সূরা আলে ইমরান;(৩য় পর্ব)

সূরা আলে ইমরান;আয়াত ১৪-১৭

সূরা আলে ইমরানের ১৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-


زُيِّنَ لِلنَّاسِ حُبُّ الشَّهَوَاتِ مِنَ النِّسَاءِ وَالْبَنِينَ وَالْقَنَاطِيرِ الْمُقَنْطَرَةِ مِنَ الذَّهَبِ وَالْفِضَّةِ وَالْخَيْلِ الْمُسَوَّمَةِ وَالْأَنْعَامِ وَالْحَرْثِ ذَلِكَ مَتَاعُ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَاللَّهُ عِنْدَهُ حُسْنُ الْمَآَبِ (১৪)
 


"নারী,সন্তান-সন্ততি,সোনা রুপার ভাণ্ডার আর সুশিক্ষিত ঘোড়া,গবাদি পশু এবং ক্ষেত- খামার মানুষের কাছে সুন্দর,আকর্ষণীয় ও লোভনীয় করা হয়েছে। এসবই ক্ষণস্থায়ী জীবনের ভোগ্য-বস্তু মাত্র। আল্লাহর কাছেই রয়েছে শ্রেষ্ঠ আশ্রয়স্থল।" (৩:১৪)

আল্লাহ মানুষকে এই পৃথিবীতে পাঠানোর পর জীবন-যাপনের সমস্ত বৈধ উপকরণ তাদের জন্য সৃষ্টি করেছেন। ভবিষ্যত বংশধারা রক্ষার জন্য আমরা স্ত্রী বা স্বামী এবং সন্তান- সন্ততির মুখাপেক্ষী । এছাড়াও আমাদের জীবিকা নির্বাহের জন্য আমাদের অর্থ ও সম্পদের প্রয়োজন হয়। খাদ্য ও পোশাক সংগ্রহের জন্য আমরা পশু পাখী ও ক্ষেত খামারেরও অধিকারী হতে চাই। আল্লাহ এ সবকিছুই আমাদের জন্য সহজ করে দিয়েছেন। কিন্তু এটা অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে,এসব কিছুই ক্ষণস্থায়ী ও ধ্বংসশীল। পৃথিবীতে আমাদের জীবন মানুষের সর্বোচ্চ আয়ুর মধ্যেই সীমিত। যদি আমরা আল্লাহ ও পুনরুত্থান দিবসের প্রতি বিশ্বাস রাখি,তাহলে পৃথিবীর চাকচিক্যের ধোঁকায় পড়া আমাদের উচিত হবে না। কারণ,কেয়ামতের দিন এসবের কোন মূল্যই থাকবে না।

এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো,
প্রথমত : বৈষয়িক সম্পদের প্রতি আকর্ষণ প্রতিটি মানুষের সহজাত প্রকৃতি,কিন্তু বিপজ্জনক বিষয় হলো,বৈষয়িক চাকচিক্যের মোহে প্রতারিত হওয়া।
দ্বিতীয়ত : পার্থিব বিষয়- আশ্রয়কে ব্যবহার করা ও সেসবের প্রতি আকর্ষণ মন্দ নয়। কিন্তু পার্থিব বিষয়-আশ্রয়ের মোহের জালে বাধা পড়া এবং এসবের ওপর নির্ভর করা ক্ষতিকর।
তৃতীয়ত : আমাদের আশা ও আকাঙ্ক্ষা নিয়ন্ত্রণের জন্য আল্লাহর স্থায়ী নেয়ামতের সাথে ক্ষণস্থায়ী নেয়ামতের তুলনা করতে হবে।

সূরা আলে-ইমরানের ১৫ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে,


قُلْ أَؤُنَبِّئُكُمْ بِخَيْرٍ مِنْ ذَلِكُمْ لِلَّذِينَ اتَّقَوْا عِنْدَ رَبِّهِمْ جَنَّاتٌ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا وَأَزْوَاجٌ مُطَهَّرَةٌ وَرِضْوَانٌ مِنَ اللَّهِ وَاللَّهُ بَصِيرٌ بِالْعِبَادِ (১৫)

 

