সূরা আলে ইমরান;(২১তম পর্ব)

সূরা আলে ইমরান;আয়াত ১১০-১১৫

সূরা আলে ইমরানের ১১০ নম্বর আয়াতে আল্লাহপাক বলেছেন-

كُنْتُمْ خَيْرَ أُمَّةٍ أُخْرِجَتْ لِلنَّاسِ تَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَتَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ وَتُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَلَوْ آَمَنَ أَهْلُ الْكِتَابِ لَكَانَ خَيْرًا لَهُمْ مِنْهُمُ الْمُؤْمِنُونَ وَأَكْثَرُهُمُ الْفَاسِقُونَ (১১০)

"বিশ্ব সমাজে তোমরা মুসলমানরাই শ্রেষ্ঠ জাতি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছ। তোমরা সৎ কাজের আদেশ দাও ও অসৎ কাজে নিষেধ কর এবং আল্লাহর ওপর বিশ্বাস আন। যদি আসমানি কিতাবের অনুসারী বা গ্রন্থানুগামী বা আহলে কিতাবরাও মুসলমানদের মত বিশ্বাসী হত,তবে অবশ্যই তাদের মঙ্গল হত। তাদের কেউ কেউ মুমিন,অধিকাংশই ফাসেক বা পাপাচারী।"(৩:১১০)

অনেকে মনে করেন,ধর্ম কিছু শুষ্ক বিধি-বিধানের সমষ্টি এবং তা কেবল ব্যক্তি ও খোদার সঙ্গে সম্পর্কিত। তাই তারা ধর্মকে শুধু নামায,রোজা,দোয়া ও কোরআন পাঠের মধ্যেই সীমিত রাখে। অথচ ধর্মের অধিকাংশ বিধানই মানব সমাজ এবং ব্যক্তির সঙ্গে সমাজের সম্পর্কের ব্যাপারে দিক-নির্দেশনামূলক। এমনকি ধর্মের দৃষ্টিতে নামায তখনই পরিপূর্ণ হয়,যখন তা অন্যান্য মুসলমানদের সাথে জামাতের মাধ্যমে আদায় করা হয়। ঘরে বসে পড়া নামায পূর্ণাঙ্গ নয়। মুসলিম সমাজকে সব ধরনের অপবিত্রতা থেকে দূরে রাখার জন্য ধর্মের সবচেয়ে প্রধান কর্মসূচি হলো,সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ করার দায়িত্ব পালন। আগেই আমরা আলোচনা করেছিলাম যে,এই দায়িত্ব দুই পর্যায়ে পালন করা হয়। একটি বিশেষ গ্রুপ বা দল মানুষের সামাজিক আচরণ পর্যবেক্ষণ করে এবং এভাবে তারা অন্যায় ও মন্দ কাজ প্রতিহত করে। সূরা আলে ইমরানের ১০৪ নম্বর আয়াতে এই পর্যায়ের দায়িত্বের কথা বলা হয়েছে। আর দ্বিতীয় পর্যায় হলো,সকল মুসলমানের সাধারণ দায়িত্ব যা এই আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহর এই নির্দেশ থেকে বোঝা যায় মানুষ শুধু নিজেকে সংশোধনের দায়িত্বপ্রাপ্ত নয়,সমাজের সংশোধন ও বিকাশও তাদের দায়িত্ব। তাই সমাজের কল্যাণের জন্যেই অসৎ কাজের প্রতিরোধ ও সৎ কাজের বিস্তারের জন্য আন্তরিকভাবে প্রচেষ্টা চালাতে হবে। আর এমনটি সম্ভব হলে তারাই হবে শ্রেষ্ঠ জাতি এবং তারা অন্যান্য জাতির জন্যেও আদর্শ হবে।

এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো,

প্রথমত: অন্যায় অশ্লীলতা ও অপবিত্রতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম ছাড়া শুধু মুখে সৎ কাজের পরামর্শ দেয়া খুব একটা ফলপ্রসূ নয়। কারণ,সৎ কাজের আদেশ দেয়ার পাশাপাশি মন্দ ও দুষ্টের দমনের কথাও বলা হয়েছে।

