সূরা আলে ইমরান;(১৫তম পর্ব)

সূরা আলে ইমরান; আয়াত ৭৭-৮২

সূরা আলে ইমরানের ৭৭ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-

إِنَّ الَّذِينَ يَشْتَرُونَ بِعَهْدِ اللَّهِ وَأَيْمَانِهِمْ ثَمَنًا قَلِيلًا أُولَئِكَ لَا خَلَاقَ لَهُمْ فِي الْآَخِرَةِ وَلَا يُكَلِّمُهُمُ اللَّهُ وَلَا يَنْظُرُ إِلَيْهِمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَلَا يُزَكِّيهِمْ وَلَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ (৭৭)

"নিশ্চয়ই যারা আল্লাহর অঙ্গীকার ও নিজের ওয়াদা সামান্য মূল্যে বিক্রি করে, পরকালে তাদের কোন অংশ নেই। আল্লাহ বিচার দিবসে তাদের সম্পর্কে কথা বলবেন না এবং তাদের দিকে রহমতের দৃষ্টি দিবেন না। আল্লাহ এদেরকে পাপ থেকে পরিশুদ্ধও করবেন না। তাদের জন্যে রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।" (৩:৭৭)

আল্লাহ মানুষের মুক্তি ও সৌভাগ্যের লক্ষ্যে তাদেরকে দুই পদ্ধতিতে পথ প্রদর্শন করেন। এই দুই পদ্ধতির একটি হলো,ফিতরাত বা মানুষের অভ্যন্তরীণ বিবেক। বিবেকই মানুষকে বলে দেয় কোনটা খারাপ ও কোনটা ভাল। আর দ্বিতীয়টি হলো ওহী,যার উৎস আল্লাহর অসীম জ্ঞান। ধর্ম ও ধর্মীয় আইন হিসেবে ওহী মানুষকে ক্রমেই পূর্ণতার পথে পরিচালিত করে। খোদায়ী বা ঐশী প্রতিশ্রুতির মধ্যে ধর্মের ও বিবেকের উপদেশ রয়েছে। মানুষের বিবেক তা মেনে নেয় এবং এর বাস্তবায়নকে দায়িত্ব বলে মনে করে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে মানুষের মধ্যে একদল খোদায়ী চুক্তি ভঙ্গ করে এবং দুনিয়ার কায়েমী স্বার্থ হাসিলের জন্য নিজের খেয়ালীপনাকে আল্লাহর চেয়ে বেশী গুরুত্ব দেয়। নিঃসন্দেহে আল্লাহ এ ধরনের আচরণ পছন্দ করেন না। আল্লাহর ক্রোধের পরিণতিতে এ ধরনের মানুষ বিচার দিবসেও আল্লাহর বিশেষ রহমত থেকে বঞ্চিত হয়। অথচ বিচার দিবসে আমরা সবাই আল্লাহর দয়ার মুখাপেক্ষী।

এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো,
প্রথমত : চুক্তি ও ওয়াদা ভঙ্গ করা ধর্ম থেকে বেরিয়ে আসার সমান এবং এর ফলে দোযখের আগুনে পুড়তে হবে।
দ্বিতীয়ত : আমানতদারী হলো খোদায়ী চুক্তি । পূর্ববর্তী আয়াতে মানুষের আমানতদারী সম্পর্কে কথা বলা হয়েছে। এই আয়াতে বলা হয়েছে আমানত রক্ষা হলো আল্লাহর সাথে করা অন্যতম চুক্তি। তাই সবারই উচিত আমানত রক্ষা করা।

সূরা আলে ইমরানের ৭৮ নম্বর আয়াতে আল্লাহপাক বলেছেন-

وَإِنَّ مِنْهُمْ لَفَرِيقًا يَلْوُونَ أَلْسِنَتَهُمْ بِالْكِتَابِ لِتَحْسَبُوهُ مِنَ الْكِتَابِ وَمَا هُوَ مِنَ الْكِتَابِ وَيَقُولُونَ هُوَ مِنْ عِنْدِ اللَّهِ وَمَا هُوَ مِنْ عِنْدِ اللَّهِ وَيَقُولُونَ عَلَى اللَّهِ الْكَذِبَ وَهُمْ يَعْلَمُونَ(৭৮)

