সূরা আলে ইমরান;(২৮তম পর্ব )

সূরা আলে ইমরান;আয়াত ১৪৯-১৫৩

সূরা আলে ইমরানের ১৪৯ ও ১৫০ নম্বর আয়াতে আল্লাহপাক বলেছেন-

 

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا إِنْ تُطِيعُوا الَّذِينَ كَفَرُوا يَرُدُّوكُمْ عَلَى أَعْقَابِكُمْ فَتَنْقَلِبُوا خَاسِرِينَ (১৪৯) بَلِ اللَّهُ مَوْلَاكُمْ وَهُوَ خَيْرُ النَّاصِرِينَ ((১৫০

"হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা যদি কাফেরদের কথা শোন,তাহলে তারা তোমাদেরকে পেছনে ফেলে আসা অজ্ঞতার যুগের নিয়ম-কানুনের কাছে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে। তাতে তোমরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।" (৩:১৪৯)

"(তারা তোমাদের বন্ধু বা সাহায্যকারী নয়) বরং আল্লাহই তোমাদের অভিভাবক ও শ্রেষ্ঠ সাহায্যকারী।" (৩:১৫০)

মুমিন ও মুসলিম সমাজের জন্য একটা বড় বিপদ হলো দুনিয়ার স্বার্থের জন্য ইসলামের নীতিমালা বিসর্জন দেয়া। বহু ব্যক্তি ও সমাজ প্রথমদিকে ঈমানের পথ অনুসরণ করেছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে অমুসলিম সমাজে কোন কোন বিষয়ে স্বাধীনতা এবং দুনিয়াবী কল্যাণের চাকচিক্য দেখে তারা ইসলাম থেকে দূরে সরে গিয়ে কুফরীর দিকে ঝুঁকে পড়ে। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ এই শ্রেণীর মুসলমানদের উদ্দেশ্যে বলছেন,'আল্লাহর বিধান মেনে চলার বদলে যদি তোমরা কাফেরদের পথ অনুসরণ কর,তাহলে তারা তোমাদেরকে উন্নতির পরিবর্তে অধপতনের দিকে নিয়ে যাবে। ফলে তোমরাই মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কারণ তোমরা নিজ ধর্মের ওপর ঈমান হারাবে এবং অন্যদিকে দুনিয়ার স্বার্থও লাভ করতে ব্যর্থ হবে।'এরপর মুমিনদের উদ্দেশ্যে আল্লাহ বলেছেন,'সম্মান ও ক্ষমতার জন্য কাফেরদের ওপর নির্ভরতার চেষ্টা কর না। কারণ সাহায্য ও বিজয় একমাত্র আল্লাহরই হাতে। যিনি তোমাদের অভিভাবক ও পালনকর্তা।'

এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো,

প্রথমত : বিচ্যুতি ও ধর্মত্যাগের বিপদ থেকে কেউই মুক্ত নয়। তাই শত্রুদের কুমন্ত্রণা ও শয়তানী প্রচার সম্পর্কে সাবধান হতে হবে।

দ্বিতীয়ত : যুদ্ধের ময়দানে পরাজিত হওয়া তেমন কোন ক্ষতি নয়। ঈমান ও কুফরীর মধ্যে চিন্তাগত যুদ্ধে পরাজিত হওয়াটাই সবচেয়ে বড় ক্ষতি।

তৃতীয়ত : যদি আমরা শুধু এই পৃথিবীর বুকে সম্মান ও ক্ষমতা অর্জন করতে চাই,তাহলেও তা সর্বশক্তিমান ও দয়াময় আল্লাহর বিধানের অনুসরণ ছাড়া সম্ভব নয় ।

সূরা আলে ইমরানের ১৫১ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

سَنُلْقِي فِي قُلُوبِ الَّذِينَ كَفَرُوا الرُّعْبَ بِمَا أَشْرَكُوا بِاللَّهِ مَا لَمْ يُنَزِّلْ بِهِ سُلْطَانًا وَمَأْوَاهُمُ النَّارُ وَبِئْسَ مَثْوَى الظَّالِمِينَ (১৫১)

