এক ইসলামের মধ্যে কেন এত মাযহাব?


1.    আস সালামা আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহ,
সমস্ত প্রশংসা মহান রব্বুল আলামীনের জন্য যিনি আমাদেরকে ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় দিয়ে শেষ নবীর উম্মত ও একমাত্র তাঁরই অনুসারী হিসাবে পৃথিবীতে প্রেরণ করেছেন। অতঃপর সালাম ও দরূদ পেশ করছি আমাদের শেষ নবী ও রাসূল হযরত মুহাম্মদ (সাঃ), তাঁর পবিত্র বংশধর, তাঁর সত্যনিষ্ঠ সাথী গণের প্রতি।
অতঃপর আমি ও কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি আপনাকে ও অনুরূপ পাঠকবর্গকে যারা ইন্টারনেটের বাহারি চাকচিক্য ছেড়ে তাদের মূল্যবান সময় ব্যয় করে ইসলামের মাযহাব সম্পর্কে জানার ও বুঝার লক্ষ্যে আমাদের এই ক্ষুদ্র পরিসরে অংশ গ্রহণ করেছেন।
আলোচনা শুরুতেই আমি আপনাদেরকে অবহিত করছি যে আমাদের জ্ঞান হচ্ছে সীমিত, নবী রাসূল ও মাসুম ব্যক্তি বর্গেল জ্ঞান হচ্ছে নির্ভুল আর আল্লাহর জ্ঞান হচ্ছে অসীম ও বাস্তব হাকিকত। অতএব আমাদেরকে আমাদের এ সীমিত জ্ঞান দিয়েই নির্ভেজাল ইসলামকে জানা ও বাঝুর চেষ্টা চালিয়ে সঠিক আমল ও আখলাক সম্পর্কে অবগত হতে হবে এবং সে মাফিক আমল করারও সর্বাত্মক প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। একজন মুসলিম হিসেবে আমাদের প্রত্যেকের জন্য এটিই হচ্ছে সর্বাপেক্ষা বড় কর্তব্য। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য আমাদের সমাজে এমন সব রীতিনীতির প্রচলন ঘটেছে ও ঘটছে যেগুলো আমাদের পরস্পরকে এক কাতারে শামিল হতে বাধা প্রদান করছে। আমাদের মত ইসলামের অনুসারী  সকলেই নিজেকে মুসলিম হিসেবে দাবী করার পরেও কেন এই বিভিন্নতা ও বিচ্ছিন্নতা? অথচ ইসলামই হচ্ছে আমাদের একমাত্র ধর্ম, সঠিক পথের দিক নির্দেশক হিসেবে আমাদের নবীও একজন, আমরা একই কালিমা পাঠ করি, আমাদের কিবলা এক এবং আমাদের কোরআনও এক। অতএব কোন পথ অবলম্বন করলে আমরা এক পথে চলতে পারবো আমাদেরকে তা ভেবে দেখা দরকার।
বিশেষ করে বর্তমান বিশ্বে যখন আমেরিকা ও ইসরাইলসহ পাশ্চাত্য পন্থী সম্প্রদায় ইসলামেকে ধ্বংস করার লক্ষ্যে মুসলমানদের মাঝে সর্বদাই বিভেদ ও বিশৃংখলা লাগিয়ে আসছে, যাতে আমাদেরকে একে অপরেরর বিরুদ্ধে লাগিয়ে দিয়ে সবচেয়ে বেশি সুবিধা তারা অর্জন করতে পারে।
মাযহাবগত মতভেদ
