সূরা আলে ইমরান;(২য় পর্ব)

সূরা আলে ইমরান; আয়াত ৮-১৩

সূরা আলে ইমরানের ৮ এবং ৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

 
رَبَّنَا لَا تُزِغْ قُلُوبَنَا بَعْدَ إِذْ هَدَيْتَنَا وَهَبْ لَنَا مِنْ لَدُنْكَ رَحْمَةً إِنَّكَ أَنْتَ الْوَهَّابُ  (৮)رَبَّنَا إِنَّكَ جَامِعُ النَّاسِ لِيَوْمٍ لَا رَيْبَ فِيهِ إِنَّ اللَّهَ لَا يُخْلِفُ الْمِيعَادَ (৯)



"জ্ঞানী লোকেরা বলে,হে আমাদের পালনকর্তা! সরল পথ দেখানোর পর তুমি আমাদের অন্তরকে আর বাঁকা করে দিও না এবং তোমার পক্ষ থেকে আমাদেরকে অনুগ্রহ দান কর। তুমিই সব কিছুর দাতা।" (৩:৮)
"হে আমাদের পালনকর্তা! তুমি মানুষকে একদিন অবশ্যই একত্রিত করবে: এতে কোন সন্দেহ নেই। নিশ্চয় আল্লাহ প্রতিশ্রুতি লঙ্ঘন করেন না।" (৩:৯)

গত পর্বের আলোচনায় আমরা বলেছিলাম কোরআনের আয়াতের ব্যাপারে জ্ঞানীদের মধ্যে দু'টি দল রয়েছে। এদের একদল নিজেরাই বিভ্রান্ত এবং কোরআনের অর্থ বিকৃতির মাধ্যমে তারা নিজেদের বিকৃত মতামতের যুক্তি দেখাতে চায়। কিন্তু অন্য একদল প্রকৃত জ্ঞানকে কাজে লাগিয়েছেন এবং জ্ঞানের গভীরে প্রবেশ করেছেন। এই দল আল্লাহর বিধানের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে এবং আল্লাহ কোরআনের আয়াত দিয়ে যা যা বোঝাতে চেয়েছেন তা-ই অনুধাবন করেন ও প্রয়োজনে তা বর্ণনা করেন। কিন্তু জ্ঞানী লোকেরাও ভুল করতে পারেন। তাই দূরদর্শী জ্ঞানীরা তাদের জ্ঞান ও ঈমান থাকা সত্ত্বেও তাদের অন্তরকে সব ধরনের বিচ্যুতি ও ভুল ত্রুটি থেকে রক্ষার জন্য আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেন যাতে বিভ্রান্ত দলের অন্তর্ভূক্ত না হন। এই সব জ্ঞানী লোক কিয়ামত বা পুনরুত্থানকে সব সময়ই নিজেদের সামনে উপস্থিত দেখতে পান এবং প্রমাণ ছাড়া কোন কিছুকে আল্লাহর বক্তব্য বলে উল্লেখ করেন না। কারণ তারা জানেন এ ধরনের বক্তব্যের জন্য একদিন আল্লাহর বিচারালয়ে জবাবদিহি করতে হবে এবং ঐ আদালতকে বিন্দুমাত্র ফাঁকি দেয়াও অসম্ভব। ভুল বা দুশ্চিন্তার জন্য ওয়াদা খেলাপ করা অথবা অক্ষমতা বা ভয় পাওয়া এসবের কোনটিই আল্লাহর পবিত্র সত্ত্বায় দেখা যায় না।

এই দুই আয়াতের মূল শিক্ষা হলো,আমরা যেন নিজেদের ঈমান ও জ্ঞান নিয়ে অহংকার না করি। বহু জ্ঞানী ব্যক্তি সেবার পরিবর্তে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে এবং অনেক মুমিন শেষ পর্যন্ত কাফের ও ধর্মহীন বা বেদ্বীন অবস্থায় মারা গেছেন।

সূরা আলে ইমরানের ১০,১১ ও ১২ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-


إِنَّ الَّذِينَ كَفَرُوا لَنْ تُغْنِيَ عَنْهُمْ أَمْوَالُهُمْ وَلَا أَوْلَادُهُمْ مِنَ اللَّهِ شَيْئًا وَأُولَئِكَ هُمْ وَقُودُ النَّارِ  (১০) كَدَأْبِ آَلِ فِرْعَوْنَ وَالَّذِينَ مِنْ قَبْلِهِمْ كَذَّبُوا بِآَيَاتِنَا فَأَخَذَهُمُ اللَّهُ بِذُنُوبِهِمْ وَاللَّهُ شَدِيدُ الْعِقَابِ (১১) قُلْ لِلَّذِينَ كَفَرُوا سَتُغْلَبُونَ وَتُحْشَرُونَ إِلَى جَهَنَّمَ وَبِئْسَ الْمِهَادُ (১২)