"হে নবী,আপনি মানুষকে বলুন আমি কি পার্থিব আকর্ষণের চেয়ে তোমাদেরকে ভালো কোন কিছুর সুসংবাদ দেব? যারা খোদাভীরু,তাদের জন্য তাদের প্রতিপালকের কাছে স্বর্গ-উদ্যান রয়েছে এবং সেই উদ্যানের গাছের তলদেশ দিয়ে নদী সমুহ প্রবাহিত। সেখানে তারা স্থায়ীভাবে থাকবে। সেখানে তাদের জন্য রয়েছে পবিত্র সঙ্গীনী এবং সবচেয়ে বড় নেয়ামত তথা আল্লাহর সন্তুষ্টি। আল্লাহ তার বান্দাদের প্রতি সুদৃষ্টি রাখেন।" (৩:১৫)

গত কয়েকটি আয়াতে পার্থিব কোন কোন বিষয়ের প্রতি মানুষের আকর্ষণের কথা উল্লেখ করার পর এই আয়াতে বেহেশতের স্থায়ী কিছু নেয়ামতের কথা উল্লেখ করা হয়েছে,যাতে মানুষ পার্থিব ও বেহেশতী নেয়ামতের মধ্যে তুলনা করে সঠিক পথ বেছে নেয় এবং দুনিয়ার চাকচিক্যে প্রতারিত না হয়। পৃথিবীতে ফলের বাগান,মনোরোম প্রাকৃতিক দৃশ্য এসব যদি মানুষকে মুগ্ধ করে,তাহলে বেহেশতের সবুজ গাছগাছালী ও ফলের বাগানে পরিপূর্ণ এবং নদী বিধৌত স্থায়ী বাগান কি বেশী আকর্ষণীয় নয়? ফল-ফলাদি ও অফুরন্ত খাদ্যে পরিপূর্ণ বেহেশতি উদ্যানে পবিত্র জীবনসঙ্গীনীও থাকবে। এই সব বর্ণনার মাধ্যমে বেহেশতের অফুরন্ত ও অশেষ বৈষয়িক নেয়ামতের মধ্যে অতি সামান্য অংশের উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু বেহেশতে মুমিনদের জন্য সবচেয়ে বড় ও অমূল্য খোদায়ী পুরস্কার হল আল্লাহর সন্তুষ্টি ও তার নৈকট্য।

এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো,
প্রথমত : বেহেশতের স্থায়ী নেয়ামত পেতে হলে পবিত্রতা অর্জন ও খোদাভীরু হওয়া জরুরী। কারণ,বেহেশত হল পবিত্র মানুষদের আবাসস্থল।
দ্বিতীয়ত : বেহেশতের অধিবাসীদের সুখ ও আনন্দ শুধু বৈষয়িক ক্ষেত্রে সীমিত নয়। আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন হবে বেহেশতীদের জন্য সবচেয়ে বড় আধ্যাত্মিক আনন্দ।
তৃতীয়ত : পবিত্রতা ও সতীত্ব নারীর সবচেয়ে বড় সম্পদ। আল্লাহ বেহেশতের স্ত্রী বা সহধর্মীনীদেরকে পবিত্র বলে উল্লেখ করেছেন।

সূরা আলে ইমরানের ১৬ ও ১৭ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-


الَّذِينَ يَقُولُونَ رَبَّنَا إِنَّنَا آَمَنَّا فَاغْفِرْ لَنَا ذُنُوبَنَا وَقِنَا عَذَابَ النَّارِ (১৬) الصَّابِرِينَ وَالصَّادِقِينَ وَالْقَانِتِينَ وَالْمُنْفِقِينَ وَالْمُسْتَغْفِرِينَ بِالْأَسْحَارِ (১৭)

 

"খোদাভীরু লোকেরা বলে হে আমাদের প্রতিপালক,নিশ্চয়ই আমরা ঈমান এনেছি তাই,আমাদের অপরাধ ক্ষমা করুন এবং আমাদেরকে নরকের শাস্তি থেকে রক্ষা করুন।" (৩:১৬)
"তারা ধৈর্যশীল,সত্যবাদী,সেবানুগত বা নির্দেশমান্য কারী,দানশীল এবং ভোরবেলায় প্রার্থনাকারী।" (৩:১৭)