কোন মাসআলা নিয়ে কথা উঠলে আমরা কেউ বলছি : আমাদের মালেকি মাযহাবে এরূপ নেই, কেউ বলছি আমাদের হাম্বলি মাযহাবে এমন বলা হয়নি, আমাদের হানাফি মাযহাবে এরূপ আছে, আমাদের শাফেয়ী বা জাফরী মাযহাবে এভাবে বলা হয়েছে, ইত্যাদি ইত্যাদি। আসলে কি ইসলামের দাবী ছিল এটাই? একজন মুসলিমের দাবী কি এরূপ হওয়া উচিত? তাহলে কি প্রশ্ন আসে না যে, পাঁচ ইমাম [1] বা অন্যান্য ইমামগণের আগমনের পূর্বের লোকেরা কোন মাযহাবের অনুসারী ছিলেন? মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লাম) ‘র ওফাত হলো এগারো হিজরিতে আর ইমাম –আবু হানীফা (রহঃ)– এর মৃত্যু হলো হিজরি দ্বিতীয় শতাব্দির শেষার্ধে, ইমাম জাফর সাদিক (আল্লাহ তার ওপর শান্তি বর্ষণ করুন) ’র ওফাত ১৪৮ হিজরিতে অতঃপর অন্যান্য ইমামগণ জন্ম গ্রহণ করেন। এ মধ্যবর্তি সময়ের লোকেরাও কি কোন মাযহাবের অনুসারী ছিলেন? কোন মাযহাবের অনুসারী থাকলে সে মাযহাবটির নাম কি ছিল? নিঃসন্দেহে প্রত্যেক বিবেকসম্পন্ন ব্যক্তি উত্তর দিবেন নিশ্চয় আল্লাহর রাসূল মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লাম) ‘র একমাত্র অনুসরণই ছিল তাদের মাযহাব, তাহলে সেই সময় অতীত হয়ে যাবার পরে কিভাবে আমরা নিজেদেরকে রাসূল (সাঃ) এর অনুসারী না বলে, আমি অমুক ইমামের অনুসারী আর সে অমুক ইমামের অনুসারী এরূপ কথা বলছি? তবে মুসলিম উম্মাহের এরূপ মাযহাবগত বিভক্তির কথা স্বয়ং মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লাম) ‘ই বলে গেছেন: তিনি বলেছেন আমার ভাই মূসা (আঃ) ’র পরে তার উম্মত অর্থাৎ বনি ইসরাঈল বিভক্ত হয়েছিল ৭১ টি ফেরকায় যার একটি ছিল বেহেশ্তি, আমার ভাই ঈসা (আঃ) ‘রপরে তার উম্মত বিভক্ত হয়েছিল ৭২ টি ফেরকায় যার একটি ছিল বেহেশ্তি, আর আমার উম্মত বিভক্ত হবে ৭৩ ফেরকায় যার মধ্যে মাত্র একটি ফেরকাই হবে বেহেশ্তি এবং বাকি সব হবে জাহান্নামি (সহীহ মুসলিম হা/১৯২০ ; তিরমিযী হা/২২২৯, তাফসীরে আহসানুল হাদীস, খন্ড ২, পৃ ১৫৮; তাফসীরে জামে’, খন্ড ১, পৃ ৫২৬; মাখজানুল এরফান, দার তাফসিরে কোরআন, খন্ড ৫, পৃ ১৬৫)।  অতএব বিষয়টি কি ভেবে দেখার নয়? অবশ্যই বিষয়টি নিয়ে আমাদের ভাবা উচিত ও অনুসন্ধান করা উচিত যে, কোন মাযহাব অধিকতর সত্ব পথে রযেছে? তবে আমার এ কথার দ্বারা কোন মাযহাবের অনুসারীকেই খাটো করে দেখা হচ্ছে এরূপ ভাবা ঠিক হবে না। কারণ তা গবেষণামূলক বিষয় অর্থাৎ আলেমদের কাজ।
কোন মাযহাবের ফতোয়া অধিকতর সঠিক
যদি কেউ বলেন : অবশ্যই আমাদের একটি নির্দিষ্ট মাযহাবের অনুসরণ করা জরুরী, তাহলে যিনি এ কথা বলবেন তাকে বলব : এখানে আজকে যারা সমবেত হয়েছি আমাদের মধ্য থেকে পাঁচ জন পাঁচ মাযহাবের অনুসারী হিসেবে যদি দাবী করি আর প্রত্যেকেই যদি বলি আমার মাযহাব সঠিক আমার মাযহাব সঠিকআর আমার মাযহাবই হক্বের উপর প্রতিষ্ঠিত, তাহলে কি প্রত্যেকের দাবী অনুযায়ী হক্ব পাঁচটি হয়ে যায় না? এভাবে একটি মাসআলার ক্ষেত্রে পাঁচ মাযহাবের পাঁচ জন পাঁচ ধরণের সিদ্ধান্ত দিলে