পবিত্র আশুরার শিক্ষা এবং কিছু কথা

বর্ষ পরিক্রমায় আবারও আমাদের মাঝে ফিরে এসেছে শোকাবহ আশুরা। ৬১ হিজরীর মহররম মাসের আশুরার দিন রাসূলে খোদা (সাঃ)-এর প্রাণপ্রিয় দৌহিত্র হযরত ইমাম হুসাইন (আঃ)-এর শাহাদতের পর থেকে আজ অবধি এক হাজার তিন শত পয়ষট্রি বারের বেশি বার ঐতিহ্যবাহী আশুরা আমাদের মাঝে ফিরে এসেছে। আর প্রতি বারই সাইয়্যেদুশ শোহাদা ইমাম হুসাইনপ্রেমীদেরকে নতুন নতুন শিক্ষা দান করেছে। এভাবে আশুরার কালজয়ী এ বিপ্লব মানুষের মণি কোঠায় স্থান পেয়েছে। শত্রুরা শত চেষ্টা করেও আশুরার মহা প্রদীপকে নিভাতে পারে নি। বরং তা যুগ যুগ ধরে আশুরা ভক্তদের হেদায়েতের কারণ হয়েছে।

তবে আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে,ইতিহাসের নানা বাধা বিপত্তিকে উপেক্ষা করে এবং ইমাম হুসাইনপ্রেমীদের অপরিসীম ত্যাগ-তিতিক্ষার বিনিময়ে আশুরার সংস্কৃতি (অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের আপোষহীন সংগ্রামের শিক্ষা) আমাদের হাতে এসেছে পৌছেছে। আর তাই ইমাম হুসাইন (আঃ)-এর অনুসারী হিসেবে আমাদের অত্যাবশ্যকীয় দায়িত্ব হচ্ছে এ মহান শিক্ষাকে অক্ষতভাবে যে কোন মূল্যে ভবিষ্যত প্রজন্মের হাতে তুলে দেওয়া। অবশ্য এটা তখনই বাস্তবায়িত হবে,যখন আমাদের যাবতীয় চেষ্টা ও প্রচেষ্টা একমাত্র আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের উদ্দেশ্যে সম্পন্ন হবে।

নিশ্চয়ই আশুরার মহিমান্বিত শিক্ষার প্রচার ও প্রসারই হচ্ছে আহলে বাইত (আঃ)-এর প্রতি ভালবাসা পোষণকারীদের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব। যদিও এ দায়িত্ব সুসম্পন্ন অত্যন্ত কষ্ট্যসাধ্য। কিন্তু নিঃসন্দেহে আল্লাহর দরাবরে এ কষ্টের প্রতিদান অত্যাধিক।

যে সব ব্যক্তিবর্গ ইমাম হুসাইন (আঃ)-এর আদর্শকে জাগ্রত রাখতে সাধ্যানুযায়ী চেষ্টা-প্রচেষ্টা ও কষ্ট-দুঃখ সহ্য করবে,নিঃসন্দেহে তাদের পূণ্য কর্মসমূহ ইতিহাসে স্বার্ণাক্ষারে খচিত থাকবে। পক্ষান্তরে কেহ যদি ইমাম হুসাইন (আঃ) ও তাঁর পরিবারবর্গের স্বরণে আয়োজিত শোকানুষ্ঠান পালনে প্রতিবন্ধতা সৃষ্টির অপচেষ্টা করে,তাহলে ইতিহাসে তার নাম ঘৃণাক্ষরে লিপিবদ্ধ থাকবে।

যারা ইমাম হুসাইন (আঃ)-এর শোকানুষ্ঠানের প্রতি অসৌজন্য আচরণ ও এমন ধৃষ্টতাপূর্ণ মন্তব্য যেমন,“এসব পালন করে লাভ কি?” অথবা শোকানুষ্ঠান পালনের ক্ষেত্রে স্বামী স্ত্রীকে স্ত্রী স্বামীকে,এক ভাই অপর ভাইকে ও এক প্রতিবেশী অপর প্রতিবেশীকে কোনরূপ বাধা প্রদান করে,তাহলে তাদের সবাইকে উক্ত কর্মের জন্য কিয়ামতের দিন জবাবদিহি করতে হবে।

 

আলাহর ন্যায়পরায়ণতার প্রতি ভীতি

মহান আল্লাহর পবিত্র গুণাবলীর মধ্যে একটি ব্যতিত কোনটিও ভীতিকর নয়,যেমনঃ রহমান অর্থাৎ দয়ালু,রাজ্জাক অর্থাৎ রিজিকদাতা,গাফ্ফার অর্থাৎ ক্ষমাশীল। কিন্তু আল্লাহর যে নামটি সবাইকে ভীতিগ্রস্থ করে,সেটা হচ্ছে আদীল অর্থাৎ ন্যায়বিচারক। আল্লাহ যদি আমাদের সম্পাদিত যাবতীয় সৎকর্মসমূহ (ক্ষুদ্র ও বৃহৎ) লিপিবদ্ধ করে স্বীয় দয়াশীলতায় সেগুলোর জন্য পুরুস্কার দান করেন,তাহলে তা আমাদের নাযাতের কারণ হতে পারে। কিন্তু তিনি যদি অনুরুপভাবে আমাদের কৃত গুনাহের জন্য শাস্তি প্রদান করেন,তাহলে আমাদের পরিণতি কতই শোচনীয় হবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আমাদের জেনে রাখা উচিত যে,জাহান্নামে আগুনে একবার পুড়লেই মানুষের কৃত গুনাহসমূহ ক্ষমা পাবে না। বরং মানুষ শত শত বার আগুনে পুড়বে এবং শত শত বার জীবিত হবে। এভাবে তাকে জাহান্নামের যন্ত্রণাদায়ক আযাব ভোগ করতে হবে। জাহান্নামের আযাব প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআনে যে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে; সে সম্পর্কে যদি আমরা একটু গভীরভাবে চিন্তা করি তাহলে আমাদের ঘুমই হারাম হয়ে যাবে। কোরআনের ভাষায়,

وَيَأْتِيهِ الْمَوْتُ مِنْ كُلِّ مَكَانٍ وَمَا هُوَ بِمَيِّتٍ

“মৃত্যু যন্ত্রণা চতুর্দিক থেকে আক্রান্ত করবে,কিন্তু তার মৃত্যু হবে না।(সূরা ইবরাহীম,আয়াত নং- ১৭)

আমাদের কখনও এমন ধারণা করা উচিত নয় যে,কারও গৃহে যদি অন্নের ব্যবস্থা না থাকে অথবা কেহ যদি কারাভ্যন্তরে বন্দী থাকে তাহলে সে দূর্ভাগ্য ও অসহায়ের শিকার হয়েছে। কেননা,সময়ের আবর্তে অন্নহীনের গৃহে অন্ন আসবে এবং কারাবন্দীও মুক্তি লাভ করবে। বরং সেই হচ্ছে দূর্ভাগ্য ও অসহায়ের শিকার যে ব্যক্তি আল্লাহর আদালতে স্বীয় গুনাহের শিকলে বন্দী হয়ে খোদার ন্যায়বিচারের সম্মুখীন হবে। যখন মানুষের আমল নামা উক্ত আদালতে হাজির করা হবে,তখন সে আমলনামাতে পৃথিবীতে কৃত যাবতীয় গুনাহ লিপিবদ্ধ অবস্থাতে দেখতে পাবে এবং সেগুলোর জন্য তাকে জবাবদিহিতা করতে হবে।

এ কঠিন বিচারের দিন যাদের আমলনামা সৎকর্মে পরিপূর্ণ থাকবে তারাই নাযাতের অধিকারী হবে। আর এ নাযাত প্রাপ্তদের প্রথম সারিতে তারা অবস্থান করবে,যারা ইমাম হুসাইন (আঃ)-এর পবিত্র আদর্শকে জাগ্রত রাখতে অক্লান্ত পরিশ্রম করবে।