"আহলে কিতাবদের মধ্যে এমন একদল লোক আছে,যারা খোদায়ী গ্রন্থ পাঠের নামে নিজেদের লেখা পাঠ করে। তোমরা তাকে আল্লাহর গ্রন্থ মনে কর। কিন্তু তা খোদায়ী গ্রন্থের অংশ নয়। এমনকি তারা এর সত্যতার দাবির পক্ষে বলে, আমরা যা পড়ে শোনাচ্ছি তা আল্লাহর পক্ষ থেকে এসেছে। কিন্তু তা আল্লাহর পক্ষ থেকে আসেনি। তারা জেনেশুনে আল্লাহর ওপর মিথ্যা আরোপ করছে।" (৩:৭৮)

আমরা আগেও আলোচনা করেছিলাম ধর্মের ব্যাপারে এক শ্রেণীর পণ্ডিতদের গোড়াঁমী,স্বার্থ ও হিংসা মানুষের বিভ্রান্তির অন্যতম কারণ । তারা এইসব কারণে মানুষের কাছে সত্য তুলে ধরেনি এবং সত্য ঢেকে রাখা ছাড়াও তারা ধর্মের নামে নিজেদের বিশ্বাস ও চিন্তাধারা প্রচার করে সত্যকে বিকৃত করেছে। পবিত্র কোরআন এইসব বিপজ্জনক ‘পণ্ডিত' সম্পর্কে মুসলমানদের সাবধান করে দিচ্ছে,যাতে তারা বিভ্রান্ত পণ্ডিতদের চাকচিক্যময় কথাবার্তায় প্রতারিত না হয়। এই আয়াতে বলা হয়েছে অনেক মানুষ ধর্মের নামে সবচেয়ে বড় মিথ্যা প্রচার করছে।

এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো,
প্রথমত : যে কোন কথায় কান দেয়া উচিত নয়। অনেক সুন্দর সুন্দর কথাকে কোরআনের বাণীর অনুকূল মনে হতে পারে,কিন্তু আসলে সেগুলো কোরআন বিরোধী। একশ্রেণীর মানুষ ধর্মের নামে ধর্মের গোড়া কেটে দিচ্ছে।
দ্বিতীয়ত : আল্লাহকে ভয় করে না-এমন পণ্ডিতদের সম্পর্কে সাবধান থাকতে হবে। এরা মানুষকে বিভ্রান্ত করে এবং নিজের কথাকে আল্লাহর কথা বলে মিথ্যাচার করে।
সূরা আলে ইমরানের ৭৯ ও ৮০ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

مَا كَانَ لِبَشَرٍ أَنْ يُؤْتِيَهُ اللَّهُ الْكِتَابَ وَالْحُكْمَ وَالنُّبُوَّةَ ثُمَّ يَقُولَ لِلنَّاسِ كُونُوا عِبَادًا لِي مِنْ دُونِ اللَّهِ وَلَكِنْ كُونُوا رَبَّانِيِّينَ بِمَا كُنْتُمْ تُعَلِّمُونَ الْكِتَابَ وَبِمَا كُنْتُمْ تَدْرُسُونَ (৭৯) وَلَا يَأْمُرَكُمْ أَنْ تَتَّخِذُوا الْمَلَائِكَةَ وَالنَّبِيِّينَ أَرْبَابًا أَيَأْمُرُكُمْ بِالْكُفْرِ بَعْدَ إِذْ أَنْتُمْ مُسْلِمُونَ ( (৮০

"কোন মানুষই আল্লাহর পক্ষ থেকে গ্রন্থ,প্রজ্ঞা,হেকমত,রাষ্ট্র ও নবুওত পাবার পর মানুষের মধ্যে এটা বলার অধিকার রাখে না যে তোমরা আল্লাহকে ছেড়ে আমার উপাসক হও বরং তারা বলবে তোমরা প্রভূ বা রাব্বানীর উপাসক হও। কারণ তোমরা অন্যদেরকে আল্লাহর গ্রন্থ শিক্ষা দাও এবং তোমরাই তা পাঠ করে থাক।" (৩:৭৯)
"তিনি এও বলবেন না যে,তোমরা ফেরেশতা ও নবীকূলকে প্রতিপালক হিসেবে গ্রহণ কর। তোমরা আত্মসমর্পনকারী হবার পর এটা কি সম্ভব যে কোনো নবী তোমাদের অবিশ্বাসী হতে বলবেন?" (৩:৮০)

