সূরা আলে ইমরান;(৪র্থ পর্ব)

সূরা আলে ইমরান; আয়াত ১৮-২২

সূরা আলে ইমরানের ১৮ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-


شَهِدَ اللَّهُ أَنَّهُ لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ وَالْمَلَائِكَةُ وَأُولُو الْعِلْمِ قَائِمًا بِالْقِسْطِ لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ (১৮)

"আল্লাহ নিজেই সাক্ষ্য দেন যে, তিনি ছাড়া আর কোন উপাস্য নেই। ফেরেশতাগণ এবং ন্যায়নিন্ঠ জ্ঞানীগণও সাক্ষ্য দিয়েছেন যে, তিনি ছাড়া আর কোন ইলাহ্ নেই। তারা সবাই আল্লাহর সুবিচারে আস্থা স্থাপনকারী। তিনি পরাক্রমশালী প্রজ্ঞাময়।" (৩:১৮)

এই আয়াতে মহানবী (সাঃ) ও মুসলমানদের উদ্দেশ্য করে বলা হয়েছে যে, কাফেরদের অবিশ্বাস ও মুশরিকদের অংশীবাদিতা যেন তোমাদেরকে নিজেদের বিশ্বাসের প্রতি সন্দিহান না করে। কারণ, প্রকৃত জ্ঞানী ও যুক্তিবাদী মানুষেরা আল্লাহর একত্বের ব্যাপারে সাক্ষ্য দিয়েছেন। এছাড়াও তারা এ সাক্ষ্য দেয় যে, বিশ্ব জগতের ব্যবস্থাপনা ন্যায়বিচারের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত এবং এ ক্ষেত্রে কোনো বাড়াবাড়ি লক্ষ্য করা যায়না। আর এ বিষয়টি নিজেই আল্লাহর একত্বের সাক্ষ্য বহন করছে। অর্থাৎ আল্লাহ এ বিশ্ব জগতের যা কিছুই সৃষ্টি করেছেন, যেমন- আকাশ,ভূমি,পাহাড়,নদী,সাগর,উদ্ভিদ,পশু-পাখী ইত্যাদি-সবই একই ব্যবস্থার অধীনে পরিচালনা করছেন। আর এসবই কার্যত আল্লাহর একত্বের সাক্ষ্য দিচ্ছে এবং ফেরেশতারাও আল্লাহর কর্মীবাহিনী হিসেবে জগত পরিচালনায় নিয়োজিত থেকে আল্লাহর একত্বের সাক্ষ্য দিচ্ছে।

এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো,
প্রথমত : বিশ্বজগতের শৃঙ্খলা ও বিভিন্ন সৃষ্টির মধ্যে সমন্বয় আল্লাহর একত্বের সুস্পষ্ট এবং সবোর্ৎকৃষ্ট প্রমাণ।
দ্বিতীয়ত: জ্ঞান তখনই উপকারী বা কল্যাণকর হয়,যখন তা মানুষকে আল্লাহমুখী করে। আর ঈমান তখনই গুরুত্ব পায় যখন তা হয় জ্ঞান ও যুক্তিভিত্তিক।

সূরা আলে ইমরানের ১৯ ও ২০ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-


إِنَّ الدِّينَ عِنْدَ اللَّهِ الْإِسْلَامُ وَمَا اخْتَلَفَ الَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَابَ إِلَّا مِنْ بَعْدِ مَا جَاءَهُمُ الْعِلْمُ بَغْيًا بَيْنَهُمْ وَمَنْ يَكْفُرْ بِآَيَاتِ اللَّهِ فَإِنَّ اللَّهَ سَرِيعُ الْحِسَابِ (১৯) فَإِنْ حَاجُّوكَ فَقُلْ أَسْلَمْتُ وَجْهِيَ لِلَّهِ وَمَنِ اتَّبَعَنِ وَقُلْ لِلَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَابَ وَالْأُمِّيِّينَ أَأَسْلَمْتُمْ فَإِنْ أَسْلَمُوا فَقَدِ اهْتَدَوْا وَإِنْ تَوَلَّوْا فَإِنَّمَا عَلَيْكَ الْبَلَاغُ وَاللَّهُ بَصِيرٌ بِالْعِبَادِ ((২০