সাইয়্যেদুশ শোহাদা ইমাম হুসাইন (আঃ)-এর স্বরণে আয়োজিত শোকানুষ্ঠানের গুরুত্ব ও তাৎপর্য এতই অধিক যে,অনেক বিশিষ্ট আলেম-ওলামারাও এসব শোকানুষ্ঠানে অংশ গ্রহণ নিজেদের জন্য গর্ব ও অন্যতম নেক আমল হিসেবে মনে করেন। উদাহরণস্বরুপ বলা যেতে পারে : প্রতি বছর আশুরার দিন কারবালার নিকটবর্তী তোওরীখ নামকস্থানে একটি আযাদারী বা শোকানুষ্ঠান পালিত হয়। তৎকালীন শ্রেষ্ঠ আলেম হযরত আয়াতুল্লাহ্ মুরতাজা বাহরুল উলুম (রহঃ) নিয়মিত উক্ত আযাদারীতে অংশ গ্রহণ করতেন। তিনি নিজেই বলেছেন : ইমামে জামান হযরত মাহদী (আঃ)-কে এ আযাদারীতে দেখেছি। এ আযাদারী আমি কারবালাতে অবস্থানকাল পর্যন্ত (৩৫ বছর পূর্বে) প্রতি বছর অত্যন্ত ভাবগাম্ভীর্যপূর্ণ পরিবেশে অনুষ্ঠিত হত। হাজার হাজার শোকার্ত জনতাকে খালি পায়ে এ আযাদারীতে মাতম করতে দেখেছি। এমনকি অনেক বিশিষ্ট মারজায়ে তাকলীদকে দেখেছি খালি পায়ে উক্ত আযাদারীতে শরীক হয়ে মাতম করতে। অনেক ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিকেও শোকানুষ্ঠানে শরীক হতে দেখেছি। এ সমস্ত ব্যক্তিবর্গ যদি তাদের পিতারও মৃত্যু ঘটে তবুও তারা এমনভাবে আহাজারী ও মাতম করবে না। সত্যিই তারা কতই না সৌভাগ্যবান।

ইমাম হুসাইন (আঃ)-এর শোকে মাতমকারী

সাইয়্যেদুশ শোহাদা ইমাম হুসাইন (আঃ)-এর হৃদয়বিদারক শাহাদতের স্মৃতিকে স্মরণ করে আযাদারী বা মাতমকারীরা মূলতঃ রাসূলে খোদা (সাঃ)-এর প্রতি শোক ও সহানুভূতি জ্ঞাপন করে থাকে। ইমাম সাদীক (আঃ) বলেছেন,

“যদি রাসূলে খোদা (সাঃ) জীবিত থাকতেন তাহলে অবশ্যই (এ শাহাদতের জন্য) তাকে শোক ও সমবেদনা জ্ঞাপন করা হত।”(বিহারূল আনওয়ার,খণ্ড ৪৫,পৃঃ ৬৩,হাদীস নং ৩।)

আশুরার দিনে হযরত ইমাম হুসাইন (আঃ) ও তাঁর পরিবারবর্গদের উপর পাপিষ্ট ইয়াজিদ বাহিনী যে অমানষিক অত্যাচার ও অবিচার করেছিল,তা আমাদের পক্ষে অনুধাবন করা সম্ভব নয়। হয়তো সেদিনের মর্মান্তিক ঘটনাবলী সম্পর্কে আমরা অংশিক ধারনা অর্জন করতে পারি। কিন্তু আশুরার দিন ইমামের মনের অবস্থা কিরূপ ছিল তা আমাদের পক্ষে আদৌ অনুধাবন করা সম্ভব নয়। নিঃসন্দেহে মাসুম ইমামগণ (আঃ)-সৃষ্টি জগতের সবচেয়ে সুদৃঢ় মনোবল ও স্বর্গীয় মানসিকতার অধিকারী। আত্ম সংযম ও আত্ম সংবরণের ক্ষেত্রে তাদের কোন বিকল্প নেই। তথাপি আবেগ ও অনুভূতি যে কোন মানব হৃদয়কে নাড়া দেয়।

রাসূলে খোদা (সাঃ)-এর পুত্র ইব্রাহীম মাত্র দেড় বছর বয়সে মৃত্যু বরণ করে। পুত্রের মৃত্যুতে রাসূল (সাঃ) শোকে মুহ্যমান ও অশ্রুসিক্ত হয়ে পড়েন। সাহাবীরা আরজ করল,“হে রাসূলে খোদা আপনি আমাদেরকে ধৈর্যধারনের আদেশ করেন। অথচ পুত্র শোকে এমনভাবে কাঁদছেন।” রাসূল (সাঃ) বলেন,“হৃদয় ব্যাথাতুর এবং চোখ অশ্রুশিক্ত।” স্বয়ং রাসূলে খোদা (সাঃ) তাঁর দেড় বছরের সন্তানের মৃত্যু শোকে এভাবে ক্রন্দনরত ও অশ্রুসিক্ত হয়ে পড়েছেন। সেখানে আশুরার দিন ইমাম হুসাইন (আঃ) স্বীয় পরিবারবর্গ ও সঙ্গী-সাথীদেরকে হারিয়েছেন। যাদের মধ্যে হযরত আব্বাস আলমদার (আঃ),হযরত আলী আকবার ও হযরত কাসীমের ন্যায় অত্যুজ্জ্বল নক্ষত্রতুল্য ব্যক্তিরা ছিলেন। যারা প্রত্যেকে ইমাম (আঃ)-এর সরাসরি তত্তাবাধনে লালিত-পালিত হয়েছেন। আর এসব অত্যাচার ও হত্যাযজ্ঞ আশুরার দিন একের পর এক ইমামরে সামনেই ঘটেছে এবং এগুলো সবই তিনি নীরবে সহ্য করেছেন। অতএব,তখন তাঁর অন্তরের অবস্থা কেমন হয়েছিল,তা বেশি ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই। পরিশেষে তিনি নিজেও ইসলাম রক্ষার্থে জালিমদের মোকাবেলায় স্বীয় জীবন উৎসর্গ করেছেন।

মহান আল্লাহ এগুলো সবই প্রত্যক্ষ করেছেন এবং অতুলনীয় ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছেন। কিন্তু এমনই একদিন আসবে,যখন তিনি আর ধৈর্যধারন করবেন না। বরং সেদিন তিনি এ সব অত্যাচার ও অবিচারের উপযুক্ত প্রতিশোধ গ্রহণ করবেন।

ইমাম হুসাইন (আঃ)-এর হত্যাকারীদের পরিণতি

বিখ্যাত গ্রন্থ “কামেল্যু যিয়ারাতে” বর্ণিত হয়েছে যে,ইমাম হুসাইন (আঃ)-এর হত্যাকাণ্ডে যে সমস্ত পাষাণ্ড ব্যক্তিরা অংশ নিয়েছিলো,তাদের প্রত্যেকেই হয় মস্তিষ্ক বিকৃতির শিকার অথবা কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত হয়েছে।(কামেলুয্ যিয়ারাত,পৃঃ ৬২,হাদীস নং ৮)

আরও বর্ণিত হয়েছে যে,উক্ত দুরারোগ্য ব্যাধিতে তাদের সন্তানাদিও আক্রান্ত হয়েছিল। যদিও তাদের সন্তানাদি কোন অপরাধ করেনি এবং তারা রোগাক্রান্ত না হওয়াটাই স্বভাবিক ছিল। কিন্তু আমাদের জেনে রাখা উচিত যে,এটা হচ্ছে ইমাম হুসাইন (আঃ)-কে হত্যার ন্যায় জঘণ্যতম অপরাধের প্রতিফল। এছাড়া আমরা প্রত্যক্ষ করেছি যে,পিতা যদি মদ্যপায়ী হয়,তাহলে সন্তানের উপরও সেটার ক্ষতিকর প্রভাব সংক্রামিত হয়। পিতা যদি অসৎ কর্মে অভ্যস্ত হয়ে থাকে তবে তার কু-প্রভাব সন্তানের উপরও পড়ে। আর এগুলো হচ্ছে সৃষ্টি তত্ত্বের স্বাভাবিক নিয়ম।

পূর্বোক্ত গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে যে,ইমাম হুসাইন (আঃ) হত্যাকারীদের মধ্যে একজনের মৃত্যও স্বাভাবিকভাবে হয় নি। অর্থাৎ সবাই কঠিন যন্ত্রণার শিকার হয়ে মৃত্যুবরণ করেছে। ইমাম সাদীক (আঃ) বলেছেন,“যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যু তাদের ( হত্যাকারীদের) সবার প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। কিন্তু যেহেতু আল্লাহ্ তায়ালা ইমাম হুসাইন (আঃ)-কে সুউচ্চ মর্যাদায় সমাসীন করেছেন,সেহেতু তাকে হত্যার ন্যায় জঘণ্যতম অপরাধের প্রতিফল কেবল মৃত্যুর মাধ্যমেই সমাপ্ত হবে না। আর এ বিষয়টি এতই সুস্পষ্ট যে,শিয়া-সুন্নী সবাই ঐক্যমতের ভিত্তিতে বিশ্বাস করে।

