সূরা আলে ইমরান;(৬ষ্ঠ পর্ব)

সূরা আলে ইমরান; আয়াত ২৮-৩২

সূরা আলে ইমরানের ২৮ ও ২৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে,


لَا يَتَّخِذِ الْمُؤْمِنُونَ الْكَافِرِينَ أَوْلِيَاءَ مِنْ دُونِ الْمُؤْمِنِينَ وَمَنْ يَفْعَلْ ذَلِكَ فَلَيْسَ مِنَ اللَّهِ فِي شَيْءٍ إِلَّا أَنْ تَتَّقُوا مِنْهُمْ تُقَاةً وَيُحَذِّرُكُمُ اللَّهُ نَفْسَهُ وَإِلَى اللَّهِ الْمَصِيرُ (২৮) قُلْ إِنْ تُخْفُوا مَا فِي صُدُورِكُمْ أَوْ تُبْدُوهُ يَعْلَمْهُ اللَّهُ وَيَعْلَمُ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الْأَرْضِ وَاللَّهُ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ ((২৯
 

"মুমিনগণ যেন অন্য মুমিনকে ছেড়ে কোনো কাফেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ না করে। যারা এরূপ করবে,তাদের সঙ্গে আল্লাহর কোন সম্পর্ক থাকবে না। তবে যদি তোমরা তাদের পক্ষ থেকে কোন অনিষ্টের আশঙ্কা কর,তাহলে তাদের সঙ্গে সাবধানে মিশবে। আল্লাহ তোমাদেরকে তাঁর নির্দেশ অমান্য করার ব্যাপারে সাবধান করে দিচ্ছেন এবং জেনে রাখ তোমাদেরকে তাঁরই কাছে ফিরে যেতে হবে।" (৩:২৮)
"হে নবী! আপনি মুসলমানদেরকে বলুনঃ তোমাদের অন্তরে যা আছে তা তোমরা গোপন কর অথবা প্রকাশ কর আল্লাহ তা জানেন এবং আসমান ও জমীনে যা কিছু আছে আল্লাহ তাও জানেন। আল্লাহ সব বিষয়ে সর্বশক্তিমান।" (৩:২৯)

এই আয়াতে মুসলমানদের পারস্পরিক সম্পর্ক ও কাফেরদের সঙ্গে তাদের সম্পর্কের ধরণ কি হবে তা বলা হয়েছে। একজন মুমিনের সঙ্গে অন্য মুমিনের সম্পর্ক হবে ঈমানের ভিত্তিতে। কারণ,আদর্শিক বন্ধন জাতিগত কিংবা আত্মীয়তার বন্ধনের চেয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ। তাই মুমিনরা বিশ্বের যে কোন প্রান্তেই থাকুক না কেন তাদের নিজেদের মধ্যে সুদৃঢ় বন্ধন ও ঐক্য সৃষ্টির চেষ্টা করতে হবে এবং কাফেররা যেন তাদের ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার সুযোগ না পায় ,সে জন্যও সচেষ্ট হতে হবে। অবশ্য যেসব এলাকায় অবিশ্বাসী ও মুশরিকদের কর্তৃত্ব রয়েছে এবং যেখানে বিশ্বাস ও বক্তব্যের স্বাধীনতা নেই সেখানে এই নিয়মের ব্যতিক্রম বৈধ। অর্থাৎ,যেসব এলাকায় মুমিন তার বিশ্বাস প্রকাশের কারণে মুমিনের নিজের ও অন্যান্য মুমিনের ধ্বংসের সম্ভাবনা থাকে। সেখানে মনে মনে নিজের ঈমান ঠিক রেখে অল্প সময়ের জন্য ইসলামের শত্রুদের সঙ্গে আপোস করা অবৈধ নয়। মনে রাখতে হবে,শুধু ধর্ম রক্ষার জন্যেই এই পদ্ধতি প্রযোজ্য। আর যেখানে ধর্মের মূল নীতিই বিপন্ন হয়,সেখানে সব কিছুই উৎসর্গ করতে হবে এবং কাউকে ভয় করা যাবে না। যেমন হযরত মুহাম্মদ (সা.)'র নাতি ইমাম হোসাইন (আ.) ইয়াজিদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। যদিও তিনি জানতেন যে,এর ফলে তিনি শহীদ হবেন এবং তাঁর পরিবার বন্দী হবে। ধর্ম বিশ্বাস গোপন রাখা বা তাকওয়ার অজুহাতে কখনোই কাফের বা ইসলামের শত্রুকে আকৃষ্ট করা যাবে না এবং তাদের বন্ধুত্ব গ্রহণযোগ্য হবে না। কারণ,আল্লাহ মানুষের মনের খবর রাখেন এবং কোন উদ্দেশ্যে কাফেরদের সাথে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে তাও আল্লাহ বুঝতে পারেন।
এই আয়াতের শিক্ষনীয় দিক হলো,
প্রথমত : যেসব কাজের ফলে মুমিনদের ওপর কাফেরদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয় সে সব কাজ করা নিষিদ্ধ এবং মুমিনদের নিজেদের মধ্যে অত্যন্ত সুদৃঢ় সম্পর্ক রাখতে হবে যাতে শত্রুরা প্রভাব বিস্তারের সুযোগ না পায়।
দ্বিতীয়ত : কাফেরদের অত্যাচার থেকে বাঁচার জন্য বিশ্বাস গোপন রাখা অথবা তাদের সঙ্গে আপোস করা বৈধ। তার শর্ত হল- আপোসের ফলে বা বিশ্বাস গোপনের ফলে যেন ধর্মের মূলনীতি ধ্বংস না হয়।

