আদর্শ পরিবার গঠন- সময়ের দাবি

সুখি-সমৃদ্ধ ও কল্যাণময় জীবন গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজন হলো সমাজের ক্ষুদ্রতম অথচ গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান পরিবারকে সুষ্ঠুভাবে গঠন করা। কেননা,আদর্শ সমাজের জন্য প্রয়োজন আদর্শ পরিবার। সামাজিক জীব হিসাবে মানুষের প্রথম জীবন যাপন করার স্থান হলো তার পরিবার। শিশুর শিক্ষার প্রথম ও গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হচ্ছে তার পরিবার। পরিবার একজন শিশুর মানসিকতা গঠনে যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করে থাকে। যদিও একই পরিবার থেকে ভিন্নমুখী চরিত্র-বৈশিষ্ট্যের ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষের আবির্ভাব হতে পারে তারপরও সাধারণভাবে পরিবারের ভূমিকাকে অস্বীকার করার কোন অবকাশ নেই।

বস্তুবাদের প্রভাব,মানুষের অসচেতনতা ও অদূরদর্শিতা আজকের দিনে মানুষকে নানা বিপর্যয়কর অবস্থার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। মানুষ ধীরে ধীরে তার প্রকৃত মূল্যবোধ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। সততা,নীতি-নৈতিকতা আজ অনেকের কাছে অর্থহীন হয়ে পড়ছে।

মানুষ তার মূল লক্ষ্য থেকে চ্যুত হয়ে পার্থিব বিষয়াদিতে মেতে উঠছে। সকল মূল্যবোধের বিপরীতে অনৈতিকতা,স্বার্থপরতা ও সংকীর্ণ মনোবৃত্তি মানুষের মন ও মগজে জেঁকে বসছে। মানুষের আদর্শ হয়ে উঠছে নীতিহীন বিত্তবান অথবা সামাজিক প্রতিপত্তির অধিকারী ব্যক্তিরা। এর বিপরীতে সৎ ও নীতিবানদের দুর্বল ও অক্ষম হিসাবে মনে করা হচ্ছে।

বস্তবাদ মানুষের সমস্ত চিন্তা-ভাবনাকে একপেশে করে দিচ্ছে। আর এর অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে পারিবারিক মণ্ডলে মূল্যবোধের বিষয়গুলোর চর্চা কমে যাওয়া। যে পরিবার শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে উন্নত মূল্যবোধ ও রুচিবোধসম্পন্ন মানুষ তৈরি করে এসেছে,সেই পরিবার যেন মানুষ গড়ার সেই প্রাথমিক শিক্ষকের ভূমিকা থেকে অব্যাহতি নিয়েছে।

মানুষ ধীরে ধীরে পূর্ণতার পথে অগ্রসর হবে এটিই কাম্য। তাই জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই এ লক্ষ্যকে সামনে রেখে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। আর এর জন্যই প্রয়োজন রয়েছে সর্বক্ষেত্রে আদর্শ স্থির করে তা অনুসরণের মাধ্যমে সামনের দিকে অগ্রসর হওয়া।

বস্তুত আদর্শ স্থির করা মানুষের কর্মকাণ্ডকে সুশৃঙ্খল,ভারসাম্যপূর্ণ ও গতিময় করে। আদর্শ স্থির না করে কোন কিছু এগিয়ে নিতে গেলে সেখানে বিশৃঙ্খল অবস্থার সৃষ্টি হবেই। একজন লেখক,একজন সাংবাদিক,একজন ক্রীড়াবিদ,একজন শিক্ষাবিদ-এভাবে প্রত্যেকেই নিজ নিজ কর্মের ক্ষেত্রেও তাঁদের আদর্শ নির্ধারণ করেই অগ্রসর হন। আর যেখানে পূর্ণ মানব হওয়ার পরিক্রমা সেখানে আদর্শ স্থির না করা সবচেয়ে বড় অদূরদর্শিতা;বরং এটিই সর্বাগ্রে নির্ধারণ করা প্রয়োজন।

একটি পরিবার গঠিত হয় একজন পুরুষ ও একজন নারীর মাধ্যমে। তাই পরিবার গঠনের এ প্রাথমিক পদক্ষেপ নেওয়ার শুরুতেই মানুষকে সতর্ক ও সচেতন হতে হবে। এ পদক্ষেপ পূর্ণতার পথে সহায়ক হবে কিনা এটিই মুখ্য বিষয়। বংশপরিচয়,শারীরিক সৌন্দর্য,সামাজিক প্রতিপত্তি,অর্থনৈতিক অবস্থান নয়,বরং যে বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন তা হলো জ্ঞান,চরিত্র ও ধার্মিকতা। তবে এক্ষেত্রে ধার্মিকতা সবচেয়ে গুরুত্বের দাবিদার। প্রথমেই সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করলে আশা করা যায় যে,এটি সর্বক্ষেত্রে কল্যাণ বয়ে আনবে।

