আমীরুল মুমিনীন আলী (আ.)-এর কতিপয় বাণী ও সেগুলোর ব্যাখ্যা (১ম অংশ)

সংকলন : . কে. এম. আনোয়ারুল কবীর

বাণী নং ১

‘দ্বন্দ্ব-সংঘাতের (বিশৃঙ্খলার) সময় দু’বছরের উষ্ট্র শাবকের মত হও,যার পৃষ্ঠ এমন নয় যাতে আরোহণ করা যায় এবং স্তনও এমন নয় যা দোহন করা যায়।’

ব্যাখ্যা:

ইবনে আবিল হাদীদ এ বাণীর ব্যাখায় বলেছেন,এখানে দ্বন্দ্ব-সংঘাত বলতে দু’জন বিপথগামী নেতার মধ্যে সংঘটিত যুদ্ধ বুঝানো হয়েছে যারা উভয়ে বক্রপথের দিকে আহ্বান করে। উদাহরণস্বরূপ আব্দুল মালেক ইবনে মারওয়ান ও আব্দুল্লাহ্ ইবনে যুবাইরের মধ্যে সংঘটিত যুদ্ধ,তেমনি জাহহাক ও মারওয়ান কিংবা হাজ্জাজ ইবনে ইফসুফ ও মুহাম্মাদ ইবনে আশআস ইবনে কাইসের মধ্যকার যুদ্ধ। কিন্তু যখন দু’পক্ষের একটি সত্যপন্থী হবে তখন তাকে দ্বন্দ্ব বলা যায় না বরং সেক্ষেত্রে যে পক্ষ সত্য পথে রয়েছে তার পক্ষে অস্ত্র ধারণ ও যুদ্ধ করা (জিহাদ) ফরয অর্থাৎ অন্যায়ের প্রতিরোধ করতে হবে এবং সত্যের প্রতিষ্ঠা ও তার পতাকাকে উড্ডীন রাখতে প্রয়োজনে জীবন বিসর্জন দিতে হবে। যেমন জামাল ও সিফফিনের যুদ্ধে ন্যায়কে সমর্থন করে অন্যায়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা ফরজ ছিল।

ইবনে মাইসাম বাহরানী ফিতনা বা দ্বন্দ্ব-সংঘাতের সময়ে করণীয় বিষয়কে দু’বছরের উষ্ট্র শাবকের সঙ্গে তুলনা করাকে এভাবে ব্যাখ্যা করেছেন যে,যে ব্যক্তি এরূপ অবস্থায় পড়বে সে যেন সে অবস্থায় দুর্বল,অপরিচিত ও সম্পদহীন ব্যক্তির চেহারা ও রূপে আবির্ভূত হয় যাতে তাকে অত্যাচারীকে শারীরিক ও অর্থনৈতিক কোনভাবেই সহযোগিতা করতে না হয় ঠিক যেমনভাবে দু’বছরের উষ্ট্রশাবকের পৃষ্ঠ ও দুগ্ধ থেকে লাভবান হওয়া যায় না।  

বাণী নং ১০

‘মানুষের সঙ্গে এমনভাবে আচরণ কর যেন (সেই অবস্থায়) তোমার মৃত্যুতে তারা ক্রন্দন করে এবং যদি জীবিত থাক তারা তোমার সাথে থাকতে ও মিশতে তীব্র আগ্রহ ব্যক্ত করে (তোমার সার্বক্ষণিক সঙ্গী হতে চায়)।’

ব্যাখ্যা :

এ বাণীতে আলী (আ.) মানুষের সাথে সুন্দর আচরণ করা এবং লেন-দেনের ক্ষেত্রে তাদের সাথে নীতিগত সঠিক আচরণের উপদেশ দিয়েছেন। কারণ,মানুষের সাথে সদ্ব্যবহার তাদেরকে সদাচারী ব্যক্তির উপস্থিতি ও অনুপস্থিতি উভয় অবস্থায় তার দিকে আকৃষ্ট করে।

বাণী নং ১৩

‘যখন তুমি (আল্লাহর) নিয়ামত ও অনুগ্রহ লাভ করা শুরু কর তখন কম শোকর আদায় (কৃতজ্ঞতার ক্ষেত্রে কার্পণ্যের মাধ্যমে) করে তা অব্যাহত থাকাকে দূরে সরিয়ে দিও না।