কাবা শরীফের গর্ব এবং কারবালার মর্যাদা

আল্লাহ তায়ালা কাবা শরীফকে স্বীয় গৃহ বা বায়তুল্লাহ (আল্লাহর ঘর) হিসেবে অভিহিত করেছে। নিশ্চয়ই আল্লাহর কোন শরীর ও আকৃতি নেই,তাই তার কোন গৃহেরও প্রয়োজন নেই। কিন্তু কাবা শরীফকে বায়তুল্লাহ্ নামকরণের মাধ্যমে তিনি এ স্থানের পবিত্রতা ও ফজিলত সম্পর্কে মানব জাতিকে অবহিত করেছেন।

আল্লাহ কাবা শরীফকে এতই পবিত্রতা ও ফজিলত দান করেছেন যে,সমস্ত হাজীদেরকে মক্কায় প্রবেশকালে সাধারণ পোষাক ত্যাগ করে এহরামের পোষাক পরিধানের আদেশ দিয়েছেন। এমনকি কাবা শরীফে প্রবেশের জন্য সুনির্দিষ্ট কিছু বিধানাবলী জারী করেছেন,সেগুলো যথাযথভাবে মেনে চলা প্রত্যেক হাজীর উপর ফরজ। একদা কাবা শরীফের ভূ-খণ্ড পৃথিবীর অন্যান্য ভূ-খণ্ডকে উদ্দেশ্য করে বলে,“আমি তোমাদের তুলনায় শ্রেষ্ঠ।”(এখানে একটি বিষয় সুস্পষ্ট হওয়া অত্যন্ত প্রয়োজন,আর তা হচ্ছে কাবার ভূ-খণ্ড অন্যান্য ভূ-খণ্ডসহ আমাদের চারিপাশে যা কিছু আছে সেগুলো সবই আল্লাহর সৃষ্টি এবং সেগুলো অনুভূতি সম্পন্ন। কিন্তু মানুষের পক্ষে তা অনুধাবন করা সম্ভব নয়। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হয়েছে ,“সমস্ত সৃষ্টি জগত আল্লাহর তাসবীহ্ বা গুণকীর্তনে মগ্ন। কিন্তু তোমরা তা বুঝতে পার না।” সূরা : ইসরা,আয়াত নং ৪৪।) তখন আল্লাহ্ কাবার ভূ-খণ্ডকে বলেন,“চুপ কর! তোমর থেকেও মর্যাদাপূর্ণ ভূ-খণ্ড পৃথিবীতে রয়েছে,সেটা হচ্ছে কারবালার ভূ-খণ্ড।”(কামেলুয্ যিয়ারাত,পৃঃ ৪৫৫,হাদীস নং ৬৯০) এখানে একটি প্রশ্ন আসতে পারে যে,কাবা শরীফকে আল্লাহ স্বীয় গৃহ হিসেবে অভিহিত করার কারণে উক্ত ভূ-খণ্ড বিশেষ ফজিলতে ভূষিত হয়েছে। কিন্তু কারবালার ভূ-খণ্ড অধিকতর মর্যাদায় ভূষিত হওয়ার কারণ কি? আমরা যদি একটু গভীরভাবে চিন্তা করি তাহলে এটা সুস্পষ্ট হয়ে যাবে যে,কারবালার বুকে যেহেতু ইমাম হুসাইন (আঃ)-এর হৃদয়বিদারক শাহাদতের ঘটনা ঘটেছে এবং তাঁর মাজারকে ধারণ করে রয়েছে,সেহেতু এমন সুউচ্চ মর্যাদার অধিকারী হয়েছে।

আশুরার অবদান

আসলে আমরা যা কিছু পেয়েছি তা ইমাম হুসাইন (আঃ)-এর নজিরবিহীন ত্যাগের বিনিময়েই পেয়েছি। আজ যদি আমাদের মাঝে মানুষত্ব,মানবতা,সাহসিকতা এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী মনোভাব থেকে থাকে,তাহলে এগুলো আশুরার বিপ্লবের প্রতিদান এ কারণে এ বিপ্লবকে কখনও ভুলে গেলে চলবে না। বরং আমাদের অত্যাবশ্যকীয় দায়িত্ব হচ্ছে এ বিপ্লবের চেতনাকে সঠিকভাবে সংরক্ষণ করা এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে এ শিক্ষা পৌছে দেওয়া।

আমরা জীবনে অনেক টাকা-পয়সা খরচ করি;কিন্তু জেনে রাখা উচিত যে,ইমাম হুসাইন (আঃ)- এর পথে পয়সা খরচ করা সবচেয়ে উত্তম কাজ। আমরা জীবনধারনের জন্য কতই না চেষ্টা ও সাধনায় মশগুল থাকি। স্ত্রী-সন্তান,বাড়ী,ঘর ও পেশার পেছনে আমরা কতই না শক্তি অপচয় করি। কিন্তু ইমাম হুসাইন (আঃ)-এর পথে কতটুকু শক্তি ব্যয় করেছি। নিশ্চয়ই আমরা আহলে বাইত (আঃ)-এর পথে যতবেশি নিজেদেরকে সম্পৃক্ত করবো,ততোধিক আল্লাহর নৈকট্য ও পুরুস্কারের অধিকারী হতে পারবো।

দুই জন বিশিষ্ট আলেম ছিলেন। তম্মধ্যে একজন ইমাম হুসাইন (আঃ)-এর স্বরণে শোকানুষ্ঠান পালনের ক্ষেত্রে অত্যন্ত সক্রিয় ছিলেন এবং এ পথে যে কোন চেষ্টা ও প্রচেষ্টায় সামান্যতম পিছপা হতেন না। কিন্তু অপর জন এক্ষেত্রে ততবেশি আন্তরিক ছিলেন না। অবশেষে উভয়ই এ পৃথিবী থেকে বিদায় নেন। যে আলেম ইমাম (আঃ)-এর শোকানুষ্ঠান উদযাপনের ক্ষেত্রে একনিষ্ঠ সক্রিয় ছিলেন,তার সন্তানরা আজ বিশ্বের সর্বত্রে অবস্থান করছে। তাদের কেউ শিক্ষক কেউ আলেম,কেউ লেখক আবার কেউ গবেষক হয়েছেন। কিন্তু অপর আলেমের তেমন কোন নাম ও নিশানা বর্তমানে অবশিষ্ট নেই। আর এটা হচ্ছে ইমাম হুসাইন (আঃ)-এর পথে খেদমত করা অথবা না করার প্রতিফলস্বরূপ। সুতরাং এ মহান ইমাম (আঃ)-এর স্বরণে যে কোন চেষ্টা ও প্রচেষ্টা কখনও বিফলে যাবে না।

এরূপ আহলে বাইত (আঃ)-এর পথে খেদমতের বিনিময়ে উত্তম প্রতিদানের হাজারও বাস্তব ঘটনার মধ্যে আর একটি ঘটনা আপনাদের সম্মুখে উপস্থাপন করবো। হয়তো আপনাদের কেউ কেউ নিজেদের জীবনে এ ধরনের প্রতিদানের অধিকারী হয়েছেন অথবা স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করেছেন।

একটি শহরে দু’জন ব্যক্তি পাশাপাশি বসবাস করত। তাদের মধ্যে একজন ছিল ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী এবং তার উপার্জনও ছিল খুবই সামান্য। আর অপর জন ছিল শহরের বড় শিল্পপতি। (অবশ্য তারা উভয়ই বর্তমান পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন) ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীটি সরাদিন হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করে যে অর্থ উপার্জন করত,সেটার এক তৃতীয়াংশ ইমাম হুসাইন (আঃ)-এর নামে জমা রাখত। এভাবে সে জমাকৃত অর্থ দিয়ে শহরের বাইরে এক খণ্ড জমি য় করে। লোকেরা তাকে বলত : কেন শহরের বাইরে এমন নির্জন এলাকাতে জমিক্রয় করেছো? সে উত্তর দিত : আমার নিকট এত অর্থ নেই যে,শহরের মধ্যে জমিক্রয় করবো। আমি উক্ত জমি ইমাম হুসাইন (আঃ)-এর নামে ক্রয় করেছি,যাতে করে এক সময় সেখানে একটি ইমাম বাড়ী নির্মাণ করতে পারি।

