সূরা বাকারাহ;(৬১তম পর্ব)

সূরা বাকারাহ;আয়াত ২৪৫-২৪৮

সূরা বাকারাহ'র ২৪৫তম আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেছেন-

مَنْ ذَا الَّذِي يُقْرِضُ اللَّهَ قَرْضًا حَسَنًا فَيُضَاعِفَهُ لَهُ أَضْعَافًا كَثِيرَةً وَاللَّهُ يَقْبِضُ وَيَبْسُطُ وَإِلَيْهِ تُرْجَعُونَ

"এমন কে আছে যে,আল্লাহকে ঋণ প্রদান করবে? উত্তম ঋণ ;যাতে আল্লাহ তার জন্য তা দ্বিগুণ-বহুগুণ বৃদ্ধি করে দিতে পারেন। আল্লাহই (জীবিকা) সংকোচিত করেন এবং তিনিই তা সম্প্রসারিত করেন এবং তাঁরই নিকট তোমরা সবাই ফিরে যাবে।" (২:২৪৫)

পূর্ববর্তী আয়াতে জিহাদে অংশ নিতে মুমিনদের প্রতি আহবান জানানো হয়েছে। জিহাদের জন্য জীবন উৎসর্গ করা ছাড়াও জনগণের অর্থ সাহায্যের প্রয়োজন হয়। তাই এ আয়াতে মুমিনদেরকে আল্লাহর পথে অর্থ ব্যয় করতে উৎসাহিত করার জন্যে বলা হয়েছে। আল্লাহর পথে অর্থ ব্যয় করার অর্থ হলো- আল্লাহকে উত্তম ঋণ দেয়া। অবশ্য আল্লাহকে ধন দেয়া বলতে শুধু ধর্মযুদ্ধে অর্থ সাহায্য দেয়াকে বোঝায় না,একই সঙ্গে সমাজের দরিদ্র ও বঞ্চিতদেরকে যে কোন সাহায্য দেয়াও এই ঋণের অন্তর্ভূক্ত। আল্লাহ দুনিয়ায় ও পরকালে মানুষকে এর বিনিময়ে অনেকগুণ বেশী প্রতিদান দেবেন। কারণ,আমাদের জীবিকার মালিক আল্লাহ। আর যা আমরা আল্লাহর রাস্তায় দান করব আল্লাহ তা হিসাবে রাখবেন এবং সময়মত এর প্রতিদান দেবেন।

এই আয়াতের শিক্ষণীয় কয়েকটি বিষয় হলো-

রিজিক বা জীবিকা আল্লাহর হাতে এ কথাটি মনে রাখলে আল্লাহর পথে দান-খয়রাত করা অনেক সহজ হয়ে যায়। কারণ,আমরা যা দান আল্লাহর কাছ থেকে তার প্রতিদান পাব।

এরপর ২৪৬ ও ২৪৭ নং আয়াতে বলা হয়েছে-

أَلَمْ تَرَ إِلَى الْمَلَإِ مِنْ بَنِي إِسْرَائِيلَ مِنْ بَعْدِ مُوسَى إِذْ قَالُوا لِنَبِيٍّ لَهُمُ ابْعَثْ لَنَا مَلِكًا نُقَاتِلْ فِي سَبِيلِ اللَّهِ قَالَ هَلْ عَسَيْتُمْ إِنْ كُتِبَ عَلَيْكُمُ الْقِتَالُ أَلَّا تُقَاتِلُوا قَالُوا وَمَا لَنَا أَلَّا نُقَاتِلَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ وَقَدْ أُخْرِجْنَا مِنْ دِيَارِنَا وَأَبْنَائِنَا فَلَمَّا كُتِبَ عَلَيْهِمُ الْقِتَالُ تَوَلَّوْا إِلَّا قَلِيلًا مِنْهُمْ وَاللَّهُ عَلِيمٌ بِالظَّالِمِينَ (২৪৬) وَقَالَ لَهُمْ نَبِيُّهُمْ إِنَّ اللَّهَ قَدْ بَعَثَ لَكُمْ طَالُوتَ مَلِكًا قَالُوا أَنَّى يَكُونُ لَهُ الْمُلْكُ عَلَيْنَا وَنَحْنُ أَحَقُّ بِالْمُلْكِ مِنْهُ وَلَمْ يُؤْتَ سَعَةً مِنَ الْمَالِ قَالَ إِنَّ اللَّهَ اصْطَفَاهُ عَلَيْكُمْ وَزَادَهُ بَسْطَةً فِي الْعِلْمِ وَالْجِسْمِ وَاللَّهُ يُؤْتِي مُلْكَهُ مَنْ يَشَاءُ وَاللَّهُ وَاسِعٌ عَلِيمٌ