বিভ্রান্ত ধর্মীয় পণ্ডিতদের বিপদ সম্পর্কে সাবধান করার পর এই আয়াতে তাদের উদ্দেশ্যে বলা হচ্ছে,এমনকি যেসব নবীকে ঐশীগ্রন্থ,প্রজ্ঞা ও শাসন অধিকার দেয়া হয়েছে তাদেরও অধিকার নেই মানুষকে নিজের সেবা বা দাসত্বের দিকে আহবান করার,বরং মানুষকে আল্লাহর দাসত্বের দিকে আহবান করাই তাদের দায়িত্ব। তাই তোমরা সেইসব নবীর অনুসারী ও ঐশীগ্রন্থের শিক্ষক হয়ে কীভাবে খোদায়ী বিধানের নামে নিজেদের মনগড়া কথা প্রচার করছ? মনে হচ্ছে যেন তোমরা নিজেরাই মানুষের প্রভু হয়ে বসেছো? ঐশী গ্রন্থ সম্পর্কে সাধারণ মানুষের চেয়ে তোমাদের জ্ঞান বেশী থাকায় আশা করা হচ্ছিল যে তোমরা অন্যদের চেয়ে বেশী মুমিন ও খোদায়ী বিধানের ভক্ত হবে। বিভ্রান্ত ধর্মীয় পণ্ডিতদের উদ্দেশে এ আয়াতে আরো বলা হয়েছে,মানুষকে প্রভু হিসেবে মানা এবং খোদায়ী বিধানে মানুষের হস্তক্ষেপ বা পরিবর্তন কুফরি তথা খোদাদ্রোহীতার শামিল। কোন নবী নিজের বা অন্যান্য নবীর জন্য এবং ফেরেশতাদের জন্যেও এ ধরনের অধিকার দাবী করতে পারেন না। তাই তোমরা ঐশী গ্রন্থের পণ্ডিত হয়েও কীভাবে প্রভুর স্থান দখল করেছ এবং নিজেদের চিন্তাধারাকে ধর্ম বলে প্রচার করছ ও ধর্মের বিধান বিকৃত করেছ?

এই দুই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো,
প্রথমত : পদ মর্যাদা,জনপ্রিয়তা ও দায়িত্বশীলতার যে কোন অপব্যবহার নিষিদ্ধ। এমনকি নবীর জন্যেও পদ মর্যাদা থেকে সুবিধে হাসিলের কোন অধিকার নেই।
দ্বিতীয়ত : একমাত্র খোদাভীরু পণ্ডিত বা আলেমরাই কোরআনের ব্যাখ্যা দেয়ার অধিকার রাখেন। কোরআন ও এর শিক্ষাকে ভালবাসার মাধ্যমেই মানুষ খোদাভীরু হতে পারে।
তৃতীয়ত : নবী ও অলি আওলিয়া সম্পর্কে কোন কুসংস্কার বা চরমপন্থী ধারণা রাখা নিষিদ্ধ। তাঁরাও আল্লাহর দাস বা বান্দা এবং ইবাদত বা দাসত্বের মাধ্যমেই তাঁরা উচ্চ মর্যাদায় পৌছেন। তাঁরা কখনও খোদা হয়ে পড়েন নি।
চতুর্থত : আল্লাহকে অস্বীকার করাই শুধু কুফরী নয়। খোদায়ী আইনের বিরুদ্ধে যে কোন ভূমিকাও খোদাদ্রোহীতা বা কুফুরীর শামিল।

সূরা আলে ইমরানের ৮১ ও ৮২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

وَإِذْ أَخَذَ اللَّهُ مِيثَاقَ النَّبِيِّينَ لَمَا آَتَيْتُكُمْ مِنْ كِتَابٍ وَحِكْمَةٍ ثُمَّ جَاءَكُمْ رَسُولٌ مُصَدِّقٌ لِمَا مَعَكُمْ لَتُؤْمِنُنَّ بِهِ وَلَتَنْصُرُنَّهُ قَالَ أَأَقْرَرْتُمْ وَأَخَذْتُمْ عَلَى ذَلِكُمْ إِصْرِي قَالُوا أَقْرَرْنَا قَالَ فَاشْهَدُوا وَأَنَا مَعَكُمْ مِنَ الشَّاهِدِينَ (৮১) فَمَنْ تَوَلَّى بَعْدَ ذَلِكَ فَأُولَئِكَ هُمُ الْفَاسِقُونَ (৮২)