ব্যাখ্যা :

ইবনে মাইসাম বলেছেন : এ বাণীতে এ বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে যে,নিয়ামতকে অব্যাহত রাখতে শোকর আদায় করা অপরিহার্য। অধিক শোকর থেকে বিরত থাকা,যে নেয়ামত তার ভাগ্যে জুটেছিল তার প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শনের শামিল। মহান আল্লাহ নেয়ামত অব্যাহত থাকার জন্য তাঁর শোকর ও কৃতজ্ঞতা আদায়কে শর্ত হিসেবে উল্লেখ করেছেন এবং অস্বীকৃতিকে আযাবের কারণ বলেছেন : ‘যদি তোমরা আমার নিয়ামতের (অনুগ্রহের) শোকর আদায় কর তোমাদেরকে (নিয়ামতের ক্ষেত্রে) বৃদ্ধি করব আর যদি নিয়ামতের প্রতি অকৃতজ্ঞ হও আমার শাস্তি অত্যন্ত কঠোর।’- সূরা ইবরাহীম : ৭

বাণী নং ১৫

যে কেউ বালা মুসিবত বা পরীক্ষায় পড়লে তাকে তিরস্কার করা ঠিক নয়।

ব্যাখ্যা :

মানুষ কখনও তার ধর্মের ক্ষেত্রে পরীক্ষার সম্মুখীন হয় ও তার ওপর বিপদ- আপদ নেমে আসে। কখনও আবার পার্থিব কোন বিষয়ে সে বিপদগ্রস্ত হয়। কখনও  কখনও একই সঙ্গে উভয় ক্ষেত্রে পরীক্ষার মুখোমুখি হয়। কখনও মানুষ তার নিজের অজ্ঞতা (এই অজ্ঞতার বিষয়টি তার জ্ঞানে থাকুক বা না থাকুক অর্থাৎ সে যে এ বিষয়ে অজ্ঞ তা সে জানুক বা না জানুক) এবং কখনও জ্ঞাত বা অজ্ঞাত বাহ্যিক কারণে বিপদের সম্মুখীন হয়। এদের মধ্যে শুধু ঐ সকল ব্যক্তি তিরস্কারের যোগ্য যারা নিজেরাই নিজেদের বিপদ ডেকে আনার কারণ হয়েছে অর্থাৎ সে এ সমস্যায় পড়ার ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ বা আংশিক দায়ী।

যদি কেউ অজ্ঞতাবশত বিপদে পড়ে তবে তাকে তিরস্কার বা ভর্ৎসনা করা উচিত নয়। কিন্তু যদি কেউ জ্ঞাতসারে এমন কিছু করে যে কারণে সে এরূপ সমস্যায় পড়েছে তবে সেই ব্যক্তির সমালোচিত ও তিরস্কৃত হওয়া উচিত। যেমন যদি কেউ জানা সত্ত্বেও অসৎ ব্যক্তিদের সংসর্গ ত্যাগ না করে এবং এ কারণে বিপদে পড়ে তবে অবশ্যই তিরস্কৃত হবে। এর বিপরীতে পূর্বোল্লেখিত ব্যক্তিকে যদি ঐ অবস্থায় তিরস্কার করা হয় তবে তাতে তার কোন লাভ তো হবেই না বরং তা করলে তার প্রতি যুলুম করা হবে। তাই যে ব্যক্তি বিপদে পড়ার ক্ষেত্রে নিজে দায়ী নয় তাকে সাহায্য করতে হবে এবং তার জন্য দোয়া করতে হবে। ইবনে আবিল হাদীদ ‘মাফতুন’ শব্দের অর্থ প্রতারিত করেছেন। যদিও ইবনে মাইসাম শব্দটিকে বালা-মুসিবতে পতিত অর্থে ধরেছেন।

বাণী নং ১৬

সকল বিষয় অদৃষ্টের এতটা নিয়ন্ত্রণাধীন যে,কখনো কখনো চেষ্টার ফলে মৃত্যু হয়।

ব্যাখ্যা :