"যারা অবিশ্বাস করেছে,আমি শিগগিরই তাদের অন্তরে ভয় সৃষ্টি করব। যেহেতু তারা আল্লাহর কাছ থেকে কোন প্রমাণ পাওয়া ছাড়াই আল্লাহর শরীক বা অংশীদার দাঁড় করিয়েছে। দোযখই তাদের বাসস্থান এবং তা জালেমদের জন্য নিকৃষ্ট বাসস্থান।" (৩:১৫১)

পূর্ববর্তী আয়াতে কাফেরদের চাকচিক্যময় জীবনের ব্যাপারে একদল মুসলমানের দুর্বলতার সমালোচনা করা হয়েছে। এরপর এই আয়াতে বলা হচ্ছে- তারা যেন এমনটি মনে না করে যে কাফেরদের ওপর নির্ভর করে প্রশান্তি ও নিরাপত্তা পাওয়া যাবে বরং আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন শক্তির সাহায্য চাওয়া হলে তা হবে শিরক ও কুফরী এবং এ ধরনের কাজের পরিণতিতে তারা আতঙ্কগ্রস্ত ও হয়রান হবে। কাফেরদের অনুসরণের ফলে তারা পরকালে জাহান্নামে যাবে অর্থাৎ কাফেরদের ওপর নির্ভরতা ইহকাল ও পরকালে উভয়জগতেই অকল্যাণের উৎস হবে।

এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো-

প্রথমত : আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো ওপর নির্ভর করা শির্ক এবং তা মানুষের মনে ভয় সৃষ্টির উৎস। কারণ,আল্লাহর ওপর বিশ্বাস ও আল্লাহর স্মরণ মানুষের মনে প্রশান্তি যোগায় এবং এর ফলে মানুষের আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি পায়।

দ্বিতীয়ত : মৃত্যুর ভয় এবং ভবিষ্যত সম্পর্কে নিরাপত্তাহীনতার আশঙ্কা এমন এক ত্রাস বা বিভীষিকা যা কাফেরদেরকে স্বপ্নে ও জাগরণে সবসময় তাড়িত করে বেড়ায়। মুমিনদের সংখ্যা যতই বৃদ্ধি পায় কাফেরদের মনে ত্রাস এবং আশঙ্কাও তত বাড়তে থাকে ।

সূরা আলে ইমরানের ১৫২ নম্বর আয়াতে আল্লাহপাক বলেছেন-

وَلَقَدْ صَدَقَكُمُ اللَّهُ وَعْدَهُ إِذْ تَحُسُّونَهُمْ بِإِذْنِهِ حَتَّى إِذَا فَشِلْتُمْ وَتَنَازَعْتُمْ فِي الْأَمْرِ وَعَصَيْتُمْ مِنْ بَعْدِ مَا أَرَاكُمْ مَا تُحِبُّونَ مِنْكُمْ مَنْ يُرِيدُ الدُّنْيَا وَمِنْكُمْ مَنْ يُرِيدُ الْآَخِرَةَ ثُمَّ صَرَفَكُمْ عَنْهُمْ لِيَبْتَلِيَكُمْ وَلَقَدْ عَفَا عَنْكُمْ وَاللَّهُ ذُو فَضْلٍ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ ((১৫২