"নিশ্চয়ই যারা অবিশ্বাস করে,তাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি আল্লাহর শাস্তির মোকাবেলায় কোন কাজে আসবেনা এবং তারাই হবে দোযখ বা নরকের জ্বালানী ।" (৩:১০)
"হে নবী,মক্কার কাফেররা ফেরাউন ও তাদের পূর্ববর্তীদের মতই আমার নিদর্শনাবলী ও কোরআনের আয়াতকে মিথ্যা মনে করেছে। তাই আল্লাহ তাদেরকে পাকড়াও করেছেন,আর শাস্তি দেওয়া বা প্রতিশোধ নেয়ার ক্ষেত্রে আল্লাহ অত্যন্ত কঠোর।" (৩:১১)
"যারা আমার নিদর্শনকে অবিশ্বাস করেছে তাদেরকে বলুন,শীঘ্রই তোমরা পরাজিত হবে এবং তোমাদেরকে জাহান্নামে জড়ো করা হবে। জাহান্নাম খুবই নিকৃষ্ট।" (৩:১২)

মহান আল্লাহ এই তিন আয়াতে রাসুল (সা.) ও মুসলমানদের উদ্দেশ্য করে বলেছেন ,কাফেরদের ধন সম্পদ ও জনবল যেন তোমাদেরকে ভীত বিহবল না করে। এগুলো শুধু দুনিয়াতেই সীমিত থাকবে। কিয়ামতের দিন এসবের কোন কিছুই কাফেরদের কোন উপকারে আসবেনা। কারণ,কাফেরদের শরীর জাহান্নামের আগুনের জ্বালানী হবে। তাই কোন ব্যক্তি বা সম্পদই অবিশ্বাসীদের বা কাফেরদেরকে নরকের আগুন থেকে রক্ষা করতে পারবেনা। এরপর আল্লাহ তৎকালীন মুসলমানদেরকে এটা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন যে,সে যুগের কেউ কেউ যে শুধু আল্লাহ ও তার কিতাবকে অবিশ্বাস করেছে বা তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ বাধাবার উপক্রম করেছে তা নয়। বরং সকল যুগেই বিভিন্ন জাতি সত্যের মোকাবেলায় এ ধরনের পদ্ধতি ব্যবহার করেছে। কিন্তু তাদের কেউ-ই সত্যকে ধ্বংস করতে পারেনি বরং নিজেরাই ধ্বংস হয়ে গেছে। এমনকি পরাক্রমশালী ফেরাউন আল্লাহর মোকাবেলায় এক মুহুর্তের জন্যেও প্রতিরোধ করতে পারেনি। শেষোক্ত আয়াতে মদীনা ও মক্কার কাফের মুশরিকরা শিগগিরই কুফরীর শাস্তি হিসেবে মুসলমানদের হাতে পরাজিত হবে বলে রাসুল (সা.)'র প্রতি ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে।
এই তিন আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো,

প্রথমত : আমরা যেন বংশ,সন্তান ও সম্পদের প্রতি আসক্ত না হই। কাফেররাই তাদের সন্তান এবং সম্পদের মধ্যে নিজেদের মুক্তি বা পরিত্রাণ রয়েছে বলে মনে করে।
দ্বিতীয়ত : কুফরী চিন্তাভাবনা ও ভ্রান্ত-কার্যকলাপ মানুষের পরিচিতিকে বদলে দেয়। এর ফলে মানুষ জড়বস্তুর কাতারে স্থান পায় এবং জাহান্নামের আগুনের জ্বালানী হয়।
তৃতীয়ত : পাপ করা অন্যায়। কিন্তু পাপে অভ্যস্ত হওয়া বা মনে প্রাণে আসক্ত হওয়া জঘন্যতর এবং এর পরিণতি হয় মারাত্মক।