পাঁচটি মতই কি হক্ব হিসেবে গণ্য হবে? এভাবে ইসলাম কি পাঁচটি হয়ে যাচ্ছে না? তাহলে আমরা কি ইসলামকে ভাগ করে ফেলছি না? না ভাই তা হতে পারে না, বরং তার মতটিই হক্ব হিসেবে ধরা যাবে যার মতটি বিশুদ্ধ ও সহীহ দলীল নির্ভরশীল। প্রত্যেককেই প্রমাণ উপস্থিত করতে হবে। আর দলীলের ভিত্তিতে এক জনের মতই সঠিক হবে, আর অন্যদেরকে সঠিক দলীলের মতকে মেনে নিতে হবে। আপনি যদি আপনার মাযহাবকে হক্ব মনে করেন, তাহলে আপনাকে আপনার মাযহাবের স্বপক্ষে দলীল উপস্থাপন করতে হবে। অন্যথায় আপনি কারো মুখে শুনে দলীল ছাড়া কথা বলবেন তা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
হক্বপন্থি দল মাত্র একটি
হক্বপন্থি দল হবে একটিই। তাইতো রাসূল (সাঃ) বলে গেছেন : “আমার উম্মাতের মধ্য থেকে একটি দলই হক্বের উপর সুপ্রতিষ্ঠিত থাকবে…।” তিনি আরো বলেছেন : “আমি আমার উম্মাতের পথভ্রষ্টকারী (বিদআত ও ফিসক-ফুযুরের দিকে আহ্বানকারী) ইমামদের (আলেমদের) ব্যাপারে ভয় করছি।” আবু দাউদ হা/৪২৫২ ; জামেউস সাগীর হা/২৩১৬। অতএব এ শ্রেনীর আলেম যে বর্তমান যুগে নেই তা বলা যাবে না, বরং আছে এটিই সত্য। এ জন্যই আল্লাহ তা’য়ালা প্রত্যেক মুসলমানের জন্য প্রতি নামাযে অন্ততঃ দুই বার পড়তে বলেছেন :
اهْدِنَا الصِّرَاطَ الْمُسْتَقِيمَ
صِرَاطَ الَّذِينَ أَنْعَمْتَ عَلَيْهِمْ غَيرِْ الْمَغْضُوبِ عَلَيْهِمْ وَ لَا الضَّالِّين
অর্থ : হে আল্লাহ আমাদেরকে সরল পথ দেখাও,
তাদের পথ যাদেরকে তুমি অনুগ্রহ দান করেছ। তাদের পথ নয়, যাদের প্রতি তোমার গজব নাযিল হয়েছে এবং যারা পথভ্রষ্ট হয়েছে।
অতএব কোরআনী দলিল ছাড়া কোন মুসলামানের এ কথা বলা জায়েয নয় যে, একমাত্র আমার মাযহাব ছাড়া অন্য সব মাযহাব বা অমুক মাযহাব বাতিল বা কাফের। আর কাউকে কাফের বললে সে যদি আল্লাহর কাছে কাফের বলে পরিগণিত না হয়, তবে আল্লাহ তা’য়ালা ঐ বক্তাকেই কাফের বলে সাবস্ত করবেন এবং কেয়ামতের দিন তাকে কাফেরদের কাতারে দার করাবেন।(-আল হাদীস)
এ কারণেই হক্বকে খুঁজে বের করার ক্ষেত্রে আমাদেরকে সর্বত্মক চেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। লক্ষ্য করুন ! আমাদের দুনিয়ার কোন কিছুর ক্ষেত্রে দু’জনের মধ্যে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হলে, দলীল বা সাক্ষী ছাড়া কাউকে আমরা সত্যবাদী হিসেবে মানিনা , শুধু তাই নয়, দলীল যাচাই–বাছাইও করা হয় এবং সাক্ষীকে জেরা করার দ্বারা সত্য উদঘাটন করার চেষ্টা করা হয়। অতঃপর যার দলীল এবং সাক্ষী বেশী শক্তিশালী হিসেবে প্রমাণিত হয় তার পক্ষেই রায় প্রদাণ করা হয়। দুনিয়ার বিষয়ের ক্ষেত্রে যদি এরূপ অবস্থা হয় তাহলে ইসলামের ক্ষেত্রে কেন এবং কিভাবে দলীল ছাড়া কারো কথা গ্রহণযোগ্য হবে?  