ইবনে মাইসাম এ বাণীর ব্যাখায় বলেছেন : যেহেতু মানুষ অদৃষ্টের রহস্য সম্পর্কে অবগত নয় সেহেতু তার উচিত পরিণতির বিষয়টি অদৃষ্টের ওপর ছেড়ে দেয়া এবং তার নিজের কাঙ্ক্ষিত পরিণতিকে অবধারিত জ্ঞান না করা। অনেক ক্ষেত্রেই মানুষ কোন কিছুতে কল্যাণ রয়েছে মনে করে সে লক্ষ্যে পৌছতে বিশেষ পরিকল্পনা করে,কিন্তু অবশেষে দেখতে পায় ঐ পরিকল্পনাই তার ধ্বংস ও পতনের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ইবনে আবিল হাদীদ এরূপ প্রচেষ্টার পরিণতির কয়েকটি উদাহরণ পেশ করেছেন। যেমন আবু মুসলিম খোরাসানী বিশেষ পরিকল্পনা নিয়ে আব্বাসী বংশকে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়,কিন্তু সে এই পরিকল্পনার মাধ্যমে নিজের মৃত্যু ডেকে আনে।

ইবনে মাইসাম বলেছেন,উক্ত বাণীতে হযরত আলী (আ.) শুধু পরিকল্পনার ওপর নির্ভর করতে নিষেধ করেছেন এবং পরিকল্পনার পর আল্লাহর ওপর নির্ভর করার ব্যাপারে তাগিদ দিয়েছেন। অর্থাৎ নিজের চিন্তা ও পরিকল্পনার ওপর আস্থা যেন তাকে আল্লাহর নির্ধারিত সিদ্ধান্তের কথা ভুলিয়ে না দেয়।

বাণী নং ২১

আমাদের অধিকার আছে যদি তা দেয়া হয়,তবে গ্রহণ করব-অন্যথায় আমরা উষ্ট্রসমূহের পিছনে আরোহণ করব যদিও রাতের ভ্রমণ দীর্ঘ হোক।

ব্যাখ্যা :

সাইয়্যেদ রাযি এ বাণী সম্পর্কে বলেছেন : এ বাক্যগুলো সূক্ষ্ম অর্থ বহন করে এবং অলংকারময় যা বাগ্মিতার পরিচয় বহন করে। এর বাণীর অর্থ আমাদের অধিকার না দেয়া হলে আমরা নত হয়ে থাকব অর্থাৎ উটের পেছনের আরোহীর ন্যায় যে বন্দী ও দাসের মত অবনত থাকে তার মত হব।

আজহারী আল কোতাইবী থেকে বর্ণনা করেছেন,হযরত আলী (আ.) উটের পিছনের আরোহীর উদাহরণ এজন্য দিয়েছেন যে,উষ্ট্রের পশ্চাদভাগে আরোহণ খুবই কষ্টকর একটি বিষয়। এরূপ উদাহরণ দিয়ে তিনি বুঝাতে চেয়েছেন,যদি তাঁদের অধিকার বঞ্চিত করা হয় তবে তাঁরা কষ্টকর বাহনে আরোহণ করবেন এবং ধৈর্য ধারণ করবেন যদিও তা দীর্ঘ সময়ের জন্য হয়। ধীর গতিতে কষ্ট সহ্য করে গন্তব্যে পৌছতে হলেও অধিকারের ব্যাপারে হাল ছাড়বেন না।

বাণী নং ২৪

হে আদম সন্তান! যখন দেখবে তোমার মহাপবিত্র প্রতিপালক,তাঁর অনুগ্রহ ও নিয়ামতকে অবিরতভাবে তোমাকে দিচ্ছেন অথচ তুমি তার নির্দেশকে অমান্য করছ (গুনাহে লিপ্ত রয়েছো) তখন তাঁকে ভয় কর।

ব্যাখ্যা :