সূরা আলে ইমরানের ৩০ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-


يَوْمَ تَجِدُ كُلُّ نَفْسٍ مَا عَمِلَتْ مِنْ خَيْرٍ مُحْضَرًا وَمَا عَمِلَتْ مِنْ سُوءٍ تَوَدُّ لَوْ أَنَّ بَيْنَهَا وَبَيْنَهُ أَمَدًا بَعِيدًا وَيُحَذِّرُكُمُ اللَّهُ نَفْسَهُ وَاللَّهُ رَءُوفٌ بِالْعِبَادِ (৩০)
 

"কিয়ামতের দিন প্রত্যেকেই তার ভাল ও মন্দ কাজ দেখতে পাবে। সেদিন তারা বলবে হায়! যদি আমাদের ও আমাদের খারাপ কাজের মধ্যে সুদূর ব্যবধান থাকতো! আল্লাহ তাঁর নির্দেশ অমান্য করার ব্যাপারে তোমাদের সাবধান করে দিচ্ছেন। আল্লাহ পাক তার বান্দাদের প্রতি দয়ালু।" (৩:৩০)

এই আয়াতে সমস্ত মুমিনদের প্রতি হুঁশিয়ারি দিয়ে বলা হয়েছে যে,তাদের সমস্ত ভালো ও খারাপ কাজ আল্লাহ ও ফেরেশতাদের কাছে রেকর্ড হয়ে আছে। বিচার দিবসে এইসব ভালো ও মন্দ কাজ দেখানো হবে। তাই আল্লাহর ক্রোধকে ভয় করা এবং খারাপ কাজ থেকে দূরে থাকা মুমিনের কর্তব্য। কিয়ামতের দিন খারাপ কাজ এমনভাবে দেখানো হবে যে,মানুষ নিজের করা খারাপ কাজের কদর্যতা দেখে নিজেরাই ঘৃণা প্রকাশ করবে আর আক্ষেপ করে বলবে হায়! যদি আমাদের কাজ ও আমাদের মধ্যে বিস্তর ব্যবধান থাকতো!
এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিক হলো-
প্রথমত : পৃথিবীতে আমরা যেসব নোংরা কাজ করতে আগ্রহী,বিচার দিবসে আমরা নিজেরাই সে সব কাজ ঘৃণা করব। তাই ভবিষৎতের ব্যাপারে চিন্তা করা উচিত।
দ্বিতীয়ত : আল্লাহর দেয়া হুঁশিয়ারিগুলো আমাদের প্রতি তাঁর অনুগ্রহ ও ভালবাসার প্রকাশ। তিনি আমাদেরকে ভালবাসেন বলেই সম্ভাব্য বিপদ আগেই জানিয়ে দিয়েছেন।