দুনিয়ার ব্যাপারে যদি পারস্পরিক দ্বন্দ্বের সময় দলীল ও সাক্ষীর প্রয়োজন হয় –যার কারণে সাধারণত জান্নাতী এবং জাহান্নামী হওয়ার প্রসংগ আসে না, তাহলে কোন ইসলামী বিষয়ে মতবিরোধ সৃষ্টি হলে সে ক্ষেত্রে তো দলীলের প্রয়োজন আরও বেশী হওয়ার কথা। কারণ সঠিক ইসলামের জ্ঞান লাভ করে তার উপর আমল করা আর না করার উপরেই জান্নাতী ও জাহান্নামী হওয়াটা নির্ভর করে, যা অত্যন্ত জটিল বিষয়। অতএব আমরা যদি কোন আমল করি তাহলে সে আমলের স্বপক্ষে সহীহ বিশুদ্ধ হাদীসের দলীল আছে কিনা তা আমদেরকে অবশ্যই জানতে হবে।
জাল হাদীস বিবেকবান লোকের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়
বাজারে গেলে কোন ক্রেতাই পচাষড়া মাছ বা অন্য কোন পচা পণ্য খরিদ করেন না, বরং বাজরে ঘুরে ঘুরে দেখে ভাল পণ্যই খরিদ করে থাকেন। তাহলে ইসলামের মধ্যে যখন ভেজাল ঢুকেই গেছে আর ভেজাল ঢুকবে এরূপ ভবিষ্যৎ বাণীও করা হয়েছে তখন বেছে সঠিক আমল আক্বীদার উপর আমল করেই আমাদেরকে চলতে হবে এবং এটা আমাদের জন্য এক বিরাট পরীক্ষাও বটে।
জাল হাদীসের প্রচার ও প্রসার
সহীহ বিশুদ্ধ হাদীস সন্ধনের কথা এ কারণে বলছি যে, আমাদের মুসলিম সমাজের মধ্যে অনৈসলামিক রীতিনীতির প্রবেশ ঘটেছে, ইসলাম বিরোধী চক্র ইয়াহুদী ও খ্রীষ্টান কর্তৃক ইসলাম ধর্মকে ভেজাল মিশ্রিত করার জন্য যুগে যুগে প্রচেষ্টা চলেছে এখনও চলছে, আর এর ফলেই সৃষ্টি হয়েছে জাল ও বানোয়াট হাদীসের। আল্লাহর পক্ষ থেকে দলীল লাভ করা ছাড়া তাঁর রাসূল (সাঃ) কোন কথাই বলেননি, কিন্তু তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে এ উম্মাতের মাঝে এমন বহু লোক আসবে দুনিয়ার স্বার্থ সিদ্ধির জন্য তাদের অনেকে অনেক কিছু নিজেদের পক্ষ থেকে বানিয়ে বলবে। তাই তিনি সতর্ক করে বলেন : “যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে আমার উপর মিথ্যারোপ করল সে যেন জাহান্নামে তার স্থান বানিয়ে নিল” (বুখারী; মুসলিম)। “যে ব্যক্তি আমার নিকট হতে এমন ধরনের হাদীস বর্ণনা করবে, ধারনা করা যাচ্ছে যে, সেটি মিথ্যা। সে ব্যক্তি মিথ্যুকদের একজন বা দুই মিথ্যুকের একজন” (মুসলিম)।
জাল হাদিস প্রচারের পরিণাম