এ বাণীতে হযরত আলী (আ.) আদম সন্তান অর্থাৎ মানবজাতিকে যখন তাদের ওপর আল্লাহর নিয়ামত অব্যাহত রয়েছে তখন পাপ থেকে দূরে থাকা ও আল্লাহকে ভয় করার উপদেশ দিয়েছেন। কেননা,যেমনভাবে আল্লাহর নিয়ামতের শোকর আদায় নিয়ামত অব্যাহত থাকার শর্ত তেমনি অকৃতজ্ঞতা যা ব্যক্তির গুনাহ ও নাফরমানীর মধ্যে প্রকাশ পায়,যার ফলে সে নিয়ামত লাভের উপযোগিতা হারায় এবং আল্লাহর অনুগ্রহ লাভ থেকে বঞ্চিত হয়। শুধু তা-ই নয় বরং এর পরিণতিতে সে আল্লাহর অসন্তুষ্টি ও ক্রোধের সম্মুখীন হয় এবং তার ওপর তাঁর শাস্তি অবধারিত হয় যেমন পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে : ‘এবং যদি তোমরা অকৃতজ্ঞ হও (তবে জেনে রাখ) নিশ্চয়ই আমার আযাব অত্যন্ত কঠোর।’-সূরা ইবরাহীম : ৭

তাই আল্লাহর ও মানুষের অধিকার হরণকারী কোন ব্যক্তির ওপর উপর্যুপরি নিয়ামত আসতে দেখে এটি তার জন্য কল্যাণকর মনে করা ঠিক নয় বরং এরূপ ব্যক্তির আল্লাহর শাস্তির ভয়ে শঙ্কিত ও সতর্ক হওয়া উচিত।

বাণী নং ২৯

নিজেকে রক্ষা কর! নিজেকে রক্ষা কর! আল্লাহর শপথ,তিনি তোমাদের গুনাহকে এমনভাবে ঢেকে রেখেছেন যেন তিনি তা ক্ষমা করেছেন।

ব্যাখ্যা :

ইবনে মাইসাম এ বাণীর ব্যাখ্যায় বলেছেন : মানুষ তার পাপের কারণে অবশ্যই আল্লাহর ক্রোধ থেকে নিজেকে রক্ষা করা উচিত। কেননা,তার এই অপরাধ ও পাপ ঢেকে রাখার বিষয়টি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য এবং তার চিরস্থায়ী বিষয় নয়। তাই তাঁর ক্রোধ থেকে নিজেকে রক্ষা করতে গুনাহ থেকে নিবৃত্ত থাকা এবং তাঁর আনুগত্য করা বান্দার জন্য অপরিহার্য। তিনি তাঁর শাস্তিকে ত্বরান্বিত না করে সুযোগ দিয়েছেন ও তাঁর বিশেষ অনুগ্রহে বান্দার পাপকে ঢেকে রেখেছেন এজন্য যে,বান্দা তাঁর অনুগ্রহকে স্মরণ করে তাঁর দিকে প্রত্যাবর্তন ও তওবা করবে।

বাণী নং ৩৭

ইমাম আলী (আ.) তাঁর পুত্র হাসান (আ.)-কে বলেন : ‘হে আমার পুত্র,(প্রথমে) চারটি এবং (পরে) চারটি বিষয় আমার কাছ থেকে সংরক্ষণ কর (সব সময় স্মরণ রাখ)। এতে তুমি তার সঙ্গে যা কিছুই কর কখনই তোমার ক্ষতি হবে না। বিষয়গুলো হলো : নিশ্চয় সবচেয়ে বড় অমুখাপেক্ষিতা (মূলধন) হলো বুদ্ধিমত্তা;সবচেয়ে বড় নিঃস্বতা হলো মূর্খতা,সবচেয়ে বড় ভয় ও একাকিত্ব হলো আত্মঅহমিকা এবং সবচেয়ে সম্মানজনক পরিচয় হলো সুন্দর চরিত্র ও ব্যবহার।

হে আমার পুত্র,মূর্খ লোকের বন্ধুত্ব থেকে দূরে থাক। কারণ,সে তোমার উপকার করতে গিয়ে অপকার করে ফেলবে। কৃপণ ব্যক্তির সঙ্গেও বন্ধুত্ব করো না। কারণ,যখন তোমার তার সাহায্যের তীব্র প্রয়োজন পড়বে সে তোমাকে সাহায্য করা থেকে বিরত থাকবে। পাপী (লম্পট ও প্রতারক) ব্যক্তির সঙ্গে বন্ধুত্ব (সম্পর্ক) করো না। কারণ,সে তোমাকে স্বল্পমূল্যে বিক্রি করে দেবে। মিথ্যাবাদীর সঙ্গে বন্ধুত্ব করো না। কারণ,সে মরীচিকার মত। তাই দূরের জিনিসকে সে তোমার জন্য কাছের (ও সহজলভ্য) এবং কাছের জিনিসকে দূরের (ও দুর্লভ্য) হিসেবে তুলে ধরবে।’