বর্তমানে সে শহরটি বিস্তৃতি লাভ করেছে এবং সেখানে নির্মিত ইমাম বাড়ী শহরের আওতাধীনে পড়েছে। সময়ের আবর্তে সেটা আজ বিশালাকৃতির ইমাম বাড়ীতে পরিণত হয়েছে এবং সেখানে বছরের অধিকাংশ সময় ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি উদযাপিত হচ্ছে।

কিছুদিন পূর্বে ঐ ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর পুত্র ইরান সফরকালে আমার সাথে সাক্ষাৎ করতে এসেছিল। সে আমাকে জানায় যে,তার দেশের সরকার উক্ত ইমাম বাড়ীটি ক্রয় করার প্রস্তাব দিয়েছে এবং এর বিনিময়ে পাঁচ মিলিয়ন ডলার দেওয়ার কথা বলেছে। কিন্তু আমরা সরকারের প্রস্তাবে রাজি হয় নি,বরং জানিয়ে দিয়েছি যে,এ স্থানটি ইমাম হুসাইন (আঃ)-এর নামে ওয়াক্ফ করা হয়েছে এবং আমরা কেউ এ সম্পত্তির সত্ত্বাধিকারী নই।

অতএব,ঐ ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ইমাম হুসাইন (আঃ)-এর মহব্বতে যে আন্তরিকতা প্রদর্শন করেছে,তা সংরক্ষিত রয়েছে এবং তার নির্মিত ইমাম বাড়ীতে যে ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি পালিত হচ্ছে,তা তাকে জীবিত করে রেখেছে। এছাড়া এ সৎ কর্মের জন্য সে অভূরন্ত সওয়াবের অধিকারী হবে।

পক্ষান্তরে আমি শুনিনি যে,ঐ ধণ্যাট্য শিল্পপতি ইমাম হুসাইন (আঃ)-এর নামে এক বিঘাত জমি ওয়াক্ফ করেছে। তার বিপুল অর্থ-সম্পত্তিও উত্তরাধিকারীরা ভাগ বাটোয়ারা করে নিয়েছে। অর্থাৎ সে এমন কোন অবদান রেখে যাই নি,যা তার দুনিয়া ও আখিরাতে কল্যাণ বয়ে আনবে। কাজেই যে কেউ ইমাম হুসাইন (আঃ)-এর আদর্শকে জাগ্রত রাখার লক্ষ্যে চেষ্টা ও প্রচেষ্টা করবে,নিশ্চয়ই সে দুনিয়া ও আখিরাতে বিশেষ পুরুস্কারে ভূষিত হবে।

অনুরুপভাবে আমাদের মনে রাখতে হবে যে,যেমনভাবে সাইয়্যেদুশ শোহাদা ইমাম হুসাইন (আঃ)-এর পথে অবদান আল্লাহ ও রাসূল (সাঃ)-এর সন্তুষ্টির কারণ হয়। তেমনভাবে নিঃসন্দেহে এ পথ ও আদর্শের সাথে বিরুদ্ধাচারীরা ইহকাল ও পরকালে চরম ক্ষতিগ্রস্থ হবে।.

আহলে বাইত (আঃ)-এর শোকে শোকাহত হওয়ার প্রতিদান

মাসুম ইমাম (আঃ)-এর হাদীসের আলোকে আমরা নিজেদের আমল ও আহলে বাইত (আঃ)- এর শোকে শোকাভিভূত হওয়ার প্রতিদান সম্পর্কে অবহিত হব। ইমাম জাফর সাদীক (আঃ) বলেছেন,

“আমাদের শোকে শোকাহত ব্যক্তির নিঃশ্বাস হচ্ছে তাসবিহ এবং শোক প্রকাশ হচ্ছে ইবাদত।”(বিহারুল আনওয়ার,খন্ড ৪৪,পৃষ্ঠা নং ২)

আপনারা ইমাম হুসাইন (আঃ)-এর জন্য শোক পালন করতে এখানে সমবেত হয়েছেন। এমতাবস্থায় আপনাদের প্রতিটি নিঃশ্বাস হচ্ছে তাসবীহ। আল্লাহর ফেরেশতারা আপনাদের আমল নামাতে প্রত্যেক নিঃশ্বাসের পরিবর্তে একবার “সুবহান আল্লাহ” পাঠের সওয়ার লিপিবদ্ধ করার কাজে ব্যস্ত রয়েছে। এছাড়া আল্লাহ তায়ালা আপনাদের শোক পালনকে ইবাদত হিসেবে গ্রহণ করবেন। আর ইমাম (আঃ)-এর পথে খেদমতের যে প্রতিদান রয়েছে,তা ছাড়াও এ দুটি মহা পুরুস্কারে ভুষিত করা হবে।

যে কেউ ইমাম হুসাইন (আঃ)-এর পথে বেশি পরিশ্রম করবে এবং বেশি কষ্ট-দুঃখ সহ্য করবে। সে বেশি পুরুষ্কার ও সওয়াবের অধিকারী হবে। এ প্রসঙ্গে উদাহরণ স্বরূপ দুজন বিশ্বখ্যাত আলেমের ঘটনা তুলে ধরা যেতে পারে এ দু’জনের মধ্যে একজন হচ্ছেন তৎকালীন শ্রেষ্ঠ আলেম হযরত শেখ মুরতাজা আনসারী (রহঃ) যার মূল্যবান গ্রন্থ গত দেড় শতাব্দী যাবত বিভিন্ন ধর্মীয় মাদ্রাসাসমূহে পাঠ দান করা হচ্ছে। আর অপরজন হচ্ছে শীর্ষস্থানীয় আলেম হযরত দারবান্দী (রহঃ) এ দু’জন ছাত্র জীবনে সহপাঠ ছিলেন এবং পরবর্তীতে উভয়ই বিশিষ্ট ফকীহ ও মারজায়ে তাকলীদ হিসেবে সুপরিচিতি লাভ করেন। সে সময় প্রায় ৯০ শতাংশ শিয়ারা হযরত মুরতাজা আনসারী (রহঃ)-এর এবং আর মাত্র ১০ শতাংশ হযরত দারবান্দী (রহঃ)-এর তাকলীদ করতেন।

একদা হযরত মুরতাজা আনসারী (রহঃ)-এর এক ছাত্র (যে জ্ঞান,তাকওয়া ও পরহেজগারীতায় প্রসিদ্ধ ছিল) ইরানে সফরে আসার প্রস্তুতি নেয়। হযরত আনসারী (রহঃ) পায়ে হেটে তাকে শহরের শেষ সীমানা পর্যন্ত এগিয়ে দেন। অতঃপর তিনি আবার নাজাফে ফিরে যান। সে ছাত্রটি প্রথমে কারবালা,সামেরা ও কাজেমাইন জিয়ারতের পর ইরানে আসার পরিকল্পনা করেছিল। কিন্তু পরের দিন সে কারবালাতে না পৌছে মাঝ পথ হতে আবার নাজাফে ফিরে আসে।

হযরত আনসারী (রহঃ) পরের দিন যখন উক্ত ছাত্রকে নাযাফে দেখতে পান,তখন তাকে জিজ্ঞাসা করেন,“কেন ফিরে এসেছো।” ছাত্রটি উত্তরে বলল,“গতরাতে যখন পথ চলতে চলতে একস্থানে বিশ্রামের জন্য ঘুমিয়ে পড়ে ছিলাম। তখন স্বপ্নে এক ফেরেশ্তাকে দেখলাম সে আমাকে উদ্দেশ্য করে বলে : এই মরুভূীমতে কি করছো ? তুমি তিন দিন পর মৃত্যুবরণ করবে। ঘুম থেকে জাগার পর আমি চিন্তা করলাম যে,যদি তিন দিন পর মৃত্যুবরণ করতে হয় তাহলে নাজাফেই মৃত্যুবরণ করব,মরুভূমিতে নয়। আর যদি তিন দিন পর মৃত্যু বরণ না করি,তবে পুনরায় সফর শুরু করবো।