“আমার উপর মিথ্যারোপ করা তোমাদের পরস্পরের মাঝে মিথ্যারোপের মত নয়। যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে আমার উপর মিথ্যারোপ করল সে তার স্থান জাহান্নামে বানিয়ে নিল” (মুসলিম)। “যে ব্যক্তি আমার উদ্ধৃতিতে এমন কথা বলল যা আমি বলিনি, সে তার স্থান জাহান্নামে বানিয়ে নিল” (ইবনু হিব্বান)। এ হাদীস গুলো প্রমাণ করছে যে, ইচ্ছাকৃতভাবে রাসূল (সাঃ) এর উদ্ধৃতিতে কিছু বানিয়ে বলুক আর অনিচ্ছাকৃতভাবে বানিয়ে বলুক উভয় অবস্থায় তাঁর উদ্ধৃতিতে কিছু বানিয়ে বললে সে জাহান্নামী। কারণ শেষের হাদীসটিতে ইচ্ছাকৃতভাবে এ কথা উল্লেখ করা হয় নি। এই হাদীস গুলো আরো প্রমাণ করছে যে, তাঁর উম্মাতের মধ্যে তাঁর উদ্ধৃতিতে জাল-যঈফ হাদীসের প্রসার ঘটবে এবং বাস্তবেও তা ঘটেছে এবং প্রত্যেক মাযহাবের বিজ্ঞ মুহাদ্দিসগণ জাল ও যঈফের ব্যাপারে সতর্ক করে গ্রন্থ রচনাও করেছেন। যদি জাল ও যঈফ হাদীসের প্রসার এ উম্মাতের মধ্যে না ঘটতো তাহলে রাসূল (সাঃ) এর উপরোক্ত বাণীগুলো অনর্থক বলেছেন বলে গণ্য হতো। অথচ আমরা সকলে জেনেছি তিনি ওহীর মাধ্যম ছাড়া কোন কথা বলেননি। আর ওহীর মাধ্যমে যা পাওয়া যায় তা অর্থহীন হতে পারে না। আর আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সাঃ) থেকে কোন অর্থহীন বেকার কথা বের হতেও পারে না।
জাল হাদিসের ব্যাপারে রাসূলের ভবিষ্যত বাণী
রাসূল (সাঃ) আরো বলেন : “অবশ্যই তোমরা তোমাদের পূর্ববর্তীদের অনুসরণ করবে বিঘতে বিঘতে ও হাতে হাতে এমনকি তারা যদি দব নামক জন্তুর গর্তে প্রবেশ করে তাহলে সে ক্ষেত্রেও তোমরা তাদের অনুসরণ করবে। আমরা বললাম : তারা কি ইয়াহুদ ও নাসারা হে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) ! তিনি বললেন : তারা ছাড়া আর কারা” – বুখারী হা/৭৩২০ ; মুসলিম হা/২৬৬৯।
অর্থাৎ তারা যেমন দ্বীনের মধ্যে নবাবিস্কার করে ধর্মীয় রীতিনীতিগুলো নিজেদের প্রবৃত্তি অনুযায়ী বানিয়ে নিয়েছিল, মুসলিমগণের মাঝেও অনুরুপ কর্মকারীদের আবির্ভাব ঘটবে এবং এরাও এ ক্ষেত্রে তাদের হুবহু অনুসরণ করবে। অতএব আমাদেরকে বেছে বেছে, দেখেশুনে সহীহ দলীল নির্ভর আমল করতে হবে, তাহলেই আমরা মুত্তাকী হতে পারবো এবং আখেরাতে মুক্তি পাওয়ার আশা করতে পারবো। আমাদেরকে জানতে হবে আমরা যে আমল করছি, আমরা যে আক্বীদাহ পোষণ করছি সেগুলোর সমর্থনে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সাঃ) এর বাণী হতে সহীহ দলীল রয়েছে কিনা? কারণ আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে তাঁর রাসূল (সাঃ) এর আনুগত্য করার নির্দেশ দিয়ে বলেছেন, :
وَ مَا ءَاتَئكُمُ الرَّسُولُ فَخُذُوهُ وَ مَا نهََئكُمْ عَنْهُ فَانتَهُواْ