ব্যাখ্যা :

ইবনে মাইসাম বলেছেন : আমীরুল মুমিনীন আলী (আ.) প্রথম যে চারটি বিষয়ের উল্লেখ করেছেন তা ব্যক্তির নিজের সাথে সম্পর্কিত অর্থাৎ তার সত্তাগত বৈশিষ্ট্যের অন্তর্ভুক্ত। দ্বিতীয় চারটি বিষয় অন্য ব্যক্তির সাথে সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট বিষয়।

প্রথম চারটি বিষয়ের প্রথম হলো বুদ্ধিবৃত্তি। বুদ্ধিবৃত্তি বলতে এখানে চিন্তাশক্তি বুঝানো হচ্ছে যার মাধ্যমে মানুষ স্বতঃসিদ্ধ,ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য ও অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানকে ব্যবহার করে সিদ্ধান্তে পৌছায়। বুদ্ধিবৃত্তিকে সবচেয়ে বড় অমুখাপেক্ষিতা বলা হয়েছে এজন্য যে,এর মাধ্যমে দুনিয়া ও আখেরাত উভয়ই অর্জন করা যায়। যদি ব্যক্তি বুদ্ধিমত্তার অধিকারী না হয় তবে সে যত সম্পদের অধিকারী হোক না কেন সঠিকভাবে তা ব্যবহার করতে পারে না। তাই বুদ্ধি অমুখাপেক্ষিতার সবচেয়ে বড় উপকরণ।

দ্বিতীয়টি হলো মূর্খতা অর্থাৎ বুদ্ধির অনুপস্থিতি যা নেতিবাচক একটি বৈশিষ্ট্য। এ বিষয়টিকে সবচেয়ে বড় নিঃস্বতা এজন্য বলা হয়েছে যে,মূর্খতা ও অজ্ঞতার কারণে মানুষ উন্নত নৈতিক গুণাবলী অর্জনে সক্ষম হয় না এবং মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব হলো সর্বোত্তম নৈতিক গুণাবলীর অধিকারী হওয়া।

তৃতীয় বিষয় হলো আত্মগর্ব ও অহমিকা যা বিনয়ের বিপরীত বৈশিষ্ট্য। একে সবচেয়ে বড় ভয় ও একাকীত্ব বলা হয়েছে। কারণ,আত্মগর্ব ব্যক্তিকে অন্যদের থেকে দূরে সরিয়ে রাখে যা তাঁকে নিঃসঙ্গতার দিকে ঠেলে দেয়। এই নিঃসঙ্গতাই তার মধ্যে ভীতির সৃষ্টি করে। এর বিপরীতে বিনয় মানুষকে বিনয়ী ব্যক্তির দিকে আকৃষ্ট করে।

চতুর্থ বিষয় হলো সদাচরণ ও সদ্ব্যবহার। তা ব্যক্তির জন্য সবচেয়ে সম্মানজনক পরিচয় হওয়ার কারণ হলো সুন্দর চরিত্র ও স্বভাব মানুষের আত্মিক পূর্ণতার বহিঃপ্রকাশ।

দ্বিতীয় পর্যায়ে আলী (আ.) চারটি বিষয় (চার ধরনের ব্যক্তির সঙ্গে বন্ধুত্ব) পরিহারের উপদেশ দিয়েছেন। যথা :

১. মূর্খ ব্যক্তির সঙ্গে বন্ধুত্ব পরিহারের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। কারণ,সে তার মূর্খতার কারণে উপকারের স্থানে অপকার করে বসবে।

২. কৃপণ ব্যক্তির সংসর্গ ত্যাগ করতে বলেছেন। কারণ,তার কৃপণতা তার বন্ধুর তীব্র প্রয়োজনেও তার সাহায্য করা থেকে বিরত রাখবে।