"তুমি কি মুসার পরবর্তী বনি ইসরাইল প্রধানদের দেখনি? তারা নিজেদের নবীকে বলেছিল আমাদের জন্য একজন নেতা নিযুক্ত কর যাতে আমরা আল্লাহর পথে সংগ্রাম করতে পারি। তিনি (নবী) বললেন,এমন তো হতে পারে যে,যখন তোমাদেরকে যুদ্ধের আদেশ দেয়া হবে তখন তোমরা যুদ্ধ করবে না? তারা বলেছিল,আমরা তো আমাদের ঘরবাড়ী ও সন্তানদের কাছ থেকে বিতাড়িত হয়েছি,কাজেই আমরা কেন আল্লাহর পথে সংগ্রাম করব না? এরপর যখন তাদেরকে যুদ্ধ করতে বলা হলো,তখন তাদের অল্প সংখ্যক ছাড়া সবাই পৃষ্ঠ প্রদর্শন করলো। আল্লাহ অপরাধীদেরকে ভালভাবেই জানেন।" (২:২৪৬)

"বনী ইসরাইলদের নবী তাদেরকে বলেছিলেন আল্লাহ তালুতকে তোমাদের সর্দার করেছেন। তারা বলল: সে কিভাবে আমাদের ওপর কর্তৃত্ব করবে যখন আমরা নিজেরাই শাসন কাজে তার চেয়ে বেশী যোগ্য এবং তার প্রচুর ধনসম্পদও নেই? তিনি (নবী) বললেন,আল্লাহই তাকে তোমাদের জন্য মনোনীত করেছেন এবং তিনি তাঁকে দৈহিক শক্তি ও জ্ঞানের দিক থেকে সমৃদ্ধ করেছেন। আল্লাহ প্রাচুর্যময় ও প্রজ্ঞাময়।" (২:২৪৭)

হযরত মুসা (আঃ) যুগ শেষ হবার পর বনী ইসরাইলীরা আরাম আয়েশ ও ভোগ বিলাসে নিমগ্ন হয়ে পড়ে,ফলে তাদের ওপর পুনরায় তাগুত বা জালেম শক্তির কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয় এবং তারা তাদের ভূ-খণ্ড থেকে বিতাড়িত হয়। তাদের মধ্যে কেউ কেউ উদ্বাস্তুর জীবন থেকে মুক্তি পেতে যুদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয়। আর এ লক্ষ্যে তারা তৎকালীন নবীর কাছে তাদের জন্য এমন এক নেতা নির্বাচনের আহবান জানায়,যে নেতার নেতৃত্বে তারা তাগুতি শাসনের বিরূদ্ধে যুদ্ধ করবে। যদিও ঐ নবী বনী ইসরাইলীদের অতীত আচরণের আলোকে এটা জানতেন যে,ইহুদীরা যুদ্ধ ও সংগ্রাম করার মত লোক নয়,তবুও তাদের অজুহাত তোলার পথ বন্ধের জন্য তালুত নামের এক দরিদ্র অখ্যাত রাখালকে তাদের সেনা অধিনায়ক করেন। বনী ইসরাইলীরা ভেবেছিল জাতির একজন উচ্চপদস্থ ব্যক্তিকে এ পদে নিয়োগ করা হবে। কিন্তু তাদের সে আশা পূর্ণ না হওয়ায় তারা তালুতের সেনাপতিত্ব মেনে নেয়নি,এমনকি তারা তালুতের চেয়ে নিজেদেরকে যোগ্য বলে দাবী করে। অথচ যুদ্ধের জন্য উপযুক্ত প্রশিক্ষণ ও শারীরিক শক্তির দিক থেকে তালুত অন্যদের চেয়ে বেশী যোগ্য ছিল। আর এ কারণেই আল্লাহ তাকে সেনাপতি পদে মনোনীত করেন।

এ আয়াতে আমাদের জন্য যা শিক্ষণীয় তার সারসংক্ষেপ হলো-

প্রথমত: নিজের পরিবার বা দেশ রক্ষার জন্য সংগ্রাম আল্লাহর পথে জিহাদ হিসেবে বিবেচিত হয়।