"নিঃসন্দেহে আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য দ্বীন একমাত্র ইসলাম। যাদেরকে ধর্মগ্রন্থসমূহ দেয়া হয়েছে তাদের কাছে জ্ঞান বা কোরআনের আসার পর তারা শত্রুতা ও হিংসা ছাড়া অন্য কোন কারণে এর সত্যতার ব্যাপারে মতভেদ করেনি। যে আল্লাহর নির্দশনগুলো অবিশ্বাস করে তার মনে রাখা উচিত আল্লাহ দ্রুত হিসাব গ্রহণকারী।" (৩:১৯)
"হে নবী! যদি তারা আপনার সাথে ঝগড়া-বিবাদ করতে চায় তবে আপনি বলুন আমি ও আমার অনুসারীরা আল্লাহর কাছে আমাদের মাথা সমর্পন করেছি এবং যাদের গ্রন্থ দেয়া হয়েছে এবং যারা নিরক্ষর মুশরিক,তাদেরকে বলুন তোমরাও কি আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পন করেছ? এরপর যদি তারা আত্মসমর্পণ করে তাহলে নিশ্চয়ই সুপথ পাবে আর যদি অস্বীকার করে তাহলে শুধু বাণী পৌঁছে দেয়াই আপনার দায়িত্ব। আল্লাহ নিজেই তার বান্দাদের অবস্থা লক্ষ্য করেন।" (৩:২০)

হযরত মুসা (আঃ) ও হযরত ঈসা (আঃ)'র যুগে,কিংবা অন্যান্য নবীদের যুগে মানুষের দায়িত্ব ছিল আল্লাহর প্রেরিত পুরুষ হিসেবে তাদের বিশ্বাস করা, তাদের আনুগত্য করা এবং তাঁদের কাছে অবতীর্ণ বইয়ের প্রতিও ঈমান আনা। কিন্তু পবিত্র কোরআন অবতীর্ণ হবার পর ইসলামের নবীর প্রতি বিশ্বাস আনা ও এই ধর্মের বিধান মেনে চলা সবার দায়িত্ব হয়ে পড়ে। অথচ ধর্মীয় ও বর্ণ-বিদ্বেষের কারণে অনেকেই ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে রাজী হয়নি এবং এই ধর্মকে সত্য বলে স্বীকারও করেনি। এই আয়াতে আহলে কিতাবদের উদ্দেশ্য করে বলা হয়েছে, যদি তারা আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পন করতে চায়,তাহলে তারা যেন ইসলাম ধর্মে দীক্ষা নেয়। কারণ,যে আল্লাহ তাদের কাছে ঈসা ও মুসা নবীকে পাঠিয়েছেন,তিনিই এখন মোহাম্মদ (সাঃ) কে নবী মনোনীত করে তাঁর আনুগত্য করার নির্দেশ দিয়েছেন। ইসলামকে সত্য ধর্ম হিসেবে জানার পরও যদি তারা ঈমান না আনে তাহলে ইহকাল ও পরকালে আল্লাহর শাস্তির জন্য তাদেরকে অপেক্ষা করতে বলা হয়েছে। আল্লাহ যে তাদের ধারণার চেয়েও দ্রুত সময়ে মানুষের কর্মতৎপরতার হিসাব নেবেন সেটাও তাদের জানিয়ে দেয়া হয়েছে। এরপর ইসলামের নবীকে উদ্দেশ্য করে আল্লাহ বলছেন,কাফের ও মুশরিকদের ঈমানদার করার জন্য অনর্থক তাদের সঙ্গে ঝগড়া ও দ্বন্দ্বে যাবার মত কষ্ট করার দরকার নেই। কারণ,আপনার দায়িত্ব হল শুধু আল্লাহর বাণী জনগণের কাছে পৌঁছে দেয়া যাতে মানুষ সত্যকে বুঝতে পারে। তাই যার ইচ্ছা হবে সে নিজেই সত্যকে গ্রহণ করবে এবং যারা জেনে শুনেও যে কোন কারণে সত্য ধর্ম গ্রহণ করবে না তাদের সঙ্গে আলোচনা নিরর্থক। তাদের বিষয় আল্লাহর হাতে ছেড়ে দিন। আল্লাহ তার সৃষ্টির অবস্থা ভালভাবে দেখেন।

এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো,
প্রথমত : অধিকাংশ মতবিরোধের উৎস হল হিংসা ও বিদ্বেষ। অজ্ঞতা ও বাস্তবতা সম্পর্কে না জানার কারণে খুব কমই মতভেদ দেখা দেয়।
দ্বিতীয়ত : আল্লাহর কাছে একমাত্র মনোনীত ধর্ম হল ইসলাম। তাই অন্যান্য ঐশী গ্রন্থের অনুসারী হবার দাবিদাররা যদি সত্যই আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পিত হতে চায় তাহলে তাদেরকে এখন থেকে শুধু ইসলাম ধর্মই মেনে চলতে হবে।
তৃতীয়ত : উদ্ধত বা গোঁড়াপন্থী লোকদের সাথে দ্বন্দ্ব-বিবাদ করা নয়,বরং যুক্তি তুলে ধরাই আমাদের দায়িত্ব।
চতুর্থত : ধর্ম বিশ্বাস গ্রহণের ক্ষেত্রে মানুষ স্বাধীন এবং জোর করে কারো ধর্মীয় বিশ্বাস চাপিয়ে দেওয়া নিষিদ্ধ। অবশ্য যারাই যে পথই বেছে নিক না কেন ঐ পথের ভালো বা মন্দ পরিণতি তাদেরকে ভোগ করতেই হবে।