৩. পাপী ও অসৎ ব্যক্তির সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে নিষেধ করা হয়েছে এজন্য যে,তার মধ্যে বিদ্যমান অনৈতিক বৈশিষ্ট্যসমূহ তাকে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করতে প্ররোচিত করে। ফলে সে দুনিয়াবী লাভের জন্য তাকে স্বল্প মূল্যে বিক্রি করতেও কুণ্ঠিত হয় না।

৪. মিথ্যাবাদী বন্ধুকে মরীচিকার সাথে তুলনা করেছেন এবং এমন ব্যক্তির সংশ্রব ত্যাগ করতে বলেছেন। এমন ব্যক্তিকে মরীচিকার সঙ্গে তুলনা করার কারণ হলো মরীচিকাকে যেমন মানুষ তার অতি নিকটে রয়েছে মনে করে,তাকে সহজপ্রাপ্য জ্ঞান করে অথচ বাস্তবে তেমন নয় তেমনি মিথ্যাবাদী যাকে সহজলভ্য বলে তুলে ধরে বাস্তবে তা অর্জন দুঃসাধ্য ও অসম্ভব। কখনও কখনও সে সহজলভ্য বিষয়কে দুস্প্রাপ্য হিসেবে উপস্থাপন করে যা বাস্তবের বিপরীত যেমন মরীচিকাকে মানুষ পানি মনে করে তার দিকে ধাবিত হয়ে দেখে বাস্তবে তেমনটি নয়।

বাণী নং ৩৮

নফল ইবাদত করতে গিয়ে যদি ফরয ইবাদতের ব্যাঘাত ঘটে তবে তার মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য পাওয়া যায় না।

নফল ইবাদতের মাধ্যমে ফরয ইবাদতের ব্যাঘাত কয়েকভাবে ঘটতে পারে। কখনও নফল ইবাদত করতে গিয়ে ফরয ইবাদত করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। যেমন রাত জেগে ইবাদত করতে গিয়ে ফজরের নামায কাযা হয়ে যাওয়া,কখনও একটি মুস্তাহাব অংশ আদায় করতে যাওয়ার কারণে ফরয ইবাদতের কোন অপরিহার্য অংশ (রুকন) পালন করতে না পারা ইত্যাদি। উভয় ক্ষেত্রে যেহেতু ফরয ইবাদত ক্ষতিগ্রস্ত হয় (সম্পূর্ণ হাত ছাড়া হওয়া বা অপরিহার্য অংশ বাদ পড়ার মাধ্যমে) সেহেতু তা গুনাহর শামিল এবং যে কর্ম আল্লাহর নির্ধারিত ফরয কাজের অন্তরায় হয় তার মাধ্যমে কখনও আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা যায় না।

বাণী নং ৪০

হযরত আলী (আ.) তাঁর এক সহচরের অসুস্থতার সময় বলেন : ‘আল্লাহ্ তোমার রোগকে পাপ খণ্ডনের উপায় করে দিন। কারণ,অসুস্থতার কোন পুরস্কার নেই। কিন্তু তা তোমার পাপকে মোচন করে এবং তা শুকনো পাতার মতো ঝরিয়ে দেয়। পুরস্কার শুধু মুখের কথা এবং হাত ও পায়ের (অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের) দ্বারা সম্পাদিত কর্মে। মহান আল্লাহ্ তাঁর বান্দাদের মধ্য থেকে হৃদয়ের নিয়তের সততা এবং আত্মিক পবিত্রতার অধিকারীদের যাকে ইচ্ছা বেহেশতে প্রবেশ করাবেন।’

ইবনে মাইসাম বলেন : ইমাম আলী (আ.) অসুস্থতার কারণে ঐ ব্যক্তির পাপ মোচনের জন্য দোয়া করেছেন,তার জন্য পুরস্কার ও সওয়াবের দোয়া করেননি এবং তার কারণ উল্লেখ করে বলেছেন,অসুস্থতার জন্য কোন পুরস্কার নেই।

মানুষ তার কর্মের মাধ্যমে সওয়াব ও পুরস্কারের অধিকারী হয় নতুবা যে কর্ম করতে তাকে নিষেধ করা হয় তা থেকে বিরত থাকার মাধ্যমে। কিন্তু অসুস্থতা এ দুটির কোনটিরই অন্তর্ভুক্ত নয়। কিন্তু অসুস্থতা মানুষের পাপ মোচনের উপকরণ দু’ভাবে হতে পারে :