তিনি দিন পর ঐ ছাত্রটি দুনিয়া হতে বিদায় নেয়। সে মৃত্যুর পূর্বে আনসারী (রহঃ) কে বলে : উক্ত স্বপ্নে আমি একটি প্রাসাদ দেখতে পাই এবং জিজ্ঞাসা করি,এ প্রসাদটি কার? উত্তর দেয় যে,এটা শেখ মুরতাজা আনসারীর প্রাসাদ। কিছু দুরুত্বে আরও একটি প্রাসাদ দেখি,সেটা অপেক্ষাকৃত অধিকতর সুদর্শন ও সুবিশাল। জিজ্ঞাসা করলাম এটা কার? উত্তরে বলে যে,এটা দারবান্দীর প্রসাদ।

সে সময় শেখ আনসারী (রহঃ) ও দারবান্দী (রহঃ) উভয়ই জীবিত ছিলেন। শেখ আনসারী (রহঃ) পবিত্র নাজাফ শহরে বসবাস করতেন এবং দারবান্দী (রহঃ) পবিত্র কারবালায় ছিলেন। হযরত দারবান্দী (রহঃ) মারাযাইয়্যাতের দায়িত্ব পালন ছাড়াও ইমাম হুসাইন (আঃ) স্মরণে আয়োজিত অনুষ্ঠানাদিতে বক্তৃতা করতেন। বিশেষতঃ প্রতি বছর আশুরার দিন বিকালে তিনি ইমাম হুসাইন (আঃ)-এর মাজারে ইমাম ও তাঁর পরিবর্গের মর্মান্তিক শাহাদতের ঘটনাবলী অত্যন্ত হৃদয়স্পর্শী ভাষাতে বর্ণনা করতেন। তার এ হৃদয়গ্রাহী বত্তৃতা শোনার জন্য শত শত ইমাম ভক্তরা সেখানে জমায়েত হতেন এবং শোক প্রকাশ করে মাতম করতেন। এছাড়া দারবান্দী (রহঃ) ইমাম হুসাইন (আঃ) সম্পর্কে “আকসিরুল্ ইবাদত” নামক একটি গ্রন্থ প্রনয়ণ করেছেন।

মারযাইয়াতের দিক থেকে তিনি শেখ আনসারী (রহঃ)-এর সমপর্যায়ে ছিলেন না। ঐ ছাত্রটি তাদের উভয়কেই চিনতো যখন সে দারবান্দী (রহঃ)-এর প্রাসাদটি বেশি আকর্ষণীয় ও সৌন্দর্যপর্ণূ দেখে তখন সে উক্ত ফেরেশতার নিকট প্রশ্ন করে,এমনটির কারণ কি? আনসারী (রহঃ)-এর প্রাসাদটি অধিকতর আকর্ষণীয় হওয়া উচিত। ফেরেশতাটি উত্তরে বলল : এ প্রাসাদটি ইমাম হুসাইন (আঃ) দারবান্দী কে দান করেছেন।

ইমাম হুসাইন (আঃ) মানুষের হিসাব গ্রহণকারী

ইমাম জাফর সাদীক (আঃ) থেকে বর্ণিত একটি হাদীসে বলা হয়েছে,

“কেয়ামত সংঘটিত হওয়ার পূর্বে যে মানুষের নিকট থেকে হিসাব গ্রহণ করবে সে হচ্ছে হুসাইন ইবনে আলী (আঃ)। আর কেয়ামতের দিন হচ্ছে বেহেশ্ত ও দোজখে পাঠানোর দিন।”(বিহারুল আনওয়ার,খন্ড ৫৩,পৃঃ ৪৩।)

আমাদের সবাইকে দুনিয়া থেকে বিদায় নিতে হবে এবং তিনটি স্থানে সমস্ত কর্মের হিসাব দিতে হবে। রেওয়াতে বর্ণিত হয়েছে যে,মৃত্যু কালে মানুষের আত্মাকে আল্লাহ তায়ালার নিকট নিয়ে যাওয়া হয় এবং সেখানে প্রথমে সমস্ত কর্মের হিসাব দিতে হয়। দ্বিতীয় হিসাব গ্রহণ কেয়ামতের পূর্বে আলামে বারযাখে এবং তৃতীয় হিসাব গ্রহণ কেয়ামতের দিন অনুষ্ঠিত হবে।

ইমাম সাদীক (আঃ)-এর হাদীস অনুসারে মৃত্যুর পর আলামে বারযাখে প্রত্যেককে (মুসলমান ও অমুসলমান) ইমাম হুসাইন (আঃ)-এর নিকট স্বীয় কর্মের হিসাব দিতে হবে।

কাজেই আমাদের সবাইকে ইমাম হুসাইন (আঃ)-এর সম্মুখে হাজির হয়ে হিসাব দিতে হবে। আল্লাহ তায়ালা তাকে এক বিশেষ সম্মানে ভূষিত করেছেন। এখানে একটি রেওয়ায়েত বর্ণনা করাকে খুবই উপযুক্ত মনে করছি :

এক সময় ইমাম হুসাইন (আঃ)-এর কবর মোবারক গোপন অবস্থাতে ছিল এবং জালিম প্রশাসনের গুপ্তচররা সব সময় ফাঁদ পেতে থাকত,যাতে করে ইমাম হুসাইন (আঃ)-এর জিয়ারতকারীকে আটক করে জেল হাজতে প্রেরণ করবে। ফলে যে কেউ সহজে কবর মোবারক জিয়ারত করতে পারত না। একদা ইমাম জাফর সাদীক (আঃ)-এর এক সাহাবী [ আব্দুল্লাহ বিন বুকায়ের (রহঃ) ] ইমামকে বলে : ইমাম হুসাইন (আঃ) কবর জিয়ারতের জন্য আমার মন ভীষণ ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। কিন্তু ভীতগ্রস্ত রয়েছি ?

ইমাম (আঃ) জিজ্ঞাসা করেন : কিসের ভয় পাচ্ছো ? সে বলল : জালিম শাসক ও প্রশাসনের গুপ্তচরদের। ইমাম (আঃ) বলেন : যদি কেহ আমাদের জন্য ভয়ের শিকার হয়,তাহলে সে দু’টি মহা নেয়ামতের (যা থেকে অন্যরা বঞ্চিত হবে) অধিকারী হবে। একটি হচ্ছে কেয়ামতের দিন যখন সবাই চরম ভীতিগ্রস্থ থাকবে,তখন সে ভয়মুক্ত থাকবে। আর অপরটি হলো কেয়ামতের দিন ইমাম হুসাইন (আঃ)-এর সাথে সাক্ষাৎ করবে। আপনারা হয়তো কোরআনের এ আয়াতটি,

فِي يَوْمٍ كَانَ مِقْدَارُهُ خَمْسِينَ أَلْفَ سَنَةٍ

“সেদিন (কেয়ামতের দিন) হচ্ছে পৃথিবীর পঞ্চাশ বছরের সম পরিমাণ।”(সূরা মা’আরেজ,আয়াত নং৪।) এমনই এক ভয়নক দিনে সবাই নিজ নিজ কঠিন পরিণতির আশংকায় আতংকগ্রস্থ থাকবে। কিন্তু হাশরের ময়দানে আল্লাহ একটি স্থানকে অত্যন্ত সুশীতল ও শান্তিদায়কে পরিণত করবেন। আর সেখানে উপস্থিত থাকবেন ইমাম হুসাইন (আঃ)।

পৃথিবীতে যারা ইমাম (আঃ) পথে নানা কষ্ট-দুঃখ সহ্য করবে,তারা সে স্থানে তাঁর সাথে সাক্ষ্যৎ করবে। আর যারা এ কোনরূপ কষ্টের শিকার হয়নি তারা সে নেয়ামত হতে বঞ্চিত হবে।

পরকালের পাথেয় সংগ্রহ

যতদিন আমরা এ পৃথিবীতে জীবিত আছি,কেবল ততদিনই পরকালের পথেয় সংগ্রহ করার সুযোগ রয়েছে। আমিরুল মু‘মিনীন আলী (আঃ) বলেছেন,মৃত ব্যক্তিরা যা কিছু অবলোকন করেছে,তা যদি তোমরা দেখতে পেতে। তাহলে অবশ্যই তোমাদের অবস্থার পরিবর্তন ঘটতো এবং কাজ- কর্মে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করতে।”