চতুর্থত : কুফরী শক্তি পরাজিত হতে বাধ্য এবং অবশেষে সত্যই বিজয়ী হবে।

এই সূরার ১৩ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-


قَدْ كَانَ لَكُمْ آَيَةٌ فِي فِئَتَيْنِ الْتَقَتَا فِئَةٌ تُقَاتِلُ فِي سَبِيلِ اللَّهِ وَأُخْرَى كَافِرَةٌ يَرَوْنَهُمْ مِثْلَيْهِمْ رَأْيَ الْعَيْنِ وَاللَّهُ يُؤَيِّدُ بِنَصْرِهِ مَنْ يَشَاءُ إِنَّ فِي ذَلِكَ لَعِبْرَةً لِأُولِي الْأَبْصَارِ (১৩)

"নিশ্চয়ই দুটো দলের মোকাবিলার মধ্যে তোমাদের জন্য নিদর্শন ছিল। একটি দল আল্লাহর পথে যুদ্ধ করেছিল। আর অপর দল ছিল অবিশ্বাসী। এরা বিশ্বাসীদেরকে দ্বিগুন দেখছিল এবং এর ফলে কাফেররা ভীত হয়ে পড়েছিল। আর আল্লাহ যাকে ইচ্ছে করেন নিজের সাহায্যের মাধ্যমে শক্তি দান করেন। নিশ্চয়ই এতে অন্তর্দৃষ্টি সম্পন্নদের জন্য অনেক শিক্ষা রয়েছে।" (৩:১৩)

হযরত মোহাম্মদ (সা.) ও মুসলমানরা দীর্ঘ ১৩ বছর ধরে মক্কার মুশরিকদের হাতে নির্যাতিত ও লাঞ্ছিত হচ্ছিল। এরপর শত্রুরা যখন আল্লাহর রাসুল (সা.) কে হত্যার ষড়যন্ত্র করে,তখন আল্লাহর নির্দেশে রাসুলে খোদা ও মুসলমানরা মক্কা থেকে মদীনায় হিজরত করেন। হিজরতের দু'বছর পর বদর নামক এলাকায় মক্কার কাফের মুশরিকদের সাথে মুসলমানদের যুদ্ধ হয়। ঐ যুদ্ধে মুসলমানদের সংখ্যা ছিল ৩১৩ জন আর মুশরিকদের সংখ্যা ছিল এক হাজার। কিন্তু তা সত্ত্বেও শত্রুপক্ষের ৭০ জন নিহত ও আরো ৭০ জন বন্দী হয় এবং তারা মুসলমানদের কাছে পরাজিত হয়। এই আয়াতে মুসলমানদের বিজয়ের পেছনে খোদায়ী সাহায্য থাকার কথা উল্লেখ করে বলা হয়েছে যে,আল্লাহ শত্রুদের চোখে মুসলমানদেরকে দ্বিগুণ করে দেখিয়েছেন এবং এর ফলে শত্রুরা ভীত হয়ে যুদ্ধ করার সাহস হারিয়ে ফেলে। এই আয়াতের প্রথম ও শেষাংশে এটা বোঝানো হয়েছে যে,বদর যুদ্ধে মিথ্যার অনুসারীদের বিরুদ্ধে সত্যের অনুসারীদের বিজয়ে সবার জন্য শিক্ষা রয়েছে। আর এ শিক্ষা হলো,সত্যের সংগ্রামে মুজাহিদের সংখ্যা কম হলেও ভয় পাওয়ার অবকাশ নেই এবং সত্যের সংগ্রামীরা তাদের দায়িত্ব পালন করতে গেলে আল্লাহর পক্ষ থেকে সাহায্য আসবেই।

এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো,
প্রথমত : ইসলামে যুদ্ধের উদ্দেশ্য হলো আল্লাহ ও তার ধর্মের পতাকা সমুন্নত রাখা। শক্তি প্রদর্শন বা দেশের সীমানা বৃদ্ধি কিংবা আধিপত্য প্রতিষ্ঠা ধর্ম যুদ্ধের উদ্দেশ্য নয়।
দ্বিতীয়ত : আল্লাহর অন্যতম অদৃশ্য সাহায্য হলো শত্রুদের অন্তরে ত্রাস সৃষ্টি করা। এর ফলে শত্রুরা মুসলমানদের শক্তিকে কয়েকগুণ বেশী দেখতে পাচ্ছিল এবং ভীত শত্রুরা মুসলমানদের মোকাবেলা করা থেকে বিরত হয়।
তৃতীয়ত : আমাদের চারপাশে যা ঘটছে ,তাতে সবার জন্য শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে কিন্তু শুধুমাত্র চিন্তাশীল ও জ্ঞানীরাই এসব ঘটনা থেকে শিক্ষা নেয়।