১. যেহেতু মানুষ জৈবিক প্রবৃত্তি ও ক্রোধের বশবর্তী হয়েই গুণাহ্য় নিপতিত হয়,অসুস্থতা এ প্রবৃত্তির উপশম ঘটিয়ে অপরাধ ও অন্যায়ের প্রবণতার হ্রাস ঘটায়।

২. অসুস্থতা মানুষের মধ্যে আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তনের ক্ষেত্র সৃষ্টি করে এবং তাকে তার গুনাহর জন্য অনুতপ্ত হয়ে ভবিষ্যতে তাতে পতিত না হওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে উদ্বুদ্ধ ও আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনায় অনুপ্রাণিত করে। যেমন পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ্ বলেছেন : ‘যখন দুঃখ-কষ্ট মানুষকে স্পর্শ করে তখন সে শায়িত,বসা ও দণ্ডায়মান অবস্থায় আমাদেরকে ডাকে।’-সূরা ইউনূস : ১২

তাই গুনাহর কারণে মানুষের মধ্যে যে কলুষের সৃষ্টি হয় অসুস্থতার সময় আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনার মাধ্যমে সে তা থেকে মুক্তি লাভ করে। শুকনো পাতা যেমন গাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে ঠিক তেমনি অসুস্থতার সময় গুণাহ পাপী ব্যক্তি থেকে বিচ্ছিন্ন ও দূরীভূত হয়।

অবশেষে হযরত আলী (আ.) এ বিষয়ের প্রতি ইশারা করেছেন যে,যখন অসুস্থ ব্যক্তি তার ওপর আপতিত কষ্টকে মেনে নিয়ে পবিত্র আত্মা নিয়ে সৎ নিয়তে আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে তাতে ধৈর্য ধারণ করে তখন তার এ কর্ম আল্লাহর পক্ষ থেকে সওয়াব ও পুরস্কার লাভের উপযোগিতা লাভ করে এবং তার বেহেশতে প্রবেশের কারণ হয়। কারণ,তার এ কর্ম ঐ সকল স্থায়ী বৈশিষ্ট্যের অন্তর্ভুক্ত যা আল্লাহর নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে সম্পাদিত হয়েছে।

বাণী নং ৪৩

‘যে মন্দ কাজ (তুমি তা করার পর) তোমাকে দুঃখিত করে তা আল্লাহর নিকট তোমার ঐ সৎকর্ম থেকে উত্তম যা তোমাকে গর্বিত করে।’

এ বাণীতে ‘যে মন্দ কাজ তোমাকে দুঃখিত করে’ বলতে যে পাপ কর্ম মানুষের দ্বারা সম্পাদিত হওয়ার পর তাকে অনুশোচিত করে ও তার মনঃকষ্টের কারণ হয় তা বুঝানো হয়েছে এবং ‘যে সৎকর্ম তোমাকে গর্বিত করে’ বলতে ঐ সকল সৎকর্মের প্রতি ইশারা করা হয়েছে যা তার মধ্যে অহংকারের জন্ম দেয় এবং ফলে সে নিজেকে অন্যদের থেকে শ্রেষ্ঠ ভাবে। আল্লাহর নিকট এমন সৎকর্ম অপেক্ষা যে মন্দ কর্ম ব্যক্তিকে মনঃপীড়ায় দগ্ধ করে তা উত্তম বলে পরিগণিত। কারণ,মানুষ যদি মন্দ কর্ম করার পর অনুশোচিত হয় তবে তা ঐ মন্দ কর্মকে মুছে ফেলে,কিন্তু মানুষ সৎ কর্ম করার পর তা নিয়ে গর্বিত হলে তা ঐ সৎকর্ম বিনষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তদুপরি আত্মগর্ব অন্যতম নিন্দনীয় মন্দ বৈশিষ্ট্য যা অন্তরকে কলুষ করে। যেহেতু এরূপ কর্মের মন্দ প্রভাব অত্যন্ত বেশি সেহেতু আল্লাহর নিকট তা বেশি অপছন্দনীয়। 

চলবে..