অপর একটি হাদীসে ইমাম আলী (আঃ) বলেন,“দুনিয়া হচ্ছে আমল সম্পাদনের স্থান,হিসেবের নয়। কিন্তু আখিরাত হচ্ছে হিসাবের স্থান,আমলের নয়।”(উসূলে কাফী,খন্ড ৮ম,পৃঃ ৫৮) অর্থাৎ মৃত্যুর পর ক্ষুদ্রতম কোন আমলও সম্পাদন সম্ভবপর নয়। কিন্তু আমরা যারা জীবিত আছি মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত এ সুযোগ রয়েছে এবং বেশি বেশি সৎকর্ম সম্পাদনের মাধ্যমে আমাদের আমল নামাকে পূর্ণ করতে পারি।

আমরা যে সমস্ত নামাজ পড়েছি,রোজা রেখেছি,অন্যদের সাথে উত্তম আচরণ এবং যে সব সৎ কর্ম সম্পাদন করেছি এগুলোর সওয়াব ও পুরুস্কার আল্লাহ নিজেই প্রদান করবেন। কিন্তু ইমাম হুসাইন (আঃ)-এর পথে যে সব চেষ্টা-প্রচেষ্টা এবং কষ্ট-দুঃখ সহ্য করা হবে সেগুলোর সওয়াব ও পুরুস্কারও আলাদা যা স্বয়ং ইমাম (আঃ) বণ্টন করবেন। কাজেই যারা ইমাম (আঃ)-এর পথে আন্তরিক তারা কতইনা সৌভাগ্যবান। হয়তো কারও মনে এমন প্রশ্ন আসতে পারে যে,এমনটি কি আদৌ সম্ভব ?

উত্তরে বলব : স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা এ মহান ইমাম (আঃ) কে যে ব্যতিক্রমী মর্যাদা দান করেছেন,তা অন্য কোন মাসুমীন (আঃ)-কে দান করেন নি। উদাহরণস্বরূপ : এমন অনেক কাজ রয়েছে,যেগুলো শরীয়াতের দৃষ্টিতে মাকরুহ,অর্থাৎ সেগুলো সম্পাদন না করাই উত্তম। কিন্তু এ মাকরুহ কাজ গুলো যদি ইমাম হুসাইন (আঃ)-এর নামে সম্পাদন করা হয়,তাহলে আল্লাহর দরবারে তা মুস্তাহাব হিসাবে পরিগণিত হবে।

যেমন : হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে,কালো পোষাক পরিধান করে নামাজ ও দোওয়া পাঠ করা হচ্ছে মাকরুহ। এছাড়া হজ্জের সময় কালো পোষাকে তাওয়াফ করাও মাকরুহ কিন্তু ইমাম হুসাইন (আঃ)-এর শোক পালনের জন্য কালো পোষাক পরিধান করা হচ্ছে মুস্তাহাব।

মৃত্যু ব্যক্তির জন্য আহাজারী ও বিলাপ করা এবং মুখে ও বুকে চাপড়ানো মাকরুহ। কিন্তু ইমাম হুসাইন (আঃ)-এর হৃদয়বিদারক শাহাদতের স্মরণে আহাজারী ও মাতম করা শুধু মস্তাহাবই নয়,বরং এরুপ শোকাপালনকারী আল্লাহর পক্ষ থেকে বিশেষ সওয়াব ও পুরুস্কারে ভূষিত হবে। পরকাল এ পৃথিবীর বাজারের মতই। পৃথিবীর বাজারে দু’জন ব্যবসায়ীর মধ্যে যদি একজন সারা বছর ব্যাপী অপর জন অপেক্ষা বেশি তৎপর ও পরিশ্রম করে,তাহলে স্বাভাবিকভাবে বছর শেষে পরিশ্রমী ব্যবসায়ীই অধিকতর লাভবান হবে। আর যে ব্যবসায়ী প্রয়োজনীয় চেষ্টা-প্রচেষ্টা হতে বিরত থাকবে,সে অপেক্ষাকৃত কম লাভবান হবে। তবে পার্থক্য হচ্ছে দুনিয়ার বাজারের সম্পত্তি কম অথবা বেশি হোক কোনটিই মানুষের চিরস্থায়ী সাথী হবে না। কিন্তু হযরত ইমাম হুসাইন (আঃ)-এর পথে চেষ্টা-প্রচেষ্টার মাধ্যমে অর্জিত সওয়াব মানুষ পরকালে নিয়ে যেতে পারবে।

ইমাম হুসাইন (আঃ) তার সঙ্গীদের উদ্দেশ্য প্রদত্ত একটি খুতবাতে বলেন,

“দুনিয়ার সুখ-দুঃখ হচ্ছে স্বপ্নে মত।” কখনও কখনও মানুষ অত্যন্ত সুখকর স্বপ্ন দেখে,কিন্তু জাগার পর মনোক্ষুন্ন হয় যে,ঘুমান্ত অবস্থাতে ছিল। পক্ষান্তরে কোন ভয়ংকার স্বপ্ন দেখলে ঘুম ভাংগার পর যখন সে বুঝতে পারে যে,সেটা নিছক স্বপ্ন এবং বাস্তব কোন ঘটনা ছিল না,তখন সে আনন্দিত হয়। আমরাও পরকালে দেখতে পাব যে,এ পৃথিবীর অনেক কিছুই ছিলো স্বপ্নের মত। কিন্তু ইমাম হুসাইন (আঃ)-এর পথে যে সমস্ত কষ্ট-দুঃখ সহ্য করেছি,সেগুলো কোনটিও স্বপ্ন ছিল না। তখন যে যতবেশি এ পথে কষ্ট-দুঃখ সহ্য করেছে,সে ততবেশি আনন্দিত হবে।

আশুরার শিক্ষার প্রচার ও প্রসার

আশুরার শিক্ষা পৃথিবী থেকে কখনও মুছে যাবে না,আর এটা সাইয়্যেদুশ শোহাদা ইমাম হুসাইন (আঃ)-এর শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ। ইমাম (আঃ) হচ্ছেন আমাদের নেতা ও পথ প্রদর্শক। অতএব,আমাদের উচিত আশুরার ঐতিহাসিক ঘটনায় ইমাম (আঃ)-এর প্রদত্ত শিক্ষা প্রথমে নিজেদের জীবনে বাস্তবায়ন অতঃপর তা বিশ্ববাসীর নিকট পৌছে দেওয়া। এখানে সকলের অবগতির জন্য উক্ত শিক্ষাসমূহের কয়েকটি তুলে ধরছি :

ইমাম হুসাইন (আঃ) তৃষ্ণার্ত হোর বাহিনীকে পানি পান করান। হোর বাহিনী কুফার গর্ভণর ও পাপিষ্ট ইয়াজিদের সহচর ইবনে জিয়াদের নির্দেশে ইমাম (আঃ) ও তাঁর সাথীদেরকে গ্রেপ্তারের জন্য এসেছিল।

ইমাম (আঃ) বলেছেন যে,আমি যদি আত্মসমর্ম্পণও করি তবুও তারা আমাকে হত্যা করবে। হোর বাহিনী এজন্য এসেছিল যে,ইমাম (আঃ) যদি আত্মসর্ম্পণ না করেন,তাহলে তারা তার সাথে যুদ্ধ করবে এবং তাকে হত্যা করবে। কিন্তু পরিশেষে এ বাহিনীর প্রধান তথা হোরের মধ্যে এক অভ্যন্তরীণ পরিবর্তন দেখা দেয় এবং সে আশুরার পূর্ব দিন ইমাম (আঃ)-এর নিকট ক্ষমা চেয়ে তার পক্ষে যুদ্ধ করার প্রতিজ্ঞা করে। আল্লাহ হোরের তওবা কবুল করেন এবং ইমাম (আঃ) ও তাকে ক্ষমা করে দেন।

আমরা যদি ইতিহাস পর্যালোচনা করি,তাহলে দেখতে পাব যে,ইমাম যে হোর বাহিনীকে পানি পান করিয়ে তৃষ্ণা নিবারণ করেছিলেন,তাদের মধ্যে কেউ কেউ আশুরার দিন তীর-ধনুক ও তরবারী নিয়ে তাঁর উপর হামলা করেছিল। যাদের কাছে কোন অস্ত্র ছিল না তারা তার উপর পাথর নিক্ষেপ করেছিল। কেউ কেউ তাঁর মৃত দেহের উপর আঘাত করেছিল। আবার কেউ কেউ তাঁর সঙ্গী সাথীকে হত্যা করেছিল।

ইমাম হুসাইন (আঃ) তাদেরকে চিনতেন এবং ভাল করেই জানতেন যে,তারা তাঁর সাথে কিরূপ আচরণ করবে। কিন্তু তথাপি তিনি তাদেরকে পানি পান করিয়েছিলেন। হয়তো প্রশ্ন উঠতে পারে যে,কেন তিনি তাদেরকে পানি পান করিয়েছিলেন ?