পূর্ববর্তী আয়াতে খোদাভীরুদেরকে বেহেশতী বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আর এই দুই আয়াতে খোদাভীরুদের চিন্তাগত,নৈতিক ও আচরণগত বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করা হয়েছে যাতে বোঝা যায় কারা আল্লাহর বেহেশতে প্রবেশের যোগ্য । প্রথম আয়াতে বলা হয়েছে যারা খোদাভীরু তারা সব সময় আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে। প্রকৃতপক্ষে তওবা হচ্ছে ক্ষমা প্রার্থনা,তাকওয়া অর্জন এবং আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসী হবার উপায়। মানুষ যতক্ষণ পর্যন্ত এটা বিশ্বাস করে না,যে তার সমস্ত তৎপরতাই আল্লাহ দেখছেন ততক্ষণ পর্যন্ত সে তার আচরণ ও বক্তব্যকেও নিয়ন্ত্রণ করে না। তাকওয়া বা খোদাভীতির অর্থ শুধু পাপ থেকে মুক্ত থাকা নয়। খোদাভীতির আরেকটি দিক হল সংযম। খোদাভীরু লোকেরাও কখনও কখনও পাপ করতে পারে। কিন্তু অন্যান্য পাপীদের সাথে তাদের পার্থক্য হল পাপ কাজ তাদের অভ্যাস ও বদ্ধমূল চেতনার অংশ নয়। বরং তারা অবহেলা ও অসচেতনতার কারণে ভুলক্রমে পাপে লিপ্ত হয়।
দ্বিতীয়ত : কালেভদ্রে তারা অনিচ্ছাকৃতভাবে পাপ করলেও সাথে সাথে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে এবং নিজেদেরকে পুনরায় পাপ করা থেকে মুক্ত রাখে। পরবর্তী আয়াতে তাকওয়া বা খোদাভীতির ৫টি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট তুলে ধরা হয়েছে। সত্যের পথে সুদৃঢ় থাকা এবং শয়তানের কূমন্ত্রণার মোকাবেলায় দৃঢ় প্রতিরোধ হল এসব বৈশিষ্ট্যের মধ্যে প্রধান ।

কথায়,কাজে ও চিন্তায় সত্যবাদী থাকা খোদাভীরুদের আরেকটি বৈশিষ্ট্য। খোদাভীরু লোকেরা এসব গুণের কারণে সব ধরণের কপটতা,নিজেকে জাহির করা মিথ্যা ও প্রতারণার মত পাপ থেকে দূরে থাকতে পারেন। এছাড়াও খোদাভীরু লোকেরা বিনয়ের সাথে আল্লাহর বিধি-বিধান মেনে চলেন এবং আল্লাহর নির্দেশকে তারা মন ও প্রাণ দিয়ে গ্রহণ করেন। পরহেজগার লোকেরা আল্লাহর নির্দেশ মানার পাশাপাশি সৃষ্টির ও কল্যাণের চিন্তা করে। এজন্যে তারা বঞ্চিতদের দান-খয়রাত করে এবং তাদের অভাব পূরণ করে। এতসব ভালোগুন ও কাজের কারণে খোদাভীরুরা কখনও অহংকারী হয়ে পড়ে না,তারা তাদের অবহেলা জনিত ছোট-খাট পাপ বা ত্রুটিকে আল্লাহর ইবাদতের ক্ষেত্রে ও মানব সেবার ক্ষেত্রে অত্যন্ত বড় ভুল বলে মনে করে এবং ভোরবেলায় তীব্র অনুশোচনা নিয়ে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে।

এ দুই আয়াতের মূল শিক্ষা হল,খোদাভীতির অর্থ নিজেকে গুটিয়ে নেয়া ও ঘরের এক কোণে সরিয়ে রাখা নয়। বরং পাপ হতে দূরে থেকে সদ-গুণাবলীর অধিকারী হওয়া এবং আন্তরিকচিত্তে সমাজসেবার চিন্তা-ভাবনা করাই হল খোদাভীতি।