"নিশ্চয়ই আল্লাহ (তোমাদের সাহায্যের ব্যাপারে) নিজ অঙ্গীকার পূর্ণ করেছিলেন,তাই তোমরা আল্লাহর ইচ্ছায় শত্রুদের নিধন করতে পারছিলে যতক্ষণ তোমরা সাহস হারাওনি এবং যুদ্ধের ব্যাপারে নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করনি। এরপর তোমরা যা ভালোবেসেছিলে আল্লাহ তা অর্থাৎ গণীমতের মাল এবং বিজয়) তোমাদের দেখিয়েছিলেন এবং তোমরা আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করেছিলে। (এই যুদ্ধে প্রমাণিত হয়েছে যে) তোমাদের মধ্যে কেউ কেউ ইহকালীন ভোগের প্রত্যাশী এবং কেউ কেউ পরকালের সুখ কামনা করে। এরপর আল্লাহ তোমাদের পরীক্ষার জন্য শত্রুদের পিছু নেয়া থেকে তোমাদের বিরত রাখেন। (ফলে তোমাদের জয় পরাজয়ে পরিণত হয়) যাতে তোমাদিগকে পরীক্ষা করেন। বস্তূত: তিনি তোমাদিগকে ক্ষমা করেছেন। আর আল্লাহ মুমিনদের প্রতি অনুগ্রহশীল।" (৩:১৫২)

ওহুদ যুদ্ধে পরাজয়ের পর একদল মুসলমান রাসূল (সা.)'র কাছে প্রতিবাদ জানিয়ে বলেন,আল্লাহ কি কাফেরদের ওপর মুসলমানদের বিজয়ী করার ওয়াদা দেননি ? যদি তাই হয়,তাহলে আমরা কেন পরাজিত হলাম? এই আয়াতে তাদের প্রশ্নের উত্তরে আল্লাহ বলছেন,আল্লাহর ওয়াদা ছিল সত্য এবং তিনি তার ওয়াদা পালনও করেছেন। আর এজন্যই তোমরা যুদ্ধের প্রথমদিকে আল্লাহর সাহায্য পেয়ে শত্রুদের হত্যা করতে করতে সক্ষম হচ্ছিলে। কিন্তু ৩টি কারণে তোমরা পরাজিত হয়েছ ।

প্রথমত : বিপুল সম্পদ রেখে শত্রুদের পালিয়ে যেতে দেখে তোমরা খুব দ্রুত যুদ্ধে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছিলে এবং শত্রুদের পিছু নেয়ার পরিবর্তে অস্ত্র গুটিয়ে গনীমতের মালামাল সংগ্রহে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলে

দ্বিতীয়ত : ওহুদ পাহাড়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ গিরিপথ পাহারা দেয়ার ব্যাপারে তোমরা নিজেদের মধ্যে মতবিরোধে লিপ্ত হয়েছিলে। রাসূল (সা.) ঐ গিরিপথের প্রহরা কখনও ত্যাগ না করার নির্দেশ দিয়েছিলেন কিন্তু রাসূল ( সা. ) এর নির্দেশ সত্ত্বেও তোমরা এ ব্যাপারে নিজেদের মতামতকে প্রাধান্য দিয়েছিলে এবং ঐ গিরিপথ ত্যাগ করেছিলে। ফলে শত্রুরা পেছন দিক থেকে হামলা চালিয়ে তোমাদের অপ্রস্তুত ও স্তম্ভিত করে দেয়। তাই আল্লাহ যুদ্ধের প্রথমদিকে তোমাদের সাহায্য করেছেন। কিন্তু শেষের দিকে তোমাদেরকে পরাজয়ের স্বাদ পেতে হয়েছে যাতে তোমরা বুঝতে পার আল্লাহর সাহায্য ঈমান ও ঐক্যের ওপর নির্ভরশীল। আর এই পরাজয় ছিল তোমাদের জন্যে এক চিরস্মরণীয় শিক্ষা ।

এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো,

প্রথমত : আল্লাহর সাহায্যের ওয়াদা ততক্ষণ পর্যন্ত কার্যকরী থাকে,যতক্ষণ বিশ্বাসীরা তাদের দায়িত্ব পালন করে। বিশ্বাসীরা তাদের দায়িত্ব পালন না করার কারণে যদি আল্লাহর সাহায্য বন্ধ হয়ে যায় তাহলে তাকে আল্লাহর পক্ষ থেকে দেওয়া প্রতিশ্রুতির লঙ্ঘন বলা যাবে না।

দ্বিতীয়ত : হতাশা,মতবিরোধ ও নেতার নির্দেশ অমান্য করা পরাজয়ের প্রধান কারণ। এক্ষেত্রে কাফের ও মুমিনদের মধ্যে পার্থক্য নেই।