উত্তরে বলা যেতে পারে : আল্লাহ মানুষদের প্রতি একে অপরকে (চাই তারা ভাল হোক অথবা মন্দ ) সেবা করার আদেশ দিয়েছেন। তাই এটা বলা সঙ্গত হবে না যে,ইমাম (আঃ) যদি তাদেরকে পানি না দিতেন। তাহলে তাদের অনেকেই তৃষ্ণার্তাবস্থায় মৃত্যুবরণ করতো। ফলে তারা ইমাম (আঃ)-এর হত্যায় শরীক হতে পারতো না। আসলে মানুষ মানুষের উপকার করবে,এটাই আল্লাহ চায়। এক্ষেত্রে কোন পার্থক্য নেই যে,সে মুসলমান হোক অথবা অমুসলমান,ভাল হোক অথবা মন্দ। তবে শর্ত হচ্ছে এ উপকার যেন তাদের ভ্রান্ত পথের সমর্থনের কারণ না হয়।

অতএব,আমাদেরকে ইমাম হুসাইন (আঃ)-এর প্রদত্ত শিক্ষানুসারে সব সময় আল্লাহর সৃষ্টি জীবের উপকারে সচেষ্ট থাকতে হবে। আমাদের পক্ষে যদি কারও সমস্যা দুরীকরণ সম্ভব হয়,তাহলে সেক্ষেত্রে কোনরূপ কুন্ঠাবোধ করা সমীচীন নয়।

ইমাম হুসাইন (আঃ)-এর হত্যাকারী অপেক্ষা নিকৃষ্টতম কেহ আছে কি ? কিন্তু যেদিন হোর বাহিনীকে ইমাম (আঃ)-এর নির্দেশে পানি দেওয়া হয়েছিল,সেদিন তিনি দেখতে পান যে,জনৈক ব্যক্তি পানির পিপাসার মৃতপ্রায় অবস্থাতে পড়ে আছে। তখন তিনি নিজেই ঘোড়া থেকে নেমে এসে পানির পাত্র সে ব্যক্তি মুখের সামনে ধরেন,যাতে করে পানি পানের মাধ্যমে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচতে পারে। অথচ অনেক ঐতিহাসিকদের মতে ঐ ব্যক্তিই আশুরার দিন ইমাম (আঃ)-এর হত্যাকাণ্ডে শরিক হয়েছিল। ইমাম (আঃ) জানতেন যে,সে একদিন তাকে হত্যায় অংশ নিবে। কিন্তু তবুও প্রাণ বাচানোর জন্য তাকে পানি দিয়েছিলেন।

অনেক গরীর দেশে আহলে বাইত (আঃ)-এর অনুসারীরা রয়েছেন,যাদের অঞ্চলে কোন মসজিদ,মাদ্রাসা,ইমাম বাড়ী ও ধর্মীয় পুস্তক নেই। আপনারা নিজেরা যদি তাদের জন্য মসজিদ ও ইমাম-বাড়ী নির্মাণের সমর্থ না রাখেন তাহলে যাদের সমর্থ রয়েছে তাদেরকে একাজে উৎসাহিত করতে পারেন।

হয়তো আপনাদের আত্মিয়-স্বজন ও পরিচিত জনরা বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আপনাদের সাথে পত্র ও টেলিফোন যোগাযোগ করতে পারে,সেক্ষেত্রে আপনারাও তাদের সাথে যোগাযোগের ফাকে ফাকে তাদেরকে এ সমস্ত নেক কাজে উদ্বুদ্ধ করতে পারেন। এ লক্ষ্যে যদি আন্তরিক হন,তাহলে অবশ্যই ইমাম হুসাইন (আঃ) আপনাদের সহায় হবেন।

আমি নিজেই একটি দেশে দেখেছি যে,ইমাম বাড়ী তৈরিকালে অর্থাভাবে প্রাথমিক নির্মাণ সামগ্রীসমূহ ঋণ করে ক্রয় করা হয়। কিন্তু মাত্র ২০ বছরের ব্যবধানে উক্ত ইমাম বাড়ীটি সে দেশের সর্ববৃহৎ ইমাম বাড়ীতে পরিণত হয়েছে। আপনারা আপনাদের বত্তৃতা ও লেখনীর মাধ্যমে অন্যদেরকে এ পথে উদ্বুদ্ধ করুন। যদি আপনাদের কাছে কিছু টাকা-পয়সা থাকে তা যতই সামান্য হোক না কেন এ পথে ব্যয় করুন। এ কাজগুলোর কারণে ইমাম হুসাইন (আঃ) দারবান্দী (রহঃ) কে বেহেশতে একটি সুরম্য প্রাসাদ উপহার দিয়েছেন। যা হযরত আনসারী (রহঃ)-এর মত জগদ্বিখ্যাত মারজায়ে তাকলীদকে দেওয়া অপেক্ষা অধিকতর সৌন্দর্যপূর্ণ।

আপনারা নিজেদের গৃহসমূহে ইমাম হুসাইন (আঃ)-এর হেদায়েতের প্রদীপকে প্রজ্জলিত করুন। যদি কারও পক্ষে সম্ভব হয়,তাহলে সে ইমাম (আঃ)-এর স্বরণে ব্যাপক আকারে শোকানুষ্ঠানের আয়োজন করবে। আর যদি কারও এমন সামর্থ না থাকে তাহলে সে যেন স্বীয় গৃহে ঘরোয়া পরিবেশে শোকানুষ্ঠানের আয়োজন করে। কেহ যদি এরুপ পদক্ষেপ নেয়,তাহলে সে অবশ্যই ইহলৌকিক ও পারলৌকিক বরকতের অধিকারী হবে।

ইমাম বাড়ীতে আয়োজিত শোকানুষ্ঠানে শরীক হওয়ার বিশেষ সওয়াব রয়েছে। কিন্তু এটা কতই না উত্তম হবে যে,মানুষ এ বরকতসমূহ স্বীয় গৃহসমূহেও নিয়ে আসবে।

আমানত দারী

যুবসমাজ আমাদের নিকট আল্লাহ ও আহলে বাইত (আঃ)-এর আমানত স্বরূপ। আমাদের পূর্বপুরুষরা অত্যন্ত কষ্ট-দুঃখ সহ্য করে আমানতদারী করেছেন এবং দ্বীন ইসলামকে আমাদের নিকট আমানত হিসেবে রেখে গেছেন। এখন আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে এ আমানতকে উত্তমরূপে হেফাজত করা এবং সেটাকে ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছে হস্তান্তর করা। আমাদের আশপাশে পরিচিতদের মধ্যে একজন যুবকও যেন মসজিদ,ইমাম বাড়ী ও ইমাম (আঃ)-এর মাতম হতে বঞ্চিত না থাকে। যদি এমন কোন যুবক থাকে তাহলে অবশ্যই তাকে বিশেষভাবে উৎসাহিত করতে হবে। যদি একবারে সম্ভব না হয়,তাহলে দুইবার,তিনবার,চারবার অথবা পাঁচবার চেষ্টা করতে হবে। কেননা,বর্তমানে ইসলামের শত্রুরা যুবসমাজকে বিচ্যুত ও বিপথগামী করার জন্য নানাবিধ কৌশল অবলম্বন করছে। এমতাবস্থায় আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মকে রক্ষা করতে হলে,অবশ্যই তাদের মধ্যে ইমাম হুসাইন (আঃ)-এর আদর্শের চেতনাকে জাগ্রত করা ছাড়া কোন উপায় নেই।

ইমাম হুসাইন (আঃ) থেকে শিক্ষা নিতে হবে

ইমাম হুসাইন (আঃ)-এর শোকানুষ্ঠানে অংশগ্রহণ এবং এ অনুষ্ঠানাদি উদযাপনের লক্ষ্যে সাধ্যানুযায়ী চেষ্টা করা অত্যন্ত সওয়াবের কাজ। কিন্তু আমাদের দায়িত্ব এগুলোতেই সীমাবদ্ধ নয়। আশুরা কেবল শোক পালনের জন্যেই সংগঠিত হয় নি। বরং এটার মূখ্য উদ্দেশ্য হচ্ছে এ কালজয়ী বিপ্লব থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা আসলে আমাদের প্রত্যেকের উচিত জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে যথাযথভাবে ইমাম হুসাইন (আঃ)-এর জীবনাদর্শ অনুসরণ করা। কাজেই সে ব্যক্তি ইমাম (আঃ)-এর নিকট অধিকতর প্রিয় যে তাঁর শোক পালনের পাশাপাশি জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তাকে অনুসরণ করবে।