দ্বিতীয়ত : অন্যদের প্রতি সৎ কাজের নির্দেশ ও অসৎ কাজের প্রতিরোধের ক্ষেত্রে বয়স,বংশ,শিক্ষা,সম্পদ ও পদমর্যাদা কোন বিবেচ্য বিষয় নয়। একজন মুসলমান যে কোন পদে আসলে অন্য একজন মুসলমানকে সৎ কাজের নির্দেশ ও মন্দ কাজে বাধা দেয়ার অধিকার রাখে।

তৃতীয়ত : শ্রেষ্ঠত্বের অন্যতম মানদণ্ড হলো,সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ। যারা সমাজের শুভাকাঙ্ক্ষী তারাই এই দায়িত্ব পালন করে থাকেন।

চতুর্থত : শ্রেষ্ঠ জাতি হবার জন্য ঈমান ও সৎ কাজ জরুরী। আর সৎ কাজ করতে হবে সমাজ সংশোধনের উদ্দেশ্যে,শুধু ব্যক্তিগত দায়িত্ব পালনের জন্য নয়।

সূরা আলে ইমরানের ১১১ ও ১১২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

لَنْ يَضُرُّوكُمْ إِلَّا أَذًى وَإِنْ يُقَاتِلُوكُمْ يُوَلُّوكُمُ الْأَدْبَارَ ثُمَّ لَا يُنْصَرُونَ (১১১) ضُرِبَتْ عَلَيْهِمُ الذِّلَّةُ أَيْنَ مَا ثُقِفُوا إِلَّا بِحَبْلٍ مِنَ اللَّهِ وَحَبْلٍ مِنَ النَّاسِ وَبَاءُوا بِغَضَبٍ مِنَ اللَّهِ وَضُرِبَتْ عَلَيْهِمُ الْمَسْكَنَةُ ذَلِكَ بِأَنَّهُمْ كَانُوا يَكْفُرُونَ بِآَيَاتِ اللَّهِ وَيَقْتُلُونَ الْأَنْبِيَاءَ بِغَيْرِ حَقٍّ ذَلِكَ بِمَا عَصَوْا وَكَانُوا يَعْتَدُونَ (১১২)

"হে মুসলমানরা,তোমরা জেনে রাখ,সামান্য কষ্ট দেয়া ছাড়া শত্রুরা তোমাদের কোন ক্ষতি করতে পারবে না। যদি তারা তোমাদের সঙ্গে যুদ্ধ করে তবে তারা পৃষ্ঠ প্রদর্শন করবে। তাদের কোন সাহায্য করা হবে না।"

"আল্লাহর ওয়াদা ও মানুষের প্রতিশ্রুতি ছাড়া তারা যেখানেই অবস্থান করুক,লাঞ্ছনায় আক্রান্ত হয়েছে,আল্লাহর ক্রোধে নিপতিত হয়েছে এবং দারিদ্রে আক্রান্ত হয়েছে। এটা এ জন্যে যে,তারা আল্লাহর নিদর্শনাবলী অবিশ্বাস করেছিল এবং অন্যায়ভাবে নবীগণকে হত্যা করেছিল,এছাড়াও এটা এজন্যে যে,তারা বিদ্রোহ করেছিল ও সীমা অতিক্রম করেছিল।"