সূরা আলে ইমরানের ২১ ও ২২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-


إِنَّ الَّذِينَ يَكْفُرُونَ بِآَيَاتِ اللَّهِ وَيَقْتُلُونَ النَّبِيِّينَ بِغَيْرِ حَقٍّ وَيَقْتُلُونَ الَّذِينَ يَأْمُرُونَ بِالْقِسْطِ مِنَ النَّاسِ فَبَشِّرْهُمْ بِعَذَابٍ أَلِيمٍ (২১) أُولَئِكَ الَّذِينَ حَبِطَتْ أَعْمَالُهُمْ فِي الدُّنْيَا وَالْآَخِرَةِ وَمَا لَهُمْ مِنْ نَاصِرِينَ (২২)

"যারা আল্লাহর নিদর্শনকে অস্বীকার করেছে,নবীদেরকে অন্যায়ভাবে হত্যা করেছে এবং ন্যায়পরায়নতার নির্দেশদানকারী যেসব মানুষকে হত্যা করেছে, তাদেরকে সুনিশ্চিত যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির সুসংবাদ দাও।" (৩:২১)
"এরাই হলো সে লোক যাদের সমগ্র আমল দুনিয়া ও আখেরাত উভয়লোকেই বিনষ্ট হয়ে গেছে। পক্ষান্তরে তাদের কোন সাহায্যকারীও নেই।" (৩:২২)

পূর্ববর্তী আয়াতে কাফের ও মুশরিকদের হিংসা ও বিদ্বেষের স্বরূপ তুলে ধরার পর এই দুই আয়াতে সত্য গোপন ও অবিশ্বাসের করুণ ও নোংরা পরিণতির কথা বলা হয়েছে। আসলে মানুষ তাদের চিন্তা ও বিশ্বাস অনুসারে কাজ করে। যারা চিন্তাগত ক্ষেত্রে সত্য গ্রহণ করতে প্রস্তুত নয়,তারা সত্যের পক্ষে কাজ তো করেই না,বরং যারা সত্য ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য সমাজে কাজ করছে তাদের সাথে বিরোধিতা করে এবং তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পর্যন্ত করে। এদের হাত নিরাপরাধ লোকদের রক্তে রঞ্জিত এবং এরা ন্যায় বিচারকামী মানুষের নেতাদেরকে হয় হত্যা করে কিংবা তাদের হত্যা করার অনুমতি দেয় অথবা তারা নিহত হলে খুশি হয় । এটা স্পষ্ট যে সত্যের বিরুদ্ধে চিন্তায় ও কাজে তাদের এই বিরোধীতার ফলে তারা যদি জীবনে কোন ভালো কাজ করেও থাকে তবুও তা হবে নিস্ফল । এদের অবস্থা হচ্ছে এমন লোকের মতো যে কিছুকাল কোন ব্যক্তির সেবকের কাজ করার পর ঐ ব্যক্তির সন্তানকেই হত্যা করে। নিঃসন্দেহে এমন নোংরা কাজ তার অতীতের সমস্ত ভালো কাজকে অর্থহীন ও নিস্ফল করে দেয়।

এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিক গুলো হলো,
প্রথমত : সত্যকে গোপন রাখার জন্য কোন কোন মানুষ নবীকে পর্যন্ত হত্যা করেছে। তাই আমাদেরকেও বিকৃত চিন্তাধারার ব্যাপারে সাবধান হতে হবে। কারণ বিপজ্জনক কাজের মূল উৎস হলো বিকৃত বিশ্বাস ।
দ্বিতীয়ত : ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য সত্যের পক্ষে আহবান জানানো এবং জাগরণ জরুরী। যদিও এর ফলে শহীদ হওয়ার সম্ভাবনাও থাকে। যেমন ইমাম হোসাইন বিন আলী ( আঃ ) ও তার সন্তানেরা সত্যের আহবানের কারণে শহীদ হবেন এটা নিশ্চিতভাবে জেনেও সত্যের জন্য নিজেদেরকে উৎসর্গ করেছিলেন ।
তৃতীয়ত : কোন কোন পাপ বজ্রপাতের মতোই মানুষের পূণ্যের বাগানের সমস্ত গাছকে এক মুহূর্তের মধ্যেই ভস্মীভূত করে দেয়। তখন দুঃখ করার মতো অবকাশও থাকে না।