“রাসূল (সাঃ) তোমাদেরকে যা দেন তা গ্রহণ কর এবং যা থেকে নিষেধ করেন তা থেকে বিরত থাক এবং আল্লাহকে ভয় কর, নিশ্চয়ই আল্লাহ কঠোর শাস্তিদাতা।” (সূরা হাশর : ৭)। তিনি কোন ইমাম, আলেম, পীর মাশায়েখের আনুগত্য করার নির্দেশ দেননি। হাঁ উক্ত ব্যক্তিগণ যদি আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সাঃ) এর সহীহ দলীল-নির্ভর কথার দিকে দাওয়াত দেন, দিক নির্দেশনা দেন, চলার জন্য উৎসাহিত করেন তাহলে অবশ্যই তাদের মাধ্যমে আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল (সাঃ) এর অনুসরণ করতে হবে। তবে সেই আলেম বা হুজুর আমাদেরকে যে কথা বলছেন বা শুনাচ্ছেন বা যা করতে বলছেন সেটি কি সঠিক কিনা তা আমাদেরকে জেনে নিতে হবে, যাচাই-বাছাই করে নিতে হবে। কারণ আল্লাহ আমাদেরকে বিবেক দিয়েছেন ভাল-মন্দ দেখে ও জেনে-বুঝে নেয়ার জন্যই। উদাহরণ স্বরূপ আমরা মাছের বাজারে গেলে যেরুপ পচা মাছ ক্রয় করি না, বেছে যেটি ভাল মাছ সেটি ক্রয় করি, অনুরুপভাবে আমাদের ধর্মীয় আমলের ক্ষেত্রেও একই নীতি অবলম্বন করে সহীহ দলীল-নির্ভর আমলকেই বেছে নিয়ে সে মাফিক আমল করতে হবে। যাতে আমাদেরকে পথভ্রষ্টদের অন্তর্ভুক্ত হতে না হয়। আল্লাহ রব্বুল আলামীন আরো বলেছেন :
فَلَا وَ رَبِّكَ لَا يُؤْمِنُونَ حَتىَ‏ يُحَكِّمُوكَ فِيمَا شَجَرَ بَيْنَهُمْ ثُمَّ لَا يجَِدُواْ فىِ أَنفُسِهِمْ حَرَجًا مِّمَّا قَضَيْتَ وَ يُسَلِّمُواْ تَسْلِيمًا
“অতএব তোমার পালনকর্তার কসম, তারা ঈমানদার হবে না যতক্ষণ না তাদের মধ্যে সৃষ্ট বিবাদের ব্যাপারে তোমাকে ন্যায়বিচারক বলে মনে না করে। অতঃপর তোমার মীমাংসার ব্যাপারে মনে কোন রকম সংকীর্ণতা রাখবে না এবং তা হৃষ্টচিত্তে কবুল করে নেবে।” – সূরা নিসা : ৬৫। এখানে দ্বন্দ্বের সময় রাসূল (সাঃ) কতৃক প্রদানকৃত সমাধানকে যারা মেনে নিবে না এবং মেনে নিতে সংকোচবোধ করবে তারা ঈমানদার হতে পারবে না এ সাবধান বানী উচ্চারণ করা হয়েছে। আল্লাহ রব্বুল আলামীন আরো বলেছেন :
“তোমরা রাসূল (সাঃ) এর আহ্বানকে তোমাদের এক অপরকে আহ্বানের মত গণ্য করো না। আল্লাহ তাদেরকে জানেন তোমাদের মধ্যে যারা চুপিসারে কেটে পড়ে। অতএব যারা তাঁর (রসূলের) আদেশের বিরুদ্ধাচরণ করে, তারা এ বিষয়ে সতর্ক হোক যে, বিপর্যয় তাদেরকে স্পর্শ করবে অথবা যন্ত্রনাদায়ক শাস্তি তাদেরকে গ্রাস করবে।” – সূরা নূর : ৬৩।
রাসূলের সুন্নত ও মাযহাবের ইমাম গণের বিবৃতি
দুনিয়ার কোন আলেম বুজুর্গ এ মর্মে প্রমাণ উপস্থাপন করতে পারবেন না যে আল্লাহর বাণী ও তাঁর রসূলের (সাঃ) সুন্নাতকে বাদ দিয়ে কোন ইমাম বা আলেমের আনুগত্য করা যায় বা জায়েজ আছে। এ কারণেই আমরা এখানে ইমামগেণের কতিপয় ঐতিহাসিক উক্তি আপনাদের সম্মুখে উপস্থাপন করছি : ইমাম আবু হানীফা বলেন : “যখনই হাদীস সহীহ্ হিসেবে প্রমাণিত হবে তখনই সেটি আমার মাযহাব ”। (এ কথাটি প্রত্যেক ইমামই বলেছেন)। তিনি আরো বলেন : “আমি যখন এমন কোন কথা বলবো যা কিতাবুল্লাহ ও রাসূল (সাঃ) এর হাদীস বিরোধী তখন তোমরা আমার কথাকে ত্যাগ করবে”। তার ছাত্র ইমাম আবু ইউসুফ সব কিছু লিখে রাখতেন, তাই তাকে উদ্দেশ্য করে বলেন : “হে ইয়াকুব ( আবু ইউসুফ ) ! তুমি আমার থেকে যা কিছু শ্রবণ করো তার সব কিছুই লিখ না, কারণ কোন বিষয়ে আমি আজকে একটি মত প্রদান করি, আবার কালকে সে মতকে ত্যাগ করি। কালকে একটি মত প্রদান করি আবার কালকের পরের দিন সে মতকে ত্যাগ করি”।