দ্বিতীয়ত:ধর্ম রাজনীতি থেকে পৃথক নয়। ইতিহাসের দীর্ঘ পরিক্রমায় আল্লাহর নবীরা মানুষকে অত্যাচারী শাসকদের নিপীড়ন থেকে মুক্ত করার জন্য ব্যাপক প্রচেষ্টা চালিয়েছেন।

তৃতীয়ত : দায়িত্ব পালনের সঠিক মানদণ্ড হলো শারীরিক ও জ্ঞানগত যোগ্যতা,অর্থ-বিত্ত,বংশ-গৌরব বা পদ নয়।

২৪৮তম আয়াতে আল্লাহ পাক বলেছেন-

وَقَالَ لَهُمْ نَبِيُّهُمْ إِنَّ آَيَةَ مُلْكِهِ أَنْ يَأْتِيَكُمُ التَّابُوتُ فِيهِ سَكِينَةٌ مِنْ رَبِّكُمْ وَبَقِيَّةٌ مِمَّا تَرَكَ آَلُ مُوسَى وَآَلُ هَارُونَ تَحْمِلُهُ الْمَلَائِكَةُ إِنَّ فِي ذَلِكَ لَآَيَةً لَكُمْ إِنْ كُنْتُمْ مُؤْمِنِينَ

"বনী-ইসরাইলদেরকে তাদের নবী আরো বললেন,তালূতের (বলিষ্ঠ) নেতৃত্বের চিহ্ন হলো এই যে,তোমাদের কাছে একটা সিন্দুক আসবে যাতে থাকবে তোমাদের পালকর্তার পক্ষ থেকে তোমাদের মনের প্রশান্তি,আর তাতে থাকবে মূসা,হারুন এবং তাঁদের সন্তানবর্গের পরিত্যক্ত কিছু সামগ্রী। সিন্দুকটিকে বয়ে আনবে ফেরেশতারা। তোমরা যদি ঈমানদার হয়ে থাক,তাহলে এতে তোমাদের জন্য নিশ্চিতই পরিপূর্ণ নিদর্শন রয়েছে।" (২:৪৮)

যখন অবাধ্য ও একগুঁয়ে বনী ইসরাইলীরা তালুতের নেতৃত্ব মেনে নিতে রাজী হলো না,তখন তাদের নবী ইহুদীদেরকে আল্লাহর নির্দেশ মানতে বাধ্য করার জন্য বল্লেন। জেনে রাখ,আল্লাহ বনী ইসরাইলের পবিত্র সিন্দুককে তালুতের মাধ্যমে তোমাদের কাছে ফিরিয়ে আনবেন। এটা হলো সেই সিন্দুক বা বাক্স যাতে হযরত মুসা (আঃ)-র মা নবজাতক মুসাকে রেখেছিলেন এবং আল্লাহর নির্দেশে তা নীল দরিয়ায় ভাসিয়ে দিয়েছিলেন। এভাবে আল্লাহ মুসাকে ফেরাউনের সেনাদের হাত থেকে রক্ষা করেন। এরপর শিশু মুসা ফেরাউনের কাছে পৌঁছলে ফেরাউন ও তার স্ত্রীর হৃদয়ে মুসার প্রতি এত ভালবাসা জন্মায় যে তারা মুসাকে নিজেদের সন্তান হিসেবে গ্রহণ করে। এই সিন্দুকটিকে ফেরাউনের দরবারে রাখা হত এবং মুসা (আঃ) যখন নবুয়্যত লাভ করেন তখন তাতে তাওরাত গ্রন্থ রাখা হয়। মুসা (আঃ)'র মৃত্যুর সময় এতে তাঁর বর্ম ও অন্যান্য স্মৃতি চিহ্ন সংরক্ষণ করে তা বনী ইসরাইলের কাছে রাখা হয়। ইহুদীদের কাছে এই গ্রন্থ অত্যন্ত পবিত্র বলে বিবেচিত হত। যুদ্ধের সময় এই সিন্দুককে অগ্রভাগে রাখা হত যাতে সেনারা প্রশান্ত ও দৃঢ় চিত্তের অধিকারী হয়। কিন্তু সিন্দুকটি শত্রুদের হস্তগত হওয়ায় ইহুদীদের মধ্যে দুঃখ ও মর্মজ্বালা বিরাজ করছিল। অবশেষে তালুতের যুগে আল্লাহর সাহায্যের ফলে ঐ সিন্দুকটি পুনরায় ইহুদীদের কাছে ফিরে আসে।