অমুসলিমদের ক্ষেত্রে ব্যবহারিক পর্যায়ে কোন আদর্শ পরিবার নির্ধারণ করা কঠিন বলে মনে হলেও মুসলিমদের জন্য তা কখনই নয়। মুসলমানদের জন্য রাসূলুল্লাহ (সা.) ও হযরত খাদীজা (রা.)-এর পরিবার আমাদের সামনে রয়েছে। যেখানে বয়সের পার্থক্য ও অন্যান্য বিষয় গৌণ হয়ে মুখ্য হয়ে উঠেছিল ভবিষ্যৎ কল্যাণকামিতা। জাহেলি যুগে এমন একটি পরিবার গঠিত হয়েছিল যা একটি ঐশী ধর্মের আবির্ভাব ও বিস্তৃতির ক্ষেত্রে পুরোপুরি কল্যাণকর বলে পরবর্তীকালে প্রমাণিত হয়েছে।

রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর পরিবারের পরেই স্বামী-স্ত্রী,পুত্র-কন্যা নিয়ে যে পরিবার আমাদের জন্য আদর্শ হয়ে রয়েছে তা হলো হযরত আলী ও হযরত ফাতিমার পরিবার। পরিবার গঠনের শুরু থেকে পারিবারিক জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে এ পরিবার মুসলমানদের জন্য আদর্শস্থানীয়। নৈতিকতা,মানবিকতা ও আত্মত্যাগের সর্বোচ্চ শিক্ষা পাওয়া যায় এ পরিবারে। নিজেরা অনাহারে থেকে ক্ষুধার্তের মুখে খাবার তুলে দেওয়া,সম্পদের অধিকাংশই অসহায়-দুঃখীদের মধ্যে বিলিয়ে দেওয়া,অতিথিদের সেবা করা,প্রার্থনায় অন্যকে প্রাধান্য দেওয়া,অসম্মান প্রদর্শনের বিপরীতে অন্যকে সম্মান দেওয়ার মতো আদর্শ রয়েছে এ পরিবারে।

ইবাদতের মিহরাবে একনিষ্ঠ ইবাদতকারী-সালাত আদায়কারী,যাঁর সালাতের সময় পা থেকে তীর বের করে নেওয়া হয়;এর পাশাপাশি যুদ্ধের ময়দানে অকুতোভয় বীর ও শত্রুর ওপর প্রবল প্রতাপশালী যোদ্ধাকে পাওয়া যায় এ পরিবারে। বিশুদ্ধ নিয়তে জিহাদ করা এবং নিজ মুখে থুথু নিক্ষেপের পর ক্রোধ সংবরণকারীর আদর্শও আমরা পাই এ পরিবার থেকে।

কায়িক পরিশ্রমে যেখানে দ্বিধা নেই,গরীরের জন্য খাদ্য প্রস্তুতে হাতে ফোস্কা পড়ার ব্যাপারে কোন ভ্রুক্ষেপ নেই সেই পরিবারের। মহান স্রষ্টার পথে ক্ষুধা-তৃষ্ণায় ও শারীরিক নির্যাতনের পরও চরম ধৈর্যশীলতার শিক্ষা,আর শত দুঃখণ্ডকষ্টের মধ্যেও মহান স্রষ্টার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের ক্ষেত্রে অতুলনীয় দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় এ পরিবারেই। সম্পদের প্রতি নির্মোহ,অথচ অধিকারের ব্যাপারে সোচ্চার,সত্য ও ন্যায়ের পথে লড়াই করে সর্বস্ব বিলিয়ে দেওয়ার প্রেরণা আসে এ পরিবার থেকেই। আর তাই এ পরিবার থেকে বেহেশতের দু’জন নেতার আবির্ভাব আমাদের বিস্মিত করে না।

তাই আজ আমাদের সর্বাগ্রে সেই কল্যাণময় পরিবার গঠনের কথাই চিন্তা করতে হবে যেখানে নিজেদের বিষয় নয়,অন্যের বিষয় প্রাধান্য পাবে;ভোগ নয়,সর্বস্ব বিলিয়ে দেওয়ার শিক্ষা থাকবে;অন্যায়ের মোকাবিলায় বজ্রকঠিনভাবে রুখে দাঁড়ানোর মনোবৃত্তি গড়ে উঠবে। আর তাহলেই সময়ের দাবি পূরণ হবে। নতুবা দিন দিন আমরা কাণ্ডারীবিহীন নৌকার মতো ভাসতে থাকব। নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলব সবকিছুর ওপর থেকে।

সূত্র: প্রত্যাশা, ৩য় বর্ষ, ১ম সংখ্যা।