তৃতীয়ত : অনেক মুসলমান নিজেদের ইহকালীন স্বার্থকেই প্রাধান্য দেন। এমনকি যুদ্ধের সময়ও তারা নিজেদের ইহকালীন স্বার্থের চিন্তায় মশগুল থাকেন।

চতুর্থত : পরাজয় খোদায়ী পরীক্ষার মাধ্যম। পরাজয়ে হতাশ না হয়ে ভবিষ্যতে বিজয়ী হবার শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে ।

সূরা আলে ইমরানের ১৫৩ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

إِذْ تُصْعِدُونَ وَلَا تَلْوُونَ عَلَى أَحَدٍ وَالرَّسُولُ يَدْعُوكُمْ فِي أُخْرَاكُمْ فَأَثَابَكُمْ غَمًّا بِغَمٍّ لِكَيْلَا تَحْزَنُوا عَلَى مَا فَاتَكُمْ وَلَا مَا أَصَابَكُمْ وَاللَّهُ خَبِيرٌ بِمَا تَعْمَلُونَ (১৫৩)

"স্মরণ কর যখন তোমরা ওহুদ যুদ্ধে পাহাড়ের উপরের দিকে পালাচ্ছিলে এবং পেছন ফিরে তাকাচ্ছিলে না। অথচ রাসূল ( সা. ) তোমাদেরকে পেছন থেকে আহবান করছিলেন। এরপর আল্লাহ এর শাস্তি হিসেবে তোমাদের দুঃখের ওপর দুঃখ বাড়িয়ে দিলেন। কিন্তু যা অতীত হয়েছে তোমরা গনীমতের যা কিছু হাতছাড়া করেছ সেজন্যে দুঃখ করো,তোমরা যা করছ আল্লাহ তা জানেন।" (৩:১৫৩)

যুদ্ধে পেছন দিক থেকে শত্রুদের আকস্মিক হামলার ফলে বহু মুসলমান রাসূল (সা.) কে একা ফেলে পালিয়ে গিয়েছিল। এ বিশ্রী অবস্থায় রাসূল (সা.) তাদেরকে রুখে দাঁড়ানোর জন্য বার বার আহবান করা সত্ত্বেও তারা পেছনের দিকে ফিরে তাকানোরও দরকার মনে করেনি বরং তারা ওহুদ পাহাড়ের দিকে উঠে যেতে থাকে। তাই পবিত্র কোরআনের এই আয়াতে আল্লাহ বলছেন রাসূল (সা.)'র নির্দেশ অমান্য করা এবং পালিয়ে যাবার ফলেই শত্রু সেনারা তোমাদের ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে। এ অবস্থায় তোমাদের দুঃখ ও গ্লানি এত বৃদ্ধি পেল যে,তোমরা গনিমতের সম্পদ হারানো এবং আহত হবার দুঃখ-বেদনাও ভুলে গেলে। তোমরা রাসূলের মনে যে রকম দুঃখ দিয়েছিলে,নিজেরাও সে রকম বড় দুঃখ পেলে।

এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো,

প্রথমত : ধর্মীয় নেতার নির্দেশ অমান্য করার পরিণতি হলো ত্রাস,পলায়ন করা এবং শত্রুদের হাতে পরাজিত হওয়া।

দ্বিতীয়ত : যুদ্ধের ময়দান হলো ঈমানের দাবিদারদের পরীক্ষাক্ষেত্র। স্বাভাবিক অবস্থায় বহু মানুষই ঈমানদার হবার দাবি করতে পারে। কিন্তু সংকট ও দুর্যোগের তিক্ত অবস্থায় প্রকৃত মুমিনকে চেনা যায় ।

তৃতীয়ত : অতীতের তিক্ততা থেকে শিক্ষা নেয়া উচিত। দুনিয়ার সম্পদ হারানোর জন্য বা বিপদ ও দুর্যোগের স্বাদ নেয়ার জন্য দুঃখ করা উচিত নয় ।