ইমাম শাফেঈ বলেন : “যে ব্যক্তির নিকট রাসূল (সাঃ) এর সুন্নাত স্পষ্ট হয়ে যাবে সে ব্যক্তির জন্য অন্য কোন ব্যক্তির কথার (মতের) কারণে রাসূল (সাঃ) এর সুন্নাতকে ত্যাগ করা বৈধ (হালাল) নয়”। তিনি আরো বলেন : “তোমরা যখন আমার কিতাবে রাসূল (সাঃ) এর সুন্নাত বিরোধী কোন কিছু পাবে তখন তোমরা আমি যা বলেছি তা ত্যাগ করে রাসূল (সাঃ) এর সুন্নাতকে প্রচার করবে”। অন্য বর্ণনায় এসেছে, “যে কোন বিষয়ে মুহাদ্দেসীনদের নিকট যদি রাসূল (সাঃ) থেকে সহীহ্ হাদীস বর্ণিত হয় যা আমার কথা (মত) বিরোধী তাহলে আমি সে বিষয়ে যে কথা বলেছি সে কথা থেকে আমার জীবদ্দশায় এবং আমার মৃত্যুর পরেও প্রত্যাবর্তন করছি”।
ইমাম মালেক বলেন : “আমি একজন মানুষ। সিদ্ধান্ত দিতে গিয়ে ভুল করি আবার সঠিকও করি। অতএব তোমরা আমার সিদ্ধান্তের দিকে দৃষ্টি দাও সেগুলোর যেটি কিতাবুল্লাহ ও নবী (সাঃ) এর সুন্নাতের সাথে মিলে তোমরা সেটি গ্রহণ কর আর যেগুলো কিতাবুল্লাহ ও নবী (সাঃ) এর সুন্নাতের সাথে না মিলবে সেগুলোকে বর্জন কর”। তিনি অন্যত্র বলেন : “নবী (সাঃ) এর পরে এমন একজন ব্যক্তিও নেই যার কথা গ্রহণীয় আবার বর্জনীয় নয়।  একমাত্র নবী (সাঃ) এর কথা (সুন্নাত) বর্জনীয় নয়”।
ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্বাল বলেন : “তুমি আমার অন্ধ অনুসরণ করো না, ইমাম মালেকের অন্ধ অনুসরণ করো না, ইমাম শাফে’ঈ, আওযা’ঈ ও সাওরীর অন্ধ অনুসরণ করো না বরং তুমি সেখান থেকেই গ্রহণ করো যেখান থেকে তারা গ্রহণ করেছে”। তিনি আরো বলেন : “ইমাম আওযা’ঈ, ইমাম মালেক ও ইমাম আবু হানীফা সহ সকলের মতামত গুলো ব্যক্তি সিদ্ধান্ত, সেগুলো আমার নিকট সমান (কারো মতের অন্যের উপর অগ্রাধিকার নেই), দলীল রয়েছে শুধুমাত্র হাদীসের মধ্যে”। তিনি অন্যত্র বলেন : “যে ব্যক্তি রাসূল (সাঃ) এর (সহীহ্) হাদীসকে প্রত্যাখ্যান করবে সে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে উপনীত”।