এই আয়াতে মুসলমানদেরকে সুসংবাদ দিয়ে আল্লাহ বলছেন,যদি ঈমানের ওপর অটল থাক এবং ঐক্য ও সহমর্মিতা নিয়ে সমাজ সংস্কারের জন্য সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজে নিষেধ করার দায়িত্ব পালন কর তাহলে শত্রুদের মোকাবেলায় শত্রুরা তোমাদের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হলে পরাজিত হবে এবং তারা লাঞ্ছনা ও দারিদ্রের শিকার হবে। ইহুদীদের সম্পর্কে এই আয়াতে ঘোষিত ভবিষ্যদ্বাণী ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে বাস্তবায়িত হয়েছে। ইহুদীরা সব সময়ই ঘৃণিত ও লাঞ্ছিত হয়েছে এবং তারা কখনোই সম্মান ও জনপ্রিয়তা অর্জন করতে পারেনি। বর্তমান যুগেও বিশ্ব অর্থনীতি ও বিশ্ব প্রচারণার মাধ্যম ইহুদী পুঁজিবাদীদের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হওয়া সত্ত্বেও ইহুদী ধর্মের ভিত্তিতে কোন স্বাধীন রাষ্ট্র পরিচালিত হচ্ছে না। এমনকি ইহুদীবাদী ইসরাইল একটি অবৈধ ও দখলদার রাষ্ট্র। এজন্যে বিশ্বের জনগণ এই সরকারকে ঘৃণা করে। ইসরাইলের অবস্থা হচ্ছে চোর ও ডাকাতের মত,যারা মানুষের সম্পদ লুট করে বিপুল সম্পদের অধিকারী হলেও কখনও মর্যাদার অধিকারী নয়। বরং মানুষ সব সময়ই তাদের ঘৃণা করে।

এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো,

প্রথমত : আল্লাহর ওপর বিশ্বাস,একটি শক্তিশালী দূর্গের মত। এই বিশ্বাস শত্রুদের অনুপ্রবেশ বা প্রভাবের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায় এবং শত্রুদেরকে পালিয়ে যেতে ও পরাজিত হতে বাধ্য করে।

দ্বিতীয়ত : সম্মান অর্জনের উপায় হলো দু'টি। প্রথম উপায় হলো আল্লাহর সঙ্গে সুদৃঢ় সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করা। দ্বিতীয় উপায় হলো,জনগণের সাথে কল্যাণকর সম্পর্ক রাখা। মানুষ যদি এই দুই সূত্র অনুযায়ী চলে তাহলে অন্য কোন শক্তিই সমাজে প্রভাব ও কর্তৃত্ব সৃষ্টির ক্ষমতা রাখে না।

তৃতীয়ত : অপরাধ ও আগ্রাসনই লাঞ্ছনা এবং অপমানের প্রধান কারণ।

সূরা আলে ইমরানের ১১৩,১১৪ ও ১১৫ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

لَيْسُوا سَوَاءً مِنْ أَهْلِ الْكِتَابِ أُمَّةٌ قَائِمَةٌ يَتْلُونَ آَيَاتِ اللَّهِ آَنَاءَ اللَّيْلِ وَهُمْ يَسْجُدُونَ (১১৩) يُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآَخِرِ وَيَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ وَيُسَارِعُونَ فِي الْخَيْرَاتِ وَأُولَئِكَ مِنَ الصَّالِحِينَ (১১৪) وَمَا يَفْعَلُوا مِنْ خَيْرٍ فَلَنْ يُكْفَرُوهُ وَاللَّهُ عَلِيمٌ بِالْمُتَّقِينَ  (১১৫)

"আহলে কিতাব বা ঐশী গ্রন্থের অনুসারীরা সবাই সমান নয়। তাদের মধ্যে কিছু লোক এমনও আছে যারা অবিচলভাবে আল্লাহর আয়াতসমূহ পাঠ করে এবং রাতের গভীরে তারা সেজদা করে।"

"তারা আল্লাহ ও পুনরুত্থান দিবসে বিশ্বাস করে। সৎ কাজের আদেশ দেয় ও বাধা দেয় অসৎ কাজে এবং সৎ কাজের জন্যে সাধ্যমতো চেষ্টা চালায়। তারাই সৎ ও যোগ্য।"

"তারা যেসব সৎ কাজ করে তার প্রতিদান হতে তাদের কখনও বঞ্চিত করা হবে না। আল্লাহ খোদাভীরুদের সম্পর্কে অবহিত।" (৩:১১৫)