সূরা আলে ইমরানের ৩১ ও ৩২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

قُلْ إِنْ كُنْتُمْ تُحِبُّونَ اللَّهَ فَاتَّبِعُونِي يُحْبِبْكُمُ اللَّهُ وَيَغْفِرْ لَكُمْ ذُنُوبَكُمْ وَاللَّهُ غَفُورٌ رَحِيمٌ (৩১) قُلْ أَطِيعُوا اللَّهَ وَالرَّسُولَ فَإِنْ تَوَلَّوْا فَإِنَّ اللَّهَ لَا يُحِبُّ الْكَافِرِينَ ((৩২

"হে নবী! আপনি মুসলমানদের বলুন: যদি তোমরা আল্লাহকে ভালবাস,তবে আমার অনুসরণ কর। তাহলে আল্লাহও তোমাদেরকে ভালবাসবেন ও তোমাদের অপরাধ ক্ষমা করবেন। আল্লাহ ক্ষমাশীল ও দয়াময়।" (৩:৩১)
"আপনি বলুন: আল্লাহ ও রাসুলের আনুগত্য করো,যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয় (অর্থাৎ আনুগত্য না করে) তাহলে তাদের জানিয়ে দিন আল্লাহ অবিশ্বাসীদের ভালবাসেন না।" (৩:৩২)

ধর্মের ক্ষেত্রে একটি সমস্যা হল,গালভরা দাবি। কোন কোন কথিত ধার্মিক বিভিন্ন অজুহাতে আল্লাহর নির্দেশ পালন থেকে বিরত থাকেন। যেমন তারা বলেন যে,মানুষের মনে আল্লাহ ও আল্লাহর ওলীদের প্রতি প্রেম থাকাই যথেষ্ট। বাহ্যিক কাজের মাধ্যমে আল্লাহর নির্দেশ পালন তো অহংকারের প্রকাশ এবং এর মাধ্যমে লোকদের প্রতারিত করা হয়। অন্তরই হল গুরুত্বপূর্ণ আমল বা কাজ,এসব গুরুত্বপূর্ণ নয়,ইত্যাদি ! এসব কথিত ধার্মিক ও পণ্ডিতরা এটা ভুলে যান যে,এ রকম কথা বলে তারা নিজেরাই নিজেদেরকে ধোঁকা দিচ্ছেন। কারণ,রাসুল (সা.)'র নির্দেশ পালন না করে আল্লাহকে ভালবাসার দাবি মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়। অন্যদিকে আল্লাহ আমাদেরকে কতটা ভালবাসবেন তা নির্ভর করে আল্লাহর নির্দেশ আমরা কতটা মানি তার ওপর । যারা আল্লাহর নির্দেশ সব সময় পালন করে আল্লাহ তাদের প্রতি ভালবাসার ভুল-ভ্রান্তি ক্ষমা করে দেন এবং আল্লাহর অসীম দয়া ও অনুগ্রহ দিয়ে তাদের ধন্য করেন।

এই দুই আয়াতের শিক্ষণীয় দিক হলো,
প্রথমত : মানুষ ইচ্ছে করলে এমন পর্যায়ে পৌঁছতে পারে যে,ঐ পর্যায়ে তাঁর সন্তুষ্টিই হয় আল্লাহর সন্তুষ্টি এবং তাঁর অনুসরণই হয় আল্লাহর অনুসরণ। যেমন- এ আয়াতে রাসুল (সা.)'র আনুগত্য করাকে আল্লাহর আনুগত্য করা বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
দ্বিতীয়ত : কাজে কর্মে আনুগত্য প্রকাশ না করে মুখে ভালবাসার দাবি করা অর্থহীন। কাজের মাধ্যমেই প্রত্যেক দাবির প্রমাণ দেখাতে হবে।
তৃতীয়ত : রাসুল (সা.)'র নির্দেশ আল্লাহর নির্দেশের সমতুল্য এবং আমাদের জন্য তা সত্যের মানদণ্ড । তাঁর নির্দেশ অমান্য করা কুফরীর সমান।