আমাদেরকে অবশ্যই বিশ্লেষণ করে দেখতে হবে যে,কেন ইমাম হুসাইন (আঃ) আশুরার দিন আপন পরিবারবর্গ ও সঙ্গী-সাথীদের জীবন বিসর্জন দিয়েছিলেন? এ প্রশ্নের উত্তর খুজতে হলে জিয়ারাতে আরবাঈনের এ বাক্যের প্রতি দৃষ্টি দেওয়া বাঞ্ছনীয়,

لیستنقذ عبادک من الجهالة و حیرة الضلالة

“(তিনি শহীদ হয়েছেন) যাতে করে আল্লাহর বান্দাদেরকে মূর্খতা ও বিচ্যুতি হতে পরিত্রাণ দিতে পারেন।”(আত্ তাহযীব শেথ তুসী,খণ্ড ৬,পৃষ্ঠা ১১৩,জিয়ারাত অধ্যায়,হাদীস নং ১৭)

এখানে عبادک অর্থাৎ আল্লাহর বান্দরা শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে যা শুধুমাত্র শিয়া অথবা সুন্নী নয় বরং সমগ্র মানব জাতিকে অন্তর্ভক্ত করে। প্রকৃতপক্ষে ইমাম হুসাইন (আঃ) স্বীয় শাহাদতের মাধ্যমে সমগ্রূ বিশ্ববাসীর জন্য অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন। তিনি মানুষদেরকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে আপোষহীন সংগ্রাম করে ন্যায় প্রতিষ্ঠার শিক্ষা দিয়েছেন।

ইমাম (আঃ) চেয়েছিলেন আল্লাহর বান্দাদেরকে অজ্ঞতা ও বিচ্যুতি হতে পরিত্রাণ দিতে। কাজেই আমরা যদি এ মহান ইমাম (আঃ)-এর প্রকৃত অনুসারী হয়ে থাকি,তাহলে আমাদের অনিবার্য দায়িত্ব হচ্ছে তাঁর মহিমান্বিত উদ্দেশ্যকে সর্বস্তরে বাস্তবায়নের জন্য আত্মনিয়োগ করা।’

সংক্ষেপে বলা যায় যে,ইমাম (আঃ) উসূলে দ্বীন (দ্বীনের স্তম্ভ),ইসলামের হুকুম-আহকাম ও ইসলামী শিষ্টাচার এ তিনটি বিষয় পুনঃ প্রতিষ্ঠার জন্য এমন নজীরবিহীন আত্মোৎসর্গের স্বাক্ষর রেখেছিলেন।

আলাহর প্রজ্জলিত প্রদীপ

কামেলুয্ যিয়ারাত গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে,

“ইসলামের শত্রুরা ইমাম (আঃ)-এর নুরকে নির্বাপিত করতে সর্বাত্মক চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে। নিশ্চয়ই এ নুর সমগ্র বিশ্বকে আচ্ছাদিত করবে।”

অত্যাচার-নিপীড়ন অনেক আদর্শ ও শক্তির ভীতকে দূর্বল করে দেয়। কিন্তু হুসাইনী আদর্শের উপর যতই দমন-পীড়ন ও অত্যাচার চালানো হবে,এ আদর্শ ততই ব্যাপকতা ও বিস্তৃতি লাভ করবে। এ আদর্শের সাথে যে কোন অপশক্তি মোকাবেলা করবে,সেটার পতন অনিবার্য ।

ইতিপূর্বে ইমাম হুসাইন (আঃ)-এর শোকানুষ্ঠান মুসলিম দেশসমূহে বিশেষতঃ শিয়া অধ্যুষিত অঞ্চলসমূহে পালিত হত। কিন্তু বর্তমানে এ শোকানুষ্ঠান বা আযাদারী কেবল এসব অঞ্চলেই সীমাবদ্ধ নেই। বরং তা বিশ্বের আনাচে-কানাচে যথাযোগ্য মর্যাদায় পালিত হচ্ছে।

আগে যারা কখনও ইমাম হুসাইন (আঃ)-এর নামও শুনে নি। বর্তমানে তারা তাঁর বাতিলের বিরুদ্ধে অপোষহীন বিপ্লবের চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় নিচ্ছে এবং স্ব-স্ব অঞ্চলে ইমাম (আঃ)-এর শোকানুষ্ঠানের আয়োজন করছে।

অতীতে ইমাম (আঃ)-এর আযাদারী যে সব স্থান ও অঞ্চলে উদযাপিত হত,কেবলমাত্র সেখানে অংশ গ্রহণকারীরা এ অনুষ্ঠানসমূহ হতে উপকৃত হতো। কিন্তু বর্তমানে আধুনিক প্রচার মাধমের (টেলিভিশন,ইন্টারনেট...) বদৌলতে পৃথিবীর সর্বত্র বসবাসকারী মানুষরা এসব আনুষ্ঠানের সাথে পরিচিত হচ্ছে। বস্তুতঃ এগুলো প্রমাণ বহণ করে যে,ইমাম হুসাইন (আঃ)-এর আদর্শের প্রদীপকে কেউ নিভাতে পারবে না এবং তা যুগ যুগ ধরে মানব জাতিকে সত্য পথ দেখাবে।

শহীদের লাশের পাশে ইমাম (আঃ) পরিবারের অর্তনাদ

এগার মহররম যখন ইয়াজিদ বাহিনীর সেনাপতি উমর সাদ ইমাম হুসাইন (আঃ)-এর পরিবারের বেচে যাওয়া সদস্যদেরকে বন্দী করে কুফাতে নিয়ে যাচ্ছিল। তখন চতুর্থ ইমাম জয়নুল আবেদীন (আঃ) অত্যন্ত দূর্বল ও ভগ্ন স্বাস্থ্যের কারণে উঠের পিঠে ভালভাবে বসতে পারছিলেন না। এজন্য তার পাদ্বয়কে উঠের পেটের নিচে বেধে দেওয়া হয়েছিল। এমতাবস্থায় বন্দী কাফেলা যখন শহীদের লাশের পাশ দিয়ে যাচ্ছিল,তখন তারা ক্ষতবিক্ষত লাশগুলোর উপর ঝাপিয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকেন। কিন্তু ইমাম জয়নুল আবেদীন (আঃ) পা বাধা থাকার কারণে উট থেকে নামতে পারেন নি। তিনি বলেন,“আমি যখন এ করুণ দৃশ্যটি প্রত্যক্ষ করি,তখন এমন মনে হচ্ছিল যে,আমি মারা গেছি। ফুফু জয়নাব আমার এমন মৃতপ্রায় অবস্থা দেখে ফেলে।”

হযরত জয়নাব (আঃ) চৌদ্দজন মাসুমীনের অন্তর্ভক্ত নয়। কিন্তু তিনি ইসমাতে ছোগরার অধিকারী ফজিলতের দিক থেকে চৌদ্দ মাসুমীনের পরই তাঁর অবস্থান। তিনি যখন ইমাম জয়নূল আবেদীন (আঃ) কে এমন অবস্থাতে দেখেন,তখন লাশগুলোর কাছ থেকে সরে এসে ইমাম (আঃ)- এর নিকট এসে তাকে সান্তনা দেন।

তিনি স্বীয় ভাইপো ইমাম জয়নুল আবেদীন (আঃ) কে বলেন,“এমন অসহায় অবস্থা সব সময় বজায় থাকবে না। এমন একদিন আসবে যখন আমাদের স্মরণে সর্বত্র শোকানুষ্ঠান পালিত হবে।”

পরিশেষে সর্ব শক্তিমান আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করছি তিনি যেন আমাদেরকে সাইয়্যেদুশ শোহাদা ইমাম হুসাইন (আঃ)-এর স্মরণে বেশি বেশি শোকানুষ্ঠান পালন এবং জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে এ মহান ইমামের মহিমান্বিত আদর্শ অনুসরণ করার তৌফিক দান করেন।

-ওয়াস্ সালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুলাহ্ ।