উপরোক্ত বাণীগুলো শাইখ নাসিরউদ্দীন আলবানী তার বিখ্যাত গ্রন্থ “সিফাতু সালাতিন নবী (সাঃ)” গ্রন্থে দলীল সহকারে উপস্থাপন করেছেন। মনে রাখতে হবে প্রতিটি মাযহাবের মধ্যেই হক্ব রয়েছে, কিন্তু প্রতিটি মাযহাবের সব কিছুই হক্ব নয়, বরং প্রতিটি মাযহাবের যে মাসআলাটিই সহীহ হাদীস ভিত্তিক সেটিই হক্ব আর আমাদের সেটিকেই গ্রহণ করতে হবে। এ অর্থে যারা ইমামগণের ভাষ্য অনুযায়ী সহীহ হাদীস ভিত্তিক আমল করবে তারা পূর্ণরুপে পাঁচ ইমামেরও প্রকৃত অনুসরণকারী এবং পাঁচ মাযহাবেরও অনুসারী। আর যারা দূর্বল হাদীসের উপরে ভিত্তি করে বলা মতকে গ্রহণ করবে তারা ইমামগণের প্রকৃত অনুসরণকারী হবেন না এবং তাদের মাযহাবেরও অনুসরণকারী হিসেবে গণ্য হবেন না। ইমামগণ তাদের ইনসাফ ভিত্তিক কথার দ্বারা তাদের থেকে সংঘটিত ভুল ত্রুটিগুলো থেকে মুক্ত হয়ে গেছেন। কিন্তু আমরা যারা অন্ধভক্তি দেখিয়ে তাদের উদ্ধৃতিতে বর্ণিত দূর্বল কথাগুলোকেও গ্রহণ করে থাকি আমাদের উপায় কি হবে? আমরা কি একটুখানি ভেবে দেখেছি। তাদের কারো কারো যুগে নবী (সাঃ) এর সব হাদীস সংকলিত হয়নি। ফলে তারা অনেক সময় ইজতিহাদ করে সমাধান দিয়ে যান, কিন্তু পরবর্তিতে দেখা যায় তাদের কিছু কিছু সমাধান সহীহ হাদীস বিরোধী হয়ে গেছে। ফলে তাদের উপরোক্ত বাণীগুলোর কারণে সহীহ হাদীসকে গ্রহণপূর্বক আমল করাই হচ্ছে ঈমানের প্রকৃত দাবী।
পরিশেষে একটি বিষয়ে গবেষণা করার জন্য প্রিয় পাঠকবর্গের কাছে আবেদন করছি। তা হল :
পৃথিবীতে যখন দুই জন লোক অর্থাৎ হযরত আদম ও হাওয়া (আঃ) ছিলেন তখনো একজন আল্লাহর মনোনীত ইমাম ও রাহবার ছিল যাতে প্রতিপক্ষের জন্য হুজ্জাত বা দলিল হিসেবে থাকে। তার পরথেকে আমাদের শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ সঃ পর্যন্ত প্রতি যুগেই আল্লাহর মনোনীত নবী/রাসূল/ইমাম বা হুজ্জাত ছিল। এখন তো কোন নবী থাকতে পারে না, তাহলে কি আজকের যুগে ৬১০ কোটি লোকের জন্য আল্লাহর মনোনীত  কোন ইমামা বা হুজ্জাত থাকবে না? এ বিষয়ে কোরআন বা হাদীস কী বলে?
যদি থেকে থাকে সে কে?
এ প্রশ্নের উত্তর দেয়া বা জানার জন্য নিম্নলিখিত ই মেইলে যোগাযোগ কররুন :
Samiul66@yahoo.com
ধন্যবাদ

-চলবে-
________________________________________
[1]। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের আলেমগণ বরাবরই ইসলামের মাযহাব বলতে চার মাযহাবের কথাই উল্লেখ করে থাকেন। কিন্তু ইনসাফ হল পাঁচ মাযহাবের সিকৃতি প্রদান। কারণ যখন কোন আলেমকে জিজ্ঞেস করা হয় যে, বিশ্বের মুসলমানের সংখ্যা কত? তখন তারা নিঃসংকোচে শিয়া তথা জাফরী মাযহাবের অনুসারীদেরকেও হিসেব করে থাকেন। অথচ জাফরী মাযহাবের অনুসারীবৃন্দ সূন্নি মাযহাবের অনুসারীদেরকে সুন্নি ভাই বলে আখ্যায়িত করে থাকেণ। শিয়ারা যদি এমন উদার হতে পারে, তবে আমরা কেন নিজেদেরকে মুসলমান দাবী করে এবং রাসূল (সঃ) এর আদর্শের অনুসারী হয়ে তাদেরকে সিকৃতি দিতে পারব না? একতরফা বিচার তো ইসলামের দাবী হতে পারে না!