আমরা আগেই বলেছিলাম আরবদের মধ্যে হযরত ইব্রাহীম (আ.)এর যুগ থেকে বছরের নির্দিষ্ট চারটি মাসে যুদ্ধ করা নিষিদ্ধ ছিল। ইসলাম এই সুন্দর প্রথাকে গ্রহণ করেছে। ফলে রজব,জ্বিলকদ,জিলহজ্ব ও মহররম মাসে যুদ্ধ হারাম করা হয়েছে। এ সম্পর্কে ইতিহাসে জানা যায় রাসুল (সা.) বদর যুদ্ধের আগে শত্রুদের অবস্থা জানার জন্য ৮ ব্যক্তিকে মক্কায় যেতে বলেছিলেন,পথে এক কুরাইশ কাফেলার সাথে তাদের সাক্ষাৎ হয়। কাফেরদের একজন শীর্ষস্থানীয় নেতা ঐ কাফেলায় ছিল। রাসূল (সা.)-র প্রতিনিধিরা রজব মাসে যুদ্ধ করা হারাম হওয়া সত্ত্বেও ওই কাফেলার ওপর হামলা চালিয়ে কুরাইশ নেতাকে হত্যা করে এবং যুদ্ধলব্ধ মালামালসহ কয়েকজনকে বন্দী করে রাসূল (সা.)'র কাছে নিয়ে আসে। রাসুল (সা.) এই আচরণে দুঃখিত হয়ে বলেন : আমি তাদের ওপর হামলা করতে তো বলিনি,তাও আবার এই নিষিদ্ধ মাসে ! তাই তিনি গনীমত ও বন্দীদের গ্রহণ করেননি। অন্যান্য মুসলমানরাও তাদের তিরস্কার করে। শত্রুরা এই অবস্থার সুযোগ গ্রহণ করে অপপ্রচার চালাতে লাগলো যে রাসুল (সা.) নিষিদ্ধ মাসগুলোতে,যুদ্ধ,রক্তপাত ও বন্দী করাকে বৈধ বলে মনে করেন এবং অন্যান্য মুসলমানদেরকেও এই কাজে উৎসাহিত করছেন। শত্রুদের অপপ্রচারের জবাবে এই আয়াত নাজিল হয়। এই আয়াতে এটা বুঝানো হয়েছে যে,নিষিদ্ধ মাসে যুদ্ধ হারাম হলেও এই কাজ রাসূল (সা.) এর অনুমতি ছাড়াই করা হয়েছে। মুসলিম নেতৃবৃন্দ ইচ্ছা করে এমনটি করেননি। অথচ তোমরা দীর্ঘ অনেক বছর ধরে মুসলমানদের ওপর জুলুম নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছো। তাদেরকে ঘর-বাড়ী থেকে বের করে দিয়েছো এবং তাদের জন্য আল্লাহর ঘরের পথ বন্ধ করে দিয়েছো । আর এসব অপরাধ এই হত্যাকাণ্ডের চেয়ে অনেক বড়। এরপর মুসলমানদেরকে হুঁশিয়ার করে দিয়ে বলা হয়েছে যে,শত্রুরা তোমাদের ছেড়ে দিয়েছে এমনটি মনে কর না বরং তারা তোমাদের সবসময় ধর্মহীন করার চেষ্টা চালাচ্ছে। তাই জেনে রাখ- যারা ঈমান বা বিশ্বাস হারাবে তাদের সব কাজ ব্যর্থ হবে এবং তারা হবে নরকের স্থায়ী বাসিন্দা । অন্যদিকে যেসব মুসলমান তাদের স্বগোত্রের বিধর্মী লোকদের ওপর হামলা চালিয়েছিল তারা আল্লাহর ধর্মের জন্য হিজরত ও জিহাদ করেছে। তাদের কোন পার্থিব উদ্দেশ্য ছিল না বলে আল্লাহ তাদের ক্ষমা করেছেন। সূরা বাকারার ২১৮ নম্বর আয়াত তাঁদেরকে ক্ষমা করার ঘোষণা উপলক্ষে নাজিল করা হয়েছে ।

এই দুই আয়াত থেকে আমরা যা যা শিখলাম তা হলো,

প্রথমত : আমরা মুসলমানরা যেন আমাদের তৎপরতা ও আচরণে সতর্ক হই যাতে শত্রুরা আমাদের ভুল থেকে আমাদেরকেই আঘাত হানার সুযোগ না পায়।

দ্বিতীয়ত : যেকোন ঘটনার বিচারের ক্ষেত্রে মূলের দিকে নজর দিতে হবে ।একজন ষড়যন্ত্রকারী বা কূটকৌশলী দাঙ্গাবাজ বাহ্যিকভাবে হয়তো কাউকে হত্যা করে না,কিন্তু তার কাজের পরিণতিতে হত্যা ও সংঘাত সৃষ্টি হয়।