আগের কয়েকটি আয়াতে মুমিনদের বিভ্রান্ত করার ব্যাপারে আহলে কিতাবদের কোন কোন দলের ষড়যন্ত্র সম্পর্কে বক্তব্যের পর এই কয়েকটি আয়াতে আহলে কিতাবদের ভালো লোকদের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এখানে বলা হয়েছে,এমন ধারণা করা ঠিক নয় যে,আহলে কিতাবদের মধ্যে সবাই ষড়যন্ত্রকারী,তাদের মধ্যে তোমাদের মুসলমানদের মত সৎ লোকও রয়েছে। তাদের অনেকেই গভীর রাতে আল্লাহর ইবাদত করে। তারা আল্লাহর ওপর ও বিচার দিবসের ওপরও ঈমান রাখে। নিজেদের মধ্যে এবং সমাজে সৎ কাজের প্রসার ও অসৎ কাজের প্রতিরোধে সক্রিয় থাকে। বিশেষ করে,তারা সৎ কাজে অগ্রগামী। আল্লাহ তাদের সৎ কাজ উপেক্ষা করবেন না এটাই স্বাভাবিক এবং তারা অবশ্যই আল্লাহর অনুগ্রহ পাবে। কারণ,বিশ্বাসী ও সৎকর্মশীলরা যেই বা যারাই হোক না কেন আল্লাহর কাছে গ্রহণীয়। আহলে কিতাবের সাথে ন্যায়সঙ্গত আচরণের ব্যাপারে এটাই কোরআনের দৃষ্টিভঙ্গি। অমুসলমানদের সাথে আচরণের ক্ষেত্রে মুসলমানদেরকে এই মানদণ্ড মনে রাখতে হবে। আমরাও যদি সৎ ও ন্যায় পরায়ণ হই,তাহলে আমাদের সৎ আচরণই ইসলামের প্রতি অন্যদের আকৃষ্ট করার জন্য যথেষ্ট হবে এবং এজন্যে ব্যাপক প্রচারের দরকার নেই।

এই তিন আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো,

প্রথমত : যারাই সৎ কাজ করুক না কেন তার উপযুক্ত সম্মান ও মূল্য দেয়া উচিত এবং তা স্বীকার করতে হবে। কোন ধর্মের অনুসারীদের মধ্যে একদল মন্দ বললে তাদের সৎ লোকদের কথা ভুলে যাওয়া উচিত নয়।

দ্বিতীয়ত : মানুষ রাতের বেলায় যখন ঘুমে থাকে,তখনই প্রার্থনা ও আল্লাহর কাছে নিজের অন্তরকে খুলে দেয়ার শ্রেষ্ঠ সময়।

তৃতীয়ত : মুসলমানরা ছাড়াও অন্যান্য খোদায়ী ধর্মের অনুসারীদের মধ্যেও সৎ কাজের আদেশ এবং অসৎ কাজের প্রতিরোধের প্রচলন ছিল।

চতুর্থত : রাতের বেলায় ব্যক্তিগত ইবাদত ও প্রার্থনা যেমন জরুরী,তেমনি দিনের বেলায় সৎ কাজের প্রসার ও অসৎকাজ প্রতিরোধের দায়িত্ব পালনও জরুরী।

পঞ্চমত : পবিত্র কোরআন সৎ কাজের প্রসারকে অসৎ কাজ প্রতিরোধের পূর্বশর্ত হিসেবে বেশী গুরুত্ব দিয়েছে। কারণ,সৎ কাজের প্রসার ঘটলে অসৎ কাজের পথ এমনিতেই বন্ধ হয়ে যাবে। যদি সমাজে বিয়ের প্রথা সহজ হয়ে যায়,তাহলে জেনা ও ব্যভিচারের ক্ষেত্র আপনা আপনিই সংকুচিত হয়ে পড়বে।

ষষ্ঠতম : সৎকাজের অভিজ্ঞতা ও সক্রিয়তা এর মূল্য বৃদ্ধি করে। তাই সৎ কাজে অন্যদের চেয়ে এগিয়ে থাকার জন্য প্রতিযোগিতা সৃষ্টি করতে হবে।