"আল্লাহ যখন পূর্ববর্তী নবীদের কাছ থেকে এ অঙ্গীকার গ্রহণ করেছিলেন যে, আমি তোমাদেরকে গ্রন্থ ও বিজ্ঞান হতে দান করার পর তোমাদের সঙ্গে যা আছে তার সত্যতা প্রমাণকারী একজন রাসুল আসবে। তখন তোমরা অবশ্যই তার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করবে এবং তার সাহায্যকারী হবে। এরপর আল্লাহ বলেছিলেন , তোমরা কি এই অঙ্গীকারের গুরু দায়িত্ব গ্রহণ করলে এবং আমার শর্ত মেনে নিলে ? সবাই বললেন আমরা স্বীকার করলাম। আল্লাহ বললেন তবে তোমরা সাক্ষী থাক এবং আমিও তোমাদের সাথে সাক্ষী থাকলাম।" (৩:৮১)
"এরপর যারা বিমুখ হবে,তারাই সত্য ত্যাগী।" (৩:৮২)

বিভিন্ন তাফসীরে এসেছে- আল্লাহ তায়ালা হযরত মুসা ও হযরত ঈসা (আঃ)'র মত পূর্ববর্তী অনেক নবীর কাছে এ ওয়াদা নিয়েছিলেন যে,তারা মানুষকে ইসলামের নবীর আবির্ভাব সম্পর্কে সুসংবাদ দেবেন এবং শেষ নবীর বৈশিষ্ট্য ও গুণাবলী বর্ণনা করে তাঁর প্রতি মানুষের বিশ্বাসের ক্ষেত্র তৈরী করবেন। কারণ, সমস্ত নবী এক আল্লাহর পক্ষ থেকে এসেছেন এবং তাঁদের খোদায়ী গ্রন্থগুলোও পরস্পরের সত্যতার স্বীকৃতি দেয়। তাই নতুন নবীর আগমনের পর পূর্ববর্তী নবীর অনুসারীদের উচিত তাঁর ওপর ঈমান আনা এবং শত্রুদের মোকাবেলায় তাঁকে সাহায্য করা। পূর্ববর্তী নবীগণ রাসুল (সাঃ)'র যুগে উপস্থিত ছিলেন না বলে তাঁর ওপর ঈমান আনতে পারেননি। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো,তারা এজন্যে প্রস্তুত ছিলেন। যেমনটি মুজাহিদরা যুদ্ধের ময়দানে শহীদ হবার জন্য প্রস্তুত থাকলেও তাঁরা শহীদ নাও হতে পারেন। অন্য কথায় আল্লাহর বিধানের কাছে নিজেকে সমর্পন করাই গুরুত্বপূর্ণ,যদিও ঐ বিধান বাস্তবায়নের পরিবেশ সৃষ্টি নাও হতে পারে।

এবারে এই দুই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো,
প্রথমত : রেসালাতের দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে নবীদের মধ্যে পার্থক্য একই স্কুলের বিভিন্ন শিক্ষকের মধ্যে পার্থক্যের সমান। তাঁদের সবারই লক্ষ্য এক। প্রত্যেক শিক্ষক তাঁর ছাত্রকে শিক্ষাদান অব্যাহত রাখার জন্য পরবর্তী শিক্ষকের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন।
দ্বিতীয়ত : শুধু মৌখিক ঈমানই যথেষ্ট নয়। ধর্মীয় নেতৃবৃন্দদের সাহায্য করা এবং ধর্মের জন্যে কাজ করাও জরুরী।
তৃতীয়ত : বিভিন্ন যুগে নবীদের আগমন ঘটায় তারা একে অপরের প্রতি ঈমান আনতে পারেননি। কিন্তু কোন নবীই অন্য কোন নবী ও ধর্মের প্রতি কখনও বিন্দুমাত্র বিদ্